এবার, তিনি খবরটা কার কাছে পেলেন জানতে চাইলাম। মিঃ ইঙ্গলথর্প বললেন ডাঃ উইলকিন্স ডেনবীকে খবরটা দিয়েছেন। তারপর মিসেস ইঙ্গলথর্প যে কী ভাল ছিলেন সেসব বলতে লাগলেন, আবার একথাও বললেন তার স্ত্রী বলে তিনি এসব বলছেন না ভদ্রমহিলা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
আমার মনটা বিষিয়ে উঠল। এত ভণ্ডামি সহ্য হচ্ছিল না, তাড়া আছে বলে আমি বিদায় নিলাম।
একটু পরে লিস্টওয়েজ কুটিরের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিলাম। এই বাড়িতেই পোয়ারো থাকে। কিছুক্ষণ কোনো সাড়া পেলাম না দেখে আবার দরজায় শব্দ করলাম। এবার পোয়ারো দরজা খুলল। আমাকে দেখে সে বেশ আশ্চর্য হয়েছে বলেই মনে হল।
ঘরের ভেতর ঢুকে তাকে জানালাম আমার আসার কারণটা। পোয়ারো আমার কথা শুনতে শুনতে পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিল।
আমি ওকে একে একে সব বললাম–কিভাবে আমার ঘুম ভাঙল, মিসেস ইঙ্গলথর্পের শেষ কথা, তাঁর স্বামীর অনুপস্থিতি, ওদের দুজনের আগের দিনের ঝগড়া, মেরী ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে তার শাশুড়ির কথোপকথনের কথাগুলো বললাম। এমনকি, মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে ইভিলিন হাওয়ার্ডের ঝগড়ার কথা এবং যাওয়ার আগে ইভিলিন আমাকে যে সতর্কবাণী দিয়েছিল তা বললাম।
তবে সব কথাগুলো ঠিকমত গুছিয়ে বলতে পারলাম না। পোয়ারো আমাকে বলল অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই, ধৈর্য ধরে শান্তভাবে ঘটনাগুলো এবার বিশ্লেষণ করতে হবে। যেগুলি প্রয়োজীয় সূত্র শুধু সেগুলিকেই মনে রাখতে হবে আর বাকীগুলো ভুলে যেতে হবে। সে জানতে চাইল তার কথা আমি বুঝতে পেরেছি কিনা। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
এবার পোয়ারো হঠাৎ আমাকে বলল আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের কথা বলতে ভুলে গেছি। আমি বললাম সব কথাই তো জানিয়েছি। পোয়ারো বলল গতকাল রাত্রে মিসেস ইঙ্গলথর্প ভালো করে খেয়েছেন কিনা সেকথা আমি তাকে জানায়নি।
আমি বললাম যে আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। পোয়ারো আমাকে চিন্তা করে দেখতে বলল। আমি একটু ভেবে দেখলাম যতদূর মনে পড়ছে উনি বিশেষ কিছুই খাননি।
পোয়ারো এবার দেরাজ খুলে ওর হাতব্যাগটা নিয়ে বলল যে ও যাবার জন্য তৈরি।
আমরা রওনা হলাম। বাড়ির দরজার কাছে এসেই পোয়ারো থমকে দাঁড়ালো, বলল বাগানে ফুলগুলো কি সুন্দরভাবে ফুটে আছে অথচ বাড়ির মানুষগুলো কত শোকার্ত।
পোয়ারো কি জানতে চাইছিল জানি না, তবুও মনে হল সত্যিই কি সকলে দুঃখে শোকে ভেঙে পড়েছে। মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুতে সকলের আঘাত লেগেছে হয়ত, কিন্তু সত্যিই শোকার্ত বোধহয় কেউ নয়। কারণ, ওঁর সঙ্গে তো কারও রক্তের সম্পর্ক ছিল না–উনি জন ও লরেন্সের নিজের মা তো ছিলেন না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ পোয়ারো পায়চারি করল।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল মিসেস ইঙ্গলথর্পের গত রাত্রে কফি খেতে দেওয়া হয়েছিল। কথাটা পোয়ারোকে বললাম। পোয়ারো জানতে চাইল কটার সময় কফি পরিবেশন করা হয়।
আমি বললাম প্রায় আটটার সময়।
পোয়ারো বলল তাহলে ভদ্রমহিলা কফিটা পান করেন আটটা থেকে সাড়ে আটটার সময়। মিসেস ইঙ্গলথর্প যে মারা গেছেন তার কারণ সম্ভবতঃ কফির মধ্যে দিয়ে স্ট্রিকনিন তার শরীরে গেছে। এখন কথা হল, স্ত্রিকনিন অতি মারাত্মক বিষ এবং খুব দ্রুত কাজ করে। ঐ বিষ শরীরে প্রবেশ করলে প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে, মিসেস ইঙ্গলথর্পের ক্ষেত্রে সেটা পরদিন ভোর পাঁচটার সময় প্রকাশ পেল। তবে ঐ বিষ পান করার আগে বা পরে প্রচুর আহার করল বিষের উপসর্গ দেরিতে দেখা দেয়, তাই বলে এত দেরি কখনই নয়। আবার ভদ্রমহিলা গত রাত্রে কোনো ভারী খাবারও খাননি। তাহলে বিষের লক্ষণ এত দেরিতে দেখা গেল কেন? যাই হোক ময়না তদন্তে হয়ত কিছু জানা যেতে পারে–একথা বলে পোয়ারো মাথা নিচু করল।
এমন সময় জন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তাকে খুব অবসন্ন দেখাচ্ছিল। সে পোয়ারোকে বলল যাতে এ ব্যাপারে বেশি জানাজানি হয়। এই বলে সে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের চাবি দুটো আমার হাত দিয়ে পোয়ারো যা যা দেখতে চায় তা দেখাতে বলল।
এবার আমরা দুজনে ঐ ঘরটাতে গেলাম। পোয়ারো ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। তারপর মনোযোগ সহকারে ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। আমাকে চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমি কেন ওভাবে দাঁড়িয়ে আছি। আমি মনের কথাটা বলেই ফেললাম–পাছে পায়ের ছাপটাপ নষ্ট হয়ে যায় এজন্য আমি দাঁড়িয়ে আছি।
পোয়ারো আমার কথা শুনে হেসে ফেলল, বলল এ ঘরে কি কোনো লোক ঢুকেছে, সুতরাং এসব চিন্তা না করে চারদিকে ভালো করে দেখতে বলল। তারপর আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
টেবিলের ওপর চাবি লাগানো একটা ছোট্ট হাল্কা গোলাপী রঙের হাতব্যাগের ওপর পোয়ারোর নজর পড়ল, চাবিটা খুলে আমার হাতে দিল পোয়ারো। ছোট ইয়েল তালার চাবি সেটা, কোনো বিশেষত্ব আমার নজরে এল না। শুধু দেখলাম গর্তটাতে একটু তার জড়ানো।
এরপর পোয়ারো ভাঙা দরজাটা পরীক্ষা করতে লাগল, যেটা ভাঙা হয়েছিল ঘরে ঢোকার জন্য। ওটাতে যে চাবি দেওয়া ছিল, সম্ভবতঃ সেই ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে চাইছিল। উল্টোদিকে সিনথিয়ার ঘরের দরজাটাও বার বার খুলে দেখল। একটু পরে একটা চিমটে দিয়ে দরজার তালার মধ্যে থেকে কিছু টেনে বের করল পোয়ারো, তারপর খুব সযত্নে সেটাকে একটা খামের মধ্যে রেখে দিল।