জয়েস রেশম কালো চুল ঝাঁকিয়ে হাত তুলে বলল-বাঃ, আমি কিন্তু আপনাদের হারাতে পারি। আমি একজন মেয়ে। মেয়েদের ঈশ্বর প্রদত্ত ষষ্ঠেন্দ্রিয় অনুভূতি কিন্তু ছেলেদের থাকে না। শিল্পী হয়ে চোখে যা দেখি না, কল্পনায় সেটা দেখি। বহু মানুষ, দেশ এবং জীবনকে যেভাবে জেনেছি, মারপল পিসিও বোধহয় তা জানেন না।
মিস মারপল উলবোনার থেকে মুখ তুলে বললেন–আমি সত্যিই জানি না সোনা। কিন্তু এই ছায়াঘেরা শান্ত মেরি মীড গ্রামেও মাঝে মাঝে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে।
মৃদু হেসে পেনডার বললেন–আমি কি বলব? আজকাল পাত্রী পুরোহিতদের অবজ্ঞা করা ফ্যাশন। কিন্তু আমরা এমন অনেক ঘটনা শুনি, চরিত্রের নানা দিক জানতে পারি যা বাইরের পৃথিবীতে কোনোদিনই পৌঁছাবে না।
উৎসাহ নিয়ে জয়েস বলল–ঠিক আছে, এখানে সব ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক মানুষ হাজির আছেন, আমরা সংঘ তৈরি করি? আজ মঙ্গলবার হওয়ায় সংঘের নাম মঙ্গলবারের সান্ধ্য বৈঠক। প্রত্যেক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিলিত হয়ে, প্রত্যেক সদস্য একটা করে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুদঘাটিত রহস্যের কথা বলবেন। যে রহস্য সম্পর্কে জানেন এবং নিজে সমাধান করতে পারবেন, সেই সব ঘটনা বলবেন। আমরা কতজন? পাঁচজন! আঃ ছয় জন হলে ভালো হত।
মিস মারপল হাসতে হাসতে বলেন–তুমি সোনা আমাকে ভুলে গেছ।
জয়েস হকচকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বাঃ। তাহলে তো খুব ভালোই হয়। আমি ভাবলাম এ ধরনের খেলা ঠিক আপনার পছন্দ নয়।
মিস মারপল বলেন–আমার ধারণা ব্যাপারটা খুব আকর্ষণীয় হবে। এতজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির সমাবেশ। আমি বুদ্ধিমতী না হলেও এত বছর সেন্ট মেরি মীডে থেকে মানুষের চরিত্র সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি জন্মেছে।
বিনীত হেনরি বলেন, আপনার সহযোগিতা খুবই মূল্যবান হবে।
জয়েস বলল, কে শুরু করবেন?
ডাঃ পেনডার বলেন, আমরা ভাগ্যবান, স্যার হেনরির মতো সম্মানীয় ব্যক্তি আমাদের মধ্যে থাকতে কোনো দ্বিধাই থাকতে পারে না,…কথা শেষ না করে সম্মানের ভঙ্গীতে তাকালেন।
স্যার হেনরি মিনিট দুয়েক চুপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পা তুলে আরাম করে বসে আরম্ভ করলেন তার কাহিনী –
একটি দুঃখজনক ঘটনা :
আপনারা যে ধরনের কাহিনী শুনতে চান সেটা বাছাই করা সত্যিই অসুবিধাজনক। এমন ঘটনা যা অনুসন্ধিৎসা মেটাবে। এবং সে ঘটনা বছরখানেক আগে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। রহস্যের কিনারা হয়নি। ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু দিনকয়েক আগে আমার হাতে এসে পড়ে সমাধান হল।
সহজ সরল ঘটনা। তিন জন রাতের খাবার খেতে বসেছিলেন। টিনে ভর্তি রান্না-করা গলদা চিংড়ি খেয়ে, রাত্রি বেলা তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হল, দুজন সেরে উঠল। তৃতীয়জন মারা পড়েন, টোমেন জাতীয় বিষই মৃত্যুর কারণ। সেই মর্মে ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। তাকে সমাধি করা হল। কিন্তু ঘটনাটা ওখানে থেমে থাকল না।
মিস মারপল বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলেন–নিশ্চয়ই, অনেক গুজব ছড়িয়ে ছিল যেভাবে ছড়ায়।
স্যার হেনরি বলে চলেন নাটকের কুশলীদের একটু পরিচয় দিই। তিনজনের এক দম্পতি ধরুন ওদের নাম মিঃ ও মিসেস জোনস, অপর জন মিস ক্লার্ক, শ্রীমতি জোনসের সাহচর্য সঙ্গিনী।
জোনস ওষুধ সংস্থার ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি। পঞ্চাশ বছর, সুদর্শন, সৌখিন। জোনসের স্ত্রীর পঁয়তাল্লিশ, সাদামাটা ধরনের। মিস ক্লার্কের বয়স ষাটের কোঠায়। শক্ত সামর্থ্য, লালচে মুখের মহিলা। এরা কেউই আকর্ষণীয় নয়। গোলমালের সূত্রপাত আশ্চর্যরকম ভাবেই।
জোনস ঘটনার আগের দিন রাত কাটান বারমিংহামের একটি হোটেলে। চিঠি লিখতে যে ব্লটিং পেপার ব্যবহার করেছিলেন সকালে সেটি পরিচারিকার হাতে পড়ে। মজা পাবার জন্য ব্লটিং পেপারটি আয়নার সামনে ধরলে কয়েকটি শব্দ তাতে ফুটে উঠে। কয়েকদিন পর কাগজে যখন চিংড়ি মাছ খেয়ে জোনসের মৃত্যুর সংবাদটা প্রকাশিত হয়, পরিচারিকাটির তখন ফুটে ওটা শব্দগুলি স্মরণ হয়। হোটেলের অন্যান্য কর্মীর কাছে ব্লটিং পেপার থেকে উদ্ধার হওয়া চিঠির কথাগুলি বলে। সেগুলি ছিল..সম্পূর্ণভাবে আমার স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল..যখন সে মারা যাবে তখন আমি..শয়ে শয়ে হাজার হাজার…।
আপনাদের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে, কিছুদিন আগে কাগজে প্রকাশিত স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা ঘটনাটি। ঘটনাটি পরিচারিকার মনে পড়ে এবং এই ব্যাপারে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। পরিচারিকার এক আত্মীয় জোনসের বাড়ির কাছাকাছিই থাকে, চিঠিতে জানা যায়। জোনস স্থানীয় ডাক্তার কন্যার প্রতি আসক্ত। তেত্রিশ বছর বয়সী, সুন্দরী। গুজব নোক মুখে ছড়াতে লাগল।
শেষে স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে দরখাস্ত গেল। স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে অসংখ্য বেনামী চিঠি আসতে লাগল। বলে রাখি, অন্য কোনো সন্দেহ আমাদের মধ্যে ছিল না। নেহাতই গ্রাম্য গুজব মনে করেছিলাম। আদেশ হল কবর খুঁড়ে মৃতদেহ তোলার। গুজবের সুদৃঢ় কোনো ভিত্তি নেই কিন্তু গুজব আশ্চর্যজনকভাবে সত্যি প্রমাণিত হল। ময়না তদন্তে পাকস্থলিতে প্রচুর বিষ পাওয়া যায়। এবং মৃত্যুর কারণ ঠান্ডা মাথায় খুন। স্থানীয় প্রশাসন নয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উপর ভার পড়ল হত্যাকারীদের বা হত্যাকরীকে খুঁজে বের করার।