ছবিটা তার মৃত্যুর পরেও ব্যাগেই থাকা উচিত ছিল। টাকা চুরি হতে পারে, কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্য না থাকলে কোন ফটো কেউ চুরি করবে না।
যত চিন্তার গভীরে প্রবেশ করছিলেন, মিস মারপলের মুখ ততই গম্ভীর হচ্ছিল। একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে। রহস্যের গন্ধ নাকে লেগেছে।
একেবারেই আকস্মিকভাবে মৃত্যুটা ঘটেছে, ডাক্তারদের মত অত সরলভাবে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। _ যদি মেজর অসুস্থ বোধ করেই থাকেন, উচ্চ রক্তচাপের ট্যাবলেট তো তার ঘরেই ছিল–সেটা কেন খাননি?
আর যদি রক্তচাপের ব্যাপারটা বানানো হয় আর মেজরের পকেট থেকে ছবিটা সরিয়ে ফেলে থাকে কেউ; তবে নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তির পক্ষেই ওষুধের শিশি তার ঘরে রেখে দেওয়া সম্ভব।
তবে মিস মারপল নিজে কখনো মেজরকে ওষুধ খেতে দেখেননি। উচ্চ রক্তচাপের কথাও কখনো তিনি বলেননি।
তবে তার মনে পড়ছে, মেজরের উচ্চ রক্তচাপের কথাটা কেউ যেন তাকে শুনিয়েছিল। কিন্তু কে বলেছিল মনে করতে পারছেন না।
মিস মারপল ধীরে ধীরে একেবারে গোড়ায় ফিরে গেলেন। খুন আর খুনীদের নিয়ে মেজর যে গল্প করেছিলেন সেটাই পর্যালোচনা করতে শুরু করলেন।
.
০৬.
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মিস মারপল সিদ্ধান্ত নিলেন, খুনের ঘটনার সন্দেহ নিরসন করবার জন্য খোঁজখবর নেবেন তিনি।
এতে হয়তো উপযাচক হয়ে তাকে একটু বেশিই কথা বলতে হবে। তবে বৃদ্ধাদের বেশি কথা বলাটা সকলেই প্রায় মেনে নেয়। সেই সুযোগই নিতে হবে।
কথাবার্তা আলোচনা চালিয়ে তাকে কিছু মানুষ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। মিস মারপলের চিন্তা ঘিরে এমনি কয়জন মানুষের মুখ পর্যায়ক্রমে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
মেজর যদি খুন হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি তার জীবনের কোন গোপন রহস্যের জন্য কিংবা অর্থের জন্য অথবা প্রতিশোধের জন্য খুন হননি।
মিস মারপলের ধারণা মেজর বেশি কথা বলতেন, অনেক কথা সকলকে জানাতেন,এটাই খুনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
ডাঃ গ্রাহামের কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর জানতে পেরেছেন তিনি। নিজেরই বেশ কিছু ছবি–পোলো খেলার পোশাকের, বাঘ শিকারীর পোশাকের এমনি ধরনের, মেজরের ওয়ালেটে ছিল। এসব ছবি রেখে দেয়ার কি কোন উদ্দেশ্য ছিল? মেজর হয়তো ওসব ছবি দেখিয়ে ঘটনার বর্ণনা শুনিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন…সন্দেহভাজন খুনী হয়তো তাতেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ভবিষ্যতে তার ফটো দেখিয়েও কোন কাহিনীর জন্ম নেবার সম্ভাবনা ছিল।
মিস মারপলের মনে পড়ল, খুনের ঘটনার প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই পকেট থেকে ব্যাগ বার করে মেজর বলেছিলেন, লোকটাকে দেখে খুনী বলে মনে হয় কিনা বলুন তো।
তিনি বুঝতে পারছেন, এভাবে সকলকে বলে বেড়ানো তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। খুনীর কাহিনীর সঙ্গে অনিবার্য ভাবে ছবিটাও নিশ্চয় প্রদর্শিত হত। খুনের গল্প বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বলতে লক্ষ্য করেছেন তিনি।
সম্ভবতঃ এখানে এ গল্প নিশ্চয় তিনি আগেও কাউকে শুনিয়ে থাকবেন। হয়তো কয়েকজনকেই তাহলে কাহিনীর বর্ণনার সঙ্গে ছবির খুনীরও একটা চেহারার আভাস কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে।
হ্যাঁ, এটাই ঠিক পথ। ভাবলেন মিস পারপল। এভাবেই শুরু করবেন তিনি।
তার মনের সন্দেহভাজন। ব্যক্তিদের কথা মনে করতে গিয়ে মিস মারপলের স্মরণে এল মেজর যেভাবে খুনীর বর্ণনা করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় সে একজন পুরুষ। কিন্তু এখানে পুরুষ দুজন। কর্নেল হিলিংডন এবং মিঃ ডাইসন।
আপাতদৃষ্টিতে এদের কাউকেই খুনী ভাবা যায় না। তবে বাইরের চেহারাটাই তো মানুষের সব নয়। কিন্তু আর কেউ কি থাকা সম্ভব?
আশপাশে তো সেই মুহূর্তে মাথা ঘুরিয়ে আর কাউকে চোখে পড়েনি। কেবল মিঃ র্যাফায়েলের বাংলোটা চোখে পড়েছিল।
কেউ বাংলো থেকে বেরিয়ে এসে আবার ভেতরে চলে যায়নি তো?
মিস মারপল ভাবলেন, যদি সত্যি এমন হয়, তাহলে নির্ঘাৎ সেই লোক ধনকুবেরের সেই সঙ্গী-জ্যাকসন। ছবির বিষয়ের মতই কি সে-ও দরজা দিয়ে বাইরে আসছে? আর সেই সময়েই নজরে পড়ে গিয়েছিল মেজরের? এবং তিনি চিনতে পেরেছিলেন?
দেখাবার জন্য ফটোটা হাতে নিয়ে মেজর মিস মারপলের ডান কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন…তখনই কি তিনি দরজা দিয়ে ছবির সেই খুনীকে বাইরে আসতে দেখে সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন?
রাতে শুতে যাবার আগে মিস মারপল তার আগামীকালের কাজের তালিকা করলেন এভাবে–হিলিংডনদের, ডাইসনদের আর আর্থার জ্যাকসন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে।
.
মাঝরাতে ডাঃ গ্রাহামের বরাবরই ঘুম ভেঙ্গে যায়। পরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।
আজ রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করলেন তিনি। অস্বস্তিটা কি কারণে ঠিক বুঝতে পারলেন না। কিন্তু এমন উদ্বেগের ভাব বহুকাল তার হয়নি।
সহসা তার মনে হল, মেজরের মৃত্যু সম্পর্কে সব কি ঠিকঠাক আছে? কিন্তু তিনি তো ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন।
মেজরের ঘরে সেরেনাইট ট্যাবলেটের শিশি পাওয়া গিয়েছিল। আর মেজর নিজেও তার ব্লাডপ্রেসারের কথা সবাইকে বলেছিলেন।
না, মেজরের মৃত্যুর মধ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন ডাঃ গ্রাহাম।
.
জায়গাটা হোটেলের চৌহদ্দির বাইরে খাড়ির পাশে। এখানে এলোমেলো ভাবে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কিছু কুটির। তাদেরই একটির ভেতরে নিজের বিছানায় উঠে বসেছে ভিক্টোরিয়া জনসন।