- বইয়ের নামঃ ডাকাতের পিছে
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার
ডাকাতের পিছে
০১.
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। দড়াম করে বন্ধ হলো। গটমট করে ভেতরে ঢুকলেন। মিসেস আমান। চোয়াল কঠিন। ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট চেপে বসা। হ্যান্ডব্যাগটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে।
আর সহ্য হয় না এই অত্যাচার! কপাল চাপড়ে বললেন তিনি। ইচ্ছে করছে গুলি করে শেষ করে দিই। তারপর আমার জেল-ফাঁসি যা হয় হোক!
কি হয়েছে, মা? শঙ্কিত হয়ে উঠেছে মুসা।
কি আর! তোর নানা! আবার একটা অঘটন ঘটিয়েছে!
আবার কি করল?
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রথমে মুসার দিকে তাকালেন মিসেস আমান। তারপর একে একে তার দুই বন্ধু কিশোর আর রবিনের দিকে। ডাইনিং টেবিলে বসে বিস্কুট খাচ্ছে ওরা।
পানি ছিটানোর জন্যে একটা ফোয়ারা বসিয়ে দিয়ে এসেছে গির্জার হলরুমে। নতুন ধরনের একটা স্প্রিঙ্কলার সিসটেম। ঘর ধোয়ার জন্যে। ভালমানুষী করে দান করেছে। করেছে, ভাল কথা, কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের আরও একখান আবিষ্কার লাগিয়ে দিয়ে এসেছে। ফোয়ারা চালু করার একটা যন্ত্র। সুইচ টিপলে হালকা ধোয়া তৈরি করে যন্ত্রটা, সেই ধোয়া গিয়ে লাগে সিসটেমে, চালু হয়ে যায়। তাতেই হয়েছে সর্বনাশ। হলঘরটা ভাড়া নিয়ে মহিলারা ফ্যাশন শো করছিল। এই সময় জ্বালানো সিগারেট নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়লেন পাদ্রী সাহেব। ব্যস, কোন দিক থেকে যে কি ঘটে গেল, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল ঘরের সমস্ত লোক। ফ্যাশন শো মাথায় উঠল। মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসেছে কোম্পানি। টাকাটা বাবাকে দিতে হবে। হুমকি দিয়েছে, নইলে কেস করে দেবে তার নামে। বাজারে গিয়েছিলাম। মিসেস গিলবার্ট আমাকে এ খবর জানাল। কেন বাপু, দুনিয়ায় এত জিনিস থাকতে ধোয়াকে ট্রিগার করার কুবুদ্ধি কেন? আর কি কিছু ছিল না?
হাসি দমন করার অনেক চেষ্টা করেও পারল না মুসা। বলল, নানা হয়তো ভেবেছিল এখন দুনিয়া জুড়ে সিগারেট বিরোধী আন্দোলন চলছে, ধোয়া কোন সমস্যা নয়। তা ছাড়া গির্জার ভেতর তো কেউ সিগারেট খায় না। স্বয়ং পাদ্রী সাহেবই যে এই কাণ্ডটা করে বসবেন, তা কি আর নানা ভেবেছিল।
দেখ, অত হাসবি না! গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা কর! ধমকে উঠলেন মিসেস আমান। কিন্তু বেশিক্ষণ তিনিও গভীর থাকতে পারলেন না। ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দিল। আর ঠেকানো গেল না ছেলেদের। হাসির রোল পড়ে গেল।
কিশোর বলল, কাজটা তিনি ভালই করতে গিয়েছিলেন। দোষটা তো। পাদ্রী সাহেবের।
মোটেও তা নয়, আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন মিসেস আমান। দোষটা আমার বাবারই। অত সেনসিটিভ একটা ট্রিগার কেন বানাতে গেল? আর সেটা বসাতেই বা গেল কেন ওরকম একটা জায়গায়, যেখানে পাবলিক মীটিঙ চলে? প্রার্থনার সময় কেউ খায় না বটে, কিন্তু অন্য অনুষ্ঠান চলার সময় যে কেউ সিগারেট খেতে পারে ওখানে। সরকারী চাকরিতে যতদিন ছিল, ভাল। ছিল। অকাজ করার সময় পেত না তখন। রিটায়ার করার পরই ধরেছে। ভূতে। খালি আবিষ্কারের চিন্তা। উদ্ভট সব ভাবনা মাথায় ঘোরে। একবার বানাল তেরপলের ছাতওয়ালা একটা বাড়ি। ভাজ করে সরিয়ে রাখা যায় ওই ছাত। কিন্তু তার নিচে আর বাস করার সাধ্য হলো না কারও। টানা-হেঁচড়ায় এত ছিদ্র হয়ে গেল, বাইরে বৃষ্টি পড়ার আগেই ভেতরে পড়ে।
আবার একচোট হাসাহাসির পর মিসেস আমান বললেন, আরও কত কাণ্ড যে করেছে, যদি জানতে! সারাজীবনে জরিমানা যা দিয়েছে, সেগুলো। জমিয়ে রাখতে পারলে এখন বড়লোক থাকতাম আমরা। বাবা ভীষণ বদমেজাজী। কথায় কথায় লোকের সঙ্গে ঝগড়া বাধায়, হাতাহাতি করতেও ছাড়ে না। আমাদের বাড়ির সামনে একটা এলম গাছ আছে। কি নাকি রোগ হয়েছে ওটার, রেখে দিলে আশপাশের অন্য গাছেরও হতে পারে এই ভয়ে একদিন পার্ক ডিপার্টমেন্টের লোকেরা এসে সেটা কাটতে চাইল। বেকে বসল বাবা। কিছুতেই কাটতে দেবে না। কথা কাটাকাটি হতে হতে একসময় ঘর থেকে গিয়ে হকি স্টিক নিয়ে এল। এলোপাতাড়ি পেটানো শুরু করল। পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরে দিল বাবাকে। উকিলের পেছনে অনেক টাকা খরচ করে শেষে বের করে আনা হলো। মোটা টাকা জরিমানা তো করলেনই জজ সাহেব, শাসিয়ে দিলেন, ফের এ রকম করলে জেল-জরিমানা কোনটাই আর মাপ হবে না।
চুপ করে দম নিলেন মিসেস আমান। তারপর বললেন, এখন ধরেছে নিউ ইয়র্ক যাবার বাতিক!
খাইছে! হাসি চলে গেল মুসার মুখ থেকে। রকি বীচ থেকে নাকি আর কোথাও নড়বে না?
একেবারে যাচ্ছে না তো। একটা বিশেষ কাজে যেতে চায়। তার মতে কাজটা খুবই জরুরী। কি একটা আবিষ্কার করেছে। জিনিসটা কি, এ ব্যাপারে কোন ধারণা দিতেও নারাজ। নিউ ইয়র্ক যাওয়া ছাড়া নাকি ওটার গতি করা যাবে না। অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি–না গিয়ে কিছু করা যায়। কিনা, শোনে না। বলে টেলিফোন কিংবা চিঠিতে কাজ হবে না, নিজেকেই যেতে হবে। সামনাসামনি প্রচুর আলোচনার দরকার।
গেলে যাক না। অসুবিধেটা কি?
অসুবিধে আছে। কার কাছে যাচ্ছে, কিছু জানি না। যাওয়ার পর সেই লোক যদি দেখা করতে রাজি না হয়? যদি কাউকে দিয়ে বলিয়ে দেয়-বাড়ি যান, চিঠিতে যোগাযোগ করুনগে? কাণ্ডটা কি করবে জানিস না? জোর করে ঢৈাকার চেষ্টা করবে!
দূর, বেশি বেশি দুশ্চিন্তা করছ তুমি।
দেখ, আমার বাপকে আমি চিনি! না শব্দটা শুনতে রাজি নয় বাবা। তার হলো বদমেজাজ। যার কাছে যাচ্ছে যদি সে দেখা করেও, বাবার ধারণার সঙ্গে একমত হতে না পারে, তাহলেও যাবে রেগে। তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসতে পারে।
মা, তুমি শুধু শুধু…
মুসার কথায় কান দিলেন না মিসেস আমান। আমি জানি এইই ঘটবে! খেপে গিয়ে অনর্থ ঘটাবে বাবা। ওরা তখন পুলিশ ডাকবে। মনে নেই, সৌরশক্তির সাহায্যে পানি ফুটানোর যন্ত্র আবিষ্কার করে কি গোলমালটাই না পাকিয়েছিল? ঘরের আর্দ্রতা দূর করার যন্ত্র নিয়েও একই অবস্থা। যন্ত্রটা ঠিকমতই কাজ করছিল, ভাঁজ করা ছাতের মত হয়নি। তবে বাবার আগেই নাকি ওই যন্ত্র আবিষ্কার করে বসেছিল আরেকজন। বাবা গেল খেপে। বলে। বেড়াতে লাগল, তার ফর্মুলা চুরি করেছে ওই লোক। ভাবো একবার! সেই লোক থাকে আইওয়ায়। কোথায় রকি বীচ আর কোথায় আইওয়া। এত দূরে বসে কি করে চুরিটা করল? এ সব ফালতু কথা বলার কোন মানে আছে? সেই লোকের কানে গেলে নির্ঘাত কেস ঠুকে বসত, দিত মানহানির মামলা করে।
চুপ হয়ে গেল মুসা।
পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। বিস্কুট খাওয়া ভুলে গেছে।
মিসেস আমান বললেন, বুঝতে পারছি না, রওনা হয়েই না আরেকটা অঘটন ঘটিয়ে দেয়!
দেবে না, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল মুসা। অর্থাৎ তাকে করতে দেয়া হবে না। তুমি কিছু ভেব না, মা। আমরা পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে প্লেনে তুলে দিয়ে আসব।
প্লেনে গেলে তো! ঠিক করেছে, মোটরগাড়িতে যাবে। নিজে গাড়ি চালিয়ে। মনটানার ভেতর দিয়ে নাকি যায়নি কখনও। ওরিগন আর ওয়াশিংটনও দেখেনি। এবার সব দেখতে চায়। আরও যুক্তি আছে, গাড়ি চালানোর সময় নাকি তার মগজ সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তার বিশ্বাস, সাংঘাতিক কোন আবিষ্কারও করে বসতে পারে ওই সময়! এ সুযোগ। কোনোমতেই হারাতে রাজি নয়।
হেসে ফেলল মুসা। মা, এতই যখন দুশ্চিন্তা, নানার সঙ্গে তুমিও চলে যাও না কেন? ঘর নিয়ে ভেব না। আমি আর বাবা মিলে সামলে নিতে পারব।
আমি! মাথা খারাপ! ভাল করেই জানিস, বাবার সঙ্গে দশটা সেকেন্ডও বনে না আমার! গাড়িতেই খুনোখুনি বেধে যাবে! তার চেয়ে এক কাজ কর, তুইই চলে যা। বেড়াতে খারাপ লাগবে না।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। মা, সত্যি বলছ!
বলছি। যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করব। তবে একটা শর্ত আছে–বাবাকে সব গোলমাল থেকে দূরে রাখতে হবে। পুলিশ তাকে ধরবে না, সে কারও মাথা ফাটাবে না, তুই সব ঠেকাবি।
আমার সাধ্যমত চেষ্টা আমি করব। কিন্তু নানাকে একা সামলানো…
খুব কঠিন, এই তো? আমিও সেটা জানি। সেজন্যেই ভাবছি, আরেক কাজ করা যেতে পারে–তোরা তিনজনেই চলে যা। ঘোষণা করলেন তিনি, তিন গোয়েন্দাকে ভাড়া করতে রাজি আছি। প্রয়োজনে খরচাপাতিও দেব। আমার বাবাকে পাহারা দিয়ে নিরাপদে নিউ ইয়র্ক পৌঁছে দিতে হবে। সেখানেও তার নিরাপত্তার দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
হাসল কিশোর। চকলেট মেশানো বড় একটা বিস্কুটের আধখানা কামড়ে কেটে নিয়ে বলল, কিন্তু, আন্টি, আমরা গোয়েন্দা, বডিগার্ড নই।
তা ঠিক, গোয়েন্দা আর বডিগার্ড এক নয়, মেনে নিলেন মিসেস আমান। কিন্তু গোয়েন্দারা আর কোন কাজ করতে পারবে না, এমনও কোন বিধিনিষেধ নেই। বডিগার্ডই ভাবছ কেন? বেড়াতে যাচ্ছ, সেই সময়ে একজন লোকের কিছুটা খেয়াল রাখছ, এই তো। বিনিময়ে বেড়ানোর খরচটা পাবে।
বডিগার্ডের চেয়ে খারাপ, ফোড়ন কাটল মুসা, মানুষের কেয়ারটেকার। তবে গাড়িতে করে নিউ ইয়র্ক যাওয়া সত্যি লোভনীয়। এ দিক বিবেচনা করে যে কোন কাজ করতে রাজি আছি আমি। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কি বলো?
কিশোর তাকাল রবিনের দিকে। নথি-গবেষকের মতামত চায়।
আমি রাজি, বলে দিল রবিন। মুসার নানা আমাদেরও নানা। তাঁর কেয়ারটেকার হতে আপত্তি নেই আমার।
কিন্তু নানাটা কি জিনিস ভাবতে হবে! চিন্তায় পড়ে গেছে মুসা। বেরিয়ে না শেষে পস্তাতে হয়!
কেন? ভুরু নাচাল কিশোর।
নানার কেয়ারটেকার হওয়ার চেয়ে খেপা গণ্ডারের কেয়ারটেকার হওয়া অনেক সহজ। সব কিছুতে সন্দেহ। মেজাজের ঠিকঠিকানা নেই। এই ভাল তো এই খারাপ। প্রতি মুহূর্তে কত আর সামলানো যায়!
তা বটে, একমত হলেন মা। বাবার ধারণা, তার মত সৃষ্টিশীল মানুষদের পেছনে সব সময় লোক লেগে থাকে–বলে, পাগল, মাথায় ছিট। আড়চোখে তাকায়, ব্যঙ্গ করে, উল্টোপাল্টা কথা বলে। রেগে গিয়ে তাদের। সঙ্গে ঝগড়া বাধালে দোষ দেয়া যায় না। আরেক ধরনের লোক আছে, তারাও পিছে লাগে, তারা আবিষ্কারের ফর্মুলা ছিনিয়ে নিতে চায়। সেজন্যেই এত সন্দেহ…
টেলিফোন বাজল।
সেদিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করলেন মিসেস আমান। কে আবার করল?
উঠে দাঁড়াল মুসা। তুমি বসো। আমি ধরছি।
রিসিভার কানে ঠেকিয়ে হালো বলল সে। নীরবে শুনতে লাগল। ওপাশের কথা। তারপর বলল, মাকে বলছি!
রিসিভার রেখে ঘুরে দাঁড়াল সে। মা, মিস্টার পেইত্রি। নানার বাড়ির। উল্টোদিকে যার বাড়ি। আজ নাকি নানার সঙ্গে তার দাবা খেলার কথা ছিল। গিয়ে দেখেন নানা নেই। সারা বাড়ি খুঁজেছেন, কোথাও পাননি। পেছনের দরজা খোলা। রান্নাঘরে সিঙ্কের কল খোলা, পানি পড়ছে। এখুনি পুলিশকে খবর দিতে বললেন।
হয়তো ঘুরতে বেরিয়েছে। চলে আসবে। এত তাড়াতাড়ি পুলিশে খবর দেয়ার দরকার নেই।
মা, গাড়িটা নাকি ড্রাইভওয়েতেই আছে। হাঁটতে গেলেও কি দরজা খোলা রেখে যেত? কলই বা খোলা কেন?
হু! তা-ও কথা! চল, যাই!
উঠে দাঁড়াল কিশোর। আপনার যাওয়া লাগবে না, আন্টি, আগে আমরাই যাই। তিন গোয়েন্দার আসল কাজ পাওয়া গেছে, রহস্য। দরকার হলে আপনাকে ফোন করব।
.
০২.
মিস্টার রাবাতের বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন মিস্টার পেইত্রি। রোগাটে শরীর, চুলের অনেকখানি ধূসর হয়ে এসেছে, মুখের বাদামী চামড়া কুঁচকানো। বসন্তের এই উজ্জ্বল আলোকিত দিনেও মুখ বাদলের মেঘলা আকাশের মত অন্ধকার।
মুসাকে বললেন, তোমার নানার স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মেলে না! দাবা খেলার কথা দিয়ে কখনও মিস করেনি। তা ছাড়া আগের খেলায় হেরে গিয়ে খেপে আছে আমাকে হারানোর জন্যে। কোন ব্যাপারেই হার সহ্য করতে পারে না সে।
জানি, পেইত্রির সঙ্গে মুসাও একমত।
সামনের দরজায় তালা নেই। ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পেছন পেছন এলেন পেইত্রি। নিশ্চয় খারাপ কিছু ঘটেছে। এ ভাবে দরজা খুলে, কল ছেড়ে রেখে দূরে যাওয়ার কথা নয়। কোন কারণে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। হয়তো এমন কিছু চোখে পড়েছিল, কল বন্ধ করার কথাও মনে ছিল না।
রান্নাঘরে ঢুকল গোয়েন্দারা।
সিঙ্কের ওপরে কলটার দিকে তাকাল কিশোর। ভঙ্গি দেখে মনে হলো, তার প্রশ্নের জবাব চাইছে ওটার কাছে। বিড়বিড় করে বলল, পানি গরম। করতে যাচ্ছিলেন। কেটলির ঢাকনা খোলা। সিঙ্ক থেকে পানি নেয়ার সময়। জানালা দিয়ে সত্যি কিছু চোখে পড়েছিল তার? কি?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। ভাবছে, কি দেখেছিলেন রাবাত? লনের একটা অংশ চোখে পড়ছে। তার ওপারে সুন্দর করে ছাটা পাতাবাহারের বেড়া আলাদা করে দিয়েছে পাশের বাড়ির সীমানাকে। এ পাশটা যেমন পরিচ্ছন্ন, ওপাশটা তেমনি নোংরা। আগাছা হয়ে আছে, কেউ কাটে না। বাড়িটাও মেরামত হয় না কতদিন কে জানে। দরজার পাল্লা আর জানালার ফ্রেমের রঙ মলিন হয়ে গেছে, উঠে গেছে অনেক জায়গায়। ছাতের অবস্থা আরও খারাপ। বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে নাকি বাড়ির মালিক? নাহলে এত অযত্ন কেন?
ওটা কার বাড়ি? পেইত্রিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যারিস মিলারের।
হাত নেড়ে মুসা বলল, নানা ওখানে যায়নি। ছায়া দেখতে পারে না। একজন আরেকজনের। দেখলেই ঝগড়া।
কিন্তু কেউ একজন গেছে ওই পাতাবাহারের বেড়া ফাঁক করে। দেখো, ডাল ভেঙে আছে। ভাঙা গোড়াটা এখনও সাদা, তারমানে গেছে যে বেশি দেরিও হয়নি।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঠান দিয়ে বেড়ার দিকে এগোল ওরা।
বিড়বিড় করে নিজেকেই বোঝাল যেন কিশোর, বেড়াটা বেশি উঁচু না। মিস্টার রাবাতের পক্ষে ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব। তার পায়ে লেগেই ডালগুলো ভেঙে থাকতে পারে।
গুঙিয়ে উঠলেন পেইত্রি। আবারও ঢুকল। আগের বার কি কাণ্ডটাই না। করল! গুলি করার জন্যে বন্দুক বের করে ফেলেছিল মিলার। পাশের বাড়ির মিসেস ডনিগান পুলিশকে ফোন না করলে খুনই হয়ে যেত একটা। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে রাবাত-মিলার নাকি তার ঘাস কাটার মেশিন চুরি করেছে। আর মিলার বলেছে, রাবাত তার গ্যারেজের তালা ভেঙে ঢুকেছে। পুলিশ একটা মিটমাট করে ক্রিয়ে গেছে বটে, তবে তাতে কোনই সমাধান হয়নি। শত্রুতা বন্ধ হয়নি দুজনের। হবেও না।
তাই নাকি! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। আবারও ঢুকে থাকলে তো খুব খারাপ কাজ করেছেন। ধরে আনা দরকার।
গেলে তো আনবে।
দেখি গিয়ে।
বেড়া ডিঙানোর সময় আরও কয়েকটা ডাল ভাঙল কিশোর। তার সঙ্গী হলো মুসা আর রবিন। দ্বিধা করতে লাগলেন পেইত্রি। তবে শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে তিনিও ঢুকলেন মিলারের বাড়িতে।
অনেক ঘুরে পুরানো বিল্ডিঙটার দিকে এগোল চারজনে।
বেশি দূর যেতে হলো না। বাড়ি ছাড়িয়ে একটা গ্যারেজ, তার ওপাশে কাচ আর কাঠের তৈরি একটা গ্রীনহাউস। বাড়িটার মত অবহেলার শিকার নয়। এটা। কাঠের ফ্রেমগুলোতে নতুন সাদা রঙ করা। দেয়াল আর ছাতের কাচগুলোও পরিষ্কার, তবে কুয়াশা পড়েই বোধহয় ঘোলা হয়ে আছে।
হঠাৎ গ্রীনহাউসের আরেক প্রান্ত থেকে দরাজ গলায় ছড়া গান শোনা গেল:
এবার তুমি কোথায় যাবে,
পাজির রাজা মিলার?
ঘাড়টি তোমার মটকে দেবে,
পুলিশ ক্যাপ্টেন ফ্লেচার!
খাইছে! বলে উঠল মুসা, নানা!
কথা শুনে ওপাশ থেকে প্রশ্ন হলো, কে? গ্রীনহাউসের পাশ দিয়ে। বেরিয়ে এলেন রাবাত। লম্বা, ছিপছিপে শরীর। বয়েসের তুলনায় অনেক শক্ত সমর্থ এখনও। মুসার চুলের মতই খুলি কামড়ে আছে কুঁচকানো তারের মত কোকড়া চুল। তবে অত কালো নয়, বয়েসের রঙ লেগেছে তাতে, ধূসর হয়ে গেছে। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বললেন, আরি, তুই, মুসা! ও, তোমরাও এসেছ, রবিন আর কিশোরকে বললেন। পেইত্রি, মাপ করে দাও, ভাই। তোমার সঙ্গে দাবা খেলার কথা ছিল। দাঁড় করিয়ে রাখলাম।
দাড় করিয়ে রেখেছ তাতে কিছু মনে করছি না, কিন্তু ভয়টা পাওয়ালে কেন? আর কিছুক্ষণ না দেখলে পুলিশকে ফোন করতাম। তোমার মেয়েই দেরি করতে বলল। এখানে মরতে এলে কেন? আগের বারে আক্কেল হয়নি?
মরতে নয় মরতে নয়, মারতে, হাসিমুখে জবাব দিলেন রাবাত, মিলারকে। হাতের পেন্সিল কাটার ছুরিটা দেখালেন, এটা দিয়ে।
সর্বনাশ! খুন করতে এসেছিলে!
মাথা নাড়লেন রাবাত, না, গ্রীনহাউসের তালা খুলতে। জানালা দিয়ে দৈখলাম, ও বেরিয়ে যাচ্ছে। সুযোগটা ছাড়লাম না।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে নানার দিকে তাকাল মুসা। মিলারকে খুন করার সঙ্গে গ্রীনহাউসের তালা খোলার কি সম্পর্ক, বুঝতে পারল না। ভাবল, নানার মাথাটা বোধহয় পুরোপুরিই গেছে। গ্রীনহাউস খুলতে গেছিলে কেন?
দেখে আয় উঁকি দিয়ে। তাহলেই বুঝবি।
গ্রীনহাউসে আর কি থাকবে? শাকসজি নয়তো অন্য কোন ধরনের উদ্ভিদ। দেখার আগ্রহ হলো না মুসার। যা-ই বললো, নানা, মিস্টার মিলার ইচ্ছে করলে এখন তোমাকে হাজতে পাঠাতে পারেন–চুরি করে তার বাড়িতে ঢুকে তালা ভাঙার অপরাধে।
কচু করবে! আমি কিচ্ছু ভাঙিনি। দরজাটা খোলার চেষ্টা করেছি কেবল, আমার জিনিসটা বের করে নেয়ার জন্যে। ওই টিনটা দেখেছিস? ওতে ম্যালাথিয়ন আছে। গত হপ্তায় বেকারের দোকান থেকে কিনেছিলাম। আমার। চীনা এলম গাছটাতে স্প্রে করার জন্যে। হঠাৎ দেখি টিন গায়েব। আরও একটা জিনিস নেই, একটা কর্নিক। ওই যে, গ্রীনহাউসের মধ্যে পড়ে আছে। আমারটাই। পুলিশের কাছে গিয়ে এখন বললে কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে যাবে না! আগের বার চুরি করেছিল ঘাস কাটার যন্ত্র, এবার করেছে কনিক আর পোকা মারার ওষুধ। এ সব কেনার টাকা তার যথেষ্ট আছে, শয়তানিটা করে শুধু আমাকে খেপানোর জন্যে। আমার কাজে অসুবিধা হতে দেখলে মজা পায়। অত্তবড় শয়তান, অথচ অর্কিড ক্লাবে গিয়ে কি ভালমানুষটিই না সেজে থাকে! আহাহা, যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না! বাড়ির বাগানে ঘাস হয়ে থাকে আধহাত লম্বা, কাটার নাম নেই, ওদিকে সারাদিন গ্রীনহাউসে পড়ে থেকে অর্কিড জন্মায়। ছাগল আর কাকে বলে!
ঘাস না কেটে অর্কিড জন্মালে দোষটা কোথায়, ছাগল হয় কি করে, সেটাও মাথায় ঢুকল না মুসার। নানার মাথার স্থিরতা সম্পর্কে সন্দেহ আরও বাড়ল। বলল, নানা, ওগুলো তোমার জিনিস কি করে বুঝলে?
রেগে উঠলেন রাবাত, তোর মত গাধা নাকি আমি নিজের জিনিস চিনব না। ছাউনিতে ঢুকে দেখি জিনিসগুলো নেই। তারপর দেখি পাতাবাহারের ডাল ভাঙা। মগজটা এখনও এত বুড়ো হয়নি যে কি ঘটেছে বুঝতে পারব না!
মিলারের ড্রাইভওয়েতে গাড়ির শব্দ হলো। থামল গাড়িটা। শঙ্কিত হলেন। পেইত্রি। রাবাতের হাত ধরে টানলেন, ওই বুঝি এলো! চলো, চলে যাই!
ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলেন রাবাত। যাব কেন? ওর মত চোর নাকি? আমার জিনিস না নিয়ে যাব না!
গ্যারেজের কোণ ঘুরে বেরিয়ে এল গাট্টাগোট্টা এক লোক। ঘন পুরু ভুরুর নিচে কোটরে বসা চোখে যেন আগুন জ্বলছে।
তাকে দেখেই বলে উঠলেন রাবাত, হ্যারিস মিলার, আবার চুরি করেছ। তুমি! গ্রীনহাউসে আছে। জলদি বের করে দাও! ম্যালাথিয়নের টিন আর কর্নিকটা আমার!
কি প্রমাণ আছে, তার? সমান তেজে জবাব দিলেন মিলার। তুমি বেরোও আমার বাড়ি থেকে, নইলে পুলিশ ডাকব!
চাপ দিয়ে কটাত্ করে ছুরির ফলা বন্ধ করে ফেললেন রাবাত। বন্ধ ছুরির মাথা মিলারের দিকে তুলে ধরে শাসালেন, প্রমাণ, না? আবার যেয়ো চুরি করতে! বুঝবে মজা! এখন থেকে তক্কে তক্কে থাকব আমি। খালি ধরতে পারলে হয় একবার! ঘাস কাটার যন্ত্র দিয়ে তোমার চুল ছেটে না দিয়েছি তো আমার নাম রাবাত নয়!
আরে যাও যাও, যা পারো কোরো! এখন বেরোও! নইলে
কি করবে? কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন রাবাত। কি করবে? চোর কোথাকার! চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুড়ি।
মিলারের চোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেল কিশোর। বুঝল, মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, রাবাতকে ভয় পায় সে। অবশ্য সেজন্যে মিলারকে দোষ। দেয়া যায় না। খেপা মোষ বা গণ্ডারকে কে না ভয় পায়।
মারামারি বেধে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি নানার হাত ধরে টান দিল মুসা, নানা, দোহাই তোমার, থামো! এসো, যাই!
ঝাড়া দিয়ে আবার হাত ছুটিয়ে নিলেন রাবাত, এই, সর, কথার মাঝখানে কথা বলতে আসবি না!
মুসাও দমল না। তুমি আসবে, না মাকে ফোন করব?
ঝাঁঝিয়ে উঠলেন রাবাত। হ্যাঁ হ্যাঁ, করগে না! তোর মাকে কি আমি ডরাই! তবে আর দাঁড়ালেন না তিনি। গটমট করে গ্রীনহাউসের কাছ থেকে সরে এসে বেড়ার দিকে এগোলেন। পিছু নিল তিন গোয়েন্দা।
পেইত্রি রয়েছেন সবার পেছনে। দুর্বল ভঙ্গিতে হাঁটছেন। খুনোখুনির ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। যা কাণ্ড করো না, তোমার কাছে আসাই বাদ দিতে হবে! অনুযোগ করলেন তিনি। আমি বলে দিলাম, এ রকম চলতে থাকলে খুনের দায়ে জেলে যাবে একদিন!
আমি কি ইচ্ছে করে করি নাকি? আশেপাশে বদ লোক থাকলে এই হবে! পাতাবাহারের বেড়া ডিঙিয়ে নিজের সীমানায় ঢুকলেন রাবাত। তাই তো বলি, একটা পড়শী-প্রতিরোধ সংগঠন করা উচিত আমাদের। তাহলে ভোটাভোটির মাধ্যমে ঠিক করা যাবে, কাকে রাখব, কাকে নয়।
তখন তোমাকে নিয়েও ভোট হতে পারে, মুখের ওপর বলে দিলেন পেইত্রি। নিজেকে অত ভাল ভাবার কোন কারণ নেই। ভোট দিয়ে তোমাকেও তাড়াতে পারে!
বাজে বোকো না! গজগজ করে বললেন রাবাত। খেললে এসো, নইলে ভাগো! অহেতুক সময় নষ্ট কোরো না!
কেটলিতে ফুসা বাষ্পের ফোঁস ফোঁস শব্দ বেরোল পেইত্রির নাক থেকে। তবে চলে গেলেন না। রাবাতের পিছু পিছু লিভিং রুমে ঢুকলেন।
রান্নাঘরে রাখা টেলিফোনের দিকে এগোল মুসা। রিসিভার তুলে বাড়ির নম্বরে ডায়াল করল।
মাকে উৎকণ্ঠা মুক্ত করে রিসিভার রেখে দিল সে। কিশোরের দিকে তাকাল। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, কি বুঝলে? যাবে নানার সঙ্গে? তাকে সামলানো সম্ভব?
সন্দেহ ফুটল কিশোরের চোখে। তারপর উজ্জ্বল হলো। হেসে বলল, সহজ হবে না কাজটা। তবে একঘেয়েমিতে ভুগতে হবে না আমাদের, এটা বলতে পারি।
.
০৩.
পরের হপ্তায় বাবাকে বাড়িতে, দাওয়াত করলেন মিসেস আমান। বাবার পছন্দের সমস্ত খাবার তৈরি করে তার সামনে দিলেন। কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বাবাকে পটানোর চেষ্টা করলেন। মুসা, কিশোর আর রবিন তার। সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বেড়াতে গেলে যে মন্দ হয় না ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন সে কথা। বোঝালেন, ওদের জন্যে এটাকে শিক্ষা সফর হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।
ওপরে পুরু করে মাখনের স্তর দেয়া চকোলেট কেকে বড় বড় কামড় বসাচ্ছেন রাবাত। কথা বলতে অসুবিধে। ভুরু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালেন।
অমন করো কেন, বাবা? কণ্ঠস্বর আরও কোমল করলেন মিসেস। আমান। ছোটদের জন্যে বেড়ানো একটা বিরাট শিক্ষা, তুমিই তো বলতে আমাকে। বই পড়ে এ জ্ঞান অর্জন করা যায় না। আমাকে নিয়ে যেতে। সবচেয়ে মনে পড়ে কার্লসব্যাড ক্যাভানে বেড়াতে যাওয়ার কথা। কি যে ভাল লাগে ভাবতে! আমার সঙ্গে, মার সঙ্গে কত ভাল ব্যবহার করতে তুমি, মনে আছে, বাবা? মা মারা যাওয়ার পরই তুমি গেলে বদলে। সেই আগের তুমি আর এখনকার তুমিতে যে কত তফাৎ, যদি বুঝতে! তখন তোমাকে ঋষি, মনে হত আমার, বাবা, আর এখন
পাগল!
না না, তা নয়! তাড়াতাড়ি বললেন মিসেস আমান। তবে মেজাজটা যে তোমার ভাল থাকে না, এটা ঠিক। শোনো, বাবা, আমার একটা কথা রাখো, ওদেরকে তুমি নিয়ে যাও। আমি কথা দিতে পারি, ওরা তোমার। বিরক্তির কারণ হবে না। খুব ভাল ছেলে ওরা। দায়িত্বশীল।
নীরবে কেক খাওয়া শেষ করলেন রাবাত। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলেন। চিনি হয়নি। আরও এক চামচ চিনি মেশালেন। তারপর তাকালেন মেয়ের দিকে।
কুঁকড়ে গেলেন মিসেস আমান। ওই দৃষ্টি তার চেনা। কারও মনের ভেতরটা পর্যন্ত দেখে নেয়ার ক্ষমতা আছে ওই দৃষ্টির। অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন তিনি।
তোর ধারণা দারোয়ান দরকার আমার? রাবাত বললেন, দারোয়ান। তুই ভালই জোগাড় করেছিস, নাক টিপলে এখনও দুধ বেরোয়! আমাকে কি পাহারা দেবে ওরা?
সে কি আমি জানি না? বিশ্বাস করো, পাহারা দেয়ার জন্যে ওদেরকে সঙ্গে দিচ্ছি না, বাবা। বরং ওদের দেখেশুনে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই তোমার। সঙ্গে দিতে চাইছি। গাড়িতে করে সেই নিউ ইয়র্ক যাওয়া, আমারই লোভ হচ্ছে! সংসারের ঝামেলা না থাকলে:
হাত নেড়ে মেয়েকে থামিয়ে দিলেন রাবাত। কাটা কাটা স্বরে বললেন, থাক, অত কথা বলতে হবে না! আমি বুঝে গেছি!
মিস্টার আমানের দিকে ফিরলেন তিনি।
একেবারে চুপ করে আছেন মুসার বাবা। শ্বশুরের সঙ্গে তর্ক করতে রীতিমত ভয় পান। তর্কটা শুধু তর্কে সীমাবদ্ধ থাকলে এতটা পেতেন না, কিন্তু লড়াই বেধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেজন্যে পারত পক্ষে কথা বলতে চান না শ্বশুরের সঙ্গে, এড়িয়ে চলেন।
এই মিয়া, তোমার কি বক্তব্য? জামাইকে প্রশ্ন করলেন রাবাত। দারোয়ান দরকার আছে আমার?
সেরেছে রে! এই ভয়টাই তিনি করছিলেন, তাকে না কোন প্রশ্ন করে বসেন। বড় করে ঢোক গিললেন। লম্বা দম নিলেন। সাবধানে শব্দ বাছাই করে বললেন, না না, দারোয়ান লাগবে কেন! তবে মাঝেমধ্যে সবারই কমবেশি অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়…
আমার হয় না! কর্কশ কণ্ঠে বললেন রাবাত। তোমরা ভাবছ রাস্তায় গণ্ডগোল করে আমি জেলে যাব, সেটা ঠেকাবে তোমাদের দারোয়ানেরা! তোমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, রোজই একবার করে জেলে যাই আমি। অ্যারেস্ট হয়েছিলাম যে সে-কথা মনে করিয়ে দিতে চাও। কিন্তু কেন গিয়েছিলাম? নিজের গাছ বাঁচাতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে। একে তুমি মারামারি বলতে পারো না। ধরো এখন তোমার সামনে থেকে জোর করে এই টেলিভিশনটা কেউ তুলে নিয়ে যেতে চাইল, বাধা দেবে না? সেই বাধাটাই আমি দিয়েছিলাম। পুরো দোষটা ছিল পার্ক ডিপার্টমেন্টের। আমার গাছ পোকায় খেয়ে মারুক, না ঝড়ে উড়ে যাক, তাতে ওদের কি? সেটাই বলতে গিয়েছিলাম। তাতে আমি হয়ে গেলাম পাগল, বদ্ধ উন্মাদ!
শ্বশুড়ের মারমুখো মূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেলেন আমান। চুপ করে রইলেন। এখন তর্ক করতে যাওয়ার ফল হবে ভয়ঙ্কর।
জ্বলন্ত চোখে মুসার দিকে তাকালেন রাবাত
দম বন্ধ করে ফেলল মুসা।
ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাবাত, এই, সত্যি করে বল, তোদেরকে দারোয়ান হিসেবে আমার সঙ্গে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না?
ঢোক গিলল মুসা।
আসল কথা ফাস হয়ে যাওয়ার ভয়ে রেগে গেলেন মিসেস আমান। গলা চড়ে গেল তাঁর, তাতে কি হয়েছে? তোমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই যদি ভাবা হয়, ক্ষতিটা কি? তোমার পাকা খেতে মই দেয়া হচ্ছে নাকি! তুমি ভেবেছ তুমি ধমকাতে থাকবে আর সবাই তা সহ্য করবে? আমি বলছি, ভাল করে শুনে রাখো, আমি বলছি ওরা যাবে তোমার সঙ্গে। হয় ওরা যাবে, নয়তো তোমার নিউ ইয়র্ক যাওয়া বন্ধ। এতক্ষণ ভাল ভাবে বলেছি, শোনোনি। এই আমি বাকা হলাম, দেখি তুমি কি করতে পারো!
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। বাবা আর মেয়ে কেউ কারও চেয়ে কম যায়, না! মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল, আল্লাহরে, বাঁচাও! কি জানি কি ঘটে যায়! নানার মেয়ে খেপেছে!
কারও দিকে তাকালেন না আর রাবাত। চুপচাপ কাপের কফি শেষ করলেন। তারপর মুখ তুললেন। মেয়ের দিকে তাকালেন না। কণ্ঠস্বরও নরম। করলেন না। খসখসে গলায় বললেন, আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করব। কারও বাধা মানতে আমার বয়ে গেছে। আমি ঠিক করেছি, ছেলেগুলোকে আমি সঙ্গে নেব। তবে দারোয়ান হিসেবে নয়। এত লম্বা পথ, মুখ বুজে থাকা যাবে না। কথা বলার জন্যেও কাউকে দরকার। তার জন্যে ছোটরাই উপযুক্ত। বুড়োগুলোর নানা ফেঁকড়া, নানা ঝামেলা। তর্ক ছাড়া কিছু বোঝে না, বেশি পেকে যায় তো! আড়চোখে মেয়ে আর জামাইয়ের দিকে তাকালেন তিনি। পেইত্রি কিংবা কক বিলার্ডকে নিতে পারতাম। কিন্তু বেড়াতে বেরোলেই বিশাল এক সুটকেস সঙ্গে নেবে পেইত্রি, তাতে থাকবে। হাজার রকমের ওষুধপত্র। কক হলো বীমার লোক। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে, তবু শুধু বীমা, বীমা। দুনিয়ায় যেন এ ছাড়া আর কোন বিষয়ই নেই। সুতরাং মুসা এবং তার দুই দোস্ত আসতে পারে আমার সঙ্গে। মুসা, স্কুল ছুটি হতে আর কদ্দিন? দুই হপ্তার বেশি না নিশ্চয়? ঠিক আছে, অপেক্ষা করতে পারব আমি। তোদের স্কুল ছুটি হলেই রওনা হব। জুনের শুরুতে যাত্রা করব। আমরা। অতিরিক্ত গরম পড়ার আগেই খোলা অঞ্চল পেরিয়ে যেতে পারব। ফিরে আসব ক্যানাডার ভেতর দিয়ে। ভাবতে কেমন লাগছে রে তোর?
লাফিয়ে উঠল মুসা। আর বোলো না, নানা! দম আটকে আসছে। আমার! স্কুলটা যে কবে ছুটি হবে! সহ্য করতে পারছি না!
রবিন আর কিশোরকে সুখবরটা জানানোর জন্যে ফোনের দিকে প্রায় উড়ে গেল সে।
স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে এরপর দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি চলল। বাড়িতে জরুরী কোন কাজ নেই, তাই মা-বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিতে রবিনের তেমন অসুবিধে হলো না। তবে কিশোরকে নিয়ে ঘাপলা বাধাতে চাইলেন মেরিচাচী। ইয়ার্ডে প্রচুর কাজ। তিনি ভেবেছিলেন, স্কুল ছুটি হলে বাড়তি কাজগুলো কিশোরকে দিয়ে করিয়ে নেবেন।
কিশোর তাকে বোঝাতে চাইল, শোনো, কাজ তো সারাজীবনই করা যাবে, করতে হবে। কিন্তু এ রকম সুযোগ আর আসবে না। তা ছাড়া এ সব ভ্রমণে অভিজ্ঞতা বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। চিন্তাশীল হতে শেখায় মানুষকে।
তোর কি চিন্তা করার অসুবিধে নাকি? বুদ্ধিও কম না! যা আছে তাতেই একেক সময় ভয় হয়, মাথাটা না বিগড়ে যায়!
চিলেকোঠা থেকে একটা স্লীপিং ব্যাগ বের করে আনলেন মেরিচাচী। রোদে শুকাতে দিলেন।
সেটা দেখে আশা হলো কিশোরের। তারমানে যেতে দিচ্ছ তুমি আমাকে?
জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলেন চাচী, জুন মাসে মিনেসোটার আবহাওয়া কেমন থাকে জানিস?
বিউটিফুল! জবাব দিয়ে দিলেন কাছে দাঁড়ানো রাশেদ পাশা। দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরিয়ে বললেন, চমৎকার!
চাচার সমর্থন পেয়ে চোখ উজ্জ্বল হলো কিশোরের। চাচীকে বলল, তুমি হিসেবগুলোর কথা ভাবছ তো? যাও, বেড়াতে যাওয়ার আগেই সব শেষ করে দেব। আর কোন অসুবিধে আছে?
এতক্ষণে হাসি ফুটল মেরিচাচীর মুখে। কিশোর যখন কথা দিয়েছে, ধরে নেয়া যায় কাজটা হয়ে গেছে। হিসেব মেলানোটা সাংঘাতিক ঝামেলার কাজ মনে হয় তার কাছে।
অবশেষে ছুটি হলো স্কুল।
জুনের এক কুয়াশা ঢাকা সকালে নিজের গাড়িতে করে তিন গোয়েন্দাকে মিস্টার রাবাতের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেলেন আমান। সুটকেস এনেছে ওরা, তবে স্লীপিং ব্যাগ আনেনি। সাফ মানা করে দিয়েছেন রাবাত, বাইরে ক্যাম্প করে ঘুমানো চলবে না। বলেছেন, বাইরে রাত কাটানোর বয়েস আমার নেই। এটাই হয়তো জীবনের শেষ অ্যাডভেঞ্চার। অতএব কিপটেমি করে দীনহীনের মত দিনগুলো না কাটিয়ে হোটেলে থাকব, মোটেলে থাকব। যতটা সম্ভব আরামে কাটাব।
নানার মত অত বয়েস না হলেও বয়েস হয়েছে তার পুরানো, বিশাল বুইক গাড়িটার। তবে যথেষ্ট সমর্থ এখনও। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে।
রওনা হলো ওরা। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন আমান। শেষবারের মত বাবাকে বিদায় জানানোর জন্যে পেছনে ফিরে হাত নাড়ল মুসা। কিশোরও তাকাল। দুজনেরই চোখে পড়ল, রাবাতের বাড়ির কোণ থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে আসছে গাট্টাগোট্টা একজন মানুষ। ঝোপের আড়ালে অর্ধেক শরীর আড়াল করে তাকিয়ে দেখছে রাবাত সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন কিনা।
হ্যারিস মিলারকে চিনতে পারল দুই গোয়েন্দা।
খালি পেয়েই ঢুকে পড়েছে। একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করেনি। বিড়বিড় করল মুসা। মতলবটা কি?
কিশোর জবাব দেয়ার আগেই সামনের সীট থেকে গাঁক করে উঠলেন নানা, কি বলছিস?
কিছু না, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। ভাবছি, সান্তা বারবারার ওই রেস্তোরাঁটায় থামবে কিনা? ওই যে, যেটাতে ঘরের বাইরে টেবিল, পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
ভাল বলেছিস, খুশি হয়ে উঠলেন রাবাত। নাতির মতই খাওয়ার ব্যাপারে তারও প্রবল আগ্রহ। হয়তো তাঁর কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতাটা পেয়ে গেছে মুসা। আমার তো খিদেয় পেট জ্বলছে। নাস্তা না খেয়ে আর পারব না।
অবাক হলো মুনা নাস্তা না খেয়েই বেরিয়েছ!
মনে নেই!
প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে নতুন উদ্যমে গাড়ি হাঁকালেন রাবাত।
মুচকি হাসল কিশোর। মেজাজ ভাল আছে রাবাতের। তবে বেশি আশা করা ঠিক না। কখন যে কি কারণে খেপে যাবেন, আন্দাজ করাও সম্ভব নয়।
.
০৪.
নাস্তা নয়, ভরপেট ভোজন হলো সান্তা বারবারায় পৌঁছে। পুরানো একটা বাড়ির চত্বরে টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। ক্যালিফোর্নিয়ার সেই স্প্যানিশ কলোনির যুগে, তৈরি হয়েছিল বাড়িটা। কুয়াশা তাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। রোদ। বাতাস পরিষ্কার, তাজা।
খুব সুন্দর! রাবাত বললেন। যতই এগোব, আবহাওয়া আরও ভাল। হবে।
যতই উত্তরে এগোল ওরা, শুধু আবহাওয়া নয়, প্রকৃতিরও রূপ বদল হতে থাকল। কখনও সাগরের কিনার দিয়ে গেছে পথ, তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একেবারে ধার ঘেষে; কখনও পাহাড়ের চূড়ার কাছ দিয়ে, ওখান থেকেও সাগর চোখে পড়ে। গ্যাভিয়োটা ছাড়িয়ে কয়েক মাইল এসে পাওয়া গেল একটা সুড়ঙ্গ, রাস্তা গেছে তার ভেতর দিয়ে। সুড়ঙ্গের অন্য পাশে বদলে গেল। প্রকৃতি। সাগরের ঢেউয়ের বদলে এখানে দেখা গেল গরু-বাছুরের পাল। শীতের বর্ষণের শেষে মাঠের ঘাস এখন সবুজ। ছড়ানো সর্ষে খেতে সবুজের মাঝে বিছিয়ে থাকা হলুদ ফুলকে লাগছে বিশাল হলুদ চাদরের মত। ঢালের গায়ে তৃণভূমিতে চরছে গরু-ঘোড়া, মহা আনন্দে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে বাছুর আর ঘোড়ার বাচ্চা।
দুপুরের পর, বিকেলের শুরুতে আবার সাগরের দেখা পাওয়া গেল।
ওই যে পিজমো বীচ! রাবাত বললেন। মুসা, তোর মা তখনও হয়নি, তোর নানীকে নিয়ে বেড়াতে আসতাম এখানে। সাগরের পাড়ে ঝিনুক খুঁজে বেড়াতাম। বহু বছর আগের কথা, অথচ মনে হচ্ছে এই সেদিন! এখন তোর নানী নেই, আছে শুধু ঝিনুক! একা একা কুড়াতে আর ভাল লাগে না রে, তবে সৈকতের পানিতে গাড়ি চালাতে এখনও মজা পাই।
পানিতে! বিশ্বাস করতে পারল না রবিন। পারবেন? চাকা আটকে যাবে না?
না, পিজমোতে যাবে না। কোন্ জায়গাটাতে নামতাম আমরা, দেখি বের করতে পারি কিনা?
হাইওয়ে থেকে একটা সরু রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে আনলেন রাবাত। সাগরের দিকে নামতে নামতে পথের শেষ মাথায় চলে এলেন। তারপরে রয়েছে একটা র্যাম্প। সেটার পর সৈকত।
বালির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, সত্যি বলছ, নানা, কাদায় চাকা দেবে যাবে না? চোরাবালি যদি থাকে?
দূর বোকা, এ সব জায়গায় থাকে না। ওই দেখ, আরেকটা গাড়ি নেমেছে।
একেবারে পানি ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছে একটা ফোক্সওয়াগেন। তীরে আছড়ে ভাঙছে ঢেউ। কোন কোনটা এতবড়, গাড়ির চাকা আর নিচেটা ভিজিয়ে দিয়ে। এ পাশে চলে আসছে।
খাইছে! বলে উঠল মুসা, ফোক্সওয়াগন বলেই চলছে এখনও। বুইক পারবে না, ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যাবে।
থাম তো! অধৈর্য হয়ে নানা বললেন, দেখই না কি করি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। অন্য কেউ এখানে গাড়ি চালালে ভয়। পেত না। কিন্তু তার নানাকে বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও। এত ঘনিষ্ঠভাবে কোনদিন মেশার সুযোগ পায়নি। বদমেজাজী বলে এড়িয়েই থেকেছে। নানার হাতে নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।
র্যাম্প পার হয়ে এসে বালিতে নেমে পড়ল বুইক। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলল সৈকত ধরে। তীর থেকে খানিকটা দূরে পানির ওপরে কুয়াশা জমছে। রাবাত বললেন, এই এক যন্ত্রণা! খালি কুয়াশা পড়ে এখানে। ভৌগোলিক কারণ একটা নিশ্চয় আছে। কিন্তু কি, কে জানে!
গাড়ি থামিয়ে, হ্যান্ডকে সেট করে দিয়ে ফিরে তাকালেন তিনি। আমি এখানে নামব। পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তোরা?
নামব, একটানে পাশের দরজা খুলে ফেলল মুসা।
চোখের পলকে খুলে গেল চারটে দরজাই। গাড়ি থেকে প্রায় ছিটকে বেরোল চারজনে। দরজায় তালা লাগালেন রাবাত। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে সৈকত ধরে হেঁটে চললেন।
কয়েক মিনিটেই পিজমা বীচের শহর ছাড়িয়ে এল ওরা। লম্বা একটা দেয়াল ঘেঁষে প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো কয়েকটা বাড়ি-ঘর, এই হলো শহর। পাহাড়ের চূড়া আর ঢালে দাঁড়িয়ে আছে হোটেল ও মোটেলগুলো।
কাছে এসে গেছে কুয়াশা। ধীরে ধীরে যেন জড়িয়ে ধরতে আরম্ভ করেছে ওদের। চোখের আড়াল করে দিয়েছে একপাশের সৈকত। কেমন ভূতুড়ে নীরবতা গ্রাস করছে সমস্ত পরিবেশকে। চুড়ার ওই হোটেলগুলোর ওপাশে রয়েছে হাইওয়ে। কাছেই। অথচ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দও কানে আসছে না।
সামনে বিছিয়ে আছে প্রায় নির্জন সৈকত। একজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ঘন হয়ে গেল কুয়াশা। তার মধ্যে হারিয়ে গেল। লোকটা। ওদের চারপাশে এখন শীতল, শূন্য, ধূসর এক পৃথিবী।
বিচিত্র অনুভূতি হলো কিশোরের। মনে হচ্ছে, ভয়ানক বিপজ্জনক কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। এমন কিছু, যা অক্টোপাসের মত উড় বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে নিয়ে চলে যাবে অজানা কোন জগতে, চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ারও ক্ষমতা হবে না ওদের।
মাথা ঝাড়া দিয়ে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করল সে। মনকে বোঝাল, অহেতুক ভয় পাচ্ছে। কিছুই নেই এখানে। কেবল ঘন কুয়াশা সূর্যকে ঢেকে দিয়ে জায়গাটাকে অন্ধকার, বিষণ্ণ আর অপার্থিব করে তুলেছে।
অনেক দূর চলে এসেছি আমরা, তাই না, নানা? জিজ্ঞেস করল রবিন।
কিশোরের আগে রয়েছে সে। মূসার সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্নটা করে জবাবের আশায় ডানে তাকাল সে। কিন্তু কোথায় রাবাত?
মুসাও থমকে দাঁড়াল। নানা! কোথায় তুমি?
জবাব নেই।
মিস্টার রাবাত! চিৎকার করে ডাকল কিশোর।
কয়েক সেকেন্ড কান পেতে রইল সে। রাবাত গেলেন কোথায়? কুয়াশার মধ্যে জলজ্যান্ত একজন মানুষ অদৃশ্য হতে পারে, গায়েব হয়ে যেতে পারে না!
মুসাও ভয় পেয়েছে। চাপা স্বরে বলল, এই, কাছাকাছি থাকো সবাই। রবিনের কাঁধে হাত রাখল। যেন তাকেও গায়েব হওয়া থেকে ঠেকাতে চায়।
নানা! গলা চড়িয়ে ডাকল আবার রবিন।
নানা, কোথায় তুমি? আরও জোরে ডাকল মুসা। জবাব দিচ্ছ না কেন?
চুপ! এতক্ষণে শোনা গেল একটা ভোতা, খসখসে কণ্ঠ।
এক ঝলক বাতাস আচমকা ফাঁকা করে দিল কুয়াশার খানিকটা। রাবাতকে চোখে পড়ল গোয়েন্দাদের। পাহাড়ের গোড়ায় বড় একটা পাথরের কাছে হুমড়ি খেয়ে আছেন। সতর্ক, উত্তেজিত, কোন কিছুর দিকে নজর। রাখছেন মনে হচ্ছে।
নানা, কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল মুসা।
তাকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করলেন রাবাত। খানিক পর রাগত স্বরে বলে উঠলেন, যা সন্দেহ করেছিলাম!
নিঃসঙ্গ সেই লোকটাকে দেখা গেল আবার, যে কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অনেক কাছে চলে এসেছে। ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে এখন। সাবধানে পা ফেলছে। যেন কুয়াশার জন্যে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। ঝাঁপিয়ে পড়লেন লোকটার ওপর।
চিৎকার করে উঠল লোকটা।
লোকটার কলার চেপে ধরে চিৎকার করতে লাগলেন রাবাত, এত্তবড় সাহস তোমার, আমার পিছু নিয়েছ!
ছাড়ো, পাগল কোথাকার! নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল লোকটা।
খাইছে! দম আটকে যাবে যেন মুসার।
রাবাত, তুমি একটা উন্মাদ! বলল লোকটা। পুরোপুরি মাথা খারাপ! জলদি ছাড়ো বলছি, নইলে ভাল হবে না!
কণ্ঠ শুনেই লোকটাকে চিনতে পেরেছে মুসা। হ্যারিস মিলার। তার নানার পড়শী, যার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক।
হুমকির পরোয়া করলেন না রাবাত। কলার তো ছাড়লেনই না, আরও জোরে চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। চোর কোথাকার! আমি জানি তুমি কিসের জন্যে এসেছ! রাতে চুরি করে আমার ঘরে ঢুকেছিলে, নতুন আবিষ্কারটার কথা জেনে গেছ। যন্ত্রপাতি চুরি করেই পেট ভরেনি, ফর্মুলাও চুরি করতে এসেছ…।
ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মিলার। পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার শুরু করল, বাঁচাও! বাঁচাও! পুলিশ! পাগলে খুন করে ফেলল আমাকে!
লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল মুসা। মিলারের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, চেঁচাবেন না, মিস্টার মিলার, প্লীজ! নানা এমনি কথার কথা বলেছে, সত্যি সত্যি খুন করতে চায়নি আপনাকে…
চুপ! গর্জে উঠলেন রাবাত। স এখান থেকে! আমার জন্যে মাপ চাইতে হবে না! যা বলেছি ঠিকই বলেছি, মোটেও কথার কথা নয়! মেরুদণ্ডহীন এই পোকাটা কি করতে চাইছে আমি জানি। কিছুতেই সেটা করতে দেব না ওকে। ল্যাঙ মেরে ফেলে ওর কোমর ভেঙে না দিয়েছি তো। আমার নাম…
আবার মিলারকে ধরার চেষ্টা করলেন রাবাত।
ঝট করে সরে গেল মিলার। আর চিৎকার করল না। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবাতের দিকে।
ইঁদুর! ছুঁচো! শুয়াপোকা! গাল দিতে লাগলেন রাবাত। এই জন্যেই, এতক্ষণে বুঝলাম! এই জন্যেই বিষবার থেকে কাজে যাচ্ছ না তুমি! বাড়িতে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ওপর চোখ রেখেছ। যেই আমি বেরিয়েছি, আমার পিছু নিয়েছ। কেন নিয়েছ, মনে করেছ বুঝব না! অত বোকা পাওনি!
পাগলের সঙ্গে কে কথা বলে! বলেই ঘুরে সৈকত ধরে প্রায় ছুটতে শুরু করল মিলার।
সত্যি কথা বলেছি তো, সহ্য করতে পারলে না, তাই না! পেছনে চিৎকার করে বললেন রাবাত।
ফিরল না মিলার। জবাবও দিল না। খেপা মানুষটার কবল থেকে পালাতে পারলে যেন বাঁচে। আবার অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।
অসহ্য! নাক দিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করতে লাগলেন রাবাত। জঘন্য লোক! আবার যদি আসে, বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দেব আমি ওর!
এতক্ষণে খেয়াল করল মুসা, কাঁপছে ও। একটা দুঃস্বপ্ন থেকে যেন জেগে উঠেছে। এ কার সঙ্গে এসেছে! মারাত্মক অবস্থা! স্যান ফ্রান্সিসকোতে পৌঁছার আগেই হয়তো ভয়ানক বিপদে ফেলে দেবে। উপকূলের কোন জেলখানায় হবে শেষ ঠাই। এমনও হতে পারে, নানার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে। তাকে সামলানো অসম্ভব ভেবে রকি বীচে ফিরে যেতে পারে কিশোর আর রবিন। নিউ ইয়র্ক যাওয়া আর হবে না।
নানা, বলল সে, আমার মনে হয় অহেতুক মিস্টার মিলারকে গালাগাল করছ। পিজমো বীচটা বেড়ানোর জায়গা, যে কেউ আসতে পারে এখানে। মিলারের আসতেও বাধা নেই। এমনও হতে পারে, এখানে কোন বন্ধু আছে তার, দেখা করতে এসেছে।
তোর মাথা! খেঁকিয়ে উঠলেন রাবাত। ওর আবার বন্ধু আছে নাকি! দুনিয়ায় কেউ ওর বন্ধু হবে না! শুনে রাখ, তার সঙ্গে এই শেষ দেখা নয় আমাদের। না হলে তখন বলিস। কিন্তু যেটার জন্যে এসেছে সেটা পাবে না সে। অত কাঁচা কাজ করি না আমি। ওর মত ছুঁচোরা যে পিছে লাগতে পারে, সেটা আগেই ভেবে রেখেছি।
কি নিতে এসেছে? এমন নিরীহ ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল কিশোর, যেন কথার পিঠে কথা, জানার কৌতূহল নেই।
আমার ফর্মুলা! জবাব দিলেন রাবাত।
যেটা আবিষ্কার করেছ? মুসার প্রশ্ন। যেটা নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাচ্ছ?
তোরাও এমন ভঙ্গি করছিস যেন আমি একটা পাগল! আবিষ্কার যেটা করেছি, জানলে নিউ ইয়র্কের বড় বড় বিজ্ঞানীরাও…
থেমে গেলেন তিনি। ফাস করে দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ খেয়াল হলো যেন। না, তোদের না জানাই ভাল। হয়তো মিলার একাই চায় না ওটা, আরও কেউ আছে। চল। আর দেরি করলে অন্ধকার হওয়ার আগে মনটিরেতে পৌঁছতে পারব না।
শান্ত ভঙ্গিতে বালি মাড়িয়ে হেঁটে চললেন তিনি। কয়েক মিনিট আগে যে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল বেমালুম ভুলে গেছেন যেন।
পেছনে এগোল তিন গোয়েন্দা। মনে ভাবনা। দীর্ঘ যাত্রায় বেরিয়েছে ওরা। শেষ হতে এক মাস কিংবা তারও বেশি লেগে যেতে পারে। এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে টিকতে পারবে অতদিন? শুধু কি খামখেয়ালী, না। আসলেই পাগল? একজন বদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে অজানা পথে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে না তো ওরা!
.
০৫.
কারও সঙ্গে একঘরে থাকতে আমি পারব না, ঘোষণা করে দিলেন রাবাত, নিজের নাতি হলেও না! পোলাপানকে বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসবে ঠিক নেই। হয়তো দেখা যাবে রাত দুপুরে উঠে পনির দিয়ে রুটি খেতে বসল। হই-চই করে, শব্দ করে আমার ঘুমের বারোটা বাজাবে।
অতএব ঘুমের সুবিধার জন্যে মনটিরের ফিশারম্যান ওআর্য থেকে কয়েক ব্লক দূরে একটা মোটেলে দুটো কামরা ভাড়া করলেন তিনি। তারপর ক্যানারি রো-র একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন ছেলেদের। চমৎকার রান্না করা নানা রকম মাছের স্বাদ বহুদিন মনে থাকবে তিন গোয়েন্দার। খেতে খেতে মনটিরে আর স্প্যানিশ ক্যালিফোর্নিয়ার অনেক ইতিহাস বললেন। মেজাজ একেবারে ফুরফুরে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মিলারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা যেন বহুযুগ আগের ব্যাপার। কোনই গুরুত্ব নেই ওটার। মন থেকে দূর করে দিয়েছেন বেমালুম।
সে-রাতে সকাল সকাল ঘুমাতে গেল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল তিন গোয়েন্দা, আলাদা ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করে একটা কাজের কাজ করেছেন রাবাত। তাতে তার চেয়ে ওদের উপকার হয়েছে বেশি। একঘরে থাকলে সারারাত জেগে থাকতে হত। এত জোরে নাক ডাকাচ্ছেন, দুটো ঘরই কাঁপতে শুরু করল।
সাইনাসের সমস্যা আছে, অনুমান করল রবিন।
মা বলে ওসব কিছু না, মুসা বলল, রোগটোগ নেই। আসলে ঘুমের মধ্যেও নানা চান না তাকে অগ্রাহ্য করা হোক।
মাঝখানে একটা দেয়াল থাকলে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যেত তিন গোয়েন্দা। অন্য ঘর থেকে আসছে বলে রক্ষা। তা-ও যা শব্দ! তবে একবার ঘুমিয়ে পড়ার পর আর অসুবিধে হলো না, একটানা ঘুমাল সকাল পর্যন্ত।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকল সকালের রোদ। ঘুম ভাঙল ওদের। শুনতে পেল, উঠে পড়েছেন রাবাত। বাথরুমে তার শাওয়ারের শব্দ। পাওয়া যাচ্ছে। ওরাও উঠে পড়ল। হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পরে তৈরি হলো। দরজায় খটখটানির শব্দ। রাবাত ডাকছেন।
জেটির ধারে একটা রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে বসল ওরা। ভাজা মাংস, কেক আর এক জগ কমলার রসের অর্ডার দিলেন রাবাত। ঘুম ভাল হওয়ায় শরীরটা ঝরঝরে লাগছে কিশোরের। খাবারে আনন্দ পাচ্ছে তাই। খেতে খেতে সাগর দেখার জন্যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে একজন লোক। তাড়াতাড়ি আবার প্লেটের দিকে নজর ফেরাল, যাতে তার চমকে যাওয়া রাবাতের চোখে না পড়ে। কেকের একটা টুকরো ভেঙে সিরাপে চুবিয়ে মুখে পুরল।
নানার পাশে, কিশোরের মুখোমুখি বসেছে মুসা। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না তার। প্রশ্ন করার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল। ভ্রুকুটি করে আর সামান্য মাথা নেড়ে তাকে চুপ থাকতে ইশারা করেছে কিশোর।
তার দিকে তাকিয়ে রাবাত জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু খাবে তোমরা?
মাথা নাড়ল কিশোর, না, অনেক হয়েছে। পেট ভরে গেছে।
খুব ভাল খাবার, রবিন বলল।
চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। খাবারের দাম দেয়ার জন্যে ক্যাশিয়ারের ডেস্কের দিকে এগোলেন।
সামনে গলা বাড়িয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা, কি দেখেছিলে, কিশোর?
হ্যারিস মিলারকে, ক্যানারি রো-র দিকে যাচ্ছে।
ফিরে এলেন রাবাত। ওয়েইটারের জন্যে প্লেটে টিপস রেখে দিয়ে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন, পানির কিনারটা ঘুরে দেখতে চাও? বেশি দেরি করা যাবে না। আজ রাতেই স্যান ফ্রান্সিসকো পেরোতে চাই। সম্ভব হলে সান্তা রোজাতে চলে যাব। কালকের দিনটা তাহলে রেডউডের বনে ঘুরে। কাটাতে পারব।
তার পেছন পেছন রেস্টুরেন্ট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এল ছেলেরা। রবিনের কাঁধে ঝোলানো একটা আনকোরা নতুন ক্যামেরা। রকি বীচে কেনার পর একটা ছবিও তোলা হয়নি ওটা দিয়ে। এখান থেকে শুরু করার ইচ্ছে তার।
সবাইকে নিয়ে জেটির কাছে চলে এলেন রাবাত। ঘাটে বাঁধা ছোট-বড় অনেক নৌকা ঢেউয়ে দুলছে। জাহাজ বেরিয়ে যাচ্ছে খোলা সাগরে।
এখনও খুব সকাল, কিন্তু জেটিতে পুরোপুরি ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। রাতে ধরে আনা মাছ নামাচ্ছে জেলেরা। দোকানে দোকানে টুরিস্টদের ভিড়। বিশেষ করে ঝিনুক-সামগ্রীর দোকানগুলোতে। খটাখট ক্যামেরার শাটার টিপতে লাগল রবিন। মুসার চোখ আকাশে চক্কর দেয়া সী-গালের খেলা। দেখছে। অলস ভঙ্গিতে রাবাত তাকিয়ে আছেন একটা দোকানের দিকে।
ধীরে ধীরে নজর সরে গেল রাস্তার দিকে। মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি। শক্ত হয়ে গেল কাধ।
কি বলেছিলাম! শয়তানটা এখানেও এসেছে!
না তাকিয়েও বলে দিতে পারবে কিশোর কার কথা বলছেন রাবাত। হ্যারিস মিলার ছাড়া আর কেউ না। আবার এসেছে যেন রাবাতের হাসিখুশি মেজাজটাকে পলকে বিগড়ে দেয়ার জন্যে। আগুন বানিয়ে দেয়ার জন্যে।
নানা, তাড়াতাড়ি দুহাত তুলে এগিয়ে এল মুসা, দোহাই তোমার, চুপ করে থাকো! কিছু বোলো না!
ভয়ানক ভঙ্গিতে নাক দিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করলেন রাবাত। বেশ! তবে এখানে আমি আর একটা সেকেন্ডও দাঁড়াব না!
ঝিনুকের দোকানটায় ঢুকে পড়লেন তিনি। বিশাল এক দানবীয় ঝিনুকের খোলার ওপাশে মুখ লুকিয়ে ফেললেন। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে গোয়েন্দারা শুধু তার কোকড়া চুলগুলো দেখতে পেল।
ধীরে সুস্থে এগিয়ে এল মিলার। তার ওপর যে নজর রাখা হচ্ছে, বুঝতে পারেনি। কাঁধে ঝোলানো নতুন ক্যামেরার ব্যাগ, ক্যামেরাটা হাতে। অবিকল রবিনেরটার মত, একটা Canon II. রবিনের মতই জেটির দৃশ্যের ছবি তোলায় আগ্রহী মনে হলো তাকে। তবে তুলছে না। সকালের ট্যুরিস্টদের ভিড়ে মিশে গেছে। সবই নতুন তার। গায়ের সাদা শার্টটা নতুন–গলার কাছে দুটো বোতাম খোলা, পরনে নতুন জিনসের প্যান্ট। পায়ে রবার সোলের নতুন জুতো। রকি বীচ থেকে বেরোনোর পর পথে কোনখান থেকে একটা নতুন স্ট্র হ্যাটও কিনেছে। হ্যাঁটের চওড়া কানা ছায়া ফেলেছে মুখে।
দ্বিধা করতে লাগল মুসা। তার নানা যে ওত পেতে আছেন ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে এ কথা বলে সাবধান করে দেবে মিলারকে? করতে গেলে এবং সেটা দেখে ফেললে তার ওপর খেপে যাবেন নানা। সেটা চায় না সে। মিলারের সঙ্গে আবার একটা বিচ্ছিরি এটে যাক, এটাও চায় না। কি করবে তাহলে? মুশকিলে পড়ে গেল।
ঘুরে তাকাল সে। দেখল, কিশোরও তাকিয়ে আছে। বুঝল, তার মত একই সমস্যায় পড়েছে কিশোরও।
কয়েক পা হেঁটে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসল রবিন। ক্যামেরাটা ব্যাগে ভরে পাশে রেখে সাগরের দিকে তাকাল। মিলারকে না দেখার ভান করল।
ক্যামেরা হাতে হেঁটে এল মিলার। মুসার এত কাছে দাঁড়াল, আরেকটু হলে কাঁধে কাধ ঠেকে যেত, অথচ লক্ষ করল না তাকে। ভয়ানক অন্যমনস্ক। বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে। কারও আসার অপেক্ষা করছে বোধহয়।
মিনিট দুয়েক পর এল সে। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে দেখতে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, মিলার?
কেমন একটু বিস্ময় আর অবজ্ঞা প্রকাশ পেল লোকটার কণ্ঠে। ফিরে। তাকাল কিশোর। বয়েস চল্লিশের কোঠায়, মাথায় মসৃণ কালো চুল, মুখটাও মসৃণ। পরনে সিল্কের পাজামা, গায়ে নরম কাপড়ের দামী শার্ট। চোখে বিরাট সানগ্লাস মুখের অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। চোখা পাতলা নাক। পাতলা ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। ছোট ছোট কান মাথার সঙ্গে প্রায় লেপ্টে আছে। তার পাশে কেমন আড়ষ্ট আর নগণ্য লাগছে জিনস আর সাদা শার্ট পরা গাট্টাগোট্টা মিলারকে।
জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে মিলার বলল, এনেছি।
কিশোরের দিকে তাকাল আগন্তুক।
নিরীহ ভঙ্গি করে সাগরের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর।
আসুন, বলে হাঁটতে শুরু করল লোকটা।
নতুন জিনসের খসখস শব্দ তুলে তার পেছনে এগোল মিলার।
আবার ওদের দিকে ফিরল কিশোর। রবিনের কাছাকাছি চলে গেছে দুজনে। কেমন সন্ত্রস্ত লাগছে মিলারকে। স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বার বার তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। যেন লক্ষকোটি চোখ রয়েছে তার। ওপর। সেগুলোকে এড়ানোর চেষ্টা করছে। অমন করছে কেন লোকটা?
রবিন যে বেঞ্চটায় বসেছে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সানগ্লাস পরা লোকটা। ফিতে ধরে ক্যামেরাটা ঝোলাতে ঝোলাতে তার সঙ্গে সঙ্গে গেল মিলার। তাকে লোকটা বলল, বসুন এখানে।
বসতে যাবে মিলার, এই সময় চোখ পড়ল রবিনের মুখের দিকে।
কুকড়ে গিয়ে যেন নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলতে চাইল রবিন।
কিন্তু চিনে ফেলেছে মিলার। চমকে গিয়ে বলল, তুমি!
কিশোর দেখল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার মুখ।
বসা আর হলো না মিলারের। সোজা হয়ে চারপাশে তাকাল। কিশোর আর মুসাকেও দেখতে পেল এতক্ষণে। তবে তার চোখ ওদের খুঁজছে না। কাকে খুঁজছে, বুঝতে পারল কিশোর। বিশাল ঝিনুকের খোলার ওপর দিয়ে সেই মুখটাকে দেখতে না পেলেও ধূসর কোকড়া তারের মত চুল বেরিয়ে থাকতে দেখল।
ধরা পড়ে গেছেন বুঝে আর লুকানোর চেষ্টা করলেন না রাবাত। সোজা হলেন। রাগে জ্বলছে চোখ।
মড়ার মুখের মত সাদা হয়ে গেল মিলারের মুখ।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। মিলারের দিকে ছুটল। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
তীব্র গতিতে দোকান থেকে ছুটে বেরোলেন রাবাত। মুঠো করে ফেলেছেন হাত। পিটিয়ে বালির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন বুঝি আজ মিলারকে!
হাতের ক্যামেরাটা বেঞ্চে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে ফেলল মিলার। পিছিয়ে গেল বেঞ্চের কাছ থেকে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল যে লোকটা, বিপদ বুঝতে পারল সে-ও। যেন পিছলে বেরিয়ে চলে গেল।
তার দিকে নজর নেই তিন গোয়েন্দার, রাবাত আর মিলারকে দেখছে।
মিলারের কলার খামচে ধরলেন রাবাত। চেঁচাতে লাগলেন, দেখে ফেলব ভাবোনি, না! আশা ছাড়তে পারোনি। বলেছি না, পাবে না। আমার কাছ থেকে জিনিস নেয়া অত সহজ না।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল মিলার। কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বেরোল কেবল ঘড়ঘড় শব্দ। কণ্ঠনালীতে চাপ পড়ায় কাশতে শুরু করল। বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না, রাবাতকে ঠেলে সরাল না; এমনকি পিছিয়ে যাবার কিংবা দৌড় দেয়ার চেষ্টাও করল না–প্রচণ্ড ভয়েই বোধহয় আড়ষ্ট হয়ে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল মারমুখো কালো মুখটার দিকে। নিজের মুখের যে কি ঘনঘন পরিবর্তন হচ্ছে জানতে পারল না।
মিলারকে ভয় দেখাতে পেরে সন্তুষ্ট হলেন রাবাত। শার্ট ছেড়ে দিয়ে বললেন, যাও, ছেড়ে দিলাম এবারও! আবার যদি পিছে লাগতে দেখি…! কথাটা শেষ না করে ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিলেন কি করবেন। ছেলেদের কাছে। সরে এসে বললেন, চলো, ভিড় জমে যাচ্ছে।
দম বন্ধ করে ফেলেছিল মুসা। বিপদ কেটে যেতে নিশ্বাস ছাড়ল।
গা ঘেষাঘেঁষি করে পড়ে আছে দুটো ক্যামেরার ব্যাগ। ছোঁ মেরে একটা তুলে নিয়েই রওনা হয়ে গেল উত্তেজিত রবিন। ভিড় জমে গেলে মিলার কি করবে, কে জানে! পুলিশ ডাকার জন্যে অনুরোধ করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কাজটা ঠিক করেননি রাবাত। পুলিশ এলে তিনিই ফাসবেন। লোকে দেখেছে, মিলার কিছু করেনি, তিনিই দোকান থেকে ছুটে এসে তাকে আক্রমণ। করেছেন। অতএব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালানো দরকার।
রাবাতের পেছনে প্রায় উড়ে চলল তিন গোয়েন্দা। খুব জোরে হাঁটতে পারেন তিনি। পানির ধার ধরে পার্কিং লটের দিকে এগোলেন। বুইকটা আছে ওখানে।
গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে আপন মনে হাসলেন তিনি। স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসার পর বেড়ে গেল হাসি। মিলারের ভড়কে যাওয়া চেহারার কথা মনে করেই হয়তো হাসছেন।
পেছনে চিৎকার শোনা গেল। এত কিছুর পরও আবার এসেছে হ্যারিস মিলার। ছুটে আসছে পেছন পেছন। মনে হলো কিছু বলতে চায়। এক হাতে স্ট্র হ্যাট, আরেক হাতে ক্যামেরার ব্যাগ। চিৎকার করে বলল, রাবাত, প্লীজ, একটা মিনিট দাঁড়াও!
দাঁড়ানো তো দুরের কথা, গাড়ির গতিও কমালেন না রাবাত, বরং এক্সিলারেটর চেপে ধরলেন আরও। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল গাড়ি।
থামলে না কেন, নানা? মুসা বলল, কি বলতে এসেছে, শুনলে পারতে।
হু, কাজ নেই আর। থামি। ওই চোরটার সঙ্গে আবার কিসের কথা? নতুন কোন ফন্দি করে এসেছে নিশ্চয়। অত কাঁচা লোক নই আমি, আমার ফর্মুলা চুরির সুযোগ দেব তাকে। তার আগেই জেলে ঢোকাব!
রাগ হয়ে গেল মুসার। যা কাণ্ড শুরু করেছ, জেলে তো ঢুকবে তুমি, দেখতেই পাচ্ছি! মাথা গরম করে কখন মেরে বসবে বেচারাকে; সে মরবে, আর গোষ্ঠীসুদ্ধ আমাদেরকে নিয়ে জেলে ভরবে পুলিশ! তোমার সঙ্গে আসাটাই বোধহয় ঠিক হয়নি!
কিশোর আর রবিন মনে করেছিল রেগে যাবেন রাবাত। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে হাসলেন তিনি। বাকা চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, এক্কেবারে দেখি তোর মায়ের মত কথা বলিস! নাকি নানীর মত!
০৬.
পাগলামি শুরু হলেই বিপদ! নইলে নানা এমনিতে মানুষ খারাপ না। যখন ভাল থাকে, তখন তো খুবই ভাল! মুসা বলল। কজন লোক আছে, আমাদের বয়েসী ছেলেদের সহ্য করতে পারে, বলো? তারপর আবার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া! আসলে আমাদেরকে ভাল লেগে গেছে তার।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মুসার নানাকে অনেক আগে থেকেই চেনে সে, তবে এ রকম ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। মুসারই হয়নি, তার আর কি হবে। তার আচরণে ক্রমেই অবাক হচ্ছে। ভাল না মন্দ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ভদ্রলোকের। এই ভাল তো এই খারাপ। তবে একটা কথা ঠিক, মিলারকে না দেখলে মেজাজ ভালই থাকে তার। অন্তত এতদিন থেকেছে। ভবিষ্যতে কি হবে বলা যায় না।
দুপুর দেড়টা বাজে। বুইকের গায়ে হেলান দিয়ে কথা বলছে দুজনে। তাকিয়ে আছে রবিন আর রাবাতের দিকে। ঘাসে ঢাকা একটা ঢালের গা বেয়ে কিছু দূর উঠে গেছে ওরা। ক্যামেরা উঁচিয়ে ছবি তুলছে রবিন। স্যান ফ্রান্সিসকো বে আর গোল্ডেন গেট ব্রিজের দিকে তাকিয়ে আছেন রাবাত। মহাসুখী মনে হচ্ছে তাকে। মেজাজ অত্যন্ত ভাল। মুসা ভাবল, ইস, এ রকম মেজাজ যদি শেষ পর্যন্ত থাকত।
রাবাতের মেজাজ সেদিন খারাপ হচ্ছে না। সকালে মিলারের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সামান্য একটুক্ষণ খারাপ ছিল, আনমনে বিড়বিড় করেছেন, ঘোৎ-ঘোৎ করেছেন। হাইওয়ে ১০১-এ ওঠার পর মিলারের কথা উধাও হয়ে গেছে তার মন থেকে। শিস দিতে আরম্ভ করেছেন। উত্তরে স্যান। ফ্রান্সিসকোয় পৌঁছে কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছিলেন। লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে। কিছু সুভনিরও কেনা হয়েছে। লাঞ্চ খেতে খেতে শুনিয়েছেন ১৯০৬ সালে স্যান ফ্রান্সিসকোর ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা।
পুরো শহরটাতেই আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল, তাই না? কিশোর বলেছে।
মাথা ঝাঁকিয়েছেন রাবাত। পানি আর গ্যাসের পাইপগুলো আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ভূমিকম্পে। তারপর যখন গ্যাসে আগুন ধরে গেল, নেভানোর জন্যে পানি আর পাওয়া গেল না।
বেলা দুটোয় গোল্ডেন গেট ব্রিজ পেরোল ওরা। সাউস্যালিটোতে এসে হাইওয়ে ছেড়ে পাহাড়ী রাস্তায় ঢুকে পড়লেন রাবাত। এক জায়গায় থেমে রবিনকে আরও কিছু ছবি তোলার সুযোগ দিলেন।
আড়াইটা বাজল। ফিল্ম শেষ হয়ে গেল রবিনের। অবাক হলো সে। এত তাড়াতাড়ি তো শেষ হওয়ার কথা নয়! এত ছবি কি তুলেছে? সন্দেহ হতে লাগল।
পাহাড় বেয়ে দৌড়ে নেমে এল সে। গাড়ির পেছন থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা বের করে নতুন ফিল্ম নিয়ে ক্যামেরায় ভরল। কি যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে কোথাও, ঠিক ধরতে পারছে না। চাপ লেগেই বোধহয় বেশি চ্যাপ্টা হয়ে গেছে ব্যাগের ওপরটা, ময়লাও লেগেছে বেশ। চিন্তিত মনে ফিরে গিয়ে আরও কয়েকটা ছবি তুলল।
আবার হাইওয়েতে ফিরে এল ওরা। আরও উত্তরে এগিয়ে চলল। রাস্তার দুধারে সুন্দর অঞ্চল। আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করল সূর্য।
ডিনারের সময় সান্তা রোজাতে পৌঁছল ওরা। একটা মোটেলে উঠে দুটো রুম ভাড়া করলেন রাবাত। পাশাপাশি ঘর। মাঝের দরজা দিয়ে একঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়া যায়। দরজাটার কোন প্রয়োজন পড়বে না ওদের, ভাল আর কোন ঘর পাওয়া গেল না বলেই নেয়া।
মোটেলের পুলে সাঁতার কাটার প্রস্তাব করলেন রাবাত। সাতারের পর মোটেলের ডাইনিং রুমে খাওয়া সারলেন। ঘরে এসে রবিন আর কিশোর টিভি দেখতে লাগল, মুসার পেল ঘুম।
এত তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে ইচ্ছে করল না তার। ঘুম তাড়ানোর জন্যে নিচে পুলের ধারে বসানো সোডা মেশিন থেকে একটা সোডা কিনতে চলল। জানালার ধার দিয়ে দরজার কাছে যেতে হয়। জানালার বাইরে চোখ পড়তেই সোডা খাওয়ার কথা ভুলে গেল সে।
ওদের ঘরটা দোতলায়। পার্কিং এরিয়াটা দেখা যায়। নিচে সারি সারি গাড়ি পার্ক করা আছে। নানার বুইকটাও আছে, ওদের ঘরের বেলকনির ঠিক নিচেই। পেছনে খানিক দূরে একটা চকচকে লিংকন গাড়ি। সেটা থেকে হ্যারিস মিলারকে বেরিয়ে আসতে দেখল মুসা।
দম বন্ধ করে ফেলল সে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল নিথর হয়ে। স্তব্ধ, বিস্মিত। তারপর চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গিয়ে বলল, কিশোর, দেখে যাও!
চোখের পলকে তার পাশে চলে এল অন্য দুই গোয়েন্দা। জানালা দিয়ে ওরাও দেখতে পেল মিলারকে। রাবাতের গাড়িটার চারপাশে ঘুরছে। একটা জানালার কাছে থেমে কাঁচে নাক ঠেকিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। সরে গেল। পেছনে, বুটের ঢাকনা টেনে তোলার চেষ্টা করল। না পেরে ফিরে তাকাল। মোটেলের অফিস এবং তার ওপরের জানালাগুলোর দিকে।
ঝট করে নিচু হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা, যাতে চোখে না পড়ে।
দ্বিধা করল মিলার। চিন্তিত ভঙ্গিতে বুইকটার দিকে তাকাল আরেকবার। তারপর লিংকনে উঠে স্টার্ট নিয়ে চলে গেল।
একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল তিনজনে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, মুসা, মনে হচ্ছে তোমার নানার সন্দেহই ঠিক, তার ফর্মুলা চুরির চেষ্টা করছে মিলার।
মাথা নেড়ে মুসা বলল, বুঝতে পারছি না। তবে কিছু একটা যে খুজতে এসেছিল মিলার, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যা হোক, মিলারের কথা নানাকে বলার দরকার নেই। কি ঘটাবে কে জানে। শেষে পুলিশ তাকেই ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরবে।
হু, আনমনে মাথা নাড়ল কিশোর।
মিলারের ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে, রবিন বলল, বিষ্যত্বর থেকে নাকি ছুটিতে আছে। হয়তো আমাদের মতই বেড়াতে বেরিয়েছে। এ দিকে এসেছিল মোটেলের খোঁজে। রাবুনানার গাড়িটা দেখেছে। ভাল করে দেখে যখন বুঝেছে এটা তারই, এই মোটেলে ওঠার সাহস করেনি আর, পালিয়েছে। পাগলকে সবাই ভয় পায়।
তোমার কথায় যুক্তি আছে। তর্জনী তুলল মুসা, কিন্তু একটা কথা। নতুন গাড়ি কোথায় পেল মিলার? তার তো একটা ঝরঝরে পুরানো শেভি গাড়ি ছিল দেখেছি।
ভাড়া নিয়েছে হয়তো, কিশোর বলল। অত পুরানো গাড়ি নিয়ে দূরের যাত্রায় বেরোনো ঠিক হবে না, তাই।
জবাব না পেয়ে চুপ হয়ে গেল মুসা। তবে সন্তুষ্ট হতে পারল না। মনটা খুঁতখুঁত করতেই থাকল।
আবার টেলিভিশন দেখায় মন দিল তিন গোয়েন্দা।
কিছুক্ষণ পর ছেলেরা কি করছে দেখতে এলেন রাবাত।
রাত সাড়ে দশটায় বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন রাবাত। তাঁর নাক ডাকানোর বিকট গর্জন পাশের ঘরে অন্যদের কানে এসে পৌঁছল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। রবিন। হেসে উঠল কিশোর। উঠে গিয়ে মাঝখানের দরজাটা লাগিয়ে দিল মুসা। তারপরেও পুরোপুরি বন্ধ হলো না শব্দ, পাল্লার ফাঁক দিয়ে আসতে লাগল এ পাশে। তবে ঘুমাতে আর অসুবিধে হলো না।
একটা আজব স্বপ্ন দেখল মুসা। হোটেলের লবিতে নানাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে সে। অনেক বড় লবি। সুদৃশ্য কাপড় পরা মানুষেরা সব ভিড় করে আছে সেখানে, নানা-নাতিকে দেখছে আর হো-হো করে হাসছে। কেন। হাসছে প্রথমে বুঝতে পারল না মুসা। নানার দিকে চোখ পড়তে দেখল তার। পরনে শুধু লাল গেঞ্জি আর লাল জাঙ্গিয়া। তারপর চোখ পড়ল নিজের দিকে। নানার তো তা-ও কিছু পোশাক আছে, তার পরনে একেবারেই নেই। পুরোপুরি দিগম্বর।
চমকে জেগে গেল মুসা। ঘামে নেয়ে গেছে। পানি খাওয়ার জন্যে উঠে বাথরুমের দিকে চলল সে। জানালা দিয়ে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়াল।
পার্কিং লটের উজ্জ্বল আলোগুলো নেভানো। পাশের প্যাসেজ থেকে এসে পড়া আলোয় দেখা গেল বুইকের কাছে ঘাপটি মেরে আছে একটা ছায়ামূর্তি।
কিশোরের বিছানার পাশে প্রায় উড়ে চলে এল মুসা। তাকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, বলল, কিশোর! জলদি ওঠো! গাড়ির কাছে আবার। এসেছে ও!
.
০৭.
খালি পায়েই ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল তিনজনে।
দুপদাপ করে নামতে গিয়ে হোঁচট খেলো কিশোর। উল্টে পড়তে পড়তে কোনমতে রেলিঙ ধরে সামলে নিল।
গাড়ির পাশে ঝুঁকে থাকা মূর্তিটা ঝট করে সোজা হলো। সিঁড়িতে চোখ পড়তেই আর দাঁড়াল না, দৌড় মারল রাস্তার দিকে মুখ করে রাখা গাড়িগুলোর দিকে।
তাড়া করল তিন গোয়েন্দা। খালি পা বলে সুবিধে করতে পারল না। কিশোর তো খোঁড়াতেই শুরু করল। সবার আগে রাস্তায় পৌঁছল মুসা। কিন্তু লোকটাকে ধরতে পারল না!
ধূর! বিরক্তিতে বাতাসে থাবা মারল সে।
গেল! দাঁড়িয়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন।
মিলারকেই দেখেছ তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কোন সন্দেহ নেই, জবাব দিল মুসা। পালাচ্ছিল যখন তখনও দেখেছি। বারান্দার আলো পড়েছিল তার মুখে।
বুইকের কাছে ফিরে এল ওরা। ঘুরতে শুরু করল চারপাশে। দরজা টান দিয়ে দেখল। তালা লাগানো। বুটের ঢাকনায়ও তালা। চার হাত-পায়ে ভর রেখে উবু হয়ে গাড়ির নিচে উঁকি দিল কিশোর। নিচেটা অন্ধকার বলে কিছু দেখতে পেল না।
টর্চ লাগবে, উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বালি ফেলল কিশোর।
এই সময় মাথার ওপরে একটা দরজা খুলে গেল। ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন রাবাত। কি ব্যাপার? চারটেই বাজেনি এখনও, এত সকালে গাড়ির। কাছে কি?
সমস্ত হোটেল ঘুমিয়ে আছে। কেউ যাতে বিরক্ত না হয় সেজন্যে আস্তে করে বললেন তিনি। কিন্তু সেই আস্তেটাই আধ মাইল দূর থেকে শোনা গেল। গলা বটে একখান। পটাপট আলো জ্বলে উঠল জানালায়, দরজা খুলে উঁকি দিল কয়েকজন গেস্ট।
কে জানি ঘোরাফেরা করছিল এখানে, নানাকে জানাল মুসা।
মিলার না তো!
জবাব দিল না মুসা।
তার চুপ করে থাকাকেই হ্যাঁ ধরে নিয়ে ওদেরকে ঘরে ফিরে আসতে বললেন রাবাত। ওরা এলে ঘোঁৎ-ঘোৎ করে বললেন, ও সন্দেহ করেছে, আমার কাছেই আছে জিনিসটা। খুঁজুক। যত ইচ্ছে উৎপাত করুক, নিতে আর পারবে না।
কি আছে তোমার কাছে, নানা? জানতে চাইল মুসা।
ও সব জেনে কাজ নেই তোদর। যত কম জানবি তত ভাল থাকবি। যা, শুয়ে পড়গে। রাত এখনও অনেক বাকি। ওই শেয়ালটার জন্যে ঘুম নষ্ট করার কোন মানে নেই। চেষ্টার কমতি করছে না, তবে ক্ষতি কিছু করতে পারেনি। কি বলিস?
তা পারেনি, জবাব দিল কিশোর।
মাথা ঝাঁকালেন রাবাত। পারবেও না। ওর স্বভাবই ওরকম। চোরের মত আসে যায়। মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই।
নিজের ঘরে চলে গেলেন রাবাত। গোয়েন্দাদের অবাক করে দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নাক ডাকানো শুরু করলেন।
মুসা বলল, নানার কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে এখন। তার আবিষ্কারের পেছনেই লেগেছে মিলার। নিতে যখন পারেনি, আবারও আসতে পারে। তালা কিংবা জানালা ভেঙে গাড়িটার ক্ষতি করতে পারে। বাকি রাতটা আমি গাড়িতে ঘুমাব।
রাবাতের ঘরে ঢুকল সে। নাসিকা গর্জনের সামান্যতম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আলগোছে টেবিল থেকে গাড়ির চাবি তুলে নিয়ে ফিরে এল। নিজের বিছানা থেকে কম্বলটা তুলে নিয়ে কিশোরকে সহ নেমে এল নিচে, গাড়ির কাছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল দুজনে। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ বের করল মুসা। কিন্তু সুইচ অনেক টেপাটেপি করেও আলো জ্বালতে পারল না।
দূর! ব্যাটারি শেষ মনে হয়। দেখা গেল না!
হতাশ খানিকটা কিশোরও হলো। বলল, যার জন্যে এসেছিল, নিতে পারেনি মিলার। আবার আসতে পারে। এলে একা কিছু করতে বেরিও না। আমাদের ডেকো।
মুসাকে গাড়িতে রেখে ঘরে ফিরে এল কিশোর।
পেছনের সীটে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিল মুসা। মনে হলো মুহূর্তের জন্যেও আর দুচোখের পাতা এক করতে পারবে না।
কিন্তু পারল। তবে গাঢ় হলো না ঘুম। একের পর এক দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল। আবার দেখল সেই স্বপ্নটান্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে আর তার নানা। লোকে হাসাহাসি করছে। সরে যাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে, কিন্তু নানা তাকে যেতে দিচ্ছে না।
ঘুম ভেঙে গেল তার। সবে সূর্য উঠছে তখন। গাছের ডালে কলরব করছে পাখিরা। মুসা দেখল, লাল জগিং স্যুট পরা মোটা এক মহিলা গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে তাকে।
মুসা চোখ মেলতেই জিজ্ঞেস করল, এখানে কি?
উঠে বসল মুসা। পরনে কেবল জাঙ্গিয়া। নামার সময় তাড়াহুড়োয় অন্য কাপড় না পরে কোমরে শুধু কম্বল জড়িয়ে বেরিয়েছিল। স্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাচ্ছে দেখে ধক করে উঠল বুক। পিছলে সীট থেকে মেঝেতে নেমে গেল সে।
সন্দেহ হলো মহিলার। চোর-টোর নাকি? দরজার হাতল ধরে টান দিল।
খাইছে! ভাগ্যিস ঘুমানোর আগে তালা লাগিয়ে রেখেছিলাম। মরিয়া হয়ে চিৎকার করে বলল, আপনি যান! সরুন!
ভাল করে কম্বল টেনে শরীরের নিচের অংশ ঢেকে দিল সে। গেল না মহিলা। জানালার কাছে নাক ঠেকিয়ে আরও বেশি করে উঁকি দিতে লাগল। আর কোন উপায় না দেখে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল মুসা। কোমরে কম্বল জড়ানো।
গাড়িতে কি করছিলে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল মহিলা।
ঘুঘুমাচ্ছিলাম। এটা আমাদেরই গাড়ি!
কেন, হোটেলে কি জায়গার অভাব?
না, তা নয়… কোমরে পেঁচানো কম্বল চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করল। মুসা।
ভুরু কুঁচকে ফেলল মহিলা, ব্যাপার কি, অমন করছ কেন? তোমার বাবা-মা সঙ্গে আসেনি? এ ভাবে ছেলেকে গাড়িতে ঘুমাতে ছেড়ে দিল? কাজটা কি ঠিক করেছে?
না, ম্যাম, কোনমতে দায়সারা জবাব দিয়ে মোটেলের দরজার দিকে দৌড় দিল মুসা।
হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল মহিলা। বিড়বিড় করে বলল, কি সাংঘাতিক কিপটেরে বাবা! পয়সা বাঁচাল! ছেলেকে গাড়িতে পাঠিয়ে নিজেরা ঘরে শুয়ে আছে আরাম করে! আরেকটা ঘর ভাড়া নিতে এমন কি-ই বা খরচ হত!
সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ব্যাঙের মত লাফাতে লাফাতে ওপরে উঠে এল মুসা। দরজায় ধাক্কা দিল। খুলে দিল রবিন।
ভেতরে ঢুকে সব বলল মুসা। শেষে বলল, নানাকে বলার দরকার নেই। শুনলেই যাবে মহিলার সঙ্গে ঝগড়া করতে!
হাসতে লাগল রবিন।
রেডউড হাইওয়ে ধরে সেদিন আরও উত্তরে এগিয়ে চলল ওরা। ফুরফুরে মেজাজে আছেন রাবাত। পথের দুই ধারে রেডউডের জঙ্গল তার স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে চলেছে। মনে পড়ছে বহুদিন আগের কথা। সেদিন এ পথে যাওয়ার সময় বয়েস ছিল অনেক কম, পাশে ছিল তরুণী স্ত্রী। আর আজ!
জিজ্ঞেস করলেন, মুসা, তোর নানীর কথা মনে আছে?
নানার এই আচমকা প্রশ্নে অবাক হয়ে গেল মুসা। আছে, অল্প অল্প। খুব ভাল অ্যাপল কেক বানাতে পারত নানী।
আরও অনেক কিছু পারত, বিষণ্ণ হয়ে গেলেন রাবাত। আমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত থাকতে পারত না। আর এখন! মানুষ মরে গেলে কত দূর হয়ে যায়!
স্থির দৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। এক খোলসে যেন দুজন মানুষ। একজন অতি কোমল হৃদয়ের স্নেহপ্রবণ স্বামী এবং নানা, যিনি তার মৃত স্ত্রীর কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে যান, নাতিকে ভালবাসেন, ভালবাসেন তার বন্ধুদেরও। আরেকজন সাংঘাতিক বদমেজাজী পাগলাটে এক বৃদ্ধ, পড়শীকে যিনি সারাক্ষণ সন্দেহ করেন, দুচোখে দেখতে পারেন না, একবিন্দু সহ্য করতে পারেন না। যদিও সহ্য করার মত লোক নয় হ্যারিস মিলার। তারও দোষ আছে। বাগান করার যন্ত্রপাতি চুরি করে খামখেয়ালী একজন মানুষকে খেপানোর কি দরকার?
আচ্ছা, পেছনে লেগেছে কেন মিলার? কাকতালীয় ঘটনা বলে আর মেনে নিতে পারছে না কিশোর। রাতে দ্বিতীয়বার এল কেন মিলার? তবে কি রাবুনানার কথাই ঠিক? তার আবিষ্কারের ফর্মুলা কেড়ে নিতে চায় মিলার? আবিষ্কারটা কি? কোন সূত্র নেই, সুতরাং কি জিনিস হতে পারে আন্দাজও করতে পারছে না সে। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ইচ্ছে করে না বললে তার মুখ থেকে কিছু বের করতে পারবে না।
মিলারের আচরণ যেহেতু সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে, তার ব্যাপারে জানা দরকার। আলোচনা শুরু করার জন্যে বলল, অর্কিডের কথা ভাবছি।
কিশোরের এই অপ্রাসঙ্গিক কথায় অবাক হলো রবিন। অর্কিড! কিসের অর্কিড?
কেন, ভুলে গেছ, মিস্টার মিলার অর্কিডের চাষ করে?
হ্যাঁ, করে, জবাব দিলেন রাবাত। তার কথায় যোগ দেবেন তিনি, এটাই চাইছিল কিশোর। বলল, কিন্তু বাগান করার মত ধৈর্য তার আছে বলে তো মনে হয় না। লনের ঘাস কাটার ইচ্ছে হয় না যার, সে অর্কিডের চাষ করে, ভাবতে কেমন অবাক লাগে না?
লনের ঘাস কাটলে তো আর পয়সা আসে না, কাটবে কেন? গাছ, ফুল, কিংবা বাগানের প্রতি কোন আগ্রহ নেই মিলারের, তার একমাত্র আগ্রহ–টাকা। অর্কিডের পেছনে সময় ব্যয় করে টাকা আসে বলে। ফুল বিক্রেতারা তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যায়। একটা অর্কিড ক্লাবের সদস্য সে। মাসে একবার করে মিলিত হয় সবাই। তখন ওর মতই কিছু পাগলকে অর্কিড দেখাতে বাড়ি নিয়ে আসে মিলার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিনা লাভে আনে না। ওদের কাছ থেকেও কিছু না কিছু হাতিয়ে নেয় সে। অন্য কিছু আদায় করতে না পারলে কায়দা করে ওদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। মাঝেমধ্যেই দেখি অপরিচিত একজন ওর গ্রীনহাউসে কাজ করছে।
কারা ওরা?
হবে ওর ক্লাবের কোন বোকা লোক।
এখন কেউ আছে নাকি? জানতে চাইল কিশোর।
কি জানি। ও সব নিয়ে মাথা ঘামাই না। অত পাজি মানুষ আমি জীবনে দেখিনি! অভদ্র! এই ব্লকে যখন প্রথম এল, কি করেছিল জানো? একবার আমার পানির পাইপে গোলমাল দেখা দিল। পানি সরবরাহ বিভাগকে খবর দিলাম। এসে দেখল মেইন লাইনে ছিদ্র হয়ে গেছে, সেটা দিয়ে সব পানি বেরিয়ে যায়। সারানোর সময় আমার বাড়িতে পানি সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। খাওয়ার পানি নেই ঘরে। ভাবলাম, কি আর হবে, পড়শীই তো, একটা কেটলি নিয়ে মিলারের বাগানের কলে গেলাম পানি আনতে। কি করল সে জানো?
নিশ্চয় পুলিশ ডাকল? অনুমানে বলল রবিন।
ডাকার হুমকি দিল। অবাক হয়ে গেলাম। আরও অভিযোগ করল, আমি নাকি তার লাইনের সঙ্গে হোস পাইপ লাগিয়ে পানি চুরি করে নিয়ে যাই বাগানে দেয়ার জন্যে। যেন ওই কটা টাকার পানি চুরি করার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছি আমি!
মিলারের কথা বলতে গিয়ে রেগে যাচ্ছেন রাবাত। এই প্রথম রেডউডের জঙ্গলের ওপর থেকে নজর সরে গেল তার।
মিলারটা একটা প্যারানয়েড, কোন সন্দেহ নেই, বললেন তিনি। এই জন্যেই ওরকম ভাবনা মাথায় ঢোকে। প্যারানয়েড কাকে বলে জানো? মগজের এক ধরনের রোগ। এ সব রোগীরা সব মানুষকেই সন্দেহের চোখে দেখে। ভাবে, এই বুঝি কেউ তার সব জিনিস চুরি করে নিয়ে গেল, তার ক্ষতি করতে এল। মিলার একটা প্যারানয়েড! কথাটা আবার বললেন তিনি।
রাবাতের রাগ চরমে পৌঁছার আগেই তাকে থামানো দরকার। আপাতত মিলারের ভাবনা তার মাথা থেকে দূর করতে না পারলে অবস্থা কোন দিকে গড়াবে বলা যায় না। তাই চুপ হয়ে গেল কিশোর। ও ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন করল না।
নীরবে গাড়ি চালালেন রাবাত। দিনটা চমৎকার, রেডউডের জঙ্গলেরও এক ধরনের আকর্ষণ আছে, যা খুব তাড়াতাড়িই রাগ কমিয়ে দিল তার।
পথে কোন অঘটন ঘটল না। ক্যালিফোর্নিয়ার সাগর তীরের ছোট্ট শহর ক্রিসেন্ট সিটিতে নিরাপদে পৌঁছল ওরা। সূর্য তখন দিগন্ত সীমার প্রায় কাছাকাছি নেমে গেছে। একটা মোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে আগে গোসল সেরে নিল সবাই। তারপর বেরোল শহরটা ঘুরে দেখতে।
মনটিরের ফিশারম্যান ওআর্ফ জেটির তুলনায় এখানকার জেটিটা অনেক ছোট। তবে বেশ ছিমছাম। পানির ধারে পার্কিঙের জায়গা আছে, কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আর গোটা দুই বড় ধরনের দোকানও আছে। রেস্টুরেন্টগুলোর কাছ থেকে কিছুটা দূরে নৌকা বাঁধার জায়গা। ছোট জেটি হলেও যথেষ্ট সরগরম। নৌকা পরিষ্কার করছে কয়েকজন মাল্লা। কেউ পরিষ্কার করছে, কেউ বা ছেঁড়া পাল মেরামতে ব্যস্ত। সী-গাল উড়ছে। বেড়াতে আসা দম্পতিরা অলস ভঙ্গিতে হাঁটছে পাকা চত্বরে, সূর্যাস্ত দেখছে।
মিলারকে বোধহয় এড়ানো গেল, আচমকা বলে বসলেন রাবাত।
এই রে, সেরেছে! শঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। ভেবেছিল, অর্কিড ব্যবসায়ীর কথা ভুলে গেছেন নানা। কিন্তু না, ভোলেননি। মেজাজ এখন কেমন হয়ে যায়, কে জানে!
আসার সময় রিয়ারভিউ মিররে চোখ রেখেছিলাম, রাবাত বললেন, কোন গাড়িকে আমাদের লেজে লেগে থাকতে দেখিনি। কাল রাতে তোদের তাড়া খেয়ে ভয় পেয়েছে শেয়ালটা, তাতেই মুরগী চুরির লোভ উবে গেছে।
হবে হয়তো, হেসে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনাটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করল মুসা।
রাস্তায় অনেকগুলো ইঞ্জিনের শব্দ আর হই-চই শোনা গেল।
সাতটা মোটর সাইকেল ছুটে আসছে জেটির দিকে। আরোহীরা সবাই তরুণ, কালো চামড়ার জ্যাকেট পরা।
হুমম! মাথা দোলালেন রাবাত। চালচলন ভাল মনে হচ্ছে না!
আসলেই ভাল নয় ওরা। বেশির ভাগেরই দাড়ি আছে। কারো ঘন চাপদাড়ি বিচিত্র ছাঁটে কাটা হয়েছে, কারও বা পাতলা ফিনফিনে, লম্বা লম্বা দাড়ি। সেগুলো এমনিতেই বিচিত্র, কাটার আর প্রয়োজন পড়েনি। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট, কব্জিতে রিস্টব্যান্ড, হাতে গ্লাভস–সব কিছুতেই ছোট বড় নানা আকারের লোহার কাটা বসানো। হলিউডের ছবিতে দেখানো। ভয়ঙ্কর মোটর সাইকেল গ্যাঙের এ যেন বাস্তব রূপ।
হাই, কালু নানা! কাছে এসে চিৎকার করে উঠল এক আরোহী। মোটর সাইকেলের সামনের চাকা রাবাতের গায়ে তুলে দেয়ার ভঙ্গি করে সরে গেল। হি-হি করে গা জ্বালানো হাসি হাসল।
তিন গোয়েন্দা ভাবল এখনই ভীষণ রাগে ফেটে পড়বেন রাবাত। কিন্তু। পড়লেন না। ওদের অবাক করে দিয়ে বরং দলটার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসলেন। বললেন, এদের মধ্যে একটা ছেলেও ভাল নেই। সব পচা ডিম।
নানা, চলো চলে যাই! ঘাবড়ে গিয়ে বলল মুসা।
চত্বরের শেষ মাথায় চলে গেছে দলটা। প্রায় একসঙ্গে ঘুরে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়াল। ক্লাচ চেপে ধরে, এক্সিলারেটর বাড়িয়ে দিয়ে ইঞ্জিনের বিকট গোঁ-গোঁ শব্দ তুলে রাবাতকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করল। তিন কিশোর আর একজন বুড়োর ক্ষমতা কতখানি আন্দাজ করছে।
হাত ধরে টানল মুসা, নানা, চলো!
ইইইই-ইআআআ! বলে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল এক আরোহী। দলটার দলপতি।
গর্জে উঠল তার ইঞ্জিন। সোজা ছুটে আসতে লাগল রাবাত আর ছেলেদের লক্ষ্য করে।
কাছাকাছি থাকো, ছেলেদের আদেশ দিলেন রাবাত, নড়বে না! আগে চলে গেলেন তিনি, লোকটার আক্রমণের মোকাবেলা করার জন্যে।
ভয়ে পেটের ভেতরে খামচি দিয়ে ধরল যেন কিশোরের।
নেতার পেছনে ভয়ানক গতিতে ছুটে আসছে বাকি ছয়জন। দাঁত বের করে হাসছে। একটা জিনিস শূন্যে ছুঁড়ে দিল একজন। কাটা বসানো একটা বেল্ট। ওটার বাড়ি শরীরে পড়লে কি অবস্থা হবে কল্পনা করে শিউরে উঠল কিশোর।
গোয়েন্দাদের চারপাশে জেটির লোক আর ট্যুরিস্টরা ছুটাছুটি করে সরে যাচ্ছে। কে যেন চিৎকার করে বলল, পুলিশকে ফোন করো।
ইঞ্জিনের গর্জন তুলে রাবাতের পাশ কেটে চলে গেল মোটর সাইকেলগুলো। কয়েক গজ গিয়ে ঘুরে আবার ছুটে আসতে লাগল। আরোহীদের অট্টহাসি তুঙ্গে উঠেছে।
রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে ঘিরে ফেলল ওরা। ঘুরতে ঘুরতে ছোট করে আনছে বৃত্ত। ভেতরে আটকা পড়েছে ওদের শিকার। এক মারাত্মক খেলায় মেতেছে।
আচমকা বৃত্ত ভেঙে দিয়ে রাবাতের দিকে সাইকেলের নাক ঘোরাল দলপতি। তীব্র গতিতে ছুটে এল রাবাতের দিকে। মাত্র হাতখানেক দূরে এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল। ওর ফিনফিনে দাড়ির ওপরে চৌকো একটা চোয়াল, বড় বড় দাঁত, কালো কুতকুতে চোখ। সাতটা ইঞ্জিনের গর্জনকে ছাপিয়ে হা হা করে হেসে উঠল সে।
নড়ে উঠলেন রাবাত। নড়াটা এত সামান্য, প্রায় চোখেই পড়ল না গোয়েন্দাদের। মনে হলো, কি যেন ছুঁড়ে দিলেন।
পিস্তলের গুলি ফোঁটার মত টাসস করে শব্দ হলো। দেখা দিল এক ঝলক, কালো ধোয়া। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিতে লাগল মোটর সাইকেল আরোহীকে।
কুতকুতে চোখে ভয় দেখা দিল। হাসির বদলে মুখ থেকে বেরিয়ে এল চিৎকার। মেঘের ভেতর থেকে সরে যাওয়ার জন্যে এত জোরে মোটর সাইকেল ঘোরাতে গেল, চাকা পিছলে পড়ে গেল কাত হয়ে।
আবার নড়ে উঠলেন রাবাত। আবার শোনা গেল তীক্ষ্ণ শব্দ, এবং তারপর ধোয়া।
পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল বিমূঢ় আরোহীরা। দিশেহারা হয়ে গেছে। যেন। পাগলের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে অদৃশ্য রহস্যময় পিস্তলধারীকে। কার গায়ে গুলি লেগেছে বোঝার চেষ্টা করছে।
হাইওয়েতে সাইরেন শোনা গেল। পুলিশ আসছে।
ছাতের ওপরে আলো ঘোরাতে ঘোরাতে জেটির দিকে ছুটে এল। পুলিশের দুটো গাড়ি।
মোলায়েম হাসি হেসে রাবাত বললেন, চলো, ছেলেরা, খিদে পেয়েছে।
পানির কিনারের একটা রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। তাকে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা।
রেস্টুরেন্টের দরজায় লোকের ভিড়। রাবাত কাছাকাছি হতেই সরে গিয়ে ঢোকার জায়গা করে দিল।
তার কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞেস করল একজন, কোথাও লাগেনি তো?
ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়া উচিত হয়নি আপনার, আরেকজন বলল। নরকের ইবলিস একেকটা। পুলিশ আসাতে বাচলেন!
পুলিশ আসাতে আমি নই, শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন রাবাত, ওরা বেঁচেছে। কতটা ক্ষতি যে করতে পারতাম জানেই না!
.
০৮.
রেস্টুরেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন রাবাত। মোটর সাইকেল গ্যাঙের লোকগুলোকে ধরেছে পুলিশ। লাইসেন্স দেখছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখাতে বাধ্য হচ্ছে আরোহীরা।
তাড়া না থাকলে ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করতাম, বললেন তিনি। জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তাম ব্যাটাদের। কিন্তু এখন ওসব করার সময় নেই। খাবারের একটা মেনু খুললেন।
একে একে স্টার্ট দিতে আরম্ভ করল লোকগুলো। একসঙ্গে দল বেঁধে। পাশাপাশি এগিয়ে চলল পানির কিনার ধরে। গাড়িতে উঠল পুলিশ অফিসারেরা। দলটার পেছনে চলল।
হাজতে নিয়ে যাচ্ছে নাকি? রবিনের প্রশ্ন।
মনে হয় না, রাবাত বললেন। শহর থেকে বের করে দিয়ে আসতে যাচ্ছে হয়তো।
নানা, শব্দটা কি করে হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল মুসা।
শব্দ? কিসের শব্দ? মেন্যুতে মনোযোগ রাবাতের, মোটর সাইকেল। আরোহীদের কথা যেন ভুলেই গেছেন।
ওদের দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে দিয়েছিলে তুমি। পিস্তল ফোঁটার মত শব্দ হয়েছিল। কিসের শব্দ? বাজি?
না না, বাজি হবে কেন! বাজি পোড়ানো অনেক শহরে নিষেধ। আমার খুদে আবিষ্কারগুলোর একটা ব্যবহার করেছি। বাজারে ছাড়লে খুব জনপ্রিয়তা। পাবে। চলবে ভাল। অতি সাধারণ একটা জিনিস, অথচ ভয়াবহ শব্দ করে, ধোয়া ছড়ায়, কিন্তু শরীরের ক্ষতি করে না; সুতরাং বেআইনী বলতে পারবে না পুলিশ। বরং অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে নিরীহ মানুষকে। দেখলেই তো, কি করে ভয় ঢুকিয়ে দিলাম শয়তানগুলোর মনে।
হাসল মুসা। দেখলাম। কিন্তু বাজারে ছাড়লেই তো অপরাধীদের জানা হয়ে যাবে ওটা কি জিনিস, আর ভয় পাবে না। তখন কি হবে?
তখন আমি ওগুলো ডাকপিয়নদের কাছে বিক্রি করব, হাসিমুখে জবাব দিলেন রাবাত। কল্পনা করতে পারবি না চিঠি বিলি করতে গিয়ে কি বিপদে পড়ে ওরা। জঘন্য সব কুত্তা পালে আজকাল লোকে।
আবার মেন্যুতে মন দিলেন তিনি।
পরদিন দুপুর একটা নাগাদ অরিগনের পোর্টল্যান্ড পেরোল ওরা। রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড দেখে মুসা বলল, নানা, এখানে থামবে? সেইন্ট হেলেনস পর্বতমালা দেখার ইচ্ছে আমার বহুদিনের।
থামব তো বটেই, রাবাত বললেন। একসঙ্গে অতগুলো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি দেখার ভাগ্য কজনের হয়? সুযোগ যখন পাওয়া গেছে সেটা অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত।
হাইওয়ে থেকে সরে এলেন তিনি। মোচড় খেয়ে খেয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ী পথ ধরে উঠতে আরম্ভ করলেন। আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে আসতে লাগল দিনের আলো। ঝপাঝপ করে যেন গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। মেঘের ভেলা। আকাশময় এখানে উড়ে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ।
শেষ মাথায় উঠে এল ওরা। ভেবেছিল এখানে উঠলেই চোখে পড়বে। মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস। মেঘের ওপরে উঠে এসেছে, অনেক নিচে ভাসছে মেঘের ভেলাগুলো। পুবে তাকাল। পর্বতমালাটা ওদিকেই থাকার কথা। কিন্তু প্রচণ্ড বিস্ময় অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে। পর্বত চোখে পড়ল না। কেবল ঘন ধূসর ধোয়া ভলকে ভলকে ওপরে উঠছে, ছেয়ে দিয়েছে আকাশ।
খাইছে! কোনমতে বলল মুসা।
হেসে তার নিরাশা দূর করার চেষ্টা করলেন রাবাত, অত মন খারাপ করছিস কেন? পুরো দেশটাই আমাদের সামনে পড়ে আছে। ভাল ভাল দৃশ্য প্রচুর দেখতে পাবি।
গাড়ি ঘুরিয়ে আবার নামতে লাগলেন তিনি। কিছুদূর নামার পর হঠাৎ নামল ঝমঝম করে বৃষ্টি। ভিজিয়ে দিল গাড়ির কাচ। অস্পষ্ট হয়ে গেল সামনের আর আশপাশের সব কিছু।
হাইওয়ে ফাইভ-এ পৌঁছে দেখা গেল অনেক গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে দিয়ে চলছে। বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলেন রাবাত, সেদিন এর বেশি আর এগোবেন না, ওয়াশিংটনের লঙভিউতে রাত কাটাবেন। নিজের পরিকল্পনা নিয়ে এতই মগ্ন রইলেন, রাস্তার ধারে থেমে থাকা লিংকন গাড়িটাকে শুরুতে খেয়াল করলেন না। আলো জ্বালেনি ওটা। ওয়াইপার চলছে। এগজস্ট থেকে একঝলক সাদা ধোয়া বেরিয়ে মিশে গেল ভেজা বাতাসে।
গাড়িটা চোখে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল কিশোর।
লিংকনের ড্রাইভিং হুইলে ঝুঁকে রয়েছে একজন লোক। কে? হ্যারিস মিলার? সান্তা মনিকায় এ রকম একটা গাড়ি দেখেছিল, ওটাই কিনা নিশ্চিত হতে পারল না। এ পথে ধূসর লিংকনের অভাব নেই। তার মধ্যে কোনটা মিলারের কে বলবে? নম্বর প্লেট একবার দেখেই মুখস্থ করে ফেলল নম্বরটা : 111-XTJ.
মিলার! আচমকা সবাইকে চমকে দিয়ে হিসহিস করে উঠলেন রাবাত। চোখে পড়ে গেছে লিংকনটা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন। বেজে উঠল একঝাক। হর্ন। তীব্র প্রতিবাদ জানাতে লাগল পেছনের গাড়িগুলো।
জলদি চালাও, নানা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
রাস্তার মাঝখানে এ ভাবে ব্রেক কষা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। ঠিক পেছনের গাড়িটা এসে বাম্পারে গুতো মারার আগেই আবার এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়ালেন রাবাত। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বুইক। অল্পের জন্যে গুতো খাওয়া থেকে বেচে গেল। দুর্ঘটনাটা ঘটল না। গায়ে কাপুনি উঠে গেছে ছেলেদের। কিন্তু রাবাতের কোন ভাবান্তর নেই, তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন।
ভয় পেয়েছ! সরি! বললেন তিনি। গাড়িটা দেখে আর সামলাতে পারলাম নাঃ শিওর ওটাতে মিলার বসে আছে।
ফিরে তাকাল ছেলেরা। রাস্তার পাশে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে লিংকন, বৃষ্টিভেজা ধূসরতার মাঝখানে ধূসর একটা অবয়বের মত।
থাকুক না, আমাদের কি? কিশোর বলল, অনুসরণ তো আর করছে না। রাস্তার ধারে পার্ক করে হয়তো রোড ম্যাপ দেখছে…গাড়ি খারাপ হয়েও থাকতে পারে।
আমাদের অনুসরণ করার জন্যে পিছে পিছে আসার দরকার পড়বে না তার। এই রাস্তা ধরে কতদূর যেতে পারব আমরা, জানে। সীটলের বেশি যে যেতে পারব না, তা-ও জানে। এ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হয়তো আমাদের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করছে, বোঝাতে চাইছে পেছনে আসছে না।
আর কোন কথা হলো না। উত্তরমুখো গাড়ির ভিড়ে মিশে রাবাতও এগিয়ে চললেন। লংভিউতে পৌঁছে শহরের গভীরে ঢুকে গেলেন। হাইওয়ে থেকে দরে একটা মোটেলের ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন। এখানে উঠলে তাদের খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে মিলারের। অবশ্য যদি সে আদৌ বের করতে চায়।
ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না, রাবাত বললেন। জীবনে কখনও কোন লড়াই থেকে পালিয়ে আসিনি। এখন যে এড়িয়ে থাকতে চাইছি, সেটাও সামান্য সময়ের জন্যে। শিক্ষা ওকে আমি একটা দিয়েই ছাড়ব, তবে সেটা পরে। আপাতত নিরাপদে নিউ ইয়র্কে পৌঁছতে চাই; আর চলার পথে যতটা সম্ভব আনন্দ। এখনই ঝগড়া বাধিয়ে সব পণ্ড করতে চাই না।
সমস্যা আর বিপদ থেকে পালানোর স্বভাব তিন গোয়েন্দারও নয়, বরং মুখোমুখি হতেই ওরা ভালবাসে। কিন্তু এই কেসটাতে এখন পর্যন্ত কেবল পালিয়েই চলেছে ওরা। মিলার যদি পেছনে লেগে থাকে, সামনাসামনি এসে কিছু না করা পর্যন্ত ওদের কিছু করার নেই। আক্রমণটা আগে তার তরফ থেকেই আসতে হবে। মিলার পেছনে লেগেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনও। কেবল সন্দেহের ওপর নির্ভর করে একজন। ভদ্রলোকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করাটা ঠিক নয়।
মাঝরাতের পর হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কানে এল পাশের ঘরে রাবুনোর বিকট নাক ডাকানোর শব্দ। তবে এই শব্দ আর এখন বিরক্ত করে না ওকে, গা সওয়া হয়ে গেছে, এর জন্যে ঘুম ভাঙেনি ওর। ভেঙেছে জানালায় হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো পড়ায়। মোটেলের ড্রাইভওয়েতে ঢুকে চলতে চলতে যেন থেমে গেল একটা গাড়ি।
দরজা খোলার শব্দ হলো। ইঞ্জিন বন্ধ করল না ড্রাইভার। দ্রুত পদশব্দ থমকে গেল আচমকা, তারপর আবার শোনা গেল।
বিছানা থেকে নামল, কিশোর।
সে জানালার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, বড় একটা গাড়ি ঘুরে নেমে যাচ্ছে রাস্তায়।
লিংকনটাই? নিশ্চিত হতে পারল না।
বিছানায় ফিরে এল আবার সে বুঝতে পারছে, রাবুমানার মত সে-ও মিলারকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে। অথচ এখন পর্যন্ত মিলার কোন ক্ষতি করেনি ওদের। বুইকটার ক্ষতি করেনি। রাতের বেলা চুপি চুপি ঘরে ঢুকে খোঁজাখুজি করেনি। পিছু পিছু আসার ব্যাখ্যা সহজেই দেয়া যায় হয়তো সে ও বেড়াতে বেরিয়ে একই দিকে চলেছে।
আচ্ছা, কি জিনিস আবিষ্কার করেছেন রাবুমানা? কি নিয়ে চলেছেন নিউ ইয়র্কে? কোথায় রেখেছেন ওটা? ছোট জিনিসই হবে, যা সুটকেসে ভরে রাখা যায়। বড় কিছু লুকানোর জায়গা নেই, গাড়িটাতেও না, তাহলে ওদের চোখে পড়তই। আর গাড়িতে রাখার জায়গাই বা কোথায়?
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখল তার অনেক আগে উঠে পড়েছে মুসা আর রবিন। কাপড় পরে তৈরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করতে হবে ওকে।
ওয়াশিংটনের ভেতর দিয়ে সেদিন পুবে এগোল ওরা। ওপরে উঠছে পথ। কাসকেড মাউনটেইন রেঞ্জ পার হয়ে এসে পড়ল খোলা অঞ্চলে। দুই পাশে রুক্ষ ছড়ানো প্রান্তর।
হায় হায়, এ যে মরুভূমি! নিরাশা ঢাকতে পারল না মুসা। আমি তো। ভেবেছিলাম পুরো ওয়াশিংটনটাই শুধু পাইনের জঙ্গল।
বোকার মত ভাবলে তো কত কিছুই ভাবা যায়, নানা বললেন।
স্পোক্যানি পার হয়ে আবার পার্বত্য অঞ্চলে ঢুকল ওরা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না রাস্তার পাশ দিয়ে বইছে, থেকে থেকেই দুপাশ থেকে চেপে আসছে জঙ্গল।
ইডাহোর কয়েউর ডিঅ্যালিনিতে রাত কাটানোর জন্যে থামল ওরা। লংভিউতে শহরের অনেক ভেতরে অখ্যাত ছোট মোটেলটার মতই কোন মোটেলে ওঠার ইচ্ছে। অবশ্যই মিলারের ভয়ে। যাতে সে খুঁজে বের করতে না পারে।
সারাদিনে অবশ্য ছায়াও দেখিনি, বললেন তিনি। রিয়ারভিউ মিররে। পলকের জন্যেও দেখিনি গাড়িটাকে। তবু ঝুঁকি নেব না। লুকিয়েই থাকব। আমাদের খুঁজে না পেলে সে ভাববে হয় আমরা স্পোক্যানিতে রয়েছি, নয়তো আরও এগিয়ে মিসৌলাতে চলে গেছি।
যদি আমাদের পিছু নিয়ে থাকে, তবেই, মিলারের কথা শুনতে আর ভাল লাগছে না মুসার। মনেপ্রাণে চাইছে লোকটাকে নিয়ে আলোচনা বন্ধ হোক।
খাওয়ার টেবিলে পড়শীর কথা আর তুললেন না রাবাত। খাওয়ার পর গলফ খেলতে বেরোলেন। সামান্য সময় খেললেন। তখনও কিছু বললেন না। সবচেয়ে বেশি স্কোর করলেন তিনি। ছেলেদের নিয়ে মোটেলে ফিরে এলেন। বেশ হাসিখুশি লাগছে তাকে।
রাতের বেলা ওদের গভীর ঘুম ভাঙিয়ে দিল সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার। সারা বাড়িতে আলোড়ন তুলে বেজেই চলল, বেজেই চলল।
খাইছে! বিছানায় উঠে বসে মুসা বলল, ঘটনাটা কি?
থামছে না সাইরেন। কানের পর্দা ছিদ্র করে দিয়ে যেন ঢুকে যাচ্ছে মগজে।
হঠাৎ জবাবটা পেয়ে গেল সে। চিৎকার করে উঠল, কিশোর, রবিন, জলদি ওঠো! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিচে নামল। স্মোক অ্যালার্ম! আগুন লেগেছে মোটেলে!
.
০৯.
রাতের নীরবতা চিরে দিয়ে যেন বেজে চলেছে ধোয়ার সঙ্কেত।
লোকের ছুটাছুটি আর হট্টগোল কানে এল গোয়েন্দাদের। দড়াম দড়াম করে বন্ধ হলো গাড়ির দরজা। ধোয়ায় ভারী হয়ে গেছে বাতাস।
দমকলকে ফোন করল কিশোর।
পাজামা পরেই ছুটে বেরোল মুসা। নানার দরজায় থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, নানা! নানা! ওঠো জলদি! মোটেলে আগুন লেগেছে!
কাশতে কাশতে টলোমলো পায়ে এসে দরজা খুলে দিলেন রাবাত।
সাইরেন বাজছে।
ইতিমধ্যে প্যান্ট পরে ফেলেছে রবিন। বেরিয়ে গিয়ে মোটেলের গেস্টদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলতে শুরু করল তাদের।
লাল গাউন পরা এক মহিলা দরজা খুলল। চোখ জ্বালা করছে। ডলতে ডলতে জানতে চাইল, কি হয়েছে?
মোটেলে আগুন লেগেছে, জানাল রবিন।
যেন আঁকুনি খেয়ে জেগে গেল মহিলা। ভেতরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, পিটার, জলদি ওঠো! তখনই বলেছিলাম এই খোয়াড়ের মধ্যে থাকার দরকার
রাবাত আর অন্য দুই গোয়েন্দাও কাপড় পরে ফেলেছে। একপাশ থেকে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল সবাই, বোর্ডারদের জাগিয়ে দিতে লাগল। ওদের চারপাশে ধোয়া উড়ছে। বাড়িটা U প্যাটার্নে তৈরি। মনে হচ্ছে U-র একটা মাথা থেকে আসছে।
কি যেন পড়ার শব্দ হলো। তারপর ঝনঝন করে কাচ ভাঙল। গাড়ির কাচ। চত্বরের পার্কিং লটে ইনডিয়ানার নম্বরপ্লেট ওয়ালা একটা গাড়ি তাড়াহুড়ো করে পিছাতে গিয়ে ওরিগনের প্লেট লাগানো একটা গাড়িকে গুতো মেরে দিয়েছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে চেঁচিয়ে উঠল ওরিগনের ড্রাইভার, এই গাধা, দেখও না নাকি!
জবাব দিল না ইনডিয়ানা। গাড়ি সরাতে ব্যস্ত।
ঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে বোর্ডাররা। কাশছে, চোখ ডলছে। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্যে বিছানার কম্বল তুলেই গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে অনেকে। কেউ কেউ গাড়ির দিকে ছুটছে, গাড়িতে করে নিরাপদ জায়গায়। পালাতে চায়। অন্যেরা চত্বরে জড়ো হলো কি ঘটে দেখার জন্যে।
দমকলকে খবর দেয়া হয়েছে? জানতে চাইল এক মহিলা।
দিয়েছি, জবাব দিল কিশোর, আসছে।
কিশোর, দেখো, হাত তুলল মুসা।
বাড়িটার শেষ মাথার একটা দরজায় লেখা রয়েছে: EMPLOYEES (ONLY. ধোয়া আসছে ওই দরজার ফাঁক দিয়ে।
ওই ঘরেই লেগেছে, বলে উঠল কিশোর। সরুন, সরুন সবাই; আগুনের কাছ থেকে সরে যান।
দরজাটার কাছ থেকে সবাইকে সরিয়ে দিতে লাগল মুসা আর রবিন।
দমকলের সাইরেন শোনা গেল। দেখতে দেখতে সেটা বেড়ে গেল, তার সঙ্গে যুক্ত হলো ভারী ইঞ্জিনের শব্দ। এসে গেছে দমকল।
কোথায় লাগল? পুরানো বাথরোব পরা টাকমাথা ছোটখাট একজন লোক জিজ্ঞেস করল। পরিচয় দিল, আমি মোটেলের ম্যানেজার। একহাতে চাবির গোছা, আরেক হাতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র।
ওই যে দেখুন দরজাটা, হাত তুলে দেখিয়ে দিল কিশোর।
দ্রুত এগিয়ে গেল ম্যানেজার। খুলে ফেলল তালা। পাল্লা খোলার জন্যে নব চেপে ধরতেই বাধা দিল কিশোর, দাঁড়ান! খুলবেন না!
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। টান দিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে ম্যানেজার। হাঁ হয়ে খুলে গেল পাল্লা। ভেতর থেকে ঝাঁপিয়ে এল যেন আগুনের চাদর, ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল ম্যানেজার, হাত থেকে খসে পড়ল ফায়ার এক্সটিংগুইশার। দুহাত উঠে গেল মুখ ঢাকার জন্যে। প্রচণ্ড গরম বাতাসের ঢেউ এসে লাগল। গোয়েন্দাদের ওপরও।
লোকটাকে সাহায্য করতে ছুটল মুসা। এক্সটিংগুইশার তুলে নিল রবিন। আগুনের দিকে তাক করে টিপে দিল ট্রিগার। তরল রাসায়নিক ফেনা ফিনকি দিয়ে বেরোল, পড়তে লাগল আগুনের মধ্যে।
দমকলের দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল মোটেলের সামনে। হুড়াহুড়ি করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ফায়ারম্যানেরা, মুহর্তে রবিনকে সরিয়ে দিল একপাশে। একজন একটা হোস তাক করে ধরল, তীব্র বেগে পানি গিয়ে পড়তে শুরু করল ঘরের মধ্যে। নিভে গেল আগুন। যেমন স্বয়ংক্রিয় ভাবে চালু হয়েছিল স্মোক অ্যালার্ম, আগুন নিভে যেতে ওটাও বন্ধ হয়ে গেল আপনাআপনি। ছোট ঘরটা একটা স্টোররুম। তেমন কিছু ছিল না। কয়েকটা পোড়া ন্যাকড়া, ঝাড়, একটা প্লাস্টিকের বালতি–পুড়ে গলে বিকৃত হয়ে। গেছে, আর একগাদা কঙ্কল পুড়ে ছাইয়ের স্তূপ হয়ে আছে।
ঘরে ঢুকল একজন ফায়ারম্যান। ভেজা ছাইয়ের স্তূপের দিকে তাকিয়ে রইল একটা সেকেন্ড, তারপর লাথি মেরে ছড়িয়ে দিল। পোড়া কম্বলের একটা টুকরো তুলে নিয়ে শুকল। আনমনেই বলল, তেল তেল গন্ধ। তারপিন হবে। রঙ করা হচ্ছিল নাকি এখানে? ম্যানেজারের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল সে।
আগুনের আঁচ লেগে ম্যানেজারের একটা ভুরু পুড়ে গেছে। সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দিল, না, রঙ করবে কে! কয়েক মাস ধরে রঙের। কাজ হয়নি মোটেলে।
নাক কুঁচকে আবার শুকল ফায়ারম্যান। কাঠের জিনিস বার্নিশ করা হয়েছে?
না! প্রার্থনা করার ভঙ্গিতে এক হাতের সমস্ত আঙুল আরেক হাতে গুঁজে দিল ম্যানেজার। আর করলেও এ ভাবে তারপিন ভেজানো ন্যাকড়া এখানে ফেলতে দিতাম না।
কি জানি! অনিশ্চিত শোনাল ফায়ারম্যানের কণ্ঠ। ফেলে দিল পোড়া টুকরোটা।
কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে শুনছেন রাবাত। নাক দিয়ে খেত-খোত করে বললেন, ফারগ্লো ব্যবহার করলেই আর এ সমস্যা হত না।
ফারগ্লোটা আবার কি জিনিস? জানতে চাইল রবিন।
নানার একটা আবিষ্কার, মুসা বলল। ফেলে দেয়া কাগজের প্যাড দিয়ে তৈরি। কাঠের জিনিস বার্নিশ করতে এর তুলনা হয় না। তারপর যেখানে ইচ্ছে ছুঁড়ে ফেলো, আগুন লাগার ভয় নেই। আগুন ধরে না ওতে।
আইডিয়াটা একটা সোপ কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছিলাম আমি, তিক্তকণ্ঠে বললেন রাবাত। ওরা কাজে লাগায়নি, আলমারিতে ভরে রেখে দিয়েছে। সেই রাগেই যেন দুপদাপ পা ফেলে ঘরে ফিরে এলেন। ঢুকেই এমন চিৎকার দিয়ে উঠলেন যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে।
চোর! বদমাশ! চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন তিনি, কিশোর! রবিন! মুসা! দেখে যা! চোরটার কাণ্ড দেখে যা!
ছুটে এল তিন গোয়েন্দা।
জলদি গিয়ে নিজেদের ঘর দেখো! কিছু নিয়েছে কিনা! দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে আছেন রাবাত। ম্যাট্রেস উল্টে ফেলা হয়েছে। চাদর আর কম্বলগুলো মেঝেতে। ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে তার কাপড়-চোপড়। মোজা আর আন্ডারওয়্যারগুলোও বাদ পড়েনি। শেভ করার আর দাঁত মাজার। সরঞ্জাম ছিল যে বাক্সটায়, সেটাও উল্টে ভেতরের জিনিস ঝেড়ে ফেলা হয়েছে।
হা হয়ে গেছে কিশোর। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নড়তে পারল না। তারপর রাবাতের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে বাথরুমে চলে গেল। পেছনের দেয়ালে বাথটাবের বেশ ওপরে একটা জানালা। সেটা খোলা। বাথটাবে জুতোর ছাপ দেখে বোঝা গেল জানালা দিয়ে এটাতে কেউ নেমেছিল।
টাবের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার হুড়কো পরীক্ষা করল সে। এক জায়গার রঙ চটে গেছে সামান্য।
হুড়কো সরিয়ে কেউ জানালা খুলে ঢুকেছিল, পেছনে দরজায় এসে দাঁড়ানো রাবাতকে বলল কিশোর। বেরিয়েছেও হয়তো একই পথে। দরজা। দিয়েও বেরোতে পারে। আগুনের দিকে খেয়াল ছিল সবার, তাকে কেউ দেখেনি নিশ্চয়।
পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এল রবিন। জানো কি কাণ্ড হয়েছে?
মুসা বলল, জানি, আমাদের ঘরেও ঢুকেছিল, সব তোলপাড় করে ফেলেছে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ। কিন্তু যতটা দেখলাম, কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হলো না।
মিলার! মিলার! ওই ব্যাটা ছাড়া কেউ না! চেঁচিয়ে উঠলেন রাবাত। এখানেও এসেছে!
কি করে, নানা? প্রশ্ন তুলল মুসা। পিছুটা নিল কি করে? কাল রাস্তার ধারে যেটা দেখেছি সেটা কার গাড়ি জানি না। যদি মিলারেরও হয়, কালকের পর আর দেখা যায়নি ওটাকে। পিছে পিছে এলে আমরা যে এখানে আছি জানবেই বা কি করে?
পিছে আসাটা তেমন কঠিন না, রাবাত বললেন। লিংকনটা ভাড়া করা গাড়ি, ওর নিজের না। যেহেতু আমাদের চেনা হয়ে গেছে, ফেরত দিয়ে অন্য আরেকটা নিয়ে নিতে পারে। আমাদের একেবারে লেজে লেগে থাকলেও তখন আর চিনতে পারব না।
কিশোরের মনে পড়ল, লংভিউতে মোটেলে রাতে একটা বড় গাড়ি চলে যেতে দেখেছিল। কিন্তু বলল না রাবাতকে, চেপে গেল। শুনলেই খেপে যাবেন।
ঘরের ছড়ানো জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, নানা, তোমার আবিষ্কারটা খোয়া গেছে কিনা দেখছ না?
জবাব দিলেন না রাবাত। দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না। যেন তিনি। জানেন, খোয়া যায়নি। লম্বা লম্বা পা ফেলে আবার চত্বরে বেরিয়ে এলেন। অনুসরণ করল ছেলেরা।
কিছু বোর্ডার তখনও আছে ওখানে। খেপে যাওয়া ম্যানেজারের লম্ফ ঝম্প দেখছে। আগুন লাগিয়েছে যে, তাকে হাতে পেলে এখন কি কি করত, গলাবাজি করে বলছে। নিষ্ফল আক্রোশ। রাস্তায় অপেক্ষা করছে দমকলের গাড়ি। ইঞ্জিন চলছে। ড্রাইভওয়েতে ঢুকেছে একটা পুলিশের গাড়ি। ছাতের বাতিটা ঘুরছে। ঝিলিক ঝিলিক করে কমলা আলো ছিটিয়ে দিচ্ছে যেন বাড়িটার সামনের দেয়ালে।
স্টোররুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একজন পুলিশ অফিসার। কথা বলছে। ফায়ারম্যানের সঙ্গে।
গটমট করে সেদিকে এগিয়ে গেলেন রাবাত। বললেন, কি করে লাগল সেটা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আগুনটা লাগানো হয়েছে, ইচ্ছে করে।
ফিরে তাকাল অফিসার আর ফায়ারম্যান। চোখে কৌতূহল। ফায়ারম্যান জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করে জানলেন?
জানি!
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কিশোর, শুরু হলো আবার!
হ্যারিস মিলার লাগিয়েছে ওই আগুন, বলতে কোন রকম দ্বিধা করলেন না রাবাত। লাগিয়েছে যাতে আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঘাটতে পারে। আমার আর ওদের, তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন তিনি, ঘর দুটোকে তছনছ করে ফেলেছে। আগুন লাগালে যে সারা বাড়িতে লেগে যেতে পারে, এতগুলো লোক বিপদে পড়বে, ভাবলও না একবার; নিজের উদ্দেশ্য সাধনটাই তার কাছে বড়। ভীষণ স্বার্থপর। পুরো বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারত!
রাবাতের দিকে তাকিয়ে হাসল ম্যানেজার। সব দাঁত বেরিয়ে পড়ল। এই প্রথম একজনকে পেল, তার পক্ষে বলছেন। চেঁচিয়ে বলল, সেই তখন থেকেই বলছি, তেল লাগানো ন্যাকড়া আমি ফেলতে দিই না! কাজের লোকদের কড়া হুকুম দেয়া আছে। অসাবধানতার জন্যে লেগেছে এ কথা কিছুতেই বলতে পারবেন না। বাইরে থেকে কেউ এসে যদি লাগিয়ে দেয়, আমি কি করতে পারি বলুন?
স্টোর রুমে ঢুকল অফিসার। পেছনের দেয়ালে একটা জানালা। রাবাতের বাথরুমের জানালার মতই এটাও বাইরে থেকে খোলা হয়েছে, তবে খুলতে গিয়ে এটার হুড়কোটা ভেঙে ফেলেছে।
এটা এ ভাবে ভাঙা আছে কদ্দিন? জানতে চাইল অফিসার।
ভাঙা থাকবে কেন? জোর প্রতিবাদ জানাল ম্যানেজার, ভাঙা জিনিস আমি থাকতে দিই না! এটা ভাল ছিল। আজ রাতে খোলা হয়েছে। হুড়কো ভেঙেছে জানলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করিয়ে ফেলি। একটুও দেরি করি না।
রাবাতের দিকে তাকাল অফিসার, আপনার ঘরটা দেখব।
সানন্দে দেখাতে রাজি হলেন তিনি। নিয়ে এলেন অফিসারকে। তার ঘরটা দেখার পর গোয়েন্দাদেরটাও দেখল সে।
নোটবুকে লিখে নিল অফিসার। গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজায় নক করল তার সহকারী। দুজনে মিলে তখন বোর্ডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। তদন্ত শেষ করার পর জানা গেল, কেবল রাবাত আর গোয়েন্দাদের ঘরেই ঢুকেছিল চোর।
হোটেলের লোকও হতে পারে, অবশেষে অফিসার বলল। কিন্তু এ ভাবে ঢুকে কোন কিছু না নিয়ে চলে গেল কেন…
অফিসারের কথা শুনে রেগে গেলেন রাবাত। খসখসে গলায় বললেন, কারণ হোটেলের লোক নয় ও! আমি বলছি, হ্যারিস মিলার! রকি বীচ থেকে আমাদের অনুসরণ করে এসেছে ও!
রকি বীচ?
কেন, চেনেন না? নাম শোনেননি? ক্যালিফোর্নিয়াতেই তো। শুনুন, পিজমো বীচে ওর সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে আমাদের, তারপর মনটিরেতে। আমি এখন শিওর, মোটর সাইকেলওয়ালা গুণ্ডাবাহিনীকেও সে-ই আমাদের পেছনে লাগিয়েছিল। ওকে গিয়ে গ্রেপ্তার করুন। ভয়ানক লোক ও!
তাই নাকি! কিন্তু সে আপনাদের ফলো করবে কেন? আপনাদের ঘর তল্লাশি করবে কেন? কি খুঁজেছে?
আমার আবিষ্কার।
তাই! সেটা কি?
সতর্ক হয়ে গেলেন রাবাত। চোখের তারায় ধূর্ত একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। সে-কথা তো আপনাকে বলা যাবে না। কাউকেই বলা যাবে না এখন।
ও! এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অফিসার বলল, ঠিক আছে, হ্যারিস মিলারের চেহারার বর্ণনা দিন। কি গাড়িতে করে এসেছে…
প্রথম একটা লিংকনে করে পিছু নিয়েছিল। এখন সম্ভবত গাড়িটা বদলে ফেলেছে। তবে এখন আর ওসব আলোচনা করে লাভ নেই। ওকে ধরতে পারবেন না। পালানোর ইচ্ছে থাকলে বহুদূরে চলে গেছে!
মাথা ঝাঁকাল অফিসার। মসৃণ হাসি ফুটল ঠোঁটে। রাবাত আর তিন। গোয়েন্দার নাম আর বাড়ির ঠিকানা লিখে নিল। কিশোরের কাছ থেকে লিংকন গাড়িটার লাইসেন্স নম্বরও লিখে নিল। তারপর সহকারীকে নিয়ে গিয়ে পুলিশ কারে উঠল।
গাধা কোথাকার! বলে উঠলেন রাবাত। অহেতুক সময় নষ্ট করে গেল! কিছু করবে না ও! করার চেষ্টাও করবে না!
করবে কি, ও তো তোমাকে পাগল ভেবে গেছে! মুখ ফসকে বলে ফেলল মুসা। নানা রেগে যাচ্ছেন বুঝে তাড়াতাড়ি সামাল দিল, কারোর কিচ্ছু করা লাগবে না। মিলার যদি পিছু নেয়, আমরাই ওর ব্যবস্থা করব!
.
১০.
দুই দিন পর। ইডাহোর ভেতর দিয়ে চলেছে ওরা, মনটানার লিভিংস্টোনের দিকে। আরও দক্ষিণে এগোলে পড়বে ওয়াইয়োমিঙের ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। টুরিস্ট মৌসুম এখনও শুরু হয়নি। রাস্তায় যানবাহনের ভিড় তাই কম।
ইয়েলোস্টোনে পৌঁছে মাটিতে ফাটল থেকে ধোয়া উঠতে দেখল ওরা। এখানে ওখানে ফোয়ারার মত পানি ছিটকে উঠছে ওপরে, কোন কোনটা একশো ফুটের বেশি ওপরে উঠে যাচ্ছে। পানির রঙ লোহার মরচের মত লাল। তাজ্জব হয়ে দেখল, রাস্তার ধারে ডোবা, তাতে গলিত কাদা থেকে বুদ্বুদ উঠছে–যেন ওগুলোর তলায় বিশাল সব চুল্লিতে আগুন জ্বলছে, কাদা। ফুটতে শুরু করবে খানিক পরই। সুন্দর সুন্দর লেক আর ঝর্নার ছড়াছড়ি। এক সময় এটা ছিল আগ্নেয়গিরির এলাকা, এখন সেগুলো মরে গেছে। এত সুন্দর দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্যে মিলারের ভাবনা ওদের মন থেকে মুছিয়ে দিল।
তারপর পার্ক রোড ধরে এগোতে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকাল রবিন আর মুসা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। নীরবে শত্রু খুঁজছে মুসার চোখ।
মাউন্ট সেইন্ট হেলেন পেরোনোর পর থেকে সন্দেহজনক আর কিছু দেখিনি, রবিন বলল।
জানানোর সময় এসেছে, ভাবল কিশোর। লংভিউর মোটেলে ড্রাইভওয়েতে বড় গাড়িটা দেখার কথা বলল সে। হ্যারিস মিলারই গাড়িটা চালাচ্ছিল কিনা, বলতে পারব না।
হয়তো এতক্ষণে রকি বীচে চলে গেছে মিলার, রবিন বলল, অর্কিড গাছে পানি দিচ্ছে। মোটেলে আগুন লাগাটা হয়তো নেহায়েত কাকতালীয় ঘটনা। কোন ছিঁচকে চোর স্টোর রুমে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ঘর থেকে। আমাদের বের করেছিল…
আরে দূর! মুসা যে ভঙ্গিতে বলে, সেভাবে বলে উঠলেন রাবাত। সাধারণ চোর হতেই পারে না। হলে চুরি করল না কেন? প্রচুর জিনিস ছিল, সুযোগও ছিল। আমার মানিব্যাগটাই তো পড়ে ছিল টেবিলের ওপর। দুয়েও দেখেনি। তোমার ক্যামেরাটা দামী, ওটাও নিতে পারত।
পেলে হয়তো নিত। কাল রাতে গাড়িতে ছিল ওটা। ঘরে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
কিন্তু টাকা? সামনে পেলে টাকা নেয় না এমন চোরের কথা শুনিনি। চালাকি করে স্টোর রুমে আগুন লাগিয়ে বোর্ডারদের বের করে জিনিস চুরি করার কথাও ভাবে না সাধারণ চোর। সুযোগ পেলে চট করে ঘরে ঢুকে পড়ে। কিছু পেলে নিয়ে চলে যায়।
পুরানো হয়ে এল ফোয়ারা। প্রথম দেখার পর যেমন লেগেছিল, অতটা ভাল লাগছে না আর। উত্তেজনাও কমে গেল।
রাবাত বললেন। জায়গাটা বেশি খালি! অত শূন্যতা ভাল লাগে না!
নানার অস্বস্তিটা মুসার মাঝেও সঞ্চারিত হলো। মনে করিয়ে দেয়ার পর এখন কেমন ভূতুড়েই লাগছে এলাকাটা তার কাছে। বলল, তাড়াতাড়ি করো, নানা, সরে যাই! দেখার কিছু আর নেই এখানে!
শেষ বিকেলে মনটানা-ওয়াইয়োমিং সীমান্তের কাছে একটা ছোট শহরে ঢুকল ওরা। মোটেল খুঁজে বের করল। মালপত্র ঘরে রাখার পর বুইকটা নিয়ে চলে গেলেন রাবাত। পার্কিং লট থেকে দূরে রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে এলেন। ইচ্ছে করেই রাখলেন, মিলারের জন্যে টোপ। দেখতে চান, সে আসে কিনা, খোলার চেষ্টা করে কিনা। বাকি বিকেলটা কাটালেন গাড়ির কাছে যাতায়াত করে।
পঞ্চমবার যখন গাড়িটা দেখতে চললেন তিনি, আর থাকতে পারল না মুসা। বলল, এ ভাবে গিয়ে লাভটা কি হচ্ছে? ক্ষতি করছ আরও। মিলার এলে তোমার এই ঘনঘন যাওয়া-আসা দেখলে সতর্ক হয়ে যাবে। জেনে যাবে আমরা কোথায় উঠেছি। রাতে এসে হানা দেবে।
মুসার কথায় যুক্তি আছে। আর গেলেন না রাবাত। ঘরে ফিরে এলেন। খানিক পরই তার নাক ডাকানোর শব্দ কানে এল।
জেগে রইল তিন গোয়েন্দা। কয়েউর ডিঅ্যালিনির মোটেলে আগুন লাগার ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল।
মিলারকে সন্দেহ করতে পারছি না আমি, মুসা বলল। সে এল কি করে মোটেলে? জানল কি করে আমরা ওটাতে উঠেছি? আমাদের পিছে আসতে দেখিনি তাকে। অন্য গাড়ি নিয়ে অনুসরণ করলেও চোখে পড়ে যেত আমাদের। এত দীর্ঘ পথ কিছুতেই লুকিয়ে থাকতে পারত না।
আচ্ছা, হেলিকপ্টারে করে আসেনি তো? রবিনের প্রশ্ন।
নাহ! সম্ভাবনাটা একেবারেই ঝেড়ে ফেলে দিল মুসা। হেলিকপ্টার পাবে কোথায়? ভাড়া করতে অনেক টাকা লাগে। তা ছাড়া অতিরিক্ত শব্দ করে হেলিকপ্টার। নিঃশব্দে অনুসরণ করা একেবারে অসম্ভব।
চুপ হয়ে গেল রবিন।
হঠাৎ বিছানায় সোজা হয়ে বসল কিশোর। ওকে ফোন করব! ইস, আরও আগে এ কথাটা ভাবলাম না কেন? রকি বীচে ওর বাড়িতে ফোন করলে যদি জবাব দেয় তাহলে বুঝব আমাদের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাওয়াটা কাকতালীয় ঘটনা ছিল। আবার ফিরে গেছে। আমাদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
কি করে করবে? নম্বর জানো? রবিনের প্রশ্ন।
না। তবে আনলিস্টেড নাম না হলে ডিরেক্টরি এনকয়ারিতে ফোন করলেই বলে দেবে।
বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ফোনের দিকে হাত বাড়াল কিশোর। মিনিট খানেকের মধ্যেই জেনে নিল মিলারের নম্বর। ফোন করল।
ও পাশে ফোন বাজতে লাগল।
এত রাতে বিছানা থেকে ডেকে তুলছ, হেসে বলল রবিন, রেগে আগুন হবে।
রকি বীচে এখন রাত এক ঘণ্টা কম। পার্বত্য এলাকায় রয়েছি আমরা, এখানে ওখানকার তুলনায় সময় বেশি।
তিনবার রিঙ হওয়ার পর খুট করে একটা শব্দ হলো, যেন কেউ রিসিভার তুলেছে ওপাশে। কয়েকটা মুহূর্ত সব শূন্য, তারপর আবার খুট। রেকর্ড করা একটা কণ্ঠ বলল, হ্যারিস মিলার বলছি। সরি, এখন ফোনের কাছে আসতে পারছি না। আপনার নাম আর ফোন নম্বর রেখে দিন। পরে যোগাযোগ করব। মেসেজ দেয়ার আগে টোন আসার অপেক্ষা করুন। কথা শেষ হওয়ার পর পরই ভেড়ার ডাকের মত একটা চিৎকার শোনা গেল।
ঝট করে কানের কাছ থেকে রিসিভার সরিয়ে ফেলল কিশোর। উফ, আরেকটু হলেই কান ফাটিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্র! অ্যানসারিং মেশিন জবাব দিয়েছে।
তারমানে আছে কি নেই জানা গেল না, মুসা বলল।
সকালে আবার করব। দেখা যাক, তখন কি বলে?
সকাল আটটায় আবার মিলারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল কিশোর। সেই একঘেয়ে জবাব দিল অ্যানসারিং মেশিন। হাল ছেড়ে দিল কিশোর। মিলার বাড়ি আছে কিনা, রোঝা গেল না।
সেদিন ওয়াইয়োমিঙের ভেতর দিয়ে চলল ওরা। পরিষ্কার, সুন্দর দিন, যদিও নীল আকাশের এখানে ওখানে পেঁজা মেঘ ভাসছে। সেই মেঘে বৃষ্টি হবে না। দুধারে ঘাসে ঢাকা মাঠ, তাতে গরু চরছে। দক্ষিণ ডাকোটার র্যাপিড সিটিতে পৌঁছে রাবাত ঘোষণা করলেন, তাদের ছুটি মাটি করতে দেবেন না মিলারকে।
ওই ড্রামটার কথা মাথায়ই আনব না আর, বললেন তিনি। ওর কথা ভেবে দুশ্চিন্তা আর টেনশনের মধ্যে থেকে দেখার আনন্দ মাটি করব না।
এতে অস্বস্তি কমল ছেলেদের। র্যাপিড সিটিতে লাঞ্চ খাওয়ার সময় অনেক হই-হুঁল্লোড় করল। সেখান থেকে দক্ষিণে এগোনোর সময় একটিবারও আর পেছনে ফিরে তাকাল না। তবে কিশোর লক্ষ করল, বার বার রিয়ারভিউ মিররের দিকে চোখ যাচ্ছে রাবাতের।
মাউন্ট রাশমোরে পৌঁছল ওরা। পাহাড়ের ওপরে খানিকটা জায়গা সমতল করে চারপাশের দৃশ্য দেখার জন্যে পর্যবেক্ষণ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাহাড়ী পথ। কয়েক মাইল পেরিয়ে এসে পার্কিং লট দেখা গেল। ওখানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে এগোল ওরা। চওড়া পথ। সিকি মাইল পর রয়েছে মঞ্চ। সহজেই পৌঁছানো যায়। পঞ্চাশটা রাজ্যের পতাকা উড়ছে ওখানে।
মঞ্চে এসে দাঁড়াল ওরা। পাইনে ছাওয়া ঢাল নেমে গেছে নিচে। গাছের ফাঁকে মাথা তুলে আছে আমেরিকার মহান চার প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন, জেফারসন, লিংকন, থিয়োডোর রুজভেল্ট। দক্ষিণ ডাকোটার পর্বতের পাথর কেটে তৈরি হয়েছে ওই বিশাল মুখগুলো।
খাইছে! কি জিনিস বানিয়েছে! অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বলল মুসা।
সঙ্গে গাইডবুক এনেছে কিশোর। কিন্তু সেটা দেখার প্রয়োজন হলো না। আগেই পড়ে নিয়েছে। বলল, গুটজন বরহ্লামের নির্দেশে তৈরি হয়েছে ওগুলো। একেকটা মুখ ষাট ফুট উঁচু।
হেসে ফেলল মূসা, গুম যখন ছোট ছিলেন, নিশ্চয় তার মা বলেছিলেন–বড় হয়ে বিশাল কোন কাজ করবে বাবা, যা তোমাকে স্মরণীয় করে রাখবে। সেই বিশাল কাজটাই করেছেন তিনি।
বাহ, খুব মজার কথা বলে তো ছেলেটা! পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
ফিরে তাকাল মুসা।
রাবাতও তাকালেন।
মোটাসোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা। পরনে আঁটো জিনসের প্যান্ট। রাবাতের দিকে তাকিয়ে হাসল। এরা আপনার নাতি?
একজন।
বাচ্চারা বড় মজার জিনিস! ঝর্নার বহমান পানির মত কলকল করে হাসল মহিলা। সব সময় তাজা। নতুন নতুন কথা খেলে মাথার মধ্যে, কখনও পুরানো হয় না।
এমন ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকালেন রাবাত, যেন তাজা আর নতুনত্ব সত্যি আছে কিনা দেখতে চাইছেন। মুসার চোখ উজ্জল। রবিন লাল হয়ে গেল।
নিজেকে বাচ্চা ভাবতে মোটেও ভাল লাগে না কিশোরের। কঠিন। দৃষ্টিতে তাকাল মহিলার দিকে। বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের শার্টে এমব্রয়ডারি করা বড় বড় গোলাপী রঙের ফুল। কানে ম্যাচ করা গোলাপী, রঙের দুল, ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক। হেসে রাবাতের দিকে দুই কদম এগিয়ে এল।
কখনও সন্তান হয়নি আমার, মহিলার কণ্ঠে খুব হালকা হতাশা আছে। কি নেই। সবাই বলে, ডরোথি, খুব ভাল মা হতে পারতে তুমি। কিন্তু কারও কথায় কান দিইনি। অন্যের বাচ্চাকে আদর করতেই ভাল লাগে আমার।
সরাসরি মহিলার চোখের দিকে তাকালেন রাবাত। তাঁর চোখের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে চোখজোড়া। মহিলার অন্তর ভেদ করে ঢুকে গেল তার দৃষ্টির ছুরি। এক পা পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। টান লাগল হাতে। দেখেন, শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরেছে মহিলার আঙুল। বড় বড় নখে গোলাপী রঙের নেলপলিশ।
নানার বিপদ বুঝতে পারল মুসা। ঘড়ি দেখল। খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল। বলল, নানা, জলদি চলো। ভুলে গেছ, নানীকে বসিয়ে রেখে এসেছ মোটেলে? দেরি দেখলে রেগে কাঁই হবে, আস্ত রাখবে না আর।
চমৎকার একটা মিথ্যে বলেছে মুসা। মনে মনে বাহবা না দিয়ে পারল না। কিশোর। এই মুহূর্তে নানাকে বাঁচানোর এর চেয়ে ভাল কোন বুদ্ধি সে-ও বের করতে পারত না। পলকে উধাও হয়ে গেল মহিলার গোলাপী হাসি। রাবাতের হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল, যেন বিদ্যুতের শক খেয়েছে। শুকনো গলায় বলল, ও, তাই নাকি, তাই নাকি! যান, তাড়াতাড়ি যান! আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল!
হু, আমারও! ভদ্রতা করার জন্যে কোনমতে বলে তাড়াতাড়ি পার্কিং লটের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন রাবাত। তার তিন পাশে বডিগার্ড হয়ে এগোল তিন গোয়েন্দা।
গাড়িতে উঠে মুসা যখন বুঝল এতক্ষণে নিরাপদ, নানার দিকে চেয়ে হেসে। বলল, নানা, মহিলা তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করছিল। আমরা না থাকলে মরতে! সোজা ধরে নিয়ে যেত।
নিলে নিত, রসিকতার জবাব রসিকতা দিয়েই দিলেন রাবাত, আরেকটা নানী পেয়ে যেতি। চিবুকটা সামনে ঠেলে দিয়ে বললেন, তাহলে বুঝলি তো, এখনও বুড়ো হইনি। মেয়েরা তাকায়।
হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছরের মেয়ে।
এ কথার আর জবাব দিলেন না নানা।
পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে এল আবার ওরা। গাড়ি ঘুরিয়ে কাস্টার স্টেট পার্কের দিকে এগোলেন রাবাত।
কাস্টার পার্কে বাইসন থাকে, কিশোর বলল। একসঙ্গে এত নাকি খুব। কমই দেখা যায়। চিড়িয়াখানার বাইসন আর বুনো বাইসনে অনেক তফাৎ। বুনোগুলো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এড়িয়ে চলা ভাল।
হেসে রাবাত বললেন, কিশোর, বেরোনোর আগে গাইড-বুকটাকে গুলে খেয়েছ নাকি? রাতে বসে বসে পাতা মুখস্থ করো?
মুখস্থ করা লাগে না, রবিন বলল, একবার পড়লেই যথেষ্ট। কম্পিউটারের মেমোরি ওর, কখনও ভোলে না।
আমারও এ রকম থাকলে ভাল হত। কাজে লাগত। মাঝে মাঝে তো মনে হয় নিজের নামই ভুলে যাচ্ছি। বললেন রাবাত।
বেশি ব্যস্ত থাকো বোধহয়, ফোড়ন কাটল মুসা। মহিলার কথা দিয়েই বলি–সব সময় তাজা, নতুন নতুন বুদ্ধি খেলে মাথার মধ্যে। সেজন্যে পুরানো কথা আর ধরে রাখতে পারো না, ভুলে যাও।
মেজাজ ভাল আছে নানার। মুসার কথায় কিছু মনে করলেন না।
ঢালু হয়ে গেছে এখন পথ। পথের মাথায় গেট পেরিয়ে কাস্টার স্টেট পার্কে ঢুকল গাড়ি।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন রাবাত, আরি, ওগুলো কি! গাড়ি থামি?, দিলেন।
রাস্তার ধারে জটলা করছে কতগুলো বুনো গাধা। গাড়িটাকে দেখে পাকা রাস্তায় খুরের খটাখট আওয়াজ তুলে এগিয়ে এল। নাক বাড়িয়ে দিল জানালার কাছে।
মনে হয় খাবার চায়! মুসা বলল।
রাবাত বললেন, খাবার দিয়ে দিয়ে অভ্যাস খারাপ করে ফেলেছে লোকে। বাইসনেরাও এসে চাইবে না তো? তাহলেই সর্বনাশ। না দিলে হয়তো রেগেমেগে শিং দিয়ে গুতানোই শুরু করবে।
কিন্তু গাধার মত হ্যাংলামি করল না বাইসনেরা। রাস্তা থেকে বেশ দুরে রইল। গাড়ি থামিয়ে ভাল করে দেখার জন্যে নামলেন রাবাত, তখনও ফিরে তাকাল না জানোয়ারগুলো। আপনমনে ঘাস খেতে থাকল।
এক সময় এত বাইসন ছিল এখানে, মাঠই দেখা যেত না, কালো হয়ে থাকত, কিশোর বলল। দল বেঁধে রেললাইনের কাছে চলে আসত। দাঁড়িয়ে থাকত লাইনের ওপর। গাড়ি আটকে দিত।
ক্যামেরা তুলে খটাখট শাটার টিপে যাচ্ছে রবিন। যতটা কাছে যাওয়া সভব, যাব। এতদূর থেকে লম্বা ঘাসের মধ্যে বাইসনগুলোকে আর বাইসন। মনে হচ্ছে না, পাথরের চাঙড়ের মত লাগছে।
খবরদার, সাবধান করল মুসা, ওই কাজও কোরো না। সাংঘাতিক বদমেজাজী জানোয়ার।
হ্যাঁ, মুসার কথায় সুর মেলালেন রাবাত, প্রায়ই অ্যাক্সিডেন্টের খবর শোনা যায়। সাহস দেখিয়ে ওগুলোর কাছে চলে যায় লোকে, বোকামির জন্যে মরে। শিঙের গুতোয় ভর্তা হয়। যে ভাবে আছে ওভাবেই থাকতে দাও, বিরক্ত করার দরকার নেই। কোন বুনো জানোয়ারকেই অতটা বিশ্বাস করা উচিত না।
বাইসনের পালকে পেছনে ফেলে এল ওরা। পথের পাশে গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া গেল।
রাবাত বললেন, আমি একটু ঘুরে আসতে চাই। একটা রাস্তা দেখালেন তিনি। পাইন-ছাওয়া পাহাড়ের ঢালের দিকে চলে গেছে। পথের মাথায় কোন রাজপুরী, দেখার ইচ্ছে আছে কারও? এতদূর এসে না দেখে চলে যাওয়াটা বোকামি হয়ে যাবে।
আপত্তি নেই, জবাব দিল রবিন, যদি রাজপুরীতে রাক্ষস না থাকে।
ইগনিশন থেকে চাবি খুলে নিলেন রাবাত। কিশোরের দিকে তাকালেন, তুমি?
আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই থাকি।
রবিন আর মুসাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন রাবাত। কয়েক মিনিটেই হারিয়ে গেলেন ঘন বনের মধ্যে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে কান পাতল কিশোর।
আরেকটা গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়েছে। এগিয়ে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। মনে হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে গাছপালার ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসবে একটা ধূসর লিংকন।
কিন্তু লিংকন নয়, এল একটা ক্যাম্পার। হুইলে বসা একজন বুড়ো লোক। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিশোরের উদ্দেশে হাত নাড়ল।
হাসল কিশোর। অতি-কল্পনা করে ফেলেছিল। কেউ অনুসরণ করছে না ওদের। মিলার পিছু নিয়ে থাকলে সারাক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারত না, এক না একসময় বেরিয়ে আসতেই হত। দেখা দিত। কিন্তু গত কয়েকশো মাইলের মধ্যে মিলারের চেহারাও দেখেনি ওরা। তারপরেও লোকটার কথা কেন যে মন থেকে তাড়াতে পারছে না, কে জানে! আসলে সন্দেহ করার মত আর কেউ নেই বলেই হয়তো এ রকম হচ্ছে।
কিশোরের মাথার ওপরে একটা গাছে পাখি ডেকে উঠল, ডানার শব্দ তুলে বেরিয়ে এল ওটা। বসতে বসতে বিরক্ত হয়ে গেল কিশোর। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। থেকেছে আসলে দেখার জন্যে, ওদের গাড়িটার কাছে কেউ আসে কিনা। সেই কেউটা আর কেউ নয়, মিলার। কিন্তু এখন ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হচ্ছে। প্রয়োজন ছিল না। এই অতি সন্দেহের কোন মানে নেই। মুসার আসতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। তাড়াতাড়ি গেলে এখনও ওদের ধরা যায়।
প্রায় দৌড়াতে শুরু করল কিশোর। চারপাশ থেকে ঘিরে এল জঙ্গল। প্রথম মোড়টার কাছে এসে ফিরে তাকাল। পেছনে রাস্তাটা দেখা যায় না। হারিয়ে গেছে গাছের ওপাশে।
আবার কানে এল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। থামল গাড়িটা। দরজা খুলে বন্ধ হলো। রাস্তার পাশে বুইকটার কাছে গাড়ি রেখেছে কেউ।
তবে কি তার সন্দেহই ঠিক ছিল? মিলারই এসেছে? শ্বাস টানা বেড়ে গেল কিশোরের। ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেছে। খানিকটা পিছিয়ে পাশে সরে গেল সে। এখন দেখা যাচ্ছে রাস্তাটা। রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। আগন্তুক। ভয় পেয়ে গেল কিলোর। মনে হলো খামচি দিয়ে ধরেছে কেউ হৃৎপিণ্ডটাকে। লুকিয়ে পড়তে হবে।
গাছপালার কারণে পাহাড়ের গোড়ায় বেশ ছায়া, অন্ধকারই বলা চলে। প্রচুর ঝোপঝাড় আছে। তবে ওগুলো বেশ দূরে। সে যেখানে রয়েছে সেখানে পথের ডান পাশে কয়েক গজ দূরে ম্যানজানিটা জাতীয় একধরনের গাছের ঝোপ, দেখতে পেল। বেশি বড় না। কাছাকাছি আর কিছু না দেখে ওটার দিকেই দৌড় দিল সে। প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। লুকিয়ে গেল ডালপাতার আড়ালে। আস্তে করে ডাল সরিয়ে ফাঁক করে উঁকি দিল রাস্তার দিকে।
লোকটার মুখ দেখতে পেল না। পা চোখে পড়ল কেবল। শোনা যাচ্ছে নিঃশ্বাসের খসখসে শব্দ। দাঁড়িয়ে গেল লোকটা। পাহাড়ের দিকে মুখ। পায়ে বাদামী রঙের লোফার, পরনে জিনস। পাহাড়-জঙ্গলে আসার অভিজ্ঞতা নেই বোধহয়–অনুমান করল কিশোর, তাহলে এই পোশাক পরে আসত না। লোফারটা নতুন, জিনসেও ভাজ নেই তেমন, রঙ জ্বলেনি।
এখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল কেন? এগোচ্ছে না কেন? কিছু দেখেছে? রাস্তা। থেকে সরে আসার আগে কোন চিহ্ন রেখে এসেছে কিশোর?
ঘাবড়ে গেল সে। মনে হতে লাগল, বড় বেশি খোলামেলা জায়গায় রয়েছে। কেউ আছে সন্দেহ করে যদি ঘুরে ভাল করে ঝোপের দিকে তাকায়। লোকটা, তাকে দেখে ফেলবে।
বাঁ পাশের ঝোপের ভেতর শব্দ হলো। ঘুরে তাকাল লোকটা। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল একটা বুনো জানোয়ার।
কি বেরোল দেখতে পেল না কিশোর, তবে সুযোগটা কাজে লাগাল। হাতের থাবা আর হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করল লোকটাকে দেখার জন্যে।
ধক করে উঠল বুক। দম বন্ধ করে ফেলল। লোকটার হাতে পিস্তল!
হাই! ডাকল কে যেন রাস্তা থেকে।
পথের দিকে তাকাল আগন্তুক। চওড়া কানাওয়ালা ঐ হ্যাঁটের নিচে তার চেহারা এখন দেখতে পাচ্ছে কিশোর। হ্যারিস মিলারকে চিনতে ভুল করল না।
মাথা নামিয়ে ফেলল কিশোর। আগের চেয়ে বেশি। মাটিতে শরীর। মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করল, যাতে মিলারের চোখে না পড়ে। ঘামছে। উঠে দৌড় দেবে? না, উচিত হবে না। বেরোলেই তাকে দেখে ফেলবে মিলার।
হাই, আবার বলল মহিলা, আমাকে মনে আছে? কাছে চলে এসেছে।
নীরবে হাসল কিশোর। গলা শুনেই চিনতে পেরেছে। সেই মহিলা, ডরোথি, মাউন্ট রাশমোরে রাবাতকে পাকড়াও করেছিল যে।
আমি ভেবেছি আর দেখা হবে না আপনার সঙ্গে, মহিলা বলছে। লাঞ্চের পর দেখি আপনি নেই! কত খোঁজা খুঁজলাম। নেই তো নেইই। যেন হাওয়া! এখানে কি করছেন? পাহাড় দেখতে এসেছেন বুঝি?
মিলারের হাত দেখতে পাচ্ছে না কিশোর। পিস্তলটা কি করেছে বুঝতে পারল না। নিশ্চয় পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। মহিলা দেখেনি। দেখলে প্রশ্ন শুরু করে দিত। বিড়বিড় করে কি যেন বলল মিলার, ঠিক বোঝা গেল না–পেট্রল ফুরিয়ে গেছে, এ রকমই কি যেন বলল। মহিলা বকবক করতে লাগল। মিলারকে আবার খুঁজে পাওয়ার আনন্দে বিভোর। নিজের গাড়িতে তাকে লিফট দেয়ার প্রস্তাব দিল। মিলার যদি পাহাড়ের দিকে হাঁটতে যেতে চায়, তাহলে সঙ্গ দেবে। হাঁটার ব্যাপারেই আগ্রহ বেশি মহিলার।
রাজি হলো না মিলার। বলল, অনেক ঘোরাফেরা করেছে, এবার ফিরে যেতে চায়। গাড়ির দিকে এগোল সে। মহিলা ছাড়ল না। সঙ্গে সঙ্গে চলল। কথা বলার নেশায় পেয়েছে যেন। অনর্গল বকছে।
আবার মাথা তুলল কিশোর।
মিলারের হাত চেপে ধরেছে মহিলা। শক্ত করে ধরেছে, যেন আর হাওয়া। হতে না পারে মিলার।
হাসি পেল কিশোরের। মিলারের মনের অবস্থা কল্পনা করে হাসিটা বাড়ল। ভাল বিপদেই পড়েছে বেচারা। ওই মহিলার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া বড় কঠিন ব্যাপার।
গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল দুজনে।
মিনিট দুই পরে প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ কানে এল। চলে গেল গাড়ি দুটো।
ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। মুসাদের পিছু নেয়ার সময় নেই আর এখন। একটা পাথর দেখে তাতে বসে পড়ল। সঙ্গীদের আসার অপেক্ষা করতে লাগল।
১১.
মুসারা এসে তাকে ওভাবেই পথের পাশে বসে থাকতে দেখল।
কি ব্যাপার, এ ভাবে বসে আছ কেন? মুসার প্রশ্ন।
ভ্রূকুটি করল রবিন। কিছু ঘটেছে? তোমার মুখ অমন শুকনো কেন?
পিস্তল নিয়ে ও আমাদের পিছে পিছে আসবে কল্পনাও করতে পারিনি, মাথা নাড়তে লাগল কিশোর। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। রাবুনো, আপনার। কাছে আমাদের সবার মাপ চাওয়া উচিত।
তাই নাকি? কেন?
এখানেও এসে হাজির হয়েছে মিলার। পিস্তল আছে তার কাছে। একটু আগেও আপনার কথায় বিশ্বাস ছিল না আমার। কিন্তু এখন হয়েছে। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের পিছু নিয়েছে সে।
সব খুলে বলল কিশোর।
মহিলার কথায় আসতেই হাসতে শুরু করলেন রাবাত। চমৎকার! অচেনা কাউকে দেখলেই খাতির করতে আসে মেয়েমানুষটা। যাক, কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চিন্ত, মিলারকে আটকে রাখবে সে।
নানার দিকে তাকাল মুসা। নানা, অত হাসার কিছু নেই। ওর কাছে। পিস্তল আছে। পেছন থেকে গুলি মেরে দিলে গেছি। পুলিশকে জানানো দরকার।
আরও যাব পুলিশের কাছে মাথা নাড়লেন রাবাত। মোটেলে আগুন লাগলে যে অফিসারটা এসেছিল, মনে নেই? কি ভঙ্গিটাই না করল? যেন আমি একটা পাগল! নিজের চামড়া নিজেদেরই বাঁচাতে হবে আমাদের, কারও সাহায্য পাব না। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে অহেতুক আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চল, যাই।
বড় করে দম নিলেন তিনি। বনের তাজা বাতাস টানলেন বুক ভরে। এই প্রথম তাকে নিশ্চিন্ত মনে হলো। এতদিনে ভার নামল আমার। মিলার যে পিছু নিয়েছে, এখন আমরা শিওর। তোদের সবার হাবভাব দেখে আমিও কিন্তু ভয় পেতে আরম্ভ করেছিলাম, সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো!
পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কিশোর। দুজনের চোখেই বিস্ময়।
আগে আগে চললেন রাবাত। পেছনে ছেলেরা।
গোধূলি বেলায় র্যাপিড সিটিতে পৌঁছল ওরা। একটা মোটেলে ঘর নিল। কাছের একটা ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে বার্গার খেয়ে এসে বিছানায় শুয়ে মহা আনন্দে নাক ডাকাতে শুরু করলেন রাবাত।
বিছানায় চিত হয়ে ছাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কি করে কাজটা করছে?
কার কথা বলছ? জানতে চাইল মুসা, মিলার, না নানা?
মিলার। যেখানেই যাচ্ছি ঠিক পিছে পিছে লেগে আছে। বের করে নিচ্ছে কোথায় আছি আমরা। কি ভাবে?
জবাব দিতে পারল না কেউ।
এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
পরদিন সকালে সবাই উত্তেজিত হয়ে রইল। রাস্তায় কড়া নজর। সামনে পেছনে দুদিকেই চোখ রেখেছে। সাউথ ডাকোটা ব্যাডল্যান্ড ধরে চলার সময় পথে দর্শনীয় কিছু দেখার জন্যে যেখানেই নামছে, গাড়ির কাছাকাছি থাকছে ওরা, চোখে চোখে রাখার জন্যে। ব্যাডল্যান্ডের নানা রকম পাথরের স্তূপ। মুসার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে, অন্য কোন গ্রহে এসে হাজির হয়েছে, এটা পৃথিবী হতে পারে না! সব কিছুতেই যেন ভূতের ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছে সে। অস্বস্তির আরও একটা বড় কারণ, তার সন্দেহ, ওসব পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে গুলি চালাতে পারে মিলার।
নানা, কি এমন আবিষ্কার করলে, যার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে সে? এই নিয়ে শতবার প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছে মুসা।
খুব জরুরী জিনিস, একই জবাব দিলেন রাবাত। না জানবি যতক্ষণ, ততক্ষণ নিরাপদ। নইলে বলতে আর অসুবিধে কি ছিল।
ছোটবড় নানা আকারের, নানা ধরনের পাথরের চাঙড় আর আলগা পাথরের স্তূপ পেরিয়ে এল গাড়ি। প্রেইরি ডগ নামে এক ধরনের প্রাণীর এলাকায় এসে ঢুকল। মাটিতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ওদের গর্ত। মুখের কাছে শুয়ে, রোদ পোয়াচ্ছে বিশাল ইঁদুরের মত দেখতে প্রাণীগুলো। গাড়িটাকে আসতে দেখলে বিচিত্র ভঙ্গিতে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে সটান সোজা করে দিচ্ছে শরীরটাকে, তীক্ষ্ণ টিইং টিইং ডাক ছেড়ে সতর্ক করছে একে অন্যকে, গাড়ি বেশি কাছে চলে এলে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ছে গর্তের ভেতর। পরক্ষণেই আবার মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে।
.
বেলা বারোটার মধ্যেই ব্যাডল্যান্ড দেখা হয়ে গেল ওদের। হাইওয়েতে ফিরে এসে পুবে রওনা হলো। ভূমি এখন সমতল। সামনে মাইলের পর মাইল রাস্তা লম্বা হয়ে পড়ে আছে। বাঁক নিয়েছে খুবই সামান্য, ওঠানামা নেই। বললেই চলে। সামনেও গাড়ি আছে প্রচুর, পেছনেও আসছে অনেক, কিন্তু লিংকনটাকে দেখা গেল না। দ্রুত চালাচ্ছেন রাবাত। একের পর এক গাড়িকে ওভারটেক করে পিছে ফেলে আসছেন। পাশ কাটানোর সময় দেখছেন ড্রাইভারের চেহারা।
বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে গতি কমিয়ে দিলেন তিনি। পেছনের গাড়িগুলোকে আগে চলে যেতে দিলেন। ড্রাইভারদের চেহারা দেখলেন। ওদের মধ্যে হ্যারিস মিলার নেই।
বুঝলাম না, অবশেষে বললেন তিনি, সামনেও নেই, পেছনেও নেই; আমরাও ওর পাশ কাটিয়ে আগে যাইনি, সে-ও আমাদের পাশ কাটিয়ে পেছনে যায়নি। কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি আশেপাশেই কোথাও আছে। কোথায়?
পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে মুসা। হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। খাইছে! মোটরসাইকেল! নানা, ক্রিসেন্ট সিটির সেই গ্যাঙটা আসছে!
রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকালেন রাবাত। ক্রিসেন্ট সিটি এখান থেকে বহুদূর। কোথায় চলেছে ওরা? বখাটেদের সভা হচ্ছে নাকি কোথাও, যোগ। দিতে চলেছে?
সামরিক শৃঙ্খলায় দুই সারিতে এগিয়ে আসছে ওরা। পিঠ সোজা, দৃষ্টি সামনে স্থির। ক্রিসেন্ট সিটির সেই দলটাই। পরনে কালো চামড়ার পোশাক, বেল্ট আর দস্তানায় কাটা বসানো।
দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা। বুইকটাকে ধরে ফেলছে।
নানা, জোরে চালাও না কেন? উদ্বিগ্ন হয়ে বলল মুসা।
কারও ভয়ে পালাতে যাচ্ছি না আমরা, শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন রাবাত।
এত সাহস কেন? আগের বার দলটাকে কি করে নাকানি-চোবানি খাইয়েছেন রাবাত, মনে করে হাসল রবিন। এবারও তেমন কোন খেল দেখানোর অপেক্ষায় আছেন নাকি?
আমাদের ক্ষতি করতেই আসছে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই, রাবাত বললেন। ক্রিসেন্ট সিটির দলটা হলেও এতদিনে নিশ্চয় আমাদের কথা ভুলে গেছে।
কাছে চলে এল বাইকগুলো। ইঞ্জিনের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বুইকটাকে পাশ কাটানোর জন্যে বায়ে সরল দলপতি।
নানা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা, এই লোকটাই তোমাকে সেদিন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল।
নাক দিয়ে শব্দ করলেন রাবাত। হুঁ! চেহারাটা কি করে রেখেছে। সারামুখে দাড়িগোফ! এগুলো মানুষ না বনমানুষ, তাই কেবল ভাবি!
গাড়ির পাশ কাটানোর সময় ফিরে তাকাল দলপতি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকেও তাকালেন রাবাত। চোখে চোখ আটকে গেল দুজনের। চোখ বড় বড় হয়ে গেল লোকটার। গোল হয়ে গেল মুখ। ধীরে ধীরে বিকৃত হাসিতে রূপ নিল সেটা। রাবাত আর ছেলেদের দেখিয়ে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কিছু বলল।
হয়েছে কাজ, বলে উঠল রবিন, ধরবে এবার আমাদের! সেদিন হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ নেবে আজ!
বুইকটাকে ঘিরে ফেলল সাইকেলগুলো। গতি কমিয়ে ফেলেছে।
আচমকা গতি বাড়িয়ে দিলেন রাবাত। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বুইক। তোয়াক্কাই করল না সামনের সাইকেলগুলো। গতি বেড়ে গেল ওদেরও। আগে আগে চলেছে। যেন ওদেরকে ধরার চ্যালেঞ্জ করেছে গাড়িটাকে।
ওরা জানে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে পারব না ওদেরকে, তিক্তকণ্ঠে বললেন রাবাত, ঠিকই আন্দাজ করছে।
ব্রেক চেপে গতি কমিয়ে ফেললেন তিনি। বাঁয়ে তাকালেন। ধীরে ধীরে পাশে সরতে লাগলেন। জায়গা করে দিল পাশের সাইকেলটা। আরও সরালেন তিনি। আরেকটু জায়গা দিল সাইকেল। তাঁর মতলব বুঝতে পারল না।
হাইওয়ের পাশে মাঠ থেকে ধোয়া উঠছে। শুকনো ঘাস পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বাতাস প্রায় নেই, তাই উড়ে না গিয়ে জমির ওপরই স্থির হয়ে আছে ধোয়া, রাস্তার ওপরেও উঠে এসেছে একটা অংশ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার ভেতরে ঢুকে যাবেন রাবাত। ছেলেদের বললেন, শক্ত হয়ে বোসো!
কি করতে যাচ্ছেন বলার সময় নেই। ধোয়ার মধ্যে ঢুকে গেল গাড়ি। অদৃশ্য হয়ে গেল মোটরসাইকেল আরোহীরা। চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না কেবল কুণ্ডলী পাকানো ধূসরতা ছাড়া। এক মোচড়ে স্টিয়ারিঙের অনেকখানি বায়ে ঘুরিয়ে দিলেন রাবাত।
রাস্তা থেকে প্রায় উড়ে সরে এল গাড়িটা। একটা মুহর্তের জন্যে শূন্যে ঝুলে রইল যেন। তারপর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। রাস্তার ডিভাইডারের মাঝে নেমে এসেছে গাড়ি। মুসার মনে হলো, উল্টে যাবে। চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু অহেতুক ভয় পেয়েছে। গাড়ি ওল্টাল না। নিরাপদেই নেমে দাঁড়িয়ে গেল।
ভারী দম নিলেন রাবাত। পায়ের চাপ বাড়ালেন অ্যাক্সিলারেটরে। বনবন করে ঘুরতে লাগল চাকা। কয়েকবার পিছলে গিয়ে অবশেষে মাটি কামড়ে ধরল। ডিভাইডারের সমান্তরালে খাদের পাড় ধরে ছুটতে শুরু করল নাক বরাবর। ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল।
আবার স্টিয়ারিং অনেকখানি ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। কঁকুনি খেতে খেতে রাস্তায় উঠে এল গাড়ি। আগের রাস্তা থেকে সরে চলে এসেছে আরেকটা রাস্তায়।
চিৎকার করে বলল মুসা, নানা, তুমি একটা জিনিয়াস!
এখনই চেঁচাবি না, সতর্ক করলেন রাবাত, আমরা কি করেছি বুঝতে দেরি হবে না ওদের। চলে আসবে তখন।
সামনে একটা এগজিট র্যাম্প দেখা গেল। সেটার দিকে ছুটলেন তিনি। সোজা নিচে নেমে এসে ছুটলেন আধ মাইল দূরের একটা গাছের জটলার দিকে। জটলার কাছে পৌঁছে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন ভেতরে। রাস্তা থেকে আর দেখা যাবে না এটাকে।
আমাদের দেখবে না ওরা, বললেন তিনি। ওরা ভাববে ধোয়া পার হয়ে সোজা সামনে চলে গেছি আমরা, সেদিকেই নজর দেবে।
ভারী হয়ে এসেছে তার নিঃশ্বাস। তবে মৃদু হাসি ফুটেছে ঠোঁটের কোণে। হাইওয়ের দিকে চোখ।
মিনিটখানেক পরেই দেখা গেল ওদের। সারি দিয়ে চলেছে পশ্চিমে। নজর সামনের দিকে। বুইকটাকে খুঁজছে।
খুব খারাপ লোক, রাবাত বললেন। আরও জ্বালাবে মনে হচ্ছে!
কিন্তু আমাদের পেছনে লেগেছে কেন? রবিনের প্রশ্ন।
বর্ণবাদী হতে পারে, অনুমানে বলল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর, আমার তা মনে হয় না। ওদের দলে কালো। লোকও আছে। শিওর, মিলার লাগিয়েছে। আমাদের কাবু করতে বলেছে ওদের। তারপর সে এসে ফর্মুলাটা কেড়ে নেবে। এর জন্যে নিশ্চয় টাকাও দিয়েছে ওদেরকে।
দূরে হারিয়ে গেল দলটা।
হঠাৎ হাত তুলল কিশোর, ওই, দেখুন! বললাম না, সব শয়তানি মিলারের!
ধূসর একটা লিংকন গাড়ি। কিশোর বলার মুহূর্ত পরই গতি কমিয়ে ফেলল।
বাহ, এসে গেছে, রাবাত বললেন।
রবিন বলল, আর কোন সন্দেহ নেই, গ্যাঙকে টাকা খাইয়েছে মিলার।
তাকে সামনে চলে যেতে দেয়া উচিত, মুসা বলল। ও এগিয়ে গেলে আমরা এগোব। পেছনে থেকে যাব তখন।
কিন্তু তাকে সে-সুযোগ দিল না লিংকন। গেল না। পথের ধারে কাঁচা জায়গায় নেমে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। মুসারা যেখানে রয়েছে তার থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
.
১২.
পার্কিং লাইট জ্বেলে দিয়ে অপেক্ষা করছে লিংকন।
শয়তানটা জানে আমরা এখানে আছি, রাবাত বললেন। কি করে জানল?
একটা পেট্রল কারকে আসতে দেখা গেল। লিংকনের কাছে গিয়ে থামল গাড়িটা। ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এল। দরজা খুলল মিলার। অফিসারের সঙ্গে কথা বলল। দুজনে এগিয়ে গেল লিংকনের সামনের দিকে। হুড তুলে ইঞ্জিন দেখতে লাগল।
ওসমস্ত অভিনয়, কিশোর বলল। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার ভান করছে। মিলার। গাড়ি থেকে বেরোল সে। কি করে আমাদের পেছনে লেগে রয়েছে, বোঝা দরকার।
কি করে? মুসার প্রশ্ন।
কোন ধরনের যন্ত্র রয়েছে আমাদের গাড়িতে, যেটা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। সেই সঙ্কেত ধরে জেনে যাচ্ছে সে, আমরা কোথায় আছি। সামনে না এসে আড়ালে থেকেও আমাদের অনুসরণ করতে পারার এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।
কিশোরের কথা বুঝে ফেললেন রাবাত। তারমানে বলতে চাইছ কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্র লাগিয়ে দিয়েছে গাড়িতে!.
সোজা গাড়ির ট্রাংকের দিকে রওনা দিলেন তিনি। সুটকেসগুলো বের করে এনে মাটিতে ফেললেন। হ্যাঁচকা টানে সীটগুলো সরিয়ে নিয়ে এলেন সামনের দিকে।
সামনের সীটের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। তারপর হাত দিল ড্যাশবোর্ডের নিচে।
জিনিসটা খুঁজে বের করল অবশেষে রবিন। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল গাড়ির নিচে। সাবানের সমান একটা প্লাস্টিকের বাক্স বের করে আনল। পেট্রোল ট্যাংকে টেপ দিয়ে আটকানো ছিল।
ওর একটা দাঁতও রাখব না আমি! ভীষণ রাগে একটা পাথর তুলে নিলেন রাবাত। আমার ওপর গুপ্তচরগিরি!
যা দাঁড়ান, দাঁড়ান! বাধা দিল কিশোর। একটা গাছের ডালে রেখে দিল। যন্ত্রটা। হেসে বলল, থাক এটা এখানে, সঙ্কেত পাঠাক মিলারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, থাকুক ব্যাটা ওখানে বসে।
সুটকেসগুলো আবার আগের জায়গায় তুলে রাখল তিন গোয়েন্দা। গাড়ি স্টার্ট দিলেন রাবাত। রাস্তায় উঠলেন না। মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে চললেন উত্তরে। ক্রমে সরে যেতে থাকলেন হাইওয়ে থেকে
ফিরে তাকাল রবিন। এখনও অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে মিলার মাথা চুলকাচ্ছে অফিসার। মনে হচ্ছে, কোন কিছু অবাক করেছে তাকে।
কিছুদূর এগিয়ে একটা রাস্তা দেখা গেল। সেটাতে উঠে পড়লেন রাবাত। কয়েকটা গায়ের ভেতর দিয়ে গেছে পথটা। দুই ধারে মাঝে মাঝেই পড়ছে বিস্তৃত পশুচারণভূমি। গরু-ঘোড়া চরছে। দক্ষিণ ডাকোটার পিয়েরিতে পৌঁছে মিসৌরি নদী পার হয়ে এল ওরা। তারপর কয়েকটা ছোট ছোট শহর। পশুচারণভূমি অনেক আছে এখানেও।
মিনেসোটা সীমান্তের মাইল পঞ্চাশেক দূরে একটা ছোট সরাইয়ে রাত কাটাতে উঠল ওরা। গ্যারেজ আছে। তাতে তালা দেয়ার ব্যবস্থাও আছে। গাড়ি ঢুকিয়ে রাখলেন রাবাত। সরাইয়ের মালিক এক হাসিখুশি মহিলা। নাম মিসেস আরগন। প্রচুর কথা বলে। সারাক্ষণ বকবক করে গেল। একাই কথা বলল। তার প্রশ্নের জবাব দিল কিনা কেউ, সেটাও লক্ষ করল না।
রাতে চমৎকার রান্না করে খাওয়াল মহিলা। সকালে দিল আঞ্চলিক নাস্তা।
আবার বেরিয়ে পড়ল ওরা। বাতাস কোমল, ভেজা ভেজা। গালে এসে লাগছে।
মিনেসোটা পেরোনোর সময় হাইওয়ে থেকে দূরে রইল। তবে রোচেস্টারে এসে আবার হাইওয়েতে উঠল। উইসকনসিনের লা ক্রসের দিকে এগোল।
রাবাতের মেজাজ ভাল বললেন, মিলার আসুক আর না-ই আসুক, লা ক্রসে থামব আমরা। এখানে বড় হয়েছিল মুসার নানী। এত সুন্দর শহর খুব কমই আছে।
তা থাকা যায়। মিলারের চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিলেই পারি, মুসা বলল। তার যন্ত্রটা খুলে ফেলে দিয়েছি। আর পিছু নিতে পারবে না সে।
ওই শেয়ালটাকে বিশ্বাস নেই। আরেকটা বুদ্ধি বের করে ফেলতে পারবে। পিছু নেয়ার জন্যে তৈরি হয়েই বেরিয়েছে সে। আমার বাড়িতেও নিশ্চয় ওধরনের যন্ত্র অনেক লাগিয়েছে। তাতে করে জেনে গেছে, আমি কি করছি।
আগে হলে এ সব কথায় গুরুত্ব দিত না কিশোর। কিন্তু এখন বিশ্বাস করল। মিলার ওদের পিছু নিয়েছে রাবাতের আবিষ্কৃত জিনিসটা ছিনিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই।
জিনিসটা কি? অনুমানও করতে পারল না কিশোর। কারণ করার মত কোন সূত্রই নেই তার হাতে। যন্ত্রটা খোঁজার সময় আবিষ্কারটাও পাওয়ার আশায় ছিল সে। নজর রেখেছিল। কিছুই চোখে পড়েনি। তবে কি রাবাতের পকেটে আছে? নাকি মাথায়? মাথায় থাকলে মিলার ওটা চুরি করবে কি করে?
মনটিরেতে ওই লোকটার সঙ্গে কি জন্যে দেখা করেছিল মিলার? ফিশারম্যান ওআর্ষে সেই যে লোকটা, দামী পোশাক ছিল যার পরনে, গণ্ডগোলের সম্ভাবনা দেখেই যে কেটে পড়েছিল, উধাও হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তে। রাবাতের প্রতি তার তেমন নজর ছিল বলে মনে হয়নি, কোন আকর্ষণ ছিল না। মিলারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কেন?
ওই যে! রাবাতের আচমকা চিল্কারে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল কিশোর।
সামনে একটা নদী। ওপরে ব্রিজ। রাবাত জানালেন, নদীটা মিসিসিপি। নদীর মাঝখানে অনেক চড়া, দ্বীপের মত হয়ে আছে। ঘন গাছে ছাওয়া। নদীর অন্য পাড়ে একটা শহর।
ওইটাই লা ক্রস, বললেন তিনি। আজ রাতে ওখানে থাকব।
বিকেলে সেদিন নদীর পাড়ের একটা রেস্টুরেন্টে খাবার খেলো ওরা। বেরিয়ে এল আশপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্যে। কাদার মধ্যে খোঁচাখুঁচি করছে মাড সোয়ালো পাখি। একটা দ্বীপের ধারে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে একটা বড় বক।
মার্ক টোয়েনের সময়ও নিশ্চয় এমনই ছিল মিসিসিপি, রাবাত বললেন। মনে আছে, হাকলবেরি ফিনের সঙ্গে একটা দ্বীপে গিয়ে লুকিয়েছিল টম সয়্যার? নিশ্চয় ওরকমই কোন দ্বীপ ছিল সেটা।
একটা কাজ করলে তো পারি, রবিন বলল, একটা জাহাজে চড়ে বসি। মোটেলের ডেস্কে লেখা দেখলাম এক ঘণ্টা পর পরই লা ক্রস থেকে বোট ছাড়ে, ভাটির দিকে যায়।
ঠিক! তুড়ি বাজালেন রাবাত। আমরাও যাব! তবে রাতে নয়, কাল সকালে।
পরদিন সকাল পৌনে এগারোটায় লা ক্রস কুইন নামে একটা জাহাজে চড়ে বসল ওরা। ওটা ডিজেল ইঞ্জিনে চলবে শুনে হতাশ হলেন রাবাত। তিনি আশা করেছিলেন, পুরানো ধরনের বাষ্পীয় ইঞ্জিনে দুই পাশে বড় বড় গরুর গাড়ির চাকার মত হুইল দিয়ে চালানো হবে। মিসিসিপির পুরানো ঐতিহ্য। যাত্রাটাই না বাতিল হয়, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি মুসা বোঝানোর চেষ্টা করল, ডিজেল ইঞ্জিন অনেক বেশি নিরাপদ। আগের বাষ্পীয় ইঞ্জিনগুলো তো দুর্ঘটনা ঘটাত। বিস্ফোরিত হয়ে গিয়ে কত বোট ডুবিয়ে দিয়েছে নদীতে।
খুশি করা গেল না রাবাতকে। তবে জাহাজ থেকে নেমে গেলেন না। ছেলেদের নিয়ে ওপরের ডেকে রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়ালেন। বন্দরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। প্রচুর লোকজন নানা কাজে ব্যস্ত। একটু দূরের একটা পার্কে খেলা করছে বাচ্চারা। খুব উপভোগ করছিলেন তিনি। হঠাৎ একটা দৃশ্য রাগিয়ে দিল তাকে।
হাত তুলে চিৎকার করে উঠলেন, দেখো! দেখো, ওই দ্বিতীয় লোকটা!
তার নির্দেশিত দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। বন্দরে জেটির কাছে রেখে আসা বুইকটা দেখা যাচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। কৌতূহলী হয়ে গাড়িটা দেখছে।
চোখ বড় বড় করে ফেলল কিশোর। সেই লোকটা, মনটিরেতে যার সঙ্গে দেখা করেছিল মিলার।
ওই ব্যাটাই, তাই না? রাবাত বললেন। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!
মেইন ডেকে নামার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলেন তিনি। কিন্তু লোকজন। ভিড় করে উঠে আসছে। ইঞ্জিনও চালু হয়ে গেছে। কাঁপতে শুরু করেছে লা ক্রস কুইন। রাবাত মেইন ডেকে নেমে আসার আগেই চলতে শুরু করল জাহাজ। দূরত্ব বাড়ছে জেটির সঙ্গে।
.
১৩.
জাহাজটার আবার জেটিতে ফিরতে এক ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। সবার আগে নামলেন রাবাত আর তিন গোয়েন্দা। দৌড় দিলেন বুইকের দিকে।
গাড়ির কোন ক্ষতি করা হয়নি। তালা ভেঙে দরজা খোলারও চিহ্ন নেই। হামাগুড়ি দিয়ে নিচে ঢুকে গেল মুসা, আবার যন্ত্রটন্ত্র কিছু লাগিয়ে দিয়েছে কিনা। দেখার জন্যে। ট্রাংক খুলে সুটকেসগুলো বের করে আনল রবিন আর কিশোর। ওগুলোর ভেতরও দেখল। রাবাত দেখলেন সীট আর ড্যাশবোর্ডের নিচে। হুড তুলে ইঞ্জিনের চারপাশের খালি জায়গায়ও দেখলেন।
নেই! ঘোষণা করলেন তিনি। তাহলে ওই ইবলিসটা এসেছিল কেন? আবার আমাদের খুঁজে বের করল কি ভাবে? যন্ত্রটা তো খুলে ফেলে দিয়েছি!
হয়তো অপেক্ষা করে করে, রবিন বলল।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল অন্যেরা।
আমার কথাই বলি। ধরা যাক, যাকে ধরতে চাই তার গন্তব্য জানা আছে আমার। পথের মাঝে তাকে হারিয়ে ফেললাম। বুঝলাম অন্য কোন ঘুরপথে পালিয়েছে। তখন তাকে ধরতে হলে কি করব? তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে এমন কোথাও বসে থাকব, যেখান দিয়ে ট্যুরিস্ট যাতায়াত করে। টুরিস্ট স্পট। অপেক্ষা করতে থাকব। নজর রাখব। লা ক্রসে এসে অবশ্যই আমি জাহাজঘাটায় খোঁজ নেব, আমার লোকটা জাহাজে উঠে বেড়াতে যাচ্ছে কিনা দেখার জন্যে। কারণ বেশির ভাগ ট্যুরিস্টই এখানে এসে এই কাজ করে। এ মাথা ঝাঁকালেন রাবাত। ঠিক। এটাই ঘটেছে। চালাক ছেলে তুমি, রবিন। তোমরা তিনজনই খুব চালাক।
এখান থেকে কেটে পড়া উচিত আমাদের, রবিন বলল। এখন থেকে টুরিস্টরা যে সব জায়গায় যায়, সে-সব এড়িয়ে চলব আমরা। মেইন রোডে যাব না পারতপক্ষে। তাহলেই আর খুঁজে পাবে না আমাদের।
হ্যাঁ, তাই করতে হবে। তাড়াতাড়ি কেটে পড়া উচিত এখন। একবার নিউ ইয়র্কে পৌঁছে গেলে আর কিছু করতে পারবে না মিলার। ওর সুযোগ শেষ হয়ে যাবে।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই লা ক্রস থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বেশ কিছু ছোট ছোট রাস্তা দক্ষিণ-পশ্চিমে চলে গেছে। সেগুলো ধরে এগোল। রাত কাটাল ইলিনয় রাজ্যের রকফোর্ড শহরের বাইরে একটা সরাইখানায়।
পরদিন সকালে শিকাগো শহরে পৌঁছল ওরা। ছেলেদের লেক শোর ড্রাইভ দেখাতে নিয়ে গেলেন রাবাত। লেক মিশিগানের দিকে মুখ করা প্রচুর। দামী দামী সৌখিন বাড়ি আর বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং দেখা গেল।
বাড়ি ফিরে বলতে পারবে এখন, মিশিগান হ্রদ দেখতে গিয়েছিলাম, হেসে বললেন রাবাত।
শহরের সবচেয়ে লম্বা একটা বাড়ির ওপরের তলার রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া সারল ওরা। তারপর পাড়ি জমাল ইনডিয়ানার ভেতর দিয়ে।
রাত কাটাতে থামল স্টারজিসে। রবিনের ক্যামেরার ফিল্ম ফুরিয়ে গেছে। শহরের প্রধান সড়কের ধারে ক্যামেরার দোকান আছে, তবে বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা। সুপারমার্কেটে গেল রবিন।
দোকানে ঢুকে কোণের দিকে একটা কাউন্টার দেখতে পেল। যে লোকটা তার কাছে ফিল্ম বিক্রি করল, সে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার। টাকা। দিয়ে দরজার দিকে এগোল রবিন। হঠাৎ পথরোধ করা হলো তার।
সেই সুবেশী লোকটা, মনটিরেতে মিলারের সঙ্গে দেখা করেছিল যে, লা ক্রস বন্দরে ওদের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল।
চোখে চোখে তাকিয়ে রইল রবিন। কথা বেরোল না। নড়তে পারল না।
তোমার সঙ্গে নেই ওটা, ভোতা, খসখসে গলায় বলল লোকটা। তবে। অসুবিধে নেই। আদায় করে নিতে পারব।
রবিনের হাত চেপে ধরল সে। এসো। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করল রবিন। পারল না। কব্জিতে ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে চেপে বসেছে লোকটার আঙুল। স্বয়ংক্রিয় দরজার দিকে ওকে টেনে নিয়ে চলল লোকটা। দরজার কাছাকাছি আসতেই হুশ করে খুলে গেল পাল্লা। দরজার ওপাশে পার্কিং লট, তার ওপাশে…
ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে রবিনের মাথায়। লোকটার সঙ্গে নিশ্চয় মিলারও এসেছে। লুকিয়ে আছে কোথাও। রবিনকে আটকে রেখে দুজনে মিলে মুক্তিপণ হিসেবে রাবাতের কাছ থেকে তার আবিষ্কারটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। যদি দিতে অস্বীকার করেন রাবাত? ওকে কি করবে ওরা?
চিৎকার করে উঠল রবিন। লোকটার পায়ে গোড়ালি দিয়ে লাথি মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। লাগাতে পারল না। ঝট করে পা সরিয়ে নিয়েছে লোকটা। তারমানে জুডো-কারাত জানা আছে তারও। সহজ লোক নয়।
দরজার কাছে একটা ওয়াটার কুলার দেখতে পেয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রবিন। পানি বের করার হাতলটা চেপে ধরল। তাকে সরানোর জন্যে টানাটানি শুরু করল লোকটা। পারল না। টান লেগে পানি বেরিয়ে আসতে লাগল। পানি পড়তে লাগল রবিনের মুখে, গলায়; শার্ট ভিজে গেল। কিন্তু বোতাম ছাড়ল না। চিৎকারও বন্ধ করল না।
দেখো, ধমক দিয়ে বলল লোকটা, বন্ধ করো এ সব! জোরে বলল না সে, কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখল। যেন অবাধ্য ছেলেকে শাসন করছে বাবা।
চেঁচামেচি শুনে সেখানে এসে হাজির হলো অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার। কি হয়েছে?
না, কিছু না, শান্তকণ্ঠে বলল লোকটা। রবিনের কব্জি ছাড়েনি। তার হাতল ধরা হাতটাও ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। ম্যানেজারকে বলল, রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ছেলেটা…
মিথ্যে কথা! আরও জোরে চিৎকার করে উঠল রবিন। এই লোক আমার বাবা নয়! জীবনে চোখেও দেখিনি একে! ও একটা ডাকাত! হোটেলে আগুন লাগিয়েছে! কিডন্যাপার! জলদি পুলিশ ডাকুন!
ছোটখাট ভিড় জমে গেল। চার-পাঁচজন দোকান-কর্মচারী ঘোট ঠেলাগাড়িতে করে মাল নিয়ে চলেছিল, দাঁড়িয়ে গেল। ওদের মধ্যে একজন তরুণ ক্লার্কও রয়েছে, লাল জ্যাকেট পরা।
হ্যারি, ওকে বলল ম্যানেজার, যাও তো, শেরিফের অফিসে ফোন। করো। এখানে কি হয়েছে বলবে। ওরা এসে যা করার করুক।
আশ্চর্য! ধমকে উঠল মিলারের সঙ্গী। এর মধ্যে আবার পুলিশ ডাকাডাকি কেন? গলার স্বর খাদে নামিয়ে ম্যানেজারকে বলল, আসল কথা। কি জানেন? নেশা ধরেছে ও। বাড়ি থেকে পালিয়েছে। শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই ছেলেটাকে…
ও আমার বাবা নয়! জোরে চিৎকার করে উঠল রবিন। আমার নাম পর্যন্ত জানে না, জিজ্ঞেস করে দেখুন?
লোকটার দিকে তাকাল ম্যানেজার।
জিজ্ঞেস করুন ওকে! আবার বলল রবিন। আমার নাম বলতে বলুন। বলতে পারবে না।
মসৃণ হাসি হাসল লোকটা। নিজের ছেলের নাম আবার বলতে পারে না কেউ? বনেট। ওর নাম বনেট।
কুলারের হাতল ছেড়ে দিল রবিন। পকেট থেকে বের করে আনল মানিব্যাগ। তার ভেতর থেকে স্টুডেন্ট আইডেনটিটি কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিল ম্যানেজারের দিকে, দেখুন, আমার নাম আসলে কি? ছবিও আছে। চিনতে অসুবিধে হবে না আপনার।
কার্ডটা হাতে নিল ম্যানেজার।
মিলারের সঙ্গী ভাবেনি রবিনের সঙ্গে কার্ড আছে। আর একটা মুহূর্ত দাঁড়াল না সে। দোকান থেকে বেরিয়ে পালাল।
.
১৪.
সুপারমার্কেটের ডেইরি সেকশনের পেছনে সেঁতসেঁতে ছোট ঘরটায় বসে ডেপুটি শেরিফের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে রবিন। কিন্তু বোঝানো সহজ হচ্ছে না।
কেন তোমাদের পেছনে লোক লাগবে? জিজ্ঞেস করল অফিসার।
মিস্টার রাবাত বলেছেন, তার আবিষ্কৃত একটা জিনিসের ফর্মুলা নিয়ে। চলেছেন। সেটাই ছিনিয়ে নিতে চাইছে লোকটা।
রাবাত কে জানতে চাইল অফিসার। তার বন্ধুর নানা, জানাল রবিন। কি জিনিস আবিষ্কার করেছেন রাবাত, জানে না সে। তাদেরকে বলেননি তিনি। নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাবেন। বিশেষ কারও কাছে বিক্রি করবেন ওটা। সেই বিশেষ লোকটি কে, তা-ও জানে না সে। শেষে বলল, মিস্টার রাবাত বলেন, আমাদের জন্যে জানাটা নাকি বিপজ্জনক। না জানলেই ভাল।
কিন্তু বিপদটা তো এড়াতে পারলে না, অফিসার বলল।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। অফিসার তাকে মোটেলে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব দিলে খুশি হয়েই রাজি হলো।
গাড়িতে করে তাকে পৌঁছে দিল অফিসার।
কি ঘটেছে শুনে রেগে আগুন হলেন রাবাত। কি আবিষ্কার করেছেন, অফিসারকে জানাতে রাজি নন মোটেও। রকি বীচ থেকে যে তাদের পিছু নেয়া হয়েছে, সব খুলে বললেন। কোন কথা বাদ দিলেন না। মোটেলে আগুন লাগার কথাও নয়। পেট্রোল ট্যাংকের নিচে যন্ত্র আটকে দেয়ার কথা বললেন। এমনকি লা ক্রসে লোকটা যে বুইকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল সে-কথাও।
চুপচাপ শুনল অফিসার। শৈষ দিকে অবিশ্বাসের ভঙ্গি দেখা দিল তার চোখেমুখে। বলল, তাই নাকি? আর কিছু ঘটেছে?
কেন, যথেষ্ট হয়নি? আরও কিছু ঘটুক, চান নাকি? রেগে উঠলেন রাবাত।
না না, তা বলিনি।
মাউন্ট সেইন্ট হেলেনে দেখা গাড়িটার নম্বর অফিসারকে জানাল কিশোর। রিপোর্ট লিখে নিল অফিসার। তার নিচে সই করলেন রাবাত আর রবিন।
বেরিয়ে গেল অফিসার। চেহারা দেখেই বোঝা গেল, ওদের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি সে।
ওই দুই ব্যাটাকে ধরতে পারবে না পুলিশ, রাবাত বললেন। এতক্ষণে শহর ছেড়ে পালিয়েছে ওরা।
তার কথার প্রতিবাদ করল না কেউ।
রাতে বিছানায় শুয়ে কিশোর বলল, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না।
মুসা কেবল গোঙাল। ঘুমে ভারী হয়ে এসেছে চোখ।
রবিন জিজ্ঞেস করল, কি?
তোমাকে কিডন্যাপ করতে চাইল কেন?
রাবুনানার আবিষ্কার আদায় করার জন্যে।
সেটা তো বুঝেছি। আমি বলতে চাইছি, তোমাকে কেন? আমাকে আর মুসাকে নয় কেন?
কি জানি। হয়তো তক্কে তক্কে ছিল, যাকে একা পেয়েছে তাকেই ধরেছে। আমাদের আগে তোমাদের পেলে তোমাদেরও ধরত।
তন্দ্রা টুটে গেছে মুসার, শান্তশিষ্ট দেখেছে তো, হয়তো, ভেবেছে ওকে ধরাটাই নিরাপদ।
হাসল কিশোর। শান্ত যে কি পরিমাণ, সেটা তো বুঝিয়ে দিয়েছে। চিন্তায় ডুবে গেল সে। আনমনে বিড়বিড় করতে লাগল, লোকটা বলেছে–তোমাদের সঙ্গে জিনিসটা নেই। আমরা ধারণা করছি, জিনিসটা রাবুনোর আবিষ্কার। কিন্তু অন্য কিছুও হতে পারে।
কিশোর, রবিন বলল, ব্যাপারটা নিয়ে কালও আলোচনা করা যাবে। এখন আর পারছি না। আমার ঘুম পাচ্ছে।
আমারও, মুসা বলল। আমি ভেবেছিলাম, ছুটি কাটাতে বেরিয়েছি। কিন্তু ছুটি যে এত টেনশনের, কল্পনাও করিনি।
এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। বলল, ঠিক আছে, তোমরা ঘুমাও।
ঘুমিয়ে পড়ল রবিন আর মুসা। চুপচাপ ছাতের দিকে তাকিয়ে রইল। কিশোর। কোন শব্দ নেই। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে কেবল রাবুনানার নাসিকা গর্জনের শব্দ।
.
১৫.
পরদিন ভোর হওয়ার আগেই ওদেরকে ডেকে তুলে বেরিয়ে পড়লেন রাবাত। ভ্রমণটা আর ভ্রমণ নেই এখন ওদের জন্যে, তাড়া খেয়ে পালানোর অবস্থা হয়েছে। গায়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে চলা বাদ দিয়েছে, কারণ, লাভ নেই। যে পথে যত সতর্ক থেকেই ওরা চলুক না কেন, শত্রুরা ঠিক বুঝে ফেলছে। ওদের পিছু নিয়ে চলে আসছে। সুতরাং হাইওয়ে ধরে যাওয়াই ভাল। তাতে ঝামেলা কম হবে, তাড়াতাড়ি চলা যাবে, সময়ও বাঁচবে। আরও একটা ব্যাপার, হাইওয়েতে যানবাহনের ভিড় থাকায় দিনে-দুপুরে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করবে শত্রুরা।
ইনডিয়ানার পর ওহাইওর ভেতর দিয়ে ছুটতে লাগল ওরা। একটানা চালিয়ে সন্ধ্যাবেলা কাহিল হয়ে পড়লেন রাবাত। মেজাজ গেল বিগড়ে। এ সবের জন্যে দায়ী করতে লাগলেন মিলারকে। তাকে এখন পেলে কি করবেন, উত্মার সঙ্গে সে-কথা বলতে লাগলেন। পেনসিলভানিয়ায় এসে আর চালানোর সাধ্য হলো না। হাইওয়ে থেকে দুশো গজ দূরে একটা মোটেলে রাত কাটানোর জন্যে থামলেন।
তোমরা গিয়ে সাঁতার কাটো, টেলিভিশন দেখো, যা ইচ্ছে করো, বললেন তিনি। আমি পেট্রোল আনতে যাচ্ছি। চলে আসব এখনই।
আমরাও যাব তোমার সঙ্গে, মুসা বলল।
কি দরকার? বডিগার্ড লাগবে না আমার! ধমকে উঠলেন রাবাত। মেজাজ খারাপ হয়েছে ভালমতই। রাস্তার ওপরই একটা পেট্রোল স্টেশন দেখে এসেছি। নিয়ে আসি। যাব আর আসব।
আর কিছু বলার সাহস পেল না মুসা।
ঘরে এসে টেলিভিশন চালু করে দিল ওরা। পর্দায় চোখ আছে, মন নেই। চিন্তিত। রাবুনোর ফেরার অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন হয়ে রইল।
বিশ মিনিট গেল। আধঘণ্টা।
মুসা বলল, এত দেরি! নিশ্চয় কিছু ঘটেছে।
ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল কিশোর। জানালার কাছে উঠে গেল রবিন। বাইরে তাকিয়ে রইল। ছোট একটা শহরের প্রান্তে ঠাঁই নিয়েছে ওরা। গাছপালার ভেতর দিয়ে শহরের আলো দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ করেই হয়তো কোন জিনিস কেনার কথা মনে পড়েছে, বলল সে। শহরে চলে যাননি তো?
কিংবা এখানে পেট্রোলের দাম বেশি দেখে অন্য কোন পাম্পে গেছেন, বলল কিশোর। কিন্তু কেন যেন কথাটা বিশ্বাস হতে চাইল না নিজেরই।
আরও পনেরো মিনিট পেরোল। আর অপেক্ষা করতে পারল না ওরা। জ্যাকেটগুলো আবার গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। রাস্তায় নামল।
মোটেলে সবচেয়ে কাছের পাম্পটায় পাওয়া গেল না তাঁকে। কর্মচারী জানাল, ওরকম কাউকে দেখেনি। তবে, বলল সে, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসা একটা গাড়ি দেখেছি। এত দূর থেকে গাড়িতে করে সাধারণত আসে না। কেউ কালেভদ্রে হয়তো দুএকটা চোখে পড়ে।
পরের স্টেশনটায় চলল গোয়েন্দারা। ঘন হয়ে আসছে তখন অন্ধকার। দ্বিতীয়টাতেও পাওয়া গেল না রাবাতকে। তৃতীয় স্টেশনটা রয়েছে পথের মোড়ে। সেখানকার কর্মচারী ছেলেদের বয়েসী। সে জানাল, বুইক গাড়িওয়ালা একজন বুড়ো মানুষকে দেখেছে।
আধঘণ্টা আগে, ছেলেটা বলল, কিংবা আরও কিছুটা বেশি হবে, বুড়ো লোকটা তেল নিতে এল। ট্যাংক ভরে তেল নিল। তেল আর পানি চেক করে দিলাম। টায়ারের হাওয়াও।
এখান থেকে বেরিয়ে কোনদিকে গেছে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই, মোটেলের দিকে দেখাল ছেলেটা। তারপর কোথায় গেল, খেয়াল করিনি। দুটো মোটর সাইকেল ঢুকল তখন। ওদের তেল দিতে গেলাম।
মোটর সাইকেল?
ভুরু কুঁচকে ফেলল কিশোর। ছেলেটা মুসার প্রশ্নের জবাব দেয়ার। আগেই জিজ্ঞেস করল, কয়টা বললে?
দুটো। কেন?
নাঃ ইয়ে..অনেক পশ্চিমে একটা মোটর সাইকেল গ্যাঙের সঙ্গে গণ্ডগোল বেধেছিল আমাদের। ওরাই কিনা বুঝতে চাইছি। ওরা কোন দিকে গেছে, দেখেছ?
ওদিকেই, বুড়ো লোকটা যেদিকে গেল। রাতে এখানে কোথায় ক্যাম্প করলে ভাল হয় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল ওরা। পার্সনস উডের পিকনিক গ্রাউন্ডের কথা বলে দিলাম। শোনো, একটা কথা বলি, গোয়েন্দাদের উদ্বেগ দেখে সন্দেহ হয়েছে ছেলেটার, তোমাদের কি মনে হচ্ছে লোকগুলো বুড়ো মানুষটার ক্ষতি করবে? বলো তো পুলিশে ফোন করতে পারি।
দ্বিধা করতে লাগল গোয়েন্দারা। নানার বদমেজাজের কথা ভাবল মুসা। অতি সামান্য কারণেও রেগে ওঠেন অনেক সময়। আজ বিকেলে মেজাজ খুবই খারাপ। ছেলেরা তার জন্যে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করছে ভাবলেই ফেটে পড়বেন।
থ্যাংকস, বলল মুসা, লাগবে না। সাহায্যের দরকার হলে তোমাকে জানাব।
পিকনিক গ্রাউন্ডে কি করে যেতে হয়? জিজ্ঞেস করল রবিন।
ছেলেটা জানাল, ওখান থেকে বড়জোর আধ মাইল দূরে। অফিস থেকে একটা শূন্য ওঅর্ক অর্ডারের ফর্ম নিয়ে তার উল্টো দিকের সাদা অংশে নকশা একে দেখাল কি করে যেতে হবে ওখানে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল। গোয়েন্দারা। ফিরে এল হাইওয়েতে। নকশাটা রবিনের হাতে।
মোটেলের দিকে এগোনোর সময় দেখল মেইন রোড থেকে একটা রাস্তা নেমে গেছে বায়ে। নকশায় এই রাস্তাটাই একে দিয়েছে পাম্পের ছেলেটা। সেটা ধরে এগোল ওরা। সামনে বাড়িঘর কিংবা দোকান চোখে পড়ল না। খানিক পর পর ল্যাম্পপোস্ট আছে রাস্তায়। কিছুদূর গিয়ে আর তা-ও নেই। অন্ধকার। তবে চাঁদ উঠছে। তার ফ্যাকাসে আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
এগোতে থাকল ওরা। খানিক পর সামনে আলো দেখা গেল। পথের বায়ে খোলা জায়গায় ক্যাম্প করেছে কেউ। আগুনের কাঁপা কাঁপা আলোয় দুটো লোককে দেখতে পেল ওরা। সতর্ক হয়ে পা টিপে টিপে এগোল। আরেকটু এগোতে বুইকটাও চোখে পড়ল। রাস্তা থেকে নামিয়ে আগুন থেকে সামান্য দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গাড়িটার কাছ থেকে কিছু দূরে, আগুন থেকে কাছে একটা কাঠের টেবিলের সামনে পিকনিক বেঞ্চে বসে আছেন রাবাত। আগুনের কাছে নড়াচড়া করা লোকগুলোর দিকে চোখ।
তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে পাথরের মত কঠিন যে হয়ে আছে, আন্দাজেই বুঝতে পারছে মুসা। ওই মোটর সাইকেল গ্যাঙেরই লোক! ফিসফিস করে বলল সে। নানাকে ধরে নিয়ে এসেছে।
চুপ থাকতে ইশারা করল তাকে কিশোর।
রাস্তা থেকে খোয়া বিছানো একটা পথ বেরিয়ে চলে গেছে পিকনিক গ্রাউন্ডের ভেতর দিয়ে। ওটা ধরে এগোল তিন গোয়েন্দা। লোকগুলোর দিকে চোখ থাকায় মোটর সাইকেল দুটো দেখতে পায়নি রবিন, আরেকটু হলে ওগুলোর ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সাইকেল দুটোর আড়ালে বসে পড়ল ওরা।
আগুনের কাছে কথা বলছে লোকগুলো। এখান থেকে স্পষ্ট কানে আসছে।
এখনও তোমার কিছুই করিনি আমরা, বুড়ো বাদুড়, হুমকির সুরে বলল একজন, এমন জায়গায় ধরে নিয়ে যাব, এমন অবস্থা করে ছাড়ব, কেঁদে পার পাবে না তখন।
একটা ক্যান থেকে চো চো করে কিছু গিলল লোকটা কোন ধরনের। ড্রিংকস হবে। শেষ করে ক্যানটা আঙুলে চেপে দুমড়াল, কাঁধের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল পেছনে। মাটিতে রাখা একটা কাগজের থলে হাতড়ে আরেকটা ক্যান বের করল। আগেরটার মতই টান দিয়ে শেষ করে ফেলল এটাও। ফেলে দিয়ে, গুড়ুক করে ঢেকুর তুলে, শার্টের হাতা দিয়ে ঠোঁট মুছল।
নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করলেন রাবাত। অসহ্য লাগছে তার, বোঝা গেল। আরেক দিকে মুখ ফেরালেন।
এই বুড়ো, ধমকে উঠল লোকটা, আরেক দিকে তাকাচ্ছ কেন? আমি কথা বলার সময়, আমার দিকে তাকাবে।
রাগে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। হাত ধরে টেনে আবার তাকে বসিয়ে দিল কিশোর।
অই বাদুড়, বলল লোকটা, পাহাড় বেয়ে দৌড়ে উঠেছ কখনও, এমন পাহাড় যেটাতে চড়ার সাধ্য নেই কারও?
হেসে উঠল দ্বিতীয় লোকটা। খুব ভাল লাগবে তোমার, ভাম–ওঠার আগেই যদি অবশ্য মরে না যাও।
হাসতে লাগল দুজনে।
মুসার হাত ছেড়ে দিয়েছিল কিশোর। হঠাৎ খেয়াল করল সে নেই তার। পাশে। অন্ধকারে কখন উঠে চলে গেছে! রেগে গেলে মুসার মাথার যে ঠিক থাকে না, কি না কি করে বসে, ভেবে মুখ শুকিয়ে গেল তার।
কিন্তু অঘটন না ঘটিয়ে ফিরে এল মুসা। দুজনের মাথা টেনে এনে কানে কানে বলল, শোনো, ওদের সাইকেলের চাবি লাগিয়ে রেখে গেছে। নানারটাও ইগনিশনেই ছিল, নিয়ে এসেছি। দেখাল সে। একে একে মোটর সাইকেলের চাবি দুটোও খুলে নিল।
নানাকে কোথাও আর নিয়ে যেতে পারবে না ওরা, বলল সে। এগুলো নিয়ে পাম্পটায় চলে যাও তোমরা। পুলিশকে ফোন করো। আমি পাহারা দিচ্ছি। নানার গায়ে হাত তোলার চেষ্টা যদি করে…আমি ওদেরকে…আমি ওদেরকে… ভয়ানক রাগে ফুঁসতে লাগল সে।
অন্ধকারে হাসল কিশোর। আরেকটা চমৎকার বুদ্ধি এসেছে তার মাথায়।
দুটো সেকেন্ড চুপ করে বুদ্ধিটা মনে মনে খতিয়ে দেখল সে। কোন ভুল আবিষ্কার করতে পারল না। তবে এতে কাজ হবে। নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে। যেতে পারবে রাবাতকে। গুণ্ডাদুটোরও খানিকটা শায়েস্তা হবে।
তার চেয়ে আমার বুদ্ধি শোনো, ফিসফিস করে বলল সে, মোটর সাইকেল চালাতে জানো না?
প্রশ্নটা করে অন্য কিছু বোঝাতে চাইছে কিশোর। মুসা বলল, ওদের একটা বাইক সরিয়ে নিতে বলছ? পাগল নাকি?
না। পরিকল্পনার বাকি অংশটা বলল কিশোর।
সত্যি চমৎকার প্ল্যান, স্বীকার করতেই হলো মুসাকে। খুঁত না থাকলেও বিপদ আছে, তাতে সন্দেহ নেই। সাইকেল সে সরিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে কিশোর আর রবিন কি পেরে উঠবে দুটো বিশালদেহী গুণ্ডার সঙ্গে?
ভাবার সময় নেই। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেরি করলে। হয়তো রাবাতের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিতে পারে লোকগুলো।
বেশ, উঠে দাঁড়াল মুসা, তা-ই করব আমি!
অন্ধকারে গা ঢেকে ছায়ার মত নিঃশব্দে আবার বুইকের কাছে চলে গেল। মুসা। শব্দ না করে ট্রাংক খুলে কয়েকটা যন্ত্রপাতি বের করে আনল। ওগুলো নিয়ে কাজে লেগে গেল তিনজনে।
একের পর এক বিয়ারের ক্যান খালি করছে দুই গুণ্ডা। পেট ঢোল করে ফেলছে। নেশা ধরতে আরম্ভ করেছে। জিভ ভারী হয়ে আসছে। কথা কেমন। আড়ষ্ট আর এলোমেলো। মুসা ভাবল, কাজ করতে গিয়ে সামান্য শব্দ যদি হয়েও যায় এখন, খেয়াল করবে না ওরা। তবে শব্দ করল না। খুব সাবধানে। কাজ করতে লাগল।
ভাগ্যিস মাত্র দুজন এসেছে, কিশোর বলল। সবগুলো একসঙ্গে থাকলে মুশকিল হয়ে যেত। এ সব করতে পারতাম না।
একটা বাইকের ইগনিশনে চাবি ঢোকাল আবার কিশোর। দ্বিতীয় চাবিটা দিল মুসার হাতে। অন্য বাইকটার সীটের দুপাশে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছে এখন ও।
বাইকটা বিশাল। সন্দেহ নেই, ক্ষমতাও নিশ্চয় সাংঘাতিক। হ্যাঁভেল ধরে ঠেলে স্ট্যান্ড থেকে নামাল ওটাকে। ইগনিশনে চাবি ঢুকিয়ে লম্বা দম নিল। কিক মারল স্টার্টারে।
রেগে যাওয়া জন্তুর মত গর্জন করে উঠল ইঞ্জিন, পরক্ষণে বন্ধ হয়ে গেল।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা।
চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দুই গুণ্ডা।
আবার কিক মারল মুসা।
আবার গর্জে উঠল ইঞ্জিন। আর বন্ধ হলো না। গিয়ার দিয়েই এক্সিলারেটরে মোচড় দিল মুসা। খেপা ঘোড়ার মত লাফ মারল বাইক। এত শক্তিশালী মোটর সাইকেল আর চালায়নি সে। এতটা যে ক্ষমতা থাকতে পারে কল্পনাই করেনি। হ্যাঁচকা টান লেগে আরেকটু হলেই হাত থেকে ছুটে যাচ্ছিল হ্যান্ডেল। মনে হলো, কাঁধ থেকে বুঝি খসে গেল বাহু দুটো।
অসমান জমিতে ঝাঁকি খেতে খেতে একটা খাদের পাশ দিয়ে ছুটল বাইক, উঠে এল খোয়া বিছানো পথে। উড়ে চলল যেন। ভীষণ উত্তেজনায় গলা ফাটিয়ে জানোয়ারের মত চিৎকার করে উঠল মুসা। শক্তিশালী বাইক চালানোর মজাই আলাদা–মনে হয় ইঞ্জিন থেকে বাইকের গা বেয়ে আরোহীর শরীরেও এসে ঢোকে প্রচণ্ড ক্ষমতা। উন্মাদনা জাগে রক্তে। এক অদ্ভুত স্বাধীনতা বোধ। সেজন্যেই বোধহয় মোটর সাইকেল গ্যাঙ তৈরি হয়, গাড়ি বা আর কোন যানবাহনের গ্যাঙ হয় না।
পড়িমরি করে ছুটে এল দুই গুণ্ডা। অন্য বাইকটায় চড়ল, একজনের পেছনে আরেকজন। সামনের লোকটা স্টার্টারে কিক দিল। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। অভ্যস্ত হাত ওদের। এক্সিলারেটরে মোচড়ের তারতম্য হলো না, ফলে ইঞ্জিনও বন্ধ হলো না। চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে আরম্ভ করল। কিন্তু মাত্র কয়েক গজ। খাদটার কাছে আসতে না আসতেই খুলে গেল সামনের চাকা।
শোনা গেল চিৎকার-চেঁচামেচি, খিস্তি করে গালাগাল। খাদে পড়ে গেছে। দুই গুণ্ডা।
দৌড় দিয়েছে ততক্ষণে রবিন আর কিশোর। রাবাতের কাছে চলে এল। দুদিক থেকে তার দুবাহু চেপে ধরে প্রায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুটল গাড়ির দিকে। একটা মুহূর্ত বিমূঢ় হয়ে রইলেন তিনি, তারপরই যা বোঝার বুঝে গেলেন। ছেলেদের হাত ছুটিয়ে নিয়ে নিজেই ছুটলেন গাড়ির দিকে। দরজা খুলে উঠে পড়লেন ড্রাইভিং সীটে। অন্য পাশের দরজা খুলে প্যাসেঞ্জার সীটে বসল কিশোর, চাবি গুঁজে দিল রাবাতের হাতে। রবিন উঠল পেছনে। দরজা। পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই চলতে শুরু করল গাড়ি। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছেন রাবাত। পুরো একটা চক্কর দিয়ে রাস্তার দিকে ঘুরতে গিয়ে আধডজন ছোট ছোট ঝোপকে মাড়িয়ে চ্যাপ্টা করে দিল। অল্পের জন্যে একটা গাছে বাড়ি লাগানো থেকে বেঁচে গেল নাকের একপাশ। দুই গুণ্ডা চমকের ধাক্কা কাটিয়ে কিছু করতে যাওয়ার আগেই রাস্তায় উঠে এল গাড়ি।
সিকি মাইল এসে গতি কমালেন রাবাত। ফিরে তাকাল দুই গোয়েন্দা।
রাস্তায় উঠে এসেছে গুণ্ডারা। হাত মুঠো করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্রচণ্ড রাগে উন্মাদ নৃত্য জুড়েছে। নিষ্ফল আস্ফালন।
মুচকি হাসল কিশোর।
হাসতে লাগল রবিন।
১৬.
আধঘণ্টা পর ফিরে এল মুসা। কপালে ঘাম। চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল। হেসে বলল, বাইকটা ফেলে দিয়েছি একটা ডোবায়। চাবি রেখে এসেছি একটা পিলার বক্সে। কিছু সময়ের জন্যে আটকে দিলাম ব্যাটাদের।
রাবাতের দিকে তাকাল সে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, নানা, কি হয়েছিল? এত গালাগাল শোনার শখ হলো কেন হঠাৎ? প্রচুর তো শুনলে-বাদুড়, ভাম! বাড়ি গিয়ে মাকে যদি বলি…কথা শেষ করতে পারল না হাসির জন্যে। মা এবং নানার কি চেহারা হবে কল্পনা করে হা-হা করে। হাসতে শুরু করল।
কিছুটা বিব্রত দেখাল রাবাতকে। আগে জানা থাকলে ধরতে পারত না। হঠাৎ করে এসে চমকে দিয়েছিল। যেটা থেকে তেল নেব বলেছিলাম সেটাতে ভিড় থাকায় মোড়ের পাম্পটায় চলে গেলাম। পেট্রোল নেয়ার পর মনে হলো, ট্যাংকের নিচে আবার যন্ত্র আটকে দেয়নি তো মিলার? রাস্তার ধারে সরে গিয়ে গাড়ির নিচে উঁকি দিয়ে দেখতে গেলাম। এই ফাঁকে আমার অজান্তে পাশে এসে দাঁড়াল শয়তান দুটো। ছুরি বের করে ভয় দেখাল, ওদের কথা না শুনলে হুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবে। পিকনিক গ্রাউন্ডে গাড়ি নিয়ে যেতে বাধ্য করল আমাকে।
গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে রয়েছেন আপনি। এখনও যে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি, এটাই বেশি।
থাক, অত ভাবতে হবে না, হাত নাড়লেন রাবাত। আমি তখন সতর্ক ছিলাম না বলে বেকায়দায় পেয়ে গিয়েছিল। এরপর এলে আর সহজে ছাড়ব না, খানিকটা শিক্ষা দিয়ে দেব।
কি ভাবে শিক্ষাটা দেবে, বুঝতে পারল না মুসা। তবে নানাকে জিজ্ঞেস করার সাহসও হলো না। পুলিশকে জানালে কেমন হয়?
আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে ওদের আর জড়াতে চাই না। ওই হাদাগুলো এসে করবেই বা কি? শুধু শুধু একগাদা প্রশ্ন করে কেবল সময় নষ্ট করবে। শহর থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে রওনা হয়ে যাব, তাহলেই হবে।
পশ্চিমে?
হ্যাঁ। ওদিকে যাব ভাববেই না ওরা। গুণ্ডাগুলোও না, মিলার আর তার দোস্তও না। পশ্চিমের কোন শহরে উঠে পুরানো গাড়ির দোকানে যাব। বুইকটা বেচে দিয়ে অন্য গাড়ি নিয়ে নেব। আবার রওনা হব নিউ ইয়র্কের দিকে। বুইকটা না দেখলে ওরা চিনতে পারবে না, আমরাও জ্বালাতন থেকে বাঁচব।
নানার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল মুসা, হ্যাঁ, এইটা ভাল বুদ্ধি। বুইকটাই হচ্ছে যত নষ্টের মূল। মিলার, তার দোস্ত, মোটর সাইকেলওয়ালারা, সবাই চিনে গেছে এটাকে। ওদের খসাতে হলে গাড়িটাই বিদেয় করতে হবে।
জলদি মালপত্র গুছিয়ে নে। এখুনি বেরোব।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার হাইওয়েতে এসে উঠল ওরা। পশ্চিমে চলল। মধ্যরাতে ওহাইও আর পেনসিলভানিয়ার সীমান্তে একটা শহরে ঢুকল। রাস্তাগুলো সব নির্জন। বেশির ভাগ বাড়িরই আলো নিভে গেছে। তবে হাইওয়ের পাশে হলিডে ইন হোটেলটায় আলো জ্বলছে। ঘর নিতে অসুবিধে হলো না। বাকি রাতটা নিরাপদেই ঘুমিয়ে কাটানো গেল। পরদিন সকালে উঠেই চলে এল একটা গাড়ির দোকানে। তখনও খোলেনি দোকানটা। অপেক্ষা করতে হলো ওদের।
অবশেষে দোকান খুলল। বুইকটার জন্যে যা দাম দিতে বলল সেলসম্যান, দর কষাকষি না করে তাতেই রাজি হয়ে গেলেন রাবাত। দুই বছরের পুরানো একটা ফোর্ড সেডান কিনে নিলেন। বুইকের দাম বাবদ যা কাটা গেল, সেটা বাদ দিয়ে বাকি টাকার চেক লিখে দিলেন। তারপর আবার অপেক্ষার পালা। লং ডিসট্যান্ট কল করল সেলসম্যান। চেকটা ঠিক আছে। কিনা ব্যাংকে ফোন করে জেনে নেয়ার জন্যে।
ফোর্ড গাড়িটা নিয়ে দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে দুপুর পেরিয়ে গেল।
এইবার আশা করি ঝেড়ে ফেলা যাবে ওদের, রাবাত বললেন। কড়া নজর রেখেছেন মিলার আর তার দোস্তকে দেখা যায় কিনা। বড় করে হাই তুললেন, চোখ ডললেন। নাহ, বয়েস বেড়েছে আমার। ধকল আগের মত সহ্য করতে পারব না, ভুলেই গিয়েছিলাম। আর বেরোতে ইচ্ছে করছে না। আজ বরং এখানেই থেকে যাই। বিশ্রাম নিই। মিলারের ভয় আর না করলেও চলবে। ফোর্ডটা চিনতে পারবে না ও, আমাদেরও খোঁজ পাবে না।
আপত্তি তো নেইই, বরং খুশি হয়ে রাজি হলো গোয়েন্দারা। এই একটানা ছোটা ওদেরও ক্লান্ত করে তুলেছে। হলিডে ইনে ফিরে এল ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাবাতের নাক ডাকানোর শব্দ শোনা গেল।
মোটেলের পুলে সাঁতার কাটল তিন গোয়েন্দা। কাছের একটা ছোট গলফ কোর্সে গলফ খেলল। বেশি দূরে গেল না। সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরে এল। মুসা আর রবিন টেলিভিশন দেখতে লাগল। জানালার কাছে বসে কিশোর তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। বার বার ভ্রুকুটি করছে আর নিচের ঠোঁট ধরে টানছে। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। আচমকা মাথা ঝাঁকিয়ে আনমনেই বলল, ঠিক, এটাই আসল ব্যাপার!
ফিরে তাকাল অন্য দুজন।
কোনটা আসল ব্যাপার? জানতে চাইল রবিন।
রাবুনানার আবিষ্কারের প্রতি কোন আগ্রহ নেই মিলারের, কিশোর বলল। কোনকালে ছিলও না।
স্তব্ধ হয়ে গেল মুসা। খাইছে! বলো কি! আগ্রহ না থাকলে আমাদের পিছু নিয়েছে কেন? কাস্টারে নেমে আমরা যখন বন দেখতে গেলাম, আমাদের পিছু নিল, তখন পিস্তল বের করেছিল কেন? তুমি কি বলতে চাইছ পিস্তল দিয়ে বাইসন শিকারে এসেছে সে?
সুপারমার্কেটে আমাকেই বা ধরেছিল কেন তার দোস্ত? রবিন বলল।
ওর কথাই ভাবছি আমি, কিশোর বলল। কেশে গলা পরিষ্কার করে সোজা হয়ে বসল। সুপারমার্কেটে ঠিক কি বলেছিল তোমাকে লোকটা, রবিন?
বলেছিল, আমি নাকি ওর ছেলে, নেশা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি, আমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে। অতি সহজ চালাকি। আমাকে আটকে রেখে রাবুনানার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে তাঁর আবিষ্কারটা চাইবে। জিনিসটা কি, বলো তো? কোন ধরনের অস্ত্র? নাকি দেশরক্ষা বাহিনীর কাজে লাগে এমন কিছু?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, ম্যানেজারকে কি বলেছে লোকটা, সেটা শুনতে চাই না। ঢুকেই তোমাকে কি বলেছিল?
তোমার সঙ্গে নেই ওটা। তবে অসুবিধে নেই। আদায় করে নিতে পারব।
তখন তোমার সঙ্গে কি জিনিস ছিল না?
আর কি? ঢোঁক গিলল রবিন। নিশ্চয় রাবুনোর আবিষ্কার।
কেন, আর কিছু হতে পারে না? এমন কিছু, যা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকে, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় ছিল না?
ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। কিসের কথা বলছ?…ও, ক্যামেরাটা? ক্যামেরা এবং ক্যামেরার ব্যাগ। কিন্তু ওই সাধারণ জিনিসের প্রতি আগ্রহী হবে কেন লোকটা?
হাসল কিশোর। ক্যামেরার ব্যাগে তোমার ব্যবহার করা ফিল্মগুলো ছিল। মোটেলে রেখে গিয়েছিল। ওগুলোই চাচ্ছিল সে। কোন সন্দেহ নেই আর আমার।
হেলান দিয়ে বসে দুই হাতের আঙুলের মাথাগুলো এক করল কিশোর, তাতে দেখাল অনেকটা তাবুর চুড়ার মত। হাসিটা লেগে আছে মুখে। পিজমো বীচে তার ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন রাবাত, চেহারাটা কি হয়েছিল মনে আছে? সাংঘাতিক চমকে গিয়েছিল। আতঙ্কিত। আমার বিশ্বাস, আমরা যা ভাবছি সে-কারণে পিজমো বীচে যায়নি সে, গিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে।
ধরা যাক, ঘটনাক্রমেই আমাদের সঙ্গে ওখানে মিলারের দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ওপর নজর রাখার জন্যে আসেনি। রাবুনানার বাড়িতেও আমরা বেরিয়ে আসার পর যে উঁকি মেরে দেখেছিল, সেটাও খুব সাধারণ ব্যাপার। উঁকিঝুঁকি মারা ওর স্বভাব। এক ধরনের কৌতূহল, পড়শীর ব্যাপারে যেমন থাকে কারও কারও। আমার চলে আসার পর মনটিরেতে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিল সে। আমরা সান্তা বারবারায় থেমে লাঞ্চ খেলাম, কিন্তু সে সোজা চলে গেল পিজমো বীচে। সেখানে গিয়ে হয়তো খাওয়া সেরেছে, বা বিশ্রাম নিয়েছে। তারপর আমরা গেলাম। সৈকতে একই সময়ে বেরিয়েছিলাম। রাবুনো তো দেখেই গেলেন রেগে। মিলারের চোখে বিস্ময় দেখেছি আমি। ওর চেহারা মনে আছে?
সৈকত ধরে হেঁটে শহরের দিকে চলে গিয়েছিল সে। তারপরই বদলে গেল পরিস্থিতি। মনটিরেতে কি কি ঘটেছিল, মনে আছে তোমাদের?
আছে, মুসা বলল। আবার ওর সঙ্গে সৈকতে দেখা হলো আমাদের। অন্য লোকটাকেও ওখানেই দেখলাম–ক্যামেরার দোকানে রবিনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল যে।
হ্যাঁ। বাজি রেখে বলতে পারি ফিশারম্যান ওআর্কে আমাদের পিছু নিয়ে আসেনি মিলার। তাহলে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করত। এমন ভাবে চলাফেরা করত, যাতে আমাদের চোখে না পড়ে। কিন্তু তা সে করেনি। খোলাখুলিই সৈকতে হাঁটছিল সে, আর দশজন সাধারণ টুরিস্টের মত।
চোখের ওপর দুহাত চেপে ধরল কিশোর। পুরো দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করছে। খুঁটিনাটি বাদ না দিয়ে।
মিলারের কাছেও একটা ক্যামেরা ছিল সেদিন, অবিকল রবিনেরটার মত। কিন্তু ছবি তুলছিল না। হাতে রেখে দিয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় লোকটা এল। তাকে বলল মিলার–এনেছি ওটা। এর মানে কি? দ্বিতীয় লোকটার জন্যে কিছু নিয়ে এসেছিল মিলার। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে একটা বেঞ্চের সামনে দাঁড়াল, যেটাতে তখন রবিন বসেছিল। আমাদের চিনতে পারল মিলার। কি রকম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল মুখ মনে আছে? স্যুভনিরের দোকান থেকে রেগেমেগে বেরিয়ে এলেন রাবুনো। দেখেই কেটে পড়ল মিলারের সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকটা। মিলারকে চেপে ধরলেন রাবুনো। ধমকাতে শুরু করলেন।
আবারও ভয় পেয়ে গেল মিলার। ওখানে রাবুনানাকে আশা করেনি, তাহলে নিশ্চয় আসত না। মিলারকে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে তার সঙ্গে যেতে বললেন রাবুনো। বেঞ্চে রাখা ক্যামেরাটা তুলে নিল রবিন। রওনা হলাম আমরা।
ওই সময় থেকেই শুরু হয়েছে যত গণ্ডগোল। আমাদের পিছু নিল মিলার। মনে আছে, আমাদের গাড়ির পেছন পেছন কি ভাবে দৌড়ে এসেছিল? কিছু বলছিল, আমরা বুঝতে পারিনি?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
রবিন তাকিয়ে রইল কিশোরের দিকে। ঠিক! কেন এসেছিল?
কারণ, যে ক্যামেরাটা তুমি তুলে নিয়েছিলে, ওটা তোমার ছিল না, রবিন। ওটা মিলারের। রাবুনানাকে তেড়ে আসতে দেখে আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে তাড়াতাড়ি রেখে দিয়েছিল বেঞ্চে।
তারমানে তুমি বলছ, মুসা বলল, ক্যামেরার পেছনেই লেগেছে সে? কিন্তু এরও তো কোন মাথামুণ্ড নেই। তার ক্যামেরা সে ফেরত চায়। মোটেলে এসে আমাদের দরজা খটখটালেই তো হত। বলত, তার ক্যামেরা ভুল করে আমরা নিয়ে এসেছি। ফেরত দিয়ে দিতাম। সাত রোজাতেই ফেরত নিয়ে যেতে পারত। এত চালাকি, এত পিছু নেয়ার কোন প্রয়োজন। পড়ত না।
শুধু ক্যামেরা হলে হয়তো তাই করত, কিংবা তা-ও করত না। মনটিরে থেকে সান্তা রোজায় গাড়ি চালিয়ে আসা কম ঝক্তি নয়, সাধারণ একটা ক্যামেরার জন্যে এ-কাজ করবে? তারপরও থামেনি। দীর্ঘ পথ আমাদের পিছে পিছে এসেছে। আমার ধারণা, ক্যামেরা নয়, ভেতরের ফিল্মের জন্যেই এমন করছে। ওটা ওদের কাছে দামী। ওই ফিল্মে কি আছে, সেটা আমাদের জানতে দিতে চায় না ওরা।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল রবিন, এইটা হতে পারে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি। মনটিরে থেকে আসার পর এত তাড়াতাড়ি ফিল্ম ফুরিয়ে গেল কেন ক্যামেরার, কেন ক্যামেরা আর তার ব্যাগটা অন্য রকম লাগল। তখনও পুরোপুরি ধরতে পারিনি ব্যাপারটা, দুটোই নতুন ক্যামেরা বলে। তবে পরিবর্তন একটা টের পেয়েছি। ক্যামেরা বদল হতে পারে, ভাবলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলতাম। উঠে গিয়ে ক্যামেরার ব্যাগটা এনে বিছানায় উপুড় করল সে। নয় রোল ফিল্ম পড়ল বিছানায়, তার মধ্যে একটা কেবল নতুন, ব্যবহার করা হয়নি। বাকিগুলো ছবি তুলে শেষ করে ফেলা হয়েছে, ডেভেলপ করতে হবে। চলো, ক্যামেরার দোকানে। দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডেভেলপ করে দেয় এমন দোকান নিশ্চয় আছে।
বেরিয়ে পড়ল ওরা। হোটেল থেকে তিন ব্লক দূরে ছোট একটা মলে পাওয়া গেল ক্যামেরার দোকান। কাউন্টারে বসা মহিলাকে ফিল্মগুলো বের করে দিল রবিন। ডেভেলপ করতে সময় লাগবে। বিভিন্ন দোকানের ডিসপ্লে উইন্ডোতে রাখা জিনিস দেখে সময় কাটাতে লাগল ওরা।
কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এল ক্যামেরার দোকানে। শক্ত হলুদ কাগজের বড় একটা খাম ঠেলে দিল মহিলা। উত্তেজনায় প্রায় কাঁপতে কাঁপতে ওটা নিয়ে পার্কিং লটের দিকে এগোল রবিন। একটা নির্জন জায়গায় এসে খাম থেকে ছবির প্রিন্টগুলো বের করে দেখতে লাগল। দুপাশে দাঁড়িয়ে পাহারা। দিতে লাগল মুসা আর কিশোর। বার বার এদিক ওদিক চেয়ে দেখছে কেউ তাকিয়ে আছে কিনা। মাউন্ট রাশমোরে রাবুনো, কাস্টার পার্কে বাইসনের পাল, ব্যাডল্যান্ডের নানা রকম পাথরের ছবি। তার মধ্যে একটা বিমানের ছবি, রানওয়েতে ছুটতে ছুটতে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এটা আমি তুলিনি, রবিন বলল।
ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল মুসা। চেহারাটা বেশ ছিমছাম বিমানটার। বেশি সরু, অনেক লম্বা ছুঁচাল মাথা, পেটের কাছে ডানাদুটো হাঙরের পিঠের পাখনার মত চোখা হয়ে পেছনে বেঁকে গেছে। যাত্রীবাহী প্লেন নয়, আর্মির জিনিস।
বাকি ছবিগুলো ঘটতে লাগল রবিন। আরও কয়েকটা ছবি পাওয়া গেল, যেগুলো সে তোলেনি। তেল শোধনাগার আর ভারী মাল তোলার এলিভেটরের মাঝামাঝি কিছু যন্ত্র দেখা গেল। খুব কাছে থেকে তোলা ড্রয়িং আর নকশার ছবি রয়েছে। বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো আছে জিনিসগুলো। নোটবুকের কিছু লেখা পাতার ছবি আছে। নানা রকম সমীকরণ, নোট, অর্থহীন শব্দমালা লেখা রয়েছে পাতাগুলোতে, যেগুলো পুরোপুরি দুর্বোধ্য ওদের কাছে।
ছবিগুলো দেখা শেষ করল রবিন। ঘেমে গেছে। হু, মাথা দুলিয়ে বলল সে, এ সব জিনিসই তাহলে দ্বিতীয় লোকটাকে দিতে যাচ্ছিল মিলার! মনে তো হচ্ছে আর্মির গোপন কোন ব্যাপার! মিলার একটা স্পাই, দেশের বাইরের শত্রুর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছিল এ সব তথ্য!
.
১৭.
এফ বি আইকে জানাতে হবে! চিৎকার করে উঠলেন রাবাত। ওরাই শয়তানগুলোর ব্যবস্থা করবে।
টেলিফোন ডিরেক্টরি টেনে নিয়েছে ততক্ষণে মুসা। দেখে বলল, এখানে নেই। এই শহরে এফ বি আইয়ের অফিস নেই।
না থাকারই কথা। নিউ ইয়র্কে গিয়ে ওদের জানাতে হবে। চল চল, এখনই রওনা হব। সুটকেস গোছা।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। সারারাত গাড়ি চলল একটানা। ভোররাতে আকাশ যখন ধূসর হয়ে আসছে তখন একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকল। সাদা পাথরের দেয়াল। প্রচুর গাড়ি চলাচল করছে। সুড়ঙ্গের অন্য পাশে আসতে চোখে পড়ল আকাশ ছোঁয়া দালান, প্রায় জট বেধে থাকা যানবাহনের ভিড়। প্রকাণ্ড পেনসিলভানিয়া স্টেশনের প্রকাণ্ড বাড়ির সামনে জায়গা দখলের জন্যে গুতোগুতি শুরু করেছে শত শত ভাড়াটে ট্যাক্সি।
স্টেশনের সামনে রাস্তার অন্য পাড়ে গাড়ি রাখলেন রাবাত। কিশোর নেমে গিয়ে একটা বিল্ডিঙে ঢুকল। টেলিফোন বুক দেখে এফ বি আই-র ঠিকানা জানার জন্যে। গাড়িতে বসে রইল অন্য দুই গোয়েন্দা, কিশোর কি খবর নিয়ে আসে শোনার জন্যে উদ্বিগ্ন।
সাড়ে নটার দিকে অফিসটা খুঁজে পেলেন রাবাত। ভেতরে ঢুকে একজন মানুষকে বসে থাকতে দেখা গেল। তার নাম হোগারসন। নিখুঁত একজন মানুষ–সুন্দর করে আঁচড়ানো বালি রঙের চুল, সাদা দাঁত, শান্ত, নরম। ব্যবহার, আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত মেলাল। মিলার আর তার দোস্তের অপকর্মের কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রাবাত, শেষ দিকে তো রীতিমত খেপে গেলেন। কথা আটকে যেতে শুরু করল।
ধৈর্য হারাল না হোগারসন। তাকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দিল।
মুসা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল, নানা, প্লীজ, অত রেগে যাওয়ার কিছু নেই। আমরা যা ধারণা করেছি তা না-ও হতে পারে। মিস্টার হোগারসনকে বরং ছবিগুলো দেখাও।
নিশ্চয়! আছাড় দিয়ে ছবির খামটা টেবিলে রাখলেন রাবাত। এগুলো ক্যামেরার মধ্যে ছিল। রবিন ভেবেছিল ওটা ওরই ক্যামেরা। ভুল করে ওরটা নিয়ে চলে গেছে স্পাইটা। মিলার বেঈমানটা এগুলো বিক্রি করে দিতে যাচ্ছিল বিদেশী শত্রুর কাছে।
ছবিগুলো দেখল হোগারসন। চেহারার ভাব একই রকম রইল, বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না।
ব্যাপারটা কেমন যেন লাগল কিশোরের। মনে হলো, রাবাতের কথায় বোধহয় গুরুত্ব দিচ্ছে লোকটা। বলল, মিস্টার হোগারসন, আগে আমাদের পরিচয়টা দিয়ে নেয়া দরকার। পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল।
কার্ডটা দেখল হোগারসন। প্রশ্ন করার জন্যে মুখ খুলল। কিন্তু তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কিশোর বলল, আমি কিশোর পাশা, আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। ক্যালিফোর্নিয়ার রকি বীচে আমাদের হেড কোয়ার্টার। যে কোন ধরনের রহস্যের ব্যাপারে আমরা আগ্রহী। অনেক ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দাগিরি করে এসেছি, শখানেকের বেশি রহস্যের সমাধান করেছি। কিছু কিছু তো এতটাই জটিল ছিল, পুলিশও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। সুতরাং এ সব ব্যাপারে আমরা একেবারেই আনাড়ী, এ কথা বলতে পারবেন না।
এই প্রথম রবিনের মনে হলো হোগারসনের নির্বিকার মুখে অতি সামান্য উজ্জলতা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। কার্ডটা টেবিলে রাখল।
মুসা বলল, মিস্টার হোগারসনকে সব বলো, কিশোর।
মনটিরেতে কি করে ক্যামেরা বদল হয়েছে, খুলে বলল কিশোর। গণ্ডগোল এখান থেকেই শুরু। তারপর নানা ভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে আমাদের। সারাক্ষণ টেনশনে রেখেছে।
এক মুহূর্ত স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি আমাদের! কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখতে পারলেন না রাবাত।
তাঁকে কথা বলতে দিল না কিশোর। নিজে বলতে লাগল সব। মোটেলের ঘরে আগুন লাগা থেকে শুরু করে, কাস্টার ন্যাশনাল পার্কে পিস্তল হাতে অনুসরণ, মিশিগানে রবিনকে অপহরণের চেষ্টা, কোন কথাই বাদ দিল না।
মিশিগানের স্টারজিসে ঘটেছে ঘটনাটা, কিশোর বলল। কয়েক দিন আগে। সুপারমার্কেটের অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার ডেপুটি শেরিফকে ডেকে এনেছিল। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। শেরিফের অফিসে নিশ্চয় রেকর্ড রাখা হয়েছে।
চুপ করে আছে হোগারসন। আর কিছু বলে কিনা কিশোর, শোনার অপেক্ষা করল। মাথা ঝাঁকাল তারপর। শুধু বলল, হু।
সব কথা উগড়ে দিতে পেরে, সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে পিঠ ঠেকাল কিশোর।
রাবাত বললেন, ওই ছুঁচো মিলারটা একজন সাংঘাতিক পাই। আর তার দোস্তটা নিশ্চয় বিদেশী শত্রুদের চর।
হোগারসন হাসল। কোন দেশ?
তাতে কি কিছু এসে যায়?
না, তা হয়তো যায় না।
ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে ছবির খামটা সহ উঠে চলে গেল। হোগারসন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানাল, তার সহকর্মীরা খোঁজখবর শুরু করেছে। গোয়েন্দাদের যোগাযোগ রাখতে বলল।
নিউ ইয়র্কে কোথায় উঠছেন আপনারা? জিজ্ঞেস করল হোগারসন।
ইস্ট সাইডের ঘোট একটা হোটেলের নাম বললেন রাবাত, রিয়ারভিউ প্লাজা। লিখে নিল হোগারসন।
হঠাৎ সন্দেহ জাগল রাবাতের, আচ্ছা, রুম পাওয়া যাবে তো ওখানে? ভর্তি হয়ে যায়নি তো?
কয়েক মিনিট বসলে আমরাই সেটা জেনে দিতে পারি, হোগারসন বলল।
আবার উঠে চলে গেল সে। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে বলল, রিয়ারভিউ প্লাজায় দুটো রুমের কথা বলে এসেছে। খালি আছে।
যদি আর কিছুর দরকার পড়ে, কিংবা মিলারের সঙ্গে দেখা হয়, দয়া করে আমাদের জানাবেন, অনুরোধ করল হোগারসন। তার নাম লেখা কার্ড দিল।
গোয়েন্দারা বুঝল, তাদের কথায় গুরুত্ব দিয়েছে এফ বি আই। তদন্ত শুরু করেছে। সন্তুষ্ট হয়ে বেরিয়ে এল ওরা। সারি দিয়ে লিফটের দিকে এগোল। নেমে এল নিচে। হোটেলে চললেন রাবাত। পুরানো বাড়ি। এক সময় নদীর দিকে মুখ করা ছিল। এখন চারপাশে বড় বড় বিল্ডিং গজিয়ে ঘিরে ফেলেছে বাড়িটাকে। আঙিনায় ঢুকতেই গাড়ির দায়িত্ব নিয়ে নিল হোটেলের একজন অ্যাটেনডেন্ট। চালিয়ে নিয়ে চলে গেল পার্কিং লটে। লটটা কোথায় বোঝা গেল না। আরেকজন অ্যাটেনডেন্ট ওদের সুটকেসগুলো বয়ে নিয়ে চলল ওপরতলায়। ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। জানালায় হালকা ঘোলাটে কাচ। তার ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে অন্য একটা বাড়ির কাঁচে ঘেরা অফিস দেখতে পেল কিশোর। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কয়েক সারি কম্পিউটারের সামনে বসে কাজে ব্যস্ত নারী-পুরুষ।
একঘেয়ে দৃশ্য। ভাল লাগল না কিশোরের। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় এসে উঠল। চোখ মুদে ভাবতে লাগল, তদন্ত শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে এফ বি আইয়ের? মিলার আর সেই লোকটার ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেবে? আর কিছু ভাবতে পারল না। ঘুমিয়ে পড়ল।
স্বপ্ন দেখল, বাড়িতে রয়েছে। স্যালভিজ ইয়ার্ডে। জঞ্জালের ভেতরে লুকানো ট্রেলারে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে ঢুকছে গোপন সুড়ঙ্গপথে। তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে তাকে, কারণ টেলিফোন বাজছে… বেজেই চলেছে…
উত্তেজিত অবস্থায় ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘেমে গেছে। টেলিফোন আসলেও বাজছে, তবে হোটেলে তাদের ঘরে রাখা ফোনটা। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল রবিন। ঘুম জড়িত চোখে তাকিয়ে আছে কিশোর। রবিনকে বলতে শুনল, হ্যাঁ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়!
রিসিভার রেখে কিশোরকে বলল, লবি থেকে হোগারসন ফোন করেছে। ওপরে আসছে।
হুড়াহুড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। মুসা দৌড় দিল নানাকে জাগানোর জন্যে। আলুথালু পোশাকে খালিপায়েই ছুটে এলেন। রাবাত। ঠিক এই সময় দরজায় টোকা পড়ল।
সঙ্গে করে আরেকজনকে নিয়ে এসেছে হোগারসন। তার চেয়ে লম্বা, বয়েসও কিছু বেশি। পরিচয় করিয়ে দিল, এজেন্ট পিটারম্যান। চেয়ারে বসল দুজনে। হোগারসন চুপ করে রইল, কথা বলতে লাগল পিটারম্যান।
মিলারের সম্পর্কে বেশির ভাগ প্রশ্নেরই জবাব দিলেন রাবাত। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। সকালের মত উত্তেজিত হলেন না, বলতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেললেন না। জানালেন, মিলারের ব্যাপারে কমই জানেন তিনি, অথচ বেশ কয়েক বছর ধরে লোকটা তার পড়শী, এত কাছাকাছি থাকলে আরও অনেক বেশি জানার কথা ছিল। কোন ধরনের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করে লোকটা, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব নেই–অন্তত রাবাত দেখেননি, অর্কিড জন্মানোর হবি। আর যে লোকটা মনটিরেতে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, রবিনকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল, তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বারোটা ছবি দেয়া হয়েছিল হোগারসনকে। সেগুলো বের করল পিটারম্যান। দ্বিতীয় লোকটার ছবি এর মধ্যে আছে কিনা জিজ্ঞেস করল। ছবিটা বের করে দিল রবিন। পুলিশের তোলা সাধারণ ছবি নয়। দামী পোশাক পরা অবস্থায় ভোলা হয়েছে। জায়গাটা দেখে মনে হলো বিমান বন্দর অথবা কোন রেল স্টেশনে রয়েছে। গেট দিয়ে বেরোচ্ছে। যেন এইমাত্র নামল। বিমান কিংবা ট্রেন থেকে।
এর পরিচয় জানা গেছে? জানতে চাইল রবিন। রেকর্ড খারাপ, না ভাল?
ছবিটা খামে ভরে আবার পকেটে রেখে দিল পিটারম্যান। আগেও এর সঙ্গে গণ্ডগোল হয়েছে আমাদের। নাম একটা জানি, তবে সম্ভবত এটাও অনেকগুলো ছদ্মনামের একটা। ব্যালার্ড।
সঙ্গে করে আনা একটা অ্যাটাশে কেস খুলল হোগারসন। কয়েক রোল। ফিল্ম বের করল। দেখে মনে হলো, ব্যবহার করা হয়ে গেছে ওগুলো। ডেভেলপের অপেক্ষায় আছে। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, রবিন, একটা সাহায্য করবে? তোমার ক্যামেরার কেসে ভরে রাখো এগুলো। অনেক উপকার হবে আমাদের। কেসটা চুরি যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। যায় যাক। নষ্ট ফিল্ম এর ভেতরে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত, প্রবল আপত্তি জানালেন, না না, এটা করা উচিত হবে না! ছেলেটাকে ফাঁদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। বিপদে পড়তে পারে ও। ওকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে ওর। বাবা-মা। আমি ওর ক্ষতি হতে দিতে পারি না।
হাসল হোগারসন। মিস্টার রাবাত, ভুল করছেন, ওকে টোপ আমরা বানাচ্ছি না। টোপ সে হয়েই আছে। তাকে বরং বাঁচানোর চেষ্টা করছি। মিলার আর তার সঙ্গী আপনাদের খুঁজে বের করবেই। ফিল্মটা ওদের চাই। রবিনকে আবার ধরবে ওরা। তখন যদি সে ফিল্ম দিতে না পারে, কি ঘটবে বুঝতে পারছেন?
বজ্রাহত মনে হলো রাবাতকে। বসে পড়লেন আবার। তারমানে কিছু একটা গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে সে। আপনারা তার ওপর নজর রাখবেন। তাকে অনুসরণ করবেন। যেই ওকে ধরবে, আপনারা ওদের আটকাবেন।
স্বীকারও করল না দুই এজেন্ট, অস্বীকারও করল না। কেবল রাবাতকে অনুরোধ করল, তারা নিউ ইয়র্ক কিংবা হোটেল ছেড়ে যাওয়ার আগে যেন ওদেরকে একটা খবর দিয়ে যান। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল দুজনে।
দরজা বন্ধ করেও সারতে পারল না মুসা, চেঁচিয়ে উঠল রবিন, দারুণ হয়েছে। কাউন্টারস্পাই হিসেবে কাজ করার সম্মান দেয়া হলো আমাকে! এতদিন আমরা ছিলাম শিকার, এখন হলাম শিকারী। ডাকাতগুলো লেগে ছিল, আমাদের পেছনে, আমরা লাগব এবার ডাকাতের পিছে!
ডাকাত নয়, স্পাই, মনে করিয়ে দিল মুসা।
ওই হলো। স্পাইরাও আমার মতে একধরনের ডাকাত।
অত খুশি হয়ো না! গম্ভীর হয়ে বললেন রাবাত। তোমাকে ওরা টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে! শান্ত থাকার চেষ্টা করছেন তিনি, পারছেন না। কল্পনাও করতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত এফ বি আইয়ের হয়ে কাজ করতে হবে। পড়শীকে ধরার জন্যে ফাঁদ পাততে হবে সুদূর নিউ ইয়র্কে এসে!
.
১৮.
আর কত! ভোতা স্বরে বলল রবিন। চার চারটে দিন পেরিয়ে গেল, ওদের ছায়াটির দেখাও নেই!
দোষটা আমাদেরই, মুসা বলল, আমরাই তো খসানোর চেষ্টা করেছি। এখন পাওয়া যাবে কেন?
চুপ করে আছে কিশোর। আমেরিকান মিউজিয়াম অভ-নেচারাল হিস্টরির সামনে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে তাকিয়ে আছে চত্বরে দানা খুঁটে বেড়ানো কবুতরের ঝাকের দিকে। রাবাতের দিকেও লক্ষ রেখেছে।
শব্দ করে পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। বিরক্ত চোখে ওগুলো দেখছেন বৃদ্ধ। রাগ হচ্ছে ভীষণ। গত চারদিনে একটি বারের জন্যে যেতে পারেননি–আবিষ্কার নিয়ে যেখানে যাওয়ার কথা, এত কাঠখড় পুড়িয়ে যাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তিনি। কারও সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারেননি। সারাক্ষণ কেবল একই চিন্তা, একই কাজ–মিলার আর তার দোস্তকে আড়াল থেকে টেনে বের করে আনা। হোটেল থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল, সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখের তারা। উত্তেজিত হয়ে যান। রবিনের কাছ ঘেঁষে থাকেন, সরেন না মুহূর্তের জন্যেও।
জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পটগুলোতে তাদের খোঁজা হতে পারে অনুমান করে ওসব জায়গাতেই এসে বসে থাকেন। নিউ ইয়র্ক সিটির দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘোরাফেরা করেন। সারাক্ষণ ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখে রবিন। যেখানে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ফিল্মের রোলগুলো বের করে দেখে। কেউ যদি চোখ রাখে, যাতে মনে করে ওগুলো ডেভেলপ করার অপেক্ষায় আছে।
প্রথম দিন জাহাজে করে ম্যানহাটান আইল্যান্ড ঘুরে এসেছে ওরা। সন্ধ্যায় ডিনার খেয়েছে একটা হোটেলের খোলা ছাতের ওপরের রেস্টুরেন্টে। একধারে ওখানে ক্রেতাদের মনোরঞ্জনের জন্যে পিয়ানো বাজায় বাদকদল। নিচে নিউ ইয়র্ক শহরের আলোকমালা, যেন আলোর এক বিশাল সমুদ্রের মত ছড়ানো। যেদিকে তাকানো যায় শুধু আলো আর আলো। শব্দেরও কমতি নেই। প্রাণবন্ত শহরের অবিরাম গুঞ্জন, চলছেই, চলছেই।
পরদিন খুব সকালে উঠল ওরা। ব্রুকলিন থেকে মাটির নিচের পথ দিয়ে গেল কনি আইল্যান্ডে। সেখানে আরও অনেক ট্যুরিস্টের সঙ্গে বিখ্যাত অ্যাকোয়ারিয়াম দেখল। পটেটো নিশ খেলো ওরা ওখানে। ঠোঁট চাটতে চাটতে কিশোর বলল, মেরিচাচীকে গিয়ে বলতে হবে এ কথা। সে তো মনে করে সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে ভাল নিশ সে-ই কেবল বানায়। এখানকারটা খেলে বুঝতে পারত কি জিনিস।
ধীরে ধীরে স্ট্যাচু অভ লিবার্টির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। দিন শেষে খাওয়া সারতে গেল ওঅর্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। এত উঁচুতে বসেছে, ছোট আকারের প্লেনগুলো উড়ছে ওদের নিচ দিয়ে। গোগ্রাসে গিলছে মুসা। চারপাশে তাকাচ্ছে। যেন বুঝতে পারছে না কোনদিকে আগে তাকাবে।
তৃতীয় দিনও ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাতে লাগল ওরা। ঐতিহাসিক গ্রীনউইচ ভিলেজ দেখতে চলে গেল। দুপুরের খাওয়া খেলো চায়নাটাউনে।
লাঞ্চের পর তার ফরচুন কুকিতে পাওয়া কাগজের টুকরোটা খুলে পড়লেন রাবাত। তার ভাগ্যলিপিতে বলা হয়েছে:
আজ রাতে প্রেমে সার্থক হবে তুমি।
তিন গোয়েন্দা তো হেসেই বাঁচে না। হাসতে লাগলেন রাবাতও। এমন উদ্ভট কথায় কে না হাসে? তারপর গেল ওরা রকেটির রেডিও সিটি মিউজিক হল দেখতে। ডিনার খেলো লিনডিতে। নিউ ইয়র্কের অসামান্য স্বাদের পনির কেক খেলো। রাতে হোটেলে ফিরে এতটাই ক্লান্ত বোধ করল, বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুম।
চতুর্থ দিন সকালে গেল মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অভ আর্টে, তারপর এসেছে সেন্ট্রাল পার্কে। বেঞ্চে বসেছে রোদের মধ্যে। ঠেলাগাড়িতে করে খাবার বিক্রি করছিল ফেরিওয়ালা। একজনকে ডেকে বিশেষ ধরনের রুটির ভেতরে ভেড়ার মাংস কেটে কেটে দিয়ে তৈরি করা সুভলাকি স্যান্ডউইচ কিনে খেয়েছে।
এখন, ওরা রয়েছে পার্কের আরেক প্রান্তে। মিউজিয়াম অভ ন্যাচারাল হিস্টরির সামনে।
এতসব ঘোরাঘুরির সময়, প্রায়ই বাদামী রঙের সোয়েটার আর ধূসর স্ন্যাকস পরা একজন তরুণকে আশেপাশে দেখেছে। আরও একজনকে দেখেছে নেভি ব্লেজার পরা, খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা, রুক্ষ চেহারার মাঝবয়েসী লোক। কখনও দুজনে একসঙ্গে থাকে, কখনও একজন এদিক থাকলে আরেকজন ওদিক।
এফ বি আইয়ের লোক, রবিন বলল। ওরা কাছাকাছি থাকলে সাহস পাই।
কিন্তু এরা কতটা কি করতে পারবে বুঝতে পারছি না, মুসার গলায় সন্দেহ। যাদের ধরতে এসেছে, বিশেষ করে মিলারের দোস্তটা একটা ইন্টারন্যাশনাল স্পাই। গোলাগুলি চলতে পারে।
এ সব আলোচনা বাদ দে, নিষেধ করলেন রাবাত। যখন চলে, দেখা যাবে। সামলানোর ক্ষমতা না থাকলে এদের পাঠাত না অফিস।
নানার মেজাজ খারাপ, আন্দাজ করতে পারল মুসা। অতিরিক্ত ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সকালে বিছানা থেকে উঠতেই কষ্ট হয়েছে। মুসা অবশ্য আসতে মানা করেছিল। বলেছে, নানা, শুয়েই থাকো। নাস্তার জন্যে খবর পাঠাচ্ছি। ঘরেই থাকি আজ। মিলারের কথা ভুলে যাই বরং। সে আর আমাদের খুঁজে পাবে না।
পাবে! প্রায় ধমকে উঠেছেন রাবাত। ওকে ধরার এই সুযোগ কোন কিছুর বিনিময়েই ছাড়তে রাজি নই আমি!
মিলারের প্রতি রাবাতের রাগ দেখে মুচকি হেসেছে কিশোর।
আজ কিছু ঘটবেই, রাবাত বলেছেন। মন বলছে আমার।
সুতরাং সেই মন বলার কারণেই এখন পার্কে বসে আছে ওরা। বিকেল। হয়ে গেছে। কিছুই ঘটেনি এখনও। বাদামী সোয়েটার পরা লোকটা নেই আশেপাশে। নীল ব্লেজার পরা লোকটা আছে। এককোণে দাঁড়িয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রীম কিনে খাচ্ছে। চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি।
আমাদের আসলে চোখে পড়ছে না ওদের, মুসা বলল। এতবড় শহরে কোথায় খুজবে মিলার? এমন কিছু করা উচিত আমাদের, যাতে সবার নজরে পড়ে যাই–এই যেমন এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের দেয়াল বেয়ে ছাতে ওঠার চেষ্টা, কিংবা হাডসন নদীতে সাঁতার কাটা। টেলিভিশনে দেখানো হবে আমাদের। মিলার তখন জানতে পারবে আমরা কোথায় আছি।
ভুরু কুঁচকে মুসার দিকে তাকালেন রাবাত। তোর মায়ের মাথায় গোবর বলেই তোর এই অবস্থা!
ফোড়ন কাটতে ছাড়ল না মুসাও, মগজ থাকার কি খেসারত যে দিতে হচ্ছে, সে-ও দেখতেই পাচ্ছি!
ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল কিশোরের মুখে। টেলিভিশন।
এইবার ভুরু কোঁচকানোর পালা মুসার। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, খাইছে! সত্যি সত্যি আবার নদীতে ঝাঁপ দিতে বলবে না তো? আমি রসিকতা। করছিলাম।
টেলিভিশনে যেতে হলে নদীতে ঝাঁপ দেয়া কিংবা বিল্ডিঙে চড়া লাগে না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। কোনো কুইজ শোতে যেতে পারি। কিংবা নতুন মুখদের অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়া যেতে পারে।
হোটেল উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যোগ দিলে কেমন হয়? রবিন বলল, পত্রিকায় পড়েছি, একটা নতুন হোটেল ভোলা হচ্ছে নিউ ইয়র্কে। নাম রাখা হচ্ছে নিউ উইন্ডসর। লোকের আগ্রহ আছে ওটার ওপর, কারণ, বছর দুই আগে পুড়ে যাওয়া আরেকটা হোটেলের জায়গায় তৈরি হচ্ছে ওটা। অনেক বড় পার্টি দেবে। গভর্নরও আসতে পারেন।
কবে খুলছে?
কাল রাতে। গভর্নর এলে টিভির লোকেরা আসবেই ক্যামেরা নিয়ে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদের দাওয়াত পাওয়ারও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে এফ বি আই। হোটেলটাতে ঘর নেয়া গেলে আরও সুবিধে। মিলার আর ব্যালার্ড জেনে যাবে কোথায় আছি আমরা।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। সোজা রওনা দিল নীল ব্লেজার পরা লোকটার দিকে। কাছে এসে বলল, কাল রাতে নিউ উইন্ডসরের উদ্বোধনী পার্টিতে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া কি এফ বি আইয়ের পক্ষে সম্ভব?
এত চমকে গেল লোকটা, হাত থেকে আইসক্রীম পড়ে গেল। ভাবতেই পারেনি তাকে চিনে ফেলবে একটা ছেলে।
টিভির নিউজ সেকশনের লোক নিশ্চয় আসবে, বুঝিয়ে বলল কিশোর। আইসক্রীম পড়ে যাওয়াটাকে পাত্তাই দিল না। লোকটার জুতোর ওপর পড়ে গলছে ওটা। হোটেলটা খোলার ব্যাপারে বাইরের লোকের মতামতও নিশ্চয় নেয়া হবে। প্রতিবেদক যদি আমাদের একজনকে প্রশ্ন করে, তাহলে বলতে পারি আমরাও ওই হোটেলে উঠেছি। ভাল লাগছে। হ্যারিস মিলার তখন জেনে যাবে আমরা কোথায় আছি। সারা নিউ ইয়র্কে আমাদের পেছনে ঘুরে বেড়ানোর ঝামেলা থেকে বাঁচবেন আপনিও।
সামলে নিয়েছে ততক্ষণে লোকটা। লম্বা দম নিল। বলতে চাইল,–কিশোর কি বলছে সে বুঝতে পারছে না। তারপর ভাবল বোধহয়, অহেতুক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এই ছেলেকে বোকা বানাতে পারবে না। আরেকবার দম নিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়। জানাব।
রাস্তার দিকে চলে গেল সে।
বন্ধুদের কাছে ফিরে এল কিশোর। জানাবে বলে গেল।
কিন্তু আমাদের যে এখানে একা ফেলে গেল, রাবাত বললেন।
নানা, মরিয়া হয়ে বলল মুসা, অমন অসহায়ের মত ভঙ্গি কোরো না তো! তোমাকে অসহায় বলা, আর ভয়ানক শারম্যান ট্যাংককে খেলনা বলা। একই কথা। তোমার সঙ্গে লাগতে এলে বরং মিলারই অসহায় হয়ে যাবে।
মুসার কথায় হাসি ফুটল রাবাতের মুখে। মেজাজ অনেকটা ঠিক হয়ে এল। ট্যাক্সি নিয়ে রিভারভিউ প্লাজায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
সেদিন সন্ধ্যায়ই ফোন বাজল। রাবাত ধরলেন। হোগারসন করেছে। জানাল, নিউ উইন্ডসরে ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আগামী কাল যেন চলে যান।
গাঢ় রঙের স্যুট কিংবা রেজার আছে আপনাদের? জানতে চাইল হোগারসন। টেলিভিশনে চেহারা যদি দেখাতেই হয়, লোকে যাতে বোঝে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যেই বহুদূর থেকে ছুটে এসেছেন আপনারা। তৈরি হয়ে এসেছেন।
কিন্তু নেই তো! কিছুটা নিরাশ মনে হলো রাবাতকে।
থাক, চিন্তা করবেন না। জোগাড় করে দেয়া যাবে।
.
১৯.
পুরোপুরি শেষ হয়নি হোটেল বাড়িটার কাজ। বিশাল গুহার মত দেখতে লবিটার বাতাসে রঙ আর অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের কড়া গন্ধ। লিফটের কাছে একজন রুম সার্ভিস ওয়েইটারের সঙ্গে দেখা। রবিনের অনুরোধে তাকে একটা ছাপানো নকশা দিল সে, তাতে হোটেলের কোন ফ্লোরে কি আছে দেখানো আছে। ওদের ঘরগুলো রয়েছে তেত্রিশ নম্বর ফ্লোরে। রিয়ারভিউর ঘরের চেয়ে ছোট। তবে ওটা যেমন চারদিক থেকে বদ্ধ, এটা তেমন নয়, রাবাতের ঘর থেকে ঈস্ট রিভার চোখে পড়ে।
পাঁচটার সময় হোটেলে এসেছে ওরা। লবিতে যন্ত্রপাতি বসিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে টিভির লোকেরা। ছয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে যখন এফ বি আইয়ের দেয়া গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার পরে নামল আবার, আলোয় ঝলমল করছে তখন লবিটা। মেসেজ ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে আছে হোগারসন। ওদের প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল একজন প্রতিবেদকের সঙ্গে।
লম্বা, সুদর্শন একজন লোক। ঝকঝকে সাদা দাঁত। সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল। রাবাতের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় তাঁর বাঁ কানের পাশ দিয়ে পেছনে তাকাল। তারপর তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল একজন
মহিলাকে স্বাগত জানানোর জন্যে। রিভলভিং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। মহিলা। গায়ের জ্যাকেটে প্রচুর ঝলমলে পুতি আর আয়নার টুকরো বসানো।
টিভি ক্যামেরার লাল আলো জ্বলে উঠল। একধারে দাঁড়ানো কানে হেডফোন পরা একজন ইঙ্গিত করল একজন ঘোষককে। ক্যামেরার সামনে এসে ঘোষক বলতে লাগল, সে নিউ উইন্ডসরের লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে যিনি রয়েছেন তার নাম মনিকা কনসর, হোটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। যোগ দিতে সেই রোম থেকে উড়ে এসেছেন।
মিসেস কনসর ভি আই পি, সন্দেহ নেই, কিন্তু তার আর কোন পরিচয় দিল না ঘোষক। তিন গোয়েন্দা ভাবল, এখানে উপস্থিত অতিথিরা নিশ্চয়।
মহিলার পরিচয় জানে, কেবল ওরা তিনজন আর মিস্টার রাবাতই জানেন না। হাসিতে ঠোঁট এত ছড়িয়ে ফেললেন মহিলা, মুসার ভয় হতে লাগল ছিঁড়ে না যায়। অল্প দুচারটা কথা বলেই সরে গেলেন।
আচমকা রাবাত আর তিন গোয়েন্দার দিকে নজর দিল ঘোষক। হাত তুলে স্বাগত জানানোর ভঙ্গি করল। মুহূর্তে ওদের দিকে ঘুরে গেল ক্যামেরার চোখ।
আর ইনি হলেন মিস্টার আরমান রাবাত, চেঁচিয়ে উঠল ঘোষক, যেন হঠাৎ করে তাকে চোখে পড়ে যাওয়ায় অবাক হয়েছে। অত্যন্ত সম্মানিত একজন মেহমান। বহুদূরের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছেন শুধু এই অনুষ্ঠানে, যোগ দেয়ার জন্যে।
ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি হাসলেন রাবাত। ঘোষকের হাত চেপে ধরলেন। সহজে আর ছাড়তে চাইলেন না। ঘোষক বলল–পুরানো ওয়েস্টমোর হোটেলেটা যখন এখানে ছিল, তখন তার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এলে ওটাতে ছাড়া আর কোথাও উঠতেন না। তাঁর স্ত্রী এখন পরপারে; ঈশ্বর তার বিদেহী আত্মার মঙ্গল করুন!! তাড়াতাড়ি বলতে গেলেন রাবাত, আমি আর আমার স্ত্রী হানিমুন করেছি…
কথা শেষ করতে দিল না ঘোষক, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে দিল, অবশ্যই ওয়েস্টমোর হোটেলে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। পারল না।
গমগমে কণ্ঠে রাবাত বললেন, প্রায়ই আসতাম আমরা। ওয়েস্টচেস্টার পুড়ে যাওয়ার খবর শুনে তো রীতিমত মুষড়ে পড়েছিলাম। তবে আর চিন্তা নেই। ওটার চেয়ে ভাল হোটেল নিউ উইন্ডসর এখানে দাঁড়িয়ে গেছে। এখনও কাঁচা কাঁচা গন্ধ আছে বটে, তবে কেটে যাবে। খুব শীঘি কেটে যাবে, ঠিকমত চালু হলেই। এই ছেলেগুলোকে নিয়ে এসেছি এবার, নিউ ইয়র্ক দেখাতে। এদের একজন আমার নাতি, অন্য দুজন তার বন্ধু ক্যামেরার চোখ ঘুরে গেল কিশোর, মুসা আর রবিনের হাসি হাসি মুখের দিকে। পুরো হপ্তাটাই এখানে কাটিয়ে যেতে চাই আমরা। খুব উপভোগ করছে ওরা। ইতিমধ্যেই রোলার কোস্টারে করে কনি আইল্যান্ড ঘুরিয়ে এনেছি ওদের।
এই সময় হাতের চাপ সামান্য শিথিল হতেই তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিল ঘোষক। তার পেশাদারী হাসিটা বিন্দুমাত্র মলিন না করে দ্রুত পিছিয়ে গেল। রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে ধন্যবাদ দিল। ব্যস, কাজ শেষ।
ঘোষকের মতই তাড়াহুড়ো করে ওখান থেকে সরে এলেন রাবাত। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ছেলেদের দিকে তাকালেন, কি বলেছি আমি, বলো তো? ঠিকঠাক মত বলেছি তো সব?
হেসে মুসা বলল, দারুণ বলেছ তুমি, নানা। একটা ভুলই কেবল করেছ, ওয়েস্টমোরের জায়গায় ওয়েস্টচেস্টার বলে ফেলেছ।
তাই নাকি? মোটেও চিন্তিত মনে হলো না রাবাতকে। একই কথা। মিথ্যে যে এতগুলো বলতে পেরেছি, এই বেশি। নিউ উইন্ডসরে যে থাকব, এটা ঠিকমত বলেছি তো?
তা বলেছ।
তবে আর চিন্তা নেই। ওই ছুঁচো মিলারটাকে জানিয়ে দেয়া হলো, কোথায় আমাদের পাওয়া যাবে।
ওখানে থাকার আর কোন দরকার নেই। ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন রাবাত। সিটিক্রপ বিল্ডিঙের একটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে চললেন ওদের।
রিসিপশনের কাছে দাঁড়িয়ে ওদের বেরোতে দেখল হোগারসন। বাধা দিল না।
ভাবতে ভাবতে চলেছে তিন গোয়েন্দা, কাজ যা করার তো করা হলো। মিলার আসতে কত সময় নেবে?
.
২০.
পরদিন সকালে নাস্তা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তিন গোয়েন্দা, এই সময় হোটেলের কফি শপে ঢুকলেন রাবাত। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন, রাত জেগে টেলিভিশনে নিজের ইন্টারভিউ দেখেছেন। লেট নাইট নিউজ দেখেছেন, লেট-লেট নাইট নিউজ দেখেছেন। মূসার পাশে হাসিমুখে বসতে বসতে জানালেন, সকালের খবরেও তার ইন্টারভিউ দেখানো হয়েছে।
কফি শপে হোটেলের আরও অনেক মেহমান নাস্তা খাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে হাসলেন, যেন সাংঘাতিক কেউকেটা কিছু হয়ে গেছেন। এখনই সবাই অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে সই নিতে ছুটে আসবে। খাতা না আনলেও মেনু হাতে এগিয়ে এল ওয়েইটার। তার মুখের দিকে তাকালও। তবে চিনতে পারার কোন লক্ষণ নেই তার চোখে।
রেগে গেলেন মনে হলো রাবাত। জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। আদেশ দিলেন, কফি। প্যানকেক। দুটো ডিম। আর গরুর মাংস ভাজা। এ চমকে গেল মুসা। নানা, তোমার না ডিম আর গরু খাওয়া বারণ। কোলেস্টেরল:..
চুলোয় যাক কোলেস্টেরল! ধমকে উঠলেন রাবাত। ময়লা জমলে, আমার শিরায় জমবে, তোর মাথাব্যথা কেন? আজ সারাদিনে অনেক ঘটনা ঘটবে, এনার্জি দরকার হবে আমার। সুতরাং সেটা এখনই জোগাড় করে নিতে, হবে।
কিন্তু খাওয়ার পর ঘটনা আর ঘটে না। এনার্জি খরচেরও প্রয়োজন পড়ছে রাবাতের। হোটেলের লবিতে বসে থাকার ব্যবস্থা করেছে তিন গোয়েন্দা। বার বার অহেতুক ক্যামেরা আর ক্যামেরার ব্যাগে হাত বোলাচ্ছে রবিন। এফ বি আইয়ের দুজনেই উপস্থিত। নীল ব্লেজার পরা লোকটা ঢুকেছে গিফট শপে, জিনিস দেখার ভান করছে। নিউজ কাউন্টারে ম্যাগাজিন ওল্টাচ্ছে বাদামী সোয়েটার।
আসছ না কেন, মিলার? বিড়বিড় করলেন রাবাত। আমরা তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি।
তা কিন্তু তা-ও কিছু ঘটল না। আধঘণ্টা গেল। এক ঘণ্টা। ঘড়ির কাটা চলছে।
বেলা এগারোটায় মেজাজ গরম হতে আরম্ভ করল তার। সাড়ে এগারোটায় ফুটতে শুরু করল।
আশ্চর্য! বললেন তিনি। সেই কখন থেকে বসে আছি, মনে হচ্ছে বছর পেরিয়ে গেছে। গাধাটা সাক্ষাৎকার দেখেনি নাকি? ছাগল কোথাকার! খবরও দেখে না! ধূর্ত হাসি ফুটল ঠোঁটে। আজ বিকেলে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে একটা ডাবল গেম আছে। দেখতে যাবি নাকি, মুসা?
যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না, মুসা বলল। মিলার আর তার দোস্ত সাক্ষাৎকারটা দেখেছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। দেখলে এখানে খুঁজতে আসবেই। তখন আমরা না থাকলে এতদিনের কষ্ট অহেতুক যাবে।
বাইরে থেকে একটু ঘুরে এলেও পারি, রাবাত বললেন। এখানে বসে থেকে ভুল করছি আমরা। হয়তো ঢোকার সাহসই পাচ্ছে না। বাইরে গিয়ে ওদের সুযোগ করে দেয়া উচিত।
আমার মনে হয় না, কিশোর বলল, আমরা বাইরে বেরোলেও ওদের হারাতে হবে। এসে আমাদের না পেলে অপেক্ষা করবে ওরা। কিংবা আবার। আসবে। এতদূর আমাদের পিছু ধাওয়া করে আসতে পেরেছে ওই ফিল্মের জন্যে। এত সহজে হাল ছাড়বে না।
সুতরাং বসে না থেকে বাইরে ঘুরে আসারই সিদ্ধান্ত হলো। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে মেসেজ ডেস্কে এসে দাঁড়ালেন রাবাত। ইয়াংকি স্টেডিয়ামে যেতে হলে কোন্ ট্রেন ধরতে হবে, এবং সেটা মাটির নিচ দিয়ে যায় কিনা, জিজ্ঞেস করলেন।
দুপুর বেলা সদলবলে হোটেল থেকে বেরোলেন রাবাত। হোটেলের দুই ব্লক দূরেই একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন। আধ ব্লক পেছনে লেগে রইল দুই এফ বি আই। প্ল্যাটফর্মে নেমে প্রথম ট্রেনটা ইচ্ছে করে মিস করল গোয়েন্দারা, ওই দুজনকে আসার সময় দিল, ওরা এখনও এসে পৌঁছায়নি। পরের ট্রেনটায় চড়ল সবাই। এফ বি আইরা রইল কামরার এক প্রান্তে, গোয়েন্দারা আরেক প্রান্তে। ব্রংক্স বল পার্কের দিকে চলল ট্রেন। চতুর্দিকে কড়া নজর রাখলেন রাবাত। মিলাররা পিছু নিয়েছে কিনা দেখছেন।
স্টেডিয়ামে এসে ভান করলেন যেন তারা নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। তাতে খেলা দেখার সুবিধে আছে। খেলা দেখতে বসলে কোনও এক পক্ষকে সমর্থন করতে হয়। সেই পক্ষের দর্শকদের মধ্যে বসা ভাল। এবং সেটাই করলেন। তিনি। ইয়াংকিদের মধ্যে, বসলেন। প্রথম গেমে এক রান এগিয়ে রইল ইয়াংকিরা। সুতরাং প্রচুর চেঁচাতে পারলেন তিনি। আশেপাশে ইয়াংকি সমর্থক থাকায় চেঁচাতে কোন অসুবিধে হলো না।
বিরতির সময় হট ডগ খাওয়া হলো। নাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলেন তিনি। দুজনের কেউই জিততে পারলেন না। রবিন আর কিশোরও প্রচুর খেল, তবে নানা-নাতির ধারেকাছেও যেতে পারল না।
শুরু হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের খেলা। শুরুতেই ইয়াংকিদের হারিয়ে দিল বহিরাগত টীম। নিজের আর বাইরের দল, দুটোকেই গালাগাল শুরু করল ইয়াংকি সমর্থকরা। সিটি বাজিয়ে, নানা রকম কটু কথা বলে উত্তেজিত করে জেতানোর চেষ্টা করতে লাগল। খেলার উত্তেজনায় কখন যে তাদের দলে মিশে গেলেন রাবাত আর তিন গোয়েন্দা, খেয়ালই রইল না। শেষ পর্যন্ত যখন ব্রংক্স বহুবাররা হেরে গেল, শির উঁচু করে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে বেরোনোর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। ঘাড় কাত করে মুসার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি, বলেছিলাম না ইয়াংকিরা জিতবে?
প্রচুর দর্শক হয়েছে। বেরোনোর গেটে ভিড়। ঠেলাঠেলি করে বেরোতে হচ্ছে। কনুইয়ের গুতো মেরে ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোলেন। রাবাত। স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে রেল স্টেশনে চলে এলেন। জনতার কোলাহল বিরক্তিকর, তবু বিকেলটা ভাল লাগল তার। সুন্দর বাতাস বইছে।
ম্যানহাটানের ট্রেন এসে দাঁড়াল। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। রাবাত যে কামরাটায় উঠলেন, তাতে বেজবল খেলার বেশ কিছু ভক্তও উঠেছে। দরজা বন্ধ হলো। চলতে শুরু করল ট্রেন। মুসার চোখে পড়ল বাদামী সোয়েটার পরা এফ বি আইকে, প্ল্যাটফর্মে জনতার ভিড়ে আটকা, পড়েছে সে, পাগলের মত তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, ওদেরকে খুঁজছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিল মুসা। দেখতে পেল লোকটা। গতি বেড়ে গেছে। ট্রেনের। বাদামী সোয়েটারকে ফেলে রেখেই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে চলে। এল।
মুসার দুপাশে চেপে আছে দুজন ভক্ত। একজন হোঁৎকা বিশালদেহী লোক, গায়ে স্পোর্টস কোট; আরেকজন মুসার চেয়ে দু-এক বছরের বড় হবে, কোন কিছু না ধরেই দাঁড়িয়ে আছে, একনাগাড়ে পিনাট খেয়ে চলেছে। শরীর মোড়ামুড়ি করে কোনমতে দুজনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে কিশোরের কাছে চলে এল মুসা। একটা ধাতব হ্যান্ড-স্ট্র্যাপ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
বডিগার্ডকে খুইয়েছি, তাকে বলল মুসা। বাদামী সোয়েটার পরা লোকটাকে প্ল্যাটফর্মে দেখলাম, উঠতে পারেনি।
বডিগার্ড? হেসে উঠল হাড্ডি সর্বস্ব একটা মেয়ে। বয়েস ষোলো সতেরো হবে। মাথায় বেগুনী রঙের কাপড় অনেকটা পাগড়ির মত করে পেচিয়েছে। সেটে আছে প্রায় কিশোরের গায়ের সঙ্গে। অকারণ কথা বলে বলে তার কান পচিয়ে ফেলার জোগাড় করেছে। গায়ে মাংস না থাকলে কি হবে, গলাটা যেন মাইক। এমন করে ফাটা বাশে বাড়ি মারছে, কিশোরের ভয় হতে লাগল, কামরার সব লোকই শুনে ফেলবে। কিসের বডিগার্ড? ভি আই পি নাকি তোমরা! বাব্বাহ, বডিগার্ডও থাকে সঙ্গে! পরের বার প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে দাঁড়াবে নাকি!
খুব সাংঘাতিক কোন রসিকতা করে ফেলেছে যেন মেয়েটা, এমন ভঙ্গিতে নিজের কথায় নিজেই পুলকিত হলো। তার কথায় মজা পেল আরও কয়েকজন যাত্রী। মুসার দিকে তাকাল।
দুষ্টবুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল কিশোরের চোখে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেবো না। ওকে আর দরকার হবে না। ইনকিউবেশন পিরিয়ড কালই শেষ হয়ে গেছে তোমার।
শক্ত হয়ে গেল মেয়েটা। সতর্ক হয়ে উঠল। ইনকিউবেশন! কেঁপে উল ফাটা বাঁশ। কিসের ইনকিউবেশন? ছোঁয়াচে রোগে ধরেছিল নাকি?
না না, মাথা নাড়ল মুসা, কিসের রোগ! ও এমনি এমনি বলছে! মিথ্যে বলা ওর স্বভাব!
মুসার বলার ভঙ্গিতে সন্দেহ আরও বাড়ল মেয়েটার। কিশোরের কাছ থেকে সরার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মুসার কাছে থাকাটাও বিপজ্জনক। কোন রোগ, কে জানে! চিকেন পক্সও হতে পারে! তাড়াতাড়ি সরে যেতে লাগল। সে। কামরার একেবারে আরেক ধারে চলে গেল। পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে গেল। পক্সের ভয়ে তার সঙ্গে নামল আরও কয়েকজন।
ম্যানহাটানে পৌঁছার আগেই আরও অনেকে নেমে গেল। ভিড় আর আগের মত নেই। কামরার মাঝখানে প্রচুর জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়েছে রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে। তাদের কাছাকাছি আসতে ভয় পাচ্ছে লোকে।
রাবাতকে বলল কিশোর, এফ বি আইয়ের লোকটা ট্রেনে উঠতে পারেনি। প্ল্যাটফর্মে তাকে থেকে যেতে দেখেছে মুসা।
তাতে আর অসুবিধে কি? রাবাত বললেন। এখানে মিলারও নেই, তার দোস্তও নেই।
তা ঠিক। যাত্রীদের ওপর আরেকবার চোখ বোলাল তিন গোয়েন্দা। মিলার কিংবা ব্যালার্ডের সঙ্গে কারও সামান্যতম মিলও নেই।
ফোরটি-সেকেন্ড স্ট্রীটে এসে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল ওরা। একটা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করলেন রাবাত, যেটা ধরে গেলে পথ বাঁচবে। অল্প সময়ে পৌঁছতে পারবেন হোটেলে। অন্ধকার সুড়ঙ্গমুখটা দেখতে ভাল লাগল না মুসার। মনে হলো, ওর মধ্যে ঢোকাটা উচিত হবে না। সমর্থনের আশায় রবিন আর। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কিছু বলল না ওরা। নীরবে এগোল রাবাতের। পিছু পিছু। অগত্যা মুসাকেও যেতে হলো।
সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি পৌঁছে একটা ডাক কানে এল, দাঁড়াও, রাবাত!
পুরো সুড়ঙ্গটা নির্জন, নিজেদের বাদে আর কাউকে দেখেনি এত ক্ষণ। এবার দেখল। এগিয়ে আসছে আরেকজন। হাসি হাসি মুখ। বিচিত্র একটা রেনকোট পরা থাকায় আগের চেয়ে খাটোও লাগছে, মোটাও।
মিলার! চিৎকার করে উঠলেন রাবাত।
যাক, দেখা তাহলে হলো, মিলার বলল। অনেক দিন পর, কি বলো।
নীরব সুড়ঙ্গ। এতটাই নীরব, কোথায় যেন টপ টপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে, তা-ও কানে আসছে।
পেছনে কথা বলে উঠল আরেকজন, ক্যামেরার ব্যাগটা আমি নিয়ে নিচ্ছি।
মনটিরেতে এই লোককেই দেখেছে গোয়েন্দারা, মিলারের দোস্ত, ব্যালার্ড। হাতে উদ্যত পিস্তল, রবিনের দিকে ধরে রেখেছে।
প্রতিবাদ না করে ব্যাগটা দিয়ে দিল রবিন।
ফিল্মগুলো আছে কিনা, দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিল লোকটা। মিলারের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, ঠিকই আছে। রাবাত আর গোয়েন্দাদের আদেশ দিল, ভেতরে যাও। সবাই।
পিস্তল দিয়ে সুড়ঙ্গের একটা দরজার দিকে ইশারা করল সে। খিল খুলে দিল মিলার। তার ওপাশে একটা দেয়াল আলমারি। সেঁতসেতে। ঝাড়ু, মেঝে পরিষ্কার করার স্পঞ্জ আর জীবাণু ও কীট-পতঙ্গনাশক ওষুধের টিনে বোঝাই।
ঢোকো! পিস্তল নেড়ে আবার আদেশ দিল ব্যালার্ড।
ঢুকতে বাধ্য হলো চারজনে। দরজা লাগিয়ে দেয়া হলো বাইরে থেকে। খিলটাকে ভালমত আটকে রাখার জন্যে তার মধ্যে কাঠি জাতীয় কিছু ঢোকানোর শব্দ পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে সরে গেল পদশব্দ।
বাঁচাও! চিৎকার করে উঠল মুসা। কে আছ, আমাদের এখান থেকে বের করো।
২১.
দীর্ঘ একযুগ পরে যেন রেলের একজন টিকেট বিক্রেতা এসে মুক্ত করল ওদের। রাবাতদের মতই সুড়ঙ্গ দিয়ে চলেছিল একজন পথচারী। আলমারির মধ্যে আজব আওয়াজ শুনতে পেয়ে সন্দেহ জাগে। রেলের অফিসে গিয়ে জানায়। একজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে এসেছে টিকেট বিক্রেতা। রাবাতকে প্রশ্ন শুরু করল পুলিশের লোকটা। কোন কথারই জবাব দিলেন না রাবাত। বিরক্ত হয়ে বরং এক ধমক লাগালেন তাকে। ছেলেদের নিয়ে সুড়ঙ্গ পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হোটেলে ঢুকেই হোগারসনকে ফোন করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল হোগারসন। আগের মতই শান্ত।
এতে রাগ আরও বেড়ে গেল রাবাতের। ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। চিৎকার করে বললেন, এত কষ্ট করে টাকা কামাই করে ট্যাক্স দিই, সেই ট্যাক্সের টাকায় বেতন পান আপনারা, আর সেবা করার এই নমুনা। রাস্তাঘাটে জান নিয়ে টানাটানি পড়ে আমাদের। দুটো:ডেঞ্জারাস স্পাইকে ধরার জন্যে আপনাদের সাহায্য চেয়েছিলাম। আমাদের কাজ তো ঠিকমতই করেছি, আপনার লোক কোথায়? ঘুমোচ্ছিল নাকি?
অনেকটা সে-রকমই, মিস্টার রাবাত, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল। হোগারসন।
ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠলেন রাবাত। তাকে শান্ত করতে সময় লাগল হোগারসনের।
সারাদিন কোথায়, কি ভাবে কাটিয়েছেন, জানালেন তখন রাবাত। বার বার অভিযোগ করলেন দুর্গন্ধে ভরা, বাতাসহীন, ময়লা ঝাড়ুতে বোঝাই আলমারির মধ্যে আটকে থাকতে হয়েছে বলে।
জঘন্য! বলে বক্তব্য শেষ করলেন তিনি।
ঠিক, একমত হলেন হোগারসন। এ রকমটা ঘটা মোটেও উচিত হয়নি।
মেজাজ একেবারে নরম হয়ে গেল রাবাতের। এতক্ষণে বসলেন।
হোগারসন বলল, আমাদের এজেন্টরা সব ছড়িয়ে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক থেকে বেরোনোর সমস্ত পথে পাহারা দিচ্ছে ওরা–এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন, বাস স্টেশন, সুড়ঙ্গমুখ, ব্রিজ, কোথাও বাদ নেই। শহর থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলে ওই দুজন ধরা পড়বেই।
যদি না পড়ে? প্রশ্ন করলেন রাবাত। এখানে এ ভাবে অকর্মণ্য হয়ে বসে থাকব নাকি আমরা?
যা মোটেও না। আপনাদের কাজ শেষ। আপনাদের আর বিরক্ত করবে না ওরা। মিলার তার ফিল্ম পেয়ে গেছে। ব্যালার্ডকে দিয়ে দেবে। ব্যালার্ড যখন ফিল্মগুলো ডেভেলপ করে দেখবে কিছুই নেই, বুঝবে আসল ছবিগুলো আমাদের হাতে পড়েছে। আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে আসার সাহস তার হবে না। গা ঢাকা দেবে। ধরে নিতে হবে, আমরাই জিতলাম। আপনাদের আর ভয় নেই।
দুই দুইজন স্পাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার রেগে গেলেন রাবাত, আর আপনি বলছেন ভয় নেই! বাহ্, চমৎকার কথা!
হাসল হোগারসন। আর কোনদিন স্পাই হতে পারবে না মিলার, সেই সুযোগই পাবে না। তার শয়তানি ফাঁস করে দিয়েছেন আপনারা। গর্বিত হওয়া উচিত আপনাদের। যে কোন ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে হলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট জমা দিতে হয়। যেখানে চাকরি করত, তার ধারেকাছেও আর যেতে পারবে না। নাম ভাড়িয়ে যদি আবার কোথাও চাকরির দরখাস্ত দেয়, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হবে, বাঁচতে পারবে না তখন আমাদের হাত থেকে। তবে আমার মনে হয় না এই বোকামি করার সাহস পাবে সে। আমেরিকায় থাকতে হলে চিরকাল পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে এখন থেকে। জানের শান্তি নষ্ট হবে। সেটা আরও বড় জেল।
সন্তুষ্ট হতে পারলেন না রাবাত। কিন্তু তার সঙ্গের শুয়াপোকাটার কি হবে? ব্যালার্ড না ফ্যালার্ড? যদি সে আবার কিছু করার চেষ্টা করে? আমার তো মনে হয় না সে স্পাইগিরি ছেড়ে দেবে।
আমারও না, একমত হলো হোগারসন। তবে তার খোঁজে লোক লাগিয়ে রাখব আমরা। ভালমত খোঁজা হবে। মিস্টার রাবাত, আপনি আর। তিন গোয়েন্দাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক সাহায্য করেছেন আপনারা।
চলে গেল হোগারসন। দরজা লাগিয়ে দিয়ে এল রবিন। পরিস্থিতি সহজ হলো না, কেমন ভারী হয়ে রইল।
মুসা বলল, কোন কাজই হলো না!
ওই হোগারসনটা একটা অপদার্থ! নাক দিয়ে ঘোঁৎ-ঘোৎ করতে লাগলেন রাবাত। দুধের শিশু পেয়েছে আমাদের! একটা কিছু বোঝাল, আর অমনি বুঝে গেলাম!
গম্ভীর হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদের অবস্থাটা হয়েছে, পিঠের নিচে ভাজ হয়ে থাকা এলোমেলো চাদর নিয়ে ঘুমানোর মত। রাতে বার বার ঘুম থেকে জেগে উঠে চাদর টানতে হবে।
তোমার এ সব মঙ্গলগ্রহের ভাষা ছাড়ো দেখি!
ব্যাখ্যা করতে গেল না কিশোর। গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। হোগারসন যা-ই বলে যাক, আসল ফিল্মগুলো না দেয়া পর্যন্ত মিলার বা ব্যালার্ডের হাত থেকে নিরাপদ নয় ওরা। দুজনকে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার আগে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না। তিন গোয়েন্দাও আরাম করে নিউ ইয়র্ক দেখতে পারবে না, রাবাতও তার আবিষ্কার হাত বদল করার ব্যাপারে মন দিতে পারবেন না।
পরদিন সকালে উঠে অবশ্য বেরিয়ে গেলেন তিনি। সারাদিন পর ফিরে এসে জানালেন, যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। কাজ এগোচ্ছে।
ফোর্ড গাড়িটা নিয়ে গেলেন একটা ওঅর্কশপে। সার্ভিসিং করাবেন। টুকিটাকি মেরামত থাকলে, সারিয়ে নেবেন। বাড়ি ফেরার পথে দীর্ঘ যাত্রায়। যাতে গোলমাল না করে ওটা। কি পরের কয়েকটা দিন খুব সকালে বেরিয়ে যান তিনি, ফেরেন সন্ধ্যায়। ছেলেরা থাকে নিজেদের মত। যেখানে ইচ্ছে ঘোরাফেরা করে। হাডসন নদীতে রাখা অনেক পুরানো একটা উভচর বিমান দেখতে গেল ওরা। টুরিস্টদের জন্যে রাখা হয়েছে ওটা দর্শনীয় বস্তু হিসেবে। গেল হেইডিন প্ল্যানেটোরিয়ামে। লিটল ইটালিতে পিজ্জা খেলো। মাথার অনেক ওপরে বসানো ট্রামলাইন ধরে বেড়াতে গেল রুজভেল্ট আইল্যান্ডে। রকফেলার সেন্টার দেখতে গেল। নানা জায়গার সুভনির কিনল। মিলারের সঙ্গে শেষ মোলাকাতের চারদিন পর সাক্ষাৎ হলো অর্কিড়ওয়ালা এক মহিলার সঙ্গে।
সিক্স অ্যাভেনু আর থার্টিয়েথ স্ট্রীটটা যেখানে মিলেছে, সেই মোড়ের কাছে ওদের পাশ কাটাতে গেল মহিলা। একটা ঝুড়িতে বসানো টবে অর্কিড নিয়ে চলেছে। গাছটা বেশ সুন্দর। ফ্যাকাসে সবুজ আর বাদামী রঙের, কাঁটাওয়ালা তিনটে চমৎকার ফুল।
শুনুন! ডাকল রবিন।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। এ তো অর্কিড!
লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। বিনয়ের অবতার সেজে জাপানী কায়দায় মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে বলল, সিমবিডিয়াম ফুল, তাই না?
উজ্জল হলো মহিলার মুখ। তুমি অর্কিড চেনো? সুন্দর ফুল, তাই না? চাষ করো নাকি?
আমার চাচা করে, নির্বিকার ভঙ্গিতে মিথ্যে বলে দিল কিশোর।
তাকে বিশ্বাস করল মহিলা। একটা জরুরী কাজ আছে আমার, ফুলটা আমার মেয়ের বাড়িতে রেখে সেখানে যাব। ফিরে এসে ফুলটা দেখাতে নিয়ে যাব। এইবার আর আমাকে পুরস্কার না দিয়ে পারবে না।
তাই নাকি? অর্কিড শো হচ্ছে নাকি শহরে?
ঠিক শো না। আমাদের স্থানীয় সৌখিন অর্কিড চাষীদের মাসিক সম্মেলন। প্রধান অতিথি হয়ে আসবেন স্যার ওয়ালথার মারিয়াট। বক্তৃতা দেবেন। অর্কিডে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ। এসো না তোমরাও? অর্কিডে আগ্রহী লোকদের বিনে পয়সায় অর্কিড বিতরণ করি আমরা। তোমাকেও দিতে পারব।, তোমার চাচাকে নিয়ে গিয়ে দেবে। নিউ ইয়র্কেই থাকো কোমরা?
না, ক্যালিফোর্নিয়ায়।
বাবা, অনেক দূর থেকে এসেছ! বেড়াতে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
অর্কিডের ঝুড়িটা মুসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পার্স খুলে কার্ড বের করল মহিলা। তাতে ঠিকানা লিখে কিশোরকে দিয়ে বলল, রাত আটটায় স্টেটলার রয়ালে আসবে। স্যার ওয়ালথার মারিয়াটের সঙ্গে দেখা করে তার অনুষ্ঠান থেকে অর্কিড় নিয়ে গেছ শুনলে খুব খুশি হবেন তোমার চাচা, আমি শিওর। আমাদের একজন সদস্য অনুষ্ঠানের ভিডিও করে রাখবে। ইচ্ছে করলে ক্যাসেটটার কপিও করিয়ে নিতে পারো। তার জন্যে অবশ্য পয়সা লাগবে।
মুসার হাত থেকে ঝুড়িটা নিয়ে নিজের পথে চলে গেল মহিলা।
কার্ডটার দিকে তাকাল কিশোর। নাম লেখা রয়েছে মিসেস স্নো জেলিমেয়ার। নিউ ইয়র্কের রিভারডেলের ঠিকানা। আর স্টেটলার রয়ালটা। পাওয়া যাবে থারটিজের সেভেন্থ অ্যাভেন্যুতে।
বন্ধুদের দিকে তাকাল সে। কি মনে হয় তোমাদের? সৌখিন অর্কিড। চাষীদের সম্মেলনের কথা পত্রিকায় দেখলে দেখতে যাবে মিলার? যেহেতু অর্কিডের ব্যাপার, তার চোখে পড়তেও পারে খবরটা।
মহিলার সঙ্গে যখন কথা বলছিলে, তোমার মতলব তখনই বুঝেছি, রবিন বলল। তোমার ধারণা মিলার এখনও নিউ ইয়র্কেই আছে। কিন্তু ওরকম একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার সাহস কি সে করবে? এফ বি আইয়ের ভয়ে তার। তো লুকিয়ে থাকার কথা।
এফ বি আই তো আর সমস্ত জায়গায় চোখ রাখেনি, ওরা রেখেছে। বিশেষ বিশেষ জায়গায়। নিউ ইয়র্ক থেকে মিলার বেরোতে গেলে ওদের চোখে পড়বে। সুতরাং অত তাড়াতাড়ি বেরোনোর সাহস করবে না সে। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে তখন চেষ্টা করবে। এতদিন সে বসে থেকে করবেটা কি? বিরক্ত হয়ে যাবে না? সময় কাটানোর জন্যে হলেও অনুষ্ঠানে যেতে চাইবে। বিশেষ করে অর্কিডের প্রতি তার যখন এত আগ্রহ।
তাহলে এটাই সুযোগ, মুসা বলল। ধরা যাক, সে যাবে। আমরাই বা বসে থাকি কেন?
রাবাতকে ওখানে নিয়ে যাবে কিনা, এটা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেল ওরা। মুসা নেয়ার বিপক্ষে। বলল, নানার মেজাজের ঠিক-ঠিকানা নেই। মিলারকে দেখেই হয়তো জ্বলে উঠবে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ক্ষিপ্ত হয়ে যা খুশি করে বসতে পারে। ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না আমাদের।
আমরা যে গেছি পরে যদি জানে? প্রশ্ন তুলল রবিন।
নাক কুঁচকাল মুসা, জানলে জানবে।
কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারল না ওরা। হোটেলে ফিরে চলল। রিসেপশন ডেস্কে একটা মেসেজ পেল। রাবাত রেখে গেছেন। আসতে দেরি হবে। রাতের খাওয়া ছেলেদের সঙ্গে খেতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। ওদেরকে খেয়ে নিতে বলেছেন। সময় না কাটলে সিনেমা দেখতেও যেতে পারে ওরা।
হয়ে গেল সমস্যার সমাধান। সন্ধ্যায় স্থানীয় একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার খেলো ওরা। নিউ ইয়র্কের মধ্যে নাকি সবচেয়ে বড় এবং ভাল হিরো স্যান্ডউইচ বানায় ওখানে। কথাটা বোধহয় সত্যি। খাওয়া শেষ করার পর মুসারও মনে হলো তার পেট ঠাসাঠাসি হয়ে গেছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ক্রসটাউন বাস ধরে চলে এল স্টেটলার রয়ালে। লিফটে করে তেরোতলার গ্র্যান্ড বলরুমে পৌঁছল।
গ্র্যান্ড অর্থাৎ মহান বলরুমটা অত মহান নয়। গালভরা নামটাই যা। হোটেলটাও পুরানো। লাল কার্পেটের জায়গায় জায়গায় রঙ চটে গেছে। স্ফটিকের ঝাড়বাতিতে পুরো হয়ে জমে আছে ধুলো। লিফট থেকে নামতে তিন গোয়েন্দাকে স্বাগত জানাল মোটা এক লোক। গায়ে সাদা শার্ট। শার্টের বুকের কাছে তার নাম সুতো দিয়ে তোলা। কোন্ জায়গা থেকে এসেছে, তা ও লেখা আছে। তাতে জানা গেল তার নাম বিল কংকি, সাইয়োনেট থেকে এসেছে। ছেলেরা অর্কিডে আগ্রহী শুনে খুব খুশি হলো। স্যার মারিয়াটের বক্তৃতা সহ ভিডিও ক্যাসেটও যে তার অর্কিড়-বিলাসী চাচার জন্যে অবশ্যই নিয়ে যেতে চাইবে কিশোর, এ ব্যাপারেও নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করে দিল।
কি করে ভাল অর্কিড ফলাতে হয়, এ ব্যাপারে লেকচার দেবেন স্যার মারিয়াট, বিল বলল। এর জন্যে ঠিক মত প্যারেন্ট জোগাড় করতে হবে। ভয়ানক ইন্টারেস্টিং।
দৃষ্টি বিনিময় করল মুসা আর রবিন। মুসার পেট ফেটে হাসি আসছে।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল বিল, আরও কয়েকজন এসেছে, তাদের স্বাগত জানাতে। মুসা বলল, প্যারেন্ট মানে কি? অর্কিডেরও কি মাতাপিতা থাকে নাকি?
কি জানি! ঠোঁট ওল্টাল রবিন। ইন্টারেস্টও যে কি করে ভয়ানক হয়, খোদাই জানে। সাংঘাতিক বলতে পারত। তা না, ভয়ানক।
থাক, খুঁত ধরা বাদ দাও, হাত নেড়ে বলল কিশোর। ওরকম ধরতে থাকলে বেশির ভাগ মানুষেরই ধরতে পারবে।
তেরোতলার ওই ঘরটা ঘুরে দেখতে শুরু করল ওরা।
প্রায় পুরো ফ্লোরটাই জুড়ে আছে গ্র্যান্ড বলরুম। প্রবেশমুখের বাইরে দুটো করিডর আছে। তাতে দুটো লিফট, হোটেলের গেস্টদের ওঠার জন্যে। লিফট শ্যাফটের পাশে একটা দরজা, তার ওপাশে সিঁড়ি। ডানের একটা হলঘরে রয়েছে কয়েকটা টয়লেট। বায়ের আরেকটা হলঘরে সার্ভিস লিফট, হোটেল কর্মচারীদের ওঠানামার জন্যে। লিফট ছাড়িয়ে গেলে পাওয়া যাবে ছোট প্যানট্রি অর্থাৎ ভাড়ার ঘর। প্যানটি থেকে বলরুমে সরাসরি ঢোকারও দরজা আছে। হলের শেষ মাথায় ভারী একটা দরজা, মুসার সন্দেহ হলো, ওটা দিয়ে বেরোলে আরেকটা সিঁড়ি পাওয়া যাবে। তবে নিশ্চয় সাধারণের চলাচলের জন্যে নয় ওটা। নব ঘুরিয়ে দরজাটা খুলল সে।সিঁড়ি দেখতে পেল। না। সরু এক চিলতে বারান্দার মত, ভারী রেলিঙ দিয়ে ঘেরা, তার ওপাশে খোলা।সে যে দরজাটা খুলেছে, সেটা ছাড়া বারান্দা থেকে বেরোনোর আর কোন পথ নেই। সরে এল সে। আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল ভারী পাল্লা, খুট করে জায়গামত লেগে গেল নবের প্রিঙ লক।
মিলার এলে হয় লিফট ব্যবহার করতে হবে, নয়তো মেইন করিডরের সিঁড়ি। পালাতে হলেও ওই একই পথে। আর কোন পথ নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিল গোয়েন্দারা। সাইয়োসেটের বিল কংকলিন এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে স্পীকারস টেবিলের সামনে। বিনীত ভঙ্গিতে অতিথিদের সীটে বসতে অনুরোধ করল।
ঘরের একধারে লম্বা টেবিলে নানা রকম অর্কিডের টব রাখা আছে। সেটার দিকেই আগ্রহ বেশি অতিথিদের। সেখানেই ভিড় করছে। বিলের। মোলায়েম স্বরে কাজ হলো না। জোরে জোরে বলতে হলো। তাতেও সুবিধে হলো না। শেষে চিৎকার করে টেবিল চাপড়ে কিছুটা রুক্ষ স্বরেই যখন বসতে বলল, তখন এক দুই করে সরে এল অতিথিরা। সারি দিয়ে রাখা খাটো পিঠওয়ালা চেয়ারে বসল। ছাতে ঝোলানো আলোগুলো ম্লান হতে হতে যখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল, তখন জ্বলে উঠল স্পটলাইট, আলো ফেলল স্পীকারস টেবিলের কাছে।
মাপা স্বরে বাছাই করা শব্দে অতিথিদের আরেকবার স্বাগত জানিয়ে, কি কারণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, জানাল বিল কংকলিন। ঘোষণা করল, স্যার মারিয়াট এখন আপনাদের তার চাষ করা কিছু অর্কিড দেখাবেন। কি করে বাজে প্যারেন্ট থেকেও উঁচু মানের অর্কিড জন্মানো যায়, সে-ব্যাপারে আলোচনা করবেন।
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা। একেবারেই তো নীরস সাবজেক্ট! শুকনো, খটখটে! ঘুমিয়ে না পড়ি!
তার সামনের সীটে বসা মহিলা ফিরে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে কথা বলতে নিষেধ করল।
চেয়ারের পিঠ খাটো হওয়ায় আরাম করে হেলানও দিতে পারল না মুসা। তার মনে হলো, ইচ্ছে করে এ রকম চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে বিরক্তিকর বক্তৃতার সময় শ্রোতারা ঘুমিয়ে পড়তে না পারে, শুনতে বাধ্য হয়। তবু যতটা সম্ভব কাধ নিচু করে গা এলিয়ে দিল সে।
স্পীকারের টেবিলের ওপাশে এসে দাঁড়ালেন রোগাটে, প্রায় কঙ্কালসার, আপেলের মত টুকটুকে লাল মুখওয়ালা এক ভদ্রলোক। হাডিসার হাতের তালু ক্রমাগত ডলছেন। যেন করজোড়ে মিনতি করছেন তার ভয়াবহ বক্তৃতা শোনার জন্যে। বক্তৃতা ভয়াবহই হবে, বিলের কথা থেকেই আঁচ করে নিয়েছে মুসা। ইনিই প্রধান অতিথি স্যার ওয়ালথার মারিয়াট, পরিচয় করিয়ে দিল কংকলিন।
পুরো তিন সেকেন্ড কোন কথা বললেন না মারিয়াট। আন্তরিক হাসিতে কেবল দাঁত দেখালেন অর্কিড় প্রেমিকদের। তারপর বললেন, সম্মানিত ভদ্রমহোদয়গণ।
বলেই চুপ। আবার কয়েক সেকেন্ড দাঁত দেখানোর পর বললেন, কয়েক মিনিট আগে মিস্টার কংকলিন আমাকে বললেন, বক্তা হিসেবে একজন ভেজা চাষীকে পেয়ে আজকের সভা নাকি খুবই আনন্দিত। এর আগের সম্মেলনের বক্তা নাকি ছিলেন শুকনো চাষী। ভেজা চাষী কাকে বলেছেন, বুঝতে পারছেন তো? আমাকে।
চাষী কি করে ভেজা কিংবা শুকনো হয় মাথায় ঢুকল না মুসার। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ল সে।
কনুই দিয়ে, তো মেরে তাকে থামানোর চেষ্টা করল রবিন। তার মুখেও হাসি।
শব্দ করে হেসে ফেলার ভয়ে বন্ধুদের দিকে তাকাতে পারছে না। কিশোর। জোর করে চোখ আটকে রেখেছে ভেজা চাষীর ওপর।
পেছনে দরজা খোলার মৃদু শব্দ হলো। ফিরে তাকাল সে।
দয়া করে কি কেউ আলোটা নিভিয়ে দেবেন? অনুরোধ করলেন স্যার। মারিয়াট।
প্রায় লাফাতে লাফাতে ছুটে গেল কংকলিন। মাথার ওপরের আলোগুলো আগেই নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। স্পটলাইটটাও নিভে গেল। ক্ষণিকের জন্যে অন্ধকারে ঢেকে গেল ঘর। একটা স্নাইড প্রোজেক্টর চালু হওয়ার হালকা গুঞ্জন শোনা গেল। পর্দায় আলো পড়ল। ছবি ফুটল। তাতে দেখা গেল, একটা গ্রীনহাউসে কাজে ব্যস্ত স্যার মারিয়াট। টেবিলে একের পর এক অর্কিড তুলে রাখছেন।
এখন শুনুন, কি করে ভাল, প্যারেন্ট বাছাই করব আমরা, আবছা অন্ধকারে আবার শোনা গেল তার কণ্ঠ। কুড়ি কিংবা ফুল দেখেই অনেক কিছু বোঝা যায়। যারা এর চাষ করে তাদের কাছে ওই জিনিস দুষ্প্রাপ্য নয়, ফুলের জন্যেই তো করে, তাই না? শ্রোতাদের কাছে প্রশ্ন রাখলেন তিনি।
করিডরের দিকের একটা দরজা খুলে গেল। দরজায় এসে দাঁড়ানো গাট্টাগোট্টা একজন মানুষের অবয়ব প্রোজেক্টরের আলোর আভায় চোখে, পড়ল। ঘরের অন্ধকার চোখে সইয়ে নেয়ার অপেক্ষা করছে মনে হলো।
ছবিতে টেবিলের সামনে দাঁড়ানো মারিয়াট তখন নানা রকম ফাস্ক, বীজ আর গাছের চারা নাড়াচাড়া করছেন। কোনটা বাছাই করে কি ভাবে লাগালে ভাল ফলন আশা করা যাবে, বোঝাচ্ছেন।
অন্ধকার ঘরে ঢুকল আগন্তুক। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
মুসার গায়ে খোঁচা দিল কিলোর। আস্তে উঠে রওনা হয়ে গেল ঘরের পেছন দিকে। তাকে অনুসরণ করল মুসা আর রবিন।
খানিকটা সরে এসে ফিসফিস করে কিশোর বলল, ঢুকল যে, ওই লোকটা মিলার, কোন সন্দেহ নেই আমার। হোগারসনকে ফোন করব, দেখি পাওয়া যায় কিনা।
দরজার পাল্লা যতটা সম্ভব কম ফাঁক করে পিছলে বেরিয়ে এল সে। পেছনে বেরোল অন্য দুজন। দাঁড়িয়ে গেল ওখানে। নীরব করিডরে ফোন। কোথায় আছে খুঁজছে ওদের চোখ।
কাছেই আরেকটা দরজা খুলে গেল।
করিডর আর বলরুমের সঙ্গে যোগাযোগকারী বড় দরজাটা নয়, অন্য আরেকটা ছোট দরজা, প্যান্ট্রির কাছে।
মিলার? তিন গোয়েন্দাকে দেখে ফেলে বলরুম থেকে পালাচ্ছে? করিডরে নিশ্চয় ওদের আবছা অবয়ব চোখে পড়েছে তার। ত্রিমূর্তিকে চিনতে অসুবিধে হয়নি মিলারের।
বাঁয়ের ছোট হলটাতে পদশব্দ শোনা গেল। তারপর বাসন-পেয়ালার ঠোকাঠুকি। এবং তারপর একটা গুঞ্জন, নিচতলা থেকে উঠে আসতে আরম্ভ করেছে সার্ভিস্ লিফটটা।
পা টিপে টিপে এসে হলে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। লিফটের দিকে তাকাল। গাঢ় রঙের স্যুট পরা একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। অন্ধকারে তার কাপড়ের রঙ বোঝা যাচ্ছে না, কালো দেখাচ্ছে। ওদের দিকে পিঠ। দুহাতে ধরা ট্রেতে কাপ-পিরিচ।
কোন ওয়েইটার? ব্যবহৃত কাপ-পিরিচ নিয়ে নিচে নামতে যাচ্ছে সে?
রবিন বলল, এই দেখো, ওর পায়ে লোফার?
চমকে গেল ওয়েইটার। সামান্য ঘুরে গেল মাথা, এদিকে তাকাল। মুখের একটা পাশ দেখা গেল।
ওভাবেই থাকুন, মিস্টার মিলার। রবিন বলল, আপনার একটা ছবি তুলে নিই!
সঙ্গে ক্যামেরা এনেছে রবিন। বেড়াতে বেরোনোর পর থেকে এটা সব সময় সাথে থাকে তার, কখনও কাছছাড়া করে না। লোকটার দিকে করে শাটার টিপে দিল। ঝিলিক দিয়ে উঠল ফ্ল্যাশার।
রবিনের দিকে লাফ দিল মিলার। একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠল। হাত থেকে ট্রে-কাপ খসে পড়ে ঝনঝন করে ভাঙল।
ওই মুহূর্তে খুলে গেল সার্ভিস লিফটের দরজা। মিলারের পাশ দিয়ে ছুটে লিফটে ঢুকে গেল কিশোর আর মুসা। ইমারজেন্সি সুইচ টিপে দিল কিশোর। এটা টিপলে আটকে যায় লিফট, যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আর অ্যালার্মের লাল, বোতামটা টিপল মুসা। তীক্ষ্ণ শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। বাজতেই থাকল।
পুলিশ। পুলিশ! বলে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। খুন করে ফেলল! বাঁচাও!
রবিনের গলা টিপে ধরতে যাবে মিলার, এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল। বলরুমের দরজা।
আরেকটা ছবি তুলে ফেলল রবিন।
ছুটে বেরিয়ে এল কংকলিন। রাগে কুঁচকে গেছে মুখচোখ। চিৎকার করে বলল, এই, হচ্ছে কি এ সব! বন্ধ করো।
থমকে গেল মিলার দ্বিধায় পড়ে গেছে। চোখ প্রায় অন্ধ করে দিয়েছে। ফ্র্যাশারের তীব্র আলো।
পুলিশ। আবার চেঁচিয়ে উঠল রবিন, পুলিশ ডাকুন! আমাকে খুন করতে, এসেছে।
আবার টিপল শাটার একেবারে মিলারের মুখের কাছে ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে।
ধাক্কা খেয়ে যেন পিছিয়ে গেল মিলার। চোখের সামনে নিয়ে গেছে। দুহাত তারপর ঘুরে দৌড় দিল সার্ভিস লিফটের দিকে।
মুসা আর কিশোর ওখানে অপেক্ষা করছে। ভাঙা কাপ-পিরিচ মাড়িয়ে উঠতে গিয়ে ওদেরকে লক্ষ করল মিলার। উঠল না আর। দৌড় দিল ভারী দরজাটার দিকে মুসার মত সে-ও ভেবেছে ওদিকে সিঁড়ি আছে। দুহাত সামনে বাড়িয়ে ছুটছে সে। নব ঘুরিয়ে একটানে পাল্লাটা খুলে চলে গেল। ওপাশের অন্ধকারে। পান্না ছেড়ে দিতেই আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল সেটা, তালা লেগে গেল। চাবি ছাড়া ওদিক থেকে খুলতে পারবে না।
বলরুম থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে কৌতূহলী মানুষেরা। মহিলাদের কেউ কেউ ভয় পেয়েছে। করিডরে এসে এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল অর্কিডপ্রেমীর দল।
লিফটের ঘণ্টা বাজা থেমে গেল।
অকস্মাৎ নীরব হয়ে গেল যেন সব কিছু, বড় বেশি চুপচাপ। এরই মাঝে কানে এল একটা চিৎকার। হলের শেষ মাথায় দরজার ওপাশ থেকে আসছে।
বাচাও! চিৎকার করছে মিলার, দরজায় কিল মারছে, দরজা খোলো! বের করো আমাকে! বাঁচাও!
কংকলিনের দিকে ফিরল কিশোর। শান্তকণ্ঠে বলল, মিস্টার কংকলিন, টেলিফোনটা কোথায় বলবেন দয়া করে? এফ বি আইকে ফোন করতে হবে।
.
২২.
রেস্টুরেন্টটা অবিশ্বাস্য রকমের বিলাসবহুল। সাদা মখমলের কাপড়ে ঢাকা টেবিলগুলো, জানালার পর্দায় এমব্রয়ডারি করা দামী কাপড়ের পর্দা। সবখানে তাজা ফুলের ছড়াছড়ি। কার্পেট এত পুরু, পা ফেললেই গোড়ালি অবধি দেবে যায়। মেন্যুর বদলে হেডওয়েইটার স্বয়ং এসে নরম, ভদ্রস্বরে কথা বলে খাবারের অর্ডার নিয়ে যায়। নীল টেলকোট আর ডোরাকাটা ভেস্ট পরা অন্য ওয়েইটাররা খাবার সরবরাহ করে। তিন গোয়েন্দার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হলো না। চিঙড়ির একটা বিশেষ ডিশের অর্ডার দিল ওরা। রান্না নাকি খুবই চমৎকার এখানে।
ওদের খাওয়াতে এনেছেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার ঘরের চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললেন, সিনেমায় তখনও ঢুকিনি। প্রায় পথে পথেই ঘুরে বেড়াচ্ছি বলা চলে, বেকার, কাজ খুঁজছি। এখানে আসার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না তখন হলে। সাধারণ কোন ফাস্ট ফুড শপের সাধারণ বার্গার পেলেই বর্তে যেতাম। তা-ও সব দিন জোগাড় করতে পারতাম না।
মিনারেল ওয়াটারের গেলাসে চুমুক দিলেন তিনি। হাসলেন। ধনী হওয়ার মজাই আলাদা। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না এ কথা। হ্যাঁ, এবার তোমাদের কেসের কথা বলো। কিশোর, পত্রিকায় হ্যারিস মিলারের খবরটা দেখে তোমার মেরিচাচীকে ফোন করেছিলাম। তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি জানেন মুসার নানার সঙ্গে তোমরা ছুটি কাটাতে গেছ, বেড়াতে। কল্পনাই করতে পারেননি, স্পাই তাড়া করে বেড়িয়েছ।
হেসে ফেলল মুসা। ছুটিতে বেড়াতে বেরিয়েছি, এটাও যেমন ঠিক : একটা কেস হাতে নিয়ে বেরিয়েছি এটাও ঠিক। কেসটা দিয়েছিল আমার মা
বাবাকে কি করে ঝামেলা মুক্ত রাখার জন্যে তিন গোয়েন্দাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মিসেস আমান, খুলে বলল সে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। সেটা করতে গিয়েই স্পাইদের সঙ্গে জড়িয়েছিলাম।
সে-রকমই শুনেছি, পরিচালক বললেন। এ সময় নিউ ইয়র্কে তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবিনি। ভাল লাগছে। একটা ছবির কাজে এসেছি। নিউ ইয়র্কে শুটিং করতে হবে। মনে হচ্ছে, সিনেমার আরও একটা ভাল গল্প পেয়ে গেলাম। পত্রিকায় তোমাদের কেসের খবরটা পড়ে তাই মনে হলো। এবার বলো সব। পুরো কাহিনীটা তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই রবিন, এটা তো বাড়ি নয়, লিখে ফেলার কাজটা নিশ্চয় শুরু করোনি?
করেছি, স্যার, রবিন বলল। আজ সকালে আপনার ফোন পেয়ে তো চমকেই গিয়েছিলাম। আমরাও ভাবতে পারিনি আপনি নিউ ইয়র্কে আছেন, দেখা হয়ে যাবে।
কাহিনী শুরু করল রবিন। গোড়া থেকে বলতে লাগল। কি করে মুসার আম্মা ওদেরকে কাজটা দিয়েছেন। পিজমো বীচে মিলারের সঙ্গে গোলমালের সূচনা থেকে স্টেটলার রয়ালে তাকে পাকড়াও করা পর্যন্ত কিছুই বাদ দিল না। মাঝে মাঝে তাকে কথা জুগিয়ে দিল মুসা আর কিশোর।
চমৎকার! পুরোটা শুনে বললেন পরিচালক। হোটেলের ওয়েইটাররা যে কাজের সময় লোফার পরে না, শুধু এই সামান্য সূত্র দিয়ে কাউকে সন্দেহ করে ফেলাটা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। একটা ব্যাপার অবাক করছে আমাকে। সান্তা রোসায়ও তো গাড়ির নিচে উঁকি দিয়েছিলে তোমরা। পেট্রোল ট্যাংকে লাগানো সঙ্কেত পাঠানোর যন্ত্রটা তখন চোখে পড়ল না কেন?
অমন কিছু থাকতে পারে, তখনও ভাবিনি, জবাব দিল কিশোর। তা ছাড়া রাত দুপুরে চোখ তখন এমনিতেই ক্লান্ত, তার ওপর টর্চের ব্যাটারি গিয়েছিল ফুরিয়ে। নানা রকম উত্তেজনার মাঝে ব্যাটারি চেক করতে ভুলে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা, মিলার যে দুষ্ট লোক, মিস্টার রাবাতের এ কথায় তখনও গুরুত্বই দিইনি। তাই নতুন ব্যাটারি ভরে ভালমত আবার খোঁজার কথা মনে হয়নি।
আগেও এ ধরনের অপরাধ করেছে কিনা মিলার, জানতে পারিনি। এ সব গোপনীয়, ব্যাপার, তাই এফ বি আই আমাদের সামান্যই জানিয়েছে। হোগারসনের কাছে জেনেছি, বিমানের যন্ত্রপাতি তৈরির একটা কারখানায় কাজ করত মিলার। ইলেকট্রনিক এঞ্জিনিয়ার ছিল সে। সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স ছিল তার, কারখানার মধ্যে যেখানে ইচ্ছে যখন তখন যেতে পারত। তবে কিছুদিন পর চাকরি থেকে বের করে দেয়া হলো তাকে–অন্যান্য টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অপরাধে। হয়তো প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে জেদের বশেই প্রাইয়ের কাজটা করেছে সে। চাকরি যাবে শোনার পর তথ্য চুরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, বেরিয়ে আসার আগেই কাজটা সেরে ফেলে।
ছবি ডেভেলপ করার যন্ত্রপাতি ছিল না তার বাড়িতে। কোন ক্যামেরার দোকান থেকে করিয়ে আনারও সাহস করেনি, ঝুঁকি নিতে চায়নি। ক্যামেরাটা সহই দিয়ে দিতে চেয়েছিল ব্যালার্ডকে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, ক্যামেরাটা বদল হয়ে হাতছাড়া হয়ে গেল। অন্য কারণে তাকে সন্দেহ শুরু করেন মিস্টার রাবাত। মিলার ভাবল, তার তথ্য চুরির ব্যাপারটা নিয়ে তাকে সন্দেহ করছেন তিনি। চোরের মন পুলিশ পুলিশ!
হু, মাথা ঝাঁকালেন পরিচালক। অপরাধী এ ভাবেই নিজেকে ধরিয়ে দেয়।
মুসা বলল, যতই এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা, ক্যামেরাটার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল মিলার। ওটা যে বদল হয়ে গেছে, ধরতে পারেনি রবিন। সে বুঝতে পারার আগেই তার কাছ থেকে ওটা কেড়ে নিতে চেয়েছিল মিলার।
সে-সব তো আগেই শুনলাম। ব্যালার্ডের কি খবর? তাকে ধরেছে?
মুহূর্তের জন্যে কালো হয়ে গেল কিশোরের মুখ। ও পালিয়েছে। হোগারসনের কাছে শুনলাম, মিলার ধরা পড়ার পরদিন নাকি ভিয়েনায় দেখা। গেছে তাকে। এফ বি আইয়ের জাল কেটে বেরিয়ে গেছে সে।
তারমানে ওস্তাদ গুপ্তচর সে। অনেক দিন ধরে আছে এ লাইনে।
যতবড় ওস্তাদই হোক, মুসা বলল, আমাদের কাছে একটা মার খেয়ে গেছে। যে ফিল্মগুলো নিয়েছে রবিনের ব্যাগ থেকে, সব বাতিল জিনিস। ডেভেলপ করার পর দেখবে কিচ্ছু ওঠেনি। মুখটা তখন পচা ডিম হয়ে যাবে। হয়তো গালাগাল করবে আমাদের, কিন্তু লাভ হবে না কিছুই।
মৃদু হাসি ফুটল পরিচালকের ঠোঁটে। মাথা ঝাঁকালেন। তা বটে। তো, মুসা, তোমার নানার আবিষ্কারটা কি? বিক্রি করতে পেরেছেন?
হাসল মুসা। পেরেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সত্যিই কাজের জিনিস। গাড়িতে ওটা পাইনি আমরা তার কারণ, গাড়িতে ছিল না। আক্রমণ আসতে পেরে ভেবে ওটা আগেই ডাকে রিভারভিউ প্লাজায় পাঠিয়ে দিয়েছিল, নিউ ইয়র্ক এসে প্রথম যে হোটেলে আমরা উঠেছিলাম। ম্যানেজারকে বলে রেখেছিল, আমরা না আসা পর্যন্ত যেন খামটা নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়। রেখে দিয়েছিল ম্যানেজার। সেজন্যেই মিলার পিছে লাগায় আবিষ্কার খোয়া যাওয়ার ভয় ছিল না নানার, লোকটাকে দেখতে পারে না বলে ভীষণ খেপে গিয়েছিল।
কিন্তু আবিষ্কারটা কি? সামরিক বাহিনীর কাজে লাগবে এমন কিছু?
না, মহাকাশচারীদের কাজে লাগবে। গির্জার হলের জন্যে প্রিঙ্কলার। সিসটেম বানাতে গিয়ে এক ধরনের নতুন ভালভ আবিষ্কার করে বসে নানা। এর মধ্যে একটা অটোম্যাটিক সেনসর থাকবে। বর্তমানে যে সব ভালভ ব্যবহার করে নভোচারীরা তার চেয়ে অনেক ছোট আর হালকা বলে বহন করতেও সুবিধে। স্পেসস্যুটের ভেতরে বসানো এই জিনিসটা তাপমাত্রা আর চাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে অন্যান্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ছেটে ফেলা যাবে, তাতে স্যুটের আকার আর ওজন দুটোই অনেক কমানো যাবে। শিপ থেকে বেরিয়ে মহাকাশে ঘোরাফেরা করতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে নভোচারীরা।
তারমানে ভাল জিনিসই আবিষ্কার করেছেন!
হ্যাঁ। নানাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে এখন কয়েকটা ফার্ম, NASA-র অনেক জিনিস সাপ্লাই দেয় ওরা। একজন উকিল নিযুক্ত করেছে। নানা। তাকে নিয়ে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মাটিঙে বসছে। ভোরে বেরোয়, রাত করে ফেরে। সাংঘাতিক খাটুনি যাচ্ছে। সেই তুলনায় মেজাজ খারাপ হচ্ছে না। রাতে এসেও হেসে হেসে কথা বলে আমাদের সঙ্গে। রসিকতা করে। আগে যেটা একেবারেই করত না। হয় চুপ করে থাকত, নয়তো খেউ খেউ করে উঠত।
আসল কথাটা হলো দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মানসিক চাপ থাকলে ভাল মেজাজ খারাপ হয়ে যায় হাসলেন তিনি হলে একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে, এই দীর্ঘ যাত্রায় একসঙ্গে থেকে থেকে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছেন তোমাদের। নিঃসঙ্গ জীবনে তিন তিনজন ভাল বন্ধু জুটিয়ে নিয়েছেন।
হাসল না কেবল মুসা।
এখন আসল কথা শোনো, পরিচালক বললেন, খাওয়াতে এনেছি। কোথাও আরামে বসে তোমাদের গল্পটা শোনার জন্যে। আরও একটা প্রস্তাব– দিতে পারি, হাতে কাজ না থাকলে আমার সঙ্গে যেতে পারো। আমার নতুন ছবিটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে আজ রাতে। মিস্টার রাবাকে ফোন করে দাও। সম্ভব হলে যেন সন্ধ্যার দিকে চলে আসেন আজ তিনি। কয়েক ঘণ্টা সময় দেন আমাদের।
পরিচালকের প্রস্তাবে খুশি হলো কিশোর।
তবে মুসাকে তেমন খুশি দেখাল না। আমতা আমতা করে বলেই ফেলল, এ ধরনের অনুষ্ঠানে যেতে ভয় লাগে আমার, স্যার।
অবাক হলেন পরিচালক। কেন?
অর্কিডপ্রেমীদের অনুষ্ঠান তো দেখলাম। বাপরে বাপ! ঢাকায় গিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটা আলোচনা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম একবার। টিভির সামনে থেকে উঠে সোজা দৌড় দিতে ইচ্ছে করে। অর্কিডওয়ালারা। তার চেয়ে বিরক্তিকর!
হেসে ফেললেন পরিচালক। না, অতটা বিরক্তিকর লাগবে না আমাদের অনুষ্ঠান, কথা দিতে পারি তোমাকে, উত্তেজনা আর আনন্দের অনেক খোরাক পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রচুর খাবার সাজানো দেখবে টেবিলে, মুসার দিকে সরাসরি তাকালেন তিনি। চোখে মিটিমিটি হাসি। তোমার পছন্দ মত।
এইবার হাসি ফুটল মুসার মুখে। তাহলে স্যার আর কোন আপত্তি নেই আমার।