আমি বলি, ঘটনাটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ব্যাজওয়ার্থ বলেন, প্রাণহানি না ঘটলেও প্রচুর সোনার বাট ছিল জাহাজে। ব্যাক অন্ ইংল্যান্ডের ভল্টে যাচ্ছিল।
ডুবুরি নামিয়েও সোনা উদ্ধার করা যায়নি।
অবাক হয়ে বললাম–সোনা তো উবে যেতে পারে না।
ব্যাজওয়ার্থ বললেন–ধাক্কা খাবার সময় স্ট্রংরুমে ফাটল ধরে, যেখানে সোনা মজুত ছিল। ডুবুরিরা ফাটলের মধ্যে স্ট্রংরুমে ঢুকে সোনা পায়নি। আসল প্রশ্ন হল সোনা অপহৃত হয় ডোবার আগে না পরে। নাকি সোনা জাহাজে আদৌ তোলা হয়েছিল।
অদ্ভুত ব্যাপার তো।
ব্যাজওয়ার্থ বলেন, কেউ পকেটে ভরে নিতে পারে না, কারণ প্রচুর সোনার বাট। হয়তো, জাহাজ যাত্রা করার আগে কোনো প্রতারক সোনা সরিয়ে ফেলেছিল বা কেউ বাটগুলি অপহরণ করে। এই রহস্য উন্মোচন করতেই পলপেরানী যাত্রা।
নিউম্যান এককোণে দাঁড়িয়েছিল। দেখেই হৈ হৈ করে এগোল। বলল, মেরামতির জন্য গাড়িটা আনতে না পারায় লরি নিয়ে এসেছি। থাকা খাওয়ার অসুবিধার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করল।
আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে লরি চলল। গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পর গাড়ি উপরে উঠল। উঁচুতে ওঠার পর সমতল জায়গা, সেখানেই পাথরের প্রাসাদ পল হাউস।
পল হাউস আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে খোদিত স্পেনীয় জাহাজও সুউচ্চ চূড়ায় বাড়িটি। তিন চারশো বছরের। সামনে প্রসারিত মহাসমুদ্র। পিছনে বিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র। পাহাড়, নিবিড় জঙ্গল। প্রকৃতির রূপে প্রশান্ত চিত্ত উপন্যাস শেষ করার আদর্শ জায়গা।
সন্ধ্যায় নিউম্যান যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে জুয়ান ফারনানডেস জাহাজ সম্পর্কে অনেক নথিপত্র দেখাল। মানচিত্র খুলে বোঝাল কোন অঞ্চল দিয়ে গিয়ে কোথায় ধাক্কা খায়। কোন যন্ত্রপাতি দিয়ে সোনা উদ্ধার করবে তাও বোঝাল। বিমোহিত হয়ে পড়লাম।
ব্যাজওয়ার্থের সঙ্গে আলাপের কথা বললাম, এবং তার আসার কারণটা। আগ্রহ সহকারে সব শুনে বলল-উপকূলভাগের লোকেদের রক্তের মধ্যে দসুতা এবং ধ্বংসের প্রবৃত্তি আছে। এই অঞ্চলে জাহাজ ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেলে, ডুবন্ত জাহাজের সম্পত্তি তাদের মনে করে, হস্তগত করতে কালক্ষেপ করে না।
এইরকম লোকের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেব, যেন কোনো জলদস্যু।
পরদিন প্রথম সূর্যের আলোয় আমি আর নিউম্যান গ্রামে এলাম। একটু ফিরে গেলাম সমুদ্রতীরে কোম্পানির জাহাজঘাটায়, পরিচয় হল ডুবুরি হিগনিসের সঙ্গে, বিরাট চেহারার সঙ্গী, ধূসর পলকহীন ভাবলেশহীন মুখ। হ্যাঁ বা না ছাড়া কিছুই বলল না।
স্থানীয় রেস্তরাঁয় থ্রি অ্যাসকোরের বিয়ার খেতে গেলাম। বিয়ার খেতে খেতে আলাপ হল হিগনিসের সঙ্গে। নানা বিষয়ে কথা বলল।
জানতে চাইলাম কেমন দেখতে সমুদ্রের তলা। কি রকম মাছ ও গাছপালা আছে। ডুবুরির পোশাকে কেমন অনুভূতি।
শান্ত মেজাজেই উত্তর দিচ্ছিল। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল-লন্ডন থেকে গোয়েন্দা এসে জানবে নভেম্বরে ডুবে যাওয়া জাহাজে কত সোনা ছিল। বহু জাহাজও ডুবি হয়েছে। সরকারী সোনাও লুট হয়েছে।
হঠাৎ কার গলা শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, মিঃ কেলডিন।
আগ্রহের সঙ্গে কেলডিনকে দেখে বুঝলাম চেহারায় বিশেষ ছাপ আছে। পেশীবহুল তামাটে রং। রক্তবর্ণ চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখেই মনে হল নিউম্যান বর্ণিত জলদস্যু সর্দার।
হঠাৎ তাকিয়ে বলল, বিদেশীদের নাক গলানো তারা সহ্য করবে না, শুধু পুলিশ নয় অন্যদেরও। এই বলে তীব্র দৃষ্টি ফেলে চলে গেল থ্রি-অ্যাসকোরের মালিক কেলডিন।
বাড়ি ফেরার পথে নিউম্যান কথাবার্তায় ভয় দেখানোর হুমকি দিল। তার কাজকর্ম সে পছন্দ করছে না। নিউম্যান ওর কথায় গা করল না।
মন থেকে সন্দেহ গেল না। মনে হল এই ধরনের লোক যে কোনো ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারে। মনে হল কোথাও গণ্ডগোল হতে পারে। এই আশঙ্কায় ঘুম এল না।
মেঘলা আকাশ। ঝড়বৃষ্টি নামতে পারে। সঙ্গে অজানা আশঙ্কায় মন ছিল ভারাক্রান্ত। প্রাতঃরাশের টেবিলে নিউম্যান জানতে চাইল মুখ গম্ভীর হওয়ার কারণ।
মনের কথা জানাতেই নিউম্যান গুরুত্ব না দিয়ে বলল–অবস্থার জন্য মেঘলা আকাশ দায়ী।
একটু বেড়াতে বেরিয়েও ফিরে আসতে হল। উপন্যাস লেখার চেষ্টা ব্যর্থ, গল্প শোনার আশায় হিগনিসের খোঁজ করা হল কিন্তু পাওয়া গেল না।
সন্ধেবেলা নিউম্যানের মোটর বোটে বেরিয়ে পড়লাম।ঝড়বৃষ্টির মুখে ফিরে আসি।কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের দাপাদাপিতে বন্ধ ঘরে থাকলাম।
ঘরে ফিরে অজানা আশংকায় মন ভার হয়ে গেল। বুকটা ভার। কাঁটা বিঁধছিল মনে। যেন কিছু ঘটবে। অবস্থান বোঝাবার নয়। দশটা নাগাদ ঝড় কমল।
জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে নিউম্যান বলল-কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্লান্ত হয়ে জানালাম–গত রাত্রে ঘুম না হওয়ায় প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে আমার। তাকে একাই যেতে বললাম।
ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। মনে হল গভীর গহ্বরের পাশ দিয়ে সে হাঁটছে। পা ফসকালেই মৃত্যু। বাইরে চোখ পড়তেই দেখলাম, একটা মানুষ বাগানের পিছনে কবর খুঁড়ছে। চোখ মুছে দেখি বাগানের মালী লম্বা গর্তটি খুঁড়ছে। পাশে রয়েছে কয়েকটা গোলাপের চারা।
মালী সুপ্রভাত জানিয়ে বলল–আজকের দিনটা ভালোই যাবে। প্রত্যুত্তরে আমিও সম্মতি জানালাম।