দক্ষিণ মেরু অভিযানের সময় এলিয়ট চিঠিটা আমাকে দেয়। আশংকা ছিল অভিযান থেকে উনি ফিরবে না। সে ফিরে আসতে চাননি। মারপল ঠিকই বলেছেন, লাভ তো হয়নি বরং দুঃসহ নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। চিঠির শেষ কথাটি ছিল সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ সঠিক প্রয়াশ্চিত্ত। নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত কাটল।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার শুরু করলেন পেনডার-ঈশ্বরের কৃপায় কোনো অপরাধী ছাড়া পায় না। অপরাধ প্রমাণিত না হলেও কিংবা আইনের চোখে দোষী না হলেও ঈশ্বরের আদালতে শাস্তি পাবেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অশুভ পরিবেশই ঘৃণ্য কাজের জন্য দায়ী। মিস মারপলকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন–আপনি আবার রহস্যমোচন করলেন।
ঘটনার আশ্চর্য পরিসমাপ্তিতে সবাই চুপ। চুল্লির লালচে আভা সবার মুখে। জয়েস উঠে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে পেনডারকে বলে–অদ্ভুত ঘটনা শোনানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। পরের মঙ্গলবার গল্পকার রেমণ্ড অনুদঘাটিত রহস্য গল্প শোনাবে।
পেথোরিক বললেন, আমি সমর্থন জানাচ্ছি।
রেমণ্ড বলল-জয়েসের ধারণা আমার জীবন পেশা সবই কল্পনাভিত্তিক। পরের মঙ্গলবার বাস্তব ঘটনা শোনাব।
২. স্বর্ণ তৃষা
মারপলের বসার ঘরে সবাই উপস্থিত। মিঃ পেনডার, মিঃ পেথোরিক এখন আসেনি। হেনরি, মিস মারপল নিচু স্বরে গল্প করছেন। জয়েস ও রেমণ্ড চুল্লীর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাকি দুজন একসাথে ঢুকলেন।
চা পর্ব চুকে গেলে রেমণ্ড তার কাহিনী শুরু করল।
আমি যে গল্পটা শোনাব এই পরিবেশে উপযুক্ত হবে কিনা জানি না। শেষ জানি না এবং পুরোটাই রহস্যময় রয়ে গেছে, আমার কাছে।
আমার কাছে কাহিনীটা আশ্চর্যজনক। পুরো কাহিনী শোনার পর আপনারা কেউ হয়তো রহস্য ভেদ করতে পারবেন। সমস্বরে সবাই তাকে গল্পটি বলার অনুরোধ করলো।
প্রায় ছবছর আগের ঘটনা। আমি তখন নিউম্যানের অতিথি।
জয়েস বলল–কর্নওয়ালে?
রেমণ্ড বলল, কেন?
না, তেমন কিছু নয়। আমার গল্পের পটভূমিও কর্নওয়াল। সমুদ্রতীরে জেলেদের একটা ছোটো গ্রাম রাদোল। তোমার গল্পটা নিশ্চয় ওখানকার নয়।
আশ্বস্ত করে বলল জয়েসকে, গ্রামটির নাম পলপেরানী। প্রাকৃতিক দিক থেকে রুক্ষ; পাথুরে, বন্য। যার অতিথি ছিলাম, তার সঙ্গে আলাপ বেশি দিনের নয়। অল্প দিনের বন্ধুত্ব। প্রথমদিনই ওর জ্ঞান এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া পাই। বেশিরকম কল্পনাপ্রবণ থাকায় মাথায় ঘুরত আজগুবি কল্পনা।
মধ্যযুগীয় ইতিহাসে ছিল তার প্রচুর জ্ঞান। স্পেন থেকে যে জাহাজ ইংল্যান্ড আসত, বিশেষতঃ স্পেনীয় আর্মাডার যাত্রাপথ সম্পর্কে বহু গবেষণা করেছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যখন তিনি যাত্রাপথের বিবরণ দিতেন তখন মনে হত তিনি যেন সেই জাহাজের নাবিক ছিলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে হাত-পা নেড়ে গল্প করার সময় মনে হত সত্যিই উনি জাতিস্মর হয়ে এসেছেন এবং গতজন্মে দুর্ধর্ষ স্পেনীয় নাবিক ছিলেন।
মারপল সস্নেহে তাকিয়ে বলেন, ছোঁয়াচে কল্পনার ছায়া তোমার ভালোই লেগেছে।
বিরক্ত হয়ে প্রতিবাদ করে রেমণ্ড বলল-না পিসি, আমি নই, তার কল্পনা জগতে তিনি নিমজ্জিত থাকেন।
নিউম্যানের মোদ্দা কথা হল, ওই বিখ্যাত আর্মাডার একটি জাহাজ প্রচুর সোনা ও ধনরত্ন নিয়ে ইংল্যান্ডে আসার পথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সর্পিল ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নিউম্যানের স্থির বিশ্বাস কর্নওয়ালের উপকূলে কোথায় জাহাজডুবি হয়।
একটা কোম্পানিও তৈরি হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের স্বর্ণ উদ্ধারের জন্য। অনুসন্ধান ব্যর্থ হয়। নিউম্যানের কল্পনা ছিল গগনচুম্বী। ধনরত্ন উদ্ধারের জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে জলের দরে কোম্পানিটা কিনে নেয়। ওর ধারণা স্প্যানিস জাহাজের স্বর্ণসম্পদ সাগরের তলায় আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হবে স্বর্ণ তুলে আনতে।
খেয়াল মেটাতে সেইখানে পল হাউস নামে একটি বাড়ির লিজ নেবেন। অবাক হয়ে গেলাম নিউম্যানের মতো ধনী ব্যক্তি টাকা উড়িয়ে হয়তো কয়েকশো টাকা দামের খেলো জিনিস পায়। তার অদ্ভুত খেয়াল আমাকেও প্রভাবিত করল। আমিও মনশ্চক্ষে দেখতাম ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তাদের এগিয়ে যাওয়া। তারপর পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ঘটে সলিল সমাধি।
নিউম্যানের আমন্ত্রণ যোড়শ শতাব্দীর পটভূমিকায় উপন্যাস লেখার উপযুক্ত রসদ।
শুক্রবার ভোরে প্যাডিংটন থেকে রওনা দিলাম কর্নওয়ালের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী লম্বা চেহারার মানুষটিকে প্রথমেই চেনা লাগছিল। মনে পড়ল ইনি হলেন পুলিশ ইনসপেক্টর ব্যাজওয়ার্থ এডার্সন, নিরুদ্দেশ মামলায় ওর সঙ্গে আলাপ। মামলা সম্পর্কে ধারাবাহিক লেখার সময় ব্যাজওয়ার্থের শরণাপন্ন হতে হত।
পরিচয় দিতেই চিনতে পেরে সারা পথ গল্প করে কাটালাম। পলপেরানী যাচ্ছি শুনে বলেন–আমিও তো ওখানেই যাচ্ছি।
আমি ও অঞ্চলে যাবার উদ্দেশ্য জানিয়ে ডুবে যাওয়া স্প্যানিস জাহাজ সম্পর্কে বন্ধুর আগ্রহের কথাও বললাম।
জাহাজের কথা আমিও জানি, নাম জুয়ান ফারনানডেস। অনেক মানুষ ব্যর্থ হয়েছে ডুবন্ত জাহাজের সন্ধান করতে গিয়ে।
আমি বললাম–সবই কল্পনা মাত্র। জাহাজ ডুবলেও কোনো ধনরত্ন তাতে ছিল না।
অবাক করেই ইনসপেক্টর বলেন–একটা নয় অনেক জাহাজডুবি হয়েছিল। আর ওইরকম ধ্বংসগ্রাপ্ত জাহাজ ওটারনাটো নামে একটা জাহাজে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়।