রবিনসনদের সদর দরজার সামনে একটা দুর্লভ হিবিসকাস গাছ দেখতে পেয়ে একটা ছবি তুলে নেয়। ঠিক যেই মুহূর্তে সাটার টেপে তখনই মহিলার স্বামী সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। ক্যামেরায় সে-ও ধরা পড়ে গেল। অবশ্য ছবিটা একটু ফোকাসের বাইরে চলে গিয়েছিল।
মেজর বললেন, সেই ছবির একটা কপি আপনাকে আমি দেখাতে পারি–ডাক্তার বন্ধু নিছক আমার কৌতূহল মেটাবার জন্য দিয়ে দেন। ছবিতে ধরা পড়া সেই লোকটি এমন এক খুনের আসামী যে ঘটনার রহস্য আজও সমাধান হয়নি। খুনী নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মেজর প্যালগ্রেভ তার ব্যাগ বের করে হাজারো জিনিসের মধ্যে ফটোর খোঁজ করতে লাগলেন।
মিস মারপল বুঝতে পেরেছিলেন, মেজর তার গল্পে যথেষ্ট রঙ চড়াতে অভ্যস্ত। এধরনের লোকেরা যতবার গল্প শোনায় ততবারই তাতে নতুন করে পলেস্তারা পড়ে।
–সব ঘটনা প্রায় ভুলেই গেছি। মহিলা বেশ সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু কোথায় যেন–এই তো–বলতে বলতে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ফটো টেনে বার করলেন।
–একজন খুনীর ছবি এটা।
ছবিটা মিস মারপলের হাত চালান করবার মুহূর্তে পায়ের শব্দ পেয়ে মিস মারপলের ডান কাঁধের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ফেললেন তিনি।
-যাচ্ছেতাই, গোল্লায় যাক।
বিরক্ত হয়ে হাত গুটিয়ে নিলেন মেজর। সবকিছু আবার মানিব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন। এবং প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পাল্টে হাতির দাঁতের গল্প করতে শুরু করলেন। পরক্ষণেই বলে উঠলেন–হ্যালো
মেজরের কণ্ঠ কেমন কৃত্রিম বলে বোধ হতে লাগল মিস মারপলের।
এগিয়ে আসা পদশব্দের দিকে তাকিয়ে মেজর বললেন, দেখুন কারা এসেছেন–বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ–পুষ্প ও প্রাণীসংগ্রাহক।
মিস মারপল এগিয়ে আসা চার অতিথিকে আগেই দেখেছিলেন। বিরাট চেহারার একঝাঁক খাড়া ধূসর চুলের মানুষটির নাম গ্রেগ ডাইসন আর স্বর্ণকেশী স্ত্রীলোকটি তার স্ত্রী লাকি ডাইসন।
অন্য দম্পতির একজন কৃশ চেহারার মানুষ। তিনি কর্নেল এডওয়ার্ড হিলিংডন আর তার স্ত্রী ইভিলিন হিলিংডন।
প্রথম দম্পতি প্রকৃতিবিদ, দ্বিতীয় পাখি সম্পর্কে খুব আগ্রহী।
মেজর মিস মারপলের সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দিলেন। সকলেই তাঁকে শুভেচ্ছা জানালেন।
ইভিলিন হিলিংডন মিস মারপলের পাশে বসে তার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলেন। মিস মারপল ঘাড়ের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। তবু আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তার চোখে পড়ল বেশ একটু দূরে ধনকুবের মিঃ র্যাফায়েলের বিরাট বাংলোটা কিন্তু মানুষজন কাউকে দেখা গেল না সেখানে।
ইভিলিনের গল্প শুনতে শুনতে মিস মারপল অন্যমনস্ক ভাবে হলেও যথাযথ সায় দিয়ে যাচ্ছিলেন। পুরুষ দুজনকে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিল তাঁর চোখ।
এডওয়ার্ড হিলিংডন শান্ত সুদর্শন। বেশ ভালমানুষ বলেই মনে হয়।
আর গ্রেগ ডাইসনের বিরাট চেহারা। বেশ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল।
এর পরে মেজরের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি।
.
০২.
গোল্ডেন পাম হোটেলের সন্ধ্যা।
কোণের দিকে একটা চেয়ারে বসেছিলেন মিস মারপল। প্রকাণ্ড ডাইনিং রুমটার তিনদিক খোলা। ভেতরে হাওয়ায় ভাসছিল বেশ মিষ্টি গন্ধ। টেবিলে টেবিলে ছড়িয়ে পড়েছে হালকা রঙীন আলো।
আনন্দমুখর এই সন্ধ্যায় বেশির ভাগ মহিলারই দেহে রঙিন সান্ধ্য পোশাক। হলের আলোয় প্রকট হয়ে উঠেছে তাদের বাদামী কাঁধ আর পেলব হাত।
নানা বয়সের মানুষ চারপাশে। প্রৌঢ় ধনীদের দেখে বোঝা যাচ্ছিল তাদের সঙ্গিনীরা তৃতীয় বা চতুর্থ ঘরণী।
মধ্যবয়স্ক অনেক দম্পতি এসেছিল উত্তর ইংলণ্ড থেকে। সন্তানসহ হাসিখুশি এক দম্পতি এসেছে কারাকাস থেকে।
দক্ষিণ আমেরিকার নানা রাজ্যের মানুষও কিছু কম ছিল না। সকলের মুখের নানা ভাষার শব্দ মিলেমিশে এক বিচিত্র গুঞ্জনধ্বনি তৈরি হয়েছে হলে।
আরো ছিলেন দুই ইংরাজ যাজক। একজন ডাক্তার আর একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। একপাশে এক চীনা পরিবারকেও চোখে পড়ছিল।
দীর্ঘাঙ্গী কালো স্থানীয় যুবতীরা নিপুণ হাতে খাদ্য পরিবেশন করছিল। তাদের তদারক করছিল ইতালির প্রধান ওয়েটার আর পানীয় পরিবেশনকারী।
সকলের ওপর সতর্ক নজর রাখছিল টিম কেণ্ডাল। তাকে সহায়তা করছিল তার স্ত্রী মলি। একরাশ সোনালী চুল আর হাসিঝলমল মুখের মলিকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছিল।
একটু পরেই শুরু হল স্টীল ব্যাণ্ড। দ্বীপে এই জোরালো বাজনা খুবই জনপ্রিয়। যদিও মিস মারপলের মোটেই ভাল লাগল না।
গান আর বাদ্যের তালে তালে নাচও শুরু হয়েছিল। মিস মারপল লক্ষ্য করলেন এ নাচে ব্যায়ামের ধাঁচে অদ্ভুতভাবে সারা শরীর বেঁকে যায়। তরুণ-তরুণীরা বেশ উপভোগ করছে।
কাছেই টেবিলে বসেছিলেন গোলগাল চেহারার ক্যানন প্রেসকট আর তার বোন। কেমন ভয় জাগানো মুখভাব মহিলার। চেহারাও কৃশ।
মিস প্রেসকট সারাদিন ধরে কোথায় কোথায় ঘুরেছেন সেই বিবরণ শোনাতে লাগলেন মিস মারপলকে। এরা দুই ভাইবোন বেশ কিছুদিন গোল্ডেন পাম হোটেলে রয়েছেন। কফি পানের ফাঁকে অতিথিদের সম্পর্কে নানা কথা বলতে লাগলেন।
বৃদ্ধ মিঃ র্যাফায়েল প্রতি বছরই এখানে আসেন। লোকটি টাকার পাহাড়ের মালিক। বয়স প্রায় আশি। তার সঙ্গে রয়েছে সেক্রেটারী অল্পবয়সী একটি মেয়ে। এসথার ওয়াল্টার্স। সে চিচেস্টারে থাকে, বিধবা।
মিঃ র্যাফায়েলের সঙ্গে তার ভ্যালেও রয়েছে। তার নাম জ্যাকসন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মিঃ র্যাফায়েলের অঙ্গসংবাহন করে সে একজন নার্সের মতই।