কথা শেষ করেই তিনি দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
.
যথাসময়েই অ্যাগনেস উডলফের ইনকোয়েস্ট তদন্ত অনুষ্ঠিত হল। করোনার তার রায়ে জানালেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা খুন।
কদিন যেমন চারদিকেই উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, ইনকোয়েস্টের পর আবার দিনকতকের মধ্যেই সব কেমন শান্ত হয়ে পড়ল।
লিমন্টকের জীবনধারা একই খাতে বয়ে চলতে আরম্ভ করল।
তবে অ্যাগনেসের খুনের ঘটনা, এই জীবনস্রোতে একটা পরিবর্তনের সূচনা করল। সবার মনেই একটা ভয় আর চোখে সন্দেহের আভাস জেগে উঠল।
ইনকোয়েস্টের রায় যাই হোক না কেন, সকলেই জেনে গিয়েছিল, অজানা অচেনা কেউ অ্যাগনেসকে খুন করতে আসেনি। খুনী লুকিয়ে রয়েছে লিমন্টকের জনস্রোতেই। সে হয়তো অন্য সকলের সঙ্গেই হাইস্ক্রিটে, কেনাকাটা করে, নির্ভাবনায় হাঁটাচলা করে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে একটা নিরীহ কিশোরীকে মাথায় আঘাত করে তার ঘাড়ে বিধিয়ে দিয়েছিল ছুঁচলো কিছু।
সকলেই জানে, তার পরিচয় কেউ জানে না, অথচ সে মিশে আছে সকলের সঙ্গেই।
স্বীকার না করে পারছি না, এ নিয়ে অস্বস্তি আমার মনেও ছিল। ব্যাপারটাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার তাগিদ বোধ করছিলাম।
যোয়ানা আর আমার মধ্যে আলোচনা চলছিলই। তার মতে দোষী হল মিঃ পাই। আমার দৃষ্টি পড়ছিল মিস গিনচের দিকে।
যাই হোক, কিছুদিন বেশ নিরুপদ্রবে কাটল। আমাদের চেনাজানা কেউ বেনামী চিঠি পায়নি। ন্যাস বা পুলিস নতুন করে কোন ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করেছে কিনা, সেরকম কোন খবরই আমি পাইনি।
শুনেছি গ্রেভস ফিরে গেছেন। তদন্তের হয়তো ইতিই পড়ে থাকবে।
এমিলি বার্টন একদিন চা খেতে এসেছিলেন। মেগান মধ্যাহ্নভোজে এসেছিল। আমরা একদিন মিঃ পাইয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। গ্রিফিথ তার চিকিৎসার কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
একদিন আমরা গেলাম ভিকারেজে চা খেতে। সেদিন লিটলফার্জ থেকে যে মারমুখী ভাবটা নিয়ে ফিরেছিলেন, তারপর আর তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি।
কিন্তু দেখে ভাল লাগল, তার মধ্যে আগের সেই তীব্র ভাবটা আর নেই। সেটা হয়তো ছিল তার ক্ষণিক অতি উত্তেজনার ব্যাপার। আপাতত তিনি তাঁর বাগান পরিচর্যার কাজে মনোযোগ দিয়েছেন।
ভিকারেজের শান্ত সুখকর পরিবেশে এসে মনটা যেন অনেক হালকা হয়ে গেল।
একজন অতিথিকে দেখলাম ডেন ক্যালথুপের ড্রইংরুমে। বয়স্কা মহিলা, বেশ আলাপী আর অমায়িক। সারাক্ষণ পশম নিয়ে বুনে চলেছেন।
আমাদের কেক সহযোগে চা পানের অবসরে ভিকার এসে মিলিত হলেন। তিনি খুশি হয়ে হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালেন।
এবাড়ির অতিথির নাম মিস মারপল। তিনি আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু শুনে দেখলাম বেশ শিহরিত হলেন।
খুনের ঘটনাটাই প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের এসে পড়েছিল।
মিস মারপল মিসেস ডেন ক্যালথ্রপকে বললেন, এই খুনের ব্যাপারটা নিয়ে এই শহরের মানুষজন কি ভাবছে? তারা কি বলছে?
যোয়ানা বলে উঠল, মিসেস ক্লিটের কথাই আমার মনে হয়–
মিসেস ক্লিট কে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।
–যোয়ানা জানাল, তাকে গ্রামের সকলে ডাইনি বলেই জানে।
-ডাইনি না ছাই, বলে উঠলেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ, মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন।
লোকে তাহলে তাকে খুনের ব্যাপার সন্দেহ করছে না কেন? বললাম আমি, সবাই তো ধরে নিয়েছিল চিঠিগুলো তারই লেখা ছিল।
মেয়েটাকে, শুনেছি খুন করা হয়, বললেন মিস মারপল, এতেই মিসেস ক্লিটের ওপর থেকে সব সন্দেহ কেটে যাচ্ছে।
কারণ তিনি যদি মেয়েটির ক্ষতি করতেন তাহলে সে দিনে দিনে শুকিয়ে গিয়ে একদিন স্বাভাবিকভাবেই মারা যেত। ডাইনিদের ক্ষেত্রে এরকম হতেই শোনা যায়।
–এই সব পুরনো বিশ্বাস মানুষের মন থেকে হেঁটে ফেলার জন্য খ্রিস্টীয় মতবাদ যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছে। বললেন ভিকার।
–কিন্তু এক্ষেত্রে কোন কুসংস্কার নয় অতি জঘন্য বাস্তব ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে আমাদের।
বললেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ।
-যথার্থই অপ্রীতিকর ঘটনা এসব। বললাম আমি।
-খুবই ঠিক কথা বলেছেন আপনি মিঃ বার্টন, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মিস মারপল, কিছু যদি মনে করেন, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি?
-স্বচ্ছন্দে।
–কথাটা হল, আপনি এখানে সম্পূর্ণ অচেনা, কিন্তু বুঝতে পারছি, জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। এই অপ্রীতিকর ঘটনার রহস্য আপনিই সমাধান করতে পারতেন বলে আমার ধারণা।
আমি স্মিত হেসে তাকালাম মিস মারপলের দিকে। আমার মনে হল, জীবন সম্পর্কে খুবই অভিজ্ঞ এই মহিলা।
–আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান তরুণ; তিনি বলতে লাগলেন, তবে আত্মবিশ্বাস তুলনায় যতটা থাকা দরকার ছিল তা নেই।
সম্পূ অপরিচিত একজন মহিলার মুখ থেকে আমার প্রশংসা শুনে যোয়ানা আমার দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকাল।
মিস মারপলের দিকে ফিরে বলল, দয়া করে ওকে আর আকাশে তুলবেন না মিস মারপল, এমনিতেই মাটিতে পা পড়তে চায় না।
মিস মারপল তার হাতের পশমের কাটা বন্ধ রেখে বললেন, আসলে খুন করার ব্যাপারটা অনেকটা যাদুবিদ্যার কৌশলের মতো। কাজটা এমনভাবে করা হয়, যে নোক ভুল জায়গায় ভুল কিছু দেখতে থাকে। খুনীরা এভাবেই লোককে ভুল পথে চালিত করে।
একদম ঠিক কথা। আমাদের খুনীকেও প্রত্যেকেই এখনো পর্যন্ত ভুল জায়গাতেই খুঁজে বেড়িয়েছে। বললাম আমি।