মিস মারপল নিজের মনে লজ্জিত বোধ করছিলেন। মিথ্যা কথা বলে ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন বলে। এছাড়া আর কিই বা তাঁর করার ছিল।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সত্যবাদী এবং সত্যকে শ্রদ্ধা করার মানুষ। কিন্তু দরকারে নির্বিচারে মিথ্যার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেন না।
একসময় তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন। সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ডাঃ গ্রাহাম, আপনাকে আর একটা কথা বলতে চাইছিলাম। মেজর প্যালগ্রেভকে নিয়ে। সকালে তার মৃত্যু সংবাদটা পেয়ে খুবই আঘাত পাই।
–হ্যাঁ। এমন হাসিখুশি মানুষটা…
–গতকালই তিনি দুনিয়ার নানা অঞ্চলের গল্প শোনাচ্ছিলেন।
–গল্প করার সুযোগ পেলে বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠতেন। অনেকেই বিরক্ত বোধ করত অবশ্য।
–মেজর তার ছেলেবেলার কথা শুনিয়েছিলেন, মিস মারপল অকম্পিত গলায় বলতে লাগলেন, সেই সময় আমি আমার এক ভাইপোর ছবি তাঁকে দেখাই। আমার কাছে সে চিরকালই খুব আদরের।
উনি যখন ছবিটা দেখছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই ওই যে ফুল আর প্রজাপতি সংগ্রহ করেন..কর্নেল আর মিসেস হিলিংডন…ওরা উপস্থিত হন।
মেজর তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কভাবে ছবিটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেন। সেই সময় আর তাকে বিরক্ত করতে চাইনি। ভেবেছিলাম সকালে চেয়ে নেব। কিন্তু সকালেই তো…
কথা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস মারপল।
ডাঃ গ্রাহাম সহানুভূতির স্বরে বললেন, সেই ছবিটা আপনি ফেরত চাইছেন, এই তত?
সঙ্কোচের সঙ্গে মিস মারপল বললেন, আমার ভাইপো, প্রিয় ডেনজিল পাঁচবছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
খুবই বিব্রত বোধ করছি আপনাকে বলতে–মেজরের জিনিসপত্র কে দেখাশোনা করছে জানি না তো তাই আপনাকে
-আমি বুঝতে পারছি। কাল অন্ত্যেষ্টি হবে। তার জিনিসপত্রের ব্যাপারটা কালই দেখা হবে–আচ্ছা, ফটোটার একটু বর্ণনা যদি দেন সুবিধা হয়।
মিস মারপল সহজ গলায় বললেন, ছবিটা তুলেছিল আমার আর এক ভাইপো। হিবিসকাস বা লিলিজাতীয় কোন ফুলের ছবি তুলছিল, সেই সময় ডেনজিল দরজা দিয়ে বেরচ্ছিল। খুব ভাল ওঠেনি যদিও, কিন্তু ওই ছবি দেখেই আমি তার স্মৃতিচারণ করি।
–মনে হচ্ছে ছবিটা আপনাকে ফিরিয়ে দিতে কোনো অসুবিধা হবে না।
বলে ডাঃ গ্রাহাম উঠে দাঁড়ালেন।
মিস মারপল তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন।
.
০৫.
যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গেই পরলোকগত মেজর প্যালগ্রেভের অন্ত্যেস্টিক্রয়া সম্পন্ন হল পরদিন। কিন্তু এই স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা এখানকার সামাজিক আনন্দের জীবনে কোন দাগ কাটতে পারল না। যেন খুব তাড়াতাড়িই সকলে ভুলে গেল।
মেজরকে অবশ্য তেমন করে কেউই চিনতেন না এখানে। নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু অন্যেরা শুনতে চাইতেন না।
বহুবছর আগেই স্ত্রী গত হয়েছিল তার। নিঃসঙ্গ জীবন অতীত দিনের গল্প আর হাসিখুশিতে ভরিয়ে রাখতে চাইতেন।
একসপ্তাহ পরে হয়তো কেউ আর তাকে মনেও করবে না।
মিস মারপল কিন্তু এত সহজে ভুলতে পারলেন না মেজরের কথা। এতে অবশ্য ব্যক্তিগত কোন আকর্ষণের ব্যাপার নেই। আলাপচারিতার মাধ্যমেই দুজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে একটা মানবিক আবেদনের সূত্র তৈরি হয়েছিল।
মেজরের দুঃখজনক আকস্মিক মৃত্যুর জন্য তিনি শোকসন্তপ্ত না হলেও তার অভাব বেশ বোধ করছেন।
অন্ত্যেষ্টির দিন বিকেলে মিস মারপল যথারীতি তার পছন্দের জায়গায় বসে উল বুনছিলেন। ডাঃ গ্রাহাম এসে তার সঙ্গে মিলিত হলেন। পরে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে জানালেন, মিস মারপলের মূল্যবান ফটোটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হতাশকণ্ঠে মিস মারপল বললেন, কি আর করা যাবে। কিন্তু ছবিটা মেজর প্যালগ্রেভের ব্যাগেই তো ছিল।
পকেট, অন্যান্য জিনিসপত্র, সবই খুঁজে দেখা হয়েছে। কয়েকটা চিঠি, খবরের কাগজের টুকরোটাকরার সঙ্গে আরো কয়েকটা ফটোও ছিল। কিন্তু আপনি যেমন বলেছেন তেমন কোন ফটো ছিল না।
দুর্ভাগ্য। আপনি যথেষ্ট করেছেন ডাঃ গ্রাহাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
কথা শেষ করে একমুহূর্ত থামলেন মিস মারপল। পরে বললেন, বাড়ির বাইরে এমনভাবে মৃত্যু হওয়াটা খুবই দুঃখজনক। ফুসফুসের কোন দোষ ছিল নিশ্চয়ই
-তা মনে হয় না, বললেন ডাঃ গ্রাহাম, মনে হয় উচ্চ রক্তচাপে ভুগতেন।
–এসব ক্ষেত্রে অবশ্য মৃত্যু ঘটা স্বাভাবিক। তবে রোগের কথা তো কখনো বলতে শুনিনি।
-তার চিকিৎসা আগে আমি কখনো করিনি। ব্লাড প্রেসারও নিইনি। তবে ব্লাড প্রেসারে অ্যালকোহল খুবই ক্ষতিকর।
–এজন্য তো শুনেছি ট্যাবলেট খেতে হয়।
–হ্যাঁ। ওর ঘরেও সেরেনাইটের একটা শিশি ছিল।
-আজকাল বিজ্ঞান নানা দিকেই কত উন্নতি করেছে। আচ্ছা, বলছেন মেজরের পকেটে কোন ছবি ছিল না।
–আপনার বর্ণনা মত আপনার ভাইপোর ছবি ছিল না। মেজরের নিজের কিছু ছবি ছিল।
এরপর মিস মারপলের হাঁটুর খোঁজখবর নিয়ে ডাঃ গ্রাহাম বিদায় নেন।
মিস মারপলের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ পড়ে তিনি উদাস ভাবে পাম সারি আর সুনীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
একটা সন্দেহের নিরসন হয়েছে। এবারে যা জেনেছেন তা নিয়ে তাঁকে ভাবতে হবে। তার সামনেই ছবিটা মেজর পকেটব্যাগে রেখেছিলেন। অথচ তার মৃত্যুর পর সেই ছবিটাই পাওয়া গেল না।
যে ছবি এত যত্ন করে রেখে দিয়েছেন, মেজর যে সেটা ফেলে দিতে পারেন না তা সহজেই অনুমান করা চলে।