বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল অ্যালেলে পবিত্র লোকাঁচার, পূজার্চনার শব্দগুলি। লোকাঁচারের নিয়মগুলি কি? অস্ফুট স্বরে বলল ডায়না।
ক্যাপ্টেন উচ্চস্বরে হেসে বলেন–হয়তো নরবলি হত!
রিচার্ড ঠাট্টাকে অবজ্ঞা করে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন–অরণ্যের মাঝখানে মন্দির থাকাটা বইতে পড়েছিলাম। মাথাব্যথা না থাকলেও কল্পনা করতে দোষ কোথায়?
ঠিক সেই মুহূর্তে জঙ্গল ছাড়িয়ে খোলামেলা জায়গার মাঝখানে দেখলাম, শ্বেত পাথরে কারুকার্য করা চূড়াযুক্ত মন্দির। স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন।
অবাক হয়ে আমরা দেখছিলাম। অনুসন্ধিৎসু চোখে ডায়না তাকাল রিচার্ডের দিকে।
প্রশ্নটা বুঝতে পেরে বলল–মনে হয় এটাই সেই মন্দির।
মন্দিরের ভেতরে মেহগনি কাঠের এবড়ো খেবড়ো থামের উপর বসানো ব্রোঞ্জের খোদাই করা অদ্ভুত মূর্তি চোখে পড়ল। সিংহের ওপর উপবিষ্টা, অর্ধচন্দ্রাকৃতি শৃঙ্গবিশিষ্ঠা, ছোটো দেবী মূর্তি, অপূর্ব কারুকাজ করা।
রিচার্ড বললেন–ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বইয়ের পাতায় দেখা দেবীমূর্তি হলেন ফিনিশীয়দের চাঁদের দেবী।
চাঁদের দেবী? লাফিয়ে উঠল ডায়না। তন্ময়ভাবে বলল–আজ রাতে পুরানো আমলে ফিরে গিয়ে ধর্মীয় উৎসবে মেতে পুরানো দিনের পোশাকে সাজব। কেমন হবে? চাঁদ উঠলে সবাই মিলিত হয়ে দেবীর সামনে ধর্মীয় প্রথা পালন করব।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শরীরটা কেঁপে ওঠায় এলিয়ট বলে উঠল–এসব বোধহয় আপনার পছন্দ নয়?
গম্ভীরভাবে বললাম-পুরানো নিয়ে এসব করা আবার ঠিক নয়।
কৌতূহলী দৃষ্টিতে এলিয়ট আমাকে দেখে বলল–এটা যে প্রাচীন দেবীর পবিত্র অরণ্য কেউ সঠিক জানে? এটা রিচার্ডের কল্পনার বিলাস মাত্র।
ধরুণ যদি তাই-ই হয়?
আমার প্রশ্নে এলিয়ট হাসল–আপনি অবশ্যই এসব বিশ্বাস করতে পারেন না। একজন যুক্তিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে এগুলি বিশ্বাস করা যায় না। কবে মুছে গেছে প্রথাগুলি। চিন্তা করে বললাম–পরিবেশের প্রভাবে অভিভূত হওয়ার মানুষ আমি নই। কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর থেকে মনে হচ্ছে আমার চারদিকে অমঙ্গলের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অস্বস্তিকরভাবে এলিয়ট বলল–অদ্ভুতই বটে। আমার মনে অতিরিক্ত কল্পনাই এর জন্য দায়ী। তোমার কি মত সাইমণ্ডল?
তরুণ ডাক্তার কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল-বোঝাতে পারব না, আমার কেন ভালো লাগছে না। পরিবেশটা অস্বস্তিজনক।
সেই মুহূর্তে ডায়োলেট এগিয়ে এল আতঙ্ক চোখে। ফ্যাকাসে সাদা মুখে চিৎকার করে বলল–বিষম যাচ্ছেতাই জায়গা আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলুন চলে যাই।
আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগোলাম সবাই। কিন্তু ফিরে দেখি ডায়না নিবিষ্টি মনে মূর্তির দিকে তাকিয়ে। পরে আমার সঙ্গ নিলেও আনমনে হাঁটতে লাগল।
ফিরে আসার পথে মন্দির, দেবী, নিবিড় অরণ্যের বিশ্রী অনুভূতির কথা বলতে লাগল। বাড়ি ফিরে মজার পোশাক পরে চাঁদ উঠলে মন্দিরে যাবার আগ্রহে চলল কে কী পোশাক পড়বে। আড়াপাতা, ফিসফিসানি এইসব।
সবাই যখন নানা সাজে সজ্জিত হয়ে খাবার টেবিলে এল বিস্ময়ে আনন্দের হুল্লোড় পড়ে গেল। ক্যাপটেন ও স্ত্রী পরেছেন নিতথিলিক যুগের গুহামানবদের পোশাক। রিচার্ড সেজেছেন ফিনিশীয় নাবিকের পোশাকে। এলিয়ট দস্যুদলের সর্দার। সাইমণ্ডল পাঠক সেজেছে, লেডি ম্যানারিং নার্স এবং কন্যা ডায়োলেট ক্রীতদাসীর বেশ, ক্রীশ্চান সাধুর বেশ ছিল আমার। সর্বশেষে নীল আলখাল্লা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে এল ডায়না।
চপল ভঙ্গিতে ডায়না বলে–হ্যাঁ, আমি অপরিচিতা, এখন খেতে চলুন।
খাওয়া-দাওয়া সেরে গুমোট গরমের পর ঝির ঝির হাওয়ায় বেড়াতে বেরোলাম। আকাশের বুকে চাঁদ উঠেছে। এলোমেলোভাবে ঘুরে একঘণ্টা কাটাবার পর দেখলাম ডায়না নেই।
রিচার্ড বলল–ডায়না শুতে যায়নি নিশ্চয়।
মাথা ঝাঁকিয়ে ডায়োলেট বলল-পনেরো মিনিট আগে জঙ্গলের দিকে গেছে। আবছা আলোয় অরণ্য কালো অন্ধকারের রূপ নিয়েছে।
রিচার্ড বলল–দেখি তো গিয়ে–নিশ্চয় কোনো দুষ্টু বুদ্ধি খেলেছে।
সবাই মিলে এগোতে গিয়ে ভাবছি–কি উদ্দেশ্য জঙ্গলে যাবার। আমার অনিচ্ছা ছিল, মনে হচ্ছিল শক্তিশালী কেউ যেন আমাকে বাধা দিচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই অনুভূতিটা প্রত্যেকের কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছি। মহীরুহ এমন ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যে, উজ্বল আলো তা ভেদ করতে পারল না। চারিদিকে মৃদু আওয়াজ ফিসফিসানো পরিবেশকে ভীতিপ্রদ করে তুলল।
হঠাৎ আমরা ভোলা জায়গায় এলাম। আর যে দৃশ্য দেখলাম তাতে বাকরুদ্ধ..মন্দিরের সামনে উজ্জ্বল আলোয় দাঁড়িয়ে এক অপূর্ব নারীমূর্তি। সর্বাঙ্গে স্বচ্ছ আবরণে সুগঠিত নারী দেহ। একরাশ চুল ভেদ করেছে অর্ধচন্দ্রাকৃতি শৃঙ্গ দুটি। সুন্দর আর ভয়ঙ্করের মিলন।
রিচার্ড বলল–কে এ? কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
ডায়োলেট চেঁচিয়ে উঠে বলল–এ যে ডায়না। নিজেকে কেমন সাজিয়েছে।
তার দিকে এগিয়ে যেতেই সেই মূর্তি হাত উপরে তুলল। বেজে উঠল জলতরঙ্গের মতো কণ্ঠস্বর–আমি দেবী অ্যাসটার্টের যাজিকা। অগ্রসর হলে সাবধান। মৃত্যু আমার হাতে।
প্রতিবাদে লেডি ম্যানারিং বললেন–ডায়না তুমি আমাদের ভয় পাইয়ে দিও না।
রিচার্ড ডায়নার দিকে এগিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ডায়না সত্যিই তুমি অপূর্ব।