-না, ওদের মধ্যে তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। তবে এখনও কয়েকদিন ওকে নজরে রাখা দরকার।
এরপর অভিবাদন জানিয়ে ডাঃ গ্রাহাম হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন। মিস মারপল, নিজের চেয়ারে বসেই নানা কথা ভাবতে লাগলেন। প্রেসকট যেসব কথা বলেছেন…এসথার ওয়াল্টার্সও যা বলল…আবার মেজর প্যালগ্রেভের কথাও মনে পড়ল। একে একে।
.
২৩.
ইতিমধ্যে স্টীলব্যাণ্ড পূর্ণোদ্যমে বাজতে শুরু করেছে। সেই শব্দে চিন্তার ছেদ পড়ল না। কেন না তিনি যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
মলির ধূর্তামি মাখানো দৃষ্টির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না মিস মারপল। অথচ প্রথমে সবকিছুই তার কাছে কত স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কারোর মধ্যেই কোন অস্বাভাবিকতা তিনি দেখতে পাননি।
মলি আর টিম কেণ্ডাল–স্বাভাবিক উৎসাহী দুই তরুণ দম্পতি। হিলিংডনদের কত উজ্জ্বল হাসি-খুশি, সুখী মনে হয়েছে।
বেপরোয়া গ্রেগ ডাইসন আর লাকি–যেন পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পুরে নেবার জন্য ছটফট করছে, কত উজ্জ্বল তারা। চারজনের এই দলটাকে চমৎকার মানিয়েছিল।
হাসিখুশি দয়ালু এখজন যাজক ক্যানন প্রেসকট, তার বোন যোয়ান প্রেসকট চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত এক মহিলা।
তারপর মিঃ র্যাফায়েল-দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। একবার তার সঙ্গে পরিচিত হলে সহজে ভুলতে পারা যায় না।
মিঃ র্যাফায়েল অশক্ত মানুষ, তিনি নিজে জানেন তাঁর দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু কোন জরুরী ব্যবস্থা নিতে হলে এই প্রভাবশালী মানুষটির সাহায্যই তাকে নিতে হবে। তিনি কি এতে সম্মত হবেন?
এমনি নানান বিষয় ভাবতে ভাবতে মিস মারপল তার চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন।
নৈশবাতাস ভরপুর হয়ে উঠেছে আনন্দ কোলাহলে। সকলেই তখন খুশির জোয়ারে ভেসে চলেছে। টিম কেণ্ডালও এই হাসি-আনন্দের হাটে যোগ দিয়েছে।
মিস মারপল উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে তার বাংলোর দিকে ফিরে চললেন।
.
একটা কলগুঞ্জনের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় উঠে বসলেন মিস মারপল। ঘড়িতে রাত দুটো। অথচ মনে হচ্ছে বাইরে অনেক লোক কথা বলছে!
ধীরে ধীরে ড্রেসিং গাউন গায়ে চাপালেন তিনি। চপ্পল পড়লেন। তারপর মাথায় একটা উলের স্কার্ফ জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
চোখে পড়ল, টর্চ হাতে অনেকে কি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েক পা এগিয়ে ক্যানন প্রেসকটকে দেখতে পেলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কিছু ঘটেছে?
-ওহ, মিস মারপল? মিসেস কেণ্ডেলকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্বামী ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পান তিনি বিছানায় নেই–তাকেই খুঁজতে বেরিয়েছি আমরা।
বলতে বলতে দ্রুত চলে গেলেন ক্যানন প্রেসকট। মিস মারপল ধীর পায়ে তার পেছনেই চললেন।
মলি বিছানায় নেই…ও কি আগেই এরকম একটা মতলব ভেঁজে রেখেছিল? স্বামী ঘুমিয়ে পড়লেই পালাবে? কিন্তু এর উদ্দেশ্য কি?
এসথার ওয়াল্টার্স যা বলেছে তাহলে তাই কি সত্যি? এর মধ্যে অন্য একজন পুরুষ জড়িয়ে আছে?
চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে এগিয়ে চললেন মিস মারপল। কিছুটা এগুবার পর অস্পষ্ট ডাক শুনতে পেলেন তিনি।
-এই যে…এই দিকে…ওই তো…
জায়গাটা হোটেল থেকে খানিকটা দূরে। সমুদ্রমুখী খাড়ির কাছাকাছি। বেশির ভাগ লোকই হোটেলে ঘুমিয়ে রয়েছে। খাড়ির ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাত্র কয়েকজন।
একজন পেছন থেকে ছুটে এসে প্রায় তাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে গেল সামনে। মিস মারপল চিনতে পারলেন, টিম কেণ্ডাল।
এক মিনিট পরেই তার আর্দনাদ শুনতে পেলেন।
–মলি…হায় ভগবান…মলি…
ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি সকলের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে রয়েছে কিউবার ওয়েটার দুজন, ইভিলিন হিলিংডন আর দুজন স্থানীয় মেয়ে।
টিম সামনে মাটিতে হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে রয়েছে। খাড়ির মধ্যে শায়িত মেয়েটির দেহ দেখতে পেলেন মিস মারপল। মুখ জলের মধ্যে ডোবানো। সোনালী চুল কাঁধ ঢেকে রাখা হাল্কা সবুজ শালের ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে।
–ওহ মলি…।
টিম হাত বাড়াল মৃতের একটা হাত স্পর্শ করবার জন্য। মিস মারপল এবারে দায়িত্ব হাতে না নিয়ে পারলেন না। তিনি কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে বলে উঠলেন, ওকে সরাবেন না মিঃ কেণ্ডাল। সেটা উচিত হবে না।
-কিন্তু আমাকে দেখতে হবে…ওই…মলি…
ইভিলিন এগিয়ে গিয়ে টিমের কাধ স্পর্শ করলেন। বললেন, ও মারা গেছে টিম, আমি ওর নাড়ি দেখেছি।
মারা গেছে? অবিশ্বাসের সুরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল টিম, ও জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে…কিন্তু বোন? কি এমন ওর যন্ত্রণা…আমাকে কেন ও জানালো না?
কণ্ঠ চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে এল টিম কেণ্ডালের।
–কেউ ডাঃ গ্রাহামকে একবার ডেকে আনলে ভাল হয়। সেই সঙ্গে পুলিসে টেলিফোন করা দরকার। বললেন মিস মারপল।
–পুলিস? তিক্তস্বরে বলে উঠল টিম, ওরা এসে কি করবে?
–আত্মহত্যার ব্যাপার ঘটলে পুলিসকে জানাতেই হবে। বললেন মিস মারপল।
–আমিই ডাঃ গ্রাহামকে ডেকে আনছি। হয়তো এখনো তিনি কিছু বলতে পারেন।
একরকম টলতে টলতে হোটেলের দিকে চলে গেল টিম।
মিস মারপল আর ইভিলিন হিলিংডন মৃত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
–এখন আর কিছুই করার নেই। অন্তত একঘণ্টা আগে মারা গেছে মলি। ওঃ কী মর্মান্তিক। ওদের দুজনকে কত সুখী ভেবেছি। মলি যেন বরাবরই কেমন একটু অপ্রকৃতিস্থ ছিল।