ক্রমে সকলেই আলাদা দল করে হলঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল। হিলিংডন-ডাইসন চারজনের দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মেজর প্যালগ্রেভ।
মিস মারপল সেই দিকে ইঙ্গিত করে তাদের সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করলেন।
ক্যানন প্রেসকট জানালেন, প্রতিবছরই তারা ওয়েস্ট ইণ্ডিজে নানা দ্বীপে ঘুরে তিনমাস কাটিয়ে যান। এখানে গত বছরও এসেছিলেন।
লম্বা লোকটি হলেন হিলিংডন, তারা স্বামী-স্ত্রী উদ্ভিদবিদ। অন্য দুজন হলেন আমেরিকান মিঃ ও মিসেস ডাইসন। ভদ্রমহিলা প্রজাপতির ওপরে লেখালেখি করে থাকেন। পাখির বিষয়েও সকলে উৎসাহী।
এই টেবিলে যাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তাদের দিক থেকে স্টীল ব্যাণ্ডেল শব্দ ছাপিয়ে হাসির শব্দ ভেসে আসছিল।
সেদিকে তাকিয়ে মিস মারপল বললেন, মানুষের পরিচয় জানাটা বেশ আনন্দের।
–এবং মজার। গতবছর আমি ওদের দেখে তো ভেবে নিয়েছিলাম মিসেস ডাইসনই বুঝি মিসেস হিলিংডন। পরে ভুল ভেঙ্গেছিল।
মিস মারপল বললেন, মিঃ ডাইসন তার স্ত্রীকে ডাকেন লাকি বলে। ওটা কি তার ডাকনাম?
মিঃ ক্যানন বললেন, স্ত্রীর দৌলতে ভাগ্য ফিরেছিল বলে মিঃ ডাইসন ওই নামে ডাকেন বলে শুনেছি।
এমনি একে একে অন্যান্য সকলের সম্পর্কেই নানা কথা জানা হয়ে গেল মিস মারপলের।
একসময় মিঃ র্যাফায়েলের টেবিলে দৃষ্টি পড়ল তার। অবিশ্বাস্য ধনী এই লোকটিকে জরাগ্রস্ত শিকারী পাখি বলে মনে হল তার।
শরীর অত্যন্ত কৃশ। তবে দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ। খুবই খিটখিটে মেজাজের হলেও লোকে মানিয়ে নেয় তিনি ধনী বলে। ব্যক্তিত্ব অসাধারণ।
ভদ্রলোকের ভ্যালে সঙ্গী সুদর্শন দীর্ঘাকৃতি মিঃ জ্যাকসন দাঁড়িয়ে আছেন পাশে।
.
০৩.
শয্যায় বসেই প্রাতরাশ সারলেন মিস মারপল। চা, সেদ্ধ ডিম আর এক টুকরো পেঁপে।
প্রাতঃরাশ শেষ হলে অভ্যাস মত হোটেলের পথ ধরে এগোলেন। পথেই দেখা হয়ে গেল মলি কেণ্ডেলের সঙ্গে। তার চোখেমুখে কেমন একটা বিপর্যন্ত ভাব।
উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি জানতে চাইলেন, কি হল? অমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন?
মলি বিমর্ষভাবে জবাব দিল, খুবই দুঃসংবাদ। সকলেই জানছেন একে একে–মেজর প্যালগ্রেড পরা গেছেন।
-সেকি, কখন? গতকালও তাকে বেশ হাসিখুশি দেখেছি। বিস্মিত হলেন মিস মারপল।
–গত রাত্রিতে আকস্মিকভাবেই মৃত্যুটা হয়েছে। তিনি রক্তচাপের রোগী ছিলেন।
–কিন্তু আজকাল তো এ রোগের যথেষ্ট ভাল ওষুধ আছে।
–তা আছে। সেটা খেতেই হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন।
–ডাক্তার কি বলছেন? উদ্বিগ্ন ভাবে জানতে চাইলেন মিস মারপল।
-অবসর নেবার পর থেকে ডাঃ গ্রাহাম তো হোটেলেই থাকেন। তিনি দেখেছেন, স্থানীয় ডাক্তারও দেখেছেন। তারাই ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। তাদের অভিমত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এরকম হতে পারে। তার ওপর গতরাত্রে মদের পরিমাণটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল।
একটু থেমে মলি আবার বলল, কিন্তু আমাদের কাছে ঘটনাটা মস্ত বড় আঘাত। হোটেলের খাবার সম্বন্ধে লোকের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে।
–কিন্তু চলতে চলতে বললেন মিস মারপল। তার মনে পড়ল, গতকালই হিলিংডন আর ডাইসনদের সঙ্গে বেশ হাসিখুশি মেজাজে ছিলেন। কথাটা মনে হতেই তিনি গতি পাল্টে সমুদ্রতীরে না গিয়ে বারান্দার ছায়ায় এসে বসলেন।
হাতের উলের কাটা খুব দ্রুত চলছিল। আকস্মিক দুঃসংবাদটা তাকে খুবই ছন্দহারা করে তুলেছিল।
গতকালই মেজর প্যালগ্রেভ কেনিয়ার কথা, ভারতের কথা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত তারপর খুনের ঘটনা অনেককিছুই সোৎসাহে শুনিয়েছিলেন।
পশমের গুলি পড়ে গেলে মেজর তা তুলে দিয়ে সেই খুনীর ফটোর কথাটা বলেছিলেন।
তেমন আগ্রহ নিয়ে তখন শুনতে চাননি তিনি…কোন ক্লাবে তার ডাক্তার বন্ধু শুনেছিলেন তার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে। একজন ডাক্তার ছবি তুলেছিলেন সেই খুনী যখন সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল।
বিশেষ করে এই ঘটনাটাই ঘুরেফিরে মনে আসতে লাগল মিস মারপলের। ফটোটা দেখাবেন বলে মেজর পকেটব্যাগ বার করেছিলেন। সেই মুহূর্তেই তিনি পদশব্দ লক্ষ্য করে তাকিয়েছিলেন।
তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, সেই সময় মুখ লাল হয়ে উঠেছিল মেজরের। কেমন কাঁপা হাতে আচমকা সব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। অস্বাভাবিক ভাবে হাতির দাঁতের গল্প শুরু করেছিলেন।
কয়েক মুহূর্ত পরেই হিলিংডন আর ডাইসনরা তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। সেই সময় ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে মিস মারপল তাকিয়েছিলেন। কাউকে দেখতে পাননি। কেবল একটু দূরে হোটেলের দিকে টিম কেণ্ডাল আর তার স্ত্রীকে চোখে পড়েছিল।
মেজর প্যালগ্রেভ সেদিকে অবশ্য তাকাননি।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা নিয়ে মধ্যাহ্নভোেজ পর্যন্ত চিন্তায় ডুবে রইলেন মিস মারপল। বিকেলেও বেড়াতে বেরলেন না। কি মনে করে ডাঃ গ্রাহামকে তার শরীর ভাল লাগছে না বলে একটা চিরকূট পাঠালেন।
.
০৪.
ওয়েস্ট ইণ্ডিজে দীর্ঘদিন ডাক্তারী করার পর অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন ডাঃ গ্রাহাম। বয়স এখন পঁয়ষট্টির কোঠায়। বেশ সদাশয় মানুষ।
চিরকূট পেয়েই তিনি উপস্থিত হলেন এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে মিস মারপলের শরীরের অসুবিধার কথা জানতে চাইলেন।
হাঁটুর ঝামেলা মিস মারপলের নিত্যসঙ্গী। সেই কথাটাই তিনি জানালেন।
ডাক্তার যথারীতি ওষুধের কথা লিখে দিলেন। পরে মিস মারপলের একাকীত্বের কথা ভেবে কথা বলতে লাগলেন।