পরদিন সকালে তিনজনে মিলে হাজির হল মিসেস বারলেটের বাড়িতে। ছোটোখাটো ঝকঝকে উঠোন সিঁড়ি। সর্বত্র পরিচ্ছন্নতার ছাপ, কড়া নাড়তেই একটি সুশ্রী মহিলা দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন। দুটি ঘন নীল চোখ, মুখে লাবণ্যের ছোঁয়া। মিঃ ড্রেউইট সুপ্রভাত জানিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল জো এলিম বাড়িতে আছে কিনা।
মিসেস বারলেট জানালেন দশমিনিট আগে সে ফিরেছে। তাদের আসন গ্রহণ করার অভ্যর্থনা জানিয়ে হাঁক দিলেন, জো তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একজন ভদ্রলোক এসেছেন, তাড়াতাড়ি এসো। উত্তরে জো জানাল, হাতমুখ ধুয়েই সে আসছে।
যথা সময়ে জো এলিম ঘরে প্রবেশ করল। লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারা, নীল চোখে মাখানো লাজুক হাসি। মেলচেট জো-এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, রোজ এমটক নামে যে মেয়েটি জলে ডুবে মারা গেছে তার তদন্তের ব্যাপারে তাদের এখানে আসা। সে তো মেয়েটিকে ভালোই চিনত।
ইতস্তত করে জো বলল, সে তাকে ভালোবাসত, ওকে বিয়ে করবে বলে ঠিকই করেছিল। মৃত্যুর সময় সে গর্ভবতী ছিল কথাটা শুনে হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিল স্যানফোর্ড তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও সে তাকে গ্রহণ করত।
মেলচেট তাকে আবার প্রশ্ন করে, এই অবস্থাতেও কি সে তাকে গ্রহণ করত? উত্তরে জো জানাল, তার এই অবস্থার জন্য দায়ী স্যানফোর্ড। সেই রোজকে ভুলিয়ে তার সর্বনাশ করেছে, মেয়েটির কোনো দোষ নেই।
হেনরির প্রশ্ন গত পরশু রাতে সাড়ে আটটায় সে কোথায় ছিল। উত্তরে জো বলল, সে বাড়িতেই ছিল। রান্নাঘরের তাক বানাচ্ছিল। তার উত্তরে হেনরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না; মনে হল উত্তর আগে-ভাগে সাজানো।
তারপর হেনরির বাচ্চা ছেলেটির কথা মনে পড়ল, যে সাঁকোর উপর আর্তনাদ শুনেছিল। তার সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানাল। মিঃ ড্রেউইটি ছেলেটির সন্ধানে লোক পাঠাল। ছোটোখাটো বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। হেনির তাকে প্রশ্ন করে সে তখন নদীর ওপারে ছিল। কিন্তু সাঁকো পেরিয়ে বনের দিকে যাবার সময় সে কি কাউকে দেখেছিল–উত্তরে সে জানাল যে স্যানফোর্ড স্থপতি তাকে দেখেছিল এবং সে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিল।
হেনরি প্রশ্ন করে, সে কি রোজকে সাঁকোর উপর দেখেছিল? সে ফিরবার সময় রোজ-এর আর্তনাদ শুনেছিল তার কত আগে স্যানফোর্ডকে বনের মধ্যে দেখেছিল?
সে উত্তর দিল, দশ মিনিট আগে। আবার প্রশ্ন, সে কি নদীর পাড়ে কাউকে দেখেছিল? জিমি উত্তরে বলল, আবছা অন্ধকারে একজন হেঁটে যাচ্ছিল। তার মনে হয়েছিল। যে লোকটি শিষ দিতে দিতে যাচ্ছিল সে জো এলিমই।
ড্রেউইট জিমিকে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে, সে অন্ধকার কুয়াশায় কি করে বুঝল যে, লোকটি জো এলিম?
জিমির উত্তর–যে গানটা শিষ দিয়ে গাইছিল সেটা সাধারণত জো গায়।
মেলচেট আবার প্রশ্ন করে, সে ফিরে আসার সময় আর্তনাদ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখল নদীতে সাদা মতো কি ভেসে যাচ্ছে। তখন সাহায্যের জন্য গ্রামবাসীদের কাছে ছুটে যায়। দৌড়বার সময় সাঁকোর আশেপাশে কাউকে দেখেছিল কিনা?
একটু ভেবে জিমি বলল, সে দেখল দুজন লোক ছোটো ঠেলা গাড়ির মতো কি যেন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা দূরে থাকায় সে মিঃ জেলের বাড়িতে খবরটা দেয়।
জিমির সাক্ষ্যে স্যানফোর্ডই অপরাধী কিন্তু জো এলিমের সম্পর্কে তার যে ধারণা তা আইনসিদ্ধ নয়। শুধু শিষ শুনে কাউকে সনাক্ত করা যায় না।
হেনরি পকেট থেকে মিস মারপলের লেখা নামধারীকে অভিযুক্ত করতে না পেরে আবার মিস মারপলের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
গল্প শুনে হেনরির মুখের দিকে সবাই তাকাল, মিস মারপলের মুখে মৃদু হাসির রেখা।
আবার শুরু করেন হেনরি, মিস মারপলের মুখ দেখে বুঝলেন তিনি অধীর হয়ে আছেন এই তদন্তে তিনি কতটা অগ্রসর হয়েছেন জানার জন্য।
হেনরি দুঃখের সঙ্গে জানাল তার উল্লিখিত অপরাধীর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করা যায়নি। সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে স্যানফোর্ডের পক্ষে। তাই স্যানফোর্ডকে রক্ষা করা অসম্ভব।
মারপল আশাহত গলায় বলেন, তারই ভুলে হয়েছে। নতুবা তার মতো দক্ষ অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারের চোখে নিশ্চয়ই কোনো সূত্র মিলত।
হেনরি বলেন, জো সেদিন রাত্রে তাক বানাচ্ছিল এবং মিসেস বারলেট সেখানে সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন।
কথাটা শুনেই মিস মারপল চমকে ওঠেন। বলেন, সেদিন শুক্রবার ছিল। হেনরি প্রশ্ন করল, শুক্রবারের সঙ্গে ঘটনার কি সম্পর্ক?
মারপল বলেন, মিসেস বারলেট বাড়িতে থাকতেই পারেন না। কারণ প্রতি শুক্রবার তিনি কাপড় বিলি করতে বেরোন।
পুরো ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। মিসেস বারলেট চোখে ধুলো দিতে এই গল্পের অবতারণা করেছেন। এবং দুজনের সম্পর্ক সম্বন্ধে তার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেল।
সিদ্ধান্ত স্থির করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছালেন এবং সরাসরি জোকে প্রশ্ন করেন, জো সেদিন রান্না ঘরে তাক বানাচ্ছিল না সেদিন ঐসময় নদীর পাড় ধরে শিষ দিতে দিতে যাচ্ছিল।
কথাটা শুনে বজ্রাঘাতের মতো চুপ করে থেকে তারপর ভাঙ্গা গলায় বলল, রোজকে সে খুন করেনি। সে জানতই না রোজ সাঁকোর উপর আছে। সে রোজকে ভালোবাসত এবং তার ক্ষতি সে বিন্দুমাত্র চায়নি।
সে কেন মিথ্যে বলেছে জানতে চাওয়ায়, জো বলল-মিসেস বারলেট নদীর পাড়ে বেড়ানোর সময় তাকে দেখেছে এবং পুলিশ তাকে সন্দেহ করতে পারে। পুলিশের কানে খবরটা পৌঁছালে পুলিশ তাকে রেহাই দেবে না এবং রান্নাঘরের তাক বানানোর ফন্দিটা তার মাথা থেকেই এসেছে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা বলবে তাক বানানোর গল্পটা। মিসেস বারলেট তাকে বিশেষ স্নেহ করেন বলে এত বড় ঝুঁকি নিয়েছে। মিসেস বারলেট কোথায় আছে জেনে তার মুখোমুখি হলেন।