- বইয়ের নামঃ ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, কল্পকাহিনী
ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ
০১.
আগে চলো পিজ্জা কোভে যাই, মুসা বলল। আজকাল ওদের পিজ্জাগুলো আরও ভাল হয়েছে। বীফ আর মাশরূম দিয়ে যা বানায় না!
ওর বলার ধরনই বুঝিয়ে দিল, জিভে পানি এসে গেছে।
হাসল রবিন, বেরিয়েই আগে খাওয়ার চিন্তা?
তো আর কার করবে? খাওয়াই তো জীবন, মুসার কথায় সায় দিয়ে বলল টনি হাওয়াই। ঝাড়ুর শলার মত খাড়া খাড়া চুলে আঙুল চালানোর চেষ্টা করল। হেঁটে এত খাটো করে ফেলেছে, আঙুল ঢোকেই না। ওদের পিজ্জা আমারও খুব ভাল লাগে। প্রায়ই খাই।
আবার মাথা ঝাঁকাল রবিন। সেটাও জানি। তোমাকে চিনতেও কি আর। বাকি আছে নাকি আমার।
পিজ্জা কোভ আমার মোটেও ভাল লাগে না, জানিয়ে দিল টনির ছোট বোন সিসি। বছর সাতেক বয়েস। কিন্তু পাকা পাকা কথা বলার ওস্তাদ। পিজ্জা তো আরও পচা।
স্কুলে গরমের ছুটি হতেই খালার বাড়ি বেড়াতে চলে গিয়েছিল সিসি। সেজন্যে বাবা-মা আর ভাইয়ের সাথে একসঙ্গে আসেনি। দুদিন হলো ওর খালাত ভাই রেখে গেছে ওকে স্যান্ডি হোলোতে।
এসেই ভাইয়ের পেছনে লেগেছে সিসি। ভাই যেখানে যায়, তারও সেখানে যাওয়া চাই। নিতে চায় না টনি। কিন্তু না নিলে মায়ের ধমক খেতে হয়। কি আর করে বেচারা। নিতে বাধ্য হয়।
খেঁকিয়ে উঠল টনি, চুপ! তোকে কেউ জিজ্ঞেস করছে না। আইসক্রীমখোরের পিজ্জা কোভ ভাল লাগার কারণ নেই।
মেইন স্ট্রীট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে তাকাতে লাগল রবিন। সেই আগের মতই আছে স্যান্ডি হোলো৷ মিনি মার্কেটটা ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন পরিবর্তন নেই।
আজই রকি বীচ থেকে মুসার সঙ্গে এসে হাজির হয়েছে সে। জিনাকে ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে সাত দিন আগে। তার অবস্থা দেখে সেদিনই তাকে নিয়ে রকি বীচে ফিরে গেছেন তার বাবা-মা। সঙ্গে গিয়েছিল মুসা।
জিনার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। কোন কথা মনে করতে পারে। উল্টোপাল্টা আচরণ করে। বাধ্য হয়ে তাকে মেন্টাল হোমে ভর্তি করতে হয়েছে। ডাক্তারের ধারণা, বিষাক্ত কোন কিছু রক্তে ঢুকে যাওয়াতে মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে জিনার। ভ্যাম্পায়ারের কথা ডাক্তার কিংবা জিনার আব্বা-আম্মাকে বলতে যায়নি মুসা, তাকেও যদি পাগল ভেবে হাসপাতালে আটকে রাখে, এই ভয়ে। জন আর লীলার কথাও গোপন রেখেছে।
তবে কিশোর আর রবিনকে সব ঘটনা খুলে বলেছে সে।
ভ্যাম্পায়ারের কথা বিশ্বাস করেনি দুজনের কেউই, তবে কোন একটা রহস্য যে আছে, এ ব্যাপারে কিশোর নিশ্চিত। মুসা আর রবিনের সঙ্গে আসতে পারেনি সে। জরুরী কাজে রাশেদ পাশার সঙ্গে কোথায় নাকি যেতে হবে। রবিনকে নিয়ে স্যান্ডি হোলোতে ফিরে যেতে বলেছে মূসাকে। তদন্ত চালিয়ে যেতে বলেছে। সময় করতে পারলে সে নিজেও স্যান্ডি হোলোতে চলে আসবে।
গালে এসে লাগছে ভেজা নোনা বাতাস। লম্বা, বাদামী চুল উড়ছে রবিনের। কেঁপে উঠল, বাপরে, খুব ঠাণ্ডা! শীত লাগছে।
শীতই তো মজা, উনি বলল। খোলা সৈকতে অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসতে আরাম। ঠাণ্ডা পড়লে পার্টি জমে ভাল।
সবগুলো পাগল, সিসি বলল। নইলে শীতের মধ্যে কেউ করে এসব। ঘরে লেপের নিচে থাকা অনেক আরাম।
তাহলে সেটাই থাকতি, আমাদের সঙ্গে এলি কেন?
আমার ইচ্ছে।
তাহলে ওদেরও ইচ্ছে। কোনটা বেশি আরাম, তোর কাছে জিজ্ঞেস করবে নাকি?
করলে ভাল করত… কথা শেষ না করেই চিৎকার করে উঠল সিসি, দেখ দেখ, ওই যে আইসক্রীমের দোকান! নতুন হয়েছে, তাই না, টনি? আগের বার কিন্তু দেখিনি।
ভাইকে নাম ধরে ডাকে সিসি। ভাইয়া ডাকতে বললে ডাকে না, বলে ওসব পুরানো ঢঙ তার ভাল লাগে না। নাম ধরে ডাকাটা অনেক বেশি আধুনিক।
মুচকি হাসল রবিন। ভাইবোনের এই ঝগড়া ভালই লাগছে ওর। টনিকে বোকা বোকা লাগছে।
প্রিন্সেস-এর আইসক্রীম পারলার আর ভিডিও আর্কেডের দিকে তাকিয়ে চোখ চকচক করছে সিসির। ভাইয়ের হাত আঁকড়ে ধরে কো-কো শুরু করল, টনি, দে না একটা আইসক্রীম কিনে। বেশি করে যদি দিস, যা, আজ থেকে তোকে ভাইয়া ডাকাই শুরু করব।
ঘোঁৎ-ঘোৎ করে উনি বলল, পরে।
দিবি তো?
দেখা যাক। তুই কতখানি জ্বালাতন করিস, দেয়া না দেয়া তার ওপর নির্ভর করবে।
মেইন স্ট্রীটের শেষ মাথায় গিয়ে ঘুরে আবার যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে চলল ওরা।
মিনি মার্কেটটায় লোকের ভিড় তেমন নেই। সৈকতে চলে গেছে সব। এখানে তো আর কেনাকাটা করতে আসে না ট্যুরিস্টরা, বেড়াতেই আসে।
গরমকালটা এখানে ভালই কাটত, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল মুসা, যদি না
থাক থাক, কি বলতে চায় মুসা বুঝে ফেলেছে রবিন, তাড়াতাড়ি বাধা দিল, এখন ওসব কথা…
কি কথা? জানতে চাইল টনি।
বললাম তো থাক। তারচেয়ে বরং নাটকের কথা বলো। হচ্ছে তো এবার?
হ্যাঁ, হবে। না হওয়ার কোন কারণ নেই। কবে লোক বাছাই করা হবে, দুএকদিনের মধ্যেই ঘোষণা দেবেন মিসেস রথরক…
নাটকের কথা শুনতে আমার ভাল্লাগে না, সিসি বলল।
তুই থাম! ধমক দিল টনি। কোনটাই তো তোর ভাল লাগে না, তাহলে এসেছিস কেন?
লাগে তো–বেড়াতে আর আইসক্রীম খেতে…
চুপ থাক! নইলে পাবি না।
মেইন স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে ডানে মোড় নিল ওরা। এগিয়ে চলল সৈকতের দিকে। গোমড়া মুখে তিনজনের পিছে পিছে চলল সিসি। আইসক্রীম ছাড়া সৈকতে যেতে মোটেও ইচ্ছুক নয় সে।
একটা উঁচু বালিয়াড়ির গায়ে কাঠের সিঁড়ি আছে। সেটা বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। এতজনের ভারে মড়মড় করে উঠল পুরানো সিঁড়ি। ভেঙে পড়ার হুমকি দিতে লাগল।
চারপাশে তাকাল রবিন। ওরা বাদে আর কেউ নেই সৈকতে। তবে আসবে। রাত বাড়লে ভিড় বাড়ে।
চাঁদের আলোয় ঢেউয়ের মাথাগুলোকে লাগছে রূপালী মুকুটের মত। দূরে দেখা যাচ্ছে পাথরের জেটি। সাগরের মধ্যে বেশ অনেকখানি ঢুকে গেছে।
কিসের শব্দ!
আচমকা এমনভাবে কথাটা বলল রবিন, মুসা আর টনি দুজনেই চমকে উঠল। ভয় পেয়ে গেল সিসি।
শব্দটা কানে গেছে সবারই। অসংখ্য ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ।
ওই দেখো! আকাশের দিকে হাত তুলল সিসি। ওরিব্বাবা! কত বাদুড় রে!
মুসাও দেখছে। আতঙ্কের ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। তাকিয়ে আছে ওগুলোর দিকে।
অবিশ্বাস্য দৃশ্য! বিড়বিড় করল রবিন। আগের বার কিন্তু এত বাদুড় ছিল না এখানে।
কি বলেছিলাম! প্রায় ফিসফিস করে বলল মুসা। বিশ্বাস তো কয়রানি!
তুমি যা বলেছ, এখনও করছি না। পৃথিবীর বহু জায়গাতেই এ রকম বাদুড়ের ঝাক দেখা যায়। বাদুড়ের সঙ্গে ভূতের কাল্পনিক সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু বাস্তবেও আছে, এ আমি বিশ্বাস করি না।
ভাইয়ের গা ঘেঁষে বসল সিসি। শীতে না ভয়ে বোঝা গেল না। তবে যতদূর জানে মুসা আর রবিন, ভয়ডর একটু কমই আছে মেয়েটার।
আসছে তো আসছেই। বাদুড়ের ঝাক চাঁদ ঢেকে দিয়েছে। সৈকত অন্ধকার।
ধীরে ধীরে কমে এল বাদুড়। পেছনের পাহাড়ের দিকে চলে গেল। আবার বেরিয়ে এল চাঁদের মুখ।
কোত্থেকে এল ওগুলো? মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল সিসি।
সাগরের মাঝের দ্বীপটা থেকে, মুসা বলল। বাদুড়ের অত্যাচার আর ভ্যাম্পায়ারের ভয়ে ওখানকার সব মানুষ পালিয়েছে। পোড়ো বাড়িগুলো এখন…
প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যে রবিন বলল, এতদিন হলো পড়ে আছে, সিনেমার লোকেরা দেখে না নাকি দ্বীপটাকে? হরর ছবির চমৎকার শূটিং করতে পারত।
তা পারত, টনি বলল। তেমন করে নজরেই পড়েনি হয়তো কারও। তাই আসেনি।
সিনেমা থেকে আবার নাটকের প্রসঙ্গ এসে পড়ল। স্যান্ডি হোলোতে একটা থিয়েটার আছে, সামার থিয়েটার। গরমের সময় প্রতি বছরই তাতে ছেলেমেয়েদের দিয়ে নাটক করানো হয়। এবারেও হবে। স্থানীয়রা তো থাকেই, যারা বেড়াতে আসে তাদের মধ্যে থেকেও অভিনয়ের জন্যে লোক নেয়া হয়।
কি নাটক করছে ওরা? জানতে চাইল রবিন। বই পড়া ছাড়াও নাটক, গান এ সবের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আছে তার। কিছুদিন একটা গানের কোম্পানিতে পার্ট টাইম চাকরিও করেছে। আবার ওরা ডাকছে যাওয়ার জন্যে।
নাইট অভ দ্য ভ্যাম্পায়ার, নাটকের নাম বলল টনি।
কান খাড়া করে ফেলল মুসা, কাহিনীটা কি?
কি আর হবে, যে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে রাখতে চাইছিল রবিন, সেটা। আবার উঠে পড়ছে দেখে তাড়াতাড়ি বলল, ভ্যাম্পায়ারের রক্ত খাওয়ার কাহিনী। ওরা তো ওই একটা কাজই পারে। এত কিছু থাকতে ভূতের গল্প। আর কোন কাহিনী খুঁজে পেলেন না মিসেস রথরক!
এটা সেরকম না, টনি বলল। নামটা ভয়ঙ্কর হলেও আসলে হাসির নাটক।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর উঠে দাঁড়াল মুসা, চলো, ওঠা যাক।
কোথায় যাব? জিজ্ঞেস করল টনি।
আর্কেডে। আমার খিদে পেয়েছে।
আমারও, বলেই বোনের দিকে তাকাল টনি। কিন্তু যত্ত মুশকিল এই, মেয়েটাকে নিয়ে। ঝামেলা! ওর জ্বালায় না পারব রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভালমন্দ কিছু খেতে, না পারব আর্কেডে খেলতে।
ও, আমি ঝামেলা। বিরক্তির কারণ! ঝাঁঝিয়ে উঠল সিসি, বেশ, আমি থাকবই না। গেলাম বাড়ি চলে।
আঁতকে উঠল টনি, না না, যাসনে! একা গেলে মা আর আমাকে আস্ত রাখবে না!
তাহলে আর উপায় কি? আমাকে নিয়েই যেতে হবে তোদর।
যাব। তবে ঝামেলা করতে পারবি না।
করব, আইসক্রীম কিনে না দিলে। বাড়ি ফিরে গিয়ে মাকে বলব, তুই আমাকে সারা পথ ধমকাতে ধমকাতে নিয়ে গেছিস…
কতবড় মিথ্যুক রে! ধমকালাম আবার কখন? তুইই তো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে পিত্তি জ্বালাচ্ছিস।
আবার গালাগাল! চ্যাটাং চ্যাটাং, না? বেশ, যাচ্ছি বাড়ি ফিরে।
খপ করে বোনের হাত ধরে ফেলল টনি। দেখ, সিসি, কাজটা তুই ভাল করছিস না। ব্ল্যাকমেইল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
কোন্ মেইল হচ্ছে তা বুঝিটুঝি না। তবে আমি সঙ্গে যাব, আমার যা। ইচ্ছে বলব, সাফ কথা। টীচার বলেছেন, স্বাধীনভাবে কথা বলা মানুষের। গণতান্ত্রিক অধিকার…
নাও, হয়েছে! হতাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল টনি। এবার ওনার কাছে রাজনীতিও শুনতে হবে..অপরাধ হয়ে গেছে, সিসি। মাপ করে দে। তোর মরিচ গোলানো কথার তীর বন্ধ করে এবার রেহাই দে। চল, দেব। তোকে আইসক্রীম কিনে।
হাসি ফুটল সিসির মুখে, যা, দিলাম মাপ করে। তবে একটা আইসক্রীমে। আর চলবে না এখন। যতগুলো বলব, দিতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল টনি, চল, দেব। ঠাণ্ডা লেগে তোর টনসিল পচে মরলে আমার কি!
হাসতে হাসতে বলল সিসি, তখনও মা তোকেই বকবে। বলবে, আমাকে ভোগানোর জন্যে ইচ্ছে করে বেশি বেশি আইসক্রীম কিনে দিয়ে আমার টনসিল তুইই পচিয়েছিস।
.
০২.
সাত দিন পর।
ছায়ায় লুকিয়ে আছে মেয়েটা। ছোট্ট নাক। কালো চুলের লম্বা বেণি। গায়ের রঙ আমেরিকানদের মত ফর্সা নয়, বরং কিছুটা বাদামী দেখছে সে। অপেক্ষা করছে।
দুটো মেয়ে এগিয়ে আসছে। একজনের লম্বা লাল চুল। চাঁদের আলোয় চকচক করছে।
এগিয়ে আসতে আসতে দ্বিতীয় মেয়েটার দিকে তাকাল সে। এই মেয়েটার সোনালি, কোঁকড়া চুল। মুখের চামড়া মসৃণ, ফ্যাকাসে। হাঁটার সময় নাচে চুলগুলো।
খুব খিদে পেয়েছে, বলল সোনালি চুল মেয়েটা। আর সহ্য হয় না। কখন যে পাব কে জানে!
পাওয়া যাবে শীঘ্রি, দ্বিতীয় মেয়েটা বলল। লোকজন তো আর কম। নেই।
ইস, যা খিদে লেগেছে! আর সহ্য করতে পারছি না…
দেখা দেয়ার সময় হয়েছে, ভাবল বাদামী মেয়েটা। ছায়া থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেল অন্য মেয়ে দুটোর দিকে।
হাই! চোখ চকচক করে উঠল লাল-চুল মেয়েটার।
দুজনেই দৌড়ে আসতে শুরু করল।
ওই যে এসে গেছে খাবার, সঙ্গের মেয়েটাকে বলল লাল-চুল মেয়েটা। বেশিক্ষণ আর না খেয়ে থাকতে হবে না।
দাঁড়িয়ে গেল বাদামী মেয়েটা। তার দুই পাশে এসে দাঁড়াল মেয়ে দুটো। ঠোঁট ফাঁক হলো। শ্বদন্ত দেখা গেল।
লাল-চুল মেয়েটার তাড়াহুড়া বেশি। শিকারের গলার শিরায় দাঁতের চোখা মাথা ফুটিয়ে দিতে মুখ বাড়াল।
ধমকে উঠল বাদামী মেয়েটা, গাধা কোথাকার! নিজের দলের লোককে চিনতে পারো না?
দ্বিধায় পড়ে গেল মেয়ে দুটো। মুখ সরিয়ে নিল লাল-চুল মেয়েটা।
কয়েক দিন আগে আমিও তোমাদের একজন হয়ে গেছি, বাদামী মেয়েটা জানাল।
অ, হতাশ ভঙ্গিতে বলল লাল-চুল মেয়েটা।
পেটের খিদে চোখে ফুটেছে ওদের।
তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করল সোনালি-চুল মেয়েটা। দলে ঢুকিয়েছে কে?
আমি কণিকা। বাড়ি ইন্ডিয়ায়। জন ঢুকিয়েছে আমাকে।
ও, জন। বেচারা! আগুনে পুড়ে মরল শেষ পর্যন্ত। বস্ তো ওর জন্যে রোজই দুঃখ করে,। দলের সেরা এজেন্ট ছিলখ কতজনকে যে ঢুকিয়েছে কিন্তু তোমার নাম তো কখনও শুনিনি ওর মুখে?
এতজনকে ঢোকাল, কজনের নাম আর বলবে।
তা ঠিক। তা ছাড়া আমরা এসেছি দিন তিনেক হলো। গতবছরের পর আর জনের সঙ্গে দেখা হয়নি আমাদের। ওর সঙ্গে লীলাও মারা গেছে। ওদের মৃত্যুটা রহস্যময়। কি করে মারা গেছে কাউন্টও জানেন না। যে বাড়িটাতে ছিল ওরা, আগুন লেগে পুরো বাড়িটাই পুড়ে গেছে। কোন সূত্রই পাওয়া যায়নি।
তোমাদের নাম কি?
আমি কিমি, পরিচয় করিয়ে দিল সোনালি-চুল মেয়েটা। ও ডলি।
শ্বদন্ত দেখিয়ে হাসল ডলি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কণিকার দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে, কণিকা সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে। জ্বলজ্বল করছে চোখ। তাতে রাজ্যের খিদে। কণিকাও চোখ সরাচ্ছে না ওর চোখ থেকে। হেসে নিজের শ্বদন্তও দেখিয়ে দিল।
এখানে দাঁড়িয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি আমরা, ডলি বলল। আমার রক্ত দরকার। খিদেয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। এক্ষুণি চলো।
হ্যাঁ, চলো, বলল কিমি।
রাস্তার সমতলে উঠে যাওয়া বালিয়াড়িটায় চড়ল ওরা।
বছরের এই সময়টায় আমার ভীষণ খারাপ লাগে, শুকনো গলায় বলল ডলি। খাবার নেই, কিছু নেই। শুধু রক্ত খেয়ে থাকতে হয়। মানুষকে পটিয়ে রক্ত জোগাড় করা যে কি কঠিন কাজ!
রাস্তায় উঠল ওরা। শহরের মেইন রোডের দিকে এগোল। সাইডওয়াক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেকে। দুজন তরুণ-তরুণী হাঁটছে, মাঝে একটা বছর চারেকের মেয়ে। দুদিক থেকে দুজনে হাত ধরে রেখেছে বাচ্চাটার। হার্ড রক, টি-শার্ট গায়ে দুটো মেয়ে হাঁটছে গা ঘেষাঘেঁষি করে। একজোড়া প্রৌঢ় দম্পতি হেঁটে যাচ্ছে দোকানগুলোর সামনে দিয়ে। দোকানের উইন্ডোর দিকে নজর। কিছু কিনবে বোধহয়।
ওদের কাউকে ধরা যায় কিনা ভাবছে ডলি, হাত চেপে ধরল কিমি, ওই দেখো! শিকার!
খানিক দূরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওদের সমবয়েসী তিনটে ছেলে। পেছন পেছন হাঁটছে সাত-আট বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে।
সবচেয়ে লম্বা ছেলেটা নিগ্রো। পেশী দেখে বোঝা যায় নিয়মিত ব্যায়াম করে, অ্যাথলিট। দ্বিতীয় ছেলেটাও লম্বা। মাথায় খাটো করে ছাঁটা চুল। আর তৃতীয় ছেলেটা হালকা-পাতলা, গোলগাল চেহারা, বাদামী-চুল।
মাথা নেড়ে চুল ঝাঁকিয়ে, মৃদু হেসে ডলি বলল, ওদের পটানো যেতে পারে, কি বলো?
চলো, চেষ্টা করে দেখা যাক, বলল কিমি।
.
০৩.
ছেলেগুলোর দিকে এগোল তিন ভ্যাম্পায়ার।
কাছাকাছি এসে ডাকল কিমি, হাই।
ফিরে তাকাল ছেলেগুলো। মেয়েদের আসতে দেখে দাঁড়াল। বাদামী চুল ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, আমাদের বলছ?
অকারণেই খিলখিল করে হাসল কিমি, এখানে তোমরা ছাড়া আর কে আছে? বেড়াতে এসেছ বুঝি?
মোরগের মত ঘাড় কাত করে, লাল চুল নাচিয়ে হাসল ডলি। আমরাও বেড়াতে এসেছি। আমি লেবার ডে পর্যন্ত থাকব।
অ, হাত বাড়িয়ে দিল বাদামী-চুল ছেলেটা, আমি রবিন। রবিন। মিলফোর্ড।
কোন শহর থেকে এসেছ তোমরা?
রকি বীচ।
আমি হানিকম্ব থেকে।
শুনতে তো নামটা মিষ্টিই লাগছে। জায়গাটাও মিষ্টি নাকি?
আছে। মোটামুটি।
আমাদেরটাও মোটামুটি। খুব খারাপও না, খুব ভালও না।
সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দিল রবিন। নিগ্রো ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, ও মুসা আমান। আর এ হলো টনি হাওয়াই। ও সিসি। টনির বোন।
হাই, হালো, হাত মেলানো ইত্যাদি শেষ হলে কণিকা জিজ্ঞেস করল, যাচ্ছ কোথায় তোমরা?
শহরে, জবাব দিল রবিন। নাটকের জন্যে প্লেয়ার সিলেকশন করা হবে। আজ। টেস্ট দেব।
ও, ভালই হলো। আমরাও ওখানেই যাচ্ছি। চলো, একসঙ্গেই যাওয়া যাক।
মুসার বাহুর ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে দিল ডলি। শুধু শুধু হাসছে। এত দ্রুত আন্তরিক হতে চাওয়ার ব্যাপারটা মুসার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। এখানে অবশ্য অপরিচিত সবাইকেই তার সন্দেহ।
ওকে টেনে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল ডলি।
ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা। চিন্তিত।
তর সইছে না। খিদেটা ডলির সত্যি খুব বেশি, বুঝতে পারল কণিকা।
যেতে চাইছে না মুসা। অস্বস্তি বোধ করছে।
মুচকি হাসল কণিকা। বুঝতে পারছে, মেয়েদের সঙ্গে সহজ হতে পারে ছেলেটা। ভাল বিপদে পড়েছে বেচারা। মেয়েমানুষের খপ্পর।
টনি মোটামুটি স্বাভাবিক। কিমি যখন ওর হাত ধরল, মুসার মত কুঁকড়ে গেল না। বরং হাসির জবাব দিল হাসি দিয়ে।
রবিনের সঙ্গী হলো কণিকা। রবিন টনির চেয়েও স্বাভাবিক। মুসার মত অস্বস্তি বোধ করছে না। সহজ ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগল কণিকার সঙ্গে। মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে কোন অসুবিধে হয় না তার।
চলো, হটি, মুসার হাত ধরে টানল আবার ডলি।
মেইন স্ট্রীট ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। বীচ এমপোরিয়ামের উইন্ডোর সামনে দাঁড়াল কিমি। বিকিনিগুলো খুব সুন্দর।
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল ডলি, কিনবে নাকি?
নাহ, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল কিমি, পয়সা নেই।
স্যাভি হেলোতে এই প্রথম এলে বুঝি? মুসাকে জিজ্ঞেস করল ডলি।
না, আরও এসেছি।
তাহলে তো তুমি সব জানো। গরমকালে নাকি এখানে অনেক লোক আসে, পার্টি-টার্টি, হই-চই হয় খুব?
হ্যাঁ, হয়। ভরে যায়। সৈকতে আগুন জ্বেলে কাবাব বানিয়ে খায়, আড্ডা দেয়, নাচাকোদা করে। পাগল হয়ে যায় যেন সব। বুড়োগুলোও ছেলেমানুষ। হয়ে যায়।
তাই নাকি! খুব মজা হবে এবার। খোলা জায়গার পার্টি আমার খুব ভাল লাগে। তোমরা সঙ্গে থাকলে আরও বেশি জমবে।
জবাব না দিয়ে হাঁটতে থাকল মুসা।
মনে মনে হাসছে কণিকা। মুসাকে আগ্রহী করতে পারছে না ডলি।
রবিনের দিকে তাকাল কণিকা। তুমি এসেছ আর?
মাথা নাড়ল রবিন, এসেছি।
কথা বলতে বলতে এগোল ওরা।
ডলি বার বার মুসাকে দল থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। মুসাও সরতে নারাজ।
আমি বাড়ি যাব! আচমকা তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সিসি।
ফিরে তাকাল সবাই। ভুলেই গিয়েছিল যেন ওর কথা। এমনকি ওর ভাই টনিরও যেন মনে ছিল না।
এত তাড়াতাড়ি?
কেন, আম্মা বলে দিয়েছে না এগারোটার পর যেন আর না থাকি।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিমির দিকে তাকিয়ে উনি বলল, তোমরা এগোও। আমি চট করে ওকে বাড়িতে রেখে আসি। সিলেকশনের আগেই চলে আসব। সিসির দিকে তাকাল, চল! জলদি! আর যদি রাতে কখনও সঙ্গে আসতে চাস তো ভাল হবে না বলে দিলাম।
রোজ রোজ দুটো করে কোন আইসক্রীম আর একটা করে চকলেট যদি। দিস, আসতে চাইব না।
অত পাবি না। একটা আইসক্রীম, আর একদিন পর পর একটা করে চকলেট।
কি ভেবে তাতেই রাজি হয়ে গেল সিসি।
*
মুসা কোন কথা জিজ্ঞেস করছে না দেখে ডলিই আগ বাড়িয়ে বলল, নাটকের প্লটটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। মেইন একটা চরিত্র যদি পাই…
জবাব দিল না মুসা।
থিয়েটারে পৌঁছে গেল ওরা।
মুসা আর রবিনকে বলল ডলি, তোমরা যাও। আমরা আসছি।
থিয়েটারের দরজার দিকে এগিয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ডলি। খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে পেট। ভ্যাম্পায়ার হওয়ার যে এত যন্ত্রণা, আগে জানলে কে আসত!
খবরদার! চট করে কণিকার দিকে তাকাল কিমি। চোখে সন্দেহ। বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও ওদের নতুন সঙ্গীকে। আবার ফিরল ডলির দিকে। এসব কথা বোলো না। কে কোনখান থেকে শুনে ফেলবে, কাউন্ট ড্রাকুলার কানে চলে গেলে রক্ষা থাকবে না। ভ্যাম্পায়ার যখন হয়েই গেছি, মানুষের রক্ত খেয়ে ফেলেছি, এখন এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের।..কি বলো, কণিকা?
মাথা ঝাঁকাল কণিকা। তা তো বটেই!
যাই বলো, ডলি বলল, ওই মুসাটাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কি স্বাস্থ্য। অনেক রক্ত শরীরে। ওর গলায় দাঁত ফোঁটাতে পারলে… চুটকি বাজাল সে, আহ!
কিন্তু ও তোমাকে ভাল চোখে দেখছে বলে মনে হলো না, কণিকা। বলল।
তা ঠিক। অতিরিক্ত চালাক, ডলি বলল। সম্মোহনের অনেক চেষ্টা করেছি। চোখের দিকেই তাকাতে চায় না। এখানকার ভ্যাম্পায়ারের ব্যাপারে কিছু জানে নাকি কে জানে! জন আর লীলা মরার সময় কাউন্ট ড্রাকুলা এখানে ছিলেন না। তার ধারণা, ওদের মরার ব্যাপারে এখানকার কারও হাত থাকতে পারে।
মুসার কথা বলছ?
অন্য কেউও হতে পারে!
ভঙ্গিতে তো মনে হচ্ছে আমাকে সন্দেহ করছ! নাকি? তোমার সঙ্গে কিন্তু কাউন্টের পরিচয় হয়নি এখনও, ঘুরিয়ে জবাব দিল ডলি। কোথায় থাকো সেটাও জানি না আমরা…
কাউন্টের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা ছিল জনের। কিন্তু সে-ই তো নেই।…চলো, ভেতরে চলো। দেরি দেখলে মুসারা আবার অবাক হয়ে ভাববে আমাদের কি হলো।
থিয়েটারের দরজার দিকে পা বাড়াল কণিকা।
.
০৪.
স্টেজের কিনারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সব মুসা। তিরিশ-বত্রিশজন ছেলেমেয়ে আছে ঘরে। একসঙ্গে কথা বলছে সবাই। হই-চই, হাসাহাসি করছে।
কোনজন? ভাবছে সে। ওদের মধ্যে ভ্যাম্পায়ার কে? আছে কি কেউ?
সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। সামনের সারির ওই চটপটে মেয়েটাই কি সারাদিন কফিনে শুয়ে কাটিয়ে রাতে বেরোয়? নাকি ওই ছেলে দুটো? চেঁচিয়ে, পরস্পরের পিঠে চাপড় মেরে উল্লাস করছে যারা?
ও নিশ্চিত, জন আর লীলাই শেষ নয়। ওদের দলে ভ্যাম্পায়ার আরও আছে। রিকি শরকে শেষ করেছে লীলা। জন দিচ্ছিল জিনাকে শেষ করে আরেকটু হলেই। অল্পের জন্যে বেঁচেছে জিনা।
বেটে, মোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা গটগট করে হেঁটে এসে ঢুকলেন স্টেজে। সোনালি চুল ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। কোলাহল ছাপিয়ে চিৎকার করে বললেন তিনি, অ্যাটেনশন, প্লীজ! আমার কথা শোনো তোমরা!
ধীরে ধীরে কমে এল চিৎকার-চেঁচামেচি, হট্টগোল। আমি মিসেস রথরক। স্যান্ডি হোলোর এই কমিউনিটি থিয়েটারের পরিচালক। একসঙ্গে তোমাদের এতজনকে দেখে খুব ভাল লাগছে আমার।
নাটকটা সম্পর্কে বলতে আরম্ভ করলেন তিনি। আগ্রহ হারাল মুসা। অডিটরিয়ামের সীটে বসা ছেলেমেয়েদের দিকে নজর ফেরাল আবার। ওসব। হাসিমুখের যে কোনটার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক শ্বদন্ত। সুন্দর চেহারাগুলোর যে কোনটা নিমেষে পরিবর্তিত হয়ে রূপ নিতে পারে। ভয়াবহ দানবে।
কেশে গলা পরিষ্কার করলেন মিসেস রথরক। আবার তার দিকে ফিরল মুসা।
শুরু করা যাক, বললেন তিনি। রবিন মিলফোর্ড, উঠে এসো। তোমাকে দিয়েই শুরু করি।
সীটের সারির পাশ দিয়ে মঞ্চের দিকে এগোল রবিন। চেহারায় উত্তেজনার ছাপ। মঞ্চে উঠলে তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন মিসেস, রথরক। তাতে সংলাপ লেখা। পড়া আর অভিনয় একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে।
শুরু করল রবিন।
মুসার চোখ ওর দিকে। পাশ থেকে চমকে দিল ডলি, মুসা, আমি এসে গেছি।
ফিরে তাকাল সে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ডলি। বলল, দেরি করে। ফেললাম নাকি?
না, মাত্র শুরু করেছে। রবিনই প্রথম। যে রকম ঢিলামি শুরু হয়েছে, কয়েক ঘণ্টা লাগিয়ে দেবে। হয়তো দেখা যাবে আজ আর সবার টেস্ট নেয়াই হলো না।
তুমি কোন পার্টটা করছ?
ডলির গায়ের পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে মুসা। পরিচিত লাগছে গন্ধটা। মনে করতে পারছে না। আমার এসব নাটক-ফাটক ভাল্লাগে না। তবু যদি করতেই হয় সবচেয়ে ছোটটা নেব, ডেলিভারি বয়। মাত্র পাঁচ লাইনের সংলাপ। দিলে দিল দিলে নাই।
লেডি ভ্যাম্পায়ারের পার্ট করার ইচ্ছে আমার, গর্বের সঙ্গে বলল ডলি। ডায়লগ আগেই নিয়ে গিয়ে মুখস্থ করে ফেলেছি। আশা করছি পেয়ে যাব। চরিত্রটা।
পরীক্ষা দেয়া শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এল রবিন। ডলিকে জিজ্ঞেস করল, কণিকা আসেনি?
এসেছে, হাত তুলে দেখাল সে, ওই তো।
আমাকে খুঁজছ? এগিয়ে এল কণিকা। পেছনে কিমি।
কেন খুঁজছ? জানতে চাইল কণিকা।
না, এমনি। এলে একসঙ্গে, তারপর আর দেখা নেই…
ও। চলো, বসি।
আগের সীটটায়ই গিয়ে বসল রবিন। পাশে কণিকা। কিমি বসল টনির পাশে।
মুসার দিকে তাকাল ডলি। লম্বা চুলে ঝাঁকি দিয়ে হেসে বলল, আবার সেই তুমি আর আমি। একা।
জবাব দিল না মুসা।
মিসেস রথরক বললেন, টনি হাওয়াই, অভিনয় করবে? বলে ঘুরতেই ডলির ওপর চোখ পড়ে গেল, ও, ডলিও এসে গেছ। ভাল। তোমার কথাই ভাবছিলাম।
এখানকার ছেলেমেয়েদের অনেকেই তার পরিচিত।
হ্যাঁ, এসেছি, এক পা এগিয়ে গেল ডলি।
টনির আগে তুমি টেস্ট দিতে চাও?
অসুবিধে নেই। উনি আগে গেলেও হয়।
ঠিক আছে, তুমিই এসো আগে। তোমার চরিত্রটা বড়।
এগিয়ে গেল ডলি। মঞ্চের মাঝখানে গিয়ে দর্শকের দিকে ফিরে হাসল।
অনেকের মত মুসাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ভ্যাম্পায়ার হওয়া বড়ই কঠিন কাজ, সংলাপ বলার আগে লেকচার দিতে শুরু করল ডলি। যে না হয়েছে, সে বুঝবে না। গুঙিয়ে উঠল সে।
বাই ভাবল অভিনয় করছে ডলি, কিন্তু কণিকা আর কিমি বুঝতে পারছে, গোঙানিটা সত্যি। খিদেয় এমন করছে।
একটা বিশেষ দৃশ্য অভিনয় করে দেখাতে বললেন মিসেস রথরক।
অভিনয় শুরু করল ডলি।
ভালই, বলে উঠল মুসার কাছে দাঁড়ানো একটা মেয়ে। তবে অতি অভিনয় করছে।
ফিরে তাকাল মুসা। মেয়েটা সুন্দরী। কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে বলতে পারবে না। মঞ্চের দিকে চোখ থাকায় খেয়াল করেনি এতক্ষণ। মাথাভর্তি কালো চুল। এত নিঃশব্দে এল কি করে! ভ্যাম্পায়ার নাকি?
ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, কি বললে?
বললাম, অতি অভিনয়। নাটক না হয়ে কার্নিভলের যাত্রা হয়ে যাচ্ছে।
আস্তে বলো। শুনতে পেলে দুঃখ পাবে।
পায় পাক। ভুল তো আর বলিনি।
খুব বেশি আত্মবিশ্বাস মনে হচ্ছে তোমার?
জবাবে হাসল মেয়েটা। ডান হাতটা মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি অ্যানি। ওই চরিত্রটার জন্যেই টেস্ট দেব আমিও।
কয়েক মিনিট পর ডলিকে বিদেয় করে দিয়ে মিসেস রথরক ডাকলেন, এনিড ক্যামেরন, এবার তুমি এসো।
নড়ে উঠল অ্যানি। মুসার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হেসে বলল, যাচ্ছি, দোয়া কোরো।
হালকা পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে মঞ্চে উঠল সে।
ভ্যাম্পায়ার হিসেবে কাকে বেশি সন্দেহ করা উচিত, ভাবতে লাগল মুসা। ডলি, না অ্যানি? অ্যানিই হবে। ডলি অতিমাত্রায় সরব। অ্যানি শান্ত। ছায়ার মত নিঃশব্দ চলাফেরা তার।
অ্যানি অভিনয় শুরু করতেই নীরব হয়ে গেল সমস্ত অডিটরিয়াম। যেন কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সে। নাক কুঁচকাল, মোরগের মত ঘাড় কাত করল, হাসল, ভ্রূকুটি করল।
তাকিয়ে আছে সবাই।
মুসা নাটক বোঝে না। কিন্তু অ্যানি আর ডলির অভিনয় দেখে এটুকু অন্তত বুঝল, দুজনের মধ্যে কে ভ্যাম্পায়ারের অভিনয় ভাল করতে পারবে।
ডায়লগ বলা শেষ হতেই তুমুল হাততালি পড়তে লাগল। লজ্জা পেল অ্যানি। লাল হয়ে গেল। মঞ্চ থেকে নেমে এগিয়ে এল মুসার দিকে।
তুমি দারুণ অভিনয় করো! প্রশংসা করল মুসা। সত্যি বলছ? পার্টটা পেলে খুব খুশি হতাম।
ওর চকচকে বাদামী চোখের দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। কোমল, কেমন যেন পুরানো ধাচের চোখ। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে ওর। ভ্যাম্পায়ারের বয়েসের কোন ঠিকঠিকানা থাকে না। কোন্ আমলের মানুষ অ্যানি!
এখান থেকে বেরিয়ে কোন কাজ আছে তোমার? জানতে চাইল অ্যানি।
নাহ। চলো না তাহলে হেঁটে আসি কোনখান থেকে। সৈকতে যাবে?
তা যাওয়া যায়, ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভেবে বুকের মধ্যে কাপুনি শুরু হয়ে গেল মুসার। কিন্তু অ্যানি কি সতি, ভ্যাম্পায়ার? বাইরে নির্জনতার মধ্যে না গেলে সেটা বোঝা যাবে না। প্রমাণ করতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে। ভূতের সঙ্গেই বেরোতে হবে।
দাঁড়াও, আসছি, বলে বাথরূম সারতেই বোধহয় মঞ্চের পেছনের পর্দা। সরিয়ে ওপাশে চলে গেল অ্যানি।
বেশি মানুষের সঙ্গে জানাশোনা হবে, তত ভাল। ভ্যাম্পায়ারের খোঁজ পাওয়া সহজ হবে। কোনজন যে ভ্যাম্পায়ার, কাছাকাছি না এলে বোঝা যাবে না।
সীটের দিকে ফিরে দেখল রবিন আর কণিকা বেরিয়ে যাচ্ছে।
পেছনে এসে দাঁড়াল ডলি। বলল, কিছুক্ষণের মধ্যে কে কোন পার্টটা পাবে, ঘোষণা করবেন মিসেস রথরক।
তুমি যেটা চাইছ, পাবে বলে মনে হয়?
না পাওয়ার কোন কারণ আছে? চোখের পাতা সরু হয়ে এল ডলির।
না না, তা বলছি না, ডলির প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হলো মুসা। তুমি কি ভাবছ সেটা জানতে চাচ্ছিলাম। রাগার কিছু কিন্তু বলিনি।
সামলে নিল ডলি, পার্টটা আমিই পাব।
অভিনয় তেমন বুঝিটুঝি না। তবে আমার মনে হয়েছে ভাল অভিনয় করেছ তুমি।
চেহারা আবার স্বাভাবিক হয়ে এল ডলির। বাইরে যাবে? চলো না, ঘুরে আসি। বদ্ধ ঘরে ভাল লাগছে না।
তোমার সঙ্গে যেতে পারব না।
কেন? ঘাড় বাকিয়ে তাকাল ডলি।
ঘাবড়ে গেল মুসা। আবার রেগে যাবে না তো!
না, আর রাগল না ডলি। মুসার চোখের দিকে তাকাল। আঠার মত আটকে গেল যেন দৃষ্টি।
মুসার মনে হতে লাগল তাকে কোন অদ্ভুত জায়গায়, স্বপ্নের মধ্যে টেনে নিয়ে চলেছে মেয়েটা। নিচের অন্ধকার খাদের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে সে।
এমন লাগছে কেন! জোর করে চোখ সরিয়ে নিল।
অবাক হলো ডলি। সেই সঙ্গে হতাশ। অভিমানের সুরে বলল, আমার সঙ্গে যেতে পারবে না কেন?
অ্যানিকে কথা দিয়ে ফেলেছি-ওর সঙ্গে বেরোব।
হতাশা ছেয়ে দিল ডলির চেহারা।
ওর অবস্থা দেখে মায়া লাগল মুসার। তুমি যেতে চাও আগে বললে না কেন? তাহলে অ্যানিকে আর…
অ্যাটেনশন প্লীজ! জোরে জোরে বলতে লাগলেন মিসেস, রথরক। আমার কথা শোনো! নাটকের জন্যে যারা যারা সিলেক্টেড হয়েছ, তাদের নাম ঘোষণা করছি। সবাই তোমরা ভাল অভিনয় করেছ। এত ভাল যে, কাকে বাদ দিয়ে কাকে নেব সেটা ঠিক করতেই বেকায়দায় পড়ে গেছি। সবাইকে নেয়ার মত এত চরিত্র আমাদের নাটকে নেই। তাই বাধ্য হয়ে কয়েকজনকে বাদ দিতে হয়েছে…
যারা বাদ পড়েছে তাদের দুঃখ ঘোচানোর জন্যে প্রচুর ভাল ভাল কথা বললেন তিনি। সান্ত্বনা দিলেন। শেষে নাম ঘোষণা করতে লাগলেন।
টনি, রবিন, মুসা তিনজনেই সুযোগ পেল। পেল কণিকা আর কিমি। অ্যানিকে মেইন রোলটা পেতে দেখে অবাক হলো না মুসা। ডলিকে দেয়া হলো একটা বড় চরিত্র। ডলি তাতে খুশি হতে পারল না মোটেও। অ্যানি যেটা পেয়েছে সেটা চেয়েছিল সে।
মুসা, রোলটা পেয়েই গেলাম শেষ পর্যন্ত! উল্লাসে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো অ্যানির।
পাবে, সে তো জানা কথা। তোমার পাওয়ার ব্যাপারে একবিন্দুও সন্দেহ ছিল না আমার।
সত্যি বলছ?
মিথ্যে বলব কেন?
থ্যাংক ইউ, ঝলমলে হাসি উপহার দিল অ্যানি। চলো, বেরোই। নাকি আরও থাকবে?
না, আর কি? হয়েই তো গেল। টেস্ট দিলাম, চান্স পেলাম, ব্যস।
এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলল মুসা। ধরে রাখল, অ্যানির বেরোনোর জন্যে।
বাইরে বেরিয়ে আগে আগে হাঁটতে শুরু করল অ্যানি। মুসাও পা বাড়িয়েছে, খুট করে শব্দ হলো পেছনে ফিরে তাকাল। সাৎ করে একটা ছায়া সরে গেল দরজার কাছ থেকে। ক্ষণিকের জন্যে আলো পড়ল ছায়াটার। মুখে। ডলিকে চিনতে ভুল হলো না তার।
একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ডলি। তারপর দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা। রাগ দেখাল। মুসার সঙ্গে বেরোতে না পারার দুঃখ ভুলতে পারছে না।
কিছু করার নেই মুসার। অ্যানিকে কথা দিয়েছে আগে।
.
০৫.
সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে চাঁদের দিক মুখ তুলে তাকাল অ্যানি। জ্যোৎস্নায়। অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগছে ওকে।
মেয়ে ভ্যাম্পায়াররা যে সুন্দরী মেয়ের রূপ ধরে আসে, ভোলেনি মুসা। কিন্তু অ্যানিকে ভ্যাম্পায়ার ভাবতে ভাল লাগল না। তবে অসতর্কও হলো না। ভ্যাম্পায়াররা নানা ছলনা জানে। ওদের মায়ার জালে জড়ালে রিকি আর জিনার অবস্থা হতে দেরি হবে না তারও।
পানির কিনার দিয়ে হাঁটছে ওরা। নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই। ডানে পাথরের জেটিতে আছড়ে পড়ছে ঢেউ।
সামনের দিকে হাত তুলে অ্যানি জিজ্ঞেস করল, ওরা কি তোমার বন্ধু?
পানিতে নেমে পাশাপাশি হাঁটছে রবিন আর কণিকা। ঢেউ আছড়ে পড়ছে ওদের পায়ে।
মেঘের আড়ালে চলে গেল চাঁদ। অন্ধকারে হারিয়ে গেল দুজন। আবার যখন বেরোল চাঁদ, আর দেখা গেল না ওদের।
অবাক হলো মুসা। এত তাড়াতাড়ি গেল কোথায় ওরা?
কয়েক মিনিট নীরবে হাঁটল মুসা আর অ্যানি। আবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। অনবরত চলতে লাগল চাঁদের এই লুকোচুরি খেলা।
অ্যানি বলল, রাত নিশ্চয় অনেক। কটা বাজে?
অন্ধকারে ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল মুসা। দেখা যাচ্ছে না। এগারোটার বেশিই হবে।
বাড়ি যাওয়া দরকার। দেরি করলে আম্মা চিন্তা করবে।
বাহ, ভ্যাম্পায়ারের আবার আম্মাও থাকে!–ভাবল মুসা। যদিও এখন পর্যন্ত কোন রকম অস্বাভাবিক আচরণ করেনি অ্যানি। সময় নিচ্ছে আরকি। ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
কাল যাচ্ছ তো থিয়েটারে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
নিশ্চয়ই।
চলো, তোমাকে দিয়ে আসি।
লাগবে না। আমি একাই চলে যেতে পারব। শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না তোমার।
শহরের দিকে রওনা হয়ে গেল অ্যানি। যতক্ষণ দেখা গেল ওকে, তাকিয়ে। রইল মুসা।
ধীরে ধীরে বালিয়াড়ির ওপাশে হারিয়ে গেল অ্যানি।
*
খুব ভাল লাগছে আমার, কিমি বলল। আজকের রাতটা খুব সুন্দর।
আমারও ভাল লাগছে, টনি বলল। সৈকতের কিনারে সাগরের দিকে মুখ করা বারান্দায় বসে আছে দুজনে। মস্ত কটেজটা ভাড়া নিয়েছেন টনির বাবা।
চলো না, সৈকতে হেঁটে আসি।
কি দরকার। এখানেই তো ভাল লাগছে।
তা লাগছে। গেলে আরও ভাল লাগত, সুযোগের অপেক্ষায় আছে। কিমি। টনিকে সম্মোহিত করে, ওষুধ শুকিয়ে কাবু করে রক্ত খাওয়ার অপেক্ষা। এভাবে বসে থাকলে সে-সুযোগ পাবে না। উঠে দাঁড়াল সে। রেলিঙের কাছে গিয়ে পেট ঠেকিয়ে দাঁড়াল।
খানিকক্ষণ বসে থেকে টনিও উঠে গেল।
ফিরে তাকাল কিমি। টনির মুখোমুখি হলো। জ্যোৎস্নায় খুব সুন্দর লাগছে ওকে। টনির চোখ আটকে গেল কিমির চোখে।
আরও কাছে চলে এল কিমি। হাত নাড়ল টনির নাকের সামনে। কিমির চাহনিতেই কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল টনি, মিষ্টি গন্ধে অবশ হয়ে আসতে লাগল শরীর।
ওর কাঁধে দুই হাত রাখল কিমি। ধীরে ধীরে মুখটা নামিয়ে আনতে লাগল। গলার কাছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে দপদপ করছে শিরাটা। মুহূর্তে খিদে চাগিয়ে উঠল। প্রবল হয়ে গেল রক্তের তৃষ্ণা। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল আপনাআপনি। বেরিয়ে পড়ল তীক্ষ্ণ মাথাওয়ালা শ্বদন্ত। কুটুস করে ফুটিয়ে দিলেই হলো এখন। রক্ত বেরিয়ে আসবে ফিনকি দিয়ে। চুষে চুষে খাবে সে।
সাবধান, অত উতল হয়ো না!–নিজেকে হুঁশিয়ার করল কিমি। লোভ সামলাও। রক্ত শুষে ওকে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলো না। ও মরে গেলে ভীষণ বিপদে পড়বে।
শিরাটার ওপর মুখ নামাল সে। দাঁত চেপে ধরল। ফুটিয়ে দিতে যাবে, ঠিক এই সময় শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার, অ্যাই, কি করছ তোমরা?
ঝটকা দিয়ে মুখ সরিয়ে একলাফে পিছিয়ে গেল কিমি। ঠোঁট দিয়ে চেপে ঢেকে ফেলল দাঁত দুটো। গলা শুনেই বুঝতে পারল টনির বোন সিসি। সর্বনাশ! শঙ্কিত হলো কিমি। বিন্দু মেয়েটা শ্বদন্ত দুটো দেখে ফেলেনি তো?
টনিরও ঘোর কেটে গেল। চিৎকার করে উঠল, সিসি, চেঁচাচ্ছিস কেন?
দেখতে এসেছিলাম, তোরা কি করছিস, বলে হি-হি করে হাসতে লাগল সিসি।
রাগ আগ্নেয়গিরির লাভার মত ফুটতে শুরু করল কিমির মগজে। সিসির ঘাড় চেপে ধরে ওর গলাতেই দাঁত ফুটিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সেটা করতে যাওয়া হবে চরম বোকামি। যতই ঝগড়া করুক, বোনকে প্রচণ্ড ভালবাসে টনি। মুসা আর রবিনও পছন্দ করে। সিসির কিছু হলে। ভ্যাম্পায়ারের পেছনে আদাজল খেয়ে লাগবে তিনজনে। সাংঘাতিক বিপদে ফেলে দেবে। স্যান্ডি হোলো ছাড়তে বাধ্য করবে।
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল কিমি।
পারছে না কোনমতে। পেটে খিদে না থাকলেও এক কথা ছিল। এখানে থাকলে নিজেকে সামলাতে না পেরে শেষে কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে কে জানে! চলে যাওয়াই ভাল।
আমি যাই, টনি, বলে আর একটা মুহূর্ত দাঁড়াল না সে। দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করল। কানে এল, ওর চলে যাওয়ার জন্যে বোনকে দায়ী করে বকাবকি শুরু করেছে টনি।
*
রাত দুপুরে ঘনঘন কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। এতরাতে কে? আধো ঘুম নিয়ে বিছানা থেকে নামল সে। দরজা খুলতে চলল।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিশ অফিসার। মুসার নাম জানতে চাইল একজন।
মুসা।
পুরো নাম?
মুসা আমান।
আজ রাতে এনিড ক্যামেরনের সঙ্গে সৈকতে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, ডলে ডলে চোখ থেকে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করল মুসা। কেন? কিছু হয়েছে নাকি?
কটার সময় শেষ দেখেছ ওকে?
এই….এগারোটা-সাড়ে এগারোটা হবে।
তোমার আব্বা আছেন বাসায়?
না, মাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে হ্যাঁমারহেডে। বলে গেছে শনিবার নাগাদ আসবে। কেন, বাবাকে দরকার?
না, তোমাকেই দরকার।
পরস্পরের দিকে তাকাল দুই অফিসার। একজন পুরুষ। ছয় ফুটের বেশি লম্বা। মাংসপেশীর পাহাড় মনে হয়। দ্বিতীয়জন কঠোর চেহারার মহিলা। দুজনেই গম্ভীর।
অ্যানির কিছু হয়েছে? জানতে চাইল মুসা।
ওকে পাওয়া যাচ্ছে না, অফিসার জানাল।
কে খবর দিল আপনাদের?
ওর আম্মা।
তারমানে সত্যি সত্যি আম্মা আছে অ্যানির। ভ্যাম্পায়ার নয় সে।
কোথায় তাকে শেষ দেখেছ? জানতে চাইল মহিলা অফিসার।
সৈকতে।
সৈকতের কোনখানে?
শহরের কিনারে। একটা বালিয়াড়ির কাছে। কমিউনিটি থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ওখানে হাঁটতে গিয়েছিলাম আমরা।
জায়গাটা আমাদের দেখাতে পারবে?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
কাপড় পরে তাহলে এসো একটু আমাদের সঙ্গে।
পেট্রলকারের পেছনে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মুসা।? ভেসে ভেসে যেন সরে যাচ্ছে নির্জন, ঘুমন্ত শহরটা। খড়খড় করছে টু-ওয়ে রেডিওর স্পীকার। কথা হচ্ছে। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলছে অফিসাররা, বুঝতে পারল না সে।
অ্যানির কথা ভাবতে লাগল। মনে পড়ছে ওর চকচকে চুল। উজ্জ্বল হাসি।
আস্তে চালান, শহরের কিনারে পৌঁছে অফিসারদের বলল সে। আরেকটু সামনেই। মসৃণ, রূপালী সৈকতটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ বলে উঠল, হ্যাঁ, থামুন, এখানেই।
সঙ্গে সঙ্গে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল অফিসার।
গাড়ি থেকে নামল মুসা। ছোট বালিয়াড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে গিয়ে ঠাণ্ডা বালি ঢুকছে জুতোর মধ্যে।
ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে দুই পুলিশ অফিসার। ওদের হাতের শক্তিশালী টর্চের রশ্মি হলুদ আলোর বৃত্ত সৃষ্টি করছে বালিতে।
এখানেই হাঁটছিলাম আমরা, মুসা বলল। গালে এসে লাগছে সাগরের। ফুরফুরে হাওয়া। নোনা গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে পচা শ্যাওলার গন্ধ।
পেছনে দুদিকে সরে গিয়ে আলো ফেলে ফেলে দেখতে শুরু করল দুই অফিসার।
সৈকতের এপাশ-ওপাশ, সামনে-পেছনে চোখ বুলিয়ে অনুমানের চেষ্টা করল মুসা, কোথায় যেতে পারে অ্যানি?
রাতে এই সৈকত ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সর্বক্ষণ চলে ভ্যাম্পায়ারের আনাগোনা।
বালিয়াড়ির সাদা বালিতে উঁচু হয়ে আছে কালোমত একটা কি যেন। শেষবার এই বালিয়াড়িটার আড়ালেই হারিয়ে যেতে দেখেছিল অ্যানিকে। কৌতূহল হলো। এগিয়ে চলল ওটার দিকে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল, টর্চ হাতে খুজতে খুজতে দূরে সরে যাচ্ছে দুই অফিসার। পানির কিনারে খুঁজছে দুজনে। হয়তো ভাবছে রিকির মত পানিতে ডুবে মারা গেছে অ্যানিও।
কালো ঢিবিটার কাছে চলে এল মুসা। ভালমত দেখার জন্যে নিচু হয়ে তাকাল। পরক্ষণে সোজা হয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল দুই অফিসারকে।
০৬.
বালিতে চিত হয়ে পড়ে আছে অ্যানি। একটা হাত বুকের ওপর, আরেক হাত পাশে ছড়ানো। চাঁদের আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে সাদা চামড়া। নিথর হয়ে পড়ে আছে সে।
কোন কিছুতে হাত দিয়ো না, মুসাকে সাবধান করল মহিলা অফিসার। সরে যেতে বলল।
অ্যানির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। খোলা চোখ দুটো নিপ্রাণ, শূন্য চাহনি মেলে যেন তাকিয়ে রয়েছে রাতের আকাশের দিকে। হাঁ হয়ে থাকা মুখ বালিতে ভরে গেছে। নাকের ফুটোয়ও বালি।
জানা দরকার কি করে মারা গেল ও। কাছে যেতে মানা করেছে তাকে। অফিসাররা। করুক। শুনবে না কথা। জানতেই হবে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুজনে। মুসার দিকে চোখ নেই। এই সুযোগে অ্যানির লাশের কাছে চলে গেল সে। বসে পড়ে হাত বাড়িয়ে গলার কাছের চুল সরিয়ে দিল।
চিৎকার করে উঠল দুই অফিসার। ওকে সরিয়ে নিতে এল একজন।
ততক্ষণে যা দেখার দেখে ফেলেছে মুসা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা। গেল গলার শিরার ওপরের চামড়ায় দুটো ফুটো। দুই ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে কালো হয়ে আছে।
এই জিনিস দেখারই আশঙ্কা করেছিল। তারমানে তার সন্দেহ ঠিক। লীলা আর জন ছাড়াও আরও ভ্যাম্পায়ার আছে এই এলাকায়। ওগুলোকে থামানো দরকার। নইলে রিকি আর অ্যানির মত আরও কত জীবন যে নষ্ট করবে ঠিক নেই।
চাপা রাগ ফুঁসে উঠতে লাগল ভেতরে ভেতরে। ওখানে দাঁড়িয়েই আরও একবার প্রতিজ্ঞা করল, সবগুলোকে ধ্বংস না করে ক্ষান্ত হবে না।
খুঁজে বের করবে!
খুন করবে একে একে!
কোনটাকে রেহাই দেবে না। স্যাভি হোলোকে পুরোপুরি মুক্ত করবে। ভ্যাম্পায়ারের কবল থেকে।
*
বালিতে বসে পড়ল মুসা। মাথার মধ্যে কেমন ঘোর লেগে আছে।
মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে আরও অনেক পুলিশ এসে হাজির হয়েছে। কাজে ব্যস্ত ওরা। লাশটা যেখানে পাওয়া গেছে, সাদা রঙের প্লাস্টিকের খুটি দিয়ে তার চারপাশ ঘিরে দিয়েছে। সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিভাবে মারা গেল মেয়েটা বোঝার চেষ্টা করছে।
বসেই আছে মুসা।
অবশেষে কাজ শেষ হলো পুলিশের। ওকে ডাকল একজন। একটা গাড়িতে তুলে নিল।
চুপচাপ বসে রইল সে। কারও সঙ্গে কোন কথা বলল না। ওরাও তাকে জিজ্ঞেস করল না কিছু। থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওকে। অন্ধকার শহরটা ওর পাশ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে যেন স্বপ্নের মধ্যে।
মেইন স্ট্রীট আর ওশন অ্যাভেনিউটা যেখানে ক্রস করেছে, তার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। পাথরে তৈরি পুরানো বাড়ি। জানালায় মোটা। লোহার শিক লাগানো। জেলখানার মত। হাজত, না জেল?
অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে।
শেষবার ওর সঙ্গে দেখা গেছে অ্যানিকে। লাশটাও খুঁজে বের করেছে সে। তার জন্যে কি সন্দেহ করা হচ্ছে ওকে?
ওকারিশ নামে একজন ডিটেকটিভ তার অফিসে নিয়ে ঢোকাল মুসাকে। তারপর শুরু হলো মুষলধারে প্রশ্ন। একই প্রশ্ন বার বার। কখনও কণ্ঠস্বর চড়িয়ে, কখনও নামিয়ে; কখনও ধমকের সুরে, কখনও কোমল স্বরে–কোথায় দেখা হয়েছে অ্যানির সঙ্গে, কতদিনের পরিচয়, শেষবার ওর সঙ্গে কোনখানে ছিল, কতক্ষণ, ইত্যাদি ইত্যাদি এবং আরও নানা প্রশ্ন।
জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেল মুসা।
ভোরের ঘণ্টাখানেক আগে ছাড়া পেল সে। হেঁটে চলল মেইন স্ট্রীট ধরে, বন্ধ দোকানগুলোর পাশ দিয়ে। একটা লোককেও দেখা গেল না এ সময়ে।
দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে চাইছে যেন। থানার কাছ থেকে। সে যে নির্দোষ এটা পুলিশকে বোঝাতে পেরেছে কিনা বুঝতে পারছে না।
মনে হয় পারেনি। ওকারিশ ওকে সন্দেহ করে বসে আছে। ছেড়ে দিয়েছে বোধহয় ওর গতিবিধির ওপর চোখ রাখার জন্যে।
দোতলার শিক লাগানো জানালাগুলোর কথা মনে পড়তে আবার কেঁপে উঠল সে। ওর মধ্যে আটকা থাকতে হলে মরেই যাবে।
আবার অ্যানির কথা ভাবল।
রিকির কথা ভাবল।
রাগটা মাথা চাড়া দিল আবার। মনে মনে আবারও কসম খেল, ভ্যাম্পায়ারের দলকে ধ্বংস না করে শান্ত হবে না।
কি করে খতম করতে হয় ওদের, ভালমতই জানে এখন সে। ড্রাকুলার বইতে পড়েছে। একজন পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করেছে। একজন মওলানাকে জিজ্ঞেস করেছে। পাদ্রী বলেছেন, কাঠের চোখা খুঁটি ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভ্যাম্পায়ারের বুকে। ক্রুশ বাড়িয়ে ধরলে ভ্যাম্পায়ার আর এগোয় না। মওলানা বলেছেন, আল্লাহ-রসুলের নাম করলে কোন জিন-ভূতেরই সাধ্য নেই। কাছে এগোয়। দুজনেই একটা ব্যাপারে একমত রোদের আলো আর আগুন সহ্য করতে পারে না রক্তচোষা ভূত। রোদের মধ্যে বের করে নিয়ে এলে, কিংবা গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলে ধ্বংস হতে বাধ্য। বুকে কাঠের খুঁটি পোঁতার চেয়ে আগুন ধরানোটাই সহজ মনে হয়েছে ওর কাছে।
তবে সবার আগে, প্রথম কাজটা হলো ওদের খুঁজে বের করা
*
সাঁঝের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কণিকা। কেমন অসহায় বোধ করছে। কোথায় ওরা?–ভাবল। সব সময় এত দেরি করে কেন আসতে? শহরে গিয়ে ছেলেগুলোকে খুঁজে বের করার কথা ভাবল একবার।
চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিল উড়তে থাকা লম্বা কালো চুল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। ওর এত তাড়া থাকাটা উচিত না। ডলি আর কিমি কখনও তাড়াহুড়া করে না।
পা থেকে স্যান্ডেল খুলে নিল সে। ঠাণ্ডা বালি ঢুকে যাচ্ছে আঙুলের ফাঁকে। হাঁটতে গেলে লাফ দিয়ে দিয়ে উঠে আসছে পায়ের পাতার ওপরে।
মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দে মুখ তুলে তাকাল সে। অনেকগুলো বাদুড় একসঙ্গে উড়ে চলেছে পাহাড়ের দিকে।
বালিয়াড়ির পাশ দিয়ে চলার সময় খিলখিল হাসির শব্দে চমকে গেল। ফিরে তাকিয়ে দেখল টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে কিমি আর ডলি। ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর।
ঘাবড়ে গেল কণিকা। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল দুজনকে। চিৎকার করে উঠল, এই, কি করছ!
রক্ত খাব, জবাব দিল ডলি।
কি যা তা বলছ! আমি তোমাদের স্বজন!
স্বজনের রক্তই খাব আজ, কিমি বলল।
দুজনে যুক্তি করে এসেছে, বুঝতে পারল কণিকা। তারমানে আমাকে– বিশ্বাস করতে পারছ না?
না, পারছি না, ডলি বলল। তুমি যে আমাদের স্বজন, কি করে বুঝব?
কি করে বুঝতে চাও?
তোমার গলায় দাঁত বসাব। রক্তের স্বাদ থেকেই বুঝে যাব, তুমি আসল না নকল।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজনকে দেখতে দেখতে কণিকা বলল, কাউন্ট ড্রাকুলা বলেছেন বুঝি?
যদি বলি তাই?
একই কথা তো আমিও তোমাদের বলতে পারি। আমি যদি বলি, আমার সন্দেহ তোমরা নকল। কাউন্ট ড্রাকুলা আমাকে বলেছেন তোমাদের রক্ত খেয়ে দেখার জন্যে। তাহলে কি বলবে?
প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কিমি আর ডলি। পরস্পরের দিকে তাকাতে শুরু করল।
দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে ওদের বুঝতে পেরে চাপ দিল কণিকা, কই, দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো, রক্ত টেস্ট করো আমার। তারপর আমি তোমাদের রক্ত টেস্ট করব।
ডলির দিকে তাকিয়ে আচমকা ধমকে উঠল কিমি, তখনই বলেছি, এসব চালাকির দরকার নেই। ও আমাদেরই লোক। জন যখন ঢুকিয়েছে, নকল। হতেই পারে না, কাউন্ট ড্রাকুলা যতই বলুন। নইলে আমাদের যা করতে বললেন, একই কাজ কণিকাকেও করতে বলবেন কেন? কণিকার দিকে তাকাল, থাক, নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করে আর লাভ নেই। কোথায় যাচ্ছিলে?
শহরে।
আমরাও যাব।
.
০৭.
পরদিন সন্ধ্যায় রবিনকে ফোন করল মুসা। সারাদিন ওর খোঁজ পায়নি। আশা করেছিল, আসবে। আসেনি। সে নিজেও যোগাযোগ করতে পারেনি। সারারাত থানায় কাটিয়ে এসে ভোরের দিকে সেই যে শুয়েছিল, উঠেছে। দুপুরের পর। সাগরে গিয়ে সাঁতার কেটেছে অনেকক্ষণ। ফিরে এসে গোসল করে খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে বিকেল শেষ। কাপড় পরে বেরোনোর জন্যে রেডি হয়ে এখন রবিনকে ফোন করল।
ফোন ধরল বোর্ডিং হাউসের অ্যাটেনডেন্ট। ওখানেই উঠেছে রবিন। মুসার শত চাপাচাপিতেও ওদের ভাড়া করা কটেজে ওঠেনি। লোক বাড়লে গাদাগাদি হয়ে যাবে, আঙ্কেল আর আন্টির অসুবিধে হবে। বেড়াতে আসা মানুষকে কোনভাবে বিরক্ত করা উচিত না।
রবিন কোথায়? জানতে চাইল মুসা। রবিন মিলফোর্ড?
ঘরে। আপনি কে?
আমি তার বন্ধু। মুসা আমান। ডেকে দেয়া যাবে, প্লীজ?
ধরো। দিচ্ছি।
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ শুনতে পেল মুসা। বেশ দেরি করে এসে ফোন ধরল রবিন।
কে, মুসা? অ্যানির খবর শুনেছ?
হ্যাঁ। কেবল শুনিইনি, নিজের চোখে লাশ দেখে এলাম, মুসা বলল। কাল রাতে সৈকতে গিয়েছিল আমার সঙ্গে। বেড়িয়ে-টেড়িয়ে সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে চলে গেল। রাত দুপুরে পুলিশ এসে ঘুম থেকে জাগাল আমাকে। বলল বাড়িতে ফিরে যায়নি সে। ওর মা নাকি খোঁজাখুঁজি করছে। আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে। সৈকতে লাশ খুঁজে পাওয়ার পর আমাকে থানায় ধরে নিয়ে গেল। তারপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন। যেন খুনিটা আমিই।
মানুষের জীবনটা কি অদ্ভুত, তাই না? কাল দেখলাম বেঁচে আছে, হেসেখেলে বেড়াচ্ছে, অভিনয় করছে, আজ নেই। কোনদিন আর মঞ্চে উঠবে না, কথা বলবে না… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।
মুসা চুপ করে আছে। অ্যানির গলার দাগগুলোর কথা বলবে কিনা ভাবছে। রবিন বিশ্বাস করবে না। এতদিন যেমন করেনি, এখনও করবে না।
মুসা, শুনছ?
হ্যাঁ।
চুপ করে আছ কেন?
এমনি। তোমার কথা শুনছি। তোমার গলা এমন লাগছে কেন? শরীর খারাপ নাকি?
হ্যাঁ। খুব টায়ার্ড লাগছে সারাটা দিন ধরে। কেন এ রকম হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আর ঘুম! বিছানা থেকেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে সাতদিন ঘুমাইনি।
অসুখটা কি?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না। শরীরটা যেন একেবারে ভেঙেচুরে গেছে। আর দুর্বল কাকে বলে। আঙুল নড়াতেও ইচ্ছে করে না।
শঙ্কিত হয়ে উঠল মুসা। খারাপ ভাবনাগুলো মনে আসতে দিল না। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল, জুরটর আসবে হয়তো। রিহারস্যালে যাবে?
চেষ্টা করব। কণিকাকে কথা দিয়েছি ওর সঙ্গে কার্নিভল দেখতে যাব।
বন্ধুত্বটা তাহলে ভালমতই হয়ে গেছে, হাসল মুসা।
কি জানি! মেয়েটা যেন কেমন। এখনই ভাল, এখনই কেমন হয়ে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক। খুব অবাক লেগেছে আমার।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মুসা বলল, ঠিক আছে, রাখি। থিয়েটারে দেখা হবে।
রিসিভার রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। রবিনের ক্লান্তির কথা শুনে ভাল লাগছে না। ভ্যাম্পায়ারের খপ্পরে পড়ার পর রিকির ক্লান্ত লাগত, জিনারও লাগত। ক্লান্তি, ঘুম, বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে না করা, ফ্যাকাসে চেহারা, ঘোর লাগা ভাবভঙ্গি এ সব ভ্যাম্পায়ারে রক্ত খেয়ে যাওয়ার লক্ষণ। রিকি তো মরেই গেল। জিনা বেঁচেছে কপালগুণে। তবে ওই সময়কার কথা। কিছু মনে করতে পারে না। জিনা কিছু বলতে পারেনি বলেই কিশোর আর রবিনকে ভ্যাম্পায়ারের কথা বিশ্বাস করাতে পারেনি সে। ভূতের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে কিশোর। অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছে রবিন। তবে এইবার ওদের ভুল ভাঙানোর সময় এসেছে। যা মনে হচ্ছে, রবিন নিজেই পড়েছে। ভ্যাম্পায়ারের কবলে।
রবিনকে সাবধান করে লাভ হবে না। ও কথা শুনবে না। সাবধান। থাকতে হবে মুসার নিজেকে। রবিনের ওপর চোখ রাখতে হবে। যাতে রক্ত খেয়ে খেয়ে ওকেও মেরে ফেলতে না পারে ভ্যাম্পায়ার।
ইস, রিকির ব্যাপারটাও যদি আগেভাগে বুঝতে পারত! তাহলে এভাবে অপঘাতে মরতে হত না বেচারাকে। অ্যানি যে এভাবে ভ্যাম্পায়ারের কবলে পড়বে, সেটাও আন্দাজ করতে পারেনি মুসা। ওকেই ভ্যাম্পায়ার ভেবে বসে ছিল।
সামনের টেবিলটায় এক কিল মারল সে। দাতে দাঁত চেপে চিৎকার করে বলল, রবিনকে আমি কোনমতেই মরতে দেব না! রিকিকে নিয়েছ, অ্যানিকে নিয়েছ, আর কাউকে পাবে না। আমার কোন বন্ধুকেই আর নিতে দেব না তোমাদের।
অস্থির ভঙ্গিতে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল সে। রবিনের গলায় দাঁতের দাগ আছে কিনা দেখে শিওর হয়ে নিতে হবে।
কাজটা কার? কণিকার?
মেয়েটার চেহারা কল্পনা করল মুসা। আকর্ষণীয় চেহারা। লম্বা কালো চুল। মায়াময় দুটো চোখ।
কণিকার ওপর নজর রাখতে হবে, ভাবল মুসা। যত সুন্দর চেহারাই হোক, ভ্যাম্পায়ার হলে কোনমতেই বাঁচতে পারবে না আমার হাত থেকে।
টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দেয়া কাগজটা একটানে তুলে নিল সে। নাটকের সংলাপ লিখে নিয়েছে ওতে। গটমট করে এগোল দরজার দিকে। ওপাশে গিয়ে দড়াম করে পাল্লা লাগাল। টনিদের বাড়ি হয়ে যাবে ঠিক করল। ওকে পেলে একসঙ্গে যাবে থিয়েটারে।
অন্ধকার রাত। চাঁদ তো বটেই, তারাও সব মেঘে ঢেকে দিয়েছে। কটেজগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ছায়াগুলোকে মনে হচ্ছে যেন ঘাপটি মেরে থাকা ভূত।
শিউরে উঠল মুসা। গা ছমছম করতে লাগল। এটা ভ্যাম্পায়ারের রাত! এমন চমৎকার রাতে রক্ত খেতে বেরোবেই ওরা।
নিরাপদে টনিদের বাড়িতে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাচল সে। বাড়িটা নতুন। ইটের দোতলা বাড়ি। যেন ভুল করে গজিয়ে উঠেছে স্যান্ডি হোলোতে। এখানকার সব বাড়ি হয় কাঠের, নয়তো পাথরের। বেশির ভাগই পুরানো। সৈকতের ধারে ওগুলোর পাশে বাড়িটা তাই একেবারে বেমানান।
বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা পার্কও আছে। গাছপালা আছে। দুটো দোলনা আর কয়েকজনে একসঙ্গে বসার ব্যবস্থা আছে।
এত অন্ধকার, কোনদিকে যাচ্ছে সে, ঠাহর করা কঠিন।
খুট করে শব্দ হলো।
দাঁড়িয়ে গেল মুসা। কান পেতে রইল। আর কোন শব্দ নেই। কিন্তু। শুনেছে যে তাতে কোন সন্দেহ নেই। লুকিয়ে আছে নাকি কেউ? মানুষ না
সব কিছুতে সবখানেই এখন ভ্যাম্পায়ার দেখছে সে। কারণ মন জুড়ে আছে রক্তচোষা ভূতের চিন্তা।
নিঃশব্দে বাড়িটার দিকে কয়েক পা এগোল। তারপর দাঁড়িয়ে গেল। অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি। মনে হচ্ছে আড়াল থেকে কেউ নজর রাখছে তার ওপর।
লীলা আর জনের দোসররা কি জেনে গেছে ওর কথা? বুঝেছে ওকে ঠেকাতে না পারলে সবাইকে ধ্বংস করে দেবে সে? তাই আগেভাগেই ওকে খতম করে দিয়ে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে চায়?
শব্দটা আবার কানে আসতে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। গাছপালার মধ্যে কোন কিছু থেকে থাকলেও চোখে পড়ল না। শুধুই অন্ধকার।
নাহ, কিছু না। কিছু শুনিনি। সব কল্পনা। মনকে বোঝানোর চেষ্টা করল সে।
বাড়ির আশেপাশে গভীর ছায়া। যেখানে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার, সেই জায়গাটুকু পার হয়ে টনিদের সদর দরজার কাছে যেতে হবে।
এগোতেই আবার কানে এল ঘষার শব্দ। টেনে টেনে এগোনো পায়ের শব্দের মত। মাত্র কয়েক ফুট দূরে।
ও কিছু না! ফিসফিস করে বলে নিজেকে অভয় দিতে চাইল সে। আবার পা বাড়াল দরজার দিকে।
আবার শব্দ।
ঘষার!
নখ ঘষছে নাকি! বাদুড়ের ডানাতেও ধারাল, বাঁকা নখ থাকে। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের রূপ নিতে পারে।
চলমান ছায়াটা চোখে পড়ল হঠাৎই। কিছু করার আগেই ওর গায়ের ওপর এসে পড়ল ওটা।
আতঙ্কে গলা চিরে চিৎকার বেরিয়ে এল ওর।
হি-হি হাসি শোনা গেল অন্ধকারে। হাততালি দিয়ে সুর করে বলতে লাগল সিসি, পেয়েছে। পেয়েছে! ভয় পেয়েছে।
চেপে রাখা দমটা ধীরে ধীরে ছাড়ল মূসা। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি জীবনে কমবে কিনা ভেবে অবাক হলো। বিড়বিড় করে বলল, কে বলল ভয়। পেয়েছি? আমি জানতাম, তুমিই!
মোটেও জানতে না। তুমি ভেবেছিলে ভ্যাম্পায়ার।
অন্ধকারে অস্পষ্ট ছায়ার মত লাগছে সিসির চেহারা। হাসিতে ওর দাঁত যে সব বেরিয়ে পড়েছে, না দেখেও অনুমান করতে পারছে মুসা।
মানুষকে এভাবে ভয় দেখানো ঠিক না, গলার কাঁপুনি এখনও বন্ধ হয়নি। মুসার।
কেন?
কারণ ব্যাপারটা মজার নয় মোটেও, বলে আবার দরজার দিকে রওনা দিল মুসা।
আমার কিন্তু বেশ মজা লাগে। এমন চমকে যায় সবাই, উ, যা মজা। লাগে না তখন!
জবাব না দিয়ে বেল বাজাল মুসা।
কয়েক সেকেন্ড পর দরজা খুলে দিল টনি।
ইস্, তোমার বোনটা না একটা পাজির পা ঝাড়া! অভিযোগ করল মুসা।
.
০৮.
নীরবে থিয়েটার হাউসের দিকে এগিয়ে চলেছে দুজনে। মুসা আর টনি।
অ্যানির কথা ভাবছে মুসা। দুঃখ হচ্ছে ওর জন্যে। কাল সবার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সে, আজ আর থাকবে না। কত সহজেই না একজন জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে যায় চিরকালের জন্যে!
রবিনের জন্যেও দুশ্চিন্তা হতে লাগল।
স্যান্ডি হোলোর দক্ষিণ ধারে সামান্য উঁচু একটা ঘাসে ঢাকা জমিতে দাঁড়িয়ে আছে থিয়েটার হাউসটা। আয়তাকার কাঠের বাড়ি। দেয়ালে সাদা রঙ। জানালাগুলো সবুজ।
মুসা আর টনি একসঙ্গে হলে ঢুকল। অনেকেই এসেছে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। মঞ্চের কাছে জড় হয়েছে। অ্যানির কথাই আলোচনা করছে সবাই।
সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল মুসা। ওদের মধ্যে কোনজন ভ্যাম্পায়ার? কণিকাকে খুঁজল তার চোখ। কোথাও দেখতে পেল না ওকে।
ওই যে কিমি, উনি বলল। আমি যাই। পরে কথা বলব তোমার সঙ্গে।
মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির কাছে কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। কিমি। টনিকে ওর দিকে আসতে দেখে হাসল।
অন্য দিকে ভিড়ের মধ্যে রবিনকে খুঁজল মুসা। দেখতে না পেয়ে থিয়েটার। হাউসের আরেক দিকে রওনা হলো।
স্যান্ডি হোলোরই কেউ খুন করেছে অ্যানিকে, পাশ কাটানোর সময় বাদামী-চুল একটা মেয়ের মন্তব্য কানে এল মুসার। এমন কেউ, যাকে আমরা চিনি।
অ্যাই, মুসা, মুখ তিলে ভরা একটা ছেলে ডেকে বলল, নাটকটা আর হবে কিনা, কিছু শুনেছ?
মাথা নাড়ল মুসা। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাল। এমন ফ্যাকাসে চামড়া কেবল ভ্যাম্পায়ারেরই হতে পারে। দিনের বেলা বেরোতে পারে না, রোদে যেতে পারে না, অন্ধকার ঘরে কফিনের মধ্যে শুয়ে থাকতে হয়–তাই এ অবস্থা। একে মনে রাখতে হবে, ভাবল সে।
থিয়েটারের দরজা খুলে গেল। ফিরে তাকাল মুসা। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঢুকছে রবিন।
চমকে গেল মুসা। রীতিমত করুণ রবিনের অবস্থা। বিধ্বস্ত চেহারা।
ঘুমের ঘোরে হাটছে যেন রবিন। মেঝের দিকে চোখ রেখে পা টেনে টেনে এগোচ্ছে মঞ্চের দিকে।
ভিড় ঠেলে ওর দিকে এগোল মুসা। কিন্তু সে রবিনের কাছে পৌঁছার আগেই ছায়া থেকে বেরিয়ে এল কণিকা। পৌঁছে গেল রবিনের কাছে। হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল ওকে সীটের দিকে। কথা বলতে বলতে হাসছে।
কণিকার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুসা। রবিনের অসুস্থতার জন্যে সে-ই দায়ী কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। রবিনের গলায় দাঁতের দাগ আছে নাকি আগে দেখতে হবে। তারপর অন্য কথা।
পাশ থেকে কে যেন হাত চেপে ধরল, হাই, মুসা।
ডলি। পরনে ডেনিম কাটঅফ আর একটা নীল হলটার টপ। লম্বা চুলগুলোকে পেছনে কষে বেঁধেছে, ঘোড়ার লেজের মত ঝুলছে ঘাড়ের ওপর। হাঁ করে তাকিয়ে রইল মুসা। সুন্দর লাগছে ডলিকে। তবে কোনখানে যেন একটা খুত আছে। চোখে নাকি? মনে হলো। শীতল চাহনি। কেমন লোভাতুর।
খবর শুনেছ? জিজ্ঞেস করল ডলি।
নীরবে মাথা ঝাঁকাল মুসা।
সাংঘাতিক কাণ্ড। কালকের এতবড় ঘটনার পরেও সবাই রিহারস্যালে এল, অবাকই লাগছে আমার। আমি তো ভাবলাম ভয়ে আজ রাতে বাড়ি থেকেই বেরোবে না কেউ।
তুমিও তো বেরিয়েছ।
খিলখিল করে হাসল ডলি, কোন কিছুতে ভয় পাই না আমি।
ওরাও হয়তো পায় না।
মঞ্চে উঠলেন মিসেস রথরক। মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত তুললেন চুপ করার জন্যে। অ্যাটেনশন, প্লীজ! এই, আমার কথা শোনো তোমরা।
কথা বন্ধ করে দিল সকলে।
মিসেস রথরক ঘোষণা করলেন, নাটক চলবে। সেটাকে উৎসর্গ করা হবে অ্যানির নামে। তারপর জানালেন, অ্যানির জায়গায় এখন ডলি অভিনয় করবে।
শুনেই উজ্জল হলো ডলির মুখ। মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, এবার তোমার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পাব আমি।
জবাব দিল না মুসা। হিংসুক মেয়েটার ওপর বিরূপ হয়ে গেল মন। মিসেস রথরকের দিকে নজর ছিল বলে এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। এখন ফিরে তাকিয়ে দেখল রবিন আর কণিকা নেই সীটে। অদ্ভুত ব্যাপার! রিহারস্যাল শুরুর আগেই কেটে পড়ল! কণিকা কি ওকে রক্ত খাওয়ার জন্যে ধরে নিয়ে গেল নাকি?
তাহলে শুরু করা যাক, মিসেস রথরক বলছেন। প্রথম পর্ব।
মুসার হাত ধরে টানল ডলি, আমাদের দিয়েই শুরু।
মনে রবিনের জন্যে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ডলির পেছন পেছন মঞ্চের দিকে এগোল মুসা। মঞ্চে উঠল। কোথায় কোন ভঙ্গিতে দাঁড়াতে হবে দেখিয়ে দিলেন মিসেস রথরক। তারপর বললেন, রেডি। স্টার্ট।
মঞ্চের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল মুসা। নজর পেছনে ব্যাকড্রপের আঁকা বিল্ডিঙের দিকে। বিড়বিড় করে বলল, টোয়েন্টি সেভেন ব্র্যাকার স্ট্রীট।…কোথায় ওটা?..পাচ্ছি না কেন?…খুঁজে বের করতে না। পারলে পিঠের চামড়া রাখবেন না আমার মিস্টার কর্কলি।
ওর হাতে একটা ছোট বাক্স। মুদি দোকানের কর্মচারি সেজেছে। ডেলিভারি বয়ের বেশে খদ্দেরের বাড়িতে মাল সরবরাহ করতে এসেছে। ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে না।
ছায়া থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ডলি। কানের কাছে বলে উঠল, কি খুঁজছ?
এমন চমকে গেল মুসা, আরেকটু হলে হাত থেকে ছেড়ে দিচ্ছিল বাক্সটা।
পথ হারিয়েছ বুঝি? ডলির ঠোঁটে শয়তানির হাসি।
আঁ… ইয়ে..ইয়ে… কথা সরছে না মুসার মুখ থেকে।
ইয়ে ইয়ে করছ কেন? হারিয়ে গেছ নাকি, সেটাও বলতে পারছ না?
আ-আমি ব্র্যাকার স্ট্রীটের সাতাশ নম্বর বাড়িটা খুঁজছি। তুমি চেনো?
চিনব না কেন? এসো, হাঁটতে শুরু করল ডলি।
পেছন পেছন চলল মুসা। বুক কাঁপছে। এত ভয় পাচ্ছি কেন? মনে মনে নিজেকে ধমক লাগাল সে। এটা তো আর আসল নয়। নাটক।
তবে আসল বিপদও আছে স্যান্ডি হোললাতে। পথ হারানো মানুষের কাছে এভাবেই আচমকা এসে উদয় হয় ভ্যাম্পায়ার। সেটা ভেবে নিজেকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করল। মনে হলো তার, তাতে অভিনয়টা জমবে ভাল।
হঠাৎ মুসাকে চেপে ধরল ডলি।
হাত থেকে বাক্স ফেলে দিল মুসা। ধাক্কা দিয়ে ডলিকে সরানোর চেষ্টা করল।
আসুরিক শক্তিতে তাকে জাপটে ধরল ডলি। ফাঁক হয়ে গেল ঠোঁট। দুদিকের কোণা সরে গিয়ে বেরিয়ে এল মারাত্মক শ্বদন্ত। মঞ্চের আলোয় ঝকঝক করে জ্বলছে দাঁত দুটো। মুসার গলায় দাঁত বসিয়ে দিতে গেল।
ভূ-ভূ-ভূত! বলে চিৎকার করে উঠল মুসা। কিছুতেই ডলির বাহুমুক্ত হতে না পেরে চেঁচাতে শুরু করল, বাবাগো! খেয়ে ফেলল! বাঁচাও! বাঁচাও!
ডলির আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ছটফট করতে লাগল।
আরে করছ কি? আবার চিৎকার করে উঠল মুসা। চিৎকারটা আগের চেয়ে বাস্তব মনে হলো। অভিনয় নয়। এত জোরে দাঁত ফোঁটাচ্ছ কেন? কেটে যাবে তো!
হাসি শোনা গেল দর্শকদের।
কিন্তু কানেই তুলল না ডলি। দাঁতের চাপ কমাল না সামান্যতম। বরং বাড়াতে শুরু করল।
.
০৯.
আরে! করছ কি! ছাড়ো! ছাড়ো! চিৎকার করতে লাগল মুসা। যখন কোনমতেই ছাড়ল না ডলি, এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিল।
হাসি বাড়ল দর্শকদের।
পিছিয়ে গেল ডলি। প্লাস্টিকের দাঁত দুটো খুলে নিল।
গলায় হাত বোলাতে লাগল মুসা। রক্ত বেরোয়নি। তবে দাঁতের চাপ আরেকটু জোরে লাগলে যেত ফুটো হয়ে। বাপরে বাপ! আসল দাঁতের চেয়ে কম শক্ত নয় ওই প্লাস্টিকের দাঁত।
সরি, ডলি বলল, অভিনয়ে এতটাই মনোযোগ দিয়ে ফেলেছিলাম, তুমি যে ব্যথা পাবে সেটাও মনে ছিল না।
আহত জায়গা ডলতে লাগল মুসা। ডলির সরি বলাও তার গোমড়া মুখে হাসি ফোঁটাতে পারল না। ভোতা স্বরে বলল, তবে স্বীকার করতেই হবে তুমি ভাল অভিনেত্রী।
উজ্জল হলো ডলির চোখ। থ্যাংকস।
ভেরি গুড। চমৎকার অভিনয় করেছ, মিসেস রথরক বললেন। পরের দৃশ্য। রবিন, এসো।
দুর্বল ভঙ্গিতে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল রবিনকে। অন্য মানুষ লাগছে আজ ওকে। সেই প্রাণচঞ্চল রবিন নয়।
সংলাপও বলতে পারল না ঠিকমত। নীরস কণ্ঠ। তাতে প্রাণ নেই। যা করল সেটাকে আর যাই বলা যাক, অভিনয় বলা যাবে না।
বাতিল করে ফেলেছে ওকে! আনমনে বিড়বিড় করল মুসা।
শুনে ফেলল ডলি। কণিকার সঙ্গে বেরিয়েছিল না একটু আগে?
অ্যাঁ!…হা! কি মনে হতে ঝট করে তাকাল ডলির দিকে। কণিকার সঙ্গে বেরোনোয় কি হয়েছে?
না, কিছু না, অন্য দিকে চোখ ফেরাল ডলি।
ওর আচরণ রহস্যময় মনে হলো মুসার কাছে। ডলি কিছু জানে মনে হচ্ছে। ভ্যাম্পায়ারের ব্যাপারটা সে-ও সন্দেহ করেছে নাকি!
রিহারস্যালের পর মুসা আর ডলির সঙ্গে টনি আর কিমিও এগোল দরজার দিকে।
বাড়ি যাবে এখন? মুসাকে জিজ্ঞেস করল টনি।
এই সময় রবিন আর কণিকাকে আসতে দেখে মুসা বলল, না, এত সকাল সকাল যাব না। কণিকার ওপর নজর রাখতে চায় সে। চলো, প্রিন্সেসে যাই। খিদে পেয়েছে।
রবিনের দিকে তাকাল ডলি, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে কয়েক বছর ধরে ঘুমাওনি।
উল্টোটা বললে, রকিন বলল। সারা দিনই ঘুমাই এখন। জেগে উঠে দেখি, ঘুমানোর আগে যেমন ছিলাম, তার চেয়ে দুর্বল লাগছে।
তাকিয়ে আছে মুসা। রিকি আর জিনার সঙ্গে রবিনের অসুস্থতার মোলো আনা মিল। গলায় দাগ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করল। নেই।
দ্বিধায় পড়ে গেল সে। রবিন কি আসলেই কোন রোগের শিকার? ভ্যাম্পায়ারের নয়?
পোলা শার্ট পরেছে রবিন। উঁচু কলার। গলার নিচের দিকটা দেখা যায় না। ওখানে দাগ থাকতে পারে। পুরো গলা না দেখে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
রবিনের হাত ধরে টানল কণিকা, চলো, বেরোই।
কোথায় যাব?
প্রিন্সেসে। মুসা বলল না?
হাই তুলতে তুলতে জবাব দিল রবিন, আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি বাড়ি যাব।
হতাশ মনে হলো কণিকাকে। এক ঘণ্টার জন্যেও পারবে না?
ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন। মুসার দিকে তাকাল, মুসা, আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে? একা যেতে ভরসা পাচ্ছি না।
চলো।
কিন্তু মুসা.. বলতে গেল ডলি।
বাধা দিল মুসা, না, ডলি, আজ আর তোমার সঙ্গে যেতে পারলাম না। কাল দেখা যাবে। রবিনকে দিয়ে আসা দরকার। ও অসুস্থ
এই না বললে প্রিন্সেসে যাবে?
বলেছি। রবিন বাড়ি যেতে চাইবে, জানতাম না। তোমরাও চলে যেতে পারো। আজ আর প্রিন্সেসে যাওয়া হবে না।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কণিকার মতই হতাশ মনে হলো ডলিকেও।
মুসার দেখাদেখি টনিও যদি মত পাল্টায়, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে টান দিল কিমি, চলো, ওরা না গেলে নাই। আমরাই যাই।
মাথা ঝাঁকিয়ে, মুসা আর রবিনকে পরে দেখা হবে বলে কিমির হাত ধরে বেরিয়ে গেল টনি।
একা যেতে যেন ভাল লাগছে না কণিকার। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। পাশ থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ, কি ব্যাপার, একা নাকি?
ফিরে তাকাল সবাই। মুসা দেখল, সেই তিল-পড়া ছেলেটা।
কণিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটা। হেসে বলল, আমি ইমি। কার্নিভলে যেতে ইচ্ছে করছে। একা একা যেতে ভাল লাগছে না। একজন সঙ্গী পেলে যেতাম। ভয় নেই, খেলাধুলার খরচা সব আমিই দেব।
কি ভেবে রাজি হয়ে গেল কণিকা। রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, তুমি বাড়ি যাও। আমি এর সঙ্গে চলে যাচ্ছি।
হা-না কিছু বলল না রবিন। বলার শক্তিও যেন নেই।
ইমির সঙ্গে বেরিয়ে গেল কণিকা।
রবিনের দিকে তাকাল মুসা, এসো।
সারাটা পথ ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে এল রবিন। উঁচু-নিচু জায়গাগুলোতে তাকে ধরে ধরে পার করল মুসা।
বোর্ডিং হাউসের গেটের কাছে এসে রবিন বলল, থাক, আর আসতে হবে না। যাও এখন। কাল দেখা হবে। থ্যাংক ইউ।
সামান্য উসখুস করে মুসা বলল, রবিন?
ঘুরে দাঁড়াল রবিন, কি?
রবিন, সাবধানে থেকো।
হাসল রবিন। বাড়ির বারান্দা থেকে এসে পড়া আলোয় মলিন দেখাল। হাসিটা। দেখো, রোগ হওয়াটা কারও হাতে নয়। সাবধানেই তো থাকি…
আমি সেকথা বলছি না…
তাহলে? …ও, ভ্যাম্পায়ার। তোমার মাথা থেকে এখনও গেল না সেটা। কই, হপ্তা তো পেরিয়ে গেল এখানে এসেছি। ভ্যাম্পায়ারের ছায়াও তো চোখে পড়ল না।
কিন্তু আমি দেখে ফেলেছি…।
পরে কথা বলব। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না…
ঠিক আছে, যাও। পরেই কথা বলব। তুলে দিয়ে আসব বারান্দায়?
না, লাগবে না।
*
বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করল না মুসার। সঙ্গী হিসেবে কাউকে পাওয়া যাবে না। এখন আর। ডলিও চলে গেছে। একা একাই সৈকতে রওনা হলো সে।
চলে এল ডক হাউসের কাছে। দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে গা ছমছম করে উঠল। ফিরে তাকাল পেছনের কালো পাহাড়ের দিকে।
বাদুড় উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। দ্বীপ থেকে আসছে। যাবে ওই পাহাড়টায়। খেয়েদেয়ে পেট ভরিয়ে অন্ধকার থাকতে থাকতেই আবার দ্বীপে ফিরে যাবে।
একা একা থাকতে ভাল লাগল না বেশিক্ষণ। ফিরে চলল। এতক্ষণ কৃষ্ণপক্ষের হলুদ চাঁদ ছিল আকাশে। এখন সেটাও মেঘে ঢাকা পড়েছে। সাগর থেকে এসে ঝাঁপটা দিয়ে গেল একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস। গায়ে কাঁটা দিল।
অন্ধকার। চাঁদ-মেঘের খেলা। ভ্যাম্পায়ার আসার উপযুক্ত সময়।
সাবধানে এগিয়ে চলল মুসা।
ভয় লাগছে তার। দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে এগোল।
হাঁটতে হাঁটতে বালিয়াড়িটার কাছে চলে এল। কিছু ঘটল না।
মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। ভূতুড়ে ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে ৩ দিল আবার।
বালিয়াড়ির কাছ দিয়ে চলার সময় কালো কি যেন পড়ে থাকতে দেখল সে।
আবার কালো জিনিস! ধড়াস করে উঠল বুক। মানুষ না তো!
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ওটার দিকে।
মানুষই! পড়ে থাকার ভঙ্গিটা ভাল না। আরও কাছে এসে দেখল উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে ওর। পকেটে হাত দিল। এখনও আছে। রিকির বুটেন লাইটারটা। দ্বীপে গিয়ে জিনাকে আনার সময় একবার কাজে লেগেছে ওটা। তারপর থেকে আর কাছছাড়াই করে না।
আলো জ্বেলে পড়ে থাকা মানুষটার মুখ দেখে চমকে গেল সে।
ইমি!
একবার নাড়ি টিপেই বুঝে গেল, বেঁচে নেই।
বালিতে মাখামাখি মুখ। গলায় ঝাক বেঁধে রয়েছে মাছি। নিশাচর মাছিও আছে তারমানে। রক্ত খায় নাকি! হাত দিয়ে প্রায় ডলে সরাল সেগুলোকে।
গলার চামড়ায় স্পষ্ট দেখা গেল ফুটো দুটো। এক ফোঁটা করে রক্ত লেগে রয়েছে সেগুলোর ওপর। মুখের চামড়া ময়দার মত সাদা।
শুষে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলা হয়েছে ওকে। এক ফোঁটা রক্ত থাকতে। ছাড়েনি। একেবারে রিকির মত।
কে করল কাজটা? বেরিয়েছিল তো কণিকার সঙ্গে।
সন্দেহটা সরাসরি কণিকার ওপরই পড়ে। তবে সে না-ও হতে পারে। মাত্র আগের দিন একইভাবে অ্যানি খুন হয়েছে এখানে। সে তো আর কারও সঙ্গে বেরোয়নি। তারমানে খুন করার পদ্ধতি বদল করেছে ভ্যাম্পায়ার। রাতে এসে ওত পেতে থাকে শিকারের আশায়। কাউকে একা পেলেই…
ঝট করে মাথা তুলে চারপাশে তাকাতে শুরু করল মুসা। নির্জন সৈকতে কোন মানুষের সাড়াশব্দ নেই। সে একা! তার রক্ত খাওয়ার জন্যেও আসবে না তো ভ্যাম্পায়ার!
একটা মুহূর্তও আর থাকতে সাহস করল না। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুটতে শুরু করল লোকালয়ের দিকে।
.
১০.
পরদিন রাতে। পিজ্জা কোভে দুটো টেবিলে বসেছে টনি, রবিন, কিমি, ডলি, কণিকা আর মুসা। আলোচনা হচ্ছে ইমির মৃত্যুরহস্য নিয়ে।
মেইন স্ট্রীটের একটা পে ফোন থেকে থানায় ফোন করলাম, মুসা বলছে। মাথাটা তখন পুরো খারাপ আমার। ভয়ে, উত্তেজনায় থরথর করে। কাঁপছে হাত-পা। কথাও বলতে পারছিলাম না ঠিকমত।
যাই হোক, পুলিশ এল। নিয়ে গেলাম লাশের কাছে। ওদের কাজ শেষ হওয়ার পর আবার আমাকে নিয়ে গেল থানায়। চলল একটানা জিজ্ঞাসাবাদ। ডিটেকটিভ অফিসার ওকারিশের সন্দেহ আরও বেড়েছে আমার ওপর। বাড়বেই। দু দুটো খুন হলো। একজনের সঙ্গে শেষ দেখা গেছে আমাকে। তা ছাড়া দুজনের লাশই খুঁজে পেলাম আমি। ওকারিশের বোধহয় সন্দেহ, খুন করে রেখে এসে খুঁজে বের করার অভিনয় করেছি।
কথা শেষ করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল মুসা।
কোন ভাবান্তর নেই ডলির।
রবিনকে আগের দিনের চেয়ে ক্লান্ত লাগছে। কণিকার পাশে বসে আছে চুপচাপ। চোখ লাল। মাথা সোজা রাখতেও কষ্ট হচ্ছে।
বার বার ওর গলার দিকে তাকাচ্ছে মুসা। পোলো শার্টের কলারের জন্যে আজও দেখা যাচ্ছে না দাঁতের দাগ।
কণিকার দিকে তাকাল সে। একটা পেপার ন্যাপকিন ছিঁড়ে কুটি কুটি করে এক জায়গায় জমাচ্ছে কণিকা। হাত কাঁপছে ওর। ভয়ে নাকি?
ভয় না কচু! মনে মনে রেগে গেল মুসা। অভিনয় করছে। দেখাচ্ছে আমাদের যে ওর কোন দোষ নেই।
মৃত্যুর আগে অ্যানির হয়েছিল তোমার সঙ্গে শেষ দেখা, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল কণিকা, আর ইমির হলো আমার সঙ্গে। বিশ্বাসই করতে পারছি না।
এক টুকরো পিজ্জা বাড়িয়ে দিল রবিন। নাও।
আমি এখন কিচ্ছু মুখে দিতে পারব না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল কণিকা। মনটা ভীষণ খারাপ।
ওর দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। জানে, ভ্যাম্পায়াররা রক্ত ছাড়া কিছু খেতে পারে না। কণিকার চামড়া মোমের মত সাদা। যেন রক্তশূন্যতায়। ভুগছে। দিনের বেলা না বেরোতে পারলে, চামড়ায় রোদ না লাগলে এ রকম মড়ার মত সাদা হয়ে যায় মানুষের চামড়া।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল টনি। এখানে এসেছিলাম ছুটি কাটাতে। ভেবেছিলাম চমৎকার কাটবে দিনগুলো। কিন্তু কারোর মনেই আর আনন্দ নেই। সৈকতে টহল দিচ্ছে পুলিশ। লোকে আতঙ্কিত। সবার মুখে কেবল খুনের আলোচনা। ভ্যাম্পায়ারকে দোষ দিচ্ছে অনেকে।
ওফ, চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল কিমি, এক কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল! ভ্যাম্পায়ার বলে কোন কিছু থাকলে তো খুন করবে।
হায়রে কপাল, এখনকার দিনেও এই কুসংস্কার, আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল ডলি। ভূত বলে কিছু নেই, সবাই জানে। তা-ও ভূতকে দোষ দেয়। বেকুব ছাড়া আর কি বলব ওদের।
বেকুব বলো আর যাই বলো, আমি ভূত বিশ্বাস করি, জোর গলায় বলল মুসা। সেটাকে আমি কুসংস্কারও বলব না। ভূত আছে এটা যেমন প্রমাণ। করতে পারেনি কেউ, নেই এটাও পারেনি। তবে, আছে, এটা আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব এবার।
কণিকা তাকাল ওর দিকে। ভাবলেশহীন শূন্য দৃষ্টি। যেন মুসার কথায়। কোন আগ্রহ নেই ওর। বিরাট অভিনেত্রী। ভাবল মুসা। ডলিকে না দিয়ে নাটকের প্রধান চরিত্রটা ওকে করতে দেয়া উচিত ছিল।
সত্যি ভূত বিশ্বাস করো তুমি? কিমি জিজ্ঞেস করল।
করে, মুসার হয়ে জবাবটা দিল রবিন। ভূতের কথা শুনলেই চোখ উল্টে দেয়। অথচ ক্ষ্যাপা মোষের সামনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দাও, ভয় পাবে না। এ এক আজব চরিত্র, আমাদের মুসা আমান।
দুনিয়াটা, সত্যি, আজব মানুষে বোঝাই।
চুপ করে রইল মুসা। মনস্থির করে নিয়েছে কারও ব্যঙ্গ, কারও হাসাহাসিতে কান দেবে না। তর্কও করবে না। যে যা বলে বলুক। তার কাজ সে করে যাবে।
উঠে দাঁড়াল কিমি। টনির হাত ধরে ওকে টেনে তুলল চেয়ার থেকে। চলো। আমাকে কার্নিভলে নিয়ে যাবে বলেছিলে।
সেটা কাল বলেছি। মনমেজাজ আজ ঠিক নেই।
চলো। গেলেই মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে। এখানে বসে এসব ফালতু আলোচনা করতে থাকলে বরং বিগড়াবে আরও।
তোমরা কেউ যাবে? সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল টনি।
কেউ যেতে চাইল না। টনিকে নিয়ে কিমি বেরিয়ে গেলে কণিকার দিকে ফিরল মুসা।
রবিনের সঙ্গে কথা বলছে কণিকা। কালো চুল। কালো চোখ। ফর্সা গাল। সুন্দর চেহারা। ওকে ভ্যাম্পায়ার ভাবতে কষ্ট হলো।
কিন্তু লীলাও সুন্দর ছিল।
তাই বলে কি ভ্যাম্পায়ার ছিল না?
আবার এক টুকরো পিজ্জা নিয়ে কণিকার দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা, নাও।
বিরক্ত ভঙ্গিতে টুকরোটার দিকে তাকাল কণিকা।
মুসা জানত, এ রকমই করবে সে।
না, আমি খাব না, মাথা নাড়ল কণিকা। বললামই তো, খেতে পারব না।
খাও না, কণিকার মুখের কাছে টুকরোটা নিয়ে গেল মুসা। জোর করে। গুঁজে দেবে যেন। খুব ভাল বানানো হয়েছে। দারুণ টেস্ট।
না! বলে ঝটকা দিয়ে পেছনে মাথা সরিয়ে নিল কণিকা।
এক কামড় খেয়ে দেখো, চাপাচাপি শুরু করল মুসা।
খেতে যখন চাইছে না, থাক না, রবিন বলল, শুধু শুধু জোর করছ কেন ওকে?
আস্তে করে টুকরোটা প্লেটে নামিয়ে রাখল মুসা। চোখ কণিকার দিকে। ও বুঝে ফেলেছে, আমি ওকে চিনে ফেলেছি, ভাবছে মুসা। এখন নিশ্চয়। আমার মুখ বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাববে। চিন্তায় পড়ে গেল সে। ভ্যাম্পায়ারকে সরাসরি যুদ্ধে আহ্বান! কাজটা কি ঠিক হলো? অ্যানি আর ইমির সৈকতে পড়ে থাকার দৃশ্যটা কল্পনা করে শিরশির করে উঠল মেরুদণ্ডের ভেতর।
১১.
পরদিন বিকেল।
রবিনকে ফোন করল মুসা।
রবিন, আমি, কান আর কাঁধ দিয়ে ফোনের রিসিভারটা চেপে রেখে উবু হয়ে জুতোর ফিতে বাধতে লাগল সে।
কেমন আছ? জিজ্ঞেস করল রবিন। খসখসে কণ্ঠস্বর। কথাতেই বোঝা গেল ক্লান্তি এখনও কাটেনি ওর। নিশ্চয় আবার কোন ফাঁকে ওর রক্ত খেয়েছে ভ্যাম্পায়ার।
ঘাবড়ে গেল মুসা। দেরি করে ফেলল না তো! জরুরী কণ্ঠে বলল, রবিন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
এখন তো বলতে পারব না, রবিনের কণ্ঠস্বর এত দুর্বল, বোঝাই যায় না। প্রায়। কণিকার সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওকে আমি কথা দিয়েছি…
ওর ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই, বাধা দিয়ে বলল মুসা। ফিতে বাধা শেষ। সোজা হয়ে বসল। রিসিভারটা হাতে নিল আবার।
কণিকা? অবাক মনে হলো রবিনকে।
শোনো, রবিন, আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, তবু। বলি। ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি।
ওপাশ থেকে মৃদু হাসি শোনা গেল। দুর্বল হাসি।
দেখো, রবিন, আমি সিরিয়াস, গভীর কণ্ঠে বলল মুসা। হেসো না। আমার কথা শোনো।
আমার ভাল লাগছে না, মুসা, কাশতে কাশতে বলল রবিন। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বেরোতে হবে।
রবিন, একবারও কি তোমার মনে হয়নি হঠাৎ করে এত দুর্বল লাগছে। কেন তোমার? কিসের অসুখ? কারণটা আর কিছুই না, রবিন। সব কিছুর মূলে ওই কণিকা।
দীর্ঘ নীরবতার পর রবিন বলল, তাই?
কণিকা একটা ভ্যাম্পায়ার, রবিন, গরম হয়ে উঠছে মুসা। আমি জানি, কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু ও ভ্যাম্পায়ার। তোমার রক্ত খাচ্ছে। অল্প অল্প করে খাচ্ছে, যাতে মরে না যাও। রিকি, অ্যানি আর ইমির মত একবারে খেয়ে ফেলছে না। এখনও যদি সাবধান না হও…
মুসা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাধা দিল রবিন। এখন এসব ভূতের গল্প ভাল লাগছে না…।
রবিন, গল্প নয়! বিশ্বাস করানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল মুসা। রিকির বেলায় কি ঘটেছে, বলেছি তোমাকে। জিনার অবস্থা তো নিজের চোখেই দেখলে। জিনার মতই তোমাকেও…
জিনার মাথায় গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, তাই ওরকম করেছে। আমার তো আর তা হয়নি…
ভ্যাম্পায়ারেই ওর মাথাটা বিগড়েছে, রবিন। আমার কথা না শুনলে তোমারও এই অবস্থা হবে। যদি ভাগ্য ভাল হয়, বেঁচে থাকো, রিকির মত মরে না যাও। কণিকা তোমাকে…
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার, মুসা। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছি। সেটা। ভূতের কারণে নয়। নিশ্চয় কোন ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে, ফুয়ু হবে। মুসা, তুমি বরং আমার কথা শোনো। রকি বীচেও বলেছি, এখনও বলছি–ডাক্তার দেখাও। জিনার আর তোমার একই অসুখ। কি হয়েছিল তোমাদের, কে জানে। অতিরিক্ত ভয় পেলে হয় ওরকম। সেরাতে নৌকা। নিয়ে একা একা দ্বীপে যাওয়া তোমাদের মোটেও উচিত হয়নি।…আঙ্কেল আর আন্টি ফিরেছেন?
আঁ? … হ্যাঁ।
কথা বলেছ তাঁদের সঙ্গে?
না।
তাহলে বলে ফেলল। আর দেরি কোরো না। সত্যি কথাটাই জানাও। বলবে, ভ্যাম্পায়ারের আতঙ্ক তোমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। তোমার যদি বলতে সঙ্কোচ হয়, আমিই নাহয় বলে দেব। মোট কথা, তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। দেরি করলে শেষে জিনার মত হাসপাতালে যেতে হবে।
নিজের জীবন বিপন্ন, আমাকে ভাবছে পাগল! কি যে করি!–চুপ করে রইল মুসা।
অ্যাই, মুসা, শুনছ?
হ্যাঁ, বলো।
আমি বেরোচ্ছি।…ওই যে, কণিকা এসে গেছে। পরে দেখা হবে…
প্লীজ, রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। দোহাই লাগে তোমার! ওর সঙ্গে বেরিয়ো না! মারা পড়বে, রবিন…
কট করে শব্দ হলো। লাইন কেটে গেছে।
*
টপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ল মুসার ঘাড়ে। বরফের মত শীতল পানি ঘাড় বেয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। চামড়ায় অদ্ভুত সুড়সুড়ি তুলে।
ঘন হচ্ছে কুয়াশা। শহর ঢেকে দিয়েছে। স্ট্রীট ল্যাম্পগুলোকে আলো ছড়াতে দিচ্ছে না। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে ঘোলাটে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে কেবল ওগুলো।
মেইন স্ট্রীটে উঠল মুসা। পিজ্জা কোভে খুজল রবিন আর কণিকাকে। পেল না।
আর্কেডে এসে প্রিন্সেস-এর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বাইরের ভেজা রাতের চিহ্নও নেই এখানে। প্রচুর আলো। জোরাল মিউজিক বাজছে। বাজনার শব্দকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর হাসির শব্দ। ভিডিও গেম খেলছে।
আইসক্রীম পারলারে উঁকি দিল। পাশাপাশি টুলে বসে আছে টনি আর কিমি। টনির হাতে আইসক্রীম।
এগিয়ে গেল মুসা। ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। টনি, রবিনকে দেখেছ?
ঝট করে মাথা ঘোরাল কিমি। মুসাকে দেখে বদলে গেল চাহনি। মাথা নেড়ে বলল, না, দেখিনি। তুমি বাপু এখন যাও তো। আবার কোন্ ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করবে…।
তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি আমি! কঠোর স্বরে জবাব দিয়ে টনির দিকে ফিরল মুসা, কি, দেখেছ রবিনকে?
নাহ, গতকাল থেকেই দেখছি না, টনিও অধৈর্য।
কিন্তু ওকে আমার দরকার। খুঁজে বের করতেই হবে। ভীষণ বিপদে আছে ও।
আবার নাক গলাল কিমি, কিসের বিপদ?
কণিকা একটা ভ্যাম্পায়ার। রবিনকে সাবধান করেছি। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করল না। কণিকা ওকে…
আহ, দয়া করে এবার থামাও না তোমার ওই ভ্যাম্পায়ারের গপ্পো! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল টনি। কুটি করল।
বললাম তো গপ্পো নয়..
চোখের পাতা সরু করে ফেলল টনি। কথা শেষ করতে দিল না মুসাকে। দেখো, অতিরিক্ত জ্বালাতন শুরু করেছ তুমি। সহ্যের একটা সীমা আছে। তোমার মাথায় গোলমাল হয়ে গেল নাকি ভাবছি।
গোলমাল! কিসের গোলমাল? ফেটে পড়ল মুসা। রিকি মরল। জিনার যখন এই অবস্থা হয়েছিল, তখনও তোমাদের জানিয়েছি। বিশ্বাস করোনি। হাসাহাসি করেছ। আমাকে পাগল ভেবেছ। ওর কি অবস্থা হয়েছে, দেখেছ…
দেখেছি। সে-ও তোমার মত পাগল হয়ে গেছে। কোন কারণে। তোমাদের দুজনেরই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, হয়েছিল। এবং সেই কারণটা ভ্যাম্পায়ার! কতবার বলব এক কথা!
নিরাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল টনি। মুসার দিকে তাকালও না আর।
মুসা বুঝল, কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না এদের কাছে। যা করার তার। নিজেকেই করতে হবে। একা।
সে-ও আর কারও দিকে না তাকিয়ে গটমট করে বেরিয়ে এল আর্কেড থেকে।
.
১২.
কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলল নীরবে মুসা।
সাদা কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে স্যান্ডি হোলো। চেপে আসছে যেন চারদিক থেকে।
মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে ওর। কেউ বিশ্বাস করছে না ওকে। সবাই ভাবছে পাগল হয়ে গেছে। সাহায্য করার কেউ নেই। একেবারে একা সে। নিঃসঙ্গ।
পায়ের নিচে নরম লাগল। নিচে তাকিয়ে দেখল ভেজা বালি। সৈকতে পৌঁছে গেছে।
জুতো খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগল। আরাম লাগছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালি ঢুকে যাওয়ার সময় চমৎকার একটা অনুভূতি হয়। ওর বাঁ দিকে পানি। ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কিছুদূরে সামনে বোট হাউসটা। কোন চিন্তাভাবনা না করে সেদিকেই এগিয়ে চলল সে।
মাথার ওপরে ডানা ঝাপটানোর শব্দ হতেই চমকে মুখ তুলে তাকাল। তিনটে বাদুড়। কুয়াশার মধ্যে অস্পষ্ট। নিচ দিয়ে না উড়লে চোখে পড়ত না। তাকিয়ে রইল ওগুলোর দিকে। বাদুড়ের রূপ ধরে আসে ভ্যাম্পায়ার। কুয়াশার মধ্যে এসেছে। কুয়াশার মধ্যে বাদুড় ওড়ে কিনা, খাবারের খোঁজে বেরোয় কিনা, জানা নেই ওর। ভূত হওয়ার সম্ভবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সাবধান রইল। কিন্তু থেকেই বা কি করবে বুঝতে পারছে না। ভ্যাম্পায়ার হলে কি দিয়ে ঠেকাবে? কোন অস্ত্র তো নেই সঙ্গে।
বোকামি হয়ে গেছে। মস্ত বোকামি। যে সৈকতে দুদুটো খুন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে, সেখানে এভাবে নিরস্ত্র চলে আসাটা উচিত হয়নি।
কিন্তু আক্রমণ করল না বাদুড়গুলো। তিনটে কালো ছায়ার মত মিলিয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।
ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে এগিয়েই চলল সে। আপন চিন্তায় বিভোর।
আরেকটা শব্দ কানে এল।
পেছনে।
কেউ অনুসরণ করছে ওকে!
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল সে।
কেউ নেই।
কল্পনা! ভাবল সে। মাথার মধ্যে ভূতের চিন্তা পাক খাচ্ছে বলেই উল্টোপাল্টা এত কিছু দেখছে।
কিন্তু না, ভুল দেখেনি। কুয়াশার মধ্যে থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল একটা মেয়ে। যেন একটা কাঁপা কাঁপা ছায়া বেরিয়ে এসে মানুষের রূপ নিল। কুয়াশা আর আলোর কারসাজি নাকি!
কে? জিজ্ঞেস করল সে।
আমি, ধীরপায়ে সামনে এসে দাঁড়াল ডলি।
এত রাতে এখানে?
বাড়িতে একা একা ভাল লাগছিল না। তোমার সঙ্গে হাঁটি কিছুক্ষণ? অসুবিধে আছে?
না, অসুবিধে আর কি, সঙ্গী পেয়ে খুশিই হলো মুসা।
পাশাপাশি হাঁটতে লাগল ওরা। চারপাশ ঘিরে ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে যেন কুয়াশার সাদা দেয়াল।
খপ করে মুসার হাত চেপে ধরল ডলি, শুনছ?
ফগহর্ন।
হ্যাঁ। ওই শব্দ আমার ভাল লাগে।
কেমন যেন রহস্যময়।
সামনে এসে দাঁড়াল ডলি। মুখোমুখি হলো ওর। হাত রাখল দুই কাঁধে। মিষ্টি গন্ধ পেল মুসা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মোহনীয় কণ্ঠে বলতে লাগল ডলি, ফগহর্ন আমার ভাল লাগে। কুয়াশা ভাল লাগে। সব কিছু ঢেকে দেয়। কিছু দেখা যায় না। কেউ দেখতে পাবে না আমাদের।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিচিত্র অনুভূতি হলো মুসার। মাথার মধ্যে বো করে উঠল। মগজে সব কিছু গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে নাচতে শুরু করেছে কুয়াশা।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ডলির মুখ।
*
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল মুসা। সরিয়ে নিল গলা। হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলল, কামড় দিল কিসে?
ডলিও সরে গেছে। মশাটশা হবে। কুয়াশা পড়লে যেন পাগল হয়ে যায় রক্ত খাওয়ার জন্যে।
তোমাকে ঘাবড়ে দিলাম নাকি?
মুসার কথা যেন কানেই যায়নি। একঘেয়ে কণ্ঠে বলল ডলি, মশাকে আমি ঘৃণা করি। এমন শয়তানের শয়তান। রক্তচোষা জীব!
ঘাড় ডলছে এখনও মুসা। বলল, বাড়ি যাব। আর ভাল লাগছে না এখানে।
তুমি সব সময়ই খালি পালাতে চাও।
না, তা চাই না। তবে তোমার সঙ্গে যতবার দেখা হয় আমার, জরুরী কোন না কোন কাজ থাকে। ইচ্ছে করে কাজ বের করি ভেবো না। রবিনকে খুঁজতে এসেছিলাম এখানে। ওর জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।
কাল রাতে দেখা হচ্ছে তো? গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে মুসার চলে যাওয়ার কথায় হতাশ হয়েছে ডলি।
হ্যাঁ। কাল না হলেও পরশু। তুমি কোনদিকে যাবে? চলো, এগিয়ে দিয়ে আসি।
না, লাগবে না, থ্যাংক ইউ। এত তাড়াতাড়ি আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। এসেছি যখন, খানিকক্ষণ হাঁটব। নইলে ঘুম আসবে না।
বাড়ি রওনা হলো মুসা। প্রায় দৌড়ে চলল। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকাল। দেখা গেল না ডলিকে। হারিয়ে গেছে কুয়াশায়।
মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দ হলো। ওপরে তাকিয়ে বাদুড়টাকে দেখতে পেল না মুসা। বেশ কিছুটা ওপরে কুয়াশার মধ্যে রয়েছে।
নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিল ওর। গতি বাড়িয়ে দিল। তবে বাদুড়টা ভ্যাম্পায়ার হয়ে গিয়ে আক্রমণ করল না ওকে। নিরাপদেই বাড়ি ফিরে এল সে।
বাড়িতে ঢুকেই আগে টেলিফোনে রবিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল।. পারল না। ফেরেনি সে।
*
সৈকতে বসে আছে রবিন। কান পেতে শুনছে ঢেউয়ের গর্জন। গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে পানি জেটি থেকে, সৈকতের বালি থেকে। শব্দটা কেমন দূরাগত মনে হচ্ছে। যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে এসব।
পাশে বসে আছে মেয়েটা।
এটাও কি বাস্তব?
নাকি কল্পনা?
ফিসফিস করে ডাকল, কণিকা, তুমি সত্যি আছ?
জবাব দিল কণিকা, আছি।
ওপরে উঠতে আরম্ভ করেছে কুয়াশা। হালকা হয়ে আসছে নিচের দিকের কুণ্ডলীগুলো। ঢেউয়ের বুকে এখন চাঁদের আলোর প্রতিফলন। সব কিছু ঝিলমিল করছে। সব কিছু কেমন কাঁপছে।
কণিকার দিকে ফিরে তাকাল রবিন। চাঁদের আলোয় আরও ফ্যাকাসে লাগছে মেয়েটার মুখ। চামড়ার রঙ এমন মোমের মত কেন? কালো চুল কুয়াশায় ভিজে গিয়ে ধূসর লাগছে। পাশে বসে থাকলেও এ মুহূর্তে মেয়েটাকে অবাস্তবই লাগছে ওর কাছে।
তার চোখের সামনে অস্পষ্ট, ধোয়াটে হতে আরম্ভ করল কণিকা।
রাতের হালকা বাতাস বয়ে গেল। কুয়াশার শেষ পুজগুলোকেও উড়িয়ে নিয়ে গেল। কণিকাকে অবাস্তব লাগছে এখনও ওর কাছে। ফিসফিস করে ডাকল আবার, কণিকা! জোরে ডাকতে যেন ভয় লাগছে।
কি? সাড়া দিল কণিকা।
বুঝতে চাইছি সত্যি তুমি আছ নাকি?
আবার রবিনের কাঁধে হাত রাখল কণিকা, আছি। তোমার খুব খারাপ লাগছে?
দুর্বল। পা-টা ভাঙার পর আর সুস্থ হতে পারলাম না। একটার পর একটা রোগ ধরতেই আছে।
সেই সঙ্গে ওষুধের প্রতিক্রিয়া, কণিকা বলল। এত অ্যান্টিবায়োটিকে শরীর দুর্বল হতে বাধ্য। তার ওপর নিশ্চয় কোন ধরনের জটিল ভাইরাস ঢুকেছে রক্তে। তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত। দরকার হয় হাসপাতালে কাটাওগে কয়েক দিন।
কণিকা?
বলো?
দ্বিধা করল রবিন। একটা কথা। কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। মুসা যে বলে ভ্যাম্পায়ারে রক্ত খেলে এমন হয়, কথাটা কি বিশ্বাস করা উচিত?
না। আমি ভ্যাম্পায়ার বিশ্বাস করি না। তবে কিছু একটা এসে যে রক্ত খেয়ে যাচ্ছে, খুন করে মানুষগুলোকে ফেলে যাচ্ছে সৈকতে, এটা ঠিক।
তোমার কি মনে হয়? কারা করে? জানো কিছু?
ঢেউয়ের দিকে তাকাল কণিকা। চিন্তা করল একমুহূর্ত। তারপর জবাব দিল, বোধহয় জানি!
.
১৩.
মেইন স্ট্রীটে ঘোরাফেরা করছে মুসা। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত দোকানগুলোর দিকে নজর। বেরিয়ে আসা প্রতিটি মুখ দেখছে। রবিনকে খুঁজছে।
বোর্ডিং হাউসে ক্রমাগত ফোন করেছে। রবিনকে পায়নি। অ্যাটেনডেন্ট জানিয়েছে, কোথায় গেছে বলে যায়নি। ধরেই নিয়েছে মুসা, কণিকার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে রবিন। কণিকার মায়াজালে জড়িয়েছে।
ভ্যাম্পায়ারের জাল। বড় ভয়ঙ্কর জাল। একবার জড়ালে ছিন্ন করা কঠিন।
সম্মোহন করে করে নিশ্চয় রবিনের মনটাকে ধোয়াটে করে দিয়েছে কণিকা। সেজন্যেই অন্য কারও কথা আর শুনতে চাইছে না সে। কোন কিছু ভাবতে চাইছে না। জিনারও এ অবস্থা করেছিল জন।
জিনাকে মুক্ত করেছে। রবিনকেও করতে হবে। ভ্যাম্পায়ারের হাতে ওকে কোনমতেই মরতে দিতে পারে না।
অ্যানটিক হাউসটা থেকে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে এল একটা পেশীবহুল ছেলে আর একটা সোনালি-চুল মেয়ে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
টনি! কিমি! ডাকতে ডাকতে ওদের দিকে এগিয়ে গেল মুসা।
ফিরে তাকাল ছেলেমেয়ে দুটো। অবাক চোখে তাকাল। টনি আর কিমি নয়। মুসার অপরিচিত।
সরি, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। আমার বন্ধু মনে করেছিলাম। তোমরা দেখতে ওদেরই মত।
হেসে হাত নেড়ে আবার হাঁটতে শুরু করল ছেলেমেয়ে দুটো।
গেল কোথায় সব? ভাবছে মুসা। চেনা কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন?
শহরে রবিনকে না পেয়ে সৈকতে চলে এল। আজ কুয়াশা নেই। চাঁদের আলো আছে। কিন্তু লোকজন বড় কম। পর পর দুটো খুন হওয়ার পর থেকে রাতের বেলা সৈকতে আসা কমিয়ে দিয়েছে লোকে। কয়েক জোড়া দম্পতি, আর হাতে গোণা কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখা গেল। দুএকজন তার। মুখচেনা আছে, বাকি সবাই অপরিচিত।
রবিনকে খুঁজছে আর কণিকাকে ধ্বংস করা যায় কিভাবে ভাবছে। সবচেয়ে সহজ হত যদি রোদে বের করে আনা যেত। কিন্তু আনাটাই হলো। কঠিন। ও গিয়ে বললেই বেরিয়ে চলে আসবে না কণিকা। ধ্বংস করার দ্বিতীয় উপায়টা হলো বুকে কাঠের গজাল ঢোকানো। তার জন্যে ভ্যাম্পায়ারের আস্তানা খুঁজে বের করতে হবে।
কণিকার আস্তানা কোথায়? দ্বীপটাতে? জন আর লীলাকে ধ্বংস করার পরেও কি ওখানে থাকতে সাহস করবে ভ্যাম্পায়াররা?
দ্বীপটাতে গিয়ে খুঁজে দেখার কথা ভাবল। গেলে দিনের বেলা যেতে হবে। তখন কফিনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে ভ্যাম্পায়ার।
রবিনের সাহায্য পেলে সবচেয়ে ভাল হত। রোদে বের করে আনতে পারত কণিকাকে। গজাল ঠুকে মারা অনেক বেশি কঠিন কাজ। নিজের আস্তানায় ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায় ভ্যাম্পায়ারের। দিনের বেলায়ও জেগে, উঠে আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে। যদি আস্তানায় কোন ফাঁকফোকর না। থাকে, আলো আসার পথ না থাকে, অন্ধকার হয়।
সৈকতেও রবিনকে না পেয়ে সোজা ওর বোর্ডিং হাউসে রওনা হলো সে। খুঁজে আজকে বের করবেই। যেখান থেকেই হোক।
বারান্দার পরে হলঘর। ডেস্কে বসে পত্রিকা পড়ছে অ্যাটেনডেন্ট। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ঘরেই আছে রবিন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। যাক, পাওয়া গেল। দুশ্চিন্তাও হলো। নিশ্চয় খুব অসুস্থ। ওঠার শক্তি নেই। নইলে ঘরে থাকত না।
ওর ধারণাই ঠিক। বেশ কয়েকবার থাবা দেয়ার পর দরজা খুলে দিল রবিন। চোখের পাতা আধবোজা। সাংঘাতিক দুর্বল। মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়েছে। টলছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।
এই অবস্থা হয়েছে তোমার! প্রায় চিৎকার করে উঠল মুসা। আমাকে খবর দাওনি কেন?
ভাবলাম রেস্ট নিলে সেরে যাবে…
ভেতরে ঢুকল মুসা।
একটা কাউচে পাশাপাশি বসল দুজনে।
কাল রাতে কোথায় ছিলে? কোন পার্টিতে গিয়েছিলে নাকি? জানতে চাইল মুসা।
কাল রাতে? কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগল রবিন। মনে করার চেষ্টা করল। না, পার্টিতে যাইনি। কণিকার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। সৈকতে গিয়ে বসে থেকেছি অনেকক্ষণ। খুব কুয়াশা ছিল কাল, তাই না?
জবাব দিল না মুসা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিনের মুখের দিকে। রক্তশুন্য মুখ। বিধ্বস্ত।
গলার দিকে তাকাল। দাঁতের দাগ দেখল না। তবে আছে, আজও ভাবল একই কথা। আরও নিচে। শার্টের কলারের নিচে লুকানো।
কেন, কুয়াশা ছিল কিনা মনে করতে পারছ না? জিজ্ঞেস করল মুসা।
পারছি। তবে অস্পষ্ট। সবই যেন ঘোরের মধ্যে ঘটেছে। কিংবা স্বপ্নের মধ্যে।
হবেই এ রকম–জানা আছে মুসার। ভ্যাম্পায়ারের মায়াজালে পড়লে এইই হয়। সব কিছু ভুলিয়ে দেয় ওরা। সম্মোহন করে। চোখে ঘোর লাগায়। তারপর ওই ঘোরের মধ্যে ধীরে সুস্থে ওদের কাজ সারে।
কেন ওরকম লেগেছে জানো? ভ্যাম্পায়ার তোমাকে সম্মোহন করেছে। বলে।
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল রবিন, আবার সেই ভ্যাম্পায়ার!
ভ্যাম্পায়ারেই যখন করছে এ সব, আবার সেই ভ্যাম্পায়ারই তো হবে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি তোমাকে প্রমাণ। আমার কথা বিশ্বাস না করে আর পারবে না।– শার্টের কলার চেপে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ওপরের বোতামটা ছিঁড়ে ফেলল মুসা। কলারটা নামিয়ে দিল নিচের দিকে।
আরে, আরে, কি করছ! চিৎকার করে উঠল রবিন।
এই দেখো! মুসাও চিৎকার করে উঠল। জানতাম, থাকবেই!
রবিনের গলার নিচের দিকে দুটো ছোট ছোট ফুটোর দাগ। কালচে বেগুনি হয়ে আছে।
দেখো এখন! দাগগুলো দেখো ভাল করে! টানতে টানতে রবিনকে আয়নার কাছে নিয়ে এল মুসা।
কি হবে দেখলে?
দেখোই না।
কি দেখব? তুমি কি বলতে চাও বুঝতে পারছি না।
কামড়ের দাগ।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। তুমি বলতে চাইছ ভ্যাম্পায়ারের কামড়?।
তো আর কিসের? এমন করে আর কে ফুটো করবে?
পোকার কামড়! অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, মুসা, তোমার পাগলামি থামাও! ছুটিতে এসে অসুস্থ হওয়াটাই একটা জঘন্য ব্যাপার। তার। ওপর তোমার পাগলামির অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না।
ভুলে যেয়ো না, ছুটিতে বেড়াতে আসোনি তুমি। জোর করে তোমাকে ধরে এনেছি আমি। ভ্যাম্পায়ার রহস্যের তদন্ত করতে। সেটা করছ না। উল্টো আমার কাজে বাধা দিচ্ছ। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। ভ্যাম্পায়ার তোমার মাথাটা গড়বড় করে দিয়েছে। তবে তোমাকে আমি মরতে দেব না। রিকির মত। দেরি হওয়ার আগেই যা হোক একটা কিছু করব।
রিকি পানিতে ডুবে মরেছে। রাতের বেলা ভাটার সময় আমি পানিতেও নামব না, ঢেউয়ে ভাসিয়েও নিতে পারবে না। অতএব মরব না। ভয় নেই।
রিকিকে ঢেউয়ে ভাসিয়ে নেয়নি, রবিন, বিশ্বাস করো আমার কথা! রক্ত খেয়ে ওকে শুষে মেরে ফেলেছিল ভ্যাম্পায়ারে। লাশটা পানিতে ফেলে দিয়েছিল। কণিকা তোমাকে সম্মোহন করে তোমার মাথাটা ঘোলাটে করে। দিয়েছে, তাই স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারছ না। গলায় দাগ দেখেও তাই পোকার কামড় ভাবছ।
মুসার দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল রবিন। কণিকাকে তুমি ভ্যাম্পায়ার ভাবছ? তুমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছ, মুসা। নইলে ওর মত ভাল মেয়েকে…
রবিন, থামিয়ে দিল ওকে মুসা। কথা আজ শোনাতেই হবে রবিনকে। জোর করে হলেও। আমার কথা শোনো। কণিকা যে ভ্যাম্পায়ার, কোন সন্দেহই নেই আমার তাতে। রক্ত শুষে খেয়ে যাওয়ার সময় তার দাঁত আর মুখ থেকে তোমার রক্তে বিষ ঢুকে যায়। সেই বিষ তোমাকে অসুস্থ করে রেখেছে। এত দুর্বল লাগে সেজন্যেই। জিনার ব্যাপারে ডাক্তার কি বলেছে, ভুলে গেছ? বলেছে, রক্তে বিষ ঢুকেছে। তোমাকে এ ভাবে চলতে দিলে শেষমেষ তোমার কি হবে জানো? মারা যাবে। আর ভ্যাম্পায়ারের হাতে মারা পড়লে তুমি নিজেও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাবে। জীবত। মানুষের রক্ত ছাড়া আর তখন চলবে না তোমার…
উফ, কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে! অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল রবিন। মুসা, তোমার দোহাই লাগে, তুমি যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
রবিন! মুসাও চিৎকার করে উঠল, কেন তোমরা শুরুতেই আমার কথা বিশ্বাস করো না! কি করলে বিশ্বাস করবে? কি করে বোঝাব তোমাকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
মুসা, তুমি যাও। ঘুম না এলে ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুম দাওগে। আমি একটু ভাল হলেই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব…
রাগে, দুঃখে, হতাশায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো মুসার। ফোঁস করে। নিঃশ্বাস ফেলে জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, পারলাম না, রবিন! কিন্তু আমি চেষ্টা করেছিলাম…
এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না সে। ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নিজেকে বোঝাল, হাল ছাড়বে না কোনমতেই। জিনার বেলায়ও ছাড়েনি। ওকে বাঁচিয়েছে। আগে জানা থাকলে রিকিকেও মরতে দিত না। রবিনকেও বাঁচাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রমাণ করে ছাড়বে, সে পাগল নয়, তার সন্দেহই ঠিক।
সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখল, হলে ঢুকছে কণিকা। মুসাকে দেখে হেসে হাত তুলল, হাই, মুসা।
কটমট করে তাকাল মুসা।
কণিকা হাসল।
তুমি কোত্থেকে এলে? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা।
সৈকত থেকে। পার্টি হচ্ছে। দাওয়াত দিয়েছে আমাদেরকে। রবিনকে নিতে এলাম।
ও যাবে না। শরীর ভীষণ খারাপ।
তাহলে তুমিই চলো। যাবে?
যাব, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল মুসা। রবিন আজ গেলে আর বাঁচবে না। রিকির মতই কাল তার লাশ পাওয়া যাবে সাগরে। ওর বদলে সে নিজে গেলে রবিন বাঁচবে। আর কণিকাও তার কিছু করতে পারবে না।
চলো, মুসার হাত ধরে টান দিল কণিকা। সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে আমার।
.
১৪.
পরদিন সন্ধ্যা।
মুসাকে দেখেই সরে পড়তে চাইল রবিন।
কিন্তু মুসা নাছোড়বান্দা।
শেষে প্রায় হাতজোড় করার মত করে রবিন বলল, দোহাই তোমার, আমার সঙ্গে কথা বোলো না। আর যদি বলোই, তো শুধু নাটকের কথা বলো। তোমার ওই ভ্যাম্পায়ারের গল্প শুনতে শুনতে কান পচে গেছে আমার।
থিয়েটারে নাটকের রিহারস্যাল দিতে এসেছে ওরা।
রবিন…
কিন্তু শুনল না রবিন। সরে গেল মঞ্চের দিকে।
তাকিয়ে রইল মুসা। ছাড়বে না সে। যতই রাগুক রবিন, তাকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়বে। রবিন বিপদটা বুঝতে পারছে না, কিন্তু সে তো পারছে।
সময়মত শুরু করা গেল না রিহারস্যাল। কয়েকজন ছেলেমেয়ে তখনও এসে পৌঁছায়নি। তাদের মধ্যে কিমি, ডলি আর কণিকাও রয়েছে। মঞ্চের সামনের দিকে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন মিসেস রথরক। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন।
রবিনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল মুসা। আগের দিনের চেয়ে খারাপ অবস্থা ওর। চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে, পানিতে ভরা। মুখের চামড়া মোমের মত ফ্যাকাসে। যেন জীবনে কোনদিন রোদের মুখ দেখেনি।
ভ্যাম্পায়ারের মত।
জীবন্মৃতদের দলে যোগ দিতে আর কত সময় লাগবে রবিনের? কিংবা মারা যেতে?
*
রিহারস্যালের পর টনি আর কিমিকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে বললেন মিসেস রথরক, ওদের দৃশ্যগুলো ভালমত বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে। দুজনেই কাঁচা।
থিয়েটারের দরজা দিয়ে কণিকার সঙ্গে রবিনকে বেরিয়ে যেতে দেখল মুসা। ওদের দিকে এগোতে যাচ্ছিল সে, সামনে এসে দাঁড়াল ডলি।
বাইরে খুব সুন্দর রাত। হাঁটতে যাবে?
চলো, রাজি হয়ে গেল মুসা। রবিনকে নিয়ে কোথায় গেল কণিকা দেখা দরকার।
বাইরে বেরিয়ে এল দুজনে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রবিন আর কণিকাকে খুঁজতে লাগল মুসা। বাড়িটার মোড় ঘুরে অন্যপাশে চলে যেতে দেখল একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে। সরু রাস্তা ধরে শহরের দিকে চলেছে আরও অনেক ছেলেমেয়ে। কেউ কেউ যাচ্ছে সৈকতে।
রবিনের দেখা নেই।
কোথায় গেল ও? ভুলিয়েভালিয়ে ওকে থিয়েটারের পেছনের বনে নিয়ে গেল না তো কণিকা? এখন হয়তো রবিনের রক্ত খাচ্ছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? তাড়া দিল ডলি, চলো, শহরে চলে যাই।
ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আশপাশের গলিগুলোর দিকে নজর রাখল মুসা। রবিন আর কণিকাকে খুঁজছে ওর চোখ। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে ছেলেমেয়েরা। হট ডগ খাচ্ছে। বীচ এমপোরিয়ামের উইন্ডোতে সাজানো জিনিসপত্র দেখছে।
আমাদের ডায়লগগুলো আরেকবার প্র্যাকটিস করলে কেমন হয়? ডলি বলল।
কি আর প্র্যাকটিস করব? হাতে গোণা কয়েকটা বাক্য আমার, মুখস্থ হয়ে গেছে। ভুলব না।
কিন্তু আমার ডায়লগ অনেক। কিছুতেই মনে থাকে না। প্র্যাকটিস করতে পারলে ভাল হত। স্ক্রিপ্টটা আছে তোমার কাছে?
না। ওটা আমার লাগে না।
আমারটা ভুলে ফেলে এসেছি থিয়েটারে। এনে দিতে পারবে?
ঠিক আছে, যাচ্ছি।
যাও। সৈকতে চলে এসো। কাঠের সিঁড়ির কাছে থাকব আমি।
দৌড় দিল মুসা। ও ভেবেছিল, তখনও টনি আর কিমিকে রিহারস্যাল দিচ্ছেন মিসেস রথরক। কিন্তু এসে দেখল অন্ধকার।
নিশ্চয় তালা দিয়ে চলে গেছেন মিসেস রথরক, ভেবে দরজার নব ধরে মোচড় দিল সে।
সহজেই খুলে গেল দরজা। লবিতে ঢুকল মুসা। পেছনে বাতাস লেগে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লাটা। চমকে উঠল সে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলল।
বাতির সুইচটা কোনখানে অনুমানের চেষ্টা করল সে। লবিতে কোথায় কি আছে জানে। টিকেট বুদ। একটা কোকের মেশিন। সীটের কাছে যাওয়ার দরজা। সবই দেখতে পাচ্ছে কল্পনায়। কিন্তু সুইচটা কোথায়?
খসখস শব্দ হলো। বাঁয়ে। তারপর খুট করে আবার শব্দ।
কে? ডেকে জিজ্ঞেস করল সে।
জবাব নেই।
বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটাতে শুরু করল যেন হৃৎপিণ্ডটা।
থিয়েটারের দরজা খোলা, অথচ সব আলো নেভানো। খটকা লাগল তার। ঘটনাটা কি?
বড়, ভারী একটা কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা লাগল। ঠং-ঠং, ঝনঝন, নানা রকম শব্দ হলো।
কোকের মেশিনটা।
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ধীরে ধীরে ছাড়ল মুসা। লাইট সুইচটা খুঁজতে শুরু করল।
শব্দ হলো আবার। পা টিপে টিপে হাঁটার মৃদু শব্দ। বিড়ালের পায়ের মত। চারপাশের দেয়ালে মোলায়েম প্রতিধ্বনি তুলল যেন।
কে? আবার জিজ্ঞেস করল সে। গলা কাঁপছে।
এত ভয় পাচ্ছ কেন? নিজেকে ধমক দিল সে। ওটা ইঁদুর। অন্য কিছু না।
দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে চলল সে। সুইচটা কোথায়? পাচ্ছে না কেন?
পেল অবশেষে। সুইচ বোর্ডের কিনারে হাত পড়ল। সুইচটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিপে দিল।
আলো জ্বলল মাথার ওপর।
চোখ মিটমিট করে সইয়ে নিতে লাগল এই হঠাৎ উজ্জলতা। চারপাশে আকাল। লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। একা। ইঁদুর থেকে থাকলে আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে।
কিন্তু মনের খুঁতখুতি গেল না। সত্যি কি ইঁদুর? নাকি রেস্ট রূমে কেউ লুকিয়ে রয়েছে?
দরজা খুলে একটা ঘরে ঢুকল সে। এটা পুরুষদের রেস্ট রূম খালি। মেয়েদেরটাতেও উঁকি দিল। এটাও খালি। কেউ নেই।
ধূর! অহেতুক দেখাদেখি করছে এভাবে। কোন প্রয়োজন ছিল না। তারচেয়ে যা নিতে এসেছে, সেটা নিয়ে কেটে পড়া উচিত। দেরি দেখলে ডলি আবার চিন্তা শুরু করবে।
ডাবল ডোরটা পার হয়ে অডিটরিয়ামে চলে এল সে। সামনে সারি সারি সীট তার দিকে মুখ করে রয়েছে। সব যেন তাকিয়ে রয়েছে শূন্য মঞ্চটার দিকে।
ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগোল সে। নির্জন অডিটরিয়ামে প্রতিধ্বনি তুলল তার পায়ের শব্দ। অনেক জোরাল হয়ে কানে বাজল।
ডলি বলেছে, উইঙসের ভেতরে একটা টুলের ওপর স্ক্রিপ্টটা ফেলে গেছে।
সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠতে শুরু করল সে। মঞ্চের পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে কাপড়ের স্তূপ। ভাল করে দেখল মুসা। ধূসর রঙ চোখে পড়ল। পরিচিত রঙ।
ওগুলো দৃশ্যপট। নাটকের জন্যে তৈরি করা হয়েছে। মাটির নিচের ঘরে ভ্যাম্পায়ারের আস্তানার ছবি। কফিনের মধ্যে শুয়ে থাকা ভ্যাম্পায়ার।
এগিয়ে গেল মুসা। এভাবে ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। ছড়িয়ে নিয়ে ঠিকমত, রোল করে কিংবা ভাঁজ করে রাখতে হবে। দেখেই যখন ফেলেছে, ঠিক করে রাখাটা তার কর্তব্য।
একটা কাপড়ের কোণা ধরে টান দিল সে।
দিয়েই থমকে গেল। চমকে উঠল ভীষণভাবে।
কাপড়টাকে ওভাবে স্তূপ করে রাখার কারণ আছে।
কাপড়ের নিচে একটা লাশ।
একজন মহিলার।
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল মুসার। নাড়িভুড়িগুলো যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
খাইছে! একটিমাত্র শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
মিসেস রথরক। চিত হয়ে পড়ে আছেন। দৃশ্যপটের রঙের মতই তাঁর মুখটাও ফ্যাকাসে ধূসর।
কাঁপা পায়ে হাঁটু গেড়ে বসল মুসা। ভাল করে তাকাল গলার দিকে। দুটো দাঁতের দাগ স্পষ্ট।
খোদা, আবার খুন করল ভ্যাম্পায়ার! এই লাশটাও প্রথম চোখে পড়ল। তার! কি ভাববে এখন পুলিশ?
চোখের কোণ দিয়ে একটা নড়াচড়া দেখতে পেল।
ভ্যাম্পায়ারটা কি এখনও ঘরেই আছে!
বুকের দুরুদুরু বেড়ে গেল তার। পাঁই করে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল একটা ছায়ামূর্তি। চিনে ফেলল।
কণিকা!
.
১৫.
গাঢ় ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। মঞ্চের পেছনে। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। ঠোঁট ফাঁক।
কেন? দাঁতের জন্যে? এখনও গুটিয়ে নেয়নি শ্বদন্ত?
যেন মুসার মনের কথা পড়তে পেরেই তাড়াতাড়ি মুখের কাছে হাত নিয়ে গেল কণিকা। চিৎকার ঠেকাল, না শ্বদন্ত গোপন করল, বোঝা গেল না।
আবার অভিনয় করা হচ্ছে! রাগ লাগল মুসার। বলবে নাকি এসব ভণ্ডামি বন্ধ করতে? বলবে, আমি জানি, তুমি ভ্যাম্পায়ার!
নাহ, আপাতত না বলাই ভাল।
সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয় ঝেড়ে ফেলে গটমট করে ওর দিকে এগিয়ে গেল মুসা। মঞ্চের পেছনে ছায়ায় এসে দাঁড়াল। খপ করে চেপে ধরল কণিকার একটা হাত। হ্যাঁচকা টানে নিয়ে এল ছায়া থেকে আলোতে।
এতক্ষণে যেন লাশটাকে চোখে পড়ল কণিকার। ছোট্ট একটা চিৎকার বেরোল মুখ থেকে। চোখে ফুটল বিস্ময়। কুঁচকে গেল কপাল। নিজের অজান্তেই পিছিয়ে গেল এক পা।
এখানে কি তোমার? গর্জন করে উঠল মুসা। আমি তো জানতাম তুমি রবিনের সঙ্গে রয়েছ।
ছিলাম, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে কণিকার। কিন্তু ও অতিরিক্ত দুর্বল। হাঁটা তো দূরের কথা, দাঁড়াতেই পারছিল না। বাড়ি চলে যেতে বললাম। একটা জরুরী কথা মিসেস রথরককে জিজ্ঞেস করতে থিয়েটারে ফিরে। এসেছিলাম আমি। কিন্তু…
থেমে গেল সে।
আর ন্যাকামি করতে হবে না। মনে মনে বলল মুসা। তুমিই খুন করেছ। মহিলাকে। কোন সন্দেহ নেই আর আমার। জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ আগে এসেছ?
এই তো, মিনিটখানেকও হয়নি। মিসেস রথরকের লাশটা দেখে কি করব ভাবছি, এই সময় একটা শব্দ কানে এল। ভাবলাম খুনী ফিরে এল বুঝি। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম। কারণ আমাদের এই খুনীটা ডেঞ্জারাস। বাগে পেলে আমাকেও ছাড়ত না। তাই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখি তুমি।
আমি পুলিশকে ফোন করতে যাচ্ছি, মুসা বলল।
মাথা ঝাঁকাল কণিকা।
লবিতে দৌড়ে গেল মুসা। ফোন আছে ওখানে। থানায় ফোন করল। ডিউটি অফিসার বলল, কয়েক মিনিটের মধ্যে লোক পাঠাবে।
পুলিশ এবার আমাকে দেখলে খুশিতে মাথায় তুলে নাচবে! তেতো হয়ে গেল মুসার মন। আছাড় দিয়ে নামিয়ে রাখল রিসিভার। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, পেছনে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা।
বুকের মধ্যে আবার ধড়াস করে উঠল মুসার। মনে পড়ল কণিকা ভ্যাম্পায়ার। একটা ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে একা এক ঘরে রয়েছে সে। তিন তিনটে খুন যে ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে।
পিছিয়ে যেতে শুরু করল মুসা।
দেয়ালে গিয়ে পিঠ ঠেকল। কণিকার চোখে চোখ।
এক পা আগে বাড়ল কণিকা।
আরেক পা।
আর দাঁড়াল না মুসা। ঘুরে দৌড় মারল।
মুসা, শোনো, চিৎকার করে ডাকল কণিকা। দাঁড়াও। পালাচ্ছ কেন?
কিন্তু ফিরেও তাকাল না মুসা। এক ছুটে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। বাইরে গিয়ে পুলিশের অপেক্ষা করা বরং ভাল, নিরস্ত্র হয়ে একঘরে একটা ভয়ঙ্কর ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে থাকার চেয়ে।
১৬.
সৈকতে লোক চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে পুলিশ, মুসা বলল। রবিন আর টনির সঙ্গে বসে বসে পাথর ছুঁড়ছে পানিতে।
মিসেস রথরক খুন হওয়ার পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। খুনীকে ধরতে পারেনি পুলিশ। কোন মোটিভ বের করতে পারেনি। তিন খুনের কোনটারই কোন কিনারা করতে পারেনি ওরা, সূত্র পায়নি।
কিন্তু মুসার ধারণা, পুলিশ আসল ব্যাপারটা জানে। ভ্যাম্পায়ারের কথা না জানলে সৈকত বন্ধ করে দেয়ার কথা মাথায় আসত না ওদের। কিন্তু পুলিশ ভূত বিশ্বাস করলে লোকে হাসবে, এই ভয়ে ঘোষণা দিতে পারছে না।
রবিনকে কথা দিয়েছে মুসা, ওর সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের আলোচনা আর করবে না। টনি অবশ্য খোলাখুলি কিছু বলছে না, তবে মুসা বুঝতে পারছে, সে-ও এ নিয়ে আলোচনা করতে চায় না।
একটা সান্তনার কথা–রবিনের দুর্বলতা যা ছিল, তার চেয়ে আর বাড়েনি। তবে মুখের দিকে তাকানো যায় না এখনও। কণিকা নিশ্চয় ওকে রেহাই দিয়েছে। রক্ত খাওয়া বন্ধ করেছে।
তবে, মুসা জানে, আপাতত বন্ধ করেছে। সুযোগ পেলেই আবার খাবে, কোন সন্দেহ নেই। মায়া করে ভ্যাম্পায়ার তার শিকার ছেড়ে দিয়েছে, এ কি কোনদিন হয়!
মেজাজ খারাপ করে একটা গোল পাথর তুলে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মারল মুসা। একটা ঢেউ তখন তীরে আছড়ে পড়ে ভাঙছে। তার মাথায় পড়ল পাথর। পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ব্যাঙের মত কয়েকটা লাফ দিয়ে কিছুদূর গিয়ে তারপর ডুবল।
মুসার মত মারার চেষ্টা করল টনি। হলো না। ডুবে গেল। বলল, কি করে মারো তুমি? তোমারটা লাফায় আর আমারটা ডুবে যায়?
মারার কায়দা আছে, জবাব দিল মুসা।
রবিন হাসল। মুসার মনে হলো, জোর করা হাসি। আজকাল আর হাসি আসে না ওদের। তিন তিনটে মানুষ খুন হওয়ার পর–বিশেষ করে পরিচিত আর বন্ধুজন, হাসি থাকার কথা নয়।
সৈকতে চলাফেরা সত্যি বন্ধ করে দেবে? বলল রবিন।
তাহলে আর এখানে থেকে লাভটা কি হবে আমাদের, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল টনি। বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল।
পুলিশও সেটাই চায়, মুসা বলল।
কিন্তু আমার মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার সেই একঘেয়ে পরিবেশ, কাজ নেই কর্ম নেই, সময় কাটতে চাইবে নাঃ নাহ, সৈকত বন্ধ করে দিলেও আমি যাচ্ছি না। সিসিকে নিয়ে আব্বা-আম্মা চলে গেলেও আমি থেকে যাব।
থেকে কি করবে? সৈকতটাই এখানে আসল। আর তো তেমন কোন জায়গা নেই। এখানে যা কিছু আনন্দের, সব এই সৈকতকে ঘিরে।
ঘড়ি দেখল টনি। কিমি অপেক্ষা করবে বীচ এমপোরিয়ামে। আমি যাই। পরে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে।
সৈকত ধরে হেঁটে যাওয়া টনিকে যতক্ষণ চোখে পড়ল, তাকিয়ে রইল মুসা। তারপর ফিরল রবিনের দিকে। কণিকা কি তোমাকে বলেছে, মিসেস রথরকের গলায় দাঁতের দাগ ছিল?
জবাব না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল রবিন। হাঁটতে শুরু করল।
ছাড়ল না মুসা। পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি দেখেছি। কণিকা এ ব্যাপারে কিছু বলেনি?
না। থাক না ওসব কথা।
রবিনের হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে ফেবাল মুসা, শোনো, কণিকা যে ভ্যাম্পায়ার, এটা আমাকে প্রমাণ করতে দাও নইলে তোমাকেও ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে ছাড়বে খুব শীঘ্রি। আমি প্রমাণ করতে পারব।
ওহ, মুসা, প্লীজ! গুঙিয়ে উঠল রবিন, আমাকে রেহাই দাও।
রবিনের কথা কানেই তুলল না মুসা, তুমি দুর্বল কেন..
ফ্লু কিংবা অন্য কোন ভাইরাসে ধরেছে।
তাহলে তোমার গলায় দাগ এল কোত্থেকে? পোকার কামড় হলে চলে। যেত। ভ্যাম্পায়ারের হলে যাবে না এত সহজে।
আবার গুঙিয়ে উঠল ররিন।
প্রমাণ করতে পারলে তো বিশ্বাস করবে আমাকে? তোমাকে অনুরোধ করছি, আমাকে একটা সুযোগ দাও, কোনমতেই হাল ছাড়ল না মুসা। যদি না পারি এ ব্যাপারে আর টু শব্দ করব না কখনও, কথা দিলাম। কণিকাকে আর সন্দেহ করব না।
বেশ, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল রবিন, আমি রাজি। বুঝতে পারছি, আমি তোমাকে সুযোগ না দিলে আমাকে রেহাই দেবে না তুমি। তবে তোমার ধারণা যে ভুল হবে, এখনই আমি লিখে দিতে পারি।
যাক, খানিকটা এগোনো তাহলে গেল! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা।
রাজি তো হলাম, কি করতে চাও এখন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
প্রথমেই তোমাকে কথা দিতে হবে, প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কণিকার সঙ্গে একা কোথাও যাবে না।
এটা কোন কথা হলো?
হলো। তুমি যেহেতু প্রমাণ চাও, আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। নইলে প্রমাণ করব কি করে? রবিন, শোনো, কোন মানুষকে যদি তিনবার ভ্যাম্পায়ারে কামড়ায়, সেই মানুষটাও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়। জীবন্মত অবস্থার ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি দেয়ার একটাই উপায় থাকে তখন, বুকে কাঠের গজাল মেরে…
হয়েছে, হয়েছে, তাড়াতাড়ি দুই হাত তুলে মুসাকে থামাল রবিন। যাব না কোথাও কণিকার সঙ্গে।
একা দেখাও করবে না ওর সঙ্গে। আশেপাশে আর কেউ আছে কিনা। শিওর হয়ে নেবে।
বুঝলাম! আর…
রবিন, আমি ইয়ার্কি মারছি না!
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ঠিক আছে, যা বলছ করব।
কথা দিচ্ছ?
দিচ্ছি। এখন বলো, তোমার উদ্দেশ্যটা কি? কি করতে চাও?
খুব সহজ। কি করলে ভ্যাম্পায়ার ধ্বংস হয়?
কণিকার বুকে কাঠের গজাল ঢোকাতে পারব না আমি!
ঢোকাতে বলাও হচ্ছে না। তারচেয়ে সহজেই সম্ভব। গজাল ছাড়া অন্য কিসে ভ্যাম্পায়ার মরে, বলো তো?
জানি না।
রোদ। সূর্যের আলো।
তোমার মাথাটা পুরোই গেছে!
রবিনের কথা হাত নেড়ে ঝেড়ে ফেলে দিল মুসা। কি করে মারবে ভ্যাম্পায়ারকে বোঝাতে লাগল, এই সময় পেছনে শব্দ শুনে থেমে গেল। ফিরে তাকিয়ে দেখে কণিকা।
স্থির হয়ে গেল মুসা। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও? কতখানি শুনেছে?
.
১৭.
কি ব্যাপার? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল কণিকা, কি আলোচনা করছিলে। তোমরা? আমাকে দেখে থেমে গেলে কেন?
কণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমানের চেষ্টা করল মুসা, ওদের পরিকল্পনার কথা কতখানি জেনেছে মেয়েটা।
রবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল কণিকা। এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন তোমরা? হাঁটবে, না অন্য কিছু করবে?
মুসার দিকে তাকাল রবিন। কণিকার দিকে ফিরে বলল, আমি যেতে পারব না। শরীর ভীষণ দুর্বল।
আমাকেও বাড়ি যেতে হবে, তাড়াতাড়ি বলল মুসা।
বেশ, যাও, কণিকা বলল। কাল দেখা হবে। মেইন স্ট্রীটের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। কয়েক পা গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, ওহহো, ভুলে গিয়েছিলাম। কাল সন্ধ্যায় সৈকতে একটা বড় পার্টি হবে। সবাই আসবে। তোমাদেরও দাওয়াত দিতে বলে দিয়েছে।
তাই নাকি, খুশি হয়ে রবিন বলল, খুব ভাল খবর শোনালে।
তাহলে কাল ওই সময় দেখা হবে, কণিকা বলল।
হ্যাঁ, কোনমতে দায়সারা জবাব দিল মুসা। কণিকাকে দূরে চলে যাওয়ার সময় দিল। তারপর বলল, আমাদের কথা শুনে ফেলেনি তো?
ফেললে আর কি করব! তবে কোনভাবেই যেন ও অপমানিত না হয়, সে-খেয়াল রাখতে হবে আমাদের।
*
ছিলে কোথায় তুমি? পরদিন রাতে সৈকতের পার্টিতে এলে মুসাকে জিজ্ঞেস করল রবিন। খাবার তো সব শেষ।
হোকগে শেষ। বারগার খেয়ে এসেছি।
হাই, মুসা, হাত নাড়ল কণিকা। আরও অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সঙ্গে রবিনের পাশে বসেছে সে।
মধ্যরাত পার হয়ে গেছে। সারা সৈকত জুড়েই চলছে বীচ পার্টি। কথা রেখেছে রবিন। কণিকার সঙ্গে একা হয়নি একটিবারের জন্যেও।
চোখ বুলিয়ে চারপাশটা দেখল মুসা। হুল্লোড় করছে ছেলেমেয়েরা। সোডার ক্যান ছুঁড়ে মারছে এর ওর গায়ে। খালি ক্যান দিয়ে একটা পিরামিড বানানো হয়েছে। উচ্চতা হবে ছয় ফুট। ক্রমেই আরও উঁচু হচ্ছে ওটা। ভলিবল খেলার চেষ্টা করছে কয়েকজন, অন্ধকারে জ্বলে এ রকম বল দিয়ে। বাতাসে কয়লার ধোয়া আর সাগর থেকে ধরা তাজা মাছের কাবাবের সুগন্ধ।
কণিকার দিকে তাকাল সে।
আজকের রাতটাই তোমার শেষ রাত কণিকা!
রবিনের রক্ত আর খেতে পারবে না তুমি! কারোর রক্তই পাবে না!
ওর প্ল্যানটা হলো, রবিনের সঙ্গে কণিকাকে কোন একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে আটকে ফেলবে। বসিয়ে রাখবে সকাল পর্যন্ত। সূর্য ওঠার আগে কোনমতেই বেরোতে দেবে না।
সাগরের ওপরের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। শোনা গেল বজ্রের গুডুডু চিমনি দিয়ে ভলকে ভলকে বেরোনো ধোয়ার মত কোথা থেকে কালো মেঘ এসে ছেয়ে ফেলল রাতের আকাশ।
বৃষ্টি! চমৎকার! খুশি হলো মুসা। বৃষ্টি এলে ওর প্ল্যানমত কাজ করতে সুবিধে হবে। ঘরে ঢুকতে বাধ্য হবে কণিকা। আর একবার ঢুকলো কোনমতেই ওকে সকালে সূর্য ওঠার আগে বেরোতে দেয়া হবে না।
ডলি এল এই সময়। টনি আর রবিনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ওদের কথা শুনতে লাগল।
বৃষ্টি! আহ! আসে না কেন এখনও?
মুসার পাশে বসে পড়ল ডলি। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, চলো, সৈকতের ওদিক থেকে হেঁটে আসি।
না। বসো। এখন আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না, মুসা বলল। আমি এখন সবার সঙ্গেই থাকতে চাই।
রবিনের কাছ থেকে কিছুতেই দূরে সরা চলবে না এখন। সুযোগ দিলেই ভুলিয়েভালিয়ে তুলে নিয়ে যাবে ওকে কণিকা। আর গেলেই সর্বনাশ ভ্যাম্পায়ারের সম্মোহন বেশিক্ষণ এড়াতে পারবে না রবিন।
মিনতি ভরা চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে আছে ডলি! জোরে নিঃশ্বাস ফেলল।
হাঁটতে যেতে রাজি না হওয়ায় ও এত দুঃখ পেল কেন বুঝতে পারল না মুসা। সবার সামনে অপমান বোধ করল নাকি?
দূরে আবার গুড়গুড় শব্দ। আবার বজ্রপাত।
নীচে নেমে আসছে কালো মেঘ।
এসো বৃষ্টি। আরও তাড়াতাড়ি। প্লীজ।
কিন্তু মুসার অনুরোধে কান দিল না বৃষ্টি। দূরেই রইল বিদ্যুৎ চমকানো, দূরেই রইল বজ্রের গর্জন।
ভোররাত তিনটের দিকে পার্টিটা হয়ে গেল একেবারে প্রাগৈতিহাসিক। বুনো উন্মাদনায় মেতে উঠল সবাই। হই-হুঁল্লোড়, নাচাকোদা, যার যা ইচ্ছে চালিয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে খুনের কথাটা ভুলতে চাইছে সবাই, ডলি বলল।
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
মুসা, এবার তো হাঁটতে যেতে পারি আমরা? সারারাত এক জায়গায় বসে থাকার ইচ্ছেটা আজ তোমার কেন হলো, বুঝতে পারছি না।
কি জবাব দেবে ভাবছে মুসা, এই সময় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল আকাশ গুড়গুড় করে উঠল মাথার ওপর। চমকে ওপর দিকে তাকাতেই আকাশের এমাথা ওমাথা চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুতের শিখা। পরক্ষণে বজ্রপাতের বিকট শব্দ।
মুহত পরেই অঝোরে নামল বৃষ্টি।
লাফ দিয়ে উঠে হাসাহাসি, চেঁচামেচি করতে করতে দৌড় দিল ছেলেমেয়ের দল। আর বাইরে থাকা যাবে না। এখন ঘর দরকার।
মুসা। চিৎকার করে উঠল ডলি, এদিকে! একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে মেইন স্ট্রাটের দিকে ছুটল সে।
চমৎকার!
রবিনের দিকে ফিরে বলল মুসা, শুরু করো।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল রবিন। গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। কণিকার দিকে ফিরে বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল, এসো, কণিকা। থিয়েটারটা সবচেয়ে কাছে। ওখানেই যাব।
থিয়েটারের দিকে দৌড় দিল দুজনে। পেছনে ছুটল মুসা। পাথরের কুচির মত গায়ে এসে আঘাত হানছে বৃষ্টির ফোঁটা। বাতাসে ঝাঁপটা দিয়ে এনে এত জোরে চোখে ফেলছে, চোখ মেলে রাখা কঠিন। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল। গুড। কেউ নেই।
রবিনের পাশ কাটিয়ে গিয়ে একটানে থিয়েটারের দরজাটা খুলে ফেলল
হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল রবিন আর কণিকা। মাথার ওপরে বিদ্যুৎ চমকাল। থরথর করে বাড়িটাকে কাঁপিয়ে দিল বজ্রপাতের শব্দ।
লবিতে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাপাতে লাগল ওরা।
বাপরে বাপ! হঠাৎ করে কি নামাটাই নামল!কণিকা বলল। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি।
হঠাৎ করে আর কোথায়। অনেকক্ষণ থেকেই তো গর্জাচ্ছে। মেঝেতে পা হকে জুতোয় ঢুকে যাওয়া পানি বের করতে লাগল রবিন।
দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে ওর। দেখতে পাচ্ছে মুসা। দুর্বল শরীরে এ ভাবে দৌড়ানোটা কঠিন হয়ে গেছে ওর জন্যে।
চলো, বেসমেন্টে ঢুকে বসে থাকি, মুসা বলল। ওখানটায় গরম পাব। এখানে ঠাণ্ডা।
বেসমেন্টে নামার দরজায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। থিয়েটারের লোক ছাড়া অন্য কারও ঢোকা নিষেধ। কিন্তু তালা নেই। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল মুসা। এত রাতে আর কে দেখতে আসবে। নিষেধ অমান্য করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল সে। রইল সুবার পেছনে। দরজাটা লাগিয়ে দিল।
বেসমেন্ট থেকে বেরোনোর দুটো দরজা। একটা দিয়ে ঢুকেছে ওরা। অন্যটা দিয়ে বেসমেন্ট থেকে সরাসরি বাইরে যাওয়া যায়।
কোন জানালা নেই।
এক্কেবারে নিখুঁত। এ রকম ঘরই দরকার ছিল।
বহু বছর ধরে নাটক হচ্ছে এই থিয়েটারে। নানা রকম জিনিসে বোঝাই # করে রাখা হয়েছে ঘরটা। প্লাস্টিকে মোড়ানো পোশাক ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একদিকের দেয়ালে। তার ওপরের তাকগুলোতে নানা ধরনের হ্যাট। পুরুষের। মহিলাদের।
একটা কাঠের বাক্সের ওপর বসে পড়ল মুসা। দুটো টুল খুঁজে নিয়ে তাতে বলল রবিন আর কণিকা।
সকালের অপেক্ষায় থাকতে হবে এখন। আর কিছু করার নেই। রবিন আর মুসা দুজনে একই কথা ভাবছে। কণিকাকে আটকে রাখতে হবে সূর্যোদয়। পর্যন্ত।
ভিজেছে তিনজনেই। ভেজা চুল নিয়ে অনুযোগ করতে থাকল কণিকা। মুসা লক্ষ করল, ওর হাতে ঘড়ি নেই। তাতে আরও ভাল হয়েছে। সকাল হলো কিনা, বুঝতে পারবে না কণিকা। এ
রবিনের চোখে শীতল দৃষ্টি। একে শরীর খারাপ। তার ওপর মুসার এসব পাগলামি তার পছন্দ হচ্ছে না।
সবই বুঝছে মুসা। বলল না কিছু। সকাল হোক। রোদের আলো এসে পড়ুক কণিকার গায়ে। ওই দৃষ্টি আর থাকবে না রবিনের।
কথা বলতে লাগল সে। কিন্তু রবিন তাতে যোগ দিতে পারল না বিশেষ। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। শুয়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু শোয়ার জায়গা নেই বলে বসেই থাকতে হলো।
কটা বাজে? অবশেষে জিজ্ঞেস করল কণিকা।
সোয়া তিনটে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলল মুসা। বাজে আসলে অনেক বেশি। ভোরের আলো ফোঁটার সময় হয়ে গেছে প্রায়। আর পনেরো মিনিট পরেই কণিকা আর ভ্যাম্পায়ার থাকবে না। জীবন্মাতের অভিশাপ মুক্ত হয়ে চিরকালের জন্যে চলে যাবে পরপারে। দুঃখ হচ্ছে না মুসার। বাঁচিয়েই দিচ্ছে বরং কণিকাকে। জীবন্ত থাকার যন্ত্রণা বড় সাংঘাতিক।
আমি আর বসে থাকতে পারছি না, রবিন বলল। এখুনি গিয়ে বিছানায় পড়তে না পারলে মারা পড়ব।
কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে যাবে কি করে? মুসা বলল।
এখানে থেকে তো বৃষ্টির শব্দও শুনতে পারছি না, কণিকা বলল। কমল কিনা বুঝব কিভাবে? জানালা নেই কিছু নেই। চলো, ওপরে চলে যাই।
যে নামা নেমেছে, এত তাড়াতাড়ি থামবে না বৃষ্টি।
আমি ওপরে গিয়ে দেখে আসি।
তুমি বসো। রবিন যাক। নড়াচড়া না করলে বরং কিছুটা স্বাভাবিক হবে। ও। এভাবে বসে থাকলে ঘুমিয়ে লুটিয়ে পড়বে এখানেই।
হাসল কণিকা। তা অবশ্য ঠিক। রবিন, যাও। কোক মেশিন তত আছে, ওপরে। একটা কোকটোক আনতে পারো নাকি দেখো।
দ্বিধা করতে লাগল রবিন। ওর দিকে তাকিয়ে আছে মূসা। মনে মনে তাগাদা দিচ্ছে–যাও না! দেরি করছ কেন? তীরে এসে তরী ডুবিয়ো না!
আস্তে করে উঠে দাঁড়াল রবিন। বুড়ো মানুষের মত পা টানতে টানতে এগিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে। আধমরা লাগছে ওকে।
পাঁচ মিনিট পর তিন ক্যান কোক নিয়ে ফিরে এল সে। বৃষ্টির কথা বলল, আরও বেড়েছে। কমার কোন লক্ষণই নেই। একটা ক্যান কণিকাকে দিয়ে আরেকটা মুসাকে দিল। দেয়ার সময় চোখে চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
ইঙ্গিতটা বুঝল মুসা। এর মানে বৃষ্টি আসলে থেমেছে। সূর্য ওঠার সময় হয়েছে।
কণিকার এখন অগ্নিপরীক্ষার সময়। মুসা জানে, এই পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না কণিকা।
তাকে আরও পাঁচ মিনিট সময় দিল মুসা। তারপর খপ করে হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। কোক খাওয়া শেষ হয়নি কণিকার। ক্যান থেকে শার্টে পড়ল অনেকখানি।
আরে! কি করছ? তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠল কণিকা। ছাড়ো, ছাড়ো! হাত থেকে ছেড়ে দিল ক্যানটা। মুসার জুতোতে ছলকে পড়ল কোক।
স্থির দাঁড়িয়ে আছে রবিন। তাকিয়ে আছে কণিকার দিকে।
রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। তাকিয়ে আছ কেন হাঁ করে? দরজা খোলো!
মুসা! কণিকাও চিৎকার করে উঠল, ছাড়া আমাকে!
বাইরে বেরোনোর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল রবিন। নবে হাত রেখে ফিরে তাকাল কণিকার দিকে। বড়
রবিন! ককিয়ে উঠল কণিকা। আমাকে বাঁচাও!
টানতে টানতে ওকে দরজার দিকে নিয়ে চলল মুসা। রবিনকে বলল, খোলো! খোলো!
ছাড়া পাওয়ার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিল কণিকা। লাথি মেরে, আঁচড়ে, খামচে অস্থির করে তুলল মুসাকে। হাত ঝাড়া দিল। শরীর মোচড়াতে লাগল। কি করছ তুমি? ছাড়ো আমাকে!
আর দ্বিধা করল না রবিন। একটানে খুলে ফেলল দরজার পাল্লা। ওপরে উঠে গেছে কংক্রীটের সিঁড়ি। রোদ উঠেছে। সিঁড়ির মাথায় এসে পড়েছে উজ্জ্বল রোদ।
কেঁদে উঠল কণিকা, তুমি না বললে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। কই? মিথ্যে কথা বললে কেন? কি করতে চাও তোমরা?
মুসার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল সে। কিন্তু পারল না। কব্জিতে আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল মুসার আঙুল।
ধাক্কা দিয়ে ওকে দরজার বাইরে বের করে দিল মুসা। ওপরে এনে ঠেলে দিল রোদের মধ্যে।
চিৎকার করে উঠল কণিকা।
.
১৮.
চোখ মুদে ফেলল মুসা। হঠাৎ করে রোদ পড়াতে মেলে রাখতে পারল না। মাথা সামান্য সরিয়ে নিয়ে আবার মেলল চোখ।
খাইছে! নিজের অজান্তেই মুসার মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা। ভাবতেই পারেনি এমন কিছু ঘটবে।
দিব্যি রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে মুসার দিকে। কিছুই হয়নি ওর।
খাইছে! আবার বলল মুসা। ঝুলে পড়ল নিচের চোয়াল। কণিকার গায়ে আগুন ধরছে না। বোমার মত ফেটে যাচ্ছে না।
সকালের রোদে চকচক করছে কণিকার কালো চুল। চোখের ওপর হাত এনে রোদ আড়াল করে জিজ্ঞেস করল, হয়েছে? তোমার প্রশ্নের জবাব পেয়েছ?
মুসা ভেবেছিল রবিন রেগে উঠবে। কিন্তু উঠল না। বরং সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। বলল, আমার শরীরটা ভাল থাকলে আজই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম।
কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও বন্ধ করে ফেলল মুসা। কথা খুঁজে পেল না।
আনমনে নিচের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে দুজনের পাশ কাটিয়ে আবার বেসমেন্টে ফিরে চলল কণিকা। সিঁড়ির গোড়ায় নেমে ফিরে তাকিয়ে বলল, আমি যে ভ্যাম্পায়ার নই, আর কোন সন্দেহ আছে?
রবিন বলল, মুসা, তুমি বরং রকি বীচে ফিরে যাও…
না, যেতে হবে না, ক্লান্ত ভঙ্গিতে একটা টুলে বসে পড়ল কণিকা। বসো। কথা আছে।
মুসা আর রবিন যার যার আগের জায়গায় বসল।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না, গলায় জোর নেই মুসার। ধাক্কাটা হজম করতে পারেনি এখনও। ভুলটা কোথায় করলাম?
ভুলটা তোমার মগজে, রবিন বলল। গাধার মত তোমার কথা শুনতে গেছিলাম! কিছু মনে কোরো না, কণিকা। আমি দুঃখিত। ও আমাকে এমন করে বোঝাতে লাগল…
ভুল করেনি ও, রবিনকে অবাক করে দিয়ে বলল কণিকা। ভ্যাম্পায়ার এখানে সত্যি আছে। সেজন্যেই এখানে এসেছি আমি। ওগুলোর অত্যাচার বন্ধ করতে।
কণিকা… তাকিয়ে আছে মুসা। তুমি..
মুচকি হাসল কণিকা। হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল কালো চুল। টান দিয়ে খুলে আনল। বেরিয়ে পড়ল কোকড়া কালো চুল। এক এক করে প্লাস্টিকের নকল নাক, নকল দাঁত, গালে লাগানো রবারের আলগা চামড়া, গালের ভেতর দিকে লাগানো প্যাড় খুলে নিয়ে রাখল পাশের একটা বাক্সের ওপর। হাসিমুখে তাকাল দুই সহকারীর দিকে।
কিশোর! একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল মুসা আর রবিন।
আস্তে! চট করে দরজার দিকে চোখ চলে গেল কিশোরের। মেয়েলী কণ্ঠস্বর আর নেই। তার স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, কেউ শুনে ফেলবে! মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তা শেষ দিকের অভিনয়টুকু কেমন লাগল?
হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা। কথা নেই মুখে।
অভিনয় কিশোরের জন্মগত ক্ষমতা। ছদ্মবেশ নেয়ার ক্ষমতাও অসাধারণ। গ্রীনহিলসে থাকতে বহুবার এর প্রমাণ পেয়েছে ওরা। পুলিশম্যান ফগর্যাম্পারকটকে কত যে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। ওকে এ রকম ছদ্মবেশ নিতে দেখে যত না অবাক হলো, তার চেয়ে বেশি হলো এই বেশে ওকে স্যান্ডি হোলোতে দেখে।
তোমার না রাশেদ চাচার সঙ্গে কোথায় যাওয়ার কথা? অবশেষে কথা খুঁজে পেল মুসা।
ছিল, কিন্তু যাইনি।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কেন?
রিকির মৃত্যুটা ভাবিয়ে তুলেছিল আমাকে। তার ওপর দেখলাম জিনার অবস্থা। তোমার মুখে সব শুনেও ভ্যাম্পায়ারের কথা বিশ্বাস করিনি। তবে বুঝতে পারছিলাম রহস্যময় কিছু ঘটছে এখানে। একটা কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে পুরানো পত্রিকা ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। শিওর হয়ে গেলাম, আমার ধারণাই ঠিক হবে।… তোমাদের না জানিয়ে ছদ্মবেশে আসার কারণ, ভ্যাম্পায়ারের নজরে পড়তে চাইনি। বরং আমি ওদের খুঁজে বের করে ওদের দলে মিশে যেতে চেয়েছিলাম…
কিন্তু আমাদের জানিয়ে এলে কি অসুবিধে হত? মুসা বলল, আমরা না চেনার ভান করতাম।
পারতে না। স্বাভাবিক আচরণ করতে পারতে না কোনমতেই। এতটা বড় অভিনেতা তোমরা নও। আমি চাচ্ছিলাম, তুমি অন্তত আমাকে সন্দেহ করো। ভ্যাম্পায়ার ভাব। তাহলে ভ্যাম্পায়াররা আর আমাকে সন্দেহ করবে না। কারণ জন আর লীলার মৃত্যুর ব্যাপারে তোমাকে সন্দেহ করবে ওরা, বুঝতে পেরেছিলাম। কার কার সঙ্গে তোমার খাতির, জেনে যেত সহজেই। ওদের সন্দেহের আড়ালে থেকে কাজ করতে চেয়েছিলাম আমি।
সফল হয়েছ?
তা বলতে পারো।
তারমানে তুমি বলতে চাইছ ভ্যাম্পায়ার সত্যি সত্যি আছে এখানে। রবিনের কণ্ঠে অবিশ্বাস।
কেন, মুচকি হাসল কিশোর, আমাকেও মুসার মত পাগল মনে হচ্ছে। নাকি? তারপর সিরিয়াস হয়ে গেল। হ্যাঁ, ভ্যাম্পায়ার সত্যি সত্যি আছে। এখানে। ওগুলোর শয়তানী বন্ধ করতে না পারলে আরও কত মানুষকে যে খুন করবে ওরা, তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। রক্তের নেশায়, বিশেষ করে ক্ষমতার নেশায় ওরা উন্মাদ। ওরা আমাকে ওদের দলের মনে করেছে। দুবার সন্দেহ করে ধরে ফেলেছিল প্রায়, অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি। ইমি আর অ্যানিকে ওরাই খুন করেছে। মিসেস রথরককেও। প্রথম দুজন খুন হওয়ার আগে কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু মিসেস রথরকের ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছিলাম। যখন গেলাম, দেরি হয়ে গেছে। বাঁচাতে আর পারলাম না। অল্পের জন্যে।
কারা করেছে এ কাজ? রাগে কাঁপছে মুসা। রিকির লাশটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। ওর নিরীহ, লাজুক হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পেল।
কিমি আর ডলি।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। বুকের মধ্যে দাপাতে শুরু করেছে। হৃৎপিণ্ডটা। ডলি!
বসো। মাথা ঠাণ্ডা করো। কিমি আর ডলি দুজনেই ভ্যাম্পায়ার। আমাকে সন্দেহ করলে, আর ডলিকে চিনতে পারলে না?
আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করল মুসা, ডলি! কিমি।
রক্তের নেশায়, খিদেয় পাগল হয়ে গিয়েছিল দুজনে। ইমি আর অ্যানিকে সৈকতে একা পেয়ে রক্ত শুষে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছিল। হুঁশ ছিল না যে মরে যাবে। কিংবা খিদের ঠেলায়, কেয়ারই করেনি। একই কাণ্ড করেছে মিসেস রথরকের বেলায়ও।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, মাথা নাড়ল রবিন। কিশোর, সব কথা যদি খুলে না বলল, তুমিও পাগল হয়ে গেছ ভাবতে বাধ্য হব। ভাবব, স্যান্ডি হোলোতে এসে মুসা আর জিনাকে যে রোগে ধরেছে, তোমাকেও সেই রোগে ধরেছে। সত্যি কি তুমি ভূত বিশ্বাস করছ?
মাথা নাড়ল কিনোর, না। তবে ভ্যাম্পায়ার বিশ্বাস করছি। কারণ, আছে ওরা। নিজের চোখে দেখেছি। তবে এ ভ্যাম্পায়ার ভূত নয়, ভূতেরও বাড়া, মানুষরূপী পিশাচ। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিক, জাদুটোনায় বিশ্বাস করে আসছে মানুষ। ভেবেছে, শয়তানের উপাসনা করে তাকে ভজাতে পারলে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। ভ্যাম্পায়ার হওয়ার চিন্তাও সেই বিশ্বাসেরই কুফল।
ব্রাম স্টোকার ড্রাকুলা লেখার বহু আগে থেকেই ভ্যাম্পায়ারের কথা জানত মানুষ। বিশেষ করে জার্মানী আর তার আশপাশের কয়েকটা দেশের লোকে। তারা নানা রকম পূজা-অর্চনার মাধ্যমে ভ্যাম্পায়ার হতে চাইত। ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্যে। তাদের আরও একটা বিশ্বাস ছিল, এই ক্ষমতা লাভ করতে পারলে অনন্তকাল বেঁচে থাকা যাবে। তবে এর জন্যে কিছুদিন বেশ কষ্ট করতে হবে। কিছু ক্রিয়াকর্ম পালন করতে হবে, বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। আসল ভ্যাম্পায়ার যা করে থাকে বলে ওদের বিশ্বাস, সেসব ওদের মত করেই পালন করতে হবে। কোন রকম উল্টোপাল্টা করলে চলবে না। এই যেমন দিনের বেলা কফিনে শুয়ে থাকা, সন্ধ্যার পর বেরিয়ে রক্ত খাওয়া–সাধনা চলাকালে অন্য কোন রকম খাবার খাওয়া চলবে না, তাহলে সব মাটি। মোট কথা ভ্যাম্পায়ার যা যা করে, ঠিক তাই তাই করতে হবে। আসল ভ্যাম্পায়ার যেহেতু ভূত, তার অনেক ক্ষমতা, কিন্তু বাস্তব মানুষের তো আর সে-ক্ষমতা নেই। মানুষের রক্ত খাওয়ার জন্যে তাই নানা কৌশল আর ওষুধের আশ্রয় নিতে হয়। শিকারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাকে সম্মোহন করে ভোলাতে হয়, সুযোগমত ওষুধ শুকিয়ে তাকে বেহুশ করতে হয়, তারপর দাতে লাগানো কৃত্রিম ধাতব দাঁত দিয়ে গলার শিরা ফুটো করে রক্তপান করতে হয়। অকাল্টের বই পড়ে জেনেছি এ সব।
যাই হোক, পুরানো আমলেও গুরু থাকত এদের, এখনও আছে। এখানে যে দলটা আছে, তাদের গুরুর নামটা নিশ্চয় শুনেছ তোমরা, বেশ গালভরা–কাউন্ট ড্রাকুলা…
কোথায় আছে ব্যাটা! দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। নাম বলো। ধরে এয়সা ধোলাই দেব…।
বলছি, হাত তুলল কিশোর, তাকে কোনমতেই ছাড়া হবে না। তবে আগে জানতে হবে কোথায় আছে সে, কোন ঠিকানায়। চ্যালাগুলোকে পুলিশে ধরে ধোলাই দিলেই সুড়সুড় করে নাম বলে দেবে।
তাহলে চলো, এখনই ধরব। কিমি আর ডলি তো? দুই মিনিটও লাগবে। কাবু করে ফেলতে। থাকে কোনখানে?
কেন, আন্দাজ করতে পারছ না? জন আর লীলা কোনখানে ছিল?
ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ!
হ্যাঁ, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ঘাটি হিসেবে এত চমৎকার জায়গা আশেপাশে আর কোথায় আছে?
তা বটে। আমি মনে করেছি, জন আর লীলাকে যেহেতু ওখানেই খতম করা হয়েছে, জায়গা পাল্টাবে ওরা, ধরা পড়ার ভয়ে ওখানে থাকতে আর সাহস করবে না…কিন্তু বাড়িটা তো পুড়ে গেছে?
একটা পুড়েছে। আরও অনেক বাড়ি আছে ওখানে।
চলো তাহলে। এখনই যাব।
অত তাড়াহুড়া নেই। সারারাত জেগে ওরা দিনের বেলা বেহুশের মত ঘুমাবে কফিনের মধ্যে। তৈরি হয়ে যেতে হবে আমাদের। সারারাত জেগেছি, আমাদেরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া দরকার। তারপর বেরোব। বলা যায় না, কিমি আর ডলি বাদেও ওখানে আরও লোক থাকতে পারে। কাউন্ট ড্রাকুলা নামে বদমাশটাও হয়তো ওই দ্বীপেই থাকে, ভিন্ন কোন বাড়িতে। লড়াই করে ওদের কাবু করতে হলে শক্তি দরকার।
গলায় হাত বোলাতে বোলাতে রবিন বলল, আমার গলার দাগ দুটো তাহলে কিসের? নিশ্চয় পোকার কামড়ই হবে। আমি তো রাতে একা ওই দুই ভ্যাম্পায়ারের কারও ত্রিসীমানায়ও যাইনি।
তুমি না গেলে কি হবে? ভুরু নাচাল কিশোর। ওরা এসেছিল তোমার কাছে। ডলির কাজই হবে। ওটার খিদেই বেশি। তুমি এমনিতে অসুস্থ মানুষ। রাতের বেলা মরার মত ঘুমিয়েছ। চুরি করে বোর্ডিঙে তোমার ঘরে ঢুকে তখন রক্ত খেয়ে এসেছে। ঘুমের মধ্যেই ওষুধ শুকিয়ে নিশ্চয় বেহুশ করে নিয়েছিল তোমাকে। সেটা করা এমন কোন কঠিন কাজ নয়।
শয়তানের দল! শিউরে উঠল রবিন।
তোমাকেও খতম করে দিত ওরা। বেঁচে গেছ মুসার জন্যে। ও তোমার ওপর এমনভাবে চোখ রাখা আরম্ভ করেছিল, বেশি সাহস করতে পারেনি ডলি। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে।
কৃতজ্ঞ চোখে মুসার দিকে তাকাল রবিন। আবার ফিরল কিশোরের দিকে। টনির কিছু করল না কেন তাহলে কিমি?
ওই একই কারণ, ধরা পড়ার ভয়। পিছে পিছে থেকে সিসি বাঁচিয়ে দিয়েছে ভাইকে। তবে টনিকেও ছাড়ত না ওরা। সুযোগমত ঠিকই সাবাড় করত। ওকে খাঁচায় পোরা মুরগী ভেবেছিল আরকি। যখন ইচ্ছে খাওয়া যাবে।
ঘড়ি দেখল কিশোর। চলো। অনেক বকবক করা হয়েছে। ঘুমানো দরকার।
ঘুমের কথায় হঠাৎ আবার দুর্বল বোধ করতে লাগল রবিন। এতক্ষণ উত্তেজনায় খেয়াল ছিল না। মুসার দিকে তাকাল, একা যেতে সাহস পাচ্ছি না।
হাসল মুসা, ভ্যাম্পায়ারের ভয়?
না, ভীষণ দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরে যদি পড়ে যাই।
চলো। আমি যাচ্ছি সঙ্গে।
.
১৯.
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। দড়ি খুলল মুসা। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল নৌকায়।
কিশোর আগেই উঠে বসে আছে।
ডক হাউসের ভেতরে মৃদু ঢেউয়ে দুলছে নৌকা।
হুডওয়ালা প্লাস্টিকের রেইন কোট পরে এসেছে দুজনেই। হুড তুলে দিয়ে শক্ত হয়ে বসল মুসা।
মাত্র দুপুর হয়েছে। কিন্তু কালো মেঘে এতটাই ভারী হয়ে গেছে আকাশ, প্রায় রাতের মত অন্ধকার। দাঁড়ের আঙটায় দাঁড় ঢুকিয়ে দিয়ে বাইতে শুরু করল সে।
গলুইয়ের কাছে বসেছে কিশোর। এদিকে মুখ করে। শক্ত হয়ে আছে। চোয়াল। চোখে কঠিন দৃষ্টি। বোঝা যাচ্ছে বন্ধুদের খুনের প্রতিশোধ নিতে মুসার মতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে।
রবিন এলে ভাল হত। সাহায্য করতে পারত। কিন্তু এতটাই অসুস্থ সে, বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয়। তা ছাড়া সারারাত জেগে থাকার উত্তেজনা আর পরিশ্রমে আরও বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে।
নৌকার পাটাতনে পড়ে আছে দুটো নাইলনের ব্যাগ। দুটোতে একই জিনিস আছে। কাঠের চোখা গজাল। বড় হাতুড়ি। ভ্যাম্পায়ার ধ্বংস করার সরঞ্জাম। কিশোরের বুদ্ধিতে নেয়া হয়েছে এসব। এগুলো দিয়ে কি করবে কিশোর, জানে না মুসা। বেকায়দায় পড়লে খুন করবে নাকি মানবভ্যাম্পায়ারের বুকে গজাল ঢুকিয়ে!
রোদ থাকলে ভাল হত, কিশোর বলল। বিচ্ছিরি আবহাওয়া।
ভ্যাম্পায়ারের জন্যে চমৎকার।
কি জানি। চাঁদনী রাতে বেরিয়েও ভ্যাম্পায়াররা আনন্দ পায়।
পাবেই। আধামানুষ তো! মানুষেরা যাতে যাতে আনন্দ পায়, ওরাও পায়।
মানুষেরা মানুষের রক্ত খায় না।
কে বলল? নরখাদকদের কাহিনী ভুলে গেছ? এই শতকের গোড়ার দিকেও আফ্রিকার জঙ্গল আর প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক দ্বীপে মানুষখেকো মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে।
তা ঠিক, আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল মুসা। মনে হচ্ছে আগামী পুরো হপ্তাটায়ই বৃষ্টি থাকবে। থাকুকগে। ভ্যাম্পায়ারগুলোকে খতম করতে পারলে আর থাকব না এখানে। বাড়ি ফিরে যাব।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, কিন্তু যে হারে অন্ধকার হচ্ছে…
বৃষ্টির বেগ খানিকটা বাড়ল। রেইন কোর্টের ওপর ফোঁটা পড়ার একটানা আওয়াজ হতে থাকল পুট পুট করে। সাগর শান্ত। ঢেউ এতই কম, হ্রদের পানির মত লাগছে। তাতে সুবিধে হয়েছে। নৌকার গতি বেশি। দ্রুত এগিয়ে চলেছে দ্বীপের দিকে।
ভয় লাগছে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
হ্যাঁ। তবে কাজ সারতেই হবে। স্যান্ডি হোলোতে এই ভ্যাম্পায়ারের ব্যবসা খতম করে ছাড়ব আজ। তোমার ভয় লাগছে না?
না, হাসল মুসা। ভয় তো ভূতকে। মানুষকে আবার কিসের ভয়?
কিন্তু মানুষকেই ভয় করা উচিত। কারণ ওরা বাস্তব। ক্ষতি করার ক্ষমতা সীমাহীন।
চুপ হয়ে গেল মুসা। এই তর্কের শেষ নেই। সে ভুত বিশ্বাস করে, কিশোর করে না। অতএব যুক্তি দেখানোরও শেষ হবে না।
কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দ্বীপটা দেখল মুসা। কাছে চলে এসেছে। মেঘলা অন্ধকারের মধ্যে সামনে খাড়া হয়ে রয়েছে কালো দেয়ালের মত। জিনাকে নিতে এসে রাতের বেলা দেখেছিল সেদিন। দিনের বেলা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর মনে হলো আজ।
দেখেই মনে হয় শয়তানের ঘাটি, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, সত্যি সত্যি শয়তান বাস করে ওখানে।
আরও কাছে এলে গাছগুলোকে আলাদা করে চেনা গেল। দ্বীপের কিনারে ঘন হয়ে জন্মেছে বড় বড় গাছ।
বরফ শীতল এক ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল মুসার কপাল থেকে। কেঁপে উঠল সে।
পুরানো ডকটা রাতের বেলা দেখেছে। কোনখানে ছিল, মনে করতে পারল না। আন্দাজে এগিয়ে চলল। তীরের একপাশ থেকে আরেক পাশে চোখ বোলাল। কিন্তু দেখতে পেল না ওটা।
কোথায়? কোনখানে ছিল?
তীরের আরও কাছে চলে এল নৌকা।
নাহ, নেই! গায়েব!
কি গায়েব? জানতে চাইল কিশোর।
ডকটা…ওহহো, না না আছে। মানে, ছিল।
করাতে কাটা কতগুলো তার মাথা পানি থেকে উঁকি দিয়ে আছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে কোন্খানে ছিল ডকটা। এমনভাবে কেটে নষ্ট করে ফেলেছে, নৌকা বাঁধারও কিছু নেই।
ভ্যাম্পায়ারেরাই কেটে ফেলেছে, মুসা বলল। নৌকা নিয়ে কেউ এসে যাতে ওদের গোপন ঘাঁটি খুঁজে বের করে হামলা চালাতে না পারে সেজন্যেই এই সতর্কতা। নিজেদের নৌকা ভেতরে কোন খাড়িটাড়িতে লুকিয়ে রাখে।
তাহলেই বোঝো, চোখের পাতা সরু করে ফেলল কিশোর। এই একটা ব্যাপার থেকেই বোঝা যায় ওঁরা ভুত নয়; মানুষ। কিন্তু ওরা কিছু সন্দেহ করে ফেলল নাকি? আমরা আসব বুঝতে পেরেছে।
অসম্ভব নয়। সাবধানে তীরের কাছে নৌকা নিয়ে এল মুসা। টেনে তোলার জায়গা খুঁজতে লাগল। বড় বড় পাথর আর পাথরের খাড়া দেয়াল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।
সাঁতরে উঠলে কেমন হয়? কিশোরের প্রশ্ন।
নৌকাটা কোথায় রেখে যাব? নোঙর নেই। ভেসে চলে যাবে। তখন ফিরব কি করে?
দ্বীপটার যে পাশে খোলা সাগর, সেদিকে নৌকা নিয়ে গেল মুসা। ওপাশে বড় বড় ঢেউ। লোফালুফি শুরু করে দিল যেন নৌকাটাকে নিয়ে। এখনই ঢেউয়ের মাথায় চড়ছে নৌকা, পরক্ষণেই ঝপাৎ করে একেবারে নিচে দুই ঢেউয়ের মাঝখানের উপত্যকায়, তারপর আবার ওপরে। চলতেই থাকল এ রকম। মোচার খোলার মত দুলছে। গলুইয়ে বাড়ি খেয়ে পানি ছিটকে এসে পড়ছে চোখে মুখে।
খোলা সাগরে বেরোনোর উপযুক্ত নয় এই নৌকা, শঙ্কিত হয়ে বলল কিশোর। দুই হাতে দুদিকের কিনার চেপে ধরে রেখেছে। ভেতরের দিকটাতে থাকাই উচিত ছিল।
তীরের কাছে একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল মুসার। চিৎকার করে উঠল, দেখো, ঢোকার মুখ!
কিশোরও দেখল। একটা খালমত ঢুকে গেছে দ্বীপের ভেতরে।
ওটার দিকে নৌকা বাইতে লাগল মুসা। ঢেউয়ের জন্যে বাইতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু হাল ছাড়ল না সে।
খালের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই ঢেউয়ের অত্যাচার কমে গেল। মাথার ওপর খাড়া হয়ে আছে বড় বড় গাছ। ছাতার মত ছড়িয়ে আছে ডালপালা। কিছু ডাল পানির ওপর ঝুঁকে পড়ে পানি ছুঁই ছুঁই করছে।
কুচকুচে কালো লাগছে পানির রঙ। তার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে ভেসে এগিয়ে চলল নৌকা। আগের বারের কথা মনে পড়ল মুসার। রাত ছিল। মাথার ওপরে উড়ছিল অগণিত বাদুড়। বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল নেকড়ের ডাকের মত ডাক। বাদুড়রা দিনে ওড়ে না, কিন্তু নেকড়ে যে কোন সময় হামলা চালাতে পারে। যদিও এখন ডাক শোনা যাচ্ছে না, তবু। সাবধান থাকতে হবে। কোন্দিক দিয়ে এসে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন ঠিক নেই। তা ছাড়া মেঘলা বনের চেহারা রাতের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না।
ওদিকে নিয়ে যাও, হাত তুলে দেখাল কিশোর। বন ওখানে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে পানিতে। নৌকা রেখে যাওয়ার উপযুক্ত জায়গা।
নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল মুসা। নরম মাটিতে ঠেকল নৌকার তলা। লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে দড়িটা একটা গাছের ডালে বেঁধে ফেলল সে।
ব্যাকপ্যাক দুটো ওর দিকে ছুঁড়ে দিল কিশোর। তীরে নামল।
ভারী দম নিল মুসা। বাতাসে একধরনের ভেজা ভেজা ভাপসা গন্ধ। যাব?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ।
দ্বীপটা যে এত ছোট, আগে বোঝেনি মুসা। আগের বার পুড়িয়ে রেখে যাওয়া বীচ হাউসটার কাছে পৌঁছতে কয়েক মিনিটও লাগল না। ওটার দিকে। এগোতে গিয়ে আরও কতগুলো প্রায় একই ধরনের বাড়ি চোখে পড়ল। বাড়ি মানে বাড়িঘরের কঙ্কাল, ধ্বংসাবশেষ।
কফিনগুলো খুঁজে বের করব কি করে? ঘড়ির দিকে তাকাল মুসা। বিকেল তো হয়ে এল। দুজন দুদিকে গিয়ে খুঁজব নাকি? তাতে সময় বাঁচবে।
সত্যি কি লাভ হবে তাতে? ব্যাগটা হাত বদল করল কিশোর।
একা হতে ভয় পাচ্ছ নাকি?
দ্বিধা করল কিশোর। মাথা ঝাঁকিয়ে স্বীকার করল, পাচ্ছি না বলা যাবে না। খুনীদের সঙ্গে লাগতে এসেছি আমরা। সাধারণ খুনী নয়, একেবারে পিশাচ, জীবন্ত মানুষের গা থেকে রক্ত চুষে চুষে খেয়ে খুন করে। ওদের পক্ষে সব সম্ভব। এটা ওদের রাজত্ব। ধরে, বেধে রক্ত খেয়ে যদি লাশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেয় কিচ্ছু করার থাকবে না আমাদের।
ধরো কফিনে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেল ওদের। কি করব? গজাল ঢুকিয়ে দেব হৃৎপিণ্ডে?
না। খুন হয়ে যাবে সেটা। শুধু ভয় দেখাবে।
যদি ভয় না পায়?
পিটিয়ে বেহুশ করার চেষ্টা করবে।
তারপর?
কফিনের ডালা আটকে রেখে চলে যাব, যাতে বেরোতে না পারে। পুলিশ নিয়ে ফিরে আসব।
একে অন্যকে গুডলাক বলে দুজন দুদিকে রওনা হয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকিয়ে মুসা দেখল, কালো একটা বাড়ির কঙ্কালের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কিশোর। ঘুরে দাঁড়াল মুসা। ডানের আরেকটা কঙ্কালের দিকে এগিয়ে চলল সে। দরজার কাছে এসে দ্বিধা করল। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখে সইয়ে নেয়ার জন্যে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড পরেই বুঝতে পারল, ঘরে আরও কেউ রয়েছে।
.
২০.
দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল মুসা।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের অন্ধকারের দিকে। ব্যাগটা হাতে ঝোলানো। চেন খুলে গজাল বের করতে সময় লাগবে। ততক্ষণে আক্রমণ করে বসবে ঘরে যে আছে। ডলি কিংবা কিমিকে ভয় করে না সে। দুটো মেয়ে কিছুই করতে পারবে না ওর। তার ভয়, কাউন্ট ড্রাকুলাকে। পালের গোদা। পুরুষ মানুষ। সঙ্গে পিস্তল থাকা অস্বাভাবিক নয়।
খুট করে একটা শব্দ হলো।
তাকাল সেদিকে।
খুব আবছাভাবে নড়াচড়া চোখে পড়ল। মৃদু গরগর কানে এল। রেগে গেলে কুকুর যা করে।
হঠাৎ বুঝে ফেলল প্রাণীটা কি। নেকড়ে!
মহাসঙ্কটে পড়ে গেল মুসা। কি করবে? এগোনোর প্রশ্নই ওঠে না। পিছানোও বিপদ। মুহূর্তে এসে আক্রমণ করে বসবে নেকড়েটা।
জিম করবেটের মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী মনে পড়ল। চৌগড়ের ভয়াবহ বাঘিনীর মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলেন একবার তিনি। হাতে ছিল রাইফেল। বাঘিনীটা এতটাই কাছে ছিল তাঁর, কোন রকম নড়াচড়া করতে গেলেই ঝাঁপিয়ে এসে পড়ত। খুব ধীরে ধীরে হাতের রাইফেলটা ঘুরিয়ে টার্গেট করে তারপর গুলি করেছিলেন।
সেই বুদ্ধিটাই কাজে লাগাল এখন সে। খুব ধীরে যেন অনন্তকাল ধরে। চেষ্টা করে নেকড়েটাকে চমকে না দিয়ে হাতের ব্যাকপ্যাকটা প্রায় পেটের ওপর নিয়ে এল। অন্য হাতটা আনল চেনের ওপর। করবেটের মত অতটা সাবধান থাকতে পারেনি, নড়াচড়া বোধহয় একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল নেকড়ের গরুগরানি। হাতটা যেভাবে আছে সেভাবেই রেখে দিল সে। একেবারে স্থির। গরগর কমলে চেন খুলতে শুরু করল। ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাল। আঙুলে ঠেকল হাতুড়ির বাট। ঠিক এই সময় আক্রমণ করে বসল নেকড়ে।
একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল। হাত থেকে ব্যাগটা ছেড়ে দিল মুসা। টান দিয়ে বের করে আনল হাতুড়ি। নেকড়েটা এসে ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই হাতুড়ি ঘুরিয়ে আন্দাজে বাড়ি মারল।
থ্যাপ করে একটা আওয়াজ হলো। বাড়িটা লাগল নেকডের পেটে। ভয়ঙ্কর গর্জন করে মুসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওটা।
পড়ে গেল মুসা। হাতুড়ি ছাড়ল না। চিত হয়ে পড়েছে। ওই অবস্থাতেই আবার বাড়ি মাবল লাগল নেকড়ের গলায়। প্রচণ্ড ব্যথায় আবার গর্জে উঠে থমকে গেল প্রাণীটা। পরক্ষণে দাঁত বের করে মুসার টুটি কামড়ে ধরতে এলো।
নাকে মুখে বাড়ি মারতে লাগল মুসা। তেলে দিল কটা। দরজা দিয়ে আসা আলোয় দেখতে পেল রক্ত বেরোচ্ছে নেকড়ের নাক থেকে। গুঙিয়ে উঠল ওটা। ভীষণ রাগে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মুসার বুকে।
কানের পাশে বাড়ি মারল মুসা। মোক্ষম আঘাত। কাত হয়ে পড়ে গেল নেকড়েটা। ঠেলা মেরে বুকের ওপর থেকে নেতিয়ে পড়া প্রাণীটাকে সরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। মরেনি এখনও। চোখ মিটমিট করে তাকাচ্ছে। ব্যথাটা সহ্য হয়ে গেলেই আবার উঠে দাঁড়াবে। আবার কামড়ে ছিঁড়তে আসবে ওকে। সুযোগ দেয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি ব্যাকপ্যাক থেকে একটা কাঠের গজাল বের করে চোখা মাথাটা ঠেসে ধরল নেকড়ের হৃৎপিণ্ড বরাবর। বাড়ি মেরে মেরে ঢুকিয়ে দিল যতখানি যায়।
থরথর করে কেঁপে উঠল নেকড়ের শরীরটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল গজালের চারপাশ থেকে। ঠিক মুমূর্ষ কুকুরের মত আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে লাগল মুখ দিয়ে।
গজাল বেঁধা নেকড়ে! ভয়ানক দৃশ্য তাকাতে পারল না আর মৃণা! নেকড়ের মতই থরথর করে কাঁপতে লাগল সে-ও। মায়াই লাগছে প্রাণীটার। জন্যে। না মেরে উপায় ছিল না। না মারলে তাকে মরতে হত।
ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে হাতুড়ি হাতে ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ভেতরে আর কেউ আছে কিনা দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না। ভয়ঙ্কর নেকড়ের সঙ্গে একঘরে বাস করার কথা নয় কারও।
কথাটা মনে হলো এই সময়–পোষা নেকড়ে নয় তো ওটা? তাই হবে। নইলে এত বিপজ্জনক একটা প্রাণীর সঙ্গে বাস করার সাহস হত না কিমি আর ডলির। তা ছাড়া এই দ্বীপে নেকড়ে আসবেই বা কোথা থেকে। দ্বীপ পাহারা দেয়ার জন্যেই রাখা হয়েছে প্রাণীটাকে। ঠিক। কাউন্ট ড্রাকুলার প্রহরী। ট্রানসিলভানিয়ার সেই দুর্গের মত। এর আগের বার যখন এসেছিল সে, তখনও ছিল ওটা। আগুনের ভয়ে নিশ্চয় কাছে আসেনি সেবার। একটাই আছে? না আরও? সাবধান থাকতে হবে। কোনদিক থেকে এসে ঘাড়ে পড়বে কে জানে। সাবধান থেকেও কতটা লাভ হবে বলা যায় না। দল বেঁধে এসে একযোগে আক্রমণ চালালে কিছুই করার থাকবে না ওর মুহূর্তে টেনে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
বাড়িটার কাছ থেকে সরে এসে দ্রুত অন্য বাড়ির খোঁজে হাঁটতে লাগল।
বুনো পথে চলতে গিয়ে দিরে বেলাতেও গা ছমছম করতে লাগল। ভূতুড়ে বন। সত্যি সত্যি ভূত থাকলেও এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভয় তার শক্তি কেড়ে নিয়েছে যেন। পা দুটো অসম্ভব ভারী লাগছে। বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে।
পাওয়া গেল আরেকটা বাড়ি। একটা পাশ ধসে পড়েছে। ঢুকে কিছু পেল না।
একের পর এক বাড়িতে ঢুকে দেখতে লাগল সে। কোনটাতেই কফিন দেখল না। কিমি আর ডলিকে পেল না। যে ঘরেই তাক, আলমারি, সিন্দুক রয়েছে, কোনখানে খোঁজা বাকি রাখল না।
কিন্তু কিমিও নেই। ডলিও না। কোন চিহ্নই নেই ওদের। গেল কোথায়? কোন্খানে আছে?
ছোট্ট এক টুকরো খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল সে। ঘড়ি দেখল। তিনটে পঁয়তাল্লিশ। আগের বার যখন দেখেছিল, তখনও ছিল তিনটে পঁয়তাল্লিশ। হঠাৎ খেয়াল করল, সেকেন্ডের কাটাটা চলছে না। এই ব্যাপার! বন্ধ হয়ে গেছে। ঘড়ি। নেকড়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় বাড়ি লেগে নিশ্চয়।
সময় বোঝার উপায় নেই আর। কতক্ষণ ধরে রয়েছে বলতে পারবে না। সূর্য ডোবার কত দেরি, তাও জানা গেল না।
বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু ভারী মেঘে ঢেকে রেখেছে আকাশ। সময় অনুমান করা কঠিন। তবে সন্ধ্যা বোধহয় হয়ে গেছে। আলো নিভে যাওয়ার আগেই কিমি আর ডলিকে খুঁজে বের করতে না পারলে আজকের মত ফিরেই যেতে হবে। রাতের বেলা অন্ধকারে ওদের খুঁজতে যাওয়াটা হবে চরম বোকামি। খুঁজে পাবেও না। ওদিকে মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে। আরও নেকড়ে থেকে থাকলে রাতের বেলা ভয়ানক বিপদে পড়বে।
কিশোর কোথায়? কাউকে নিশ্চয় খুঁজে পায়নি এখনও। তাহলে যোগাযোগ করত ওর সঙ্গে। নাকি বিপদে পড়ল? চিৎকার তো শোনা যায়নি।
খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল মুসা। কোনদিকে যাবে বুঝতে চাইছে। বনের ভেতর থেকে ভেসে এল একটা কাঁপা কাঁপা ডাক। নেকড়ে! তারমানে আরও আছে! দূর থেকে শেয়ালের ডাকও অনেক সময় নেকড়ের মত লাগে। তবু, খারাপটা ভেবে রাখাই ভাল। প্রাণীটাকে নেকড়ে ধরে নিল সে।
রাতের আর কত বাকি? রাত পর্যন্ত কি অপেক্ষা করবে ওটা? একটাই আছে আর, না আরও বেশি?
ভুল করে আবার তাকাল ঘড়ির দিকে। তাকিয়েই মনে পড়ল নষ্ট। সেই তিনটা পঁয়তাল্লিশই বাজে। বাদুড়েরা এখনও বেরোয়নি। ওরা বেরোতে শুরু করলেই বুঝতে হবে সন্ধ্যা লেগে গেছে।
কিশোরকে ডাকার কথা ভাবল। চিৎকার করতে হবে তাহলে। নেকড়ের কানে যাবে সেই ডাক। হয়তো কিশোরের আগে ওরাই ছুটে আসবে। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতেও এখন ভয় লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। নৌকার কাছে যেতে হলেও বনের ভেতর দিয়েই যাওয়া লাগবে।
নৌকা! তাই তো! এখান থেকে কতখানি দূরে, অনুমান করতে পারল না। সাগরের খোলা দিকটা দিয়ে খালে ঢুকেছিল। খুঁজে বের করতে সময় লাগবে। নেকড়ের তাড়া খেলে এখন পৌঁছতে পারবে না ওটার কাছে।
আতঙ্ক যেন চেপে ধরল ওকে। গাছপালার ফাঁকে ঘুরে বেড়াতে লাগল চঞ্চল দৃষ্টি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটা ঘাসে ছাওয়া। ভাল করে তাকাতে চোখে পড়ল একজায়গার ঘাস চ্যাপ্টা হয়ে আছে। কেউ মনে হয় হেঁটে গেছে এখান দিয়ে।
রাস্তা?
না, রাস্তা এখনও পুরোপুরি হয়নি। হেঁটে যাওয়ার ফলে একটা পায়ে চলা পথ তৈরি হচ্ছে। নেকড়ের কাজ?
ধূর! অত চিন্তা করে কিছু করতে পারবে না। নিজেকে ধমক লাগাল সে-যা হোক একটা কিছু করে ফেলো, নয়তো ভ্যাম্পায়ার খোঁজা বাদ দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ো এখান থেকে।
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতুড়িটা বাগিয়ে ধরে পা বাড়াল সে। বনে এসে ঢুকল। বনটা এদিকে বেশ গভীর। এগিয়ে চলল গাছপালার মাঝখান দিয়ে। গায়ে বাড়ি লেগে সড়াৎ সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে ডাল। পাতায় লেগে থাকা পানি মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল শরীর। ঘন হয়ে জন্মে আছে মোটা মোটা লতা ঝুলে আছে রাস্তার ওপর। হাঁটতে গেলে জড়িয়ে ধরে।
এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো সে। সামনে ডালপাতা জড়িয়ে ধরে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছে লতার দঙ্গল। তার ওপাশে বাড়ির দেয়ালের মত কি যেন চোখে পড়ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ডাল সরিয়ে দেখতে যেতেই খোঁচা লাগল হাতে। কুটুস করে কি যেন বিধল।
আউক! করে হাতটা সরিয়ে এনে তাকাল। খাইছে! দুটো ফুটো। ভ্যাম্পায়ারে দাঁত বসালে যেমন হয়। দুই ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এসেছে। চুষে ফেলতে গিয়ে থমকে গেল। ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপে এসে এ ভাবে রক্ত খাবে! নিজেও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি মুখ সরিয়ে আনল।
যাবে কি করে ওপাশে, ভাবনায় পড়ে গেল সে। কাটার জন্যে ছোঁয়াও যাচ্ছে না।
ব্যাকপ্যাক থেকে একটা গজাল টেনে বের করল। ঢুকিয়ে দিল লতার দঙ্গলের মধ্যে। চাড় মেরে মেরে ফোকর বড় করতে লাগল। তাকাল তার ভেতর দিয়ে।
বাড়িই আছে ওপাশে একটা। দ্বীপের অন্য বাড়িগুলোর তুলনায় মোটামুটি অক্ষত। আলো ফুরিয়ে আসার আগেই কাজ সারার তাগিদে দ্রুত হাত চালাল সে। ফোকরটা বড় করে ফেলল যাতে কোনমতে গলে অন্যপাশে চলে যেতে পারে। গজালটা আবার ব্যাগে ভরল।
কিন্তু কাঁটার জন্যে ফোকর গলে যাওয়াও এক ঝকমারি। কাপড়ে আঁকড়ে ধরল কাটা, ব্যাগ টেনে ধরল, হাতের, মুখের চামড়া ছড়ে গেল। সব কিছু সহ্য করেই আসতে হলো অন্যপাশে।
আকাশের দিকে তাকাল। বন্ধ হওয়ার পর আর শুরু হয়নি বৃষ্টি। মেঘের দল টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে। কেউ যেন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে ওগুলোকে। নেকড়ের দল! মনে পড়ল আবার।
সূর্য ডোবার আর কত বাকি? কতটা সময় হাতে আছে আর?
বাড়িটার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে। নব চেপে ধরে মোচড় দিতে সহজেই ঘুরে গেল। ঠেলা দিতে ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আটকে গেল পাল্লা। কোন কিছুতে লেগে গেছে।
জোরে ঠেলা দিল সে।
সামান্য একটু খুলে আবার আটকে গেল।
গায়ের জোরে ঠেলতে শুরু করল সে। যাতে আটকে ছিল, মেঝেতে ঘষার শব্দ তুলে সরে যেতে লাগল সেই জিনিসটা।
ফুটখানেক ফাঁক হতেই আর খোলার চেষ্টা করল না সে। তার মধ্যে দিয়েই চেপেচুপে কোনমতে ঢুকে পড়ল।
অন্ধকার ঘর। দরজা দিয়ে যা সামান্য আলো আসছে। আর কোনদিক দিয়ে আসার পথ নেই আর।
যার চোখে অন্ধকার সয়ে আসার অপেক্ষা করতে লাগল। চোখে পড়ল একটা ড্রেসার। এটাই দরজা আটকে রেখেছিল।
ধীরে ধীরে নজরে এল পুরো ঘরটাই। একটা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে সে। অদ্ভুত গন্ধ। আগুনের কুণ্ড করে নিভিয়ে ফেলার পর যা হয় অনেকটা সেরকম।
সমস্ত ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল তার দৃষ্টি। পুরো ঘরটাই প্রায় খালি।
আরেকটা দরজা দেখে সেটা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল। এই ঘরটা আরও বেশি অন্ধকার। ভেজা বাতাস। ভাপসা গন্ধ। কোণে কোণে অন্ধকার ছায়া। রান্নাঘর দিয়ে আসা আলোয় সে-অন্ধকার কাটছে না। দেখা যায় মোটামুটি।
দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল সে। জানালা আছে। তবে তক্তা লাগিয়ে। পেরেক ঠুকে আটকে দেয়া হয়েছে।
ছায়াতে কি আছে দেখার চেষ্টা করল।
এককোণে ওটা কি?
আরে একটা নয়, তিনটে। ছায়া এতই গভীর, বোঝা যায়নি প্রথমে।
তিনটে আয়তাকার বাক্স পড়ে আছে।
কফিন!
দম বন্ধ করে ফেলল সে। তিনটে কেন? দুটোতে কিমি আর ডলি। তৃতীয়টায় কে আছে?
কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল বুকের মধ্যে। যা খুঁজতে এসেছিল পেয়েছে। পাওয়া গেছে ভ্যাম্পায়ারের গোপন আস্তানা।
সাবধান রইল কোন রকম শব্দ যাতে আর না হয়। দরজা খোলার সময় যেটুকু করে ফেলেছে, ফেলেছে। ওই শব্দে যদি জেগে গিয়ে না থাকে, ভাল। জাগাতে চায় না। আস্তে করে নামিয়ে রাখল ব্যাকপ্যাকটা। একটা গজাল। বের করে রাখল একটা কফিনের পাশে। হাতুড়িটা মাথার ওপর তুলে, বাগিয়ে ধরে রেখে, টান দিল কফিনের ডালা ধরে।
তুলেই থমকে গেল। ভেতরে বিছানা আছে। কিন্তু মানুষ নেই।
হাতের তালু রেখে বিছানাটা ছুঁয়ে দেখল। গরম। তারমানে এইমাত্র বেরিয়েছে। নিশ্চয় দরজা খোলার শব্দে জেগে বেরিয়ে গেছে।
সোজা হয়ে দাঁড়াল মুসা। পেছনে শব্দ হলো।
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।
ধড়াস করে উঠল বুক। একটা হার্টবীট মিস হয়ে গেল। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লম্বা এক লোক। কালো আলখেল্লা, মুখ ভর্তি দাড়ি, ব্যাকব্রাশ করা চুল, ফ্যাকাসে চেহারা–সব মিলিয়ে একেবারে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা। ট্রানসিলভানিয়ার দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে যেন।
তবে এই ড্রাকুলার হাতে পিস্তল আছে। খসখসে গলায় হুকুম দিল, কোন শয়তানি করার চেষ্টা করলেই গুলি খাবে। এখানে কি জন্যে এসেছ?
জবাব দেয়ার আগেই রান্নাঘর থেকে ঢোকার দরজায় আরেকটা মূর্তিকে দেখতে পেল মুসা। কিশোর।
কি হলো, জবাব দিচ্ছ না কেন?
এই জন্যে, পেছন থেকে বলে উঠল কিশোর।
ঘুরে দাঁড়াতে গেল ড্রাকুলা। সময় দিল না কিশোর। নির্দ্বিধায় কাঠের হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারল লোকটার মাথায়।
এক আঘাতেই ড্রাকুলা কাত। হাতের পিস্তলটা মেঝেতে পড়ল খটাং করে। কাটা কলাগাছের মত টলে উঠে পড়ে যেতে শুরু করল লোকটা। হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝেতে। বেহুশ হয়ে গেছে।
ধরো ব্যাটাকে! ওর কফিনেই শুইয়ে ডালা লাগিয়ে বন্দি করি। তারপর পুলিশ আনতে যাব।
শব্দ শুনে অন্য দুটো কফিনের ডালাও খুলে গেছে। উঁকি দিল কিমি আর। ডলি। দৃশ্য দেখে হাঁ হয়ে গেল দুজনেই।
কঠোর কণ্ঠে আদেশ দিল কিশোর, চুপচাপ থাকো। নইলে বসের অবস্থা করে ছাড়ব। ভ্যাম্পায়ারগিরি ঘুচিয়ে দেব আজ। হাতের হাতুড়িটা তুলে নাচাল। মাথায় বাড়ি খাওয়ার ইচ্ছে আছে?
ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল ডলি। বোঝা গেল, ইচ্ছে নেই।
জিজ্ঞেস করল কিশোর, এ দ্বীপে আর কে কে আছে তোমাদের সঙ্গে?
কেউ না, জবাব দিল কিমি।
সত্যি বলছ?
সত্যি।
তাহলে কোথায় আছে?
বহু জায়গায়। কোটার নাম বলব?
সবগুলোরই বলতে হবে। পরে। দ্বীপে আর কেউ নেই তো?
না, মাথা নাড়ল কিমি।
থাকলে ওর মাথা ফাটানোর আগে তোমার মাথা ফাটাব, বলে দিলাম। হুমকি দিল কিশোর।
সত্যি নেই।
হু। শুয়ে পড়ো এবার। কোন রকম শয়তানির চেষ্টা করলে এটা ঢোকাব হৃৎপিণ্ডে, একটা গজাল দেখাল কিশোর। ভ্যাম্পায়ার-খেলা অনেক খেলেছ। অনেক নিরীহ মানুষকে খুন করেছ। রবিনের রক্ত খেয়েছ। তোমাদের খুন। করার জন্যে হাত নিশপিশ করছে আমার। সুযোগটা দিয়ো না।
বিশ্বাস করল ওরা। সুযোগ দিল না কিশোরকে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে ভেতর থেকে ডালা নামিয়ে দিল।
সঙ্গে করে দড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। তিনটে কফিনের ডালা বাক্সের সঙ্গে পেঁচিয়ে বাঁধা হলো, যাতে ভেতর থেকে কোনমতেই বেরিয়ে আসতে না। পারে তিন ভ্যাম্পায়ার।
কাজ শেষ করে দুই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে মুসার দিকে তাকাল কিশোর, যাও এবার, পুলিশ নিয়ে এসোগে। আমি এদের পাহারা দিচ্ছি।
যদি দলে আরও লোক থাকে? তোমার ওপর হামলা চালায়?
নেই। কিমি মিথ্যে বলেনি। ডলির মত অভিনয় জানে না ও। আর যদি থাকেও, মেঝে থেকে পিস্তলটা তুলে নিল কিশোর, কিছু করতে এলে গুলি খেয়ে মরবে। দেখামাত্র বুকে গুলি করব। কোন ঝুঁকি নেব না। হাতে পিস্তল আছে যখন, নেকড়ে এলেও ভয় নেই যাও যাও, দেরি কোরো না। ওই শয়তানগুলো আসার আগেই নৌকায় উঠে পড়োগে।
ঠিক আছে, যাচ্ছি। সাবধানে থেকো। আমি যাব, আর আসব।
একটা গজাল আর হাতুড়ি তুলে নিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুসা।