পেনডার বললেন–জীবনে রহস্যময় ঘটনা বলতে কিছুই নেই তবুও আপনাদের অনুরোধে শোনাব।
.
অ্যাসটার্টের অভিশাপ–কুয়াশা ঘেরা :
দ্বিতীয় মঙ্গলবারের সন্ধ্যায় একে একে সবাই এলেন। পেনডার এলেন শেষে, সবাই আছে কিনা দেখে কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেনরি বললেন, বলুন ডাঃ কি শোনাবেন?
বৃদ্ধ যাজক হেসে বলেন–আমার জীবন কেটেছে শান্ত পরিবেশে, ঈশ্বরের করুণায়। যখন তরুণ ছিলাম একটি বিষাদময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
পেনডার বলে চলেন–ওই ঘটনা আমার জীবনে এমন একটা দাগ ফেলেছিল সে স্মৃতি রোমন্থন করলেই এই সময়ের ভীতি ও বিভীষিকা আমি স্পষ্ট অনুভব করি। আপনারা একে অনুদঘাটিত বলবেন কি না জানি না। বাহ্যিক কোনো অস্ত্র ছাড়াই মানুষ খুন হল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ চিন্তাভাবনা করে কারণ খুঁজে পায়নি। এমন অনেক কিছু আছে যার বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
অভিযোগের সুরে হেনরি বলেন–আপনি তো আমাদের ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন?
ডাঃ পেনডার বলেন–আমার তাই হয়েছিল। পরিবেশের কথা উঠলে হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না। আমার জীবনে এর প্রভাব যথেষ্ট। কিছু কিছু জায়গায় অশরীরী দৈবশক্তির বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে।
মিস মারপল মন্তব্য করলেন–হ্যাঁ, এরকম জায়গা বা বাড়ি আছে। লারশেদের বাড়িতে মিঃ স্মিারস সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ছাড়েন। সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙে মিসেস ক্লারকে দক্ষিণ ফ্রান্সে চলে গেছেন। বাড়ির মালিক বানডেরার বাড়িতে আসার পরেই শক্ত অপারশেন হয়েছে।
মিঃ পেথোরিক বলেন-কুসংস্কারে জড়িয়ে থাকার ঘটনায় কত বড়ো বড়ো ক্ষতি হতে পারে।
স্যার হেনরি বলেন–কড়া ধাচের ভূত বা ভুতুড়ে বাড়ির গল্প আমিও জানি। বলে হেসে উঠলেন।
রেমণ্ড মন্তব্য করলেন-পেনডারের গল্পটা বলতে দেওয়া হোক।
জয়েস উঠে দাঁড়িয়ে আলো দুটো নিভিয়ে দিল। শুধু ধিকিধিকি আগুনের আভা। আলো আঁধারী মায়াময় ঘর। জয়েস বলল–এটাই গল্প শোনার উপযুক্ত পরিবেশ।
পেনডার চশমাটা খুলে মৃদু হেসে জয়েসের দিকে তাকিয়ে শুরু করেন।
আপনারা ডার্টমুর জায়গার নাম শুনেছেন? যেই অঞ্চলটার কথা বলছি সেটা ডান্টমুট সীমান্তে। মনমুগ্ধকর পরিবেশ। সম্পত্তিটা অজ্ঞাত কারণে অবিক্রিত ছিল। শীতকালে নিসর্গ দৃশ্য মনোরম। সম্প্রতি আমার বন্ধু হেভেন জমিদারিটা কেনেন। কলেজ জীবনের বন্ধু। দেখা সাক্ষাৎ বহুদিন না হলেও অটুট বন্ধুত্ব। তাই সাইলেনট গ্রোভ-এর যাবার নিমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করি।
নিমন্ত্রিতদের মধ্যে হেভেনের খুড়তুতো ভাই এলিয়ট, লেডি ম্যানারিং, কন্যা ডায়োলেট। মেয়েটি সুশ্রী এবং সাধারণ ব্যক্তিত্বের। আর সস্ত্রীক ক্যান্টেন রজার্স। পোড়খাওয়া মানুষ রজার্স অশ্বারোহণ ও শিকার জীবনের প্যাশন। তরুণ হলেও ডঃ সাইমন্ড খ্যাতিবান প্রতিষ্ঠিত। অন্যজন মিস ডায়না অ্যালেলে, অসামান্য সুন্দরী। নানা ফ্যাসন পত্রিকায় ছবি ছাপত। আকর্ষণীয়া, দীর্ঘাঙ্গী, গায়ের রং তামাটে। মসৃণ কোমল ত্বক। দীর্ঘ আঁখি পল্লবের জন্য মনে হত যেন কোনো প্রাচ্য দেশীয় রমণী। দূরাগত ঘণ্টাধ্বনির মতো মধুর কণ্ঠস্বর।
ওখানে গিয়েই বুঝতে পারি রিচার্ড ডায়নার প্রতি আসক্ত। এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন সেইজন্য।
ডায়না আত্মসচেতন খেয়ালী মেয়ে। একদিন সারাক্ষণ রিচার্ডের সঙ্গে–তো অন্যদিন ভাই এলিয়টের সঙ্গে। পরের দিন ভুবনজয়া হাসিতে ভরাল তরুণ ডাক্তারকে।
যাবার পরদিন পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। অদ্ভুত সুন্দর। ঝড়ঝঞ্ঝা উত্থান পতনের সাক্ষী গ্রানাইট পাথরে তৈরি প্রাসাদটি। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে অলংকৃত ক্রেসকোর আয়না, দেওয়ালগিরী, পুরাতন অস্ত্রশস্ত্র, পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী। নানা জীবজন্তুর মাথা আর ঝাড়লণ্ঠনে সজ্জিত অলিন্দ। দরজা জানলায় গাঢ় রংয়ের ভারী পর্দা, অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরগুলি সাজানো, উষ্ণ আরামদায়ক। জানলা দিয়ে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর, ঢেউ খেলানো পাহাড়গুলি। মেঘ পালক মেষ চড়াচ্ছে। রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে ঈগল চিলের আনাগোনা। দূরে নিবিড় বনানী।
রিচার্ড বলছিল–প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে পাহাড়ের ঢালু জায়গায় মানুষের ব্যবহৃত নিদর্শন পাওয়া যায়। খননে কিছু ব্রোঞ্জের সামগ্রী মিলেছিল। অতীত দিনের এইসব স্মারক বহুমূল্যে সংগ্রহ করে বাড়িতে সাজিয়ে রাখত আগ্রহের সঙ্গে।
বাড়ির নামকরণ কেন সাইলেন্ট গ্রোভস বা নিস্তব্ধ অরণ্য রাখা হল তাও বোঝাল। বেশির ভাগ অংশ প্রস্তরাকীর্ণ হলেও কয়েকশ গজ দূরে একটা নিবিড় অরণ্য আছে। বহুবছর গাছপালা জন্মাচ্ছে, মরছে। আবার জন্মাচ্ছে। কিন্তু অরণ্যের আকার একই রয়েছে। জায়গাটা অজানা কারণে শব্দবিহীন। এই জন্যই নাম নিস্তব্ধ অরণ্য।
এখানে এসে ঘুরে বেড়িয়ে, গুহা দেখে কাটানোর পর অরণ্যে বেড়াতে এলাম। পা দিয়েই অদ্ভুত অপার্থিব অনুভূতিতে শিউরে উঠলাম। থমথমে নিস্তব্ধতা। পাখিরা ডাকল না, ছমছমে পরিবেশ। জমা পাতা স্পঞ্জের মতো লাগছিল। অনেক ডুবে যাচ্ছিল। ডালপালা সরিয়ে পথ করলাম।
রিচার্ড কৌতূহলী হয়ে বলল–জায়গাটার বিশেষ অনুভূতি আছে না?
শান্তভাবে বললাম–অস্বস্তিকর। ঠিক ভালো নয়।
রিচার্ড বলেন–মনে হচ্ছে কেউ যেন নিষেধ করছে এটাই বহুশ্রুত দেবী অ্যাসটার্টের অরণ্য। কে তিনি? ডাক্তার সাইমণ্ডল জিজ্ঞেস করেন। রিচার্ড হলেন–অ্যাসটার্ট ফিনিশীয়দের দেবী। অনেক শতাব্দী আগে ফিনিশীয়রা অনেক দেব-দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন। কালের প্রভাবে অন্যগুলি নষ্ট হলেও অরণ্যের দেবী অ্যাসটার্টের মন্দিরটি অক্ষত। সাক্ষ্য প্রমাণিত না হলেও অরণ্যটি দেবী অ্যাসটার্টের। ঘনবৃক্ষরাজরি মধ্যে হত দেবীর পূজার্চনা।