- বইয়ের নামঃ দ্য বডি ইন দ্য লাইব্রেরি
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী
দ্য বডি ইন দ্য লাইব্রেরি
১. দরজায় সশব্দে ঠক ঠক
দ্য বডি ইন দ্য লাইব্রেরি – আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ
০১.
দরজায় সশব্দে ঠক ঠক আওয়াজ হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল মিসেস ব্যান্ট্রির। ভাবলেন মেরি প্রভাতী চা নিয়ে এসেছে প্রতিদিনের মত। বিছানায় থেকেই বলে উঠলেন–ভেতরে এসো।
সঙ্গে সঙ্গে পর্দা কুঁড়ে শোনা গেল মেরির আর্ত কণ্ঠস্বর-মাদাম-শিগগির উঠুন। মাদাম-লাইব্রেরী ঘরে একটা লাশ পড়ে আছে।
কান্না চাপার চেষ্টা করে মেরি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
একটা লাশ কথাটা যেন এক ধাক্কায় বিছানা থেকে তুলে দিল মিসেস ব্যাস্ট্রিকে। লাইব্রেরিতে একটা লাশ-এ কি করে সম্ভব?
স্থির হয়ে বসে এক মিনিট ভেবে নিলেন। তারপর তার পাশে নিদ্রিত স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে তুললেন।
–আর্থার, আর্থার ওঠো শিগগির।
কর্নেল ব্যান্ট্রি ঘুম ভেঙ্গে পাশ ফিরে তাকালেন।
–কি বলছ–অত হৈ চৈ কিসের?
–মেরি বলে গেল লাইব্রেরিতে একটা লাশ দেখে এসেছে।
–অ্যাঁ–কি বলছ?
লাইব্রেরিতে একটা লাশ।
গজগজ করতে করতে বিছানা ছেড়ে নামলেন কর্নেল ব্যান্ট্রি। দ্রুত হাতে ড্রেসিংগাউনটা গায়ে চাপিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
সিঁড়ির শেষ ধাপের সামনে বাড়ির চাকরবাকর কজন জটলা করছিল। বাড়ির কর্তাকে দেখে সবাই শশব্যস্ত হয়ে উঠল। কয়েকজন যুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
–কি ব্যাপার? কোথায় কি হয়েছে?
বাটলার এগিয়ে এসে বলল, একবার পুলিসে খবর দেওয়া দরকার স্যার। রোজকার মত ঢুকেছিল মেরি আর অমনি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল একটা লাশের ওপরে।
-আমার লাইব্রেরি ঘরে লাশ রয়েছে? চল দেখা যাক।
.
জেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে টেলিফোন পেল থানার পুলিস কনস্টেবল পক।
আজ সকাল সওয়া সাতটা নাগাদ গামিংটন হলে এক তরুণীর লাশ পাওয়া গেছে কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরি ঘরে। তাকে কেউ গলা টিপে মেরেছে। বাড়ির কেউ মেয়েটিকে চেনে না।
টেলিফোনে খবরটা পেয়েই পক সঙ্গে সঙ্গে তার উধ্বতন অফিসার ইনসপেক্টর স্ল্যাককে টেলিফোন করে জানিয়ে দিল।
.
মিস মারপল রাতের পোশাক পাল্টাছিলেন এমন সময় তার বান্ধবী মিসেস ব্যান্ট্রির টেলিফোন পেলেন।
–ভীষণ ব্যাপার ঘটে গেছে জেন। আমাদের লাইব্রেরিতে একটা লাশ পাওয়া গেছে। সোনালী চুল অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে। মাদুরের ওপর সটান মরে পড়ে আছে। মনে হয় কেউ মেয়েটাকে গলা টিপে খুন করেছে।
তুমি শিগগির এসো-খুনীকে খুঁজে বের করে রহস্যটা উদ্ধার করো–আমি তোমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
ব্যান্ট্রিদের গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সিঁড়ির মুখে কর্নেল ব্যান্ট্রির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মিস মারপলের।
–ওহ মিস মারপল। খুশি হলাম।
–আপনার স্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। ঠিক তখনই মিসেস ব্যান্ট্রি সেখানে হাজির হলেন। স্বামীকে প্রাতরাশ খেতে যাবার জন্য তাড়া দিয়ে মিস মারপলের হাত ধরে বললেন, চল জেন দেখাবে।
লম্বা বারান্দা দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন তিনি। তার পেছনে মিস মারপল।
লাইব্রেরির দরজায় পাহারা দিচ্ছিল কনস্টেবল পক। তার ওপরে হুকুম রয়েছে, কেউ যেন ঘরে ঢুকে কোন কিছু স্পর্শ না করে।
কিন্তু মিস মারপলকে সে বিলক্ষণ জানে। কাজেই সে মহিলা দুজনকে দরজা ছেড়ে দিল।
–কোন কিছু স্পর্শ করছি না।
মিস মারপল লাইব্রেরি ঘরে ঢুকলেন মিসেস ব্যান্ট্রিকে সঙ্গে নিয়ে।
বিশাল ঘর। অগোছালো ভাবে সাজানো, ছড়ানো ছিটানো একরাশ বইপত্র, দলিল দস্তাবেজের সঙ্গে পাইপ ইত্যাদি নানা জিনিস।
দেয়াল জুড়ে ঝুলছে পূর্বপুরুষদের কয়েকটা তৈলচিত্র, কিছু বিবর্ণ জলরঙের ছবি। সারাঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন।
–ওই দেখ।
পুরনো চুল্লীর কাছে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে একদিকে নির্দেশ করলেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
.
মেঝের ওপরে পড়েছিল অগ্নিশিখার মত একটি মেয়ের মৃতদেহ। থোকা থোকা কোকড়া চুল কপালের দুপাশে ছড়িয়ে আছে। কৃশ দেহে শুভ্র সার্টিনের সান্ধ্যপোশাক। স্ফীত মৃত্যু নীল মুখে উগ্র প্রসাধনের চিহ্ন।
চোখের কাজল লেপ্টেছে দুপাশের গালে, লাল লিপস্টিকে রঞ্জিত মুখ। হাত আর ওপরের নখেই রক্তিম রঙ মাখানো। পায়ে সস্তা রুপোলী চপ্পল।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখে শান্ত স্বরে মিস মারপল বললেন, খুবই অল্প বয়স।
এই সময় বাইরে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। কনস্টেবল পক গলা বাড়িয়ে বলল, বোধ হয় ইনসপেক্টর এলেন।
মিসেস ব্যান্ট্রি সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাকে অনুসরণ করলেন মিস মারপল।
.
গাড়ি থেকে নেমে এলেন এলাকার চিফ কনস্টেবল কর্নেল মেলচেট আর ইনসপেক্টর স্ল্যাক। মেলচেট কর্নেল ব্যান্ট্রির বন্ধু।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে বাইরে আসতে এদের সঙ্গে দেখা হল কর্নেলের। তিনি হাঁক ছেড়ে বন্ধুকে সুপ্রভাত জানালেন।
–একটা অস্বাভাবিক কাণ্ডের কথা শুনে নিজেই চলে এলাম। বললেন কর্নেল মেলচেট।
–একেবারেই অস্বাভাবিক।
–মেয়েটিকে পরিচিত মনে হয়?
–একদম না। জীবনে কোন দিন দেখিনি।
–বাটলার কি বলছে, কিছু জানে? স্ল্যাক বললেন।
–লরিমার আমার মতই হতবাক হয়ে গেছে।
–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। স্ল্যাক বললেন।
এই সময় বাইরে পরপর দুটো গাড়ি থামবার শব্দ শোনা গেল। প্রথম গাড়ি থেকে নেমে এলেন বিশালদেহী ডক্টর হেডক। তিনি পুলিসেরও সার্জন।
দ্বিতীয় গাড়ি থেকে নামল সাদা পোশাকের দুজন পুলিস। তাদের একজনের হাতে ক্যামেরা।
সবাই এসে গেছে। এবার তাহলে লাইব্রেরি ঘরে যাওয়া যাক। বললেন কর্নেল মেলচেট।
লাইব্রেরি ঘরের দিকে যেতে যেতে কর্নেল ব্যান্ট্রি বললেন, সকালে আমার স্ত্রী বলল, মেরি লাইব্রেরি ঘরে একটা লাশ দেখেছে। আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি।
-আশাকরি তোমার স্ত্রী তেমন দুশ্চিন্তায় পড়েননি।
-না, সুন্দর সামলে নিয়েছেন। আমাদের গ্রামের সেই মহিলা মিস মারপল রয়েছেন ওর সঙ্গে।
মিস মারপল। ভুরু কুঁচকে উঠল কর্নেল মেলচেটের, তাকে আবার ডেকে পাঠিয়েছেন নাকি তোমার স্ত্রী? মহিলা তো এই এলাকার স্থানীয় গোয়েন্দা বলা চলে। একবার আমাদের খুব টেক্কা দিয়েছিলেন।
কথা বলতে বলতে তারা লাইব্রেরি ঘরের সামনে উপস্থিত হলেন।
.
ইতিমধ্যে ডাইনিং রুমে বসে মিসেস ব্যান্ট্রি আর মিস মারপল প্রাতরাশ সেরে নিয়েছেন।
মিসেস ব্যান্ট্রি এলাকায় বিশেষ পরিচিতা। ঘটনার জট খোলা এবং কার্যকারণ খুঁজে বের করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার–একথা এলাকার সকলেই বিশ্বাস করে।
-ওই অল্পবয়সী মেয়েটার এখানে আসার কথাই আমি ভাবছি। সেন্ট মেরী মিড এমন কোন বেড়াবার জায়গা নয় যে লণ্ডন থেকে কেউ এখানে আসবে। বেসিল ব্লেকের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার ওখানে মাঝে মাঝে পার্টি হয়।
–মেয়েটার পোশাকও কোন নাচের আসরে যাওয়ার মত। কিন্তু বেসিল ব্লেক–আমি তো তার মাকে চিনি। সেলিনা ব্লেক–আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি।
–বেসিল ব্লেকের পার্টিতে লণ্ডন থেকে অনেকেই আসে। বৃদ্ধা মিসেস বেরীর কাছে শুনেছি যে, সপ্তাহের শেষে মাঝে মাঝেই এক সোনালী চুল তরুণী তার ওখানে এসে থাকে।
-তুমি কি তাহলে মেয়েটাকে সে রকম কেউ ভাবছ?
–মেয়েটিকে অবশ্য সেরকম ভাবে খুঁটিয়ে দেখিনি। একবার মাত্র কটেজের বাগানে . দেখেছিলাম একফালি জাঙ্গিয়া আর কাঁচুলি পরে সূর্যস্নান করছিল।
তুমি যে রকম ভাবছ, তা হতেও পারে।
.
০২.
কর্নেল ব্যান্ট্রি আর কর্নেল মেলচেট–দুই বন্ধুও ওই সময় আলোচনা করছিলেন। কর্নেল মেলচেট সতর্ক দৃষ্টি চারপাশে বুলিয়ে নিয়ে বললেন, তুমি তাহলে বলছ মেয়েটাকে একদম চেনো না।
–একই কথা বারবার কেন আমাকে জিজ্ঞেস করছ বুঝছি না। তুমি কি
–মেজাজ গরম করো না বন্ধু। এটা খুনের ঘটনা–ভেতরের সমস্ত কথাই একসময় প্রকাশ হয়ে পড়বে। পাছে তুমি বিসদৃশ অবস্থায় পড়ে যাও আমি সেকথাই ভাবছি। মেয়েটার সঙ্গে তোমার কোন রকম যোগাযোগ থাকলে সেকথা এখনই বলে দেয়া ভাল। আমি জানি, তুমি কখনও মেয়েটাকে গলা টিপে মারতে পার না। কিন্তু মেয়েটা যে এবাড়িতে এসেছিল–হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যই এসেছিল–এরকম হওয়া অসম্ভব নয়। তুমি ভেবে দেখ।
–মেয়েটাকে জীবনে কখনও দেখিনি।
–তাহলে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে মেয়েটা তোমার বাড়িতে কেন ঢুকেছিল। সে যে এলাকার কেউ নয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তোমার লাইব্রেরিতে সে কি করছিল?
–সে কথা তো আমার জানবার কথা নয়। আমি তাকে ডেকে পাঠাইনি।
–তুমি কোন বেয়াড়া ধরনের চিঠি বা ওরকম কিছু পেয়েছিলে?
–না, ওসব কিছু পাইনি।
–গতরাত্রে তুমি কি করছিলে?
হাল্কা ভাবেই প্রশ্নটা করলেন কর্নেল মেলচেট।
–একটা সভায় গিয়েছিলাম রাত নটার সময়–কেনহ্যামে।
বাড়ি ফিরেছ কটায়?
-ওখান থেকে বেরিয়েছিলাম রাত দশটার পরে। পথে গাড়ির গোলমালে পড়তে হয়েছিল বাড়ি ফিরতে পৌনে বারোটা হয়ে গিয়েছিল।
–সে সময় লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলে?
–না।
লাইব্রেরি কে বন্ধ করে?
লরিমার। এ সময়ে সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই বন্ধ করে দেয়।
–বুঝেছি। তোমার স্ত্রী?
–আমি বাড়ি ফেরার সময় গভীর ঘুমে ছিল। সন্ধ্যায় লাইব্রেরিতে গিয়েছিল কিনা জিজ্ঞাসা করিনি।
–চাকরদের মধ্যে কেউ এর সঙ্গে জড়িত বলে তোমার মনে হয়?
–না-না, ওরা সবাই অত্যন্ত ভদ্র বংশের মানুষ। এ বাড়িতে বহু বছর ধরে আছে।
কর্নেল মেলচেটও মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, ওদের কাউকে আমারও সন্দেহভাজন মনে হয় না। মেয়েটি সম্ভবতঃ কোন তরুণের সঙ্গে শহর থেকেই এসেছিল।
লণ্ডন-হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা। দাঁড়াও, মনে পড়েছে–বেসিল ব্লেক
–কে সে?
–সিনেমা জগতের সঙ্গে জড়িত এক ছোকরা। আমার স্ত্রীর পরিচিত। ছেলেটির মা তার সঙ্গে পড়াশোনা করেছে। একেবারে বকে যাওয়া ছেলেটি…স্ল্যানসহ্যাম রোডে একটা কটেজ নিয়েছে। মাঝে মাঝে সে এখানে পার্টি দেয়। খুবই হৈ-হুঁল্লোড় আমোদ হয়। শুনেছি সপ্তাহের শেষে সে শহর থেকে সুন্দরী মেয়েদেরও নিয়ে আসে।
-মেয়ে?
–হ্যাঁ। ওই রকম সোনালী চুল একটি মেয়েকে সে গত সপ্তাহের শেষে নিয়ে এসেছিল। কর্নেলকে খুব চিন্তিত মনে হল।
–স্বর্ণকেশী। কর্নেল মেলচেটের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ল। হ্যাঁ, একটা সম্ভাবনা আঁচ করা যাচ্ছে…।
কি যেন নাম বললে…তার সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার।
তারপর কর্নেল মেলচেট বিদায় নিলেন।
.
সেন্ট মেরী মিডের অধিবাসীদের কাছে বেসিল ব্লেকের কটেজ বুকারের নতুন বাড়ি বলেই পরিচিত। গ্রামের নতুন বাড়ির এলাকায় ওটা কিনেছিলেন মিঃ বুকার। মূল গ্রাম থেকে কটেজের দূরত্ব সিকি মাইলের মত।
কটেজের সামনের অংশটা গ্রামের পথের দিকেই।
প্রথমে শোনা গিয়েছিল একজন চিত্রতারকা বাড়িটা কিনেছেন। গ্রামের লোক উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল রুপোলী পর্দার কোন নায়ককে দেখতে পাবে বলে। পরে অবশ্য তারা হতাশ হয়েছিল।
জানা গিয়েছিল বেসিল ব্লেক কোন চিত্রতারকা নয়, এক ফিল্ম কোম্পানির স্টুডিও মঞ্চসজ্জার সাহায্যকারী কর্মী।
কটেজের মরচে ধরা লোহার গেটের সামনে পুলিসের গাড়ি এসে থামলে চিফ কনস্টেবল মেলচেট গাড়ি থেকে নামলেন।
এক তরুণ এগিয়ে এসে দরজা খুলল। তার কাঁধ অবধি লম্বা কালো চুল।
–কি ব্যাপার? এখানে কি চাই?
–আপনিই কি মিঃ বেসিল ব্লেক? বললেন মেলচেট।
–অবশ্যই আমি।
–আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই।
–আপনি কে?
–আমি…আমি কর্নেল মেলচেট, এই কাউন্টির চিফ কনস্টেবল।
–তা আমার সঙ্গে কি বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন?
-শুনেছি আপনার এখানে গত সপ্তাহের শেষে একজন মানে তরুণী…ইয়ে স্বর্ণকেশী তরুণী এসেছিলেন?
–অ। আমার নৈতিকচরিত্র নিয়ে গ্রামের বুড়িগুলি বুঝি চিন্তায় পড়ে গেছে। কিন্তু…
তাকে বাধা দিয়ে কর্নেল মেলচেট বলে উঠলেন, একজন সুন্দরী তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে…তাকে খুন করা হয়েছে
-তাজ্জব ব্যাপার, কোথায়?
গ্যামিংটন হলের লাইব্রেরিতে।
–গ্যামিংটনে-সেই বুড়ো ব্যান্ট্রির বাড়িতে কর্নেল মেলচেট ব্লেকের চাচাছোলা কথাবার্তায় ক্রমশই মেজাজ হারিয়ে ফেলছিলেন। অনেক কষ্ট করে ক্রোধ সংবরণ করে রেখেছিলেন।
এবারে আর চড়া স্বরে উত্তর না দিয়ে পারলেন না।
দয়া করে সংযত ভাষায় কথা বললে খুশি হব। আমার জানার ব্যাপার ছিল, এই ব্যাপারে আপনি কোন আলোকপাত করতে পারেন কি না।
–অর্থাৎ আমার এখান থেকে কোন স্বর্ণকেশী খোয়া গেছে কিনা-এটাই আপনি জানতে এসেছেন–আরে হ্যাল্লো-কি ব্যাপার, আবার এসে জুটেছ?
সেই মুহূর্তে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে এলো এক সোনালী চুলের সুন্দরী তরুণী। ঢোলা সাদাকালো ডোরাকাটা পাজামা, লিপস্টিক রাঙানো ঠোঁট, আর কাজল মাখা চোখে মেয়েটিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল।
ক্রুদ্ধভঙ্গিতে কটেজের দরজা ঠেলে সে চিৎকার করে বলল, তুমি আমাকে ফেলে পালিয়ে এলে কেন? বেশতো ওই স্পেনীয় মেয়েটার সঙ্গে ফুর্তি লুটছিলে।
-তুমিও তো ওই নোংরা রোজেনবার্গের সঙ্গে ছিলে।
-ও, তুমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিলে। কিন্তু তুমি বলেছিলে পার্টি থেকে দুজনে এখানে চলে আসব।
–সেই কারণেই তোমাকে বলে এসেছিলাম।
–একেবারে দেখছি বিনয়ী ভদ্রলোক।
প্রায় খেঁকিয়ে উঠল মেয়েটি, আমি তোমার হুকুম তামিল করে চলবো–তুমি ভাবলে কি করে?
–আমার ওপরে কর্তৃত্ব ফলাবার স্পর্ধা তুমি দেখিও না খুকি।
দুজনে দুজনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে একমুহূর্ত নীরব হল।
এই সময় কর্নেল মেলচেটের কাশির শব্দ শোনা গেল। বেসিল ব্লেক দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল।
–আহা, আপনার কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই…ডিনা লী–কাউন্টি পুলিসের সবজান্তা কর্নেল…তাহলে কর্নেল আমার স্বর্ণকেশী সশরীরেই উপস্থিত দেখতেই পাচ্ছেন…সুপ্রভাত।
চিফ কনস্টেবল মুখ লাল করে দ্রুত পায়ে তার গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
.
০৩.
মাচ বেনহ্যামের অফিস কামরায় বসে অধঃস্তন কর্মচারীদের তদন্তের রিপোর্টে চোখ বোলাচ্ছিলেন মেলচেট। সামনে বসে ইনসপেক্টর স্ল্যাক বলে চলেছেন, সবই বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে স্যার…নৈশভোজের পর মিসেস ব্যান্ট্রি লাইব্রেরিতে বসেছিলেন, তারপর রাত দশটা নাগাদ শুতে চলে যান। চাকরবাকররা রাত সাড়ে দশটার মধ্যে শুতে যায়। রাতের কাজকর্ম শেষ করে লরিমার শুতে যায় পৌনে এগারোটায়।
রিপোর্ট দেখতে দেখতে কর্নেল মেলচেট বললেন, চাকরবাকরদের কেউ কিছু জানে মনে হয় না।
এই সময়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন ডাঃ হেডক।
–ময়না তদন্তের বিষয়টা জানিয়ে যেতে এলাম।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধন্যবাদ, এটারই দরকার এখন। বললেন কর্নেল মেলচেট।
বলার মত বেশি কিছু নেই। শ্বাসরোধের ফলেই মৃত্যু ঘটেছে। মেয়েটির পোশাকের কোমর বন্ধ গলায় ফাঁস লাগিয়ে পেছনে টেনে এনে হত্যা করা হয়েছে। ধস্তাধস্তির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
-মৃত্যুর সময়টা কখন মনে হয়।
–সেভাবে বলতে গেলে বলতে হয় রাত দশটার আগে না, আর মধ্যরাত্রির পরে নয়।
–আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু?
-না তেমন কিছু নেই। মেয়েটির কুমারীত্ব অটুট ছিল। বয়স আঠারোর মধ্যে–চমৎকার স্বাস্থ্য।
কথা শেষ করে ডাঃ হেডক বিদায় নিলেন।
কর্নেল মেলচেট ইনসপেক্টর স্ল্যাকের দিকে তাকালেন। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা লণ্ডন থেকেই এই এলাকায় এসেছিল। কোন সূত্র তো চোখে পড়ছে না। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকে জানানোই ভাল মনে হচ্ছে।
শহর থেকে এলেও, স্ল্যাক বললেন, মেয়েটির আসার উদ্দেশ্য কর্নেল আর মিসেস ব্যান্ট্রি কিছু জানেন বলে আমার মনে হয়। অবশ্য আমি জানি তারা আপনার বন্ধু।
এ কথায় কর্ণপাত না করে কর্নেল মেলচেট কি বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। তিনি উঠে গিয়ে রিসিভার কানে তুলে নিলেন।
হ্যাঁ, ম্যাচ বেনহ্যাম পুলিস সদর দপ্তর…হ্যাঁ, একমিনিট…টুকে নিচ্ছি…বলুন…রুবি কীন… বয়স আঠারো…পেশাদার নৃত্য শিল্পী…পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতা…সোনালী চুল, পাতলা চেহারা…সাদা সান্ধ্য পোশাক পরণে…পায়ে রুপোলি চপ্পল…ঠিক আছে…মিলে যাচ্ছে…হা… এখুনি আমি স্ল্যাককে পাঠিয়ে দিচ্ছি…ওকে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কর্নেল মেলচেট।
–সঠিক সন্ধানটা পাওয়া গেল। গ্লেনসায়ার পুলিসের কাছ থেকে ফোন এসেছিল। ডেনমাউথের ম্যাজেস্টিক হোটেল থেকে একটি মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল।
-ও তো জলা ভূমিতে ঘেরা একটা জায়গা। বললেন ইনসপেক্টর স্ল্যাক।
–হ্যাঁ, এখান থেকে আঠারো মাইলের পথ। ওই ম্যাজিস্টিক হোটেলেই মেয়েটি নৃত্য শিল্পী ছিল। গতরাতে কাজে উপস্থিত হয়নি বলে হোটেল কর্তৃপক্ষ পুলিসকে জানিয়েছে। তুমি এখনই রওনা হয়ে যাও। সেখানে সুপারিন্টেন্টে হার্পারের সঙ্গে দেখা করে যা দরকার করবে।
.
০৪.
এরপর যথাসম্ভব দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে স্ল্যাক ডেনমাউথে পৌঁছেছেন, সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, আর হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন।
এরপর তিনি রুবি কীনের এক বোনকে সঙ্গে নিয়ে মাচ ব্যানহামে ফিরে এলেন।
কর্নেল মেলচেট স্ল্যাকের অপেক্ষাতেই ছিলেন। স্ল্যাকের সঙ্গে ঘরে ঢুকে তরুণীটি জানাল, পেশাদারী জগতে আমি জোসি নামেই পরিচিত। আমার আসল নাম অবশ্য জোসেফাইন টার্নার। আমার সহকারী রেমণ্ড নামে পরিচিত।
কর্নেল মেলচেটের ইঙ্গিতে মিস টার্নার একটা চেয়ারে বসল। মেয়েটি রূপসী, বয়স তিরিশের বেশি হয়নি। সৌন্দর্যের অনেকটাই প্রসাধনের সহায়তায় বাড়ানো। মেলচেটের মনে হল বেশ বুদ্ধিমতি আর নম্রস্বভাবা। উদ্বিগ্ন মনে হলেও শোকগ্রস্ত মনে হচ্ছিল না মোটেই।
আরও দু-একটি কথার পরে সকলে মর্গের দিকে পা বাড়ালেন।
মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করে বেরিয়ে এসে মিস, টার্নার কম্পিত গলায় বলল, হ্যাঁ, রুবির মৃতদেহ, কোন সন্দেহ নেই। ওঃ আমার শরীর কেমন করছে।
অফিসে ফিরে এলে কর্নেল মেলচেট বললেন, মিস টার্নার, আপনার কাছ থেকে রুবি সম্পর্কে সব কথা আমাদের জানা দরকার।
-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি গোড়া থেকেই বলছি। একটু দম নিল জোসি। পরে বলতে শুরু করল, ওর নাম রুবি কীন। অবশ্য ওটা পেশাদারী নাম। আসল নাম রোজি লেডা। ওর মা ছিল আমার মায়ের মাসতুতো বোন। ওকে আমি ছেলেবেলা থেকেই চিনি। বাইরে থেকে যতটা সম্ভব অবশ্য। রুবি নিজেকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে তৈরি করেছিল। দক্ষিণ লন্ডনের রিক্সওয়েলের প্যালে দ্য ভাস প্রতিষ্ঠানে নৃত্যশিল্পীর জুড়ি হিসেবে কাজ করছিল।
আমি ডেনমাউথের ম্যাজেস্টিক হোটেলে তিন বছর ধরে কাজ করে আসছি।
গত গ্রীষ্মকালে একটা দুঘর্টনায় আমার পায়ের গোড়ালি মচকে যায়। ফলে হোটেলে নাচ বন্ধ রাখতে বাধ্য হই। আমার বদলে রুবিকে নিয়ে আসার জন্য আমি তখন ম্যানেজারকে বলি, টেলিগ্রাম করে তাকে নিয়ে আসা হয়।
–এ ঘটনা কতদিন আগেকার? জিজ্ঞেস করলেন কর্নেল মেলচেট।
–তা এক মাস হল রুবি জয়েন করেছে। ওর সবই ভাল ছিল, দেখতেও সুন্দরী। কিন্তু তেমন মিশুকে ছিল না আর কেমন বোকা-সোকা ধরনের। অল্প বয়সীদের চাইতে বয়স্কদের সঙ্গেই ভাল মানিয়ে নিতে পারত।
-ওর বিশেষ কোন বন্ধু ছিল? জানতে চাইলেন মেলচেট।
–তা বলতে পারব না। আমাকে বলেনি কখনো।
–আপনার মাসতুতো বোনকে শেষ কখন দেখেছিলেন?
–গতরাত্রেই। ও আর রেমণ্ড দুটো প্রদর্শনী নাচে অংশ নিয়েছিল। প্রথমবার নেচেছিল রাত সাড়ে দশটায়। দ্বিতীয়টা মাঝরাতে হবার কথা ছিল। প্রথম নাচটা শেষ করার পর আমি দেখতে পাই হোটেলে থাকে এমন একজনের সঙ্গে নাচছে। আমি তখন লাউঞ্জে কয়েকজনের সঙ্গে ব্রিজ খেলছিলেন।
ওকে ওই শেষবার দেখি। মাঝরাতের পর রেমণ্ড হঠাৎ ছুটে এসে জানায় রুবিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। ওদিকে নাচেরও সময় হয়ে গেছে।
আমি তখনই রেমণ্ডকে নিয়ে রুবির ঘরে গেলাম। ঘরে সে ছিল না। যে পোশাক পরে নেচেছিল–হাল্কা গোলাপী স্কার্ট চেয়ারের ওপরে পড়েছিল।
হেড কনস্টেবল কর্নেল মেলচেট নীরবে বসে মিস টার্নারের কথা শুনে যাচ্ছিলেন।
রুবি ফেরেনি দেখে আমিই বাধ্য হয়ে রেমণ্ডের নাচের জুড়ি হয়েছিলাম। খুবই কষ্ট হয়েছিল। সকালে দেখলাম পা বেশ ফুলে উঠেছে। রুবির জন্য বেলা দুটো পর্যন্ত বসে রইলাম।
তারপর আপনি পুলিসে খবর দিলেন?
–না আমি দিইনি। আমার ধারণা ছিল, বোকার মত নিশ্চয়ই কোন ছেলের পাল্লায় পড়েছে, ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত
–মিঃ জেফারসন বলে কে একজন পুলিসে খবর দিয়েছিল। তিনি কে?
–হোটেলের অতিথিদের একজন। তিনিই পুলিসে খবর দিয়েছিলেন।
–কিন্তু তিনি হঠাৎ খবর দিতে গেলেন কেন?
–ভদ্রলোক পঙ্গুমানুষ। সামান্য কিছু ঘটলেই অস্থির হয়ে পড়েন।
–আপনার বোনকে যে তরুণের সঙ্গে শেষ নাচতে দেখেন সে কে?
তার নাম বার্টলেট। গত দশ দিন ধরেই সে হোটেলে আছে।
–এদের মধ্যে কি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল?
–এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। কথাটা শুনে কর্নেল মেলচেটের মনে হল, জোসি ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছু চেপে যাচ্ছে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এসম্পর্কে ছেলেটির কি বক্তব্য?
–সে বলেছে নাচের পরে রুবি তার ঘরে গিয়েছিল।
–এর পরেই কি সে-
-হ্যাঁ, অদৃশ্য হয়ে যায়।
–সেন্ট মেরী মিডে মিস কীন কাউকে চিনতেন বলে জানেন?
–আমার জানা নেই।
–কখনো তাকে গ্যামিংটন হলের নাম করতে শুনেছিলে?
–না, ও নামটা এই প্রথম শুনলাম।
কর্নেল মেলচেট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিস টার্নারকে লক্ষ্য করে বললেন, গামিংটন হলেই মিস কীনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।
–গ্যামিংটন হলে? আশ্চর্য কাণ্ড।
–কর্নেল ব্যান্ট্রি বলে কাউকে আপনি চেনেন? কিংবা মিঃ বেসিল ব্লেক বলে কাউকে?
–বেসিল ব্লেক নামটা শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। তবে এসম্বন্ধে কিছু জানি না।
এই সময় ইনসপেক্টর স্ল্যাক তার নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে চিফ কনস্টেবলের দিকে এগিয়ে দিলেন। তিনি কাগজে চোখ বুলিয়ে দেখলেন, পেন্সিলে লেখা রয়েছে, কর্নেল ব্যান্ট্রি গত সপ্তাহে ম্যাজেস্টিক হোটেলে নৈশ ভোজ সেরেছিলেন।
কর্নেল মেলচেট মুখ তুলে স্ন্যাকের চোখে চোখ রাখলেন। তার বন্ধু কর্নেল ব্যান্ট্রি সম্পর্কে স্ল্যাকের মনোভাব বুঝতে পেরে তিনি নীরব রইলেন। পরে জোসির দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস টার্নার, আমার ইচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে একবার গ্যামিংটন হলে যান, তাহলে কাজের কিছু সুবিধা হয়।
-আমার আপত্তি নেই।
.
০৫.
গ্যামিংটন হলেন ব্যাপারটা চিরকুমারী ওয়েদারবেরী বেশ রসালো করে রটিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন।
মিস মারপলকেও যে গ্যামিংটন হলের গাড়ি এসে নিয়ে গেছে সে খবরও সেন্ট মেরী মিডের অনেকেরই জানা হয়ে গেল।
ঘটনাটা বেশ মুখরোচক এবং কলঙ্কজনক রূপ নিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল।
মিসেস প্রাইস রিডলে খবরটা পেলেন তাঁর পরিচালিকা ক্লারার মুখে। তিনি আবার ঘটনাটা পৌঁছে দিলেন গ্রামের যাজক রেভারেণ্ড মিঃ ক্লিমেন্টকে।
মিসেস প্রাইস রিডলে গত এক বৃহস্পতিবারে লণ্ডন যাবার পথে কর্নেল ব্যান্ট্রিকে দেখতে পেয়েছিলেন। প্যাডিংটনে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেন্ট জনস উডের একটা ঠিকানায় যাচ্ছেন–এরকম তার কানে এসেছিল। যাজক ভদ্রলোককে বেশ সন্দেহের সুরেই এই বিবরণও জানিয়েছিলেন।
মিঃ ক্লিমেন্ট অবশ্য এতে কিছুই বুঝতে পারেন নি। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এতে কি প্রমাণ হয়?
.
লাইব্রেরী ঘর থেকে ইতিমধ্যে মৃতদেহটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুলিসের লোক যারা আঙুলের ছাপ আর ছবি নিতে এসেছিল, তারাও চলে গিয়েছিল।
মিসেস ব্যান্ট্রি আর মিস মারপল বসার ঘরে এসে বসেছিলেন।
–জানো জেন, আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে পারে। ভালো লাগছে না। তুমি বসো। কর্নেল মেলচেট ফোন করে জানিয়েছেন, যে মেয়েটি মারা গেছে তার এক মাসতুতো বোনকে নিয়ে আসছেন এখানে। তুমি কিছু বুঝতে পারছ?
–মেয়েটাকে এখানে কেন আনা হচ্ছে বুঝতে পারছি না, বললেন মিস মারপল, তবে এমন হতে পারে কর্নেল মেলচেটের ইচ্ছে কর্নেল ব্যান্ট্রিকে মেয়েটা একবার দেখুক।
-ওকে চিনতে পারে কিনা সে জন্য? বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি। ওরা কি আর্থারকে সন্দেহ। করছে?
-আমারও সেরকম ধারণা।
–আর্থার এই ঘটনায় জড়িত! আশ্চর্য।
–এ নিয়ে চিন্তা করো না, ডলি।
–আর্থারও বেশ ভেঙ্গে পড়েছে।
এই সময় বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। একটু পরেই কর্নেল মেলচেট সেই মেয়েটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
–ইনি হলেন মিস টার্নার, মিসেস ব্যান্ট্রি। নিহত মেয়েটির মাসতুতো বোন।
মিসসে ব্যান্ট্রি তার সঙ্গে করমর্দন করে মিস মারপলকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর তাকে নিয়ে লাইব্রেরী ঘরে এলেন।
কর্নেল মেলচেট আর মিস মারপল তাকে অনুসরণ করলেন।
–ও ওখানে পড়েছিল।
কার্পেটটা দেখিয়ে বললেন মিস ব্যান্ট্রি।
-ওহ। বড় অদ্ভুত লাগছে–এমন একটা জায়গায়
ব্যাপারটা নিয়ে মিস মারপল নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছেন? বললেন কর্নেল মেলচেট।
মিস মারপল কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে রইলেন। পরক্ষণেই সকলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের সঙ্গে মিলিত হবেন কর্নেল ব্যান্ট্রি। কর্নেল মেলচেট তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। পরে তাকে মিস টার্নারের পরিচয় জানালেন। তিনি লক্ষ্য করলেন দুজনের কারো মুখেই পরস্পরকে চিনতে পারার কোন ভাব জাগল না। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
মিস টার্নারের মুখে রুবী কীনের অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা শুনলেন।
মিস মারপল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তার পরেই আপনি পুলিসে খবর দিলেন?
–ওহ না। খবরটা দিয়েছিলেন মিঃ জেফারসন। তিনি হোটেলের বাসিন্দা। মানুষটা পক্ষাঘাতে পঙ্গু।
–মিঃ জেফারসন? মিসেস ব্যান্ট্রি বললেন।
–কনওয়ে জেফারসন কি?
–হ্যাঁ।
–তিনি তো আমাদের বহুকালের পুরনো বন্ধু। তিনি ম্যাজেস্টিক হোটেলে আছেন? আর্থার, এতো দেখছি রীতিমত এক সমাপতন।
এরপর মিস টার্নারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তিনি আজকাল কেমন আছেন? তাঁর পরিবারের আর সকলেও কি সেখানেই আছেন?
-হ্যাঁ মিঃ গ্যাসকেন, ছোট মিসেস জেফারসন আর পিটার–ওরা সবাই রয়েছেন। মিস মারপল লক্ষ্য করলেন, মিঃ জেফারসন সম্পর্কে মেয়েটি যখন কথা বলছিল, তার গলায় কিছুটা যেন কৃত্রিম রয়েছে।
আরও দু-চারটি কথা বলার পর কর্নেল মেলচেট বিদায় নিলেন।
–লক্ষ্য করেছ ডলি, জেফারসনদের কথা উঠতেই মেয়েটি কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল? বললেন মিস মারপল।
–ব্যাপারটা কি হতে পারে জেন? মেয়েটি বোনের জন্য দুঃখ পেয়েছে বলে কিন্তু মনে হল না আমর।
-হ্যাঁ, রুবী কীনের কথা বলতে গিয়ে কেমন রেগে উঠছিল, আমারও নজরে পড়েছে। কারণটা কি হতে পারে সেটাই আগ্রহের বিষয়।
এক মুহূর্ত কি ভাবলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। পরে বললেন, ব্যাপারটা জানতে হবে। আমরা আজ ডেনমাউথে খাব আর ম্যাজেস্টিক হোটেলে থাকব–তুমিও থাকবে আমাদের সঙ্গে। জেফারসনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব-দেখবে খুবই ভাল মানুষ। মানুষটা বড় দুঃখী। এক ছেলে আর এক মেয়ে ছিল তার–দুজনেই বিবাহিত। একবার ফ্রান্স থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় ওরা সকলেই মারা যায়।–মিসেস জেফারসন রোজামণ্ড আর ফ্র্যাঙ্ক। কনওয়ের পা দুটো কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। অসাধারণ মনের জোরে নিজেকে সামলে রেখেছেন। পুত্রবধূটি এখন ওঁর সঙ্গেই থাকে। ফ্র্যাঙ্ক জেফারসনের সঙ্গে বিয়ের আগে ও ছিল বিধবা। প্রথম পক্ষের এক ছেলে আছে তার পিটার কারমোডি। ওরা দুজন ছাড়া সৰ্ক গ্যামকেল, রোজামণ্ডর স্বামীও থাকে কনওয়ের সঙ্গে। ওদের কথা ভাবতে গেলে বুক ফেটে যায়।
–তার ওপরে ঘটল আর একটা দুঃখজনক ঘটনা। বললেন মিস মারপল।
–এ ঘটনার সঙ্গে কি সম্পর্ক?
–নেই বলছ? মিঃ জেফারসনই তো পুলিসে খবরটা দিয়েছিলেন।
.
.
০৬.
গ্রেনসায়ার পুলিসের সুপারিন্টেন্টে হার্পার আর ইনপেক্টর ক্ল্যাককে নিয়ে কর্নেল মেলচেট কথা বলছিলেন হোটেলের ম্যানেজার মিঃ প্রেসকটের সঙ্গে।
কর্নেলের প্রশ্নের উত্তরে মিঃ প্রেসকট বললেন, মেয়েটির সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তাকে এনেছিল যোসি
–যোসি এখানে কতদিন আছে?
বছর তিনেক।
–মেয়েটিকে আপনি পছন্দ করেন?
-হ্যাঁ। ও খুব কাজের মেয়ে। আমাদের পক্ষে সবদিক থেকেই উপযুক্ত। ব্যবহারও বেশ মনোরম। ওর ওপর যথেষ্ট নির্ভর করি আমি।
–গোড়ালির চোট পাওয়ার পরেই কি সে তার মাসতুতো বোনটিকে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল?
-হ্যাঁ। আমি মেয়েটির বিষয়ে কিছুই জানতাম না। যোসিই তাকে নিজের খরচে নিয়ে এসেছিল। মাইনের ব্যাপারটাও ওরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিয়েছিল।
এরপর রুবী কীনের সম্পর্কে জানাতে গিয়ে হোটেল ম্যানেজার জানালেন মিঃ জেফারসন তাকে খুবই পছন্দ করতেন। মাঝেমাঝে গাড়ি করে বেড়াতেও নিয়ে যেতেন। তিনি পঙ্গু মানুষ, হুইল চেয়ারেই চলাফেরা করেন। অল্পবয়সী মেয়েদের তিনি খুবই স্নেহ করেন। তাদের জন্য মাঝে মধ্যে এখানে পার্টি দিয়ে থাকেন।
–পুলিসে ফোনটা তো তিনিই করেছিলেন? জানতে চাইলেন সুপারিন্টেন্টে হার্পার।
–হ্যাঁ। আমার ঘরে বসেই ফোন করেছিলেন।
এরপর মিঃ জেফারসনের সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন কর্নেল মেলচেট। মিঃ প্রেসকট তাদের নিয়ে মিঃ জেফারসনের সুইটে উপস্থিত হলেন।
মিসেস এডিলেড জেফারসন জানালেন তার শ্বশুর প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছেন। ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠলেই তার সঙ্গে কথা বলা ভাল।
সুপারিন্টেন্টে হার্পার কর্নেল মেলচেটকে বললেন, তাহলে ততক্ষণে তরুণ জর্জ বার্টলেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসা যাক।
কর্নেল মেলচেট তার এই প্রস্তাবে সায় দিলেন।
.
০৭.
কৃশ চেহারার ছিপছিপে তরুণ জর্জ বার্টলেট। তার সঙ্গে কথা বলে কিন্তু বিশেষ কিছুই জানা গেল না।
রাত এগারটা নাগাদ সে রুবী কীনের সঙ্গে নেচেছিল। তারপর সে তার নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। সেই সময় তাকে কিছুটা ক্লান্ত আর বিমর্ষ মনে হয়েছিল তার।
এরপর খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে এসে একমাত্র পানীয় পান করেছিল। সেই সময় তার চোখে পড়েছিল যোসি টেনিস খেলে যে ভদ্রলোক তার সঙ্গে নাচছিল।
যোসির গোড়ালিতে চোট লেগেছিল সে জানত, এই অবস্থায় তাকে নাচতে দেখে সে খুব বিস্মিত হয়েছিল।
কর্নেল মেলচেট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোন গাড়ি আছে?
–হ্যাঁ, আমার গাড়ি আছে। বলল বার্টলেট।
–গাড়িটা নিয়েই ঘুরতে বেরিয়েছিলেন কি?
–না। ওটা চত্বরেই ছিল।
–একেবারে মাথামোটা গর্দভ।
বার্টলেটের সঙ্গে কথা বলার পর কর্নেল মেলচেটের এই ছিল সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া
.
হোটেলের নাইটগার্ড ও বারম্যানদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। রুবী কীন যে সদর দরজা দিয়ে বাইরে যায়নি সে রাত্রে সে কথা বেশ জোর দিয়েই জানাল নাইটগার্ড। তবে সেই সঙ্গে একথাও জানাল, দোতলার ঘর থেকে বেরিয়েই যে ঘোরানো সিঁড়ি সেটা দিয়ে বেরিয়ে গেলে তাকে চোখে পড়বার কথা নয়।
রাত দুটোয় নাচ বন্ধ হওয়ার আগে সেই দরজা বন্ধ করা হয় না।
বারম্যানের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়েই নয় বছরের একটি বালকের সামনে পড়ে গেলেন কর্নেল মেলচেট ও তার সঙ্গরী।
ছেলেটি বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি গোয়েন্দা? আমি পিটার কার মেসি। আমার দাদু মিঃ জেফারসনই রুবীর জন্য পুলিসে ফোন করেছিলেন। আমি ডিটেকটিভ গল্প খুব পছন্দ করি। গোয়েন্দাদের আমার ভাল লাগে।
ছেলেটির চটপটে কথাবার্তা শুনে সুপারিন্টেন্টে হার্পার খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তিনি তার সঙ্গে কথায় কথায় বেশ ভাব জমিয়ে নিলেন।
শেষ পর্যন্ত এই সাক্ষাৎকার থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র তারা পেয়ে গেলেন।
–রুবী কীনকে খুব ভাল লাগত। কিন্তু মা আর মার্ক কাকা ওকে একদম দেখতে পারত না। কেবল দাদু ওকে ভালবাসতো…ও যে মরে গেছে এজন্য তারা খুব খুশি…
পিটার কারমেসির কথা শুনে কর্নেল মেলচেট আর হার্পার পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
এরপর তারা কনওয়ে জেফারসনের সুইটে উপস্থিত হলেন। সেই সময় দীর্ঘকায় অস্থির চিত্ত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন কনওয়ের পুত্রবধূ এডিলেড।
পুলিস কর্তাদের দেখে সেই ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমার শ্বশুর আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল নয়।
ডাক্তার বলে দিয়েছেন কোন অবস্থাতেই যেন তাকে উত্তেজিত হতে দেওয়া না হয়।
-হ্যাঁ। ওঁর হার্ট খুবই খারাপ। এডিলেড জেফারসন মার্ক গ্যাসকেলকে সমর্থন করার চেষ্টা করলেন।
লোকটি দুঃসাহসী, অবিবেচক আর বিবেকবর্জিত। এমন চরিত্রের মানুষ যে কোন কাজই নির্বিকারে করতে সক্ষম–এরকমই ধারণা হল তার।
শোবার ঘরেই জানালার সামনে তার হুইল চেয়ারে বসেছিলেন মিঃ জেফারসন। প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায় মানুষটি প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। লাল চুলে সাদা ছোপ পড়েছে। নীলাভ চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মুখের রেখায় ফুটে উঠেছে দীর্ঘ যন্ত্রণার ছায়া। শরীরে রোগ বা দুর্বলতার কণামাত্র ছাপও নজরে পড়েনা।
প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর তিনি অতিথিদের সামনের সোফায় বসতে ইঙ্গিত করলেন।
-আমরা এসেছি মৃত মেয়েটি সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে জানতে। কর্নেল মেলচেট বললেন।
-আমার মনে হয়, সমস্ত কথা আপনাদের খোলাখুলিই জানানো দরকার।
কোনরকম ভূমিকা না করেই মিঃ জেফারসন বলতে শুরু করলেন, আটবছর আগে একটা বিয়োগান্ত ঘটনা আমার জীবনে ঘটে। এক বিমান দুর্ঘটনায় আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে ও মেয়েকে হারাই। জীবনের অর্ধেকটাই আমার এভাবে হারিয়ে যায়। আমিও পঙ্গু দেখতেই পাচ্ছেন।
এখন আমার পুত্রবধূ আর জামাই আমার সঙ্গে থাকেন। তারা আমার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারই করেন। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে অল্পবয়স্কদের ভাল লাগে। তাদের আমি উপভোগ করি।
যে বাচ্চা মেয়েটি মারা গেল গত একমাস যাবৎ তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মেয়েটি স্বাভাবিক ও সরল। বড় নিষ্পাপ। কোন রকম অশ্লীলতা তার মধ্যে ছিল না। আমি ঠিক করেছিলাম আইনসিদ্ধভাবেই তাকে দত্তক নেব।
আশা করি এ থেকে আপনারা বুঝতে পারবেন সে হারিয়ে গেছে শুনে কেন আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম।
–এ ব্যাপারে আপনার পুত্রবধূ আর জামাইয়ের বক্তব্য জানতে পারি কি? বললেন হাপার।
তাদের এতে বলার কিছু নেই। তবে এটা ঠিক তেমন ভালভাবে নেয়নি। আমার ছেলে ফ্র্যাঙ্ককে তার বিয়ের পরে আমার সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেকটাই দিয়ে দিয়েছিলাম।
মেয়ে রেজামণ্ড এক দরিদ্রকে বিয়ে করেছিল। তাকেও আমি অনেক টাকা লিখে দিয়েছিলাম। তার মৃত্যুর পরে সে টাকার মালিক হয় তার স্বামী। অর্থকরীর দিক থেকে এদের কোন অভিযোগই আমি রাখিনি।
যাই হোক বুঝতেই পারছেন মিঃ গ্যাসকেল আর মিসেস জেফারসন আমার পরিবারে থাকলেও রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়।, আমি মানুষের চরিত্র বিচার করতে জানি। বুঝতে পেরেছিলাম কিছুটা শিক্ষা পেলে রুবি কীন সঠিক ভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারবে।
-বুঝতে পারছি, বললেন কর্নেল মেলচেট, মেয়েটির দায়িত্ব আপনি নিতে চাইছিলেন, তার নামে টাকাও রাখতে চাইছিলেন–কিন্তু কাজটা আপনি
-আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পেরেছি, মেলচেট, মেয়েটির মৃত্যুতে লাভবান হবার সম্ভাবনা কারো ছিল না। কেন না, দত্তক গ্রহণের প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা তখনো সম্পূর্ণ করা হয়নি।
–কিন্তু আপনার দিক থেকে তো আশঙ্কা
-না সেই সম্ভাবনা নেই। ডাক্তাররা যাই বলুক না কেন আমি তখনও টগবগে ঘোড়ার মতই শক্তিশালী তবে এব্যাপারেও আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। দশ দিন আগে একটা নতুন উইল করেছি আমি।
-নতুন উইল করেছেন। সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন হার্পার।
রুবি কীনের জন্য ট্রাস্টি করে পঞ্চাশ হাজার টাকা তাদের হাতে দিয়েছি।
–এ যে অনেক টাকা। হার্পার যেন সামনে পথ দেখতে পেলেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহের পরিচয়ের সূত্রে আপনি একজনকে এতটাকা দিচ্ছেন, এ খুবই আশ্চর্য।
–কারুর কিছু বলার নেই। এ টাকা আমার উপার্জন করা। কাজেই এ টাকা খরচ করার ব্যাপারে আমার পূর্ণ স্বাধীনতাই রয়েছে।
যাই হোক, এই ভয়ঙ্কর ঘটনা সম্পর্কে আমি সবকিছু জানতে চাই। আমি শুনেছি এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে একটা বাড়িতে রুবিকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে।
-হ্যাঁ, গ্যামিংটন হলে। কর্নেল ব্যান্ট্রির বাড়ি
মিঃ জেফারসন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন, ব্যান্ট্রি..আর্থার ব্যান্ট্রি? তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আমার পরিচিত। আমার ধারণা ছিল না তারা এই এলাকায় থাকেন। ব্যাপারটা
-কর্নেল ব্যান্ট্রি এই হোটেলেই গত সপ্তাহের মঙ্গলবারে নৈশভোজ সেরেছিলেন, আপনার নজরে পড়েনি? বললেন হার্পার।
মঙ্গলবার…না আমরা হার্ডেন হেড-এ গিয়েছিলাম। পথেই নৈশভোজ সারতে হয়েছিল।
রুবি কীন আপনার কাছে ব্যান্ট্রিদের সম্পর্কে কখনো উল্লেখ করেছিলেন?
–না, কখনও না। ব্যান্ট্রি এব্যাপারে কি বলেছেন?
–তিনি জানিয়েছেন মেয়েটিকে কখনও দেখেননি।
–গোটা ব্যাপারটাই কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে।
মিনিট দুই নীরবতার মধ্যে কাটল। পরে হার্পার বললেন। একাজ কে করে থাকতে পারে, এ সম্পর্কে আপনার কি কোন ধারণা আছে?
–সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ব্যাপার এটা আমার কাছে। এরকম কিছু ঘটতে পারে আমার কখনই মনে হয়নি।
–তার অতীত জীবনের পরিচিত কেউ
–না। তেমন কেউ থাকলে অবশ্যই আমাকে বলত। তাছাড়া তার নিয়মিত কোন ছেলে বন্ধুও ছিল না। তবে রুবীর পেছনে কেউ যদি ঘোরাঘুরি করে থাকে তার কথা যোসিই ভাল জানবে।
–সে বলছে, কেউ তেমন ছিল না।
এরপর আর দু-একটা কথা বলে হার্পার আর মেলচেট বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
কনওয়ে জেফারসন তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারক এডওয়ার্ডসকে ডাকলেন। ডাক শুনে সে পাশের কামরা থেকে সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকল।
বলুন স্যার।
–স্যার হেনরি ক্লিদারিংকে এখুনি যোগাযোগ কর। তিনি মেলবোর্ন অ্যাবাসে রয়েছেন। বলবে, জরুরী প্রয়োজন। যেন আজই এখানে আসেন।
.
০৮.
–পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড। খুনের একটা কারণ মনে হয় খুঁজে পাওয়া গেল স্যার। বললেন। সুপারিটেণ্ডেন্ট হার্পার।
-হ্যাঁ, তা গেছে। তবে সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখা দরকার, বললেন কর্নেল মেলচেট, গ্যাসকেট লোকটিকে আমার সুবিধার মনে হয়নি। তবে খুনটা সেই করেছে। এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়।
–ওদের দুজনের কেউই খুশি বলে মনে হল না আমরা তবে, অন্য এক সম্ভাবনার কথাই আমার মনে হচ্ছে।
রুবি কীনের সেই ছেলে বন্ধু?
–হ্যাঁ, স্যার। এখানে আসার আগে থেকেই হয়তো রুবি তাকে জানতো।
–কিন্তু রুবির দেহ কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরী ঘরে গেল কি করে?
–ধরুন নাচের শেষে রুবি তার সঙ্গেই গাড়িতে বাইরে গিয়েছিল। কোন বিষয়ে কথা কাটাকাটিতে মেজাজ হারিয়ে সে রুবিকে খুন করে বসে। সেই সময় তারা একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। লোকটি নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য রুবির দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছিল। গাড়িতে একটা বাটালি ছিল। সেটা দিয়ে জানালা খুলে
-তোমার কথা অসম্ভব বলে মনে হয় না। তবে তার আগে আরও একটা কাজ করার আছে।
রুরি কীনের ঘরে তদন্ত করে তার পরিচারিকার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন স্ল্যাক। মেলচেট তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
এমনি সময়ে জর্জ বার্টলেট ঘরে ঢুকল। সে দুজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাইল।
মেলচেট তরুণটিকে আগেই ভালচোখে দেখেননি। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন কি ব্যাপার–কি হয়েছে?
–আমার গাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না স্যার।
–মানে, আপনি বলতে চাইছেন আপনার গাড়ি চুরি গেছে? বললেন হার্পার।
কেমন কুঁকড়ে গেল বার্টলেট। দুপা পিছিয়ে গিয়ে সে ইতস্তত করে বলল, মানে…ইয়ে…ঘটনাটা সেরকমই…
–গাড়িটা শেষ কোথায় দেখেছিলেন আপনি? গতরাত্রে হোটেল চত্বরে রাখা ছিল এরকমই তো বলেছিলেন।
-হ্যাঁ। কিন্তু একটু বেরুবো ভেবে গিয়ে গাড়িটা সেখানে দেখতে পেলাম না।
–কি ধরনের গাড়ি?
–মিনোয়ান চোদ্দ। মধ্যাহ্নভোজের আগে গাড়িটা নিয়ে এসেছিলাম। বিকেলে একপাক ঘুরে আসব ভেবেছিলাম মানে…আর যাওয়া হয়নি…পরে নৈশভোজের পরেও বেরুবো ভালোম…কিন্তু গাড়িটা দেখতে পেলাম না।
–গাড়িটা সেখানেই ছিল?
–হ্যাঁ, সেটাই তো স্বাভাবিক।
হার্পার কর্নেল মেলচেটকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনার সঙ্গে আমি ওপরে দেখা করব স্যার। মিঃ বাৰ্টলেটের কথাগুলো লিখে নেবার জন্য একবার সার্জেন্ট হিগিনসকে বলে আসি।
–ঠিক আছে। বললেন মেলচেট।
ক্ষীণস্বরে ধন্যবাদ দেবার চেষ্টা করে বার্টলেট বিদায় নিল।
.
যোসেফাইন টার্নার আর রুবি কীন হোটেলের দোতলায় বারান্দার শেষ প্রান্তে ছোট্ট নোংরা একটা ঘরে থাকতো। ঘরটা হোটেলের পেছনের অংশে।
মেলচেট আর হার্পার উত্তরমুখো ঘরটায় ঢুকে বুঝতে পারলেন ঘরটার অবস্থান এমন জায়গায় যে এখান থেকে বাইরে বেরিয়ে যাবার সময় হোটেলের কারোরই নজরে পড়ার কথা নয়।
গতরাতের পর থেকে ঘরটা একইভাবে পড়েছিল। ইতিমধ্যে গ্লেনসায়ার পুলিস ঘরে আঙুলের ছাপ খুঁজে গেছে। ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল রুবি, যোসি আর দুজন পরিচারিকার হাতের ছাপ। এছাড়া কয়েকটা ছাপ পাওয়া গেছে রেমণ্ডস্টারের। সে জানিয়েছিল, রাতে নাচের সময় হলে রুবিকে খুঁজতে এ ঘরে এসেছিল।
ঘরের কোণের দিকে রাখা ছিল মেহগিনি কাঠের বিরাট একটা ডেস্ক। তার খোপে পাওয়া গেছে বেশ কিছু চিঠি। স্ল্যাক চিঠিগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বুঝতে পেরেছিলেন এগুলো কোন কাজে আসবে না।
চিঠিগুলোতে কয়েকটা নাম পাওয়া গেল–লিল, (প্যালেস দ্য ডান্সে থাকে), মিঃ ফাইণ্ডিসন, বার্নি, বুড়ো গ্রাউসার, অ্যাড প্রভৃতি। স্ল্যাক সবকটি নাম তার খাতায় লিখে নিলেন। এদের সকলের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে।
ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে রাখা ছিল একটা ফোমের গোলামী নাচের ফ্রক। রুবি এটাই পরেছিল সন্ধ্যার দিকে। মেঝের ওপরে পড়েছিল একজোড়া উঁচু হিলের জুতো। দেখেই বোঝা গিয়েছিল, অযত্নে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। সিল্কের দুটো মোজা রাখা ছিল মেঝের ওপর।
মেলচেটের মনে পড়ল, মৃতের পায়ে কোন মোজা ছিল না।
আলমারির পাল্লা খোলাই ছিল। ভেতরে সাজানো ছিল কিন্তু ঝলমলে সান্ধ্য পোশাক। নিচের র্যাকে সাজানো রয়েছে একসার জুতো।
রুবি খুব দ্রুত উপরে এসে জামাকাপড় বদলে আবার দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোথায় যাবার জন্য বেরিয়েছিল সে?
স্ল্যাক বললেন, পঙ্গু ভদ্রলোক রুবিকে যেরকম জেনেছিলেন, তাতে তার কোন ছেলে বন্ধু থাকতে পারে, সে সম্পর্কে কোন ধারণাই তার ছিল না। তাছাড়া যোসিও কোন অবাঞ্ছিত লোকের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে পড়তে দিতে রাজি ছিল না। এসব জেনেই সে তার কোন পুরনো বন্ধুকে আড়ালে রাখতে চেয়ে থাকতে পারে। রুবি তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য বেরিয়েছিল। আর সম্ভবতঃ দত্তকের ব্যাপারে মতভেদের জন্যই তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়।
স্ল্যাক নিজের বক্তব্য এমন অপ্রীতিকরভাবে জাহির করছিল যে মেলচেট খুবই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তবু নিজেকে সংযত রেখে তিনি বললেন, তাহলে তো রুবীর সেই বন্ধুর পরিচয় বার করা আমাদের মোটেই কষ্টকর হবে মনে হয় না।
ব্যাপারটা আমার হাতেই ছেড়ে দিন স্যার। আসল সত্য জানা যাবে প্যালেস দ্য ডান্সের ওই লিল বলে মেয়েটিকে জেরা করলেই–আমি ঠিক বুঝতে পারছি।
একটু থেমে স্ল্যাক আবার বললেন, নৃত্য শিল্পী ওই রেমণ্ড ছোকরার কাছ থেকেও কিছু সাহায্য পেতে পারেন স্যার। পরিচারিকাদের আমি ভালভাবেই জেরা করেছি। তারা কিছুই জানে না। আর ওই বার্টলেটকে আপনার কেমন মনে হয় স্যার?
–হ্যাঁ, ওই ছোকরার ওপর নজর রাখা ভাল। বললেন মেলচেট।
তারপর তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।
.
০৯.
দুটো কাউন্টির পুলিস মিলে মিশে কাজ আরম্ভ করেছে। সুপারিন্টেণ্ডেন্ট হার্পার জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব পেয়ে খুশি হয়েছেন।
নৃত্য শিল্পী রেমণ্ডস্টারকে তিনি আগে থেকেই জানতেন। সুদর্শন চেহারার দীর্ঘকায় ক্ষিপ্রগতি মানুষটির ব্যবহার খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। তিনি হোটেলে সকলেরই প্রিয়।
হাপারের প্রশ্নের জবাবে রেমণ্ডস্টার বললেন, রুবিকে আমি ভালভাবেই জানতাম। এখানে একমাসের ওপরে ছিল। খুবই ভাল স্বভাবের মেয়ে।
–তার ছেলে বন্ধুদের সম্পর্কে আমাকে বলুন। বললেন হাপার।
–এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। তবে জেফারসন পরিবারই তাকে প্রায় দখল করে রেখেছিল।
–আপনি জানতেন যে মিঃ জেফারসন রুবি কীনকে দত্তক নেবার ব্যবস্থা করেছিলেন?
–ওরেব্বাস। বুড়োর যদি তেমন ইচ্ছাই থাকতো তাহলে নিজের শ্রেণীর কাউকেই তো, নেওয়া ভাল ছিল।
–আর যোসি? সে জানত বলে মনে হয় আপনার?
যোসি কোন আঁচ পেলেও পেতে পারে। ও খুবই চালাক-চতুর মেয়ে।
-রুবির আগের জীবনের কোন বন্ধু কি এখানে তার সঙ্গে কখনো দেখা করতে আসছিল
–এরকম কারুর কথা জানি না।
–গত সন্ধ্যায় আপনি কি করছিলেন?
–আমরা দুজনে একসঙ্গে রাত সাড়ে দশটার নাচে অংশ নিয়েছিলাম।
–সে সময় তার মধ্যে কোন চঞ্চলতা নজরে পড়েছিল?
–তেমন কিছু চোখে পড়েনি। নাচের পরে কি হয়েছিল লক্ষ্য করিনি। তবে বলরুমে তাকে দেখিনি। আমাদের দ্বিতীয় নাচের সময় হয়ে আসছিল দেখে যোসির কাছে ওর খোঁজ করি। যোসি সেই সময় জেফারসনদের সঙ্গে ব্রিজ খেলছিল। রুবি নেই শুনে চমকে উঠেছিল সে। বেশ উদ্বিগ্নভাবে মিঃ জেফারসনের দিকে একবার তাকিয়েছিল। তারপর আমাকে নিয়ে যোসি রুবির ঘরে আসে।
–যোসি কিছু বলেছিল?
-ও খুবই রেগে উঠেছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল রুবির সঙ্গে কেউ ছিল কি না। তারপর নিজেই বলে উঠেছিল–সেই ফিল্মের লোকটার কাছে যায়নি তো?
–ফিল্মের লোক? কে তিনি? হার্পার উত্তেজিতস্বরে বলে উঠলেন।
–লোকটার নাম আমি জানি না। কালো চুল, হাবভাব নাটুকে। শুনেছি লোকটার ফিল্মের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। সে দু-একবার নৈশভোজে এসেছে। রুবির সঙ্গে নেচেও ছিল।
-তারপর?
–আমরা রুবির ঘরে গিয়ে তাকে দেখতে পেলাম না। তার নাচের পোশাক একটা চেয়ারের ওপরে পড়েছিল। রুবিকে না পেয়ে যোসি ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠল যদি সব গণ্ডগোল পাকিয়ে দেয় তাহলে সে রুবিকে ক্ষমা করবে না।
-তারপর আপনারা কি করলেন?
রুবির বদলে যাসিই আমার সঙ্গে নেচে ছিল। পরে সে আমাকে বলে, জেফারসনদের একটু বুঝিয়ে বলতে–আমি যতটা সম্ভব তাকে সাহায্য করি।
এরপর রেমণ্ডস্টারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন হার্পার। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট হিগিনস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হল।
–হেড কোয়ার্টার থেকে এই মাত্র আপনার জন্য খবর এসেছে স্যার। ভেনস খাদের কাছাকাছি–এখান থেকে প্রায় মাইল দুই দূরে একটা পোড়া গাড়ি নোকজন দেখতে পায়। গাড়ির ভেতরে ঝলসে যাওয়া একটা দেহও রয়েছে।
হার্পার উত্তেজিত ভাবে নড়েচড়ে বসলেন। বলে উঠলন, কি আরম্ভ হয়েছে বল তো? গাড়ির নম্বরটা জানা গেছে?
-না স্যার। ইঞ্জিনের নম্বর মিনোয়ান ১৪ বলেই অনেকে মনে করছে।
.
১০.
স্যার হেনরি ক্লিদারিং মেট্রোপলিটন পুলিসের কমিশনার। সম্প্রতি তিনি অবসর নিয়েছেন। কনওয়ে জেফারসনের পুরনো বন্ধু তিনি। তাই জরুরী তলব পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাজেস্টিক হোটেলে এসে পৌঁছলেন।
লাউঞ্জ পার হয়ে যাবার সময় উপস্থিত অতিথিদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন।
মিঃ জেফারসন বন্ধুকে দেখে অভ্যর্থনা করে বসালেন। তারপর সরাসরি প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন।
–একটা খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছি হেনরি, তার সঙ্গে তোমার বন্ধু সেই ব্যান্ট্রিরাও।
আর্থার আর ডলি ব্যান্ট্রি? ব্যাপারটা খুলে বল।
এরপর জেফারসন সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। সব শুনে ক্লিদারিং চিন্তিত হলেন।
–আমাকে এব্যাপারে কি করতে বলছ? জানতে চাইলেন তিনি।
–ব্র্যাডফোর্ডশায়ারের চিফ কনস্টেবল মেলচেট কেসটা দেখছে। কোথাও গিয়ে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাপারটা কিভাবে পরিষ্কার জানা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্লিদারিং-এর মনে পড়ে গেল লাউঞ্জ পেরিয়ে আসার সময় একটা পরিচিত মুখ তার নজরে পড়েছিল। তিনি বন্ধুকে বললেন, আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত। বুঝতেই তো পারছ, বেসরকারী গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতে ততটা স্বচ্ছন্দবোধ করব না। তুমি জানতে চাও, মেয়েটিকে কে খুন করেছে, এই তো?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই।
–এসম্পর্কে তোমার নিজের কোন ধারণা আছে?
–কিছু মাত্র না।
-ঠিক আছে, শোন। আসার পথে লাউঞ্জে উপস্থিত এমন একজনকে দেখে এলাম। এ ধরনের রহস্য সমাধানে যার দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
–তুমি কার কথা বলছ?
–তার নাম মিস মারপল। একমাইল দূরে সেন্ট মেরী মিড গ্রামে থাকেন। গ্যামিংটন থেকে দূরত্ব আধমাইল। তিনি ব্যান্ট্রিদেরও বন্ধু। কোন অপরাধের তদন্তের ব্যাপারে তার চেয়ে যোগ্যব্যক্তি আর কেউ নেই।
-কিন্তু রুবির মত মেয়ের বিষয়ে তিনি কতটুকু জানবেন?
–আমার মনে হয় তার ধারণা নিশ্চয়ই থাকবে। বললেন ক্লিদারিং।
.
স্যার হেনরিকে দেখে মিস মারপল উজ্জ্বল আনন্দে অভিবাদন জানালেন।
চেয়ার টেনে পাশে বসে দু-চারটে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পরে মিস মারপল বললেন-আপনি নিশ্চয়ই সেই ভয়ানক ঘটনার কথা শুনেছেন?
-হ্যাঁ। শুনেছি।
–মিসেস ব্যান্ট্রিও এসেছেন আমার সঙ্গে।
–ওহো। ওর স্বামীও আছেন? আপনাকে তাহলে ইতিমধ্যেই ফিল্ডে নামিয়ে দিয়েছেন?
–একরকম তাই বলতে পারেন। বললেন মিস মারপল।
স্যার হেনরি এরপর সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিলেন। মিস মারপল মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলেন। পরে আক্ষেপের সুরে বললেন, খুবই দুঃখজনক কাহিনী। কিন্তু ওই মেয়েটার ওপরে হঠাৎ তিনি এমন স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠলেন কেন? কোন বিশেষ
–সম্ভবতঃ তেমন কিছু নয়। বললেন স্যার হেনরি। তিনি চাইছিলেন এমন একটি ছোট সুন্দর মেয়ে যে তারই মেয়ের স্থান নিতে পারে, আর মেয়েটি সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে নিজেকে যোগ্য করার চেষ্টা করে চলেছিল।
–সবই বুঝতে পারছি। রুবি কীনের মাসতুতো বোনকে আজ সকালেই গ্যামিংটন হলে দেখেছি আমি। বেশ ভাল মেজাজের উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণী বলেই মনে হয়েছে তাকে। কিন্তু যাই হোক, আমার ধারণা জটিলতা গড়ে উঠেছিল মিঃ জেফারসনের নিজের ঘরেই।
-আপনি কি বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।
দেখুন, ওরা তিনজন শোকার্ত মানুষ একই বাড়িতে বাস করে চলেছেন। তাদের মধ্যে যোগসূত্রও একটি বিয়োগান্ত ঘটনা। তবু, দেখুন, সময় হল সবচেয়ে বড় আঘাত নিবারক। এই অবস্থায় মিঃ গ্যাসকেল এবং মিসেস জেফারসন হয়তো কিছু অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। তাদের দুজনেরই বয়স কম। আর এই ধরনের কিছু উপলব্ধি করে মিঃ জেফারসনও কিছু অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তার পক্ষে নিজেকে অবহেলিত ভাবা অবাস্তব মনে করি না। সেকারণেই আমার মনে হয়, এই ঘটনার মধ্যে এমন কোন এক সম্ভাবনা রয়েছে যে এই অপরাধের সমাধান হয়তো কোনদিনই সম্ভব হবে না।
তবু আমি চাই সত্য প্রকাশ হওয়া দরকার। মৃতদেহটা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরী ঘরে পাওয়া গিয়েছিল। তিনি অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। ইতিমধ্যেই চারপাশের গুজবের প্রভাব তার ওপর পড়তে শুরু করেছে। তাই অবিলম্বে সত্য প্রকাশ হওয়া দরকার। আর এই জন্যেই আমি ডলির সঙ্গে এখানে আসতে রাজি হয়েছি।
মৃতদেহটা ওদের বাড়িতে কেন পাওয়া গেল, এসম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার কোন ব্যাখ্যা আছে?
-আমার ধারণা একটা গভীর গোপন পরিকল্পনা গড়ে তোলা হয়েছিল। আর পরিকল্পনা মাঝ পথে ভেস্তে গিয়েছিল।
স্যার হেনরি অবাক হলেন। তিনি কয়েক মুহূর্ত মিস মারপলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
–পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কেন?
–অদ্ভুত শোনালেও এমন ঘটনা কখনও কখনও ঘটে–মানুষের ভুলপ্রবণতাই যার কারণ হয়। ওইতো মিসেস ব্যান্ট্রি এসে গেছেন।
২. মিসেস ব্যান্ট্রি অ্যাডিলেড
১১.
মিসেস ব্যান্ট্রি অ্যাডিলেড জেফারসনের সঙ্গে ছিলেন। তিনি এসে স্যার হেনরি ও মিস মারপলের সঙ্গে মিলিত হলেন।
মার্ক গ্যাসকেল বারান্দায় কোণের দিকে একাই বসেছিলেন। চারজনে বেরিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিলেন।
মিস মারপল ছাড়া অপরাপর সকলেই পুরনো বন্ধু। কাজেই মার্ক গ্যাসকেল আর এডিলেড জেফারসন মিস মারপলের পরিচয় বন্ধুদের কাছ থেকেই জানতে পারলেন।
ব্যান্ট্রি বললেন, মিস মারপল অপরাধের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। তিনি এব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে আগ্রহী।
আমার শ্বশুরমশায় পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড ওই হাবাগোবা মেয়েটাকে দিতে চেয়েছিলেন, ভাবতে পারেন? মার্ক গ্যাসকেল বললেন। অ্যাডি আর আমি দুজনেই মেয়েটার মৃত্যু কামনা করেছিলাম।
স্যার হেনরি বললেন, ব্যাপারটা জানতে পেরে আপনারা কনওয়েকে কিছু জানাননি?
–আমাদের আপত্তি জানাবার অধিকার কোথায়? টাকাটা ওর। তবে ওই রুবিকে আমরা ভাল চোখে দেখতাম না।
–সবকিছুর জন্য যোসিই দায়ী। বললেন মার্ক, ওই রুবিকে এখানে নিয়ে এসেছিল। অবশ্য এটাও ঠিক, আমার স্ত্রী রোজামণ্ডের সঙ্গে ওর যেন কি রকম মিল ছিল। আর এজন্যই ওর প্রতি বুড়োর টান জন্মেছিল।
কথা বলতে বলতে মার্ক লাউঞ্জের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, দেখ অ্যাডি কে এসেছে।
মিসেস জেফারসন ঘুরে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পরে এগিয়ে গেলেন দীর্ঘকায় মাঝবয়সী এক ভদ্রলোকের দিকে।
–হুগো ম্যাকলীন মনে হচ্ছে না? মিসেস ব্যান্ট্রি বললেন।
–অবশ্যই হুগো ম্যাকলীন ওরফে উইলিয়ম ডবিন। তার আশা অ্যাডি একদিন ওকে বিয়ে করবে। অ্যাডি আজই বলেছিল তাকে টেলিফোন করবে।
এই সময় এডওয়ার্ড এগিয়ে এসে মার্কের পাশে দাঁড়িয়ে জানাল, মিঃ জেফারসন আপনাকে এখুনি একবার ডেকেছেন।
মার্ক উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। তারপর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
–খুবই হীনমনা মানুষ, বললেন মিস মারপল, পুরুষ মানুষ হিসেবে আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই কিন্তু মগজে বুদ্ধির বড় অভাব রয়েছে।
এই সময় দেখা গেল সাদা ফ্ল্যানেলের পোশাকপরা এক সুপুরুষ তরুণ বারান্দায় উঠে এল। অ্যাডিলেড আর হুগো ম্যাকলীনের দিকে তাকাল।
স্যার হেনরী বললেন, ইনি হলেন রেমণ্ডস্টার, রুবী কীনের নাচের জুড়ি। যোগসূত্র এর সঙ্গেও কিছুটা রয়েছে। ভাল টেনিস খেলোয়াড়।
মিস মারপল সাগ্রহে তার দিকে তাকালেন।
এই সময় বাচ্চা কারমেলি বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে করতে তাদের দিকে এগিয়ে এল। স্যার হেনরির দিকে তাকিয়ে সে বলল, আপনি নিশ্চয়ই একজন গোয়েন্দা। ওই সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে দেখেছিলাম। জানেন, আমি খুঁজছি, খুনের যদি কোন সূত্র পাওয়া যায়।
–কে খুন করেছে জানতে পেরেছ নাকি? মিসেস ব্যান্ট্রি আগ্রহের সঙ্গে তার দিকে ঝুঁকে বসলেন।
–একটা স্মৃতিচিহ্ন পেয়েছি।
বলতে বলতে পিটার পকেট থেকে একটা দেশলাইয়ের বাক্স বার করে সেটা খুলে দেখাল।
–দেখছেন একটা নখের টুকরো–সেই রুবি মেয়েটার নখ। একটা দারুণ স্মৃতিচিহ্ন, তাই?
–এটা কোথায় পেয়েছ? মিস মারপল বললেন।
রুবির নখ যোসির শালে আটকে গিয়েছিল। তাই ওটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। মা ওটা কেটে দিয়েছিলেন। আমাকে নখের টুকরোটা দিয়ে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিতে বলেছিলেন। আর একটা জিনিসও পেয়েছি।
একটা খাম থেকে অনেকটা বাদামী রঙের ফিতের মত জিনিস বার করে দেখলে সে।
–এটা হল জর্জ বার্টলেট নামের লোকটার জুতোর ফিতে। দরজার সামনে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়েছি–তুচ্ছ জিনিসও পরে অনেক কথা বলতে পারে।
–কি কাজে লাগতে পারে মনে কর তুমি? জানতে চাইলেন মিস মারপল।
–ওই তো শেষ বার রুবীকে দেখেছিল। লোকটার চাল-চলনও কেমন সন্দেহজনক। আরে ওই তো হুগো কাকা-মা ঝামেলায় পড়লেই তাকে ডেকে পাঠান। আজও খবর দিয়েছিলেন। হাই যোসি”..
বারান্দা পার হয়ে আসছিল যোসেফাইন টার্নার। মিসেস ব্যান্ট্রি আর মিস মারপলকে দেখে কেমন চমকে গেল।
–কেমন আছেন মিস টার্নার? বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি, আমরা একটু গোয়েন্দাগিরি করতে এলাম এখানে।
–আশা করি কিছু মনে করবেন না। আপনাকে খোলাখুলি একটা প্রশ্ন করতে চাই।
নিশ্চয়ই করবেন। কিছুটা অখুশি হয়েই বলল যোসি।
-ওই ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কি মিসেস জেফারসন ও মিঃ গ্যাসকেলের কোন তিক্ততা হয়েছিল? ওই খুনের ব্যাপারটা বলছি না আমি।
–ব্যাপারটার জন্য তারা আমাকেই দায়ী করছেন রুবিকে আমিই তো এনেছিলাম। কিন্তু এরকম কিছু যে হতে পারে আদৌ আমার মনে হয়নি।
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা আপনার পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর। বললেন মিস মারপল।
–এটা ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যায় বলুন। ভাগ্যের সহায়তা যে কেউই পেতে পারে।
কথা শেষ করে প্রত্যেকের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে গটগট করে হোটেলে ঢুকে গেল মিস টার্নার।
-নাঃ, ও খুব করেছে বলে মনে হয় না। বলে উঠল পিটার।
–আমি ভাবছি নখটা নিয়ে, বললেন মিস মারপল।
–নখ? আশ্চর্য হলেন মিঃ হেনরি।
–ওর নখ খুব ছোট করে কাটা ছিল। জেনও তাই বলেছে। বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি। তবে এ ধরনের মেয়েদের তো বড় নখই রাখতে দেখি।
–ওর ঘরে আরও কাটা নখের টুকরো পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, একটা নখ ভেঙ্গে যাওয়ায় অন্যগুলোও সমান করে কেটে নিয়েছিল। বললেন মিস মারপল।
-সুপারিন্টেডেন্ট হার্পারকে প্রশ্ন করলে জানা যাবে। তিনি তো আবার একটা অ্যাকসিডেন্টের তদন্ত করতে চলে গেছেন। বললেন স্যার হেনরী।
–অ্যাকসিডেন্ট? চমকে উঠলেন মিস মারপল।
–হ্যাঁ, একটা খনির খাদে জ্বলন্ত একটা গাড়ি দেখা গেছে।
–গাড়িতে কেউ ছিল?
–আশঙ্কা হচ্ছে ছিল।
–আমার ধারণা দেহটা সেই গার্ল গাইডের–ওর নাম পামেলা রীভস।
–আশ্চর্য কাণ্ড। আপনি একথা বলছেন কি করে?
রেডিওতে শুনেছিলাম, গতরাত থেকে মেয়েটা নিরুদ্দেশ। ওর বাড়ি কাছেই ডেনলে ভেলে। তাকে শেষবার দেখা গিয়েছিল ডেনবারি ডাউনে–গার্ল গাইড র্যালিতে। ডেনমাউথ হয়েই তার বাড়ি ফেরার কথা। আমার ধারণা মেয়েটা এমন কিছু দেখে বা শুনে থাকবে যা খুনীর কাছে বিপজ্জনক ছিল। সেকারণেই তাকে সরানো দরকার হয়ে পড়েছিল। যোগসূত্রটা খুবই পরিষ্কার।
স্যার হেনরি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে বলছেন, এটা দু-নম্বর খুন?
–হ্যাঁ। তৃতীয় খুনের ঘটনা ঘটলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।
–তৃতীয় একটা খুনও হতে পারে বলছেন?
–আমার মনে হয় খুবই সম্ভব।
–কে খুন হতে পারে, তাও কি আপনি জানেন মনে করেন?
–জানি বইকি। বললেন মিস মারপল।
.
১২.
সুপারিন্টেন্ডেন্ট হার্পার মাচ বেনহ্যামে কর্নেল মেলচেটের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছেন।
-রুবি কীন আর পামেলা রীভস এই দুটো মৃত্যু আমাদের এখন মোকাবেলা করতে হবে। বললেন মেলচেট। একটা জুতো পোড়েনি, সেটা দেখেই ওকে সনাক্ত করা সম্ভব হল। নৃশংস, ভয়ঙ্কর কাজ।
একটু থেমে আবার বললেন মেলচেট, ডাঃ হেডক জানিয়েছেন গাড়িতে আগুন লাগার আগেই মারা গিয়েছিল মেয়েটা। তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল সম্ভবত।
শ্বাসরোধ করেও মারা যেতে পারে।
-এখন আমাদের দেখতে হবে দুটো খুনের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা। বললেন মেলচেট।
মেয়েটা ডেনবারি ডাউনসে গার্ল গাইড র্যালিতে যোগ দিয়েছিল। তার সঙ্গীরা মেডচেষ্টারের বাসে উঠে গিয়েছিল। একজন সঙ্গী জানিয়েছে পামেলা রীভস ডলওয়ার্থে যাওয়ার জন্য ডেনমাউথে যাবে। সর্টকাট করবার জন্যই সে দুটো মাঠের মধ্য দিয়ে গলি আর ফুটপাথ ধরে এগিয়েছিল। ওই গলিটা ডেনমাউথে ম্যাজেস্টিক হোটেলের পশ্চিম দিক ঘেঁষে চলে গেছে। সম্ভবত ওই পথেই সে কিছু দেখে থাকবে যা রুবি কীনের সঙ্গে জড়িত। ফলে নিরপরাধ স্কুলের মেয়েটাকে খুন হতে হয়েছে।
-রুবি কীনের সম্পর্কিত যদি কিছু ঘটে থাকে তা ঘটেছিল রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। এতরাতে স্কুলের মেয়েটার ম্যাজেস্টিক হোটেলের কাছে যাবার কি কারণ থাকতে পারে?
–মিস মারপল কিন্তু ঘটনা শুনেই দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন গাড়িতে গার্ল গাইড মেয়েটিরই দেহ পাওয়া গেছে কিনা। অসম্ভব বুদ্ধিমতী মহিলা। বললেন হাপার।
মিস মারপল এরকম কাজ আগেও অনেকবার করেছেন। বললেন মেলচেট।
হুগো ম্যাকলিন আর অ্যাডিলেড জেফারসন সমুদ্রের দিকের পথ ধরে এগিয়ে গেছে।
হোটেলের বারান্দায় বসেছিলেন মিস মারপল আর মিসেস ব্যান্ট্রি।
–অ্যাডিলেড জেফারসন এতক্ষণ আমাকে বলছিল তার স্বামী সব টাকাপয়সা খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মিঃ জেফারসনকে তারা কিছুই বুঝতে দেয়নি। বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
-আর কি বলছিল। জানতে চাইলেন মিস মারপল।
–বলছিলেন হুগো ম্যাকলিন তাকে বিয়ে করতে চায়।
–হ্যাঁ বুঝতে পারছি। ওর হাবভাব দেখেই মিঃ জেফারসেন বুঝতে পেরেছিলেন। ব্যাপারটা তার পছন্দ না। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিল রুবি কীন।
.
স্যার হেনরি ক্লিদারিং ঠিক সেই মুহূর্তেই ম্যাককে বলছিলেন, তুমি বরাবরই একজন জুয়াড়ি। এই করেই ডুবেছ।
-জুয়াড়ি হতে পারি তবে খুনী নই। আমি কাউকে গলা টিপে হত্যা করতে পারি না। তবু জানি পুলিসের চোখে আমিই এক নম্বর আসামী। তবে আঘাতটা মিঃ জেফারসনের ভালই লেগেছে। অন্ততঃ আসল কথাটা জানার চেয়ে ভাল।
চমকে উঠলেন স্যার হেনরি ক্লিদারিং। বললেন, আসল কথাটা জানা–একথার অর্থ কি?
-আমার দৃঢ় বিশ্বাস রুবি কীন গত রাতে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। আমার শ্বশুর তার এই ছলনা জানতে পারলে সহ্য করতে পারতেন না। তিনি মেয়েটিকে নিষ্পাপ নিরীহ ভেবে নিয়েছেন। আমার আর অ্যাডির যে এই বন্দিজীবন, বইতে পারছিলাম না আমরা তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই রুবি কীনকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন।
.
১৩.
ডেনহ্যামের অতি পরিচিত ডাক্তার মিঃ মেটকাফ। তিনি কনওয়ে জেফারসনের চিকিৎসকও। সুপারিন্টেন্টে হার্পার তার সঙ্গে দেখা করলেন মিঃ জেফারসনের শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানবার জন্য।
ডাঃ মেটকাফ জানালেন; মিঃ জেফারসনের হৃদপিণ্ড, ফুসফুস্; রক্তচাপ–সবই অত্যন্ত চাপের মধ্যে রয়ে গেছে। মেরুদণ্ডও ক্ষতিগ্রস্ত। কোন রকম পরিশ্রম বা আঘাত বা আচমকা ভয়–এ ধরনের কিছু হলে তার মৃত্যু ঘটে যাওয়া সম্ভব।
ডাঃ মেটকাফ আরও জানালেন যে আগে মিঃ জেফারসন খুব শক্তিমান পুরুষ ছিলেন। এখনও তার দুই হাত ও কাঁধে যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে।
হার্পার বললেন, আপনার কথার সূত্র ধরে তাহলে ধরে নিতে পারি যে কেউ হয়তো ধরে নিয়ে থাকতে পারে যে মেয়েটির মৃত্যু সংবাদে মানসিক আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু ঘটতে পারে।
–হ্যাঁ, সেটা সহজেই হতে পারে। বললেন ডাঃ মেটকাফ।
দেখা যাক
বলে বিদায় নিলেন হার্পার।
ইতিমধ্যে হাপার কয়েকজন গার্ল গাইডকে চিহ্নিত করেছিলেন। তারা পামেলা রীভসের ঘনিষ্ঠ ছিল। বন্ধুর ব্যাপারে কোন কথা তাদের জানা থাকতে পারে সন্দেহ করা হচ্ছিল।
পথ চলতে চলতে আলোচনা করছিলেন হার্পার আর মিঃ ক্লিদারিং।
–মিস মারপলকে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ জানাব। তিনি মনে হয় এ ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন।
–মনে হয় আপনি ঠিকই ভেবেছেন। ওঁর নজর খুব তীক্ষ্ণ একথা ঠিক।
-আর একটা কথা স্যার। আমি চাইছিলাম আপনি যদি একবার মিঃ জেফারসনের ব্যক্তিগত পরিচারক এডওয়ার্ডকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখেন।
তার কাছে কি পাওয়া যাবে বলে ভাবছেন?
–সে এই ঘটনা নিয়ে কি ভাবছে, পরিবারের সকলের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক কেমন, রুবি কীন সম্পর্কে তার ধারণা কি রকম–এসব ভেতরের কথা যেমন খুশি প্রশ্ন করে আপনি জেনে নিতে পারেন। আপনি জেফারসনের বন্ধু, আপনাকে সে মন খুলে জানাতে ভরসা পাবে।
দুজনে কথা বলতে বলতে মিস মারপলের টেবিলে গিয়ে বসলেন। তিনি খুশি হয়ে স্বাগত জানালেন। হার্পার প্রস্তাব দিতেই তিনি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হলেন।
স্যার হেনরি বললেন, ওহো, আপনাকে বলা হয়নি মিস মারপল-হার্পার জানিয়েছেন রুবি কীনের বাজে কাগজের ঝুড়িতে কাটা নখের কিছু টুকরো পাওয়া গেছে।
খুশি হয়ে মিস মারপল বললেন, তাহলে যা ভেবেছি তাই
-কি ভেবেছিলেন আপনি মিস মারপল? সুপারিন্টেন্টে হার্পার নিতে চাইলেন।
–সাধারণতঃ যেসব মেয়ে কড়া রকমের মেকআপ করে তাদের নখ বড় থাকে। রুবি কীনেরও বড় নখ ছিল। একটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেই কারণেই সে সব নখ সমান করে নেবার জন্য বাকিগুলোও কেটে ফেলে। এটাই স্যার হেনরিকে দেখতে বলেছিলাম।
–তাহলে এবিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কি। জানতে চাইলেন হাপার।
–আপাতত কোন ব্যাখ্যাই নেই। তবে এটা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।
.
১৪.
রেমণ্ডস্টারের টেনিস প্রশিক্ষণ পর্ব চলছিল তারের জালে ঘেরা জায়গাটায়।
শক্তসমর্থ মাঝবয়সী এক মহিলা রেমণ্ডের কাছে তালিম নিচ্ছিলেন। এবারে হোটেলের দিকে চলে গেলেন। বেঞ্চে তিনজন দর্শক বসেছিল।
কাজটা বেশ একঘেয়ে। বললেন মিস মারপল।
স্যার হেনরি রেমণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কোন জবাব দিলেন না। সুপারিন্টেন্টে হার্পার উঠে পড়লেন। বললেন, মিস মারপল, আমি এখন উঠি, আপনাকে একঘণ্টা পরে ডেকে নেব।
–বেশ, আমি তৈরি থাকব।
হার্পার বিদায় নিলে রেমণ্ড সামনে এসে বেঞ্চিতে বসল।
রেমণ্ড একজন নৃত্যশিল্পী আর পেশাদার টেনিস কোচ। তাকে লক্ষ্য করে স্যার হেনরি খুশি হতে পারলেন না।
র্যামন…রেমণ্ড…আপনার আসল নামটা কি? আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন স্যার হেনরি।
র্যামন আমার পেশাদারী নাম। যদিও নামটা দিয়েছিলেন আমার এক ঠাকুমা। তবে প্রথম নাম টমাস, বলে স্যার হেনরির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো ডেভনসায়ারের মানুষ, নাম টমাস, বলে স্যার হেনরির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো ডেভনসায়ারের মানুষ, তাই না স্যার? স্টেন? আমার আত্মীয়স্বজনরাও ওই দিকেই থাকতেন, আলসম্পটনে।
–আপনি কি আলসম্পটনের স্টারেদের কেউ? এ তো আমার জানা ছিল না।
–তিনশ বছর ওখানেই আমাদের বাস। এখন অবশ্য আমার বড়ভাই নিউইয়র্কবাসী। আমাদের বাকিরা সবাই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছি।
একটু থেমে আবার বলল, আমি নাচ আর টেনিস খেলাটা জানতাম। সেই কাজই নিলাম রিভিয়েরাতে এক হোটেলে। সেখান থেকে চলে এলাম এখানে। মেয়েদের টেনিস খেলা শেখাতে হয় তার সঙ্গে বড় মানুষের সুখী মেয়েদের সঙ্গে নাচা, এই হল জীবন।
–আপনার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেলাম। বললেন স্যার হেনরি, একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।
রুবি কীন সম্পর্কে? দুঃখিত, এ ব্যাপারে সাহায্য করার মত কিছুই আমি মেয়েটার সম্পর্কে জানি না। ব্যাপারটাতে কোন মোটিভ আছে বলে আমার মনে হয় না।
–দুজন মানুষের মোটিভ ছিল, বললেন মিস মারপল, রুবি কীনের মৃত্যুতে সম্ভবতঃ লাভবান হচ্ছেন মিসেস জেফারসন আর মিঃ গ্যাসকেল–প্রায় পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড।
–না, না, এ অবিশ্বাস্য। এ ঘটনায় ওদের হাত থাকতে পারে না।
–টাকা সবই সম্ভব করে তুলতে পারে। বললেন মিস মারপল।
ঠিক এই সময়ে অ্যাডিলেড জেফারসন সেখানে উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে ছিলেন হুগো ম্যাকলীন।
দেরি হয়ে গেল, বলে ক্ষমা চেয়ে টেনিস কোর্টের দিকে চলে গেলেন মিস জেফারসন। তাকে অনুসরণ করল রেমণ্ড। হুগো ম্যাকলিন বেঞ্চে বসে পড়লেন। তার দৃষ্টি টেনিস কোর্টে খেলায় ব্যস্ত দুটি সাদা মূর্তির দিকে।
-এই রেমণ্ড লোকটা কে? পেশাদারেরা কেমন অদ্ভুত হয়। বললেন হুগো।
–ও হল ডেভনসায়ার স্টারেদের বংশধর। স্যার হেনরি বললেন।
-সত্যিই তাই? হুগো ম্যাকলীন অখুশিই হলেন বোঝা গেল। অ্যাডি আমাকে কেন যে ডেকে পাঠাল বুঝতে পারছি না।
–আপনাকে কখন ডেকে পাঠিয়েছে? সাগ্রহে জানতে চাইলেন স্যার হেনরি।
–যখন এসব ঘটছিল–টেলিগ্রাম পেলাম গলফ খেলে আসার পরেই। সঙ্গে সঙ্গে চলে আসি।
–আপনাদের ডেনবারি হেড শুনেছি খুব ভাল জায়গা। খরচও কম। বললেন মিস মারপল, একদিন যেতে হবে ওখানে।
-যাবেন–ইয়ে…হ্যাঁ, বেশ তো।
বলে হুগো ম্যাকলীন উঠে পড়লেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
–আমিও চলি। অনেক কাজ রয়েছে। এই তো, মিসেস ব্যান্ট্রি আসছেন আপনাকে সঙ্গ দেবেন।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পৌঁছলেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
–পরিচারিকাদের সঙ্গে কথা বললাম। কিন্তু কিছুই জানতে পেলাম না। মেয়েটা যে বাইরের কারো সঙ্গে প্রেম করত, হোটেলের কেউই সেটা জানতে পারেনি।
ততক্ষণে টেনিস কোর্টের দিকে চোখ পড়েছে।
–অ্যাডি টেনিস ভালই খেলে দেখছি।
–মিঃ জেফারসন মারা গেলে উনি বেশ পয়সাওয়ালা মহিলা হয়ে যাবেন। বললেন মিস মারপল।
–জেন, তুমি এখনো রহস্যের কোন কিনারা করতে পারলে না। ভেবেছিলাম তুমি সঙ্গে সঙ্গেই সব বুঝতে পারবে। মিসেস ব্যান্ট্রির গলায় অনুযোগ ঝরে পড়ল।
-প্রথমে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।
–রুবি কীনকে কে খুন করেছে, এখন বুঝতে পেরেছ বলছ?
–হ্যাঁ, তা জানি।
–সে কে, জেন?
–তোমাকে কেবল ইঙ্গিত দিতে পারি। তোমার পেটে কথা থাকে না ডলি।
–কিন্তু আমি যে এটা জানার জন্যেই ডেনমাউথে এসেছি জেন। তাকে একা বাড়িতে রেখে আসতে হয়েছে।
–আমি তা জানি ডলি। আর তোমার মত আমিও একই কারণে এখানে এসেছি।
.
১৫.
হোটেলের একটা নিরিবিলি কামরা। এডওয়ার্ডস সমসম্ভ্রমে স্যার হেনরি ক্লিদারিং-এর বক্তব্য শুনছিল।
-তুমি তো জান এডওয়ার্ডস, এখানে দুর্ঘটনাটা ঘটে যাবার পরে তোমার মনিব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এই রহস্য ভেদ করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
আমি আগে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পুলিস কমিশনার ছিলাম। আমার বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে আছেন তিনি।
মৃত মেয়েটির মৃত্যু সম্পর্কে আসল সূত্রগুলো তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ। মেয়েটিকে মিঃ জেফারসন দত্তক নেবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ওরা দুজন–মিঃ গ্যাসকেল আর মিসেস জেফারসন–এদের ঘোরতর আপত্তি ছিল ব্যাপারটাতে। এখন আমার ধারণা ভেতরের খবরাখবর যা তোমারই তা জানা সম্ভব। একজন পুলিস হিসেবে নয়, তোমার মনিবের হিতাকাঙ্ক্ষী একজন বন্ধু হিসেবে আমি এসব জানতে চাইছি। তুমি আমাকে নির্ভয়ে সব বল।
এডওয়ার্ডস দু মিনিট চুপ করে থাকল। পরে বলল, আমি অনেক দিন মিঃ জেফারসনের কাছে রয়েছি। তার ভালমন্দ দুটো দিকই আমার জানা আছে। আমি দেখেছি সবচেয়ে যেটা পছন্দ করতে পারেন না, তা হল তাকে ঠকানোর চেষ্টা।
–কোন বিশেষ কারণে একথা বলছ?
–হ্যাঁ স্যার। যে মেয়েটাকে মিঃ জেফারসন দত্তক নেবেন মনস্থ করেছিলেন, সে তার যোগ্য ছিল না। মিঃ জেফারসনের প্রতি তার কণা মাত্র টান ছিল না।
মিসেস জেফারসনও যথেষ্ট সহানুভূতি পেয়ে এসেছেন তার কাছ থেকে, কিন্তু তিনিও গত গ্রীষ্মকাল থেকে কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করেছেন।
মিঃ জেফারসন সেটা লক্ষ্য করে মনে খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। আর মিঃ মার্ককেও তিনি কখনও ভাল চোখে দেখেননি।
–তা সত্ত্বেও তিনি তাকে কাছে রেখেছিলেন?
-হ্যাঁ স্যার। সবই ওই মেয়ে রোজামণ্ডের জন্য। মেয়েকে তিনি চোখের মণির মত ভালবাসতেন।
–মিসেস জেফারসন যদি বিয়ে করতেন?
–তিনি সেটাও মেনে নিতে পারতেন না। কেবল ওই মেয়েটির প্রতি একটু টান অনুভব করতেন।
–তুমি তাহলে বলছ, রুবি কীন খুবই মতলববাজ ছিল?
–আসলে অল্প বয়স। তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না।
–আচ্ছা মেয়েটি সম্পর্কে পরিবারে কোন রকম আলোচনা হয়েছিল?
–কোন আলোচনা হত না। মিঃ জেফারসন তার মনোভাব পরিষ্কার ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।
–মেয়েটির মনোভাব কেমন ছিল?
–আমার মনে হয়েছিল সে খুবই খুশি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে স্যার।
বেশ তো। বল শুনি।
–এর মধ্যে তেমন কিছু সম্ভবত নেই। একদিন মেয়েটি তার ব্যাগ খুলবার সময় একটা ফটো পড়ে গিয়েছিল। ফটোটা একজন তরুণের ছিল স্যার। মিঃ জেফারসন খুবই বুদ্ধিমান। তিনি বেশ রেগে গিয়েছিলেন মেয়েটির কৈফিয়ত শুনে। সে বলেছিল, তরুণটিকে চেনে না। পরে বলেছিল, মাঝে মাঝে এখানে আসে; তার সঙ্গে দু-একবার নেচেছে। নামধাম জানে না। মিঃ জেফারসন কড়া দৃষ্টিতে কয়েকবার তাকিয়ে তাকে কেবল দেখে নিয়েছিলেন। তাছাড়া সে কোথাও গেলে, তিনি আমার কাছে জানতে চাইতেন, সে কোথায় গেল।
স্যার হেনরি মাথা দোলালেন। তিনি আরও কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু এডওয়ার্ডস তেমন কিছু বলতে পারল না।
.
ডেনমাউথের পুলিস দপ্তরে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হার্পার কয়েকটি মেয়ের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলেন।
প্রত্যেকেই প্রায় একই কথা চাইছিল, পামেলা রীভস তাদের কাছে বলেছিল সে উলওয়ার্থ যাচ্ছে আর পরের বাসে করে ফিরবে।
ঘরের এককোণে অত্যন্ত সাধারণ হাবভাব নিয়ে বসেছিলেন মিস মারপল। কেউই তাকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করেনি।
শেষ মেয়েটিকে বিদায় দেবার পর মিস মারপল, ঘর্মাক্ত হাপারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ফ্লোরেন্স স্মলের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
হার্পার একটি কনস্টেবলকে দিয়ে মেয়েটিকে আবার ডেকে পাঠালেন।
ফ্লোরেন্স স্মল একজন অবস্থাপন্ন কৃষকের মেয়ে। দীর্ঘাঙ্গী, কালো চুল, বাদামী চোখ। সে খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিল।
মিস মারপল মেয়েটিকে বললেন, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, পামেলার মারা যাওয়ার দিনের সব ঘটনার কথা বিশেষ ভাবে জানা দরকার। তুমি যা জান, আমাকে খুলে বল। যদি তা না বল, তাহলে পুলিস তোমাকে সন্দেহ করবে–তোমাকে জেলে পাঠানো হতে পারে। সবকথা এখনই আমাকে খুলে বল।
ফ্লোরেন্স কয়েকবার ইতস্ততঃ করল। পরে মিস মারপলের ভাবলেশহীন চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল।
পামেলা সেদিন উলওয়ার্থে যাচ্ছিল, তাই না? মিস মারপল তীব্র স্বরে বললেন।
কাতরভাবে মেয়েটি মিস মারপলের দিকে তাকাল। মিস মারপল প্রশ্ন করলেন, কোন ফিল্মের ব্যাপার ছিল, তাই না?
মেয়েটি চাপা স্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ।
–এবারে সবকথা গোড়া থেকে খুলে বল। পামেলা তোমাকে কি বলেছিল?
র্যালিতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় আমরা এক সঙ্গে বাসের জন্য হাঁটছিলাম, ও আমাকে বলেছিল ওর সঙ্গে একজন ফিল্মের প্রযোজকের আলাপ হয়েছিল। লোকটা পামকে বলেছিল পামের অভিনয় ক্ষমতা আছে, তবে কিছুদিন শিক্ষানবিশী করতে হবে। পামকে র্যালির পরে ডেনমাউথে একটা হোটেলে লোকটার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল। সে তাকে স্টুডিওতে নিয়ে যাবে। সেখানে পরীক্ষা নেয়ার পর পাম বাস ধরে বাড়ি ফিরতে পারবে।
-বেশ, বলে যাও।
–আমাদের র্যালি ভালভাবে শেষ হয়েছিল। পাম আমাকে বলেছিল, সে এবারে ডেনমাউথ হয়ে উলওয়ার্থ যাচ্ছে। ওকে আমি ফুটপাথ ধরে যেতে দেখেছিলাম।
কথা শেষ করে বেদনার্ত দৃষ্টিতে মেয়েটি মিস মারপলের চোখের দিকে তাকাল।
–আমাকে সবকথা বলে তুমি ঠিক কাজ করেছ।
ফ্লোরেন্সকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার পর মিস মারপল ওর কাহিনী হার্পারকে শোনালেন।শেষে বললেন, এরকম কিছুই আমি ভেবেছিলাম।
-আপনি অসাধারণ মিস মারপল। কি করে যে এতগুলো মেয়ের মধ্যে এই মেয়েটিকেই । বেছে নিলেন ভেবে পাচ্ছি না…লেনভিল স্টুডিও বললেন, তাই না?
কোন উত্তর না দিয়ে মিস মারপল উঠে দাঁড়ালেন।
এবারে উঠি। এখুনি হোটেলে ফিরে যেতে হবে।
.
১৬.
মিস মারপলের বাগানের পাশের গির্জার যাজক ভদ্রলোকের স্ত্রী গ্রিসলডার সঙ্গে দেখা করলেন মিস মারপল।
গ্রিসলডা, একটা রসিদ বই টাকা তোলার জন্য দাও।
ছেলে সামলাচ্ছিল গ্রিসলডা। হেসে বলল, নিশ্চয়ই কোন মতলব এঁটেছেন? ব্যাপার কি আমাকে বলবেন না?
-পরে বলব। এখন ব্যস্ততা রয়েছে।
.
চাঁদা তোলার একখানা রসিদ বই নিয়ে মিস মারপল গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চললেন। চৌমাথা থেকে বাঁ দিক ঘুরে ব্লু বোর পেরিয়ে চ্যাটস ওয়ার্থে মিঃ বুকারের নতুন বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
দরজা খুলে দিল স্বর্ণকেশী এক তরুণী ডিনালী। তার দেহে ধূসর রঙের স্ল্যাকস আর হালকা সবুজ জাম্পার।
-এক মিনিট একটু ভেতরে আসতে পারি?
বলতে বলতেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন মিস মারপল।
–অশেষ ধন্যবাদ। একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়লেন মিস মারপল। আমি এসেছিলাম সামান্য কিছু চাদার জন্য। সামনের বুধবার গির্জায় কিছু হাতের কাজ বিক্রি হবে
-ওহ। আমি মানে
সামান্য আধ ক্রাউন চাঁদা দিতে পারবেন না?
ডিনা লী তার হাতব্যাগ খুঁজতে লাগল।
মিস মারপল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দ্রুত ঘরের চারপাশ জরিপ করে নিলেন।
–আপনার চুল্লীর সামনে কোন কার্পেট নেই দেখছি। অন্তরঙ্গ স্বরে বললেন মিস মারপল।
অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল ডিনা লী। বৃদ্ধা যে তাকে খুঁটিয়ে দেখতে বুঝতে পারল।
-এটা কিন্তু বিপজ্জনক। আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়তে পারে। বললেন মিস মারপল।
ডিনা লী মিষ্টি করে বলল, কোথায় যে রাখা আছে, জানি না। এই নিন
সে ব্যাগ থেকে আধ ক্রাউন বার করে বাড়িয়ে ধরল।
–অসংখ্য ধন্যবাদ। মিস মারপল বই খুললেন, কি নাম লিখব?
–লিখুন মিস ডিনা লী।
–এ বাড়িতে মিঃ বেসিল ব্লেকের বলেই শুনেছি।
–হ্যাঁ। আর আমি মিস ডিনা লী।
স্বামীর সঙ্গে রয়েছেন অথচ কুমারী নাম বলছেন–এখানকার গ্রামীণ জীবনে ওটা ব্যবহার না করাই ভাল।
–আপনি কিভাবে জানলেন আমরা বিবাহিত? আপনি নিশ্চয়ই সমারসেট হাউসে যাননি?
–সমারসেট হাউস? ওহ না। তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু জানেন তো গ্রামে। সহজেই নানা কথা রটনা হয়ে যায়। আপনাদের মধ্যে যে ধরনের ঝগড়াঝাটি হয়েছিল সেটা। অবৈধ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেমানান। তারা ঝগড়া করতে সাহস পায় না। বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই প্রথম দিকে এই ঝগড়াঝাটি বেশ উপভোগ্য হয়।
-হ্যাঁ, মানে
ডিনা লী বলতে গিয়ে হেসে ফেলল। সে বসে বলল, আপনি অসাধারণ। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের কথাটা সম্মানজনকভাবে প্রকাশের কথা বলছেন কেন?
–কারণ যে কোন মুহূর্তেই আপনার স্বামীকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
.
১৭.
–বেসিল..খুন করেছে বলছেন? আপনি কি সেই ম্যাজেস্টিক হোটেলের মেয়েটির কথা বলছেন?
-হ্যাঁ।
–কিন্তু ও তো একদম বাজে কথা।
ঠিক সেই সময়েই বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। দুহাতে কয়েকটা বোতল নিয়ে বেসিল ব্লেক দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
ডিনা লী উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, উনি কি বলছেন শোন তো। সেই মেয়েটাকে খুন করার অপরাধে তোমাকে নাকি গ্রেপ্তার করা হবে।
–ওহ ভগবান।
বেসিল ব্লেকের হাত থেকে বোতলগুলো সোফার ওপর পড়ে গেল। সে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢাকল।
–বেসিল, আমি জানি একথা সত্য নয়। আমার দিকে তাকাও বেসিল। তুমি তো তাকে চিনতেই না, তাই না?
-হ্যাঁ, উনি ওকে জানতেন। বললেন মিস মারপল।
-চুপ করুন। বেসিল তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, ম্যাজেস্টিক হোটেলে দু-একবার ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল মাত্র। তুমি একথা বিশ্বাস কর ডিনা?
ডিনা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, তোমার ওপরে তাহলে সন্দেহ পড়ছে কেন?
কার্পেটটা কি করেছেন? মিস মারপল বলে উঠলেন।
–ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।
আর্তনাদের স্বরে বেসিলেন গলা চিড়ে বেরিয়ে এল কথাগুলো।
-কাজটা খুব বোকার মত হয়ে গেছে। ওর মধ্যে নিশ্চয় মেয়েটির পোশাকের আঁশ লেগেছিল।
–হ্যাঁ। সেটা কিছুতেই তুলে ফেলতে পারিনি।
–এসব কি বলছ তোমরা!
তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠল।
–ওকে জিজ্ঞেস কর, তিক্তস্বরে বলল বেসিল, উনি মনে হচ্ছে সবই জানেন।
-আমি অনুমান করতে পারছি। তাহলে শুনুন বলছি, বললেন মিস মারপল, আমার মনে হয় এক পার্টিতে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর আপনি গাড়ি চালিয়ে এখানে চলে এসেছিলেন। সে রাতে মাত্রা ছাড়িয়ে পান করার ফলে সময়টা নিশ্চয়ই খেয়াল করতে পারেননি।
-রাত প্রায় দুটোর সময় বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। বলল বেসিল, দরজা খুলে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল
-হ্যাঁ বাকিটা আমি বলছি, বললেন মিস মারপল, দেখলেন সামনে কার্পেটের ওপরে একটা মেয়ের অসাড় দেহ পড়ে আছে। সান্ধ্য পোশাকে শ্বাসরুদ্ধ একটি মেয়ে।
-হ্যাঁ, মুখ প্রায় নীল হয়ে গিয়েছিল, ফোলা, দেখে মনে হয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই মারা গিয়েছিল। কিন্তু সে পড়েছিল আমারই শোবার ঘরে।
বলতে বলতে কেঁপে উঠল বেসিল।
–আমার ভয় হচ্ছিল, যে কোন মুহূর্তে ডিনা এসে পড়বে, ওই অবস্থায় আমাকে দেখলে ভেবে নেবে আমিই মেয়েটিকে খুন করেছি। সেই মুহূর্তেই একটা মতলব মাথায় এসে গেল। নাকউঁচু দাম্ভিক বুড়ো ব্যান্ট্রির কথা মনে পড়ল। আমাকে বরাবর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। তাকে জব্দ করার জন্য মৃত স্বর্ণকেশীকে ব্যান্ট্রির লাইব্রেরিতে চালান করে দিলাম।
সকালে কিন্তু পুলিস এখানেই চলে এল। সেই চিফ কনস্টেবল। ইচ্ছে করেই লোকটির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। এ সব ঘটনা যখন ঘটছে, তখনই ডিনা এসে পড়ে।
ডিনা জানালার বাইরে তাকাল। বলল, একটা গাড়ি আসছে, অনেকগুলো লোক রয়েছে ভেতরে।
-খুব সম্ভব ওরা পুলিস, বললেন মিস মারপল, বেসিল ব্লেক উঠে দাঁড়াল। হাসবার চেষ্টা করল।
–তাহলে এর সঙ্গে আমি জড়িত? ভাল কথা, ডিনা ভয় পাবার কিছু নেই। আমাদের পারিবারিক উকিল বুড়ো সিমের কাছে যেও। মার কাছে গিয়ে আমাদের বিয়ের কথা জানিও। ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই–আমি খুন করিনি–সবই ঠিক হয়ে যাবে।
ঘরে ঢুকলেন ইনসপেক্টর স্ল্যাক। সঙ্গে একজন।
–মিঃ বেসিল ব্লেক।
–হ্যাঁ।
–গত কুড়ি সেপ্টেম্বর রাতে রুবি কীন নামে একটি মেয়েকে খুন করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা রয়েছে। আমার সঙ্গে আপনাকে আসতে হবে।
বেসিল মাথা নিচু করল। ডিনাকে দেখল। বলল, বিদায় ডিনা।
ইনসপেক্টর স্ল্যাক মিস মারপলের উপস্থিতি লক্ষ্য করে সুপ্রভাত জানালেন।
উৎসাহে তিনি টগবগ করছিলেন। কার্পেটটা হাতে পেয়েছিলেন। তাছাড়া গাড়ি রাখার জায়গার লোকটাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলেন বেসিল ব্লেক রাত এগারটার সময় চলে এসেছিল। বেসিলকে বিকারগ্রস্ত বলেই মনে হচ্ছিল তার। প্রথমে রিভস মেয়েটাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। পরে নিজের গাড়ি নিয়ে পার্টিতে চলে আসে তারপর ডেনমাউথে। তারপর রুবি কীনকে এখানে এনে গলা টিপে মেরে কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরিতে ফেলে আসে। যৌন উন্মাদ ছাড়া কিছু নয়।
ছকটা নিজের মনে গোছাতে গোছাতে বেসিলকে নিয়ে বেরিয়ে যান স্ল্যাক।
ডিনা মিস মারপলের দিকে তাকাল। তার চোখে কাতরতা।
–আমি জানি না। আপনি কে–কিন্তু বেসিল কখনও এমন কাজ করেনি।
–আমি জানি সে করেনি। কে করেছে তাও জানি। তবে প্রমাণ করতে একটু সময় লাগবে।
.
১৮.
বাড়ি ফিরেই স্টাডি রুমে ঢুকলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন, আমি ফিরে এলাম আর্থার।
কর্নেল ব্যান্ট্রি লাফিয়ে উঠে স্ত্রীকে আদর করে কাছে টেনে নিলেন।
-খুব ভাল হল।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিসেস ব্যান্ট্রির মনে হল, তিনি যেন কেমন চুপসে গেছেন। একটু কৃশও। চোখের কোণে কালি পড়েছে।
–ডেনমাউথে কেমন কাটালে বল। বললেন কর্নেল ব্যান্ট্রি।
–খুব মজা হল। তুমি তো জেফারসনদের পছন্দ করতে। তুমি গেলে খুব আনন্দ হত।
–যেতে পারলাম না, অনেক কাজ।
ব্র্যাফফাডসায়ারে তোমাদের সভা কেমন হল? তুমিই তো সভাপতি
–কিন্তু ইয়ে মানে..আমি যাইনি।
মিসেস ব্যান্ট্রি থমকে গেলেন। কড়া স্বরে বললেন, বৃহস্পতিবার ডাফের সঙ্গে ডিনারের কথা ছিল
-ওহ, হা–সেটা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ওদের রাঁধুনি অসুস্থ।
–গতকাল তো জেলরদের কাছে যাওয়ার কথা ছিল।
–শরীর ভাল নেই বলে ওদের টেলিফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম।
.
খুবই বিরস মুখে বসেছিলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। এমন সময় মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন।
-তোমাকে টেলিফোন করে কোথাও পেলাম না জেন। তাই ভাবছিলাম কি করব, বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি, সবকিছুই বিশ্রী লাগছে। লোকে আর্থারকে এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করেছে। ও কেমন যেন বুড়োটে হয়ে গেছে। জেন, তুমি একটা কিছু কর। আমার ভয় করছে।
–ভাবনার কিছু নেই, ডলি। বললেন মিস মারপল।
কর্নেল ব্যান্ট্রি ঘরে ঢুকলেন। মিস মারপলকে দেখে খুশি হলেন।
–একটা খবর দিতে এলাম। বললেন মিস মারপল, রুবি কীনের হত্যাকারী হিসেবে বেসিল ব্লেককে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে। তবে সে খুন করেনি। সে লাশটাকে আপনার লাইব্রেরিতে এনে রেখেছিল।
–একদম বাজে কথা। নিশ্চয়ই খুন করেছে। বললেন কর্নেল ব্যান্ট্রি।
–সে মেয়েটির মৃতদেহ তার কটেজেই দেখতে পায়।
–গল্পটা পুলিস বিশ্বাস করল? ভাল মানুষ হলে তো সঙ্গে সঙ্গে পুলিসকে জানানো উচিত ছিল।
–ঠিকই বলেছেন। বললেন মিস মারপল। কিন্তু সবার স্নায়ু তো আপনার মত দৃঢ় নয়। আজকালকার তরুণ প্রজন্ম একেবারেই আলাদা।
একটু থেমে তিনি পরে বললেন, বেসিলের সম্পর্কে অনেক কথাই আমি শুনেছি। ছেলেটি আঠারো বছর বয়সে এ আর পি-র হয়ে কাজ করেছে। একবার একটা জ্বলন্ত বাড়িতে ঢুকে চারটি শিশুকে পরপর উদ্ধার করেছিল। এরপর একটা কুকুরকে বাঁচাতে জ্বলন্ত বাড়িটাতে ঢুকেছিল। সবাই ওকে বারণ করেছিল। বাড়িটা ওর ওপরেই ভেঙ্গে পড়ে। ওকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বুকে চোট লেগেছিল-বহুদিন শয্যাশায়ী ছিল। এরপরেই সে নকশা আঁকার কাজে হাত দিয়েছিল।
-ওহ, অসাধারণ। কর্নেল লজ্জিত স্বরে বললেন, আমি ইয়ে–এতসব জানতাম না।
বেসিল এসব বলে বেড়ায় না। বললেন মিস মারপল।
–এটাই উপযুক্ত কাজ। ছেলেটা দেখছি, যা ভেবেছিলাম তা নয়। না জেনে শুনে হঠাৎ কিছু ভেবে নেয়া ঠিক কাজ হয়নি। যাই হোক, এটা খুবই দুর্বোধ্য ঠেকছে, আমার ওপরে ও কেন খুনের দায় চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল?
–আমার মনে হয়, সে ঠিক এভাবে ব্যাপারটাকে ভাবতে চায়নি। বললেন মিস মারপল, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ব্যাপারটাকে একটা তামাশা বলেই মনে করেছিল, আমার ধারণা।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কিছু করে থাকলে অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। আপনি বিশ্বাস করেন না সে খুন করেছিল?
–সে খুন করেনি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
–কে করেছে সে বিষয়ে কোন
মিস মারপল মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
–জেন, তুমি বাঁচালে। আমি জানতাম তুমিই পারবে।
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
–তাহলে খুনী কে?
–এজন্যেই আপনার সাহায্য দরকার। আমরা যদি সমারসেট হাউসে যাই তাহলে, সেটা পরিষ্কার ভাবে জেনে যেতে পারব।
.
১৯.
স্যার হেনরির মুখ গম্ভীর হল। তিনি বললেন, ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না।
–আমি জানি, আপনার কাছে এটা নীতিসম্মত বলে মনে হবে না। তবে অন্তত নিশ্চিত হয়ে নেবার পক্ষে এটা না করে উপায় নেই। মিঃ জেফারসন যদি রাজি হন ।
–তাহলে হার্পারকেও তো সঙ্গে নিতে হয়।
-না, তার পক্ষে বেশি জেনে ফেলা ঠিক হবে না। তবে আপনি খানিকটা ইঙ্গিত দিয়ে রাখতে পারেন, যেমন কোন বিশেষ ব্যক্তির ওপর নজর রাখা বা ওই রকম একটা কিছু।
–হ্যাঁ, এটা করা চলতে পারে।
–স্যার হেনরি বললেন ধীরে ধীরে।
.
–আপনি কি আমাকে কোন ইঙ্গিত করতে চাইছেন স্যার?
সুপারিন্টেন্টে হার্পার স্যার হেনরি ক্লিারিংকে সসম্ভ্রমে জিজ্ঞেস করলেন।
–আমার বন্ধু আপনাকে যেটুকু জানাতে বলেছেন, আপনাকে আমি শুধু সেটুকুই জানাচ্ছি। এর মধ্যে গোপনীয়তা কিছু নেই। তিনি আগামীকাল ডেনমাউথে একজন সলিসিটারের কাছে যাচ্ছেন–একটা নতুন উইল করার ইচ্ছা তার।
হাপারের ভ্রু কুঁচকে উঠল। তিনি বললেন, মিঃ কনওয়ে জেফারসন একথা কি তার জামাতা ও পুত্রবধূকে জানিয়েছেন?
–আজ সন্ধ্যায়ই কথাটা জানাবেন।
-বুঝলাম, হার্পার চিন্তিত ভাবে বললেন, তাহলে বেসিল ব্লেকের অপরাধ সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত নন, স্যার?
-আপনি নিজে নিশ্চিত নিশ্চয়ই?
মিস মারপল…তিনিও কি নিশ্চিত?
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আপনি সব ব্যাপার আমার হাতে ছেড়ে দিন স্যার। কয়েকজন লোককে লাগিয়ে রাখব–নতুন করে আর কোন ঘটনা আমি ঘটতে দেব না।
–আর একটা কথা।
স্যার হেনরি একটুকরো কাগজ টেবিলের ওপরে এগিয়ে ধরে বললেন, এই কাগজটা দেখে নাও।
কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়েই হাপারের মুখভাব বদলে গেল। তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এই ব্যাপার? তাহলে গোটা ব্যাপারটাই অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। এটা খুঁজে বের করলেন কি করে?
-বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহের কথাটা তো তোমার অজানা নয়।
–তার ওপরে স্যার, বয়স্কা অবিবাহিতা স্ত্রীলোক।
.
স্যার হেনরি নিচে নেমে এসে পোর্টারের কাছে খোঁজ নিলেন মিঃ গ্যাসকেলের।
সে জানাল, তিনি তো এই মাত্র গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, লণ্ডন যাবেন।
–মিসেস জেফারসন?
–তিনিও একটু আগেই শুতে গেলেন। লাউঞ্জ আর বলরুমের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন স্যার হেনরি। বলরুমে নাচগান চলছে।
শুতে যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল। স্যার হেনরি ওপরে উঠে গেলেন।
.
রাত তখন তিনটে। নিস্তব্ধ চরাচর। শান্ত সমুদ্রের বুকে লুটোপুটি খাচ্ছে চাঁদের আলো।
কনওয়ে জেফারসনের শোবার ঘর থেকে তাঁর চাপা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বালিশে পিঠ রেখে উঁচু হয়ে শুয়েছিলেন তিনি।
বাইরে বাতাসের বেগ কমে এসেছিল। তবু একসময় জানালার পর্দা নড়ে উঠল। কয়েক মুহূর্ত পরেই সামান্য ফাঁক হল পর্দা। তার আড়ালে চাঁদের আলো আঁধারিতে দেখা গেল একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি।
পর্দা আবার যেমনকার তেমনি হয়ে গেল। চারপাশে অখণ্ড নিস্তব্ধতা।
ঘরের ভেতরে সন্তর্পণে একজন আগন্তুক নড়েচড়ে উঠল। নিঃশব্দে পা ফেলে বিছানার দিকে এগিয়ে চলেছে।
বালিশের ওপরে গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ তবু থামল না। মিঃ জেফারসন তৈরি হয়েই ছিলেন। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে চামড়ার কিছু অংশ টেনে ধরলেই হয় এখন। অপর হাতে ধরা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা কাজে লাগাতে পারবেন।
ঠিক এমনি সময়েই অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে সিরিঞ্জ ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরল। অন্য হাত তার দেহটা সবলে জাপটে ধরল।
অন্ধকারের ভেতর ভাবলেশহীন একটা কণ্ঠস্বর জেগে উঠল, না, একাজ করতে দেব না। উঁচটা আমার চাই।
দপ করে আলো জ্বলে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে বালিশে পিঠ রেখে জেগে থাকা মিঃ জেফারসন দেখতে পেলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে রুবি কীনের হত্যাকারী।
.
২০.
–আপনার তদন্তের কৌশলটা আমাদের জানতে ইচ্ছে করছে মিস মারপল।
সবার প্রথমে কথা বললেন স্যার হেনরি ক্লিদারিং।
–আমার জানার আগ্রহ হচ্ছে প্রথম কিভাবে আপনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন। বললেন সুপারিন্টেন্টে হার্পার।
এবারেও আপনি বাজি মাৎ করলেন মিস মারপল। আপনি সত্যিই অসাধারণ। গোড়া থেকে সবকথা আমরা শুনতে চাই। বললেন কর্নেল মেলচেট।
মুহূর্তের জন্য মুখ লাল হয়ে উঠলেও সচেতনভাবে সামলে নিলেন মিস মারপল।
সপ্রতিভ কণ্ঠে তিনি বললেন, আমার পদ্ধতির কথা শুনলে আপনাদের সকলেরই খুবই অপেশাদার সুলভ বলে মনে হবে।
আসলে কি জানেন, বেশিরভাগ মানুষই, এমনকি পুলিসও সরলভাবে সবকিছুই বিশ্বাস করে নেয়। আমি কিন্তু উল্টো পাপে ভরা পৃথিবীর কোন কিছুই আমি নিজে যাচাই না করে কখনো বিশ্বাস করি না।
-এটাই সঠিক মনোভাব বললেন স্যার হেনরি।
–একেবারে গোড়া থেকেই এই ঘটনার কয়েকটা বিষয় ঠিক বলে ভেবে নেওয়া হয়েছিল, বললেন মিস মারপল, কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলাম।
নিহত মেয়েটির বয়স খুবই অল্প ছিল। দাঁতে নখ কাটার অভ্যাস ছিল তার। লক্ষ্য করেছিলাম তার দাঁত একটু বাইরে ঠেলে বেরিয়ে থাকত। ছেলেবেলা থেকে দাঁতে নখ কাটার অভ্যাস বন্ধ করতে না পারলে সহজে দূর করা যায় না।
এত অল্প বয়সী একটি মেয়ের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। বুঝতে পেরেছিলাম শয়তান চরিত্রের লোক ছাড়া এমন নৃশংস কাজ কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।
ব্যাপারটা শুরু থেকেই ছিল বড় গোলমেলে। মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরি ঘরে। যোগাযোগ ভেবে নেওয়া খুবই কঠিন।
আসলে ব্যাপারটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। তাই এমন গোলমেলে হয়ে উঠেছিল।
আসল মতলবটা ছিল, মৃতদেহটার দায় বেসিল ব্লেকের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া। অনেক দিক থেকেই তাকে ফাঁসানো যেত। কিন্তু সে মৃতদেহটা কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরিতে চালান করে দিয়েছিল। আসল খুনী এতে খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। আর আমাদেরও অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়।
স্বাভাবিক ভাবেই পুলিসের সন্দেহ মিঃ ব্লেকের ওপরেই পড়ত। খোঁজ নিলেই তারা জানতে পারত, সে মেয়েটিকে চিনত। আরও জানা যেত সে অন্য আর একটি মেয়ের সঙ্গেও মেলামেশা করে।
পুলিস ধরে নিত, রুবি কোন ভাবে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিল মিঃ ব্লেককে। তখন তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। নৈশ ক্লাবগুলোতে সাধারণতঃ এ ধরনের অপরাধই ঘটে থাকে।
কিন্তু ব্যাপারটা ঘুরে গিয়েছিল অন্য দিকে। সকলের দৃষ্টি পড়েছিল জেফারসন পরিবারের ওপর। আর এই ব্যাপারটা বিশেষ একজনের খুবই বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল।
আমার যে প্যাঁচালো মন, আগেই তা বলে দিয়েছি। কোন কিছু সোজা ভাবে নিতে আমি অভ্যস্ত নই। আমি অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি। অবশ্য এরকম না ভেবে উপায় ছিল না।
বুঝতে পেরেছিলাম, মেয়েটির মৃত্যুতে লাভবান হবে দুজন লোক। পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড নেহাৎ ছেলেখেলা নয়। বিশেষ করে যার অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন।
ওই দুজন লোকেরও অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। যদিও তাদের দুজনকেই বাইরে থেকে খুবই ভদ্র মানুষ বলে মনে হয়েছিল। সন্দেহ করার মত নয়। তবু কিছুই তো বলা যায় না।
মিসেস জেফারসন যেভাবে জীবন কাটিয়ে চলেছিলেন, শ্বশুরের ওপর নির্ভরশীলতার জীবন, তাতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। গত গ্রীষ্মকাল থেকে তার মধ্যে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। যদিও তিনি জানতেন। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, তার শ্বশুর বেশিদিন বাঁচবেন না। রুবি কীনের আবির্ভাব না হলেও অবস্থাটা মোটামুটি মানিয়ে নিয়ে চলার মতই ছিল।
মিসেস জেফারসন তার ছেলেকে খুবই ভালবাসতেন। সন্তানের ভালর জন্য কোন অপরাধকে নৈতিক দিক থেকে সঠিক বলে মনে করে এমন বহু স্ত্রীলোক দেখা যায়। মিসেস জেফারসন ছিলেন সেই শ্রেণীর।
মিঃ মার্ক গ্যাসকেল স্বভাবতই সন্দেহ করার মত মানুষ। তিনি জুয়ায় আসক্ত ছিলেন, তাঁর নৈতিক চেতনাও তেমন জোরালো ছিল না। তবু তাকে আমি উপেক্ষা করেছিলাম।
বিশেষ কতগুলো কারণে আমার ধারণা হয়েছিল এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে কোন স্ত্রীলোক জড়িত।
তবে এই দুজনের ব্যাপারটা অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেও আমি হতাশ হয়েছিলাম। কেননা রুবি কীনের মৃত্যুর সময়ে এদের দুজনেরই জোরালো অ্যালিবাই ছিল।
এর পরেই পাওয়া গেল দগ্ধ গাড়িটা আর তার মধ্যে পামেলা রিভসের দেহ। এই ঘটনার পরেই সমস্ত কিছু আমার চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম ওই অ্যালিবাইয়ের কোন মূল্য নেই।
এভাবে মূল ঘটনার দুটো অংশ আমার হাতে এল। কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও দুটো ঘটনাকে মেলাতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম কোথায় একটা যোগসূত্র আছে, কিন্তু আমি তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
যে লোকটিকে অপরাধী বলে সন্দেহ করছিলাম, তার কোন মোটিভই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বীকার করতেই হয়, আমি খুবই বোকামী করে ফেলেছিলাম। ডিনা লীর সঙ্গে দেখা হবার পর কথাটা আমার মনে পড়ে। অথচ অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
বিবাহ! সমারসেট হাউস। কেবল মিঃ গ্যাসকেল বা মিসেস জেফারসনের বিয়েই নয়। আরও একটা বিয়ের সম্ভাবনা ছিল।
ওই দুজনের কারো বিয়ে হয়ে থাকলেও, এই বিয়ের চুক্তিতে অন্য আর একজনেরও জড়িত থাকার কথা।
রেমণ্ডের মনে এমন ভাবনা থাকতেই পারত যে একজন ধনী স্ত্রী পাবার তার সম্ভাবনা ছিল। মিসেস জেফারসনের প্রতি সে গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিল। আর তার প্রেরণাতেই মিসেস জেফারসন একটা সময়ে বৈধব্যের জীবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিশেষভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন।
রেমণ্ড ছাড়া আর একজন ছিলেন। তিনি হলেন মিঃ ম্যাকলীন। তাকে মিসেস জেফারসন খুবই পছন্দ করতেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো তিনি তাকেই বিয়ে করতেন।
মিঃ ম্যাকলীন আর্থিক দিক থেকে খুবই দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন। আর তিনি ডেনমাউথ থেকে সে রাতে খুব দূরেও ছিলেন না। সেকারণেই আমার ভাবনাচিন্তা আমি একজনের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত করে নিয়েছিলাম। কেননা এদের যে কোন একজনের পক্ষে কাজটা করে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।
তবে ওই দাঁতে নখ কাটার ব্যাপারটাই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল খুনী কে।
–সেই নখ। সবিস্ময়ে বলে উঠলেন স্যার হেনরী, একটা নখ ভেঙ্গে যাওয়ায় বাকি নখ তো সে কেটে ফেলেছিল।
–কথাটা কিন্তু ঠিক নয় স্যার হেনরী। কেননা দাঁতে কাটা নখ আর এমনি ভেঙ্গে যাওয়া নখ কিন্তু আলাদা। মেয়েদের নখ সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে তারা আমার কথাটা অস্বীকার করবেন না। নখগুলো ছিল বাস্তব ঘটনা। তা না হলে আর একটা অর্থই হতে পারে। কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরী ঘরে যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল সেটা রুবি কীনের নয়।
যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, এই সূত্র সরাসরি তার দিকেই আঙ্গুলি নির্দেশ করছিল। লাশটা সনাক্ত করেছিল যোসি। সে ভাল ভাবেই জানত দেহটা রুবি কীনের নয়। লাইব্রেরি ঘরে দেহটা দেখার পরে সে খুবই ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল। সব রহস্য ফাঁস করে দেবার মুখে প্রায় চলে এসেছিল সে। কারণ সে জানত দেহটা কোথায় পাওয়ার কথা ছিল।
সে জানত, দেহটা পাওয়ার কথা ছিল বেসিল ব্লেকের কটেজে। আপনাদেরও নিশ্চয় মনে পড়বে, যোসিই বেসিলের দিকে ইঙ্গিত করেছিল। সে রেমণ্ডকে জানিয়েছিল রুবি হয়তো ফিল্মের লোকটার কাছে গিয়ে থাকতে পারে।
আরও একটা কাজ সে আগেই করে রেখেছিল। বেসিলের একটা ফটো রুবির হাতব্যাগে তার অগোচরে ঢুকিয়ে রেখেছিল।
যোসি এমন একটা মেয়ে যে টাকা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু চেনে না। তার বাস্তবজ্ঞান টনটনে, আর অত্যন্ত কুটিল। এসব মানুষ নখের মতই শক্ত ধাতের হয়ে থাকে।
তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে, দেহটা যখন রুবি কীনের নয়, তখন অবশ্যই আর কারও হবে। কিন্তু সে কে? সম্ভাবনা তো একটাই–যে মেয়েটি নিরুদ্দেশ বলে জানা যায়। নিশ্চয় তার দেহ–সে হল পামেলা রীভস।
বয়সের দিকটা লক্ষ্য করুন। রুবিন ছিল আঠারো, পামেলার মোল। দুজনেই স্বাস্থ্যবতী এবং অপক।
আমি ব্যাপারটা একটু নেড়েচেড়ে ভাববার চেষ্টা করলাম। পেছনে এমন কি ব্যাপার কাজ করছে যাতে ব্যাপারটাকে এমন গোলমেলে করে তুলবার দরকার হল?
আমি একটাই সম্ভাবনা খুঁজে পেলাম। সেটা হল, কোন বিশেষ ব্যক্তির জন্য অ্যালিবাই তৈরি করা। তাহলে সেই বিশেষ ব্যক্তিটি কে?
রুবি কীনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অ্যালিবাই ছিল তিনজনের ক্ষেত্রে–মার্ক গ্যাসকেল, মিসেস জেফারসন আর যোসির।
ওদের পরিকল্পনা কিভাবে কাজ করেছিল, সেটা খুঁজে পাওয়া আপাত দৃষ্টিতে খুবই কঠিন বলে বোধ হবার কথা। অথচ ব্যাপারটা ছিল খুবই সরল।
প্রথমত বেছে নেওয়া হয়েছিল হতভাগ্য পামেলাকে। ফিল্মের টোপ ফেলে তাকে সহজেই বশ করা গিয়েছিল। ফিল্মে নামার সম্ভাবনাটাকে খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তার সামনে তুলে ধরেছিল মার্ক গ্যাসকেল। লোভ সামলাতে না পেরে টোপ গিলে নিয়েছিল সে।
মার্ক গ্যাসকেল তার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করে ছিল। পামেলা হোটেলে আসে। সে মেয়েটিকে পাশের দরজা দিয়ে যোসির কাছে নিয়ে যায়। মেয়েটিকে তার পরিচয় দেয় একজন মেকআপ বিশেষজ্ঞ বলে।
হতভাগ্য সরল মেয়েটির কথা ভাবলে আমার খুব কষ্ট হয়।
বাথরুমে বসে যোসি ওর চুল আর মুখে প্রসাধনী লাগিয়ে দেয়। হাত ও পায়ের নখে । নখপালিশ লাগিয়ে দেয়। এরই মাঝখানে তাকে ওরা সম্ভবতঃ কোন আইসক্রীম বা সোডার মধ্য দিয়ে ওষুধও প্রয়োগ করে। ফলে পামেলা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
শুনেছি হোটেলের ঘরগুলো সপ্তাহে একবার মাত্র সাফ করা হয়। এই সুযোগটা ওরা নিয়েছিল। পাশের কোন খালি কামরাতেই তারা পামেলাকে রেখে দেয়।
ডিনারের পর মার্কা গ্যাসকেল তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে জানিয়েছিল সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। সেই সময়েই সে পামেলার দেহ মিঃ ব্লেকের কটেজে নিয়ে যায়।
গাড়িতে তুলবার আগেই রুবির একটা পুরনো পোশাক পামেলাকে পরিয়ে নিয়েছিল। তখনো সে মারা যায়নি, অজ্ঞান হয়ে ছিল। তারপর কটেজে চুল্লীর সামনে কার্পেটের ওপরে নামিয়ে দেয়। তারপর পামেলার ফ্রকের বেল্ট দিয়ে সে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। স্বস্তির বিষয় যে এই নৃশংস কাজটা বেচারী মেয়েটা টের পায়নি। ওই নিষ্ঠুর লোকটা–মার্ক গ্যাসকেল ওকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে না দেখলে আমার শান্তি হবে না।
রাত দশটার মধ্যেই সমস্ত কাজ সারা হয়ে গিয়েছিল। মিঃ ব্লেকের কটেজ থেকে বেরিয়ে সে দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে হোটেলে ফিরে আসে।
সেই সময় রুবি কীন রেমণ্ডের সঙ্গে নাচছিল। মেয়েটা সবসময়ই যোসি যেভাবে বলত তাই মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিল। আমার ধারণা যোসি আগেই তাকে কিছু বলে রেখেছিল। সেই মতই সে নাচের শেষে পোশাক বদলে যোসির ঘরে চলে এসেছিল। তাকেও মাদক প্রয়োগ করা হয়েছিল। যার ফলে দেখা গেছে তরুণ বাৰ্টলেটের সঙ্গে কথা বলার সময় সে হাই তুলছিল।
রেমণ্ড যোসিকে জানিয়েছিলে, রুবিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে রাতের দ্বিতীয় নাচের সময় হয়ে আসছিল।
যোসি রেমণ্ডকে নিয়ে ওকে খুঁজতে আসে। রুবিকে ঘরে অনুসন্ধান করা হয়। তবে রুবির ঘরে ঢুকেছিল যোসি নিজে। আর কেউ না।
সম্ভবতঃ সেই সময়ই সে মেয়েটিকে শেষ করে। হয় ইনজেকশান দিয়েছে নয়তো মাথায় আঘাত করে।
এরপর নিচে গিয়ে যোসি রেমণ্ডকে বলে, রুবিকে বদলে সেই তার সঙ্গে নাচবে। এবং দুজনেই নাচে অংশ নেয়। তারপর শুতে যায়।
রুবির দেহ সেভাবেই পড়েছিল। ভোরে উঠে যোসি রুবির পামেলার পোশাক পরিয়ে দেয়। পাশের সিঁড়ি দিয়ে তাকে বাইরে নিয়ে যায়।
যোসির বয়স কম, স্বাস্থ্যবতী, কাজটা করতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। এরপর সে বার্টলেটের গাড়ি নিয়ে দুমাইল দূরে খনির দিকে চলে যায়। গাড়ির গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এরপর সে আবার হোটেলে ফিরে আসে।
সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলেন মিস মারপলের ব্যাখ্যা। সবার আগে কথা বললেন কর্নেল মেলচেট।
–খুবই জটিল ছক।
কাজও নিখুঁত, বললেন মিস মারপল, নখের গোলমালের ব্যাপারটা যোসি ঠিক লক্ষ্য করেছিল। সেজন্য সে কোন ত্রুটি রাখতে চায়নি, রুবির একটা নখ ভেঙ্গে শালের ওপর লাগিয়ে রেখেছিল। যাতে পরে দরকার হলে বলতে পারে রুবি তার সব নখ কেটে ফেলেছে।
-হ্যাঁ, সবদিকেই সতর্ক নজর ছিল, হার্পার বললেন, আপনি যে প্রমাণ পেয়েছিলেন তা ছিল কোন স্কুলের মেয়ের কামড়ানো নখ।
–মার্ক গ্যাসকেল বেশি কথা বলে। রুবির সম্পর্কে সে বলেছিল, তার দাঁত ভেতরে ঢোকানো। কিন্তু কর্নেল ব্যান্টির লাইব্রেরিতে যে মৃতদেহ পাওয়া যায় তার দাঁত ছিল উঁচু, বাইরে ঠেলে বেরিয়ে আসা।
কনওয়ে জেফারসন গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। বললেন, শেষের ওই নাটকীয় দৃশ্যটাও নিশ্চয়ই আপনারই কল্পনা প্রসূত, মিস মারপল?
–তা বলতে পারেন। সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবার জন্যই পরিকল্পনা নিতে হয়েছিল। ব্যাপারটা হল, আপনি একটা নতুন উইল করতে চলেছেন, এই কথা এরা দুজন যখনই শুনল, বুঝতে পারল, তার আগেই একটা কিছু করা দরকার।
তাদের দরকার টাকার। টাকার জন্য ইতিমধ্যেই দুটো খুন করা হয়েছিল, প্রয়োজনে তৃতীয় খুনটি করবার জন্যও তারা পিছপা ছিল না।
মার্ককে ঝামেলার বাইরে রাখার দরকার ছিল নানা কারণেই। তাই আলিবাই তৈরি করার উদ্দেশ্যেই সে লণ্ডনে চলে গিয়েছিল।
সেখানে সে বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় ডিনার খায়, পরে নৈশ ক্লাবেও যায়।
কাজটা করার দায়িত্ব ছিল যোসির। মিঃ জেফারসনের মৃত্যু ঘটানো।
রুবির মৃত্যুর দায় তখনও তারা বেসিলের ওপরেই চাপাতে চাইছিল। তাই তাদের প্রমাণ করবার দরকার ছিল, মিঃ জেফারসনের মৃত্যুটা হয়েছে হার্ট ফেল করে।
সুপারিন্টেণ্ডেন্টের কাছে শুনলাম সিরিঞ্জে ডিজিট্যালিস ছিল। এরকম অবস্থায় মৃত্যুকে যে কোন ডাক্তারই হার্টের গোলমাল বলেই রায় দিতেন।
ইতিমধ্যে যোসি ব্যালকনিতে একটা পাথরের বল আলগা করে রেখেছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল সেটা পরে মাটিতে আছড়ে ফেলে আচমকা কোন শব্দ তৈরি করা।
সকলে ধরে নিত সেই প্রচণ্ড শব্দের ধাক্কাতেই মিঃ জেফারসনের মৃত্যু ঘটেছে।
উঃ বিশ্বাস করা যায় না। একেবারে জ্যান্ত শয়তান। বললেন মেলচেট।
–তাহলে, তৃতীয় মৃত্যুটা বলছেন হত কনওয়ে জেফারসন? বললেন স্যার হেনরি।
–ওহ, না, বললেন মিস মারপল, আমি বলেছিলাম বেসিল ব্লেকের কথা। তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্যেই ওরা উঠে পড়ে লেগেছিল।