তার অজানা ছিল না যে কারো স্ত্রী হঠাৎ মারা গেলে স্বামীর ওপরেই প্রথমে সকলের সন্দেহ পড়ে। সে মৃত্যু যদি বিষক্রিয়ায় হয় তাহলে নানারকম পরীক্ষার প্রশ্ন এসে পড়ে। সেক্ষেত্রে নিজেকে আড়ালে রাখা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই তিনি চাইলেন মৃত্যুর ঘটনাকে অন্যকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে দিয়ে সকলকে ভুলপথে চালিত করতে।
এই চিন্তা থেকেই একজন ভুয়ো বেনামী চিঠি লেখকের সৃষ্টি হল।
সাধারণত বেনামী চিঠির ব্যাপারে স্ত্রীলোকদেরই সন্দেহ করা হয়ে থাকে। বেনামী চিঠির লেখক স্ত্রীলোকই বেশি হয়। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রেও তাই হল। তারা ধরে নিল এসব চিঠি কোন স্ত্রীলোকই লিখছে।
সম্ভবত ডাঃ গ্রিফিথের কাছে বেনামী চিঠির গল্প মিঃ সিমিংটন শুনে থাকবেন। গ্রিফিথ উত্তরে থাকার সময়ে ওখানে সকলেই ওরকম চিঠি পেতে শুরু করেছিল। সেই গল্প শোনার পরই তিনি এমন কৌশলে চিঠিগুলো লিখলেন যাতে সকলেই ধরে নিতে বাধ্য হয়–সেগুলো কোন উম্মাদ স্ত্রীলোকই লিখেছে।
উড়ো চিঠির ব্যাপারে একসময়ে যে পুলিস তৎপর হয়ে উঠবে, এও তিনি জানতেন। হাতের লেখা, ডাকঘরের ছাপ, টাইপ মেসিন ইত্যাদি পরীক্ষার কৌশল তারা অবলম্বন করবে। তাই তাদের চোখে ধুলো দেবার ব্যাপারে নিখুঁত চাতুরির আশ্রয় নিলেন।
খুনের লক্ষ্যে তার প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন থেকেই। উইমেন ইনসটিটিউটে টাইপ মেশিনটা দিয়ে দেবার আগেই সম্ভবত সমস্ত খামে ঠিকানা টাইপ করে রেখেছিলেন। আর কাজটা নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ করার জন্য বহু আগেই কোন একসময় মিস এমিলির ঘরে অপেক্ষা করার ফাঁকে বেছে বেছে একটা ধর্মোপদেশের বই থেকে কতগুলো পাতা ছিঁড়ে রেখেছিলেন। এখানেও তিনি চাতুর্য অদ্ভুতভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি জানতেন ধর্মোপদেশের বই কেউ বড় একটা পড়ে না–কেটে নেওয়া পাতার খোঁজও তাই সহজে কেউ জানতে পারবে না।
বেনামী চিঠির ব্যাপারটা যখন বেশ ভাল রকমে জমে উঠল, সকলে তাই নিয়েই মেতে উঠল, সেই সুযোগে তিনি আসল ঘটনার দিকে হাত বাড়ালেন।
খুব সুবিধাজনক একটা সময় এজন্য বেছে নিলেন তিনি। সেদিন চাকরবাকরদের সাপ্তাহিক ছুটি, বিকেলে গভর্নের্স বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে গেছে, মেগানও তার সাইকেল নিয়ে বাড়ির বাইরে গেছে।
নিভৃতে একটা খুনের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করার একেবারে প্রশস্ত সময়।
কিন্তু ভাগ্যেরই প্রহসন বলতে হবে তার ক্ষেত্রে, ঘটনাচক্রে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় অ্যাগনেস সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এরকম ব্যাপার যে ঘটতে পারে মিঃ সিমিংটন ভাবতে পারেননি।
–অ্যাগনেস তাহলে কিছু দেখেছিল, বলছেন? যোয়ানা জানতে চাইল।
–সঠিক বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা ও কিছু দেখেনি।
–হয়তো কিছু ধারণা হয়ে থাকতে পারে।
-না, তা নয়। আমার মনে হয় সে ছেলেবন্ধু আসতে পারে এই আশায় সারা বিকেল রান্নাঘরের জানালার ধারে বসেছিল। সত্যিকথা বলতে সেদিন বিকেলে বাড়িতে ডাকপিওন বা অন্য কেউই আসেনি।
–তাহলে মিসেস সিমিংটন কি কোন চিঠি পাননি?
-কখনই না। যাই হোক, রাতের জন্য কিছু পুরিয়া ওষুধ গ্রিফিথ মিসেস সিমিংটনকে দিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি সেটা খেতেন।
মিঃ সিমিংটন ওইদিন সবচেয়ে ওপরের পুরিয়ার মধ্যে সায়ানাইড রেখে দিয়েছিলেন।
তিনি জানতেন মধ্যাহ্নভোজের পরেই তার স্ত্রী সেটা খাবেন।
এরপর সিমিংটন অফিস থেকে ঠিক সেই সময়ে বাড়ি ফিরে এলেন, যখন এলসি হল্যাণ্ড বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে এলো।
বাড়ি ফিরে তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন, এলসি তা শুনতে পেল, স্ত্রীর সাড়া না পেয়ে তার ঘরে ছুটে গিয়ে জলের গ্লাসে একফোঁটা সায়ানাইড ফেলে দেওয়া, বেনামী চিঠিটা দলা পাকিয়ে চুল্লীতে ফেলে দেওয়া আর এভাবে আর পারছি না লেখা কাগজের টুকরোটা স্ত্রী হাতের কাছে। রেখে দেওয়া–এই সব কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গেই শেষ করলেন তিনি।
–এক টুকরো কাগজ, আমার দিকে ফিরে বললেন মিস মারপল, এই কথাটাও আপনিই আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন মিঃ বার্টন। সাধারণত আত্মহত্যার কথা মানুষ এক টুকরো কাগজে লিখে রাখে না। তার জন্য তারা একখণ্ড কাগজ ব্যবহার করে। অনেক সময় খামও। তাই টুকরো কাগজের ব্যাপারটা আপনার খটকা লেগে ছিল।
–কিন্তু আপনার মতো করে তলিয়ে দেখতে পারিনি আমি।
–আসলে ব্যাপারটা একদম অন্যরকম ছিল। সিমিংটন হয়তো এই ধরনের কিছু কোথাও লিখে থাকবেন। সেটা চোখে পড়ায় লেখা সহ কাগজের টুকরো ছিঁড়ে নিয়েছিলেন মিঃ সিমিংটন। কার্যক্ষেত্রে সেই টুকরোটাই নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছিলেন।
একটু থেমে মিস মারপল আমার দিকে তাকালেন। পরে বললেন, আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন। তা হল–এলসি হল্যাণ্ড কোন বেনামী চিঠি পাননি।
–গতকাল রাতেই আমি ভাবছিলাম, ও নিজেই বেনামী চিঠিগুলো লিখেছিল, তাই নিজে কোন চিঠি পায়নি। আমি বললাম।
–ওহ্ না, বললেন মিস মারপল, বেনামী চিঠি যারা লেখে তারা নিজেদের নামেও লিখে থাকে। এটাই তাদের অপরাধের প্রকৃতি।
ব্যাপারটা আমি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। ওটা ছিল মিঃ সিমিংটনের দুর্বলতা। বলতে পারেন মনুষ্য চরিত্রের এক বিশেষ দুর্বলতা। ভালবাসার মেয়েকে তিনি ওরকম চিঠি দিতে চাননি।
এই একটা ব্যাপারই তার দিকে আমাকে বিশেষভাবে আগ্রহী করে তুলেছিল। আর তিনি ধরাও পড়লেন।