Site icon BnBoi.Com

দি মিরর ক্রাকড ফ্রম সাইড টু সাইড – আগাথা ক্রিস্টি

দি মিরর ক্রাকড ফ্রম সাইড টু সাইড - আগাথা ক্রিস্টি

দি মিরর ক্রাকড ফ্রম সাইড টু সাইড

১. জানলার ধারে বসে

দি মিরর ক্রাকড ফ্রম সাইড টু সাইড (মিস মারপল)

জানলার ধারে বসে নিজের বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মিস মারপল। এই সেদিন পর্যন্ত বাগানের পরিচর্যায় সময় কাটানোই ছিল তার আনন্দ, কি অসীম গর্ব আর পরিতৃপ্তি ছিল একে নিয়ে। কিন্তু উপায় কি? বয়সের শৃংখল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, ডাক্তারের কঠোর অনুশাসনে কোনোরকম শারীরিক পরিশ্রম করাই বারণ হয়ে গেছে। কিন্তু জেন মারপলের মনে কিশোরীর মতো অনুসন্ধিৎসা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির খবর রাখে কজন?

নিজের আশৈশব পরিচিত এই সেন্ট মেরী মিড-এরও কি পরিবর্তন। পথ-ঘাট ও আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে গিয়েছে। বদলে গেছে দোকানগুলোর চেহারা। বেশির ভাগ বাড়িই হাতবদল হয়েছে, তাদের বাইরের চেহারা অবিকৃত রেখে ভেতরে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। প্রচুর ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে, সেখান থেকেই আসে মিস মারপল-এর ঘরের কাজে সাহায্য করার মেয়েটি। লেখাপড়া জানা মেয়ে বউরাও আজকাল এই ধরনের কাজ করতে উৎসাহী। কিন্তু মনে মনে পুরানো দিনের পরিচারিকাদের কাজের গুণগত মানের সঙ্গে এদের তুলনা করে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় নেই।

অন্যমনস্ক ভাবেই হাতের বোনাটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মিস মারপল। কাঁধের কাছে ঘর কমাতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, বহুক্ষণ আগেই একটা ঘর পড়ে গিয়েছে। এই ক্ষীণদৃষ্টি নিয়ে সেটিকে ঠিক লাইন পর্যন্ত তুলে আনা তার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। মিস নাইট-এর জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।

ওঃ, মিস নাইট-এর কথা মনে পড়লেই মনে মনে অস্বস্তিবোধ করেন যেন মারপল। ভাইপো রেমন্ড কিছুতেই একা বাড়িতে থাকতে দেবেনা তাকে, তাই মিস নাইট-কে নিযুক্ত করে দিয়েছে তার সঙ্গিনী হিসেবে। ভদ্রমহিলা অবশ্য খুবই উৎসাহী, কর্মদক্ষ, কিন্তু তার সস্নেহ ব্যবহারের মধ্যে যেন প্রতিবন্ধী শিশুর প্রতি মমতা দেখানোর প্রয়াস আছে বলে মনে হয় মিস মারপল-এর। আর এটাই ভীষণ বিরক্তিকর বলে মনে হয় তার।

আজ কিন্তু আর ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। মিস নাইটকে কয়েকটা কাজের ছুতোয় বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে একাই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। ঐ নতুন ফ্ল্যাটগুলো তো দেখাই হয়নি তাঁর। নতুন মুখগুলোর সঙ্গে তার ফেলে আসা অতীতের মানুষজনের মিল খুঁজে বার করতে পারলে ভারি খুশি হন মিস মারপল। এতে মানুষগুলোকে বুঝতে সুবিধা হয় তার।

একটি অর্ধ সমাপ্ত বাড়ির জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল একজোড়া তরুণ তরুণী। কথা শুনে মনে হলো, শিগগিরই বিয়ে করতে যাচ্ছে ওরা। এত বড়ড়া বাড়ি কেনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ছেলেটির, এত টাকা খরচ করতে চায় না সে। কথাবার্তায় এ-ও বোঝা গেল ভাবী শাশুড়ীটিকেও মোটেই পছন্দ নয় ছেলেটির। এমন সময় ঘটলো এক অভাবনীয় দৃশ্য। খোলা জানলায় আড়াআড়িভাবে রাখা একটি আলগা বোর্ডে অন্যমনস্কভাবে হাতের চাপ একটু বেশি দিয়ে ফেলেছিল মেয়েটি। শেষ মুহূর্তে দেওয়াল আঁকড়ে ধরতে না পারলে নির্ঘাৎ ওপর থেকে আছড়ে পড়তো মাটিতে। ছেলেটি কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে একটু পিছিয়ে পড়লো।

একটু পরেই নিচে নেমে এলো মেয়েটি। ফ্ল্যাটটিতে তালা বন্ধ করে ছেলেটির নামতে যতটুকু দেরি হলো, তার মধ্যেই মিস মারপল ছেলেটি সম্বন্ধে মেয়েটিকে সতর্ক করে দিতে ভুললেন না। দেখে খুশি হলেন তার কথাটি উড়িয়ে দিল না মেয়েটি, রীতিমতো চিন্তিত দেখালো তাকে।

ছেলেটির মুখোমুখি হতে চান না মিস মারপল, একটু তাড়াতাড়িই পা চালালেন তিনি, এবং ভুলটা হলো এখানেই, একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে একেবারে পপাত ধরণীতল। বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষটির হাত-পা অবশ্য ভাঙলো না, কিন্তু বিলক্ষণ নাড়া খেলেন তিনি। সামনের বাড়ির মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ব্যাপার দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে হাত ধরে তুলে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। তাড়াতাড়ি চা নিয়ে এলেন তার জন্য।

অত্যন্ত আলাপী মহিলা এই মিসেস বেডকক। টুকটাক সমাজসেবা করে আনন্দ পান এই প্রাণোচ্ছল মহিলা। একবার যেটা মনে হয়, করেই ছাড়েন। অনেকদিন আগের একটা ঘটনা বললেন, বিখ্যাত অভিনেত্রী মেরিনা গ্রেগ, যিনি বহুবিবাহ করার জন্যও বিশেষ প্রসিদ্ধ, তার সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পেয়ে ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও অসুস্থ শরীর মেক-আপ-এ ঢেকে চলে গিয়েছিলেন মিসেস বেডকক। আরও জানালেন, একটি বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে মেরিনা, চলে যান যবনিকার অন্তরালে। এখন আবার পর্দায় ফিরে আসছেন তিনি। আর ঐ মেরিনা গ্রেগ ও তার পরিচালক স্বামী এই সেন্ট মেরী মিড-এর গসিংটন হলটি কিনেছেন, যে বাড়ির লাইব্রেরিতে একসময় একটি তরুণীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়ে যথেষ্ট উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল।

পরদিন গসিংটন হল-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন মিস মারপল। ঐ বাড়িটির আদি মালিক মিসেস ব্র্যান্ট্রি তার অনেকদিনের বন্ধু। স্বামীর মৃত্যুর পর এই বাড়ির সংলগ্ন একটি কুটির আর কিছুটা ঘেরা বাগান নিজের জন্য রেখে, ঐ বিশাল বাড়ি ও জমি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। অতএব প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। বছরের অনেকটা সময়ই তিনি দেশে বিদেশে ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের কাছে ঘুরে বেড়ান। মাঝে মাঝে এই আরামদায়ক ছোট্ট বাড়িটিতে কাটিয়ে যান।

মিসেস ব্র্যান্টির কাছে জানা গেল, বেশ কয়েকবার হাতবদল হওয়ার পর বাড়িটি সত্যিই এখন মেরিনা গ্রেগ কিনেছেন, বাড়িটির ভেতরের অংশ বহু অর্থব্যয় করে বিপুল সুবিধাজনক পরিবর্তন করেছেন, এবং বর্তমানে এখানেই থাকতে আসছেন। মেরিনা-র সঙ্গে বেশ কিছুদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় আলাপ হয়েছিল মিসেস ব্র্যান্টি-র। খুবই আকর্ষণীয় মহিলা এই চিত্রতারকাটি। এই জনপদের কয়েক মাইলের মধ্যেই হেলিংফোর্থ-এর নতুন স্টুডিওটিতে মেরিনার স্বামী জ্যাসন হ্যাড-এর পরিচালনায় একটি ছায়াছবি তৈরির কাজ চলছে। তাতে অস্ট্রিয়ার এলিজাবেথ-এর ভূমিকায় অভিনয় করছেন মেরিনা।

কিছুদিন পরেই গসিংটন হলে সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্স-এর উদ্যোগে একটি মেলার আয়োজন করা হয়েছে। তাতে অংশ নেবেন মেরিনা।

মেরিনার প্রসঙ্গ শেষ করে এবার মিস মারপল-এর খবরাখবর নিয়ে ব্যস্ত হলেন মিসেস ব্র্যান্টি। তিনি শুনেছেন, ফ্ল্যাটবাড়িগুলি দেখতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন জেন মারপল। কিন্তু ওখানে যাওয়ার দরকার কি ছিল?

অবাক হলেন জেন?

–তুমি কি করে জানলে?

-আরে, ঐ ফ্ল্যাটবাড়িগুলির একটি থেকেই তো আমার বাড়ি রোজ কাজ করতে আসে। মিসেস মিভি। এই সেন্ট মেরী মিড-এ কোনও খবর গোপন থাকে না জেন। তা তুমি কি করতে গিয়েছিলে সেখানে?

-দেখতে গিয়েছিলাম জায়গাটা কেমন, ওখানকার মানুষগুলো কেমন?

–কেমন দেখলে?

–অন্য আর পাঁচজনের মতোই, খুবই চেনা চরিত্র। দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম।

–কেন?

–চরিত্রগুলো চেনা হলে খুব সুবিধে হয়, ধরো যদি কোনো তেমন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে কেন হলো, কার জন্য হলো, এসব বুঝতে তেমন অসুবিধে হয় না।

ঘটনা মানে? খুন জখমের কথা ভাবছো নিশ্চয়ই?

–আমি যে সব সময় খুন-এর কথাই ভাবি, এ কথা মনে করছো কেন?

–তোমাকে তো কম দিন ধরে দেখছি না জেন, আচ্ছা নিজেকে অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলে জাহির করতে আপত্তি কোথায় তোমার?

-কেননা, আমি সেরকম কিছুই নই। এরকম একটা গ্রামে থাকলে মানব চরিত্র সম্বন্ধে মোটামুটি একটা জ্ঞান অর্জন করাটা তেমন অসম্ভব কিছু নয়। যাই হোক, এবার আমি চলি, নইলে মিস নাইট ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

সত্যিই উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিলেন মিস নাইট, এই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে পেরে ওঠা মুস্কিল। মিস মারপলকে নিরাপদে ফিরতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি। সর্বনামে বহুবচন ব্যবহার করা অভ্যেস তার, গম্ভীরভাবে বললেন।

–আমরা এখন নিশ্চয়ই খুবই ক্লান্ত?

–তুমি ক্লান্ত হলেও হতে পারো, আমি কিন্তু একটুও ক্লান্ত নই।

–আগুনের পাশে একটু আরাম করে বসুন। এক কাপ ওভালটিন খাবেন, না কি হরলিক্স?

–একটু ড্রাই শেরী নিয়ে এসো। প্রস্তাবটা পছন্দ হলো না মিস নাইট-এর,ডাক্তার এ ব্যাপারে মত দেবেন কি না–

–সে কাল সকালে তাকে জিজ্ঞেস করে নিলেই হবে, এখন নিয়ে এসো তো।

গসিংটন হল-এ চায়ের নেমন্তন্নে যোগ দিতে এলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। পুরোনো বাড়িটিকে ভেঙে-চুরে মনের মতন করে সাজিয়েছেন নতুন বাসিন্দারা। সুমধুর ব্যবহার মেরিনার। এই মধ্যবয়সেও যথেষ্ট মনোহারিনী। তার স্বামী জ্যাসন হাড, আপাতদৃষ্টিতে কুদর্শন হলেও, গভীর চোখের দৃষ্টি ও অকপট হাসিতে ভেতরের মানুষটিকে চিনিয়ে দেয়। মেরিনা বারে বারেই বলছিলেন, এই বাড়িটি খুব ভালো লেগেছে তার, এখানেই থাকতে চান সারাজীবন। কিন্তু এমন কথা হয়তো আরও বহুবার বহু-জায়গার ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে তার। মেরিনার সেক্রেটারি এলা-র সঙ্গে পরিচয় হলো। তারও ধারণা শিল্পীরা, বিশেষ করে চিত্রতারকারা এক জায়গায় বিশেষ করে বেশিদিন আটকে থাকতে পারে না। অশান্ত মন ছুটিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তাদের। বাস্তবের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই তাদের। আর, জীবনে এত বেশি উত্থান-পতন আর সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে মেরিনা, যে তার ভাবাবেগগুলিও একটু অস্বাভাবিক ভাবেই প্রবল। এলার কাছ থেকেই জানতে পারলেন মিসেস ব্যান্ট্রি, জ্যাসন প্রচণ্ড ভালোবাসেন স্ত্রী মেরিনাকে। তাকে আনন্দে রাখার জন্য সব কিছুই করতে পারেন।

বহুদিনের বন্ধু ডাক্তার হেডক মিস মারপলকে দেখতে এসে একটি আশ্চর্য প্রেসক্রিপশান দিয়ে গেলেন, নতুন কোনো রহস্য সমাধানের চেষ্টা করাই জেন মারপলের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একমাত্র প্রয়োজনীয় ওষুধ। মিস নাইট মন্তব্য করলেন, ঐ নতুন আবাসনগুলিতে খুন জখমের মতো ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়, কেননা, ওখানে প্রচুর ছেলেছোকরা আছে, যাদের চেহারা ও গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক বলে মনে হয়।

খুনটা সত্যিই হলো, তবে আবাসন-এ নয়।

সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্সের মেলা-র জন্য গসিংটন হল খুলে দেওয়া হয়েছে। এত ভিড় হয়েছে যে বলার কথা নয়। প্রবেশ মূল্যের পাহাড় জমে যাচ্ছে। চমৎকার আবহাওয়া আজ, পরিষ্কার রৌদ্রজ্জ্বল দিন, কিন্তু এত দর্শক সমাগমের সেটাই একমাত্র কারণ নয়, সকলেই গসিংটন হল-এর নতুন চেহারাটা দেখতে চায়, সেই সঙ্গে যদি মেরিনা গ্রেগকে একঝলক দেখতে পাওয়া যায়, তবে তো সোনায় সোহাগা।

সবথেকে বেশি আকর্ষণ করছে সুইমিং পুলটা। যদিও এখানকার আবহাওয়ায় সাঁতার কাটার মতো দিন খুবই কম পাওয়া যায়। এসব জিনিস হলিউড-এই মানায়। তবু বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে মানুষজন এই বিপুল অর্থব্যয়ে গড়ে তোলা নয়নাভিরাম জলাশয়টি দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে লাগলো।

বিকেলবেলা বাড়তি এক শিলিং দক্ষিণার বিনিময়ে দর্শকরা গসিংটন হলের ঘরগুলি ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়ে উফুল্ল হয়ে উঠলো মেলার জনতা। স্থানীয় লোকেদের তো বিশ্বাসই হতে চাইলো না যে, এটা সেই তাদের বহুবার দেখা প্রাচীন গসিংটন হল।

বাগানের বড়ো ছাউনির তলায় চা এবং জলযোগের আয়োজন করা হয়েছিল। ভিড়ে ও গরমে সেখানে প্রাণ ওষ্ঠাগত ব্যান্ট্রি-এর। কিন্তু সব ব্যাপারটা বেশ সুদক্ষ হাতে পরিচালিত হচ্ছে, এবং মেলার মুখ্য উদ্দেশ্য যে সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা, সেটাও আশাতীতভাবে সফল হতে চলেছে দেখে মনে মনে উৎফুল্লও হলেন তিনি।

এমন সময় জ্যাসন হ্যাড-এর একজন সহকারী হেইলি প্রেস্টন খুঁজে বার করলো মিসেস ব্যাট্রিকে। মেরিনা এবং জ্যাসন কয়েকজন বিশিষ্ট অতিথিকে আপ্যায়ন করছে চান, এই বাড়ির পুরোনো মালিক হবার সুবাদে ব্যান্ট্রিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

সিঁড়িতে ওঠার মুখে কাউন্সিলার অ্যালকক ও তার পৃথুলা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা। রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন ভদ্রমহিলা, তবু ব্যাট্রিকে দেখে তার মনের সাধটি ব্যক্ত করতে ভুললেন না। এইসব চিত্রতারকাদের বিলাসবহুল বাথরুমগুলি কেমন হয়, সেটা দেখার খুব ইচ্ছে তাঁর, কিন্তু সেটা আর সম্ভব হবে?

সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন জ্যাসন হাড ও মেরিনা গ্রেগ। ভারি সহজ স্বাভাবিক ও সুন্দরী দেখাচ্ছে মেরিনাকে। কি গভীর অধ্যবসায়ের সাহায্যে নিজের এই ভাবমূর্তিটি তৈরি করেছেন মেরিনা, সেকথা কজনই বা জানে?

মিসেস ব্যাট্রিকে স্বাগত জানালেন মেরিনা। জ্যাসন তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের হাতে তুলে দিলেন তাদের পছন্দমতো পানীয়ের পাত্র। ইতিমধ্যে পরবর্তী অভ্যাগতরা এসে গেছে। এঁদের মধ্যে আছেন মিস্টার ও মিসেস বেডকক। মিসেস বেডকক সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্সের স্থানীয় সম্পাদিকা। আজকের এই অনুষ্ঠানটি সংঘটিত হওয়ার পেছনে তার পরিশ্রমই সবথেকে বেশি। মেরিনাকে কাছে পেয়ে উৎসাহে যেন টগবগ করে ফুটছিলেন এই ভদ্রমহিলা। সবিস্তারে শোনাতে লাগলেন বারো তেরো বছর আগে বাড়াতে কিভাবে মেরিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য অসুস্থ শরীরে ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করার জন্য চলে গিয়েছিলেন তিনি। অত্যন্ত ভদ্র হাসি ঠোঁটে রেখে মহিলার বকবকানি সহ্য করে যাচ্ছিলেন মেরিনা, দেখে মায়া হচ্ছিল মিসেস ব্যান্ট্রিরহঠাৎ মেরিনার দিকে চেয়ে চমকে উঠলেন তিনি, মেরিনার দৃষ্টি কিন্তু মিসেস বেডকক-এর দিকে নেই। সিঁড়ির ওপর টাঙানো শিশুকোলে ম্যাডোনার একটি ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন মনে হলো। মুখ হয়ে গেছে কাগজের মতো সাদা। দেখে কেন জানি না টেনিসনের লেডি অব শ্যালট কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়লো মিসেস ব্যান্ট্রির।

এই অবস্থা থেকে মেরিনাকে উদ্ধার করলেন তার স্বামী জ্যাসন। মেরিনা-র প্রিয় পানীয়ের দুটি পাত্র তিনি তুলে দিলেন স্ত্রী ও মিসেস বেডককের হাতে। পানীয়ের পাত্র হাতে নিয়ে এবার এগিয়ে যেতে বাধ্য হলেন মিসেস বেডকক। মেরিনা সদ্য আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

মিসেস ব্যান্ট্রি তখন চললেন কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে দোতলার বাথরুমগুলো দেখতে। এমন জিনিস তারা আগে কখনো দেখেননি। বিলাস ও বৈভবের মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে যেন এখানে।

এমন সময় মেরিনার সেক্রেটারি এলাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল বাথরুমের দিকে। মিসেস বেডকক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, বাথরুমের ম্যাডিকেল ক্যাবিনেটে প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ পাওয়া যায় কিনা দেখতে এসেছে সে।

সদলবলে হন্তদন্ত হয়ে ঘটনাস্থলে ফিরে এলেন মিসেস ব্যান্ট্রি, সিঁড়ির মুখে জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগছিল তার। জ্যাসনের কাছেই জানা গেল, আর কোনো সাহায্যেরই দরকার নেই মিসেস বেডকক-এর। সেই স্বাস্থ্যবতী প্রণোচ্ছল মহিলাটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন।

মিস মারপলের বিছানায় প্রাতরাশের ট্রে নিয়ে এলেন মিস নাইট। জানালেন, একটু আগে মিসেস ব্যান্ট্রি ফোন করেছিলেন, কিন্তু প্রাতরাশ খাওয়ার আগে মিস মারপলকে এটা জানানো তিনি উচিৎ বলে মনে করেননি। কথাটা শুনে একটু অসন্তুষ্ট হলেন মিস মারপল। জানালেন, বন্ধুদের ফোন এলে, সেটা তিনি সঙ্গে সঙ্গেই জানতে চান। প্রাতরাশটা বেশ যত্ন নিয়েই তৈরি করেন মিস নাইট, সেটা অবশ্য জানাতে বাধ্য হলেন মিস মারপল। জলযোগ শেষ করে মিসেস ব্যাট্রিকে ফোন করলেন তিনি, কিন্তু জানা গেল, তিনি বাড়ি নেই, মিস মারপল বুঝতে পারলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যই আসছেন বান্ধবীটি।

বাইরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে তরুণী মিসেস চেরী বেকার-এর গান। মিস নাইট মোটেই পছন্দ করেন না ব্যাপারটা, আগেকার দিনের পরিচারিকারা গান গাইতে গাইতে কাজ করছে, এটা ভাবাই যেত না। জেন মারপলের কিন্তু বেশ লাগে এই প্রাণোচ্ছল মেয়েটিকে। নিজে প্রায় গৃহবন্ধীর জীবনযাপন করেন, বাইরের জগৎ সম্বন্ধে তার চিরকালের অনুসন্ধিৎসা কিন্তু একটুও কমেনি। সেই অভাবটা অনেকটাই মিটিয়ে দেয় এই মেয়েটি।

দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকলো চেরী। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে সে, কালকের খবরটা শুনেছেন কি মিস মারপল?

-কিসের খবর?

কালকে গসিংটন হল-এ যে মেলা বসেছিল, সেখানে হঠাৎ একজন মারা গেছেন?

–শুনিনি তো, কে মারা গেছেন?

–আপনি চিনবেন না। আমাদের ওদিকে থাকেন। মিসেস বেডকক।

মিসেস বেডকক? হ্যাঁ, চিনি বই কি, ওঁর বাড়ির সামনেই তোত আমি পড়ে গিয়েছিলাম। খুবই সহৃদয় ব্যবহার করেছিলেন আমার সঙ্গে।

-ওঃ হিথার বেডকক দয়ালু ছিলেন তো বটেই, বোধহয় একটু বেশিমাত্রাতেই দয়ালু, মানে লোকে তাই বলে আর কি। তিনিই মারা গেছেন।

-কিভাবে? তাকে তো যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী বলেই মনে হয়েছিল।

–ঠিক জানি না, সেন্ট জন-এর সেক্রেটারি হিসেবে ওপরের পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে নাকি একপাত্র পানীয় পান করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মারা গেছেন। কারণটা কেউ বুঝতেই পারছে না।

–কি ভয়ংকর ঘটনা! ওঁর কি হার্টের কোনো রোগ ছিল?

-সেরকম তো কিছু শুনিনি, তবে শুনলাম, ওঁর মৃতদেহ নাকি পোস্টমর্টেম-এর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, তিনি আগে মিসেস বেডকক-এর কোনো অসুখের চিকিৎসা করেননি। বুঝতে পারছেন না ঠিক কিভাবে এই মৃত্যু হলো।

ভদ্রমহিলাকে চিনতে তুমি?

-খুব একটা আলাপ ছিল না। এমনিতে উনি খারাপ লোক নন। কিন্তু অন্যের উপকার করার উৎসাহে বা কথা বলার সময়, অন্যের ওপর সেটার কি প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা একটুও ভাবতেন না।

চেরী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস ব্যান্ট্রি এসে ঢুকলেন।

-তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে জেন।

কাল যে মৃত্যুটা ঘটেছে গসিংটনে, সে সম্বন্ধে?

–তুমি সব সময়েই সব খবর পেয়ে যাও, কিভাবে পাও, কিছুতেই বুঝতে পারি না।

–যেভাবে সকলে পায়। আমার রোজকার সহকারিণী চেরী বেকার খবরটা দিয়েছে এখনই। দেখো, মিস নাইটও নিশ্চয়ই এতক্ষণে রুটিওয়ালার কাছ থেকে খবরটা জানতে পেরে গেছেন।

-তা, এ বিষয়ে তোমার কি মনে হয়?

–কি বিষয়ে?

–না বোঝার ভান কর না জেন, আমি তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি। এই যে সম্পূর্ণ সুস্থ ও প্রাণোচ্ছল মিসেস বেডকক হঠাৎ এ ভাবে মারা গেলেন, এ বিষয়ে তুমি মনে মনে কি ভাবছো?

–এ রকম তো যে কোনো মানুষেরই হতে পারে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে হয়তো জানা যাবে

-অত সহজ নয় ব্যাপারটা, শুনলাম ডক্টর স্যানফোর্ড পুলিশকে ফোন করেছেন।

–সেটা আবার জানলে কিভাবে?

–পুরানো পদ্ধতি। মালী বুড়ো বিগ্রস ওঁর স্টাডির কাছেই বাগানের কাজ করছিল, সে শুনেছে সে তার মেয়েকে বলেছে, সেখান থেকেই এসেছে খবরটা। যাই হোক, এ বিষয়ে তুমি কি ভাবছো?

-প্রথমে অবশ্য মহিলার স্বামীর কথাই মনে হচ্ছে। সে কি ওখানে উপস্থিত ছিল?

নিশ্চয়ই। আচ্ছা, তুমি কি এটাকে আত্মহত্যা বলে ভাবছে।

–না, আমি তাকে যতটুকু দেখেছি সেদিন, ঐ মনের মানসিকতা তার থাকতেই পারে না।

-স্বামীকেও তো দেখেছো, কেমন লোক বলে মনে হলো? সে কি স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে? এই ধরনের তোমার চেনা কোনো চরিত্রের সঙ্গে কি তার কোনো মিল খুঁজে পেয়েছে?

-না, তবে মিসেস বেডকক-এর সঙ্গে অ্যালিসন ওয়াইল্ড-এর মিল পেয়েছি। অর্থাৎ অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক চরিত্র। মানে স্বার্থপর বলছি না, তবে পৃথিবী, বা তার লোকজন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যাদের। নিজের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে সবকিছু। এমন কিছু বলে বা করে ফেলে, যার প্রতিক্রিয়া অন্যের মধ্যে কিভাবে হবে, তা একবারও ভেবে দেখে না। কাজেই বিপদে পড়লে আত্মরক্ষাও করতে পারে না।

-বুঝলাম না কিছুই।

দাঁড়াও, একটা কাল্পনিক গল্পের উদাহরণ দিয়ে বোঝাই তোমাকে। মনে কর, কোনো দোকানে গিয়ে তুমি পরিচিত দোকানদারের কাছে নিতান্ত অকারণেই বলে ফেললে তোমার ঘরে খুব একটা দামী জিনিস বা বেশ কিছু টাকা আছে, কিন্তু চাবি তালা লাগানোর ব্যাপারে তোমার খেয়াল খুব কম। সপ্তাহের কোনো একদিন সন্ধ্যেয় বাড়ি খালি রেখে তোমাকে কোথাও একটা যেতে হবে সে কথাও জানালে। দোকানীর বিগড়ে যাওয়া ছেলেটি যে সব কথা শুনছে, সেটা খেয়াল করলে না। সেই নির্দিষ্ট দিনে তুমি কোনোও কারণে হঠাৎ অসময়ে বাড়ি ফিরে দেখলে, সেই ছেলেটি চুরি করার উদ্দেশ্যে তোমার ঘরে ঢুকেছে। হাতে-নাতে ধরা পড়ে গিয়ে মরিয়া হয়ে সে তোমাকে আক্রমণ করে বসলো। এইভাবে নিজের বিপদ, নিজের স্বভাবের দোষেই তুমি ডেকে আনলে না কি?

তার মানে তুমি বলতে চাইছো মিসেস বেডকক না বুঝেই একটা বিপদজনক কাজ করে ফেলেছিল?

হতে পারে, আবার এ-ও হতে পারে, খুনটা অন্য কাউকে করার উদ্দেশ্যে ছিল, ভুলক্রমে উনি খুন হয়ে গেছেন।

আচ্ছা ডলি, তুমি তো পুরো ব্যাপারটা দেখেছো, ঠিক বলো তো, কি করে কি হলো?

–ওপরে গিয়ে দেখলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই যে বাড়তি বেডরুমটা ছিল সেটা ভেঙ্গে একটা চাতাল মতো করা হয়েছে। সেখানেই হচ্ছিল পার্টিটা। মেরিনা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে অতিথিদের সঙ্গে দু-একটা কথা বলছেন, তারপর তার স্বামী ও তাদের সহকারীরা অতিথিদের নিয়ে গিয়ে পানীয় দিয়ে আপ্যায়িত করছেন। আমার পরেই সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল মিস্টার ও মিসেস বেডকক। ভদ্রমহিলা বেশ কিছুক্ষণ একাই অধিকার করে রাখলেন মেরিনাকে। বকবকানি আর থামতেই চায় না, সেই কবে তরুণ বয়সে চিকেন পক্স নিয়েই মেরিনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন না, কি যেন! ইত্যাদি ইত্যাদি, ভদ্রতাবশত মুখে হাসি নিয়ে শুনছিলেন মেরিনা। হঠাৎ একবার সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলেন, একদৃষ্টে মিসেস বেডককের মাথা ছাড়িয়ে বাঁদিকে তাকিয়ে আছেন মেরিনা, মুখে কেমন একটা বিবর্ণতা, যেন সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে তার। অবশ্য পরক্ষণেই জ্যাসন হাড স্ত্রীকে সচকিত করে দুজনের হাতে একইরকম পানীয়ের গ্লাস তুলে দিয়ে মিসেস বেডকককে সরিয়ে এনে অন্য অতিথিদের মেরিনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিলেন।

–যেদিকে তাকিয়ে ছিলেন মেরিনা, সেদিকে কি ছিল?

হতে পারে যীশু কোলে ম্যাডোনার ছবিটির দিকে, অথবা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা কোনো অতিথি বা ক্যামেরা নিয়ে থাকা মেয়েটির দিকে, বা অন্য কোনো পরিচালকদের দিকে, তা বলতে পারবো না।

যাই হোক, তারপর কি হলো?

–তারপরে তো আমি মহিলাদের সঙ্গে বাথরুমগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেই মেরিনার মহিলা সেক্রেটারিটি এসে জানালো কেউ একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খুব সাদাসিধে ভাবেই ইনকোয়েস্ট হয়ে গেল। জানা গেল খুব বেশি মাত্রায় স্নায়ু উত্তেজনা প্রশমনকারী একটি ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল মিসেস বেডককের পানীয়ের মধ্যে। কিভাবে এটা করা হয়েছিল, তা জানা যায়নি।

ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ফ্র্যাংক কর্ণিশ একান্তে ডেকে নিলেন আর্থার বেডকককে। বললেন, তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান তিনি। এই কদিনেই যেন আরও শীর্ণ ও অবসন্ন হয়ে পড়েছেন আর্থার বেডকক। কি করে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, তা বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন তিনি।

কর্ণিশের গাড়িতেই আর্থার-এর বাড়িতে নিরিবিলিতে কথা বলতে এলেন দুজন। পাশের বাড়ির একজন বিধবা মহিলা এদের জন্য চা-এর ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন। আর্থারের কাছ থেকে অবশ্য তেমন কিছু শোনা গেল না। তবে জানা গেল, কোনো অসুখের ইতিহাস নেই মিসেস বেডকক-এর। এখানে বাড়ি নেওয়ার পর বছর ঘুরে গেছে ওদের, তার মধ্যে একবারও ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি তাকে। যে ওষুধের প্রয়োগে তার মৃত্যু হয়েছে সেটার নামও শোনেননি কখনও।ইনসপেক্টর জানালেন ওষুধটি ক্যালমো নামে আমেরিকায় প্রচলিত। সাধারণত ছায়াছবির জগতে বাসিন্দারা অতিরিক্ত টেনশন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এটা অল্প মাত্রায় সেবন করে থাকেন। গসিংটন হলের প্রায় প্রতিটি ঘরেই ওই ওষুধের শিশি পাওয়া গেছে।

আর্থার দৃঢ়ভাবেই জানালেন টেনশন থেকে মুক্তি পাওয়ার বা মানসিক প্রফুল্লতা আনার জন্য কোনো ওষুধই ব্যবহার করার অভ্যেস ছিল না তার স্ত্রীর।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আর্থার বললেন, কারো হাত লেগে তার স্ত্রীর হাতের পানীয়ের গ্লাসটি পড়ে ভেঙে যায়। মেরিনা তাঁর নিজের হাতের গ্লাসটি নিতে অনুরোধ করেন তাকে। সেটি নিয়ে একটু এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসেন মিসেস বেডকক, এবং গ্লাসে দু-এক চুমুক দিয়েই ঢলে পড়েন, ডাক্তার এসে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। সব ব্যাপারটা যেন এক লহমার মধ্যে ঘটে গেল, যে এখনও সত্যি বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আর্থারের।

স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চীফ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক সেন্ট মেরী মিড গ্রামটির নাম শুনেই চমকে উঠলেন। সেখানকার গসিংটন হল-এ একটি মৃত্যু হয়েছে, সেই সমস্যার সমাধানের জন্য স্থানীয় প্রশাসন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দ্বারস্থ হয়েছে। ঐ গ্রামের বাসিন্দা মিস জেন মারপল-কে বহুদিন আগে থেকেই চেনেন ডার্মাট ক্র্যাডক। বহু রহস্য সমাধানে তার কাছ থেকে পেয়েছেন অমূল্য সাহায্য। অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার মেরিনা গ্রেগ, গসিংটন হল, মিসেস বেডকক সম্বন্ধে সব কিছু জানালেন ক্র্যাডক-কে। অবিলম্বে একজন সহকারীকে নিয়ে সেন্ট মেরী মিড-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পরামর্শ দিলেন তাকে।

ক্র্যাডককে দেখে আনন্দে গোলাপী হয়ে উঠলো জেন মারপলের মুখ। কতদিন পরে দেখা এই ছেলেটির সঙ্গে, অবশ্য এখন আর একে ছেলেটি বলা যায় না, চাকরিতেও যথেষ্ট উন্নতি করেছে, সেটা পদমর্যাদা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ক্র্যাডক জানালেন, এখানকার গসিংটন হলের কাজটা পেয়েই তিনি আন্টি জেন-এর কাছে চলে এসেছেন, কেননা এটাকেই তিনি এখানকার হেডকোয়ার্টার বলে মনে করেন।

কিন্তু আমি তো এখন আর তেমন বাইরে বেরোতেই পারি না, কাজেই সেরকম কোনো খবরও পাই না।

-কিন্তু আপনি একদিন বেরিয়েই মিসেস বেডকক-এর বাড়ির সামনে পড়ে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলেন। সেই মহিলাই তো খুন হয়েছেন?

–কোথা থেকে এত খবর পেলে?

–আপনি তো নিজেই একবার বলেছিলেন, গ্রামে সবাই সবারকার কথা জানতে পারে। তা আপনি কি তখনই মহিলাকে দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, যে তিনি খুন হতে চলেছেন?

-কি অসম্ভব কথা! সেরকম মনে হবে কেন?

-তার স্বামীকে দেখে কিছু মনে হয়নি? অতীতের কোনো পত্নীহন্তার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাননি?

-মোটেই না, আর্থার বেডকক খুবই সাদাসিধে, ভালোমানুষ। অবশ্য আমার মনে হয় না স্ত্রীর অভাবে তেমন কষ্ট পাবেন ভদ্রলোক। কেননা ভদ্রমহিলা খুব সহৃদয় এবং সেবাপরায়ণ ছিলেন বটে, তবে অন্য লোকের মনের কথা তেমন বুঝতে পারতেন না, অথবা, চেষ্টা করার কথা ভাবতেনই না। এসব ক্ষেত্রে স্বামীরা খুবই একা মনে করে নিজেকে। সে যাক, মূল ঘটনা আমি তেমন ভাবে জানি না। তুমি আমার বান্ধবী ডলি ব্যান্ট্রির সঙ্গে দেখা কর। অনেক কিছু জানতে পারবে।

–তিনি কি ঐ ফিল্ম জগতের লোক?

-না না। এখানকার পুরোনো বাসিন্দা, গসিংটন হল-টা ওঁদেরই ছিল, বিক্রি করে দিয়েছেন। উনি সেদিন পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।

তিনি পার্টিতে ছিলেন? বিশেষ কিছু লক্ষ্য করেছিলেন?

–উনিই বলবেন, উনি কি দেখেছেন, তবে বিশেষ করে লেডি অব শ্যালট-এর কথা জিজ্ঞেস করো। তাহলে ওর সেই কথাটি মনে পড়বে।

-ওটা কি কোনো কোড ওয়ার্ড নাকি?

–শুনেই দ্যাখো।

মিসেস ব্যান্ট্রি, ক্র্যাডককে দেখে একটু অবাক হলেন তা-ও আবার জেন পাঠিয়েছে ওঁকে?

–কি শুনতে চান বলুন?

এটা কি তাহলে সত্যিই হত্যা?

–আপনার কি তা-ই মনে হয়?

–দুর্ঘটনাও হতে পারে। কেউ-ই এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। আর যদি হত্যাও হয়, তবে এটা কার পক্ষে করা সম্ভব, তাও তো বোঝা যাচ্ছে না। মিসেস বেডককের কি প্রচুর টাকা ছিল?

-না, তেমন কিছুই ছিল না।

–আচ্ছা, উনি কি কাউকে ব্ল্যাকমেল করতে পারতেন, বা কারো গোপন কথা জানতেন বলে মনে করেন?

ঘাড় নাড়লেন মিসেস ব্যান্ট্রি।

-না, আমার তা মনে হয় না, কোনো গোপন কথা জানলেও প্রথম সুযোগেই জানিয়ে দিতেন উনি, ওঁকে বিশ্বাস করে কেউ কোনো গোপন কথা বলবে বলেও মনে হয় না। আর, ব্ল্যাকমেইলের মতো নিচ কাজ করার চিন্তা ওর মাথায় আসা সম্ভব নয়।

-মিস মারপল আপনাকে লেডি অব শ্যালট-এর কথা মনে করিয়ে দিতে বলেছিলেন।

-ওঃ, সেই টেনিসনের কবিতায় আছে না, আয়নাটা চূর্ণ হয়ে গেল, তার ওপর ধ্বংস নেমে আসছে? সেই কবিতা মনে পড়ে গিয়েছিল মেরিনা-কে দেখে।

তার মানে?

–জেন আপনাকে অনেক ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পারতো। যাই হোক, ব্যাপারটা হচ্ছে, মিসেস বেডকক-এর একঘেয়ে কথা শুনতে শুনতে একসময় যেন মনে হলো, মেরিনা মোটেই মন দিচ্ছেন না, মিসেস বেডককের পেছনে অনির্দিষ্ট কিছুর দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখ হয়ে উঠেছে পাংশু, যেন কোনো সর্বনাশের ইঙ্গিত পেয়েছেন। সেই মুখটা দেখেই আমার লেডি অব শ্যালটের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

গসিংটন হল-এ সরেজমিন তদন্তে গেলেন ক্র্যাডক। জ্যাসন হাড-এর সেক্রেটারি হেইলি প্রেসটন-এর কাছ থেকে জানা গেল, সেদিন পার্টিতে কাদের ওপরে ডাকা হয়েছিল, কর্মচারীদের মধ্যেই বা কে কে উপস্থিত ছিল। আরও জানা গেল বাড়ির সবাই ঐ ক্যালমো ড্রাগটি প্রয়োজন হলে অল্পমাত্রায় সেবন করে থাকে। মহিলাদের তো হ্যান্ডব্যাগেই থাকে, যখন দরকার হয়, পানীয়ের সাথে মিশিয়ে নেন। এমনকি সেটন নিজেও তাই করে।

মেরিনা-র সঙ্গে অবশ্য দেখা করা গেল না। ডাক্তার গিলক্রিস্ট জানালেন, মেরিনা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সব শিল্পীর মতোই আবেগপ্রবণ। এই আকস্মিক দুর্ঘটনা তাকে শয্যাশায়ী করে ফেলেছে। অগত্যা ক্র্যাডক জ্যাসন হাড-এর সাক্ষাৎ প্রার্থী হলেন।

একনজরেই জ্যাসনকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং দৃঢ়চরিত্র বলে চিনে নিতে ভুল হলো না ক্র্যাডক-এর। সেদিনের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন তিনি। ক্ষণিকের জন্য তার স্ত্রী যে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলেন, সে কথাও স্বীকার করলেন। এবার ক্র্যাডক জিজ্ঞেস করলেন, জ্যাসনের কি মনে হয় না, এই মৃত্যুটা একটা দুর্ঘটনা। আসলে হত্যাকারীর লক্ষ্য ছিল অন্য কেউ? সম্ভবত তার স্ত্রী?

একটু চুপ করে থাকলেন জ্যাসন, তারপর বললেন, তারও সেরকমই ধারণা হয়েছিল। তবে স্ত্রী শুনলে বিচলিত হবেন মনে করেই কাউকে সেই সন্দেহের কথা জানাননি। মেরিনাকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চেনেন, জানেন, সে একটু সুখ, একটু শান্তি পাবার জন্য কতটা কাঙাল। বহুবার এই সুখের মুহূর্ত তার কাছে এসেছে, আবার পরক্ষণেই সেই সুখের আশা চূর্ণ হয়ে গেছে। এখানে এসেও খুবই সুখী হয়েছিল সে, সেই আনন্দটুকু স্থায়ী হোক, এটাই চেয়েছিলেন তিনি।

বেশ কয়েকবার বিবাহ করেছে মেরিনা। ছোট্ট মেয়ের মতো রূপকথার রাজপুত্র আশা করেছে। সে, কিন্তু বাস্তব জীবনটা তা নয়। বিশেষতঃ ফিল্ম জগতে বিয়ে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব বলা চলে, তাই বারবার বিয়ে ভেঙেছে তার, এজন্য মরিনার টেম্পারমেন্ট-ও কম দায়ী নয়। সন্তান লাভ করার অদম্য ইচ্ছে ছিল তার। একটি মেয়ে ও দুটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিল সে, কিন্তু তাতে মন ভরেনি বেশিদিন। এগারো বছর আগে যখন প্রথম সে অন্তঃসত্ত্বা হয়, আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছিল মেরিনা। কিন্তু ছেলেটি জন্মালো মানসিক প্রতিবন্ধী। সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল তার। বিয়ে ভেঙে গেল। বহুদিন মানসিক চিকিৎসা করানোর পর অতি সম্প্রতি সুস্থ হয়েছে মেরিনা। বহুদিনের বন্ধু জ্যাসন বিয়ে করেছেন তাকে। এই ক্ষমতাশীল অভিনেত্রীটিকে আবার আনতে চেষ্টা করছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। এই সময় এই দুর্ঘটনা। তবে জ্যাসন তাঁর স্ত্রীর ওপর ভবিষ্যতে কোনোরকম আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে তৈরি থাকবেন, সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করবেন। তবে, কথাটা মেরিনাকে জানতে দিতে চান না।

এরপর ক্র্যাডক দেখা করলেন মেরিনা-র সেক্রেটারি এলা জেলেনেস্কির সঙ্গে। মেয়েটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে সেদিনকার অতিথি ও কর্মচারীদের নামের তালিকা জানিয়ে দিল ক্র্যাডককে। মেরিনার স্বভাবের উত্তেজনা প্রবণতার কথা, যে কোনো ঘটনাকে নাটকীয় করে তোলার ক্ষমতার কথা জানা আছে তার। মুহূর্তের মধ্যেই মুড পরিবর্তিত হয়ে যায় তার। বিশেষ করে, কেউ নিজের সন্তান বা কোনো শিশুর কথা তুললেই কেমন আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে মেরিনা, এটাও সে লক্ষ্য করেছে। তার একমাত্র সন্তান যে মানসিক ভারসাম্যহীন, এ কথা বোধহয় সে কখনো ভোলে না।

মিস মারপল এদিকে তার হোম-ওয়ার্ক নিজের মতো করেই শুরু করে দিয়েছেন। বিউটি পার্লার থেকে পুরোনো ফিল্ম ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে, ফিল্ম জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ক্র্যাডক এসে তারিফ করলেন মিস মারপল-এর। গসিংটন হল-এ গিয়ে সাম্প্রতিক যে সব কথাবার্তা হয়েছে, সবই সবিস্তারে বললেন মিস মারপল মেরিনা-র দত্তক নেওয়া ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বললেন ক্র্যাডক-কে। কেননা তার ধারণা দুঃস্থ অবস্থা থেকে তুলে এনে মেরিনা যাদের কয়েক বছর বিলাসব্যসনে রেখেছিলেন, এবং নিজের সন্তান সম্ভাবনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকাপয়সার ব্যবস্থা করে দিয়ে বিভিন্ন ফস্টার হোম-এ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তাদেরও মনে ক্ষোভ থাকতে পারে, প্রতিহিংসার কামনা থাকতে পারে।

অবাক হলেন ক্র্যাডক, ঐ ছেলেমেয়েদের কথা তারও মনে হয়েছিল, কিন্তু মিস মারপল কেন সেকথা ভাবছেন?

এই ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলো থেকেই জেনেছি তারা আর মেরিনার কাছে থাকে না। তার মানে, মেরিনা তাদের ওপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। শিশুরা খুবই সংবেদনশীল হয়, তারা এটা কখনই ভালোভাবে নিতে পারে না।

–তারা তো এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে। তবে দেখি, তাদের খোঁজখবর নিয়ে, কে কি করছে। আচ্ছা, হত্যাকারীর যে আসল লক্ষ্য ছিল মেরিনা গ্রেগ, সেটা আপনি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন?

-মিসেস বেডককের খুন হওয়ার পেছনে কোনো মোটিভ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যখন, তখন তো অন্য কিছু ভাবতেই হবে।

-ঐ মহিলা সেক্রেটারিকে বেশ এফিসিয়েন্ট বলে মনে হলো, সেই সঙ্গে জ্যাসন হাড-এর প্রতি বেশ অনুরক্তও।

বহু সেক্রেটারিই তাদের বস্-এর প্রেমে পড়ে, তাই বলে তারা তাদের বস-এর স্ত্রীকে খুন করে না। আচ্ছা, মেরিনা কি জানে, তাকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল?

ডাক্তার গিলক্রিস্ট-এর কথা থেকে তো সেরকমই মনে হলো, মেরিনা জানে, কিন্তু স্বামীকে জানাতে চায় না। এদিকে জ্যাসনও এরকমই সন্দেহ করে, কিন্তু স্ত্রীকে জানাতে চায় না, তার ধারণা, এত অতিরিক্ত আবেগসম্পন্ন মেরিনার আবার নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে পারে।

শহরের মেয়রকে সন্দেহের তালিকায় রাখা গেলে খুবই খুশি হতেন ইনসপেক্টর কর্ণিশ। আত্মগর্বী, ধূর্ত স্বভাবের এই লোকটি সব সময়েই আইন বাঁচিয়ে কাজ করেন, এটাই তার আক্ষেপ। যাই হোক, এখন ক্র্যাডকের সঙ্গে বসে মিসেস বেডকক-এর আগে এবং ঠিক পরে যে কজন অভ্যাগত এসেছিলেন, তাদের মধ্যে কার পক্ষে পানীয়ের সঙ্গে ঐ বিষটি মিশিয়ে দেওয়া সম্ভব হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন তিনি। বিখ্যাত আমেরিকান অভিনেতা মিঃ ফেন এবং অভিনেত্রী লোলা ব্রিডস্টার এসেছিলেন। অতীতে মিঃ ফেন-এর সঙ্গে মেরিনার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল, আর মেরিনার তৃতীয় স্বামী মেরিনাকে বিয়ে করার জন্য ঐ লোলা ব্রিডস্টারকে ডিভোর্স করেছিলেন। কাজেই ঐ দুজনের মেরিনার ওপর রাগ থাকতেই পারে।

কিন্তু পনেরো বছর পরে খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে এই মানুষের ভিড়ের মধ্যে তারা আসবেন কি?

সম্ভব নয়। সমবেত সকলেই তো তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী বলে কথা। তাদের পক্ষে ঐ অল্প সময়ে সবার অলক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।

-মাগৰ্ট বেনস নামে যে মহিলা ফোটোগ্রাফারটি সিঁড়ি থেকে ছবি তুলছিল, সে হয়তো কিছু দেখতে পারে। এছাড়া বাটলার গিসিপ্পি, পানীয় তো সেই ঠিক করে রাখছিল, কোনো পাত্রে ক্যালমো মিশিয়ে দেওয়া তার পক্ষেই তো সবথেকে সুবিধে। স্টুডিওর ক্যানটিনের দুজন মহিলা কর্মীও সেদিন এই পার্টিতে কাজে সাহায্য করতে এসেছিল, এদের সকলের সঙ্গেই কথা বলতে হবে।

এছাড়া এরকম ক্ষেত্রে স্বামীকেই তো সর্বপ্রথম আসামীর তালিকায় রাখা হয়।

–হ্যাঁ, জ্যাসন হাড। তবে সে যে তার স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসে, একথাটাও স্টুডিও-মহলে খুবই উচ্চারিত তথ্য। স্ত্রীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যই বিপুল অর্থব্যয়ে একটি ছবি করছে সে। মেরিনার হাত থেকে মুক্তি পাবার বাসনা থাকলে তাকে তো ডিভোর্স করতেই পারতো সে।

দুজনের কথোপকথনের মধ্যেই টেলিফোন বেজে উঠলো। গসিংটন হল থেকে জানানো হচ্ছে মেরিনা গ্রেগ ইনসপেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত আছেন। একটুও সময় নষ্ট না করে ঝড়ের গতিতে গসিংটন হল-এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন ক্র্যাডক। চিত্রতারকা বলে কথা, এদের মত পরিবর্তিত হতে কতক্ষণ।

দোতলায় নিজের শোবার ঘর সংলগ্ন ব্যক্তিগত বসার ঘরে ক্র্যাডককে দর্শন দিলেন মেরিনা। ডার্ট ক্র্যাডক ভেবেছিলেন অসুস্থ, শয্যাশায়ী মেরিনাকে দেখবেন। কিন্তু দেখলেন, সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন মেরিনা, বেশ প্রাণোচ্ছল চেহারা। খুব অল্প প্রসাধন সত্ত্বেও তাঁর প্রকৃত বয়স বোঝা যাচ্ছে না, যথেষ্ট আকর্ষণীয়া দেখাচ্ছে। ক্র্যাডককে দেখে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন মেরিনা।

চীফ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক? আমি অত্যন্ত লজ্জিত, আপনার সঙ্গে আগে কথা বলতে পারিনি বলে। এই দুর্ঘটনা ঘটার পর আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। বড়ো রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম, তাই এই অসুস্থতা।

–আপনি আপসেট হয়ে পড়বেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

–সে তো সকলেই অল্পবিস্তর হয়েছে, মাঝ থেকে আমিই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললাম।

–তার কি বিশেষ কোনো কারণ ছিল না?

-হ্যাঁ, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, বিশেষভাবে বিচলিত হওয়ার কারণ অবশ্যই ছিল আমার। আমি একেবারেই সাহসী নই। বুঝতে পেরেছিলাম, কেউ আমাকে মারার চেষ্টা করছে, কিন্তু ইনসপেক্টর, আমি মরতে চাই না।

-কেন আপনার মনে হচ্ছে যে কেউ আপনাকে হত্যা করতে চাইছে?

চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে গেল মেরিনার।

— কেননা যে গ্লাসে বিষ মেশানো ছিল, সেটা আমার ছিল! ঐ হতভাগ্য ভদ্রমহিলা ভুল করে সেটা পান করেছিলেন, অবশ্য পরিস্থিতির প্রয়োজনেও বলতে পারেন। এছাড়া

এছাড়া কি মিসেস গ্রেগ? খুলে বলুন।

–হ্যাঁ, জ্যাসন বলেছে, সবকিছুই যেন আমি বলে দিই।

–আপনি ওঁকে আপনার সন্দেহের কথা জানিয়েছেন?

–প্রথমে জানাতে চাইনি, কিন্তু ডাঃ গিলক্রিস্ট বললেন, আমার ওকে জানানো উচিত। দেখলাম, আমার মতো একই বিশ্বাস জ্যাসনেরও। কিন্তু আমি বিচলিত হয়ে পড়বো মনে করে আমাকে কিছু জানাতে চায়নি। বেচারা! আমাকে একেবারে বোকা বলে মনে করে।

–আপনি এখনও বলেননি, কেন আপনার সন্দেহ হয়েছে যে আপনাকে কেউ হত্যা করতে চাইছে।

একটু সময় অপেক্ষা করে থাকলেন মেরিনা, তারপর নিজের হ্যান্ডব্যাগটা টেনে নিয়ে তার থেকে একটুকরো কাগজ বের করে নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন ক্র্যাডক-এর দিকে।

ইনসপেক্টর দেখলেন, একটি কাগজে টাইপ করে লেখা আছে, পরের বার আর তুমি রেহাই পাবে না।

–এটা কোথায় পেলেন?

–স্নান করে এসে দেখি, এটা আমার ড্রেসিংটেবিলের ওপর রয়েছে।

–তাহলে বাড়ির মধ্যেকারই কোনো লোক–

তা না হতেও পারে। আমার জানলার ধারের ব্যালকনিতে যে কেউই বেয়ে উঠে আসতে পারে, তারপর সেখান থেকেই ওটা ড্রেসিংটেবিলের ওপর ফেলে দিতে পারে।

–এ ধরনের বার্তা কি এই প্রথম পেলেন?

একটু ইতস্তত করলেন মেরিনা, তারপর বললেন,-না, তা নয়।

–অন্যগুলি সম্পর্কে কি আমাকে বলবেন?

–তিন সপ্তাহ আগে, আমরা যখনই এই বাড়িতে থাকতে এলাম, তখন একদিন, এ বাড়িতে নয়, স্টুডিওতে আমার হাতে এসেছিল এরকম একটা চিরকুট, তাতে লেখা ছিল, মৃত্যুর জন্য তৈরি হও। আমি ভেবেছিলাম কেউ ঠাট্টা করেছে আমার সঙ্গে। চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।

–কাউকে বলেননি এসব কথা?

-না, আসলে অত গুরুত্ব দিইনি। সেই সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের শুটিং নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলাম।

-তারপর কি আর এরকম চিঠি এসেছিল?

-হ্যাঁ, ঐ মেলা যেদিন বসেছিল, সেদিনই। একজন মালি এসে বললো, একজন লোক আমাকে একটা চিঠি দিতে বলে চলে গেছে। আমি ভেবেছিলাম, সেদিনের উৎসবের আয়োজন বিষয়ে কিছু হবে। চিঠিটা খুলে দেখি, তাতে লেখা আছে, আজই তোমার জীবনের শেষ দিন।

–চিঠিটা কোথায়?

-ওটা তো মুড়ে তখন যে ড্রেসিংগাউনটা পরেছিলাম, তারই পকেটে রেখেছিলাম, পরে আর খুঁজে পাইনি।

-কে এই ধরনের চিঠি পাঠাতে পারে বলে আপনার মনে হয় মিস গ্রেগ?

–বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার।

–আপনি একজন বিখ্যাত মহিলা। জীবনে বহুবার সার্থকতার মুখ দেখেছেন। পেশাগত ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনে। বহু মানুষ আপনার প্রেমে পড়েছে, আপনাকে বিবাহ করতে চেয়েছে। মহিলারা আপনাকে ঈর্ষা করেছে। আপনার কাছে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বহু পুরুষ। আপনার জীবনে এধরনের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রটা খুবই বিস্তৃত। তবু, এর মধ্যে থেকে কোনো ইঙ্গিত কি আপনি পাচ্ছেন না?

–এরকম চিঠি এদের মধ্যে যে কেউই লিখতে পারে। বিশেষ করে কাউকে সন্দেহ করতে পারছি না।

-না মিস গ্রেগ, যে কোনো লোকই হতে পারে না। কোনো একটি বা দুটি বিশেষ নামের কথা কি আপনার মনে পড়ছে না? স্টুডিও-র কোনো কর্মী, বা আপনার বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ?

এমন সময় দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন মেরিনা-স্বামী জ্যাসন হাড। তার দিকে ফিরে আবেদনের হাত বাড়িয়ে দিলেন মেরিনা।

-জ্যাসন, প্রিয়তম; ইনসপেক্টর বলছেন ঐ চিঠিগুলো কে লিখেছে সেটা আমার জানা উচিত। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি তা জানি না, এ সম্বন্ধে আমাদের দুজনেরই কোনো ধারণা নেই।

ইনসপেক্টর ক্র্যাডকের মনে হলো, মেরিনা যেন ভয় পাচ্ছেন, তাঁর স্বামী কিছু বলে ফেলতে পারেন, তাই আগে থেকে তাকে সাবধান করে দিলেন।

চোখে একরাশ ক্লান্তি ও মুখে বিমর্ষতা নিয়ে এগিয়ে এলেন জ্যাসন হাড।

-আমি জানি, কথাটা আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না ইনসপেক্টর। কিন্তু সত্যি বলছি এ ব্যাপারে মেরিনা বা আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

–তার মানে আপনাদের কোনো শত্রু নেই বলে মনে করেন? ইনসপেক্টরের গলায় চাপা বিদ্রুপের সুর।

-শত্রু? না ঠিক সেই অর্থে শত্রু কেউ নেই। আমাদের সঙ্গে স্বার্থে সহমত নয়, আমাদের কাজকর্ম পছন্দ করে না, এমন অনেক লোক হয়তো আছে, কিন্তু তাই বলে পানীয়ে বিষে মিশিয়ে হত্যা করতে চাইবে, এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ কেউ নেই।

-কিন্তু সেই কাজটা করার সুযোগ তো অল্প কয়েকজনেরই ছিল সেদিন, তাই না মিস গ্রেগ?

-কিন্তু আমি তো কিছুই দেখিনি, আমার নিজের গ্লাসের পানীয়ে অন্য কেউ কিছু মেশাতে গেলে আমি নিশ্চয়ই দেখতে পেতাম ইনসপেক্টর।

–অমার মনে হচ্ছে, আপনি যতটুকু জানেন, ততটুকু বলছেন না মিস গ্রেগ।

–না, এটা সত্যি নয়, জ্যাসন! তুমি ওঁকে বল এটা সত্যি নয়, আমি কিছুই গোপন করছি না। আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি মিস গ্রেগ। সেদিন সমবেত অতিথিদের মধ্যে একজন বলেছেন, মিসেস বেডককের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আপনি একসময় সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। আপনার মুখে ফুটে উঠেছিল আতংকের ছাপ, আপনি কি কাউকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন?

-কে বলেছে একথা? কাকে দেখে ভয় পাবো?

–তখন সিঁড়ি দিয়ে যারা উঠে আসছিলেন, তাদের কাউকে দেখে?

–অসম্ভব। আমি ওঁদের দেখে ভয় পাবো কেন? তবে একটা কথা আপনাকে বলতে পারি। আমাদের জীবনটাই এমন, ভক্ত দর্শকদের কাছ থেকে আমাদের দিনের পর দিন একই ধরনের কথা শুনতে হয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে সেই সব কথা শোনার চেষ্টাও করি। কিন্তু সব সময়, সব অবস্থায় সেটা বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। তাই সে সময় আমরা মাঝে মাঝে কিছুই শুনি-না, কিছুই দেখি না, মনকে সম্পূর্ণ শূন্য করে দিই, নাহলে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়বো। সেরকমই কিছু হয়তো ঘটেছিল সেদিন, তাই না জ্যাসন?

-হ্যাঁ ডারলিং, তুমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলে, আমি তোমাকে সচকিত করার জন্য মৃদু ধাক্কা দিয়েছিলাম, তারপরেই তোমাদের দুজনকে পানীয়ের গ্লাস দেওয়া হয়।

–মিঃ হাড, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনার স্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ে চিন্তিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে? ওঁর জীবনের ওপর একবার আক্রমণের চেষ্টা হয়েছে, ভয় দেখানো চিঠি এসেছে বেশ কয়েকটি। এতে কি এটাই মনে হয় না, যে এমন কেউ সেদিন মেলায় এসেছিল, হয়তো এখনও এ বাড়িতেই আছে, আপনাদের খুবই পরিচিত কোনোও মানুষ, সেই অপরাধী হতে পারে? কাজেই ওনার নিরাপত্তার জন্যই সবকিছু জানা দরকার আমার।

স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন জ্যাসন হাড,-শুনলে তো ইনসপেক্টর কি বললেন? দোহাই তোমার মেরিনা, এমন যদি কোনো কথা থাকে, যা আমি জানি না, অথচ তুমি জানো, সেটা এখন প্রকাশ করে দাও।

প্রায় কান্নার মতো শোনালো মেরিনার কথাগুলি।

-কিন্তু সত্যিই আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। বিশ্বাস করো আমাকে।

–সেদিন আপনি ভয় পেয়েছিলেন?

–আমি কাউকে ভয় পাই না।

-শুনুন মিস গ্রেগ। সিঁড়ি দিয়ে তখন আপনার দুজন পুরোনো বন্ধু উঠছিলেন, যাঁদের দেখে আপনি খুব অবাক হয়েছিলেন। এঁদের সঙ্গে বহুদিন যোগাযোগ ছিল না আপনার। আমি মিঃ ফেন ও মিস লোলা ব্রিডস্টার-এর কথা বলছি। আপনি জানতেন না ওঁরা আসবেন, তাই না?

-না, ওঁরা যে আমেরিকা থেকে ইংলন্ডে এসেছেন, সেকথাই জানতাম না আমরা। জ্যাসন হাড বললেন।

মেরিনা বললেন, কিন্তু আমি ওঁদের দেখে আনন্দিত।

-লোলা ব্রিডস্টার আপনার তৃতীয় স্বামী রবার্ট ট্রাসকট-এর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন, তাই না? এবার অসহিষ্ণু হলেন মেরিনা।

–ওঃ! সেকথা সবাই জানে। ওটা আপনি আবিষ্কার করেছেন বলে মনে করবেন না। সে সময় ব্যাপারটা নিয়ে একটু হট্টগোল হয়েছিল ঠিকই, তবে এর কোনোও রেশ থেকে যায়নি।

–মিস লোলা কি তখন আপনাকে ভয় দেখিয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, কিন্তু এ ধরনের ভীতিপ্রদর্শনকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। একটা পার্টিতে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল বটে। যদি লোলার হাতে তখন পিস্তল থাকতো, হয়তো আমায় গুলি করেই দিত, তবে সৌভাগ্যক্রমে সেটা ছিল না। এ সবই ঘটেছিল বহুবছর আগে। এই ধরনের ভাবাবেগগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তাই না জ্যাসন।

-হ্যাঁ, মেরিনার কথার মধ্যে সত্যতা আছে ইনসপেক্টর। তবে আমি আপনাকে বলতে পারি, সেদিন আমার স্ত্রী-র পানীয়ে বিষ মেশানোর কোনোও সুযোগই ছিল না। আমি লোলা ব্রিডস্টার-এর প্রায় সবসময়ই কাছেই ছিলাম। আর, এতবছর পরে ইংলন্ডে এসে লোলা আমার স্ত্রীকে খুন করতে উদ্যত হবে, এটা পুরোপুরি কল্পনা। এছাড়া মেরিনার গ্লাসের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগই পায়নি সে।

আর মিঃ ফেন?

-সে আমার এবং জ্যাসনের অনেকদিনের বন্ধু। বিশেষ করে আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন ছিল। তাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই আমার। ওঁকে দেখে আমি যেমন বিস্মিত, তেমনি আনন্দিত হয়েছিলাম। আমেরিকার টেলিভিশন জগতে এখন তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের আসন অর্জন করেছেন।

–ধন্যবাদ মিস গ্রেগ। পরে যদি কখনো মনে হয় আমাকে বিশ্বাস করে আরো কিছু কথা বলতে চান, তবে তা করতে দ্বিধা করবেন না।

২. নিজের ছোটো বাগান

নিজের ছোটো বাগানটির একমনে পরিচর্যা করছিলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। কাজ শেষ করে পরিতৃপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখলেন বাগানের সীমানার বাইরে রাস্তার পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে আসছে জ্যাসন ও মেরিনার সেক্রেটারি এলা।

তার লজ-এর পাশ দিয়ে যাবার সময় এলাকে ডেকে সুপ্রভাত জানালেন মিসেস ব্র্যান্ট্রি। বেশ চমকে উঠলো এলা।

ওঃ সুপ্রভাত। আমি একটু ফোন করতে গিয়েছিলাম, আমাদের ফোনটা আবার বিকল হয়েছে।

-সত্যিই ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর। তোমার যখনই দরকার হবে আমার ফোনটা ব্যবহার করতে পারো।

–ধন্যবাদ। বলেই হেঁচে ফেললো এলা।

–তোমার কি হে-ফিভার হয়েছে? আমার কাছে ভালো ওষুধ আছে।

-না না, আমার এটা প্রায়ই হয়। অ্যাটমাইজার-এর মধ্যে ওষুধ টেনে নিই আমি। ধন্যবাদ আপনাকে।

চলে যাবার পথে আরও বেশ কয়েকবার হাঁচলো সে।

কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন মিসেস ব্যান্ট্রি; তারপর কৌতূহল দমন করতে না পেরে গসিংটন হল-এ ফোন করে জেনে নিলেন ওখানকার ফোন ঠিকই আছে। একান্তে কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য এসেছিল এলা, মিথ্যে বলছে তাকে। বান্ধবী জেন মারপলকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দিলেন তিনি।

কথা বলতে সব থেকে আগ্রহী বলে মনে হলো ডোনাল্ড ম্যাকলিনকে। এই সাংবাদিকটি সেদিন গসিংটন-হল এর পার্টিতে উপস্থিত ছিল।

–কেমন তদন্ত এগোচ্ছে ইনসপেক্টর? আমার জন্য ছিটেফোঁটা কিছু খবর নিয়ে এসেছেন নাকি?

-এখন নয়, পরে হয়তো দিতেও পারি।

–এই ঠেকিয়ে রাখার অভ্যেসটা সব পুলিশ অফিসারের মজ্জাগত, তাই না চীফ ইনসপেক্টর। আপনারা আমাদের কিছুতেই কিছু খবর দিতে চান না। তা এখানে কি মনে করে এসেছেন?

-তোমার কাছেই এসেছি।

–কি সর্বনাশ! আপনি কি মনে করেন আমি হিথার বেডকক-কে খুন করেছি, অথবা মেরিনা গ্রেগকে খুন করতে গিয়ে মিসেস বেডকককে খুন করে ফেলেছি?

-আমি ওরকম কিছু বলছি না।

না, আপনি তা বলছেন না, কেননা আপনি সবসময় সঠিক থাকতে চান। ধরে নিলাম, আমার সেদিন খুন করার সুযোগ ছিল, কিন্তু আমার মোটিভটা কি?

–আমি শুধু তোমার মুখ থেকে সেদিনের কথা শুনতে চাই।

-সে তো পুলিশকে আগেই বলেছি। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ অপমানজনক। আমার মতো একজন সাংবাদিকের নাকের ডগায় খুনটা হলো, অথচ আমি টেরই পেলাম না যে খুনটা কে করলো? আমি কেবল ঐ মহিলাকে একটি চেয়ারে বসে খাবি খেতে খেতে মরে যেতে দেখলাম। আমার আরও দেখা, আরও জানা উচিত ছিল। তবে আমি নিশ্চিত যে বিষটা মেরিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য নিয়েই গ্লাসে মেশানো হয়েছিল, মিসেস বেডকক-এর জন্য নয়।

–সে যাই হোক, তুমি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলে, তখন তোমার সঙ্গে কে কে ছিল?

লন্ডনের মার্গট বেনস, তার ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত ছিল।

–তুমি তার সঙ্গে পরিচিত?

-হ্যাঁ, প্রায়ই এখানে ওখানে দেখা হয়ে যায়। বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার পেশায় বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। সিঁড়ির এমন জায়গায় ক্যামেরা রেখেছিল যেখান থেকে মেরিনার সঙ্গে প্রতিটি অতিথির সাক্ষাৎকারের ছবি তোলা যায়। লোলা ব্রিডস্টার আমার আগে আগে উঠছিলেন। আমি অবশ্য চুলের রং ও স্টাইল বদলে যাওয়ার কারণে প্রথমে ওঁকে চিনতে পারিনি।

–আচ্ছা, সেই সময় মেরিনার মধ্যে কি বিশেষ কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন?

-আশ্চর্য, সত্যিই তো! আমার তো এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল মেরিনা এখনই মূচ্ছা যাবেন, আপনি বললেন বলে মনে পড়লো।

-আচ্ছা! ধন্যবাদ। আমাকে আর কিছু বলার আছে তোমার?

–আর কি থাকতে পারে?

–আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, তুমি কোনো কথা খেতেও পারো।

–একথাটা তাহলে বিশ্বাস করেন যে, এই হত্যাকাণ্ডে আমার কোনো হাত নেই। তাই তো? এর জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমিই হয়তো মেরিনা-র প্রথম স্বামী। লোকটা এতই অকিঞ্চিত্বর ছিল যে, তার নামই কেউ জানে না।

–তাহলে তুমি বোধহয় প্রেপ স্কুলে থাকার সময় বা ন্যাপি পরে থাকার সময়ই সেই বিয়েটা করেছিলো। কেননা, সেটা অনেকদিন আগের ব্যাপার। আচ্ছা, চলি তাহলে। আমাকে এখনই ট্রেন ধরতে হবে।

নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে টেবিলের সামনে বসেছিলেন ক্র্যাডক। সামনে স্তূপ করে রাখা কাগজগুলো দেখছিলেন। কাজ করতে করতে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন।

-লোলা ব্রিডস্টার কোথায় উঠেছেন?

–স্যাভয় হোটেলে, স্যার। স্যুট এর নাম্বার ১৮০০। উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

–আর মিঃ ফেন?

–উনি ডরচেস্টারে আছেন, দোতলায় ১৯০ নম্বর ঘর।

–ঠিক আছে।

স্যাভয় হোটেল-এ গিয়ে লোলা ব্রিডস্টার-এর কাছ থেকে সাদর অভ্যর্থনা পেলেন ক্র্যাডক। মহিলা যে একসময়ে দারুণ সুন্দরী ছিলেন, তা এখনও বোঝা যায়। মেরিনা-র মতো শান্তশ্রী নয়, খুবই চটকদার। কড়া প্রসাধন করার অভ্যেস আছে।

স্থানীয় পুলিশের মতো আপনিও কি আবার একরাশ ভয়ংকর প্রশ্ন করবেন নাকি?

আশা করছি খুব ভয়ানক হবে না সেগুলি।

–আমার কিন্তু মনে হয়, তাই হবে। তাছাড়া আমি সন্দেহ করছি, খুব বড়ো রকমের একটা ভুল হয়ে গেছে, এই ঘটনায়।

–আপনিই কি সত্যিই তাই মনে করেন?

–নিশ্চয়, আপনি কি ঐ খবরের কাগজগুলোর মতো সত্যিই মনে করেন, মেরিনাকে কেউ খুন করতে চেয়েছিল? ওকে কেন কেউ খুন করতে চাইবে, সবাই ওকে খুব ভালোবাসে।

–আপনিও।

–আমি সবসময়েই মেরিনা-র প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলাম।

-ওঃ সবসময় বলবেন না মিস ব্রিডস্টার, এগারো বছর আগে আপনাদের মধ্যে কি একটা গণ্ডগোল হয়েছিল না?

–সেটা? ও কিছু নয়, তখন আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম অবশ্য। রব আর আমার মধ্যে সাংঘাতিক ঝগড়া হত সেসময়। তখন আমরা কেউই ঠিক স্বাভাবিক ছিলাম না। মেরিনা ওর প্রেমে পড়ে গেল, আর ওকে আমার সংসার থেকে নিয়ে গেল।

–আপনি কি খুব বেশি আঘাত পেয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, আমার তখন তাই মনে হয়েছিল। এখন কিন্তু মনে হয় আমার পক্ষে সেটা ভালোই হয়েছিল। আমি ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে বেশি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, ওদের কোনো ঘর থাকবে না, এটা আমি ভাবতে পারছিলাম না। ওদের জন্যই বিয়েটা ভাঙতে চাইছিলাম না।

আপনি সেসময় অনেক কথাই বলেছিলেন, তাই না? আপনি তো মেরিনাকে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলেন?

-ওরকম অবস্থায় অনেকেই অনেক কিছু বলে, তাই বলে এতদিন পরে এসে আমি মেরিনাকে খুন করবো নাকি। আপনি জানেন, তারপরেই আমি আবার বিয়ে করেছি, এবং সুখী হয়েছি। ওসব ইমোশান বেশিদিন টিকে থাকে না ইনসপেক্টর। আর তাছাড়া আমাদের বক্তব্য কার্যকলাপ ঐ ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলোতে বেশ অতিরঞ্জিত করেই লেখা হয়, জানবেন।

এরপর ডরচেস্টারে গিয়ে মিঃ ফেন-এর সঙ্গে দেখা করলেন চীফ ইনসপেক্টর, তিনি জানালেন একসময় মেরিনার সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল তার, তবে চারবছর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। সেদিন পার্টিতে অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে দেখে খুবই খুশী হয়েছিল মেরিনা। আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছিল। এরপর তিনি পানীয়ের টেবিলের দিকে চলে যান, কাজেই মিসেস বেডককের মৃত্যুর কারণ বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতা নেই তার। এটা ঠিক, মেরিনা তাকে প্রত্যাখ্যান করে অন্য পুরুষকে বরণ করায় মানসিকভাবে আহত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা মনে আসে না তার। এছাড়া আর কিছু বলার নেই তার।

নোটবুকে লেখা শেষ নামটির দিকে আর একবার তাকালেন ক্র্যাডক। ঐ মহিলার ফোন নম্বরে বারবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মার্গট বেত্সকে নিজে গিয়েই ধরতে হবে।

মার্গট-কে পাওয়া গেল আউটডোরে বিজ্ঞাপনের ছবি তুলতে ব্যস্ত অবস্থায়। ইনসপেক্টর-এর আগমনে সে কাজ গুটিয়ে তাকে নিজের অফিসে নিয়ে এলো।

–আপনার জন্য আমি কি করতে পারি ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক?

–গসিংটন হল-এর ঐ দুর্ঘটনার বিষয়ে যদি দয়া করে কিছু বলেন। শুনেছি, আপনি সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিলেন।

-হ্যাঁ। আমি ওখানে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। মানে ঐ কাজের জন্য আমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল।

প্রোফেশনাল ফোটোগ্রাফার হিসেবে?

–হ্যাঁ, আমাকে কয়েকটি বিশেষ ধরনের ছবি তুলতে বলা হয়েছিল। এরকম কাজ আমি প্রায়ই করি। ফিল্ম স্টুডিওর জন্যও অনেক ছবি তুলেছি। তবে, সেদিন আমি মেলা-র কয়েকটি ছবি তুলেছিলাম। এরপর মেরিনা ও জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে বিশিষ্ট অতিথিদের সাক্ষাৎকারের কয়েকটা ছবি তুলেছি।

-বুঝতে পেরেছি। আপনি আপনার ক্যামেরাটা সিঁড়িতে বসিয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, কিছু সময়ের জন্য। ওখান থেকে আমি বেশ ভালো করে একটা অ্যাংগেল পাচ্ছিলাম। নিচ থেকে যারা উঠছিলেন তাদের ক্যামেরায় পাওয়া যাচ্ছিল, এবং পরমুহূর্তে ক্যামেরা ঘুরিয়ে তারা মেরিনার কাছে পৌঁছে গিয়ে আপ্যায়িত হচ্ছেন, এটাও ধরা যাচ্ছিল। মানে, আমাকে খুব একটা নড়াচড়া করতে হচ্ছিল না।

–আপনি ওখান থেকে মেরিনাকে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন?

–খুব ভালোভাবে।

–আর জ্যাসন হাডকে?

–সবসময় নয়। উনি খুবই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। পানীয় এনে দিচ্ছিলেন, অতিথিদের একে অন্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। এই ধরনের কাজ আর কি, আর আমি ঐ মিসেস বেডকক-কে পানীয় নিতে দেখিনি। আসলে কোনজন ছিলেন ঐ ভদ্রমহিলা, তা-ই আমি বুঝতে পারছি না।

–মেয়রের আসাটা মনে আছে আপনার?

-হ্যাঁ, মেয়রকে মনে আছে আমার। তিনি তো সরকারী পোশাক পরেই এসেছিলেন, চেন টেন সমেত। তার ছবিও তুলেছি। প্রোফাইলটা বেশ নিষ্ঠুর।

–তার ঠিক আগেই মিস্টার ও মিসেস বেডকক উঠেছিলেন।

–দুঃখিত, তা-ও আমার ওঁদের চেহারা মনে পড়ছে না।

-আপনি কি লক্ষ্য করেছিলেন, মেরিনাকে একটা সময় অসুস্থ দেখাচ্ছিল, বা তার মুখের ভাব অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল?

মার্গট বেনস সামনে ঝুঁকে পড়ে সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে নিল। সেটাকে লাইটার দিয়ে জ্বালালো। যদিও প্রশ্নটার উত্তর দিল না, তবু ইনসপেক্টর তাকে উত্তর দেবার জন্য কোনো চাপ দিলেন না। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। একসময় মেয়েটি হঠাৎই বললো, আমাকে একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

-কেন না, এই প্রশ্নটার একটা বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পাওয়া খুবই দরকার আমার।

–আমার উত্তরটা বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে হয় আপনার।

-হ্যাঁ, সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে হয়, মানুষের মুখের ভাব পরিবর্তন ক্যামেরার চোখ দিয়ে লক্ষ্য করা আপনার অভ্যেস আছে। কেননা, আপনি বিশেষ কোনো মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দী করার অপেক্ষায় থাকেন। আপনি কি সেদিন সেরকম কিছু দেখেছিলেন?

–আরও কেউ ওটা দেখেছে, তাই না?

–হ্যাঁ একাধিক লোক। কিন্তু সেটা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করেছে।

–যেমন?

-একজন বলেছে মেরিনাকে চমকে উঠতে দেখেছিল, আর একজন বলেছে, ওঁর দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত শীতলতা জমাট বেঁধে উঠতে দেখা গিয়েছিল।

-ফ্রোজেন লুক?

-হ্যাঁ। একজন আবার বলেছেন সেই মুহূর্তে মেরিনা-কে দেখে তার টেনিসনের লেডি অব শ্যালটকে মনে পড়ে গিয়েছিল, সেই যে–দি মিরর ক্র্যাকড় ফ্রম সাইড টু সাইড, দি ডুম হ্যাঁজ কাম আপন মি, ক্রায়েড দি লেডি অব শ্যালট।

-ওখানে কোনোও আয়না ছিল না, তবে থাকলে হয়তো সেটা ফেটে যেত।

একথা বলেই উঠে দাঁড়ালো মার্গট,একটু অপেক্ষা করুন। বর্ণনা করার থেকেও ভালো জিনিস দেখাবো।

অফিসঘরের একপ্রান্তের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল মার্গট। একটু পরেই বেরিয়ে এলো সে-দেখুন, দরকারের সময় আসল জিনিসটা খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও অবশেষে পেয়ে গেছি।

ক্র্যাডকের কাছে সে তাকে একটি ছবির প্রিন্ট দিল। ক্র্যাডক দেখলেন, মেরিনা গ্রেগ-এর একটি চমৎকার ফোটোগ্রাফ। যে মহিলাটির সঙ্গে তিনি করমর্দন করছেন, ক্যামেরার দিকে পিছন করে থাকায় তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মেরিনা সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে নেই। ক্যামেরার একটু বাঁদিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে সেদিকে কোনোও কিছু দেখে তার এমন মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, যা অনুভূতির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা অসাধ্য। মরণোন্মুখ একটি মানুষের চোখে একবার এরকমই দৃষ্টি দেখেছিলেন ক্র্যাডক।

–ছবিটা কি আমি রাখতে পারি?

নিশ্চয়ই। এর নেগেটিভটা আছে আমার কাছে।

-এটা আপনি প্রেস-এ পাঠাননি কেন? এরকম নাটকীয় একটি ছবির জন্য কোন কোনো কাগজ ভালো দাম দিতে রাজি হতো।

-যদি হঠাৎ কোনো মানুষের ভেতরটা দেখতে পাওয়া যায়, তার থেকে আর্থিক ফায়দা তুলতে লজ্জা করে না কি?

-মেরিনা গ্রেগকে ভালোভাবে জানতেন?

–না।

–আপনি তো স্টেটস থেকে এসেছেন, তাই না?

-আমি জন্মেছি ইংলন্ডেই। ট্রেনিং নিয়েছি আমেরিকায়। তারপর এই বছর তিনেক হলো এখানে এসেছি।

-কোথায় ট্রেনিং নিয়েছেন?

রেইনগার্ড স্টুডিওতে। কিছুদিন অ্যান্ড্রু কুইল্প-এর সঙ্গে ছিলাম। ওনার কাছ থেকেই অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।

-আপনি সেভেন স্প্রিং-এ থাকতেন, তাই না?

–আপনি তো আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন দেখছি।

–আপনি তো একজন স্বনাম খ্যাত ফোটোগ্রাফার, আপনার সম্বন্ধে কাগজপত্রে তো বহুবার অনেককিছু লেখা হয়েছে। তা, আপনি ইংলন্ডে এলেন কেন?

-ও, আমি এই দেশটাকে পছন্দ করি। এখানেই জন্মেছি। অবশ্য খুব ছোটোবেলাতেই আমেরিকায় চলে গিয়েছিলাম।

–আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে আরো কিছু বলতে পারেন।

–আপনি কি বলতে চাইছেন?

–আপনি যা বলছেন, তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে মেরিনা গ্রেগকে চিনতেন।

–প্রমাণ করুন। আপনি কল্পনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

-না, আমি তা করছি না, আর এটা আমি প্রমাণ করতে পারি। আপনার পাঁচবছর বয়েসে মেরিনা আপনাকে দত্তক নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে আপনি চারবছর ছিলেন। এটা স্বীকার করছেন না কেন?

ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো মার্গটের মুখ, উঠে দাঁড়ালো সে।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে। এটা সত্যি। মেরিনা গ্রেগ আমাকে তার সঙ্গে আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মায়ের আটটি সন্তান ছিল, কোথাও কোনো বস্তিতে থাকতো সে। বোধহয় প্রায়ই চিত্রতারকাদের নিজের দুঃখ দৈন্যের কথা জানিয়ে চিঠি লিখতো, এরকম বহু লোকেই লিখে থাকে। নিজের সন্তান যাতে সব রকম সুখ সুবিধে পায়, যা সে নিজে কখনো দিতে পারবে না, তার জন্য তাকে দত্তক নিতে অনুরোধ করে। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে জঘন্য বলে মনে হয়।

–আপনারা তিনজন ছিলেন। তিনটি শিশুকে ভিন্ন ভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল।

-হ্যাঁ, আমি, রড ও অ্যাংগাস। অ্যাংগাস আমার চেয়ে বয়সে বড়ো। রড ছিল একেবারেই শিশু। আমরা খুব সুন্দর জীবনযাপন করছিলাম। সব রকমের সুখ-সুবিধে ছিল। তার ওপর মেরিনা ছিলেন আমাদের মা, আমাদের আদর করতেন, আমাদের নিয়ে ছবি তুলতেন। অসাধারণ সুন্দর সেন্টিমেন্টাল সব ছবি।

-কিন্তু তিনি সত্যিই বাচ্চা চেয়েছিলেন, সবটাই পাবলিসিটি স্টান্ট নয়, তাই না?

–হয়তো তাই, তিনি সন্তান চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের চাননি, এটা একটা মহৎ অভিনয় মাত্র। আমার পরিবার, নিজের একটা পরিবার থাকা কত সুখময় ইত্যাদি দেখাতে চেয়েছিলেন। আর ইজি তাকে এটা করতে দিত, তার একটু বোঝা উচিত ছিল।

–ইজি মানে ইসিডোর রাইট?

–হ্যাঁ, মেরিনার তৃতীয় বা চতুর্থ স্বামী। আমি ভুলে গেছি। উনি সত্যিই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি মেরিনাকে বুঝতেন, এবং মাঝে মাঝে আমাদের জন্য চিন্তিত হতেন। আমাদের প্রতি খুবই সদয় ছিলেন, কিন্তু কখনও আমাদের পিতা হবার ভান করতেন না। নিজের লেখা নিয়ে থাকতেই ভালোবাসতেন। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে তাকে একজন শক্তিমান নাট্যকার হিসেবে গণ্য করা হবে।

-এটা কতদিন ধরে চলেছিল?

-যখন এই অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন মেরিনা। না, তা অবশ্য পুরোটা ঠিক নয়, তিনি যখন জানতে পারলেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। নিজের সন্তান পেতে চলেছেন, ততদিন পর্যন্ত। তারপর ওঁর কাছে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাদীক্ষার জন্য অনুদানের ব্যবস্থা করে দিয়ে ফস্টার হোম-এ পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেউ বলতে পারবে না মেরিনা আমাদের জন্য ভালো ব্যবস্থা করে দেননি। কিন্তু সে আমাদের কখনো চায়নি। সে শুধু নিজের গর্ভজাত সন্তান চেয়েছিল।

–এজন্য তাকে দোষ দিতে পারা যায় না।

–নিজের সন্তান চাওয়ার জন্য দোষ দিচ্ছি না তাকে। কিন্তু আমাদের কথা কে ভেবেছিলো? তিনি আমাদের নিজের বাবা-মা-এর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, আমাদের নিজস্ব স্থান থেকে তুলে এনেছিলেন। আমার নিজের মা, কিন্তু তাঁর নিজের সুবিধের জন্য আমাকে বিক্রি করে দেননি। ঐ বোকা মহিলাটি আমার সুখ-সুবিধের কথাই ভেবেছিলেন, আমার শিক্ষাদীক্ষা, সমৃদ্ধিময় জীবনযাপন, ইত্যাদির কথা। ভেবেছিলেন, আমার পক্ষে সবথেকে ভালো জিনিসটাই দিচ্ছেন আমাকে। আমার পক্ষে ভালো? যদি তিনি জানতেন–

–এখনও আপনার মনে তিক্ততা আছে?

-না, এখন আর নেই। পুরোনো কথা বলা মানে সেই তিক্ত অতীতে ফিরে যাওয়া, তাই এরকম মনে হচ্ছে।

-মেরিনার শিশুটির কথা তখনই তোমরা জেনেছিলে?

–নিশ্চয়ই, সবাই জানতো, আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন মেরিনা তখন। আর শিশুটি জন্মালো জড়বুদ্ধি হয়ে। উপযুক্ত শিক্ষাই হয়েছে মেরিনার। তিনি আর আমাদের ফিরিয়ে নেননি।

–তাকে আপনি খুব ঘৃণা করেন?

–কেন করবো না? কোনো মানুষের প্রতি যতখানি অবিচার করা যায়, তাই করেছেন উনি। প্রথমে আমাদের বুঝতে দিলেন যে আমাদের তিনি চান, ভালোবাসেন। তারপরেই জানা গেল, ঐ সবটাই তাঁর মুখোশ। প্রবঞ্চনা।

–তোমার ঐ দুটো ভাই-এর কি হলো।

–আমরা পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। রড মিক্স ওয়েস্টের কোথাও চাষবাস করছে, তার স্বভাবটাই খুব আনন্দময়, বরাবরই তাই ছিল। অ্যাংগাস এখন কোথায় আছে জানি না।

মেরিনা কি সেদিন আপনাকে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন? নাকি আপনাকে খুশি করার জন্যই ফোটোগ্রাফার হিসেবে আপনাকে ডেকেছিলেন?

-আরে, উনি তো এসব ব্যবস্থাপনার কথা কিছুই জানতেন না। আমিই তাকে দেখতে চেয়েছিলাম তাই একটু চেষ্টা করেছিলাম, কাজটা পাওয়ার জন্য। দেখতে চেয়েছিলাম, এখন মেরিনা-কে দেখতে কেমন হয়েছে।

-তারপর কি হলো?

-উনি আমাকে চিনতেই পারলেন না, জানেন? পাঁচবছর বয়স থেকে নবছর বয়স পর্যন্ত আমি ওর সঙ্গে ছিলাম, তবু আমাকে একটুও চিনতে পারলেন না।

–আপনি তাকে আপনার পরিচয় দেননি?

–না, সেটা আমি কোনোদিনই করবো না।

–আপনি কি মেরিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, মিস বেনস?

হেসে উঠলো মেয়েটি।

–কি হাস্যকর প্রশ্ন করছেন ইনসপেক্টর। কিন্তু, আমার মনে হয়, এটা আপনার কাজেরই অঙ্গ। না, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, আমি ওকে হত্যা করতে চেষ্টা করিনি।

-কিন্তু কে ওঁকে হত্যা করতে চায়, সে বিষয়ে কি আপনার কোনো ধারণা আছে?

-না, এ বিষয়ে আমার নির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই, যে কেউই হতে পারে। গুডবাই চীফ ইনসপেক্টর। আমার সত্যিই আর কিছু বলার নেই।

ষোলো নম্বর অব্রে রোডে তরুণী মিসেস বেকার তার স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলো। প্রাতরাশ তৈরি করে দুটি প্লেটে সাজালো মিসেস বেকার, ওরফে চেরী। মিক্সড় গ্রীল-এর গন্ধ পেয়ে সচকিত হলো তার স্বামী জিম বেকার।

-কি ব্যাপার চেরী? স্পেশাল খাবার? আজ কি আমার জন্মদিন নাকি, না অন্য কিছু?

–তোমার বেশি করে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া উচিত।

–কে বলেছে?

–মিস মারপল। যদিও আমার মনে হয় ওনার নিজেরই আর একটু পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। ঐ বুড়ী মিস নাইট কেবল ওঁকে কার্বোহাইড্রেট খাইয়ে রাখে।

ইনভ্যালিড-দের জন্য এটাই তো ঠিক পথ্য।

-উনি মোটেই ইনভ্যালিড নন, একটু বুড়ো হয়েছেন মাত্র। আর ঐ মিস নাইট কেবল আমাকে কিভাবে কাজ করতে হয় তা শেখাতে চেষ্টা করে। এমন কি রান্না নিয়েও জ্ঞান দিতে আসে, জানোনা? এ ব্যাপারটা অন্তত আমি ওর চেয়ে ভালো জানি।

নিশ্চয়ই! রান্নায় তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না চেরী। তা তোমার মিস মারপল হঠাৎ আমার খাবার-দাবারের কথা বললেন কেন? যখন ওঁর বাড়িতে কল সারাই করার কাজে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে কি দুর্বল বলে মনে হয়েছিল ওঁর?

স্বামীর কথা শুনে হেসে উঠল চেরী,–না না। উনি আমাকে বললেন, তোমার স্বামী খুবই সুপুরুষ।

-তুমি কি তা মনে কর না?

–আরে শোনোই না। বললেন, ওকে তুমি ভালো ভালো রান্না করে পেট ভরে খাওয়াবে, পুরুষ মানুষদের এটা খুব দরকার। বাজার থেকে টিন ফুট বা রেডিমেট পাই কিনে এনে গরম করে খেতে দিও না। অবশ্য আমি সেরকম খুব কমই করি।

-আমার জন্য সেরকম করা তোমার পক্ষে সম্ভবও নয়। ওগুলোর স্বাদ আমার ভালো লাগে না।

-তোমার ঐ খেলনা জাহাজ তৈরি ছেড়ে খাবারের দিকে মন দাও দেখি। আর শোনো, খেলনা তৈরির ঐ কিটটা তুমি তোমার ভাগনে মাইকেলের জন্য কিনেছে বলে আমাকে ভোলাতে এসো না। ওটা তুমি নিজে খেলবে বলেই কিনেছো।

মাইকেলের এখনও এটা নিয়ে খেলার বয়স হয়নি চেরী। সলজ্জভাবে বললো জিম।

-তার মানে তুমি পুরো সন্ধেটা এটা নিয়েই কাটাবে। কিছু গান শুনলে হত না? যে নতুন রেকর্ডাটার কথা বলছিলে, সেটা কি এনেছো?

-হ্যাঁ। ওইতো।

–ঐ রেকর্ডগুলো ফুল ভলুমে না শুনলে, পুরো মজাটা পাওয়া যায় না। কিন্তু তার তো উপায় নেই। এখনই পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা দেওয়ালে আওয়াজ করে শব্দ কমাতে বলবেন। এভাবে কি থাকা যায়?

-হ্যাঁ, ঐ রেকর্ডগুলো আস্তে শোনার কোনো মানে হয় না। সবাই সেটা জানে। আর, ওর বেড়ালটা যে যখন তখন আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে, বাগানে গর্ত করে, তখন?

-সত্যি জিম, প্রথমে বাড়িটা পছন্দ হলেও, এখন আর একটুও ভালো লাগছে না, শুধু ঐ কুচুটে প্রতিবেশীদের জন্যে। একটুও প্রাইভেসি নেই এখানে।

–ট্রে-টা একটু সরিয়ে নেবে চেরী, এগুলো ঠিকমতো বিছিয়ে রাখতে পারছি না।

-তুমি আছো তোমার খেলনা নিয়ে, গান শোনার উপায় নেই, আমি বরং গ্ল্যাডিস ডিক্সনের কাছ থেকে ঘুরে আসি, একটা প্যাটার্ন আনবো ওর কাছ থেকে।

–ঠিক আছে ডার্লিং।

নতুন ড্রেস তৈরি করতে ব্যস্ত ছিল গ্ল্যাডিস। বান্ধবীকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ফিল্ম স্টুডিও-র ক্যান্টিনে কাজ করে সে।

–স্টুডিওতে আজ নতুন কিছু খবর শুনলে নাকি গ্ল্যাডিস?

–মেরিনা গ্রেগ কাল এসেছিল স্টুডিওতে। ওঃ যা চেঁচামেচি করছিল না।

–কি নিয়ে চেঁচামেচি?

-আরে, একটাই পট থেকে সবাইকে কফি দেওয়া হয়েছিল, অথচ মেরিনা একটু চুমুক দিয়েই বললো, তার সন্দেহ হচ্ছে কফিতে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে।

–তারপর কি হলো?

–মিঃ হাড, সবাইকে শান্ত করলেন। সত্যি, এ ব্যাপারে ওঁর তুলনা হয় না। মেরিনার কফিটা সিঙ্কে ঢেলে ফেলে দিলেন।

-কাজটা খুব হয়েছে।

তার মানে? কোন কাজটা?

কফিটা ফেলে দিলেন কেন? যদি সত্যিই ওর মধ্যে কিছু মেশানো থাকে, সেটা তো আর জানা যাবে না।

–তোমার কি মনে হয়, সত্যিই কফিতে বিষ ছিল?

-সেদিন পার্টিতে ওঁর গ্লাসেই তো বিষ মেশানো ছিল। একবার ব্যর্থ হয়েছে খুনী, আবারও তো চেষ্টা করতে পারে!

সেদিন মেরিনা তার চেয়ার থেকে উঠে যাবার পরক্ষণেই ওপর থেকে মার্বেলের একটা মূর্তি ঐ চেয়ারের ওপর পড়ে, চেয়ার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মেরিনা ওখানে থাকলে কি হত বল তো? আমি ভাবছি, স্টুডিও-র কাজটা ছেড়ে দেবো।

-সে কি? কেন?

–আরে, মেরিনাকে মারতে গিয়ে খুনী একবার ভুল করে মিসেস বেডকককে মেরেছে, পরের বার যদি ভুল করে আমাকে মেরে ফেলে!

–হ্যাঁ, কথাটা ভাববার মতো বটে।

–জানো চেরী, সেদিন তো আমি ঐ পার্টিতে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম? মেরিনার কাছে কাছেই ছিলাম।

-যখন মিসেস বেডকক মারা গেলেন?

-না না, যখন ওঁর হাতের পানীয়ের পাত্রটা পড়ে গেল। ওটা ইচ্ছে করে করেছিল, আমি স্পষ্ট দেখেছি। ভদ্রমহিলা কি সুন্দর করে একটা ড্রেস পরেছিলেন, একদম নতুন! সেটা কেউ ওভাবে নষ্ট করে? আমি যদি ওরকম একটা ড্রেস পেতাম! সে যাই হোক, ঐ মজার ঘটনাটা মানে ইচ্ছে করে গ্লাস ফেলার ঘটনাটা ওদের বাটলার গিসিপ্পিকে নিশ্চয়ই বলবো।

–ঐ ইটালিয়ান বাটলারটা, ওকে কেন?

–আরে কিছু একটা কথা বলা যাবে তো ওর সঙ্গে। কি সুন্দর দেখতে না? আর, কেমন অভিজাত চাল চলন, তাই না?

ইটালিয়ানদের চক্করে পড়তে যেও না গ্ল্যাডিস। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।

–আমি ওকে শুধু কথাটা বলবো, আর জিজ্ঞেস করবো, এ ব্যাপারে আমার কি করা উচিত।

–তোমার ইচ্ছে। যাই হোক, প্যাটার্নটা দাও, ঐ ভোগ এরটা। চলি গ্ল্যাডিস। বাই।

–বাই চেরী।

ডক্টর হেডক, মিস মারপলকে উলের জট ছাড়াতে দেখে মৃদু হাসলেন,-খুনের রহস্যটারও কি সমাধান করে ফেলেছেন মিস মারপল?

–আমার ব্রেনটা আর আগের মতো কার্যকরী নেই ডক্টর। ওটারও বয়স হয়েছে।

–আমাকে বোকা বানানো যাবে না জেন মারপল। আপনাকে আমি আজ থেকে চিনছি না।

–সত্যিই বুঝতে পারছি না, গ্লাসে বিষটা মেশালো কি করে?

–কোনো আইড্রপের মধ্যে করে বিষটা এনেছিল হয়তো।

–তা, সেটা দেওয়ার সময় কেউ দেখতে পাবে না, এতটা নিশ্চিত হলো কি করে? কুড়ি জনের মধ্যে একজন অন্তত তো দেখেছে, কিন্তু সে কথাটা কাউকে বলেনি।

-কেন বলেনি বলে মনে হয়।

–হয়তো সে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। অথবা এইসব চিত্রতারকারা যখন তখন পানীয়ের সঙ্গে নানারকম ওষুধ মিশিয়ে খায় শুনেছি, সেরকমই একজন কেউ এটা করেছে বলে, যে দেখেছে, তারও কোনো সন্দেহ হয়নি।

এছাড়া আর কি হতে পারে?

–সেটাই সবচেয়ে দুশ্চিন্তার। হয়তো যে দেখেছে, সে হত্যাকারীকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য চুপ করে আছে, অথবা এতক্ষণে করতে শুরু করে দিয়েছে। এই ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন আশংকা হচ্ছে আমার।

-সেক্ষেত্রে তো আরও খুন হবার সম্ভাবনা থেকে যায়?

–ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো, সেরকম যেন না হয়।

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে নিজের মনেই হাসলো এলা। খুব ভয় পাইয়ে দেওয়া গেছে। চীফ ইনসপেক্টর নিজেকে যতই চালাক মনে করুক না কেন, এলা-র মনের কথা বার করা তার কর্ম নয়। টেলিফোনে খুব ভয় পাইয়ে দেওয়া গেছে খুনীকে। এবার দেখা যাক, কি হয়?

কিন্তু এই হে-ফিভারটা বড় জ্বালাচ্ছে।

অফিসে আসতেই জ্যাসনের গম্ভীর মুখ দেখে বিস্মিত হল এলা।

–কি হয়েছে কি?

–ঐ কফি, যেটা মেরিনার কাপে ছিল, সেটা পরীক্ষা করে আর্সেনিক পাওয়া গেছে।

–কিন্তু ওটা তো তুমি ফেলে দিয়েছিলে?

–না, কাউকে না জানিয়ে একটুখানি পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলাম।

–তাহলে তো মেরিনা ঠিকই বলেছিল। কফিটা ওর বেশি তেতো লেগেছিল।

-না, ঠিক বলেনি। আর্সেনিকের কোনো স্বাদ নেই। কিন্তু ওর ইনস্টিংক্ট ঠিকই সাড়া দিয়েছিল।

-আর, আমরা ভেবেছিলাম ও শুধু শুধু হিস্টোরিক্যাল হচ্ছে।

–ও তো হিস্টোরিক্যালই! চোখের সামনে একটা মৃত্যু দেখেছে, একটার পর একটা ভয় দেখানো চিঠি আসছে, না হয়ে উপায় কি? আজ কি এরকম কোনো চিঠি এসেছে?

-না।

-কে যে এসব করছে। অবশ্য জানলা দিয়ে যে কেউই বাইরে থেকে চিঠি ফেলে দিতে পারে। দেখি, এ বিষয়ে আর কি সতর্কতা নেওয়া যায়। আচ্ছা, কাজের লোকদের কাউকে যদি টাকার লোভ দেখিয়ে মেরিনার খাবারে বিষ দিতে বলে? গিসিপ্পি যদিও আমাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন আছে, তবু টাকার ব্যাপারে ওকে বিশ্বাস করা যায় না।

–এভাবে উল্টোপাল্টা সন্দেহ করে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ জ্যাসন!

–সুখ কি চিরদিন মেরিনার কাছে অধরাই রয়ে যাবে এলা? এখানে প্রথম এসে কত আনন্দ পেয়েছিল, তুমি তো জান। খুব নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম আমি। হঠাৎ এই বিনা মেঘে বজ্রপাত।

–তুমি কি বিশ্বাস করেছিলে মেরিনা এখানে এসে চিরদিনের মতো সুখী হয়ে যাবে?

হাসলো জ্যাসন,–না, তা ভাবিনি, মেরিনাকে অনেকদিন ধরে চিনি তো! তৰৈ ভেবেছিলাম বছর দুইও যদি এখানে শান্তিতে থাকতে পারে, হয়তো ওর আত্মবিশ্বাস বাড়বে, নতুন এক মেরিনা-র জন্ম হবে। যখন খুশী থাকে, মেরিনাকে ঠিক শিশুর মতো মনে হয়। সেই খুশীটুকু দেখতে চেয়েছিলাম আমি।

-জীবনটা যে গোলাপের শয্যা নয়, তা তো তুমি ভালো করেই জানো জ্যাসন। যাই হোক, তোমাকে জানিয়ে রাখি, গিসিপ্পি আজ লন্ডনে গেছে। ওর কোনো আত্মীয় নাকি মোহে অঞ্চলে থাকে, সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকেই দেখতে গেছে। আজ রাতেই ফিরবে, মেরিনার সঙ্গে দেখা করে অনুমতি নিয়ে গেছে।

-ঠিক আছে।

-এই হাঁচিটা কিছুতেই কমাতে পারছি না। অ্যাটমাইজারের সাহায্য নিতেই হবে। আমি চলি জ্যাসন।

ক্ষুব্ধ মন নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো এলা। মেরিনা, মেরিনা, মেরিনা, এছাড়া অন্য কোনো চিন্তা কি আসতে নেই জ্যাসনের মনে।

অ্যাটমাইজার প্রথম বার স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ হয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। তেতো অ্যামন্ড বাদামের গন্ধে ভরে গেল ঘর।

স্থানীয় ইনসপেক্টর কর্নিশ খবর পেলেন, লোলা ব্রিডস্টার, মিঃ ফেন এবং মার্গট বেনস তিনজনেই আজ নিজস্ব কাজে শহরের বাইরে গেছেন। গিসিপ্পিও নাকি সকালেই লন্ডনে চলে গেছে। অবশ্য তার গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য পুলিশের লোক নিয়োগ করা হয়েছে। এলার-র অ্যাটমাইজার-এ সায়োনাইড ঢেলে দেবার কাজটা করা গিসিপ্পির পক্ষে খুবই সহজসাধ্য ছিল। মধ্যরাত্রিরও পরে গসিংটন হল-এ ফিরলো গিসিপ্পি। সেন্ট মেরী মিড-এ আসার ট্রেনটা ধরতে পারেনি সে। তাই, মার্কেট বেসিং থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আসতে হয়েছে।

মনটা খুব খুশী আছে তার। ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে হল-এ যাবার সর্টকার্ট রাস্তাটা ধরলো সে।

বাড়ির পেছনের দরজাটা নিজের চাবি দিয়ে খুললো সে। বাড়িটা অন্ধকার নিস্তব্ধতায় ভরা। বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল গিসিপ্পি। নিজের আরামদায়ক ঘরটিতে যাবার জন্য সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়, একঝলক ঠান্ডা হাওয়া লাগলো তার গায়ে, বোধহয় কোথাও কোনো জানলা খোলা আছে। এখন সেসব দেখার দরকার নেই। নিজের ঘরের দরজায় পৌঁছে চাবি বের করলো গিসিপ্পি। চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢোকার সময়ই সে অনুভব করলো ঘাড়ের ওপর একটা কঠিন জিনিসের স্পর্শ।

ট্রিগারে দুবার চাপ পড়লো। সামনের দিকে ঢলে পড়লো গিসিপ্পি।

নিচের ঘরে পরিচারিকা বিয়াংকার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। গুলির শব্দ হলো কি কোথাও। কিছুক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করলো সে। বোধহয় স্বপ্ন দেখছে সে। পরক্ষণেই আবার তলিয়ে গেল অতল নিদ্রায়।

হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঢুকলেন মিস নাইট। মিস মারপলকে দেখেই বলে উঠলেন,–কি সাংঘাতিক ঘটনা!

–আবার কিছু ঘটেছে নাকি?

–আমি আপনাকে বলতে চাই না ডিয়ার, এতে মানসিক আঘাত পেতে পারেন আপনি।

–আপনি না বললে, অন্য কেউ বলবে।

–তা অবশ্য খুবই সম্ভব। সবাই এত বেশি কথা বলে আজকাল।

–কি ঘটেছে?

–ঐ ইটালিয়ান বাটলারকে গত রাতে কেউ গুলি করে হত্যা করেছে।

-হ্যাঁ, এরকম একটা ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল। সে কিছু দেখেছিল বা জেনেছিল, এবং সে বিষয়ে মুখ খুলেছিল।

–আপনি কি আগে থেকেই এসব আন্দাজ করতে পেরেছিলেন নাকি? কি আশ্চর্য! কেন খুন করা হলে তাকে?

–সম্ভবত খুনীকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল।

–ওরা বলছিল, গতকাল নাকি সে লন্ডনে গিয়েছিল।

–ওরা নাকি? ইনটারেস্টিং! বাইরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দের সঙ্গে গানের সুর শোনা যেতেই মিস মারপল বুঝতে পারলেন, চেরী বেকার এসে গেছে। ডাকলেন তাকে,-চেরী আসবে একবার?

–কি বলছেন ম্যাডাম?

–গসিংটন হল-এর বাটলার গিসিপ্পি গতরাতে খুন হয়েছে, শুনেছো তুমি?

–কে বললো আপনাকে?

–মিসেস নাইট। বাজার থেকে শুনে এসেছেন।

–তা! এখানে আসার পথে আমার তো কারো সঙ্গে দেখা হয়নি, তাই খবরটা শুনতে পাইনি। সে খুন করলো ওকে?

জানা যায়নি। কাল সকালে নাকি ও লন্ডনে গিয়েছিল, রাত্রে ফিরেই খুন হয়েছে।

—লন্ডনে গিয়েছিল? তাহলে গ্ল্যাডিস কি ওর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিল তার আগে? কি জানি!

-গ্ল্যাডিস?

–আমার বন্ধুর মতো, আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে। স্টুডিও-র ক্যান্টিনে কাজ করে।

–সে কেন বাটলারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে?

-সেদিন পার্টিতে উপস্থিত ছিল তো, তা একটা নাকি মজার জিনিস দেখেছে। মিসেস বেডককের হাতের গ্লাসটা পড়ে যাওয়া নাকি ইচ্ছাকৃত। সেটাই বলবে বাটলারকে। আসলে ওসব একটা বাহানা, জানেন। ও ঐ গিসিপ্পিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে। একটু ঘনিষ্ঠতা করতে চায় আর কি।

মিস নাইটকে জানিয়ে দিলেন জেন মারপল, যে তিনি একটু একা থাকতে চান। একটু ভাবতে হবে তাকে। ঠিক কি দেখেছিল গ্ল্যাডিস? কে ইচ্ছাকৃতভাবে পানীয়টা ফেলেছিল? মিসেস বেডকক? কিন্তু কেন? মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেন মিস মারপল। কিছু একটা করতেই হবে। একা বাইরে যাওয়া নিষেধ, কিন্তু সেটা অমান্য করতেই হবে এবার।

সুদর্শন আমেরিকান যুবকটি এই রাস্তায় ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় পাকা চুলের এক ভদ্রমহিলাকে দেখে এগিয়ে এলো সে।

–মাপ করবেন ম্যাডাম। আপনি কি বলতে পারেন ব্লেনহেম ক্লোজটা কোথায়?

এখান থেকে ডানদিকে সোজা এগিয়ে বাঁ দিকে মোড় ঘুরবেন, তারপর ডানদিকে ঘুরে সোজা যাবেন। আপনি কার ঠিকানা খুঁজছেন? কত নম্বর?

-ষোলো নম্বর। গ্ল্যাডিস ডিক্সনকে খুঁজছি।

–ও, সে তো হেলিংফোর্থ স্টুডিওতে কাজ করে। ক্যান্টিনে। সেখানেই ওকে পাবেন।

–সে আজ সকালে কাজে আসেনি। গসিংটন হল-এ আজ কাজের লোক কম, তাই ডাকতে এসেছি ওকে।

-হ্যাঁ, তা তো বটেই। বাটলারকে তো কাল গুলি করে হত্যা করেছে কেউ? তাই না?

–এখানে খবর খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায়, তাই না?

-সত্যিই তাই। মিস্টার হাড-এর সেক্রেটারিও কালই কিভাবে যেন মারা গেছেন শুনেছি। কি যে হচ্ছে চারদিকে।

সেই দিনই আর একটু বেলার দিকে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট উইলিয়াম টিলার গ্ল্যাডিসের খোঁজ করতে তার বাড়িতে এলেন।

জানা গেল, গ্ল্যাডিস বাড়িতে নেই, কয়েকদিনের ছুটি কাটাতে গেছে। কোথায় যাচ্ছে সেটা পৌঁছে ফোন করে জানাবে। শুধু বলে গেছে, বিনে পয়সায় বেড়াতে যাবার একটা সুযোগ পেয়ে গেছে।

স্টুডিওতে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, গ্ল্যাডিস সকালেই ফোন করে জানিয়েছে, সে এক সপ্তাহ কাজে আসতে পারবে না। স্টুডিও মহল থেকে আরও জানা গেল, মেরিনা-র কফি-র কাপে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। তার স্বামী নিজে পরীক্ষা করিয়েছেন।

চীফ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক দেখা করলেন মেরিনা-র স্বামী জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে। অত্যন্ত বিচলিত দেখাচ্ছিল জ্যাসন হাড-কে।

–আমি যে কফিটা পরীক্ষা করিয়েছি, সেটা আমার নিজস্ব অধিকার বলেই করেছি ইনসপেক্টর।

যদি আপনি কফিতে কিছু মেশানো হয়েছে বলে সন্দেহ করে থাকেন, তবে আপনার উচিত ছিল, আমাদের সে কথা জানানো। আমারই ব্যবস্থা নিতাম।

–সত্যি কথাটা হচ্ছে, আমি এক মুহূর্তের জন্যেও সেরকম কিছু সন্দেহ করিনি।

–আপনার স্ত্রী বলেছিলেন, কফির স্বাদটা অন্যরকম লাগছে, তা সত্ত্বেও সন্দেহ করেননি?

-ওঃ, ঐ মেলার পরদিন থেকে আমার স্ত্রী তার প্রতিটি খাদ্য এবং পানীয়তেই বিষ মেশানো আছে বলে সন্দেহ করে চলেছেন। তার কারণ অবশ্য ইতিমধ্যেই মেরিনার প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া আরও দুটি চিঠি এসেছে।

চিঠি দুটি দেখলেন ইনসপেক্টর। অত্যন্ত শিশুসুলভ হুমকি বলে মনে হলো তার। অবশ্য তার মানে এমন নয়, যে এগুলো বিপদজনক হতে পারে না। শিশুসুলভ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন কম অপরাধী দেখেননি ক্র্যাডক।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জ্যাসন,এলা এইভাবে হঠাৎ মারা গেল, তার ওপর আবার গিসিপ্পির এই মর্মান্তিক মৃত্যু। আমার স্ত্রী তো ভয়ে পাগল হয়ে যেতে বসেছে। কবে ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবো ইনসপেক্টর?

–ইনকোয়েস্ট তো এখনও বাকি আছে মিস্টার হাড, কাজেই কিছু বলা যাচ্ছে না।

–সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন, মেরিনা-র প্রাণহানির আশংকা এখনও আছে?

–আমরা সবরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবশ্যই নেব মিস্টার হাড।

–একথা তো আগেও শুনেছি। মেরিনাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতেই হবে আমাকে। যত শিগগির সম্ভব।

শোবার ঘরে নিজের বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল মেরিনা। ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তায় বিবর্ণ দেখাচ্ছে তাকে। স্বামীকে এসে দাঁড়াতে দেখে অবসন্ন গলায় বললো,-ক্র্যাডক এসেছিলেন, তাই না? কেন? এলা-র জন্য?

–এলা আর গিসিপ্পি?

–গিসিপ্পিকে কে গুলি করেছে, সেটা কি ওরা জানতে পেরেছে?

–এখনও নয়।

–সব কেমন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে জ্যাসন। উনি কি বললেন? আমরা কি এখন এখান থেকে চলে যেতে পারবো? উনি কি বুঝতে পারছেন না, একজন দিনের পর দিন আমাকে খুন করার জন্য প্রতীক্ষা করছে। এই অবস্থায় আর কতদিন কাটানো যায়?

উনি বলেছেন, পুলিশ সবরকমভাবে সতর্ক থাকবে, যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটতে পারে।

-সতর্কতা! একথা তো ওরা আগেও বলেছিল, তাতে কি এলা আর গিসিপ্পিকে বাঁচাতে পারলো? আমি আতঙ্কে মরে যাচ্ছি জ্যাসন। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর, প্লিজ।

এই মৃত্যুগুলো যে ব্যাপারটাকে অনেক জটিল করে দিয়েছে মেরিনা। এছাড়া পালিয়েই কি বাঁচা যায়?

কিন্তু কে আমাকে এতটা ঘৃণা করে যে, আমাকে হত্যা করতে চায়, সেটা না জানলে আমি শান্তি পাবো কি করে? প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, নিশ্চিত হয়েছিলাম, যে এলা-ই এই কাজ করেছে। কিন্তু

–এলাকে সন্দেহ করেছিলে!

-তুমি বুঝতে পারো না, যে ও তোমার প্রেমে পাগল, আর আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারে না? পুরুষ মানুষের দৃষ্টিশক্তি এত কম! কিন্তু এখন এলা মারা যাওয়াতে সে সন্দেহটাও তো মিথ্যে হয়ে গেল।

–এত চিন্তা করো না ডার্লিং! আমি আছি তো! আমি তোমাকে আগলে রাখবো, চিরদিন।

–সত্যিই থাকবে তত জ্যাসন, আমার পাশে।

নিশ্চয়ই, একেবারে শেষ পর্যন্ত। সে সময়টা যতই কঠিন, যতই তিক্ত হোক না।

-তুমি কেমনভাবে কথাটা বললে জ্যাসন! তোমার হাসিমুখ দেখে মনে হচ্ছে একজন ক্লাউন যেন আগে থেকে একটা বিষাদময় পরিণতি দেখে ফেলেছে, যা আর কেউ দেখতে পায়নি।

ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ইনসপেক্টর পরদিনই দেখা করলেন মিস মারপল-এর সঙ্গে।

–আরাম করে বোসো। বুঝতে পারছি, খুব কঠিন সময় যাচ্ছে তোমার।

–আমি হেরে যেতে ভালোবাসি না আন্টি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুটো খুন হয়ে গেল। আমার কাজের পক্ষে নিজেকে খুবই অনুপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে।

যথোপযুক্ত সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে, এবং কড়া হুইস্কি পান করিয়ে ক্র্যাডককে একটু চাঙ্গা করে তুললেন জেন মারপল, তারপর জিজ্ঞেস করলেন–নাও। এবার সব কথা বল তো আমাকে। মানে, যতটা বলার অধিকার আছে তোমার।

আমার মনে হয়, আমি যা বলবো, তার সবটাই আপনি জানেন। এছাড়া আরও আমার না জানা কিছু তথ্য নিশ্চয়ই আপনার আস্তিনে লুকোনো আছে। আচ্ছা, আপনার ঐ দেহরক্ষী মহিলা মিস নাইট ও তো খুনী হতে পারে?

–সে কি? ও কেন খুন করতে যাবে?

–কেননা, ওরই খুন করার সম্ভাবনা সব থেকে কম।

-বাস্তবে ওরকম হয় না ডার্মট। সব সময় সে-ই খুন করে, যার পক্ষে খুন করার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। এই কথাটাই তো আমি বারবার বলেছি। এসব ক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই থাকে স্বামী, অথবা স্ত্রী। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে-ই খুনী প্রতিপন্ন হয়।

-জ্যাসন হাড! কিন্তু সে তো মেরিনাকে প্রায় পুজো করে।

–কথাটা আমি বৃহত্তর অর্থে বলেছি। মিসেস বেডকককে হত্যা করে তার স্বামী কোন দিক থেকেই লাভবান হতে পারে না, এটা আমরা জেনেছি। এবার যখন মনে হচ্ছে হত্যাকারীর আসল উদ্দেশ্য ছিল মেরিনা; তখন স্বভাবতই জ্যাসন হাড-এর দিকে সন্দেহের কাটাটা ঘুরে যাবে। আমিও তোমার সঙ্গে একমত, যে জ্যাসন তার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসে। এছাড়া সে নিজে একজন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত মানুষ। অর্থের প্রয়োজনে কাউকে খুন করার দরকারও নেই তার। স্ত্রীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য তাকে খুন করার দরকার কি। চিত্রতারকাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ব্যাপারটা তো একেবারেই রোজকার ঘটনার মতো স্বাভাবিক।

ক্র্যাডক-এর কাছ থেকে মার্গট বেনস-এর কথা শুনে ব্যথিত হলেন মিস মারপল। তিনি জানেন, শিশু মনকে কোনো ঘটনা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, তবে তা সে সারাজীবন চেষ্টা করলেও ভুলতে পারে না।

মিস মারপল এবার সেই মেলার দিনের ঘটনার খুঁটিনাটি বিবরণ নতুন করে জানতে চাইলেন। সেদিন যে সব ছবি তোলা হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে একটি ছবি মিস মারপলকে দেখালেন ক্র্যাডক।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে মেরিনা গ্রেগ-এর একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যাসন। একটু তফাতে আর্থর বেডকককে দেখা যাচ্ছে, সলজ্জভাবে মুখে হাত দিয়ে আছেন। তার স্ত্রী মেরিনা-র হাত ধরে, তার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলছেন। কিন্তু মেরিনা তার মাথার পেছনদিকে তাকিয়ে আছেন, মিসেস বেডকক-এর মুখের দিকে নয়। আর; মেরিনার মুখের ভাব হয়ে উঠেছে অনির্বচনীয়।

-হ্যাঁ, মেরিনার মুখে ভাবের এই অভিব্যক্তির কথাই আমি শুনেছিলাম ডলি ব্যান্টিং-এর কাছ থেকে। রিপোর্টার ভদ্রলোকও তোমাকে বলেছিলেন শুনেছি।

–হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন, মনে হয় মেরিনা যেন হঠাৎ শক পেয়েছিলেন।

–আচ্ছা, সেদিন মিসেস বেডক মেরিনার সঙ্গে যে সব কথা বলেছিলেন সে সম্বন্ধে আশেপাশের লোকেরা তোমাকে ঠিক কি কি বলেছিল?

–মোটামুটি সবাই একই কথা বলেছিলেন। মিসেস ব্যান্ট্রি বলেছেন, মিসেস বেডকক বলেছিলেন, তিনি নাকি আশৈশব মেরিনা-র ফ্যান। একবার মেরিনাকে দেখার জন্য চিকেন পক্স নিয়েই বিছানা থেকে উঠে চলে গিয়েছিলেন। জ্যাসন হাড ঐ ধরনেরই কথা বলেছিলেন, তবে অসুখটা বলেছিলেন ইনফ্লুয়েঞ্জা। আর্থার বেডককও বলেছিলেন, তার স্ত্রী তাকে ঐ ঘটনার কথা কয়েকবার বলেছেন। সে প্রায় দশ-বারো বছর আগেকার ঘটনা।

এবার, ইচ্ছে করে পানীয়ের পাত্রটি ফেলে দেবার ঘটনাটা নিয়ে ভাবা দরকার। কেন তিনি নতুন জামাটা নষ্ট করেছিলেন?

–কে? মিসেস বেডকক?

-হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, যদি না–আরে তাই তো! কি বোকা আমি, ব্যাপারটা অন্য দিক থেকে ভাবিনি। সেদিকটার দিকে এবার একটু আলো ফেলতে হবে।

–আচ্ছা আন্টি, আপনি তো প্রায় সব ঘটনারই অতীতের কোনো না কোনো ঘটনার সঙ্গে মিল দেখতে পান। এখানে কি সেরকম কিছু পাচ্ছেন?

-ঐ যে লরিস্টনদের পার্লারমেড ছিল যে মেয়েটা, তার কথা মনে পড়ছে। টেলিফোন রিসিভ করা তারই কাজের মধ্যে পড়তো, কিন্তু সে প্রায় সময়ই যা শুনতো, তা ঠিকঠাক লিখে রাখতে পারতো না। এইসব ভুল সংবাদ নিয়ে বহুবার বহু অনর্থ ঘটেছে ওদের পরিবারে! ওঃ,

আমি সময়মতো মেয়েটিকে নিরাপদে বোর্নমাউথে পাঠিয়ে দিতে পেরেছি!

–মেয়েটি? কোন মেয়েটি?

–ঐ যে গ্ল্যাডিস নামের মেয়েটি। যে গিসিপ্পির কাছে গিয়েছিল সেদিন।

–আপনি ওকে বোর্নমাউথে পাঠিয়েছেন? কেন?

–আমি ওর সঙ্গে দেখা করে কিছু টাকা দিয়েছিলাম, আর বলেছিলাম, এখনই কদিনের ছুটি নিয়ে চলে যেতে।

–এটা কেন করতে গেলেন?

–কেননা, আমি চাইনি ঐ মেয়েটিও খুন হোক।

.

দুদিন পরে মিস মারপলকে ব্রেকফাস্ট দিতে এসে মিস নাইট জানালেন, তার এক পরিচিত ভদ্রমহিলা শীতটা একটি বিলাসবহুল হোটেল-এ কাটাবেন। তিনি সঙ্গিনী হিসেবে মিস নাইটকে চেয়ে চিঠি লিখেছেন। যেতে পারলে মিস নাইট যে খুব খুশী হতেন, তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু মিস মারপলের ভাইপোকে কথা দিয়েছেন মিস নাইট, যে তিনি এখানেই বরাবরের মতো থাকবেন, কাজেই এই প্রস্তাবটা তার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেত বসলেন মিস মারপল। তিনি এখনও সেরকম স্থবির হননি, এবং হতেও চান না, যে মিস নাইট-এর পরিচর্যা ছাড়া চলবে না। এই অতিরিক্ত পরিচর্যা তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে।

ডক্টর হেডককে ডেকে পাঠালেন মিস মারপল। তাঁর বক্তব্য, বয়সের পক্ষে যথেষ্ট সুস্থ আছেন জেন মারপল। তবু একা একটা বাড়িতে তার থাকা উচিত নয়। মিস নাইটকে পছন্দ না হয়, অন্য কাউকে নিয়োগ করলেই হবে।

অল্প কয়েকটি কথা বলার পরেই বিদায় নিলেন মারপল। সময় নেই, প্রচুর জার্মান মিসেসের রোগী আছে তার হাতে।

ডাক্তারের এই শেষ কথাটা কেমন একটা নাড়া দিল মিস মারপলকে। জার্মান মিসে? অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ ওটা।

বাইরে চেরী-র ভ্যাকুয়াম ক্লিনার-এর শব্দ শোনা গেল। একমুহূর্ত কি ভেবে নিয়ে তাকে ভেতরে ডাকলেন মিস মারপল।

-কি ব্যাপার ম্যাডাম? আপনাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?

–আমি খুব অসহায় বোধ করছি চেরী। খুব বুড়ো, আর খুব অসহায়।

–এসব চিন্তা করবেন না, আপনি মোটেই দুর্বল বা অসহায় নন। আমাদের ওখানকার সবাই জানে, আপনি কত অসাধারণ সব সমস্যার সমাধান করেছেন। তারা কেউ আপনাকে অসহায় ভাবে না। ঐসব চিন্তা আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে ঐ মহিলাটি।

-মহিলা?

-ওই যে আপনার মিস নাইট। সর্বক্ষণ এত পুতুপুতু করে আপনাকে নিয়ে, যে মনে হয় আপনি একেবারেই অথর্ব। ওকে একেবারে পাত্তা দেবেন না।

–ভদ্রমহিলা খুবই সহৃদয় চেরী।

–অতিরিক্ত যত্ন বেড়ালকেও মেরে ফেলে ম্যাডাম। কেউ আপনার ওপর জোর করে দয়া চাপিয়ে দিলে, সেটা আপনার মোটেই ভালো লাগার কথা নয়।

–কি করা যাবে চেরী। আমাদের প্রত্যেককেই নিজের নিজের সমস্যার সঙ্গে সমঝোতা করে চালিয়ে নিতে হয়।

–তা অবশ্য খুবই সত্যি কথা। এই যে আমার প্রতিবেশিনী মিসেস হার্টওয়েল। ওঁর পাশাপাশি বেশিদিন থাকতে হলে, কবে যে একটা দুর্ঘটনাটা ঘটে যাবে। সবসময় পরচর্চা আর অভিযোগ নিয়েই আছে। গতকালই তো আমার জিম-এর সাথে খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে ওনার। কি না আমরা একটু জোরে মিউজিক চালিয়েছিলাম।

-তোমাদের কি মিউজিকটা চালাতেই হবে?

–জিম ওটাই পছন্দ করে। ও বলে ভল্যুমটা পুরো না বাড়িয়ে দিলে টোনটা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আসলে আমাদের বাড়িগুলো একটা অন্যটার সাথে পাতলা দেওয়াল দিয়ে জোড়া। এমনিতে ছোটোর ওপর সুন্দর বাড়ি হলেও, ওখানে নিজের ব্যক্তিত্বকে ঠিকমতো প্রকাশ করা যায় না, এটাই অসুবিধে।

প্রকাশ করার মতো প্রচুর ব্যক্তিত্ব তোমার আছে তাই না চেরী? সস্নেহে বললেন জেন মারপল।

খুশীর সঙ্গে লজ্জা মিশলো চেরীর মুখে। হাতের ট্রে-টা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এলো।

-একটা কথা বলবো ম্যাডাম? আপনি শুনে যদি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না, আমি কিছু মনে করবো না।

–তুমি কি আমাকে কিছু করতে বলছো?

-ঠিক তা নয়। ঐ যে আপনার রান্নাবাড়ির ওপরে যে ঘরগুলো আছে? আজকাল আর ওগুলো ব্যবহার করা হয় না, তাই না?

-না।

–আগে আপনার মালি তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে শুনেছি। তাই ভাবছিলাম, মানে, আমি আর জিম ভাবছিলাম, যদি আমরা ওখানে এসে থাকতে পারি–

–সে কী? তোমরা ঐ নতুন সুন্দর বাড়িটা ছেড়ে দেবে?

–আমরা দুজনেই বিরক্ত হয়ে গেছি। ওখানকার গ্যাজটগুলো আমরা পছন্দ করি। কিন্তু সে তো যে কোনো জায়গায় গিয়েই হায়ার পারচেজ-এ কিনে নেওয়া যায়। এখানে ঘরগুলো কত বড়ো। জিম মনের সুখে একটা ঘর শুধু যন্ত্রপাতি রাখার জন্য ব্যবহার করতে পারে। ওখানে যদি আমরা মিউজিক বাজাই, আপনি এখান থেকে শুনতেই পারবেন না।

-তুমি কি এ ব্যাপারে সিরিয়াস, চেরী?

–নিশ্চয়ই। জিম আর আমি এ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। জিম আপনার জলের কল সারানোর বা কাঠের কাজ ইত্যাদি করে দিতে পারবে। আমি আপনার দেখাশোনা করবো। ঘরের কাজ সত্যি যত্ন নিয়ে করবো দেখবেন? আর, ঐ মিসেস নাইটের থেকে আমি অনেক ভালো রান্না করি, জানেন।

এই প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরুণীটির আগ্রহভরা মুখের দিকে চেয়ে খুব ভালো লাগলো মিস মারপলের।

–ঠিক আছে চেরী, এটা আমি ভাববো।

–আমি অবশ্য মিস নাইটের ক্ষতি করতে চাই না ম্যাডাম।

-না, উনি আর একটা মনের মতো কাজ পেয়েছেন। আমার অনুমতি পেলেই সেখানে যেতে পারেন।

আমি এখন আসি ম্যাডাম। আর্থার বেডককের কথাটা শুনতে গিয়ে আজ আসতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

–আর্থার বেডকক? কি হয়েছে তার?

-আপনি শোনেননি? তাকে যে পুলিশস্টেশনে নিয়ে গেছে! সে-ই নাকি মেরিনা গ্রেগ-এর প্রথম স্বামী!

–বল কি চেরী?

-হা ম্যাডাম। শোনা যাচ্ছে কেরিয়ার শুরু করার আগে আর্থার-এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মেরিনার। এক দেড় বছর টিকেছিল বিয়েটা। তারপরেই মেরিনা একটা ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পান, আর্থার তার জীবন থেকে মুছে যায়। ইংলন্ডে এসে, পদবীটা পাল্টে নিয়েছে আর্থার, তবে পুরোনো, রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসাতেই লেগে আছে। পুলিশ এখন তাকেই সন্দেহ করছে।

-না না, এটা তো হতে দেওয়া যায় না। চেরী, ট্রে-টা নিয়ে যাও, আর মিস নাইটকে ডেকে আনো।

বিছানা থেকে উঠে পোশাক পাল্টে নিলেন মির মারপল। মেডিকেল বুকটা নামিয়ে এনে ঠিক একটা জিনিস দেখে নিলেন। একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে মনে, শুধু যদি কারও সমর্থন পাওয়া যেত। হঠাৎ ভাইকার-এর কথা মনে পড়লো, তিনিও তো সেদিন অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন। যদি ভাগ্যক্রমে তার কিছু মনে থাকে! টেলিফোন খুলে ভাইকার-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন মিস মারপল। সৌভাগ্যক্রমে তিনি মনে করতে পারলেন মিসেস বেডকককে, মেরিনাকে তার কি ধরনের অসুস্থতার কথা বলেছিলেন। জার্মান মিসসের কথা বলেছিলেন মিসেস বেডকক; নিজের কানে শুনেছেন ভাইকার।

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মিস নাইটের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ট্যাক্সি ডেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

গসিংটন হল-এ পৌঁছে জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন মিস মারপল।

গিসিপ্পির জায়গায় যে নতুন বয়স্ক শীর্ণ বাটলারটি নিযুক্ত হয়েছে, সে জানালো,-মিস্টার হাড, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সঙ্গে দেখা করেন না ম্যাডম, বিশেষত আজ

–আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা নেই। কিন্তু আমি অপেক্ষা করবো।

এগিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসলেন তিনি। অসহায়ভাবে বাটলারটি বললো,আজ সকালে ওঁর সঙ্গে দেখা করাটা একেবারেই অসম্ভব ম্যাডাম।

–সেক্ষেত্রে আমি বিকেল পর্যন্ত বসে থাকবো। ঘাবড়ে গিয়ে আর একজন তরুণকে ডেকে নিয়ে এলো সে। মিস মারপল জানলেন, এ হচ্ছে জ্যাসন হাড-এর সেক্রেটারি হেইলি সেটন।

-আরে, আমি আপনাকে আগে দেখেছি, আপনি ব্লেনহেম ক্লোজ-এ যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করেছিলেন না?

হ্যাঁ, আপনি অবশ্য ঠিক পথটা বলে দিতে পারেননি। সম্পূর্ণ উল্টো দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

–আরে, তাই নাকি? আসলে এত নানারকম ক্লোজ এখানে–আচ্ছা, আমি কি মিস্টার হাড-এর সঙ্গে দেখা করতে পারি? আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি।

–আপনি বরং আমাকে বলুন আপনার প্রয়োজনের কথাটা। যাঁরা মিঃ হাড-এর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আমার সঙ্গেই প্রথমে দেখা করতে হয়।

–আমি ওনার সঙ্গেই দেখা করবো। তার জন্য যতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, করবো।

অগত্যা ডক্টর গিলক্রিস্টকে ডেকে নিয়ে গেল প্রেসটন, ডাক্তার জানালেন ডক্টর হেডকক-এর কাছ থেকে মিস মারপল-এর কথা শুনেছেন তিনি। মিস মারপল জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে দেখা না করে এখান থেকে যাবেন না শুনে তিনি বললেন,-জ্যাসন হাড যে আজ কারো সঙ্গে দেখা করবেন না, তার একটা সঙ্গত কারণ আছে মিস মারপল। তার স্ত্রী কাল রাত্রে ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন।

মারা গেছেন। কিভাবে?

বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে। আমরা এখনই প্রেস-কে খবরটা দিতে চাই না। কাজেই আপনাকে অনুরোধ করছি, কথাটা কাউকে বলবেন না।

–নিশ্চয়ই। আচ্ছা, এটা কি একটা দুর্ঘটনা?

–আমার তাই মনে হয়।

–আত্মহত্যাও হতে পারে?

হতে পারে, কিন্তু সেটার সম্ভাবনা কম।

–অন্য কেউ ওঁর ওপর প্রয়োগ করতেও পারে।

–এর সম্ভাবনা একেবারেই নেই বলেই আমি বিশ্বাস করি। সেটা প্রমাণ করাও অসম্ভব।

-আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু ডক্টর, আমাকে যে এখুনি মিস্টার হাড-এর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

–এখানে অপেক্ষা করুন।

গিলক্রিস্ট ঘরে ঢুকতেই মুখ তুলে চাইলেন জ্যাসন হাড।

নিচে একজন বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা না করে এখান থেকে যাবেন না বলছেন। মনে হয় বিশেষ জরুরী কোনো কারণ আছে। আমার মনে হয় ওঁর সঙ্গে দেখা করাই ভালো।

–ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিন এখানে। কিছুতেই আর কিছু এসে যায় না।

রোগা চেহারার বৃদ্ধাটিকে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন জ্যাসন।

-আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন? কি করতে পারি আপনার জন্য?

–আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে খুবই দুঃখিত হয়েছি আমি। এ সময়ে আপনাকে বিরক্ত করার কোনো অধিকার নেই আমার। কিন্তু কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার করে না নিলে, একজন নিরপরাধীরা অহেতুক শাস্তি পাবে। তাই এভাবে আসতে বাধ্য হলাম।

-নিরপরাধী? কার কথা বলছেন?

–আর্থার বেডকক। পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেছে।

কি আশ্চর্য! সে তো আমার স্ত্রীকে চেনেই না। তার কাছেও আসেনি সেদিন।

–সে আপনার স্ত্রীকে চেনে মিঃ হেড। আপনার স্ত্রীর প্রথম স্বামী ছিল এই আর্থার বেডকক।–কিন্তু তার নাম তো ছিল আর্থার বিডল।

–ইংল্যান্ডে এসে নামটা পাল্টে নিয়েছে সে। আমি আপনাকে কাল্পনিক গল্প শোনাচ্ছি না, এটাই বাস্তব সত্য।

খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা! তা আমি সেজন্য কি করতে পারি?

–সেদিন মেরিনা কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন, সেই জায়গাটা একটু দেখতে চাই।

নিশ্চয় আসুন আমার সঙ্গে।

জ্যাসন দেখালেন কোথায় সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন মেরিনা। সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিক ভালো করে দেখলেন মিস মারপল। সিঁড়ির ঠিক ওপরেই আছে হাস্যমুখী মেরী ও শিশু যীশুর একটি প্রাণোচ্ছল ছবি।

–ধর্মীয় ছবি। কিন্তু একটা সুখী মা ও তার সন্তানের ছবিও বটে। তাই না মিস্টার হাড?

–হ্যাঁ।

-এখন আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা সরল, পরিষ্কার হয়ে গেছে। আপনার কাছেও নিশ্চয়ই আর কিছু অস্পষ্ট নেই।

নিচে পায়ের শব্দ ও গলার আওয়াজ শোনা গেল। চী ইনসপেক্টর ক্র্যাডক এসে যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে। মিস মারপলকে এখানে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি।

সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েই সেদিনের ঘটনার প্রেক্ষাপট, মেরিনার চেহারায় লেডি শ্যালটের মতো ধ্বংস নেমে আসার ইঙ্গিত ইত্যাদি নিয়ে কথা হলো, একটা নতুন কথা বললেন মিস মারপল। তিনি বুঝতে পেরেছেন ধ্বস নেমে আসছিল সেদিন মেরিনার ওপর নয়, মিসেস বেডকক-এর ওপর আর তার বীজ লুকিয়ে ছিল মিসেস বেডককের একটি কথার ওপর।

–সে কথা তো আমার সবাই শুনেছি, তার অসুস্থতা সত্ত্বেও কিভাবে মেরিনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

-হ্যাঁ, কিন্তু তার অসুখটা ছিল জার্মান মিসেস। এই রোগটা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের পক্ষে মারাত্মক। আর, সেই সময় মেরিনা গর্ভবতী ছিলেন, তাই না মিস্টার হাড?

-হ্যাঁ। চিকিৎসক ওকে বলেছিলেন, গর্ভাবস্থায় ঐ রোগ হওয়ার জন্যই তার সন্তান সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে জন্মাতে পারেনি। এটা মেরিনা কখনো ভুলতে পারেনি। অবশ্য সে জানতো না, এই অসুখের সংক্রমণটা তার হয়েছিল কার কাছ থেকে।

তাই জানতে পেরেই এতদিনের রুদ্ধ বেদনা ক্রোধের আকার নিল। মিসেস বেডকককে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন মেরিনা। তার গ্লাসটা হাতের ধাক্কায় ফেলে দিয়ে নিজের বিষ মেশানো গ্লাসটি তুলে দিয়েছিল মিসেস বেডককের হাতে। মেরিনার সঙ্গেই থাকতো ঐ ওষুধ। প্রায়শই নিজের পানীয়ে মিশিয়ে নিতে সে, তাই ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করে দেখেনি।

মেরিনা-ই যে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্লাসটা ফেলে দিয়েছিল, সেটা দেখেছিল গ্ল্যাডিস এবং সম্ভবত এলা। গ্ল্যাডিসের কাছ থেকে খবর পেয়ে গিসিপ্পি এবং এলা, এরা দুজনেই মেরিনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। অবশ্য এলা শুধু ভয়ই দেখিয়েছিল টেলিফোন মারফত। গিসিপ্পি চেয়েছিল টাকা। প্রথম দফার টাকাটা সে লন্ডনে ব্যাংকে রেখেও এসেছিল। কাজেই তাদের সরাতে না পারলে মেরিনার বিপদ কাটছিল না। তাই আরও দুটি হত্যা করলো মেরিনা, আর, নিজেই নিজের কফিতে বিষ মিশিয়ে, ভুয়ো চিঠি দেখিয়ে নিজেকে সন্দেহের উর্দ্ধে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। এটা আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাই না মিস্টার হাড? আর্থার বেডকককে কি চিনেছিলেন আপনার স্ত্রী।

-মনে হয় না। তাহলে আমাকে নিশ্চয় বলতো।

জ্যাসনের সঙ্গে মেরিনাকে দেখতে এলেন মিস মারপল। দুগ্ধধবল বিছানায় শুয়ে থাকা মেরিনাকে দেখাচ্ছে পরীর দেশের মেয়ের মতো। বিছানার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন জ্যাসন, ভাঙা গলায় বললেন,–এটাই কি ভালো হলো না মিস মারপল, অনেক কষ্ট পেয়েছে জীবনে। মৃত্যুতে অন্তত শান্তি পেল।

–সেই শান্তি হয়তো আপনিই এনে দিয়েছেন, তাইনা। আপনি তাকে এত ভালোবাসতেন –এত সুন্দর, এত ভালো ছিল মেরিনা অথচ সবাই ওকে কেবল কষ্ট দিয়েছে, কেউ ওর মনের কথা বোঝেনি।

Exit mobile version