হঠাৎ রাস্তার অন্য দিকে কাউকে দেখতে পেয়ে মিস গ্রিফিথ সেদিকে ছুটলেন। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মহিলার জোরালো ব্যক্তিত্ব কেমন অস্বস্তি ধরায়।
আমি প্রথমে ব্যাঙ্কের কাজটা মেটালাম। তারপর গেলাম উকিল সিমিংটনের অফিসে। একজন গ্রামীণ আইনজ্ঞের অফিস যেমন হওয়া উচিত অফিসটা তেমনি, বেশ সুন্দর। ঘরের চারপাশেই দলিলের বাক্স সাজানো। বাক্সের গায়ে নানা নামের লেবেন লাগানো।
রিচার্ড সিমিংটনের বাইরের চেহারাটা আপাত রুক্ষ মনে হলেও বেশ সদাশয় মানুষ।
আমার আনা কাগজপত্র দেখে অল্প সময়ের মধ্যেই কাজটা সেরে দিলেন। আমিও যাওয়ার জন্য উঠলাম।
–আপনার সৎ মেয়ে মেগানের সঙ্গে পথে আজ দেখা হল।
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কথাটা বললাম।
মিঃ সিমিংটন কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরে হেসে বললেন, ওহ, মেগানের কথা বলছেন? সবে স্কুল ছেড়ে এসেছে। ভাবছি কোন একটা কাজে লাগিয়ে দেব। অবশ্য বয়সও খুব বেশি নয়।
বাইরের অফিসে একমাথা কোকড়ানো চুল, মাঝবয়সী এক মহিলা দ্রুত টাইপ করে চলেছেন। তাকে দেখে ডাঃ গ্রিফিথের কথা আমার মনে পড়ল। ইনিই নিশ্চয় মিস গিনচ।
ওকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মিঃ সিমিংটনের সঙ্গে কোন গোপন সম্পর্ক থাকা একেবারেই অসম্ভব।
এরপর রুটিওয়ালার দোকান হয়ে রাস্তার ধারে এসে যোয়ানা আর তার গাড়ির খোঁজে চারপাশে তাকালাম। যোয়ানকে কোথাও চোখে পড়ল না।
আচমকা সামনে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। মনে হল কোন ভাসমান দেবীমূর্তি রাস্তার পাশ দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টি যেন আটকে গেল। নিখুঁত গড়ন। এমন চমৎকার মানানসই চেহারা, চলার ভঙ্গী, কুঞ্চিত সোনালী কেশগুচ্ছ, কোন দেবীমূর্তি ছাড়া সম্ভব নয়।
আশ্চর্য মহিমান্বিত তরুণীকে দেখে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে আমার হাতের কিসমিসের রুটি রাস্তার ওপরে খসে পড়ে গেল। ওটা ধরতে গিয়ে, ভারসাম্য হারিয়ে লাঠি সমেত আমিও পড়ে গেলাম।
সেই দেবীমূর্তিই এগিয়ে এসে শক্ত দুই হাতে আমাকে টেনে তুলল। রুটি আর লাঠিও তুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
আমি অস্ফুটস্বরে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। আমার যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
-ধন্যবাদের কিছু হয়নি, ও কিছু না। নিতান্তই সাদামাটা কণ্ঠের কথা আমার কানে ভেসে এলো।
আমারও মোহভঙ্গ হল। বেশ স্বাস্থ্যবতী চটপটে একটি মেয়ে ছাড়া বেশি কিছু মনে হল না তাকে।
এমন বিসদৃশ সহাবস্থান যে সম্ভব আমার ধারণা ছিল না। ওই রূপের পাশাপাশি নিরুত্তাপ অতি সাধারণ কণ্ঠস্বর বড় বেশি বেমানান।
যোয়ানা কখন আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল বুঝতে পারিনি। ও জানতে চাইল কিছু ঘটেছে কিনা।
না কিছু না, ওর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, একটা বিচ্ছিরি রকমের ধাক্কা খেলাম। ও কে বলতে পারিস?
একটা গর্বিত হংসিনীর মতো অনেকটা সাঁতার কাটার ভঙ্গীতে এগিয়ে চলা মূর্তিটির দিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
-ওহ, ও হল সিমিংটনদের নার্সারী গভর্নের্স। ওকে দেখেই তোর এমন বেসামাল অবস্থা? দেখতে সুন্দর তবে বড়ই নিরুত্তাপ।
–হ্যাঁ, বললাম আমি। বাইরের সৌন্দর্যটা করুণভাবে অপচয়িত হয়েছে।
যোয়ানা গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিল। আমি উঠে বসলাম।
.
০৩.
প্রাচীন ভাঙ্গা গির্জার এলাকায় প্রিয়রস লজে বাস করেন মিঃ পাই। সেদিন বিকেলে আমরা তাঁর ওখানে গেলাম চা পান করতে।
ছোটখাট গোলগাল চেহারার মানুষ মিঃ পাই। নিজে যেমন ছিমছাম তেমনি বাড়ির প্রতিটি জিনিস সাজানো গোছানো আর বেশ ঝকঝকে। অনেক প্রাচীন জিনিস তিনি অতি যত্নের সঙ্গে মিউজিয়মের মতো সাজিয়ে রেখেছেন। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের সব দেখালেন।
একথা সেকথার পর একসময় মিঃ পাই বললেন, আপনারা বেশ সুন্দর বাড়িই পেয়েছেন। এমিলি বার্টনদের অনেকদিন থেকেই আমি জানি। আমি যখন এখানে আসি, তখন ওদের বৃদ্ধা মা বেঁচে ছিলেন। বিশাল চেহারা ছিল তার। পাঁচপাঁচটা মেয়েকে নিয়ে দারুণ দাপটে চলতেন। সবচেয়ে বড় মেয়েটির বয়সই ছিল তখন ষাটের কাছাকাছি। মায়ের সেবা করার জন্য তটস্থ থাকতো সকলে।
অদ্ভুত কি জানেন, বাড়িতে বাইরের লোকের আনাগোনা একদম পছন্দ করতেন না মহিলা। মেয়েদের বন্ধুদের কাউকে আনার উপায় ছিল না। এই করে মেয়েরা অবিবাহিতই থেকে গেল।
আমরা নিবিষ্টভাবে মিঃ পাইয়ের কথা শুনছিলাম। যোয়ানা বলল, এ যে একেবারে কোন উপন্যাসের কাহিনী বলে মনে হচ্ছে।
-হ্যাঁ, সেরকমই বলতে পারেন। ওদের বাড়িতে আছেন তো, ওই পরিবারের কথা আপনাদের জানা দরকার। প্রায় সাতানব্বই বছরে মারা যান মহিলা। মেয়েদের বিয়ে করার বয়সও পার হয়ে গেছিল ততদিনে। তাদের সহ্যশক্তিও বেশি ছিল না, একের পর এক মারা গেলেন। নানা অসুখে ভুগে। বেচারি ম্যাকেল দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, এমিলি সাধ্যমতো সেবা করেছেন তার। চমৎকার মহিলা। তবে অর্থকরী সমস্যায় পড়েছেন বলে বোধহয়।
–শুনেছিলাম, ভাড়া দেবার ইচ্ছে ছিল না–যোয়ানা বলল।
–তবুও, উনি নিজেই আমাকে বলেছেন ভাল ভাড়াটিয়া পেয়ে খুশি হয়েছেন।
–বাড়িটা খুবই নিরিবিলি। বললাম আমি।
–আপনার ওরকমই লাগছে? অবাক হবার মত কথাই বটে। বললেন মিঃ পাই।
–কিছু কি বলতে চাইছেন মিঃ পাই? যোয়ানা জানতে চাইল।
অন্য কিছু না। আমার ধারণা মানুষের চিন্তা আর ধারণা বাড়ির আবহাওয়ার মধ্যে উপলব্ধি করা যায়। অবশ্য এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।