–সত্যি কথাটা হচ্ছে, আমি এক মুহূর্তের জন্যেও সেরকম কিছু সন্দেহ করিনি।
–আপনার স্ত্রী বলেছিলেন, কফির স্বাদটা অন্যরকম লাগছে, তা সত্ত্বেও সন্দেহ করেননি?
-ওঃ, ঐ মেলার পরদিন থেকে আমার স্ত্রী তার প্রতিটি খাদ্য এবং পানীয়তেই বিষ মেশানো আছে বলে সন্দেহ করে চলেছেন। তার কারণ অবশ্য ইতিমধ্যেই মেরিনার প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া আরও দুটি চিঠি এসেছে।
চিঠি দুটি দেখলেন ইনসপেক্টর। অত্যন্ত শিশুসুলভ হুমকি বলে মনে হলো তার। অবশ্য তার মানে এমন নয়, যে এগুলো বিপদজনক হতে পারে না। শিশুসুলভ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন কম অপরাধী দেখেননি ক্র্যাডক।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জ্যাসন,এলা এইভাবে হঠাৎ মারা গেল, তার ওপর আবার গিসিপ্পির এই মর্মান্তিক মৃত্যু। আমার স্ত্রী তো ভয়ে পাগল হয়ে যেতে বসেছে। কবে ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবো ইনসপেক্টর?
–ইনকোয়েস্ট তো এখনও বাকি আছে মিস্টার হাড, কাজেই কিছু বলা যাচ্ছে না।
–সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন, মেরিনা-র প্রাণহানির আশংকা এখনও আছে?
–আমরা সবরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবশ্যই নেব মিস্টার হাড।
–একথা তো আগেও শুনেছি। মেরিনাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতেই হবে আমাকে। যত শিগগির সম্ভব।
শোবার ঘরে নিজের বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল মেরিনা। ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তায় বিবর্ণ দেখাচ্ছে তাকে। স্বামীকে এসে দাঁড়াতে দেখে অবসন্ন গলায় বললো,-ক্র্যাডক এসেছিলেন, তাই না? কেন? এলা-র জন্য?
–এলা আর গিসিপ্পি?
–গিসিপ্পিকে কে গুলি করেছে, সেটা কি ওরা জানতে পেরেছে?
–এখনও নয়।
–সব কেমন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে জ্যাসন। উনি কি বললেন? আমরা কি এখন এখান থেকে চলে যেতে পারবো? উনি কি বুঝতে পারছেন না, একজন দিনের পর দিন আমাকে খুন করার জন্য প্রতীক্ষা করছে। এই অবস্থায় আর কতদিন কাটানো যায়?
উনি বলেছেন, পুলিশ সবরকমভাবে সতর্ক থাকবে, যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটতে পারে।
-সতর্কতা! একথা তো ওরা আগেও বলেছিল, তাতে কি এলা আর গিসিপ্পিকে বাঁচাতে পারলো? আমি আতঙ্কে মরে যাচ্ছি জ্যাসন। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর, প্লিজ।
এই মৃত্যুগুলো যে ব্যাপারটাকে অনেক জটিল করে দিয়েছে মেরিনা। এছাড়া পালিয়েই কি বাঁচা যায়?
কিন্তু কে আমাকে এতটা ঘৃণা করে যে, আমাকে হত্যা করতে চায়, সেটা না জানলে আমি শান্তি পাবো কি করে? প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, নিশ্চিত হয়েছিলাম, যে এলা-ই এই কাজ করেছে। কিন্তু
–এলাকে সন্দেহ করেছিলে!
-তুমি বুঝতে পারো না, যে ও তোমার প্রেমে পাগল, আর আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারে না? পুরুষ মানুষের দৃষ্টিশক্তি এত কম! কিন্তু এখন এলা মারা যাওয়াতে সে সন্দেহটাও তো মিথ্যে হয়ে গেল।
–এত চিন্তা করো না ডার্লিং! আমি আছি তো! আমি তোমাকে আগলে রাখবো, চিরদিন।
–সত্যিই থাকবে তত জ্যাসন, আমার পাশে।
নিশ্চয়ই, একেবারে শেষ পর্যন্ত। সে সময়টা যতই কঠিন, যতই তিক্ত হোক না।
-তুমি কেমনভাবে কথাটা বললে জ্যাসন! তোমার হাসিমুখ দেখে মনে হচ্ছে একজন ক্লাউন যেন আগে থেকে একটা বিষাদময় পরিণতি দেখে ফেলেছে, যা আর কেউ দেখতে পায়নি।
ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ইনসপেক্টর পরদিনই দেখা করলেন মিস মারপল-এর সঙ্গে।
–আরাম করে বোসো। বুঝতে পারছি, খুব কঠিন সময় যাচ্ছে তোমার।
–আমি হেরে যেতে ভালোবাসি না আন্টি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুটো খুন হয়ে গেল। আমার কাজের পক্ষে নিজেকে খুবই অনুপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে।
যথোপযুক্ত সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে, এবং কড়া হুইস্কি পান করিয়ে ক্র্যাডককে একটু চাঙ্গা করে তুললেন জেন মারপল, তারপর জিজ্ঞেস করলেন–নাও। এবার সব কথা বল তো আমাকে। মানে, যতটা বলার অধিকার আছে তোমার।
আমার মনে হয়, আমি যা বলবো, তার সবটাই আপনি জানেন। এছাড়া আরও আমার না জানা কিছু তথ্য নিশ্চয়ই আপনার আস্তিনে লুকোনো আছে। আচ্ছা, আপনার ঐ দেহরক্ষী মহিলা মিস নাইট ও তো খুনী হতে পারে?
–সে কি? ও কেন খুন করতে যাবে?
–কেননা, ওরই খুন করার সম্ভাবনা সব থেকে কম।
-বাস্তবে ওরকম হয় না ডার্মট। সব সময় সে-ই খুন করে, যার পক্ষে খুন করার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। এই কথাটাই তো আমি বারবার বলেছি। এসব ক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই থাকে স্বামী, অথবা স্ত্রী। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে-ই খুনী প্রতিপন্ন হয়।
-জ্যাসন হাড! কিন্তু সে তো মেরিনাকে প্রায় পুজো করে।
–কথাটা আমি বৃহত্তর অর্থে বলেছি। মিসেস বেডকককে হত্যা করে তার স্বামী কোন দিক থেকেই লাভবান হতে পারে না, এটা আমরা জেনেছি। এবার যখন মনে হচ্ছে হত্যাকারীর আসল উদ্দেশ্য ছিল মেরিনা; তখন স্বভাবতই জ্যাসন হাড-এর দিকে সন্দেহের কাটাটা ঘুরে যাবে। আমিও তোমার সঙ্গে একমত, যে জ্যাসন তার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসে। এছাড়া সে নিজে একজন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত মানুষ। অর্থের প্রয়োজনে কাউকে খুন করার দরকারও নেই তার। স্ত্রীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য তাকে খুন করার দরকার কি। চিত্রতারকাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ব্যাপারটা তো একেবারেই রোজকার ঘটনার মতো স্বাভাবিক।
ক্র্যাডক-এর কাছ থেকে মার্গট বেনস-এর কথা শুনে ব্যথিত হলেন মিস মারপল। তিনি জানেন, শিশু মনকে কোনো ঘটনা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, তবে তা সে সারাজীবন চেষ্টা করলেও ভুলতে পারে না।