আমি আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকালাম ন্যাসের দিকে।
-ডাক্তারের ডিসপেনসারী থেকে একটা ভারী নোড়া গোছের পাথরের টুকরো পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিশ্চিত ওটা দিয়েই ওই মেয়েটার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, বললেন ন্যাস, তার মুখে সাফল্যের হাসি।
–ওরকম একটা অদ্ভুত জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া তো এক ঝক্কির কাজ। বললাম আমি।
–মিস গ্রিফিথের পক্ষে অসুবিধাজনক ছিল না। ঘটনার দিন বিকেলে তিনি গার্ল গাইডের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন।
সেদিন রেডক্রশের অফিসে কিছু সজী দেবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বেশ বড় একটা ঝুড়ি তার হাতে ছিল।
-বুঝলাম। কিন্তু সেই শিকটা বোধহয় খুঁজে পাওয়া যায়নি?
-না। কোনদিনই পাওয়া যাবে না। উম্মাদ হলেও সেই খুনে হাতের কাছে প্রমাণ রেখে যাওয়ার মতো মতিচ্ছন্ন নয়।
.
ভিকারেজে খবরটা যখন পৌঁছাল, শুনে মিস মারপল খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আগ্রহ নিয়েই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
মিস মারপল বেশ জোরের সঙ্গেই তার অবিশ্বাসের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন।
-না, মিঃ বার্টন, আমি নিশ্চিত, কথাটা সত্যি নয়, এ হতে পারে না।
-তা বলবার কোন উপায় নেই মিস মারপল, আমি বললাম, পুলিস ফাঁদ পেতে অপেক্ষায় ছিল। এমিকে তারা চিঠিটা টাইপ করতে দেখেছে।
–তা হতে পারে। কিন্তু
-ওখানেই শেষ নয়। পুরনো ছিঁড়ে নেয়া যে পৃষ্ঠাগুলো থেকে অক্ষর কেটে বেনামী চিঠিগুলো লেখা হয়, সেগুলোও তাঁর বাড়ি থেকে পুলিস উদ্ধার করেছে।
যেন আমার কথাগুলো বুঝতে পারলেন না, এমনি হতভম্বের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস মারপল। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এ খুবই খারাপ ব্যাপার মিঃ বার্টন–খুবই সাংঘাতিক ব্যাপার
এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন মিস ডেন ক্যালথ্রপ।
-কি হয়েছে জেন? তোমার মুখ অমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেন? ব্যস্ত হয়ে বললেন ভিকারের স্ত্রী।
–ওহ, এখন তাহলে কি হবে? বিহ্বল স্বরে বললেন মিস মারপল।
–কি নিয়ে এত ভাবনায় পড়লে জেন?
–ওহ না…সব ঠিকমতো মনে আসে না…কোথাও কিছু একটা আছে…
মিস মারপল হঠাৎ এমন ভেঙে পড়লেন যে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ তখনই তার বন্ধুকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।
সেদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে মিস মারপলের সঙ্গে আবার দেখা হল আমার। তাকে এমনভাবে দেখতে পাব আশাই করতে পারিনি।
গ্রামের শেষে মিসেস ক্লিটের বাড়ির কাছে একটা ছোট ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে মেগানের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
মেগানের সঙ্গে সারাদিনে একবারও আজ দেখা হয়নি। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য খুবই উদ্গ্রীব হয়ে ছিলাম।
এখন মেগানকে দেখতে পেয়ে আমি দ্রুতপায়ে এগিয়ে চললাম।
কিন্তু কাছাকাছি হবার আগেই মেগান অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করল, আর মিস মারপল এগিয়ে এসে আসার পথ আগলে দাঁড়ালেন।
–আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল মিঃ বার্টন। বললেন তিনি।
–মেগানের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে ছিল, ও চলে যাচ্ছে কেন? বললাম আমি।
–না, এখন মেগানকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। মেয়েটার সাহস নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আপনি শান্ত হয়ে দাঁড়ান।
মিস মারপলের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে আমার কেমন ভয় জেগে উঠল। কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। মাথা নিচু করে মেগানকে অনুসরণ করা থেকে নিরস্ত হলাম।
.
বাড়িতে কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না। মেগানের সঙ্গে দেখা হলো অথচ কোন কথা বলতে পারলাম না। মিস মারপলই বা তার সঙ্গে অমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কি কথা। বলছিলেন?
তিনি আমার পথ আগলে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?
শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে ধরে রাখা সম্ভব হল না। রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
শহরের পথ পেরিয়ে সিমিংটনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম।
বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছিল। এখন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে। ঝাপসা অন্ধকারে বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। গোটা বাড়িটা অন্ধকারের স্তূপের মতো মনে হচ্ছিল।
একদিকে বাড়ির জানালায় সামান্য আলোর রেখা চোখে পড়ল। মনে হলো ওটা বসার ঘরেরই আলো।
সদর দরজার দিকে যেতে গিয়েও পা টেনে নিলাম। আমি নিচু হয়ে প্রায় হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে এগিয়ে একটা ছোট ঝোপ পার হয়ে জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। জানালার পর্দাটা ভাল করে টেনে দেয়া ছিল না। সেই ফাঁক দিয়ে আলো আসছিল। সেই ফাঁকে চোখ রেখে ভেতরের সব কিছুই পরিষ্কার দেখতে পেলাম।
সিমিংটন একটা বড় আরাম কেদারায় বসেছিলেন। পাশেই এলসি হল্যাণ্ড কিছু সেলাই করে চলেছে। মনে হয় বাচ্চাদের কিছু।
মাথা নিচু করে সেলাই করতে করতে এলসি হল্যাণ্ড বলছিলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ সিমিংটন, বাচ্চাদের স্কুল বোর্ডিং-এ যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু ওদের ছেড়ে যেতে আমার খুবই খারাপ লাগবে।
মিঃ সিমিংটন বললেন, ব্রায়ানের ব্যাপারে আপনার কথাই ঠিক। উনহে তে পরের টার্ম থেকেই ও শুরু করবে। আর কলিনের জন্য আরও একবছর অপেক্ষা করাই ভাল–ওর বয়স এখনও কম।
-হ্যাঁ, কলিন একেবারেই ছোট্ট।
সাধারণ একটা পারিবারিক চিত্র। কোন বৈচিত্র্য ছিল না এর কোথাও। জানালার পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে আমি ভাবতে লাগলাম, এখানে কেন এলাম?
সহসা সামনের দৃশ্যের পট পরিবর্তন হল। চমকে উঠলাম মেগানকে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে দেখে।