এই অঞ্চলের অন্যতম দ্রষ্টব্য বলা যায় ভিক্টোরিয়াকে। তাকে দেখলে কষ্টিপাথরে গড়া একটি অপূর্ব ভাস্কর্য বলেই ভুল হয় সকলের।
পাশেই নিদ্রিত ছিল ভিক্টোরিয়ার সঙ্গী। কোঁকড়ানো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে সে তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলল।
-এই, ওঠ শিগগির
–কি হল, এখনও রাত শেষ হয়নি।
ঘুমজড়ানো গলায় বিশালদেহী পুরুষটি বলে উঠল। তার সাদা দাঁতের সারি যেন অন্ধকারেই ঝিকিয়ে উঠল।
-কি বলছিস?
–যে মেজর লোকটা মারা গেছে–সেই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না। কোথাও একটা যেন গোলমাল আছে।
-বুড়ো মারা গেছে–এ নিয়ে তুই অত ভাবছিস কেন?
–পিলগুলোর কথা যে ভুলতে পারছি না।
–বেশি করে খেয়ে ফেলেছিলেন হয়তো।
ভিক্টোরিয়া রীতিমত হাঁপাচ্ছিল। সে কাছে এগিয়ে এসে বলল, শোন, সকাল হলেই আমি মিসেস কেণ্ডালকে বলব। নির্ঘাৎ কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে।
লোকটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি ভিক্টোরিয়ার। তবু তারা দুজনে স্বামীস্ত্রী হয়ে আছে। সে হাই তুলে বলল, বোকার মত গণ্ডগোল ডেকে আনিস না। এখন ঘুমো।
দুজনে আবার পাশাপাশি শুয়ে পড়ল।
.
০৭.
হোটেলের সামনে বেলাভূমিতে বেলা এগারোটার মধ্যেই বেশ ভিড় জমে ওঠে। সামাজিক মেলামেশায় জায়গাটা জমজমাট হয়ে ওঠে।
ইভিলিন হিলিংডন জল ছেড়ে তীরে উঠে স্নানের টুপি খুলে বালির ওপরে বসে পড়ল।
ইভিলিনের ডান পাশেই একটা চেয়ারে বসেছিলেন সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরো। তিনি ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছেন।
খানিক তফাতেই হুইলচেয়ারে বসেছিলেন অর্থবান ব্যক্তি মিঃ র্যাফায়েল। আপাতত তিনিই হোটেলের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার দেখাশোনার জন্য পাশেই উপস্থিত রয়েছে এসথার ওয়াল্টার্স।
মিস মারপলও একপাশে বসে পশম বুনে চলেছেন। তার কান ছিল বাইরের কথাবার্তার দিকে। তবে প্রয়োজনে দু-একটা মন্তব্যও যে করছিলেন না তা নয়।
ইভিলিন হিলিংডন মাঝে মাঝে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছিল মিস মারপলের দিকে।
একসময় ইভিলিনকে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, এমন একটা চমৎকার জায়গায় আসব আগে কখনো ভাবিনি। এখানে তো আপনি আগেও এসেছেন, তাই না মিসেস হিলিংডন।
–বার দুয়েক এসেছিলাম।
নিশ্চয়ই প্রজাপতি আর ফুলের নেশায়? সঙ্গে আপনার বন্ধুরাও ছিলেন নিশ্চয়ই?
–হ্যাঁ, স্রেফ বন্ধু। কয়েক বছর একসঙ্গেই ঘোরাঘুরি করছি।
এভাবে শুরু করা কথা একসময় মেজর প্যালগ্রেভের প্রসঙ্গে চলে এলো। দেখা গেল তার ব্লাডপ্রেসার সম্পর্কে দুরকম ধারণা প্রচারিত। হা এবং না।
মিঃ র্যাফায়েল তো জোর দিয়েই বললেন, তিনি নিজে আমাকে বলেছিলেন ওরকম কোন অসুবিধা তার ছিল না। বয়স অনুপাতে তার রক্তচাপ খুবই ভাল ছিল।
মিস মারপল বললেন, শুনেছি তিনি সেরেনাইট না কি-একটা ওষুধ খেতেন।
মিঃ র্যাফায়েল বললেন, প্রত্যেকেরই নিজের রোগভোগের বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত।
বেলা বারোটা বেজে গিয়েছিল। মিসেস এসথার ওয়ালটার্সের সাহায্য নিয়ে মিঃ র্যাফায়েল উঠে দাঁড়ালেন। তার স্নানের সময় হয়ে গিয়েছিল। দুজনে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হলেন।
সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরোকে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, মিসেস ডাইসন কোথায়। তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
–সেই। লাকি নিশ্চয় অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও। সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরো উত্তর করলেন।
-তাই বুঝি?
–ওর স্বভাবই ওই। ওর স্বামীরও নজর অন্য দিকে। মেয়ে দেখলেই ছোঁকছোঁক করে।
–হ্যাঁ, আপনার পক্ষে জানা সম্ভব।
.
অফিস ঘরে বসেছিল একা মিসেস কেণ্ডাল। হঠাৎ ধবধবে সাদা পোশাকে সজ্জিতা ভিক্টোরিয়া জনসন ঘরে প্রবেশ করল এবং অত্যন্ত সঙ্গোপন ভঙ্গীতে জানালো, ডাক্তারের কথায় ঘরে কি কি আছে দেখতে গিয়ে সে পরলোকগত মেজরের বাথরুমে তাকের ওপরে। দাঁতের মাজন, হজমের ওষুধ, অ্যাসপিরিনের সঙ্গে একটা পিলের শিশিও পেয়েছিল। সেরেনাইট। আগে কিন্তু সে এই শিশিটা সেখানে দেখেনি। তার সন্দেহ, কেউ গোপনে পিলগুলো সেখানে রেখেছিল আর সেগুলো খেয়ে মেজর মারা গেলেন।
মলি ভিক্টোরিয়ার কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরে তীক্ষ্ণস্বরে বলল, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি, তোমাকে ওসব ভাবতে হবে না। দয়া করে এধরনের বাজে গুজব ছড়িয়ে বেড়িয়ো না। তাতে আমাদের হোটেলের ক্ষতি হবে।
ভিক্টোরিয়া চলে গেলে মলি চিন্তিতভাবে কথাটা টিমকে জানালো। কিন্তু সে ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। তবে বলল ডাঃ গ্রাহামের কাছে গেলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার জানা যাবে।
রোজ ঘর সাফাই করত বলে ঘরে জিনিসপত্র কোথায় কোনটা আছে ভিক্টোরিয়ার মনে গেঁথে গিয়েছিল। মেজরের মারা যাবার পরদিনের আগে সে বাথরুমের তাকে সেরেনাইটের শিশি কখনো দেখেনি। তার বিশ্বাস নিশ্চয়ই কেউ বিষের বড়ির শিশি সেখানে রেখে গিয়েছিল।
কেণ্ডাল দম্পতি এসবকথাই ডাঃ গ্রাহামকে জানান। তিনি ব্যাপারটা যাচাই করবার জন্য তখনই ভিক্টোরিয়াকে ডেকে পাঠালেন।
ভিক্টোরিয়া এসে বেশ জোরের সঙ্গেই একই কথা শোনালো ডাক্তারকে। ব্যাপারটা একেবারে যেন তার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
ডাক্তার বললেন, ওটা বিষ নয় মেয়ে, খুব ভাল আর দরকারী ওষুধ। অসুখ থাকলে ওই ওষুধ মানুষকে খেতে হয়। তুমি মিছেই ভেবে হয়রান হচ্ছ।
উঃ বাঁচালেন আপনি আমাকে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল ভিক্টোরিয়া। স্থানীয় মেয়েটি চলে গেলে ডাক্তার গ্রাহামের মনে রাতের অস্বস্তিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার মনের চাপটা যেন হঠাৎই বেড়ে গেল।