ক্ষমতার সেই দুর্গও ভেঙ্গে পড়ে অষ্টাদশ শতকের আধুনিকতার ছোঁয়ায়। চূড়ান্ত অবহেলার কবলে পড়ে লিমণ্টক। রেলপথ, সড়কপথ-অগ্রগতির কোন স্পর্শই লিমণ্টকের ভাগ্যে জোটেনি। অতীতের সমস্ত গুরুত্ব হারিয়ে এক অবহেলিত জনপদ রূপেই থেকে যায়। বিস্তীর্ণ পতিত জমি, জলাভূমি আর কিছু চাষবাসের খেত খামার নিয়েই বেঁচে থাকে লিমণ্টক। পুরনো আমলের একটা গীর্জা, স্যাক্সন আমলের কিছু ধ্বংসাবশেষ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ আর একটা হাই স্ট্রিট–এসবের মধ্যেই কেবল অতীত গৌরবের কিছু পরিচয় এখানে ধরা রয়েছে।
হাই স্ট্রিটের দুপাশে সম্ভ্রান্ত কিছু বাড়িঘর এখনো রয়েছে। কিন্তু দোকান, ডাকঘর, ডাক্তারখানা, সলিসিটর অফিস, আর সাপ্তাহিক বাজার আর এসবের সঙ্গে রয়েছে একটা নতুন স্কুল আর পাঠশালা।
আমরা তো এখানে চিরকাল থাকার জন্য আসিনি, ডাক্তারের উপদেশে কিছুদিনের অবকাশ যাপনই হল উদ্দেশ্য।
তবু যাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল, সেই পাড়াপড়শীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আগ্রহ আমাদের কিছু কম ছিল না।
চিঠিটা এসেছিল প্রাতরাশের সময়। লণ্ডন ডাকঘরের কোন ছাপ ছিল না। বুঝতে পারলাম স্থানীয় চিঠি। টাইপ করে ঠিকানা লেখা।
খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে আনলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, কিছু ছাপা অক্ষর কাঁচি দিয়ে কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। বিষয়বস্তু পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
অত্যন্ত কদর্য ভাষায় কেউ লিখেছে, যোয়ানা আর আমি ভাই বোন নই।
–কার চিঠি? কে লিখেছে?
আমার মুখভাব দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল যোয়ানা।
এই জঘন্য চিঠিটা পড়ে ওর নরম মনে আঘাত লাগতে পারে, ঘটনার আকস্মিকতায় সেই কথাটা একদম মনে পড়ল না। স্বাভাবিক ভাবেই চিঠিখানা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
–নোংরা–জঘন্য একটা চিঠি। কোন বেনামী চিঠি এমন হয় কখনো শুনিনি। বলল। যোয়ানা।
-আমিও এই প্রথম দেখছি। বললাম।
-আমার পোশাক নিয়ে তুই ঠিকই বলেছিস জেরি। যে লিখেছে চিঠিটা, সে ভেবে নিয়েছে আমি কারও বাতিল হওয়া প্রেমিকা।
–আমরা দু ভাইবোন দেখতেও একরকম নই, এটাও আর একটা কারণ হতে পারে। সেকারণেই ভাই বোন ভাবতে পারেনি।
কথা শেষ করে আমি চিঠিটা চুল্লীর আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
–একদম ঠিক করেছিস। যোয়ানা বলল, কিন্তু ভাবছি, চিঠিটা কে লিখতে পারে?
–সে রহস্য বোধহয় কোন দিনই জানা যাবে না।
–কোন উম্মাদ গোছের লোকই হবে।
প্রাতরাশ শেষ করে যোয়ানা বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বিশ্রী ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসলাম।
যোয়ানার ঝলমলে পোশাক আর সৌন্দর্য কেউ একজন নিশ্চয় ভাল মনে মেনে নিতে পারেনি সেই জন্যই আমাদের আঘাত দিতে চেয়েছে। কেননা এর মধ্যে মজা করার কিছু নেই।
নানান ভাবনা মাথায় ঘুরছে বলে বিশ্রী চিঠিটার কথা ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছিলাম না।
একটু পরেই ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথ এলেন। এখানে আসার পর প্রতি সপ্তাহে একবার আমাকে। পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাঁকেই অনুরোধ করেছিলাম।
মানুষটাকে আমার বেশ ভালই লাগে। একটু ঝাঁকুনি দিয়ে কথা বলেন, একটু লাজুক ভঙ্গী।
আমাকে রুটিন মাফিক পরীক্ষা শেষ করে গ্রিফিথ বললেন, ভালই উন্নতি করছেন। কিন্তু মুখভাব এমন বিরস কেন?
অশ্লীল বেনামী চিঠিটার কথা জানালাম তাঁকে। বললাম, চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে খুব মুষড়ে পড়েছি।
-আপনিও এরকম চিঠি পেয়েছেন?
বেশ উত্তেজিত স্বরে বললেন গ্রিফিথ।
–এখানে এরকমই চলছে নাকি। আগ্রহের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম।
–হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। আপনার বোন ভেঙ্গে পড়েনি তো?
–যোয়ানা খুবই আধুনিকা আর খুবই মনের জোর। ও বেশ মজাই পেয়েছে।
–সে রকম ভাবে নেওয়াই ভাল। খুবই জঘন্য কাজ।
–কিন্তু এসব কাণ্ড কে করতে পারে, আপনার কোন ধারণা আছে?
–না, সবই দুর্বোধ্য। তবে এসব বেনামী চিঠির ব্যাপারে দুরকম কারণ থাকে। কারো যদি বিশেষ কারো প্রতি রাগ বা বিদ্বেষ থাকে সে ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ঘৃণ্য পথ বেছে নিতে পারে।
কোন চাকর, ঈর্ষাপরায়ণ স্ত্রীলোক–এরাই এসব করে থাকে। তবে এদের খুঁজে বার করা খুব কঠিন কাজ নয়।
কিন্তু বিশেষ কাউকে না লিখে যখন ইচ্ছেমতো যাকে তাকে বেনামী চিঠি লেখা হতে থাকে, সেটাই হয় মারাত্মক। মানসিক বিকারগ্রস্ত, হতাশ লোকেরাই তেমন নোংরা কাজ করে থাকে। এদের খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়। তবে কখনো সন্ধান পাওয়া গেলে দেখা যায়, যাদের কথা ভাবা যায় না। তেমনি কেউ একজন সে।
গতবছর গ্রামের অন্যদিকে এরকম একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়েছে। খুবই রুচিসম্পন্না এক মহিলা, খুবই শান্ত ভদ্র, বেশ কয়েক ওখানে আছেন, এমন বিশ্রী চিঠি লিখেছিলেন।
গ্রামের উত্তর দিকেও এরকম একটা কাণ্ড ঘটেছিল। অবশ্য সেটা ছিল ব্যক্তিগত আক্রোশের কাজ।
–এসব তাহলে অনেকদিন থেকেই চলছে? জানতে চাইলাম আমি।
–ওহ, হ্যাঁ। বিশেষ করে স্ত্রী পুরুষের সম্পর্ক নিযে। ডাক্তার হেসে বললেন, সলিসিটর সিমিংটনকে অভিযোগ করা হয়েছিল তার লেডি টাইপিস্ট মিস গিনচের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে। বেচারি মিস গিনচ সোজা পুলিসের কাছে গিয়েছিল।
আমাকে অভিযোগ করা হয়েছে, আমি নাকি আমার মহিলা রোগীদের সঙ্গে অনৈতিক ব্যবহার করে চলেছি।
এসমস্ত কিছুই অবাস্তব আর পাগলামো ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এটাও ঠিক মন বড় বিষিয়ে তোলে। বড় ভয় পাই আমি এসবে।