মনে পড়ল, হ্যাঁ, তিনি বলেছিলেন বটে–এসব এখনই বন্ধ করা দরকার…আমি এখনই তার ব্যবস্থা করতে চলেছি।…সেদিন খুবই বেপরোয়া আর উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে। আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম…ভদ্রমহিলা কি ব্যবস্থা নেন দেখা যাক।
এখন কথা শুনে বুঝতে পারলাম, সত্যিই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না মিসেস ডেন ক্যালপ।
কিন্তু কাকে ডেকেছিলেন তিনি, বিশেষজ্ঞ এমন কেউ? আর তিনি কতটা কিই বা করেছেন?
-সত্যিই ডেকেছিলেন কাউকে আপনি? জানতে চাইলাম আমি।
-হ্যাঁ। বললেন তিনি, মিস মারপলের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ওই তো বসে রয়েছেন আমার সেই বিশেষজ্ঞ। জেন মারপল। ওই বৃদ্ধ মহিলাকে দেখতে বিশেষত্বহীন মনে হলেও এটা সত্যি জানবেন, মানুষের নানা দুরভিসন্ধির কথা তিনি জানেন।
মিস মারপল তার কুরুশের কাঁটা বুনে চলেছিলেন। ডেন ক্যালথ্রপের কথা শুনে তিনি সুতোর গুলি সরিয়ে রাখলেন।
–অতটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না মড, বললেন মিস মারপল।
–কথাটা কিছু মিথ্যে বলিনি। তুমি তাই।
সারা বছর গ্রামে পড়ে থাকি–মানুষের অনেক কাণ্ডকারখানাই চোখে পড়ে–এই যা।
–সত্যিকথা বলতে, প্রথম দিন আলাপ হবার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি একজন অসাধারণ মহিলা।
তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম যখন এখানকার খুনের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন।
আমার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত ছিলেন, এটাও সত্যিকথা। তিনি আমাকে আমার নিজের দিকে তাকিয়ে বিচার করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
ডেন ক্যালথ্রপের কথায় স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সকলের আগ্রহ সৃষ্টি মিস মারপলের দিকে পড়ল। সকলের প্রত্যাশা অনুধাবন করতে পেরে তিনি বললেন,অপরাধগুলো সাধারণত খুব একটা জটিল থাকে না। একটু খোলা মন নিয়ে দেখলেই তা বোঝা যায়।
এখানের খুনের ব্যাপারটাও ছিল খুবই সরল। খুবই সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ–যদিও খুবই ভয়াবহ।
ভয়াবহ তো বটেই। আর খুবই রহস্যময়। বললাম আমি।
তবে ততটা অস্পষ্ট কিছু ছিল না। আপনি তা দেখতেও পেয়েছিলেন মিঃ বার্টন।
–মনে হয় না বিশেষ কিছু দেখতে পেয়েছি বলে।
–আপনি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন। সমস্ত ব্যাপারটাই আপনি আমাকে ইঙ্গিতও করেছিলেন। ঘটনাগুলোর পারস্পরিক যোগসূত্র আপনার চোখ এড়াতে পারেনি। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকার জন্য আপনার অনুভূতির সঠিক তাৎপর্য ধরতে পারেননি।
আপনিই শুনিয়েছিলেন, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না–কিন্তু ভুল করে ধোয়ার জাল নিয়ে মেতে ওঠার জন্য সবকিছুই ভুল মনে হয়েছিল। এই ভুলটা সকলেই করেছিল। বেনামী চিঠির ব্যাপার নিয়েই মেতে উঠেছিল। অথচ মজার ব্যাপার হল, সত্যিই কোন বেনামী চিঠি ছিল না।
–কিন্তু, মিস, মারপল, ওরকম একটা চিঠি সত্যিই আমি পেয়েছিলাম। বললাম আমি।
–তা পেয়েছিলেন। কিন্তু সে চিঠিগুলো ধোঁয়া ছাড়া কিছুই ছিল না–আসল আগুনকে আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া।
প্রিয় মড ব্যাপারটা অনেকটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। যাই হোক, যদি ওই বেনামী চিঠির ব্যাপারটা বাদ দেওয়া যায় তাহলেই আসল ঘটনাটা আমাদের চোখে পড়ে যায়।
বেনামী চিঠির প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখলেই আমরা একটা মারাত্মক ঘটনার মুখোমুখি এসে পড়ি-মিসেস সিমিংটনের আকস্মিক মৃত্যু–যেটাকে সুকৌশলে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এই মৃত্যুর ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, এর ফলে কার কি স্বার্থ চরিতার্থ হতে পারে? কার পক্ষে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুকামনা করা সম্ভব ছিল?
সবার আগে দৃষ্টি পড়ে তার স্বামীর ওপরেই। তার দিক থেকে কি ধরনের উদ্দেশ্য থাকা সম্ভব? দ্বিতীয় কোন নারীর আবির্ভাব? যার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা মিঃ সিমিংটনের বয়সী মানুষদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এখানে এসেই শুনেছিলাম, ওই বাড়িতে রূপবতী এক নার্সারী গভর্নেস আছেন। সরল সোজা ব্যাপারটা এখানেই যেন হাতছানি দিয়ে রহস্যের ইঙ্গিত করে।
মিঃ সিমিংটন ছাড়াছাড়া মানসিকতার এক আবেগবর্জিত মানুষ। এক স্নায়বিক বিকাগ্রস্ত স্ত্রীর সঙ্গে জড়িত ছিল তার জীবন। সেই অবস্থাতেই ওই সুন্দরী তরুণীর আবির্ভাব ঘটল।
ধোঁয়ার ব্যাপারটা–ওইসব বেনামী চিঠি–যদি সকলকে ভুল পথে চালিত না করত তাহলে অনিবার্যভাবে ঘটনার এই দিকে আলোকপাত ঘটত।
কিন্তু সুকৌশলে ওই বেনামী চিঠির ব্যাপারটাকেই এখানে কাজে লাগিয়ে সকলকে আরো বেশি বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল।
ওইরকম বয়সের কোন ভদ্রলোক যখন প্রেমে পড়েন, তখন তারা খুব বেপরোয়া হয়ে পড়েন। প্রায় সময়েই তাদের উম্মত্তের মতো ব্যবহার করতে দেখা যায়।
এদিকে মিঃ সিমিংটন, যতদূর জানতে পেরেছি, এমন চরিত্রের মানুষ ছিলেন যে মানবিক গুণাবলী বলতে তার কিছুই ছিল না। ফলে উম্মাদনা বোধ করবার মতো মনোবল একেবারেই ছিল না।
কি করে মেয়েটিকে বিয়ে করা যায় এই চিন্তাতেই একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। এক্ষেত্রে স্ত্রীর মৃত্যু ছাড়া তার ইচ্ছাপূরণের কোন উপায় ছিল না।
ভদ্রলোক সন্তানদের স্নেহ করেন। তাদের তাই ছাড়তে চাননি। সামাজিক সম্মান বজায় রাখার চিন্তাও মাথায় ছিল। এই সবকিছু বজায় রেখে সুন্দরী গভর্নের্সকে বিয়ে করতে হলে একটা খুনের ঘটনা ঘটানো ছাড়া উপায় ছিল না তার।
ব্যাপারটা যখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, যখন তিনি অত্যন্ত কৌশলী একটা ছক কষলেন।