রাত দুটো পর্যন্ত ওখানেই কান পেতে বসে থাকতে হলে আমাদের।
একসময় একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। পর্দার আড়াল থেকে চোখে পড়ল সিমিংটন ঘর থেকে বেরিয়ে চাতাল পার হয়ে মেগানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
এক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
আমার অধীর হওয়ার কারণ ছিল না। ন্যাস আমাকে নিশ্চিন্ত করবার জন্য ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, মেগান সম্পূর্ণ নিরাপদ। সার্জেন্ট পার্কিনস মেগানের ঘরে দরজার আড়ালে থেকে মেগানের ওপর নজর রাখছেন।
পার্কিনসের তৎপরতা ও কর্মকুশলতায় সন্দেহ ছিল না আমার। তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম, সিমিংটন ঘরে ঢুকলেও মেগান অরক্ষিত অবস্থায় নেই।
তবুও, সত্যিকথা বলতে, একটা বিষম উত্তেজনা আমাকে যেন ক্রমাগত সামনে ছুটে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে চলেছিল।
ওভাবে বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যদিও সদাসতর্ক ন্যাস শক্তহাতে আমার কব্জি চেপে ধরে রেখেছিল।
বুকের ভেতরে তোলপাড় চলেছিল। একটি মুহূর্তকে একঘণ্টা সময় বলে মনে হচ্ছিল। সিমিংটন এতক্ষণ ঘরের ভেতরে কি করছেন?
ন্যাসকে কিছু জিজ্ঞেস করবার উপায় ছিল না। তার অচঞ্চল চোখদুটি মেগানের দরজার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়েছিল।
সহসা চোখে পড়ল, সিমিংটন নিদ্রিত মেগানকে দুহাতের ওপর তুলে ধরে ধীরে ধীরে নিচে নেমে চলেছেন।
ন্যাস আমার হাত ছেড়ে দিল। কিছুটা দূরে থেকে সিমিংটনকে অনুসরণ করে চলল। আমিও চললাম তার পেছনে।
নিচে নেমে সিমিংটন মেগানকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। ধীরে ধীরে তাকে নামিয়ে এনে মাথাটা গ্যাসের উনুনের ওপরে রাখলেন। ধীর হাতে গ্যাস চালু করে দিলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি ন্যাস ঘরের ভেতরে লাফিয়ে ঢুকলাম। সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিলেন ন্যাস।
চকিতে পেছনে ঘুরে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন সিমিংটন। পরক্ষণেই একেবারে ঝিমিয়ে পড়লেন।
–আপনার খেলা শেষ, সিমিংটন। মূর্তিমান শমনের মতো ন্যাস মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন।
আমি ছুটে গিয়ে মেগানকে কোলে তুলে কল ঘুরিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিলাম।
সিমিংটন বুঝতে পেরেছিলেন, বাধা দেবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না। খেলাটা নিখুঁত ভাবে শুরু করলেও শেষ করবার আর কোন সুযোগ নেই। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। এভাবে যে হেরে যেতে হবে নিশ্চয় কল্পনা করতে পারেন নি।
.
ওপরে অর্ধচেতন মেগানের বিছানায় বসে তাকে সুস্থ করে তুলবার চেষ্টা করছিলাম।
ন্যাস যে এতবড় একটা ঝুঁকি নেবে স্বপ্নেও ভাবিনি। তার এই দুঃসাহস কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম ন। রাগে বিরক্তিতে মন বিষিয়ে উঠেছিল।
–এটা আপনারা খুবই অন্যায় কাজ হয়ে গেছে। এতবড় ঝুঁকি নেওয়া আপনার উচিত হয়নি।
–শান্ত হোন মিঃ বার্টন। মিস মেগান এখুনি ঠিক হয়ে যাবেন। বললেন ন্যাস।
-ও আদৌ সুস্থ হবে বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। অধৈর্যের সঙ্গে বলে উঠলাম আমি।
মিস মেগানের বিছানার পাশে যে দুধের গ্লাস ছিল তাতে বিষ রাখার মত বোকা সিমিংটন ছিলেন না। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ন্যাস, ঘুমের ওষুধই মেশানো ছিল দুধে। মেগানকে বিষ খাওয়ানোটা ওর পক্ষে বড় বেশি ঝুঁকির হয়ে যেত।
মিস গ্রিফিথের গ্রেপ্তারের পর সিমিংটন তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এর পর এখানে বিষপ্রয়োগ বা আঘাতজনিত কোন রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটানো তার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হয়ে পড়ত।
মেগানের মৃত্যুটাকে তিনি আত্মহত্যার ঘটনা বলেই দেখাবার মতলব করেছিলেন।
মায়ের আত্মহত্যার শোক সইতে না পেরে একটি অসুখী মেয়ে গ্যাসের উনুনে মাথা রেখে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে–লোকে এটা স্বাভাবিক বলেই মেনে নিত। বিশেষ করে মেগানকে অস্বাভাবিক মেয়ে বলেই যখন অনেকে মনে করত।
ন্যাসের কথায় যুক্তি থাকলেও মেগানের ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।
–কিন্তু ওর জ্ঞান ফিরতে অনেক দেরি হচ্ছে।
মেগানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিতভাবে বললাম আমি।
–ডাঃ গ্রিফিথ তো ভাল করেই পরীক্ষা করে গেলেন। তবু চিন্তা করছেন কেন? হার্ট, নাড়ী সবই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থেকে নিজে থেকেই জেগে উঠবে।
একটু পরেই মেগান একটু নড়াচড়া করল। বিড়বিড় করে কি বলল বোঝা গেল না। সুপারিন্টেন্টে মিনিটখানেক অপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মেগান চোখ মেলে তাকাল।
-জেরি–
-এই তো আমি, মেগান।
–আমার অভিনয় ঠিক ঠিক হয়েছে তো?
–নিখুঁত ছিল। নকল ব্ল্যাকমেল বলে মনেই হয়নি। ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকাল মেগান।
কতটা কি হবে বুঝতে পারছিলাম না। তাই গত রাতে তোমাকে একটা চিঠি লিখতে বসেছিলাম। কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল বলে শেষ করতে পারিনি। টেবিলেই আছে চিঠিটা
আমি উঠে লেখার টেবিলের কাছে গিয়ে অসম্পূর্ণ চিঠিটা পেলাম।
ও লিখেছে প্রিয় জেরি,
তোমার কথা মন থেকে সরাতে পারছি না। আমার মন-প্রাণ জুড়ে কেবলই তুমি। বুঝতে পারছি, সত্যিই তোমাকে ভালবাসি। তুমি ছাড়া আমি বাঁচার কথা ভাবতে পারছি না…।
.
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। হাওয়ায় কনকনে ভাব। জ্বলন্ত চুল্লীর তাপে ঘরের আবহাওয়া বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে।
ভিকারেজে আমরা সকলে উপস্থিত হয়েছি। মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ সোফার কুশনগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, এই কারণেই একজন বিশেষজ্ঞকে ডেকে আনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলাম আমি।