–শুনেই দ্যাখো।
মিসেস ব্যান্ট্রি, ক্র্যাডককে দেখে একটু অবাক হলেন তা-ও আবার জেন পাঠিয়েছে ওঁকে?
–কি শুনতে চান বলুন?
এটা কি তাহলে সত্যিই হত্যা?
–আপনার কি তা-ই মনে হয়?
–দুর্ঘটনাও হতে পারে। কেউ-ই এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। আর যদি হত্যাও হয়, তবে এটা কার পক্ষে করা সম্ভব, তাও তো বোঝা যাচ্ছে না। মিসেস বেডককের কি প্রচুর টাকা ছিল?
-না, তেমন কিছুই ছিল না।
–আচ্ছা, উনি কি কাউকে ব্ল্যাকমেল করতে পারতেন, বা কারো গোপন কথা জানতেন বলে মনে করেন?
ঘাড় নাড়লেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
-না, আমার তা মনে হয় না, কোনো গোপন কথা জানলেও প্রথম সুযোগেই জানিয়ে দিতেন উনি, ওঁকে বিশ্বাস করে কেউ কোনো গোপন কথা বলবে বলেও মনে হয় না। আর, ব্ল্যাকমেইলের মতো নিচ কাজ করার চিন্তা ওর মাথায় আসা সম্ভব নয়।
-মিস মারপল আপনাকে লেডি অব শ্যালট-এর কথা মনে করিয়ে দিতে বলেছিলেন।
-ওঃ, সেই টেনিসনের কবিতায় আছে না, আয়নাটা চূর্ণ হয়ে গেল, তার ওপর ধ্বংস নেমে আসছে? সেই কবিতা মনে পড়ে গিয়েছিল মেরিনা-কে দেখে।
তার মানে?
–জেন আপনাকে অনেক ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পারতো। যাই হোক, ব্যাপারটা হচ্ছে, মিসেস বেডকক-এর একঘেয়ে কথা শুনতে শুনতে একসময় যেন মনে হলো, মেরিনা মোটেই মন দিচ্ছেন না, মিসেস বেডককের পেছনে অনির্দিষ্ট কিছুর দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখ হয়ে উঠেছে পাংশু, যেন কোনো সর্বনাশের ইঙ্গিত পেয়েছেন। সেই মুখটা দেখেই আমার লেডি অব শ্যালটের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
গসিংটন হল-এ সরেজমিন তদন্তে গেলেন ক্র্যাডক। জ্যাসন হাড-এর সেক্রেটারি হেইলি প্রেসটন-এর কাছ থেকে জানা গেল, সেদিন পার্টিতে কাদের ওপরে ডাকা হয়েছিল, কর্মচারীদের মধ্যেই বা কে কে উপস্থিত ছিল। আরও জানা গেল বাড়ির সবাই ঐ ক্যালমো ড্রাগটি প্রয়োজন হলে অল্পমাত্রায় সেবন করে থাকে। মহিলাদের তো হ্যান্ডব্যাগেই থাকে, যখন দরকার হয়, পানীয়ের সাথে মিশিয়ে নেন। এমনকি সেটন নিজেও তাই করে।
মেরিনা-র সঙ্গে অবশ্য দেখা করা গেল না। ডাক্তার গিলক্রিস্ট জানালেন, মেরিনা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সব শিল্পীর মতোই আবেগপ্রবণ। এই আকস্মিক দুর্ঘটনা তাকে শয্যাশায়ী করে ফেলেছে। অগত্যা ক্র্যাডক জ্যাসন হাড-এর সাক্ষাৎ প্রার্থী হলেন।
একনজরেই জ্যাসনকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং দৃঢ়চরিত্র বলে চিনে নিতে ভুল হলো না ক্র্যাডক-এর। সেদিনের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন তিনি। ক্ষণিকের জন্য তার স্ত্রী যে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলেন, সে কথাও স্বীকার করলেন। এবার ক্র্যাডক জিজ্ঞেস করলেন, জ্যাসনের কি মনে হয় না, এই মৃত্যুটা একটা দুর্ঘটনা। আসলে হত্যাকারীর লক্ষ্য ছিল অন্য কেউ? সম্ভবত তার স্ত্রী?
একটু চুপ করে থাকলেন জ্যাসন, তারপর বললেন, তারও সেরকমই ধারণা হয়েছিল। তবে স্ত্রী শুনলে বিচলিত হবেন মনে করেই কাউকে সেই সন্দেহের কথা জানাননি। মেরিনাকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চেনেন, জানেন, সে একটু সুখ, একটু শান্তি পাবার জন্য কতটা কাঙাল। বহুবার এই সুখের মুহূর্ত তার কাছে এসেছে, আবার পরক্ষণেই সেই সুখের আশা চূর্ণ হয়ে গেছে। এখানে এসেও খুবই সুখী হয়েছিল সে, সেই আনন্দটুকু স্থায়ী হোক, এটাই চেয়েছিলেন তিনি।
বেশ কয়েকবার বিবাহ করেছে মেরিনা। ছোট্ট মেয়ের মতো রূপকথার রাজপুত্র আশা করেছে। সে, কিন্তু বাস্তব জীবনটা তা নয়। বিশেষতঃ ফিল্ম জগতে বিয়ে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব বলা চলে, তাই বারবার বিয়ে ভেঙেছে তার, এজন্য মরিনার টেম্পারমেন্ট-ও কম দায়ী নয়। সন্তান লাভ করার অদম্য ইচ্ছে ছিল তার। একটি মেয়ে ও দুটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিল সে, কিন্তু তাতে মন ভরেনি বেশিদিন। এগারো বছর আগে যখন প্রথম সে অন্তঃসত্ত্বা হয়, আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছিল মেরিনা। কিন্তু ছেলেটি জন্মালো মানসিক প্রতিবন্ধী। সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল তার। বিয়ে ভেঙে গেল। বহুদিন মানসিক চিকিৎসা করানোর পর অতি সম্প্রতি সুস্থ হয়েছে মেরিনা। বহুদিনের বন্ধু জ্যাসন বিয়ে করেছেন তাকে। এই ক্ষমতাশীল অভিনেত্রীটিকে আবার আনতে চেষ্টা করছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। এই সময় এই দুর্ঘটনা। তবে জ্যাসন তাঁর স্ত্রীর ওপর ভবিষ্যতে কোনোরকম আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে তৈরি থাকবেন, সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করবেন। তবে, কথাটা মেরিনাকে জানতে দিতে চান না।
এরপর ক্র্যাডক দেখা করলেন মেরিনা-র সেক্রেটারি এলা জেলেনেস্কির সঙ্গে। মেয়েটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে সেদিনকার অতিথি ও কর্মচারীদের নামের তালিকা জানিয়ে দিল ক্র্যাডককে। মেরিনার স্বভাবের উত্তেজনা প্রবণতার কথা, যে কোনো ঘটনাকে নাটকীয় করে তোলার ক্ষমতার কথা জানা আছে তার। মুহূর্তের মধ্যেই মুড পরিবর্তিত হয়ে যায় তার। বিশেষ করে, কেউ নিজের সন্তান বা কোনো শিশুর কথা তুললেই কেমন আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে মেরিনা, এটাও সে লক্ষ্য করেছে। তার একমাত্র সন্তান যে মানসিক ভারসাম্যহীন, এ কথা বোধহয় সে কখনো ভোলে না।
মিস মারপল এদিকে তার হোম-ওয়ার্ক নিজের মতো করেই শুরু করে দিয়েছেন। বিউটি পার্লার থেকে পুরোনো ফিল্ম ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে, ফিল্ম জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।