সিনথিয়া বলল পরিচারিকা ডরকাসের কাছে সে শুনেছে মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে তার স্বামীর ঝগড়া হয়েছে।
আমার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল রেইকসের জিপসী চেহারা আর ইভি হাওয়ার্ডের সাবধান বাণী।
রাত্রে খেতে আসার সময় মিঃ ইঙ্গলথর্পকে বসার ঘরে দেখলাম চুপচাপ বসে আছেন। সকলের শেষে মিসেস ইঙ্গলথর্প খেতে এলেন। তাকে খুবই উত্তেজিত মনে হল। সবাই নিঃশব্দে খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ হতেই মিসেস ইঙ্গলথর্প তার নিজের ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় মেরীকে ওঁর ঘরে কফি পাঠিয়ে দিতে বললেন।
সিনথিয়ার সঙ্গে বসবার ঘরে গিয়ে জানলার পাশে বসলাম। মেরী ক্যাভেণ্ডিস সকলের জন্য কফি নিয়ে এলেন, তিনি সিনথিয়াকে মিসেস ইঙ্গলথর্পের কফিটা দিয়ে আসতে বললেন।
মিঃ ইঙ্গলথর্প বলে উঠলেন তিনিই তার স্ত্রীর জন্য কফি নিয়ে যাবেন, একথা বলে কফি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সময়টা বেশ কাটছিল।
কিন্তু একটা পরিচিত অথচ বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর শুনে ভীষণ রাগ হল। ডাঃ বরস্টিন এসে উপস্থিত হয়েছেন। ডাক্তারের আগমনে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কোনো ভাবান্তর না দেখে অবাক হলাম।
মিঃ ইঙ্গলথর্প ডাক্তারকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে এলেন। ডাক্তার লাজুক হাসি হেসে বললেন তার পোশাকটি ঘরে ঢোকার জন্য একেবারে উপযুক্ত নয়। সত্যি তাকিয়ে দেখলাম সারা পোশাকে শুধু কাদা মাখানো।
মেরী ডাক্তারকে প্রশ্ন করল তিনি কি করছিলেন। এরকম অবস্থা হল কিভাবে। ডাক্তার মৃদু হেসে লজ্জিত স্বরে বললেন কিভাবে তিনি একটা দুষ্প্রাপ্য ফার্ণ গাছ খুঁজতে গিয়ে অসাবধানবশত একটা পুকুরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন।
সেই সময় হঠাৎ মিসেস ইঙ্গলথর্প সিনথিয়াকে ডাকলেন। সিনথিয়া ডাক শুনে উঠে গেল। আমিও উঠে পড়লাম।
সন্ধ্যাবেলাটা ভালোভাবে কাটাব ভেবেছিলাম। ডাঃ বরস্টিন এসে পড়ায় সব মাটি হয়ে গেল। ভদ্রলোক অবশ্য খুব বেশিক্ষণ থাকলেন না।
মিঃ ইঙ্গলথর্পপও ডাক্তারের সঙ্গে গেলেন, জমিদারীর একটা হিসাবের ব্যাপারে কোনো এক দালালের সঙ্গে তাকে দেখা করতে হবে বলে জানালেন। তিনি এও বললেন ল্যাচকিটা তিনি নিয়ে যাচ্ছেন, সুতরাং আর কাউকে তার জন্য জেগে অপেক্ষা করতে হবে না।
০৩. দ্বিতীয় তলের একটা ধারণা
এই অধ্যায়টি বোধগম্য হবার জন্য বাড়িটার দ্বিতীয় তলের একটা ধারণা থাকা আবশ্যক। শুধুমাত্র পুব দিক দিয়েই পরিচারিকাদের ঘরে যাওয়া যায়। মিঃ ও মিসেস ইঙ্গলথর্প বাড়িটির দক্ষিণ অংশে থাকেন–পরিচারকদের ঐ অংশে প্রবেশ করার উপায় নেই।
তখন প্রায় মধ্যরাত। লরেন্সের ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। লরেন্সের হাতে একটা বাতি ছিল। সেই আলোয় লরেন্সের উত্তেজিত মুখ দেখে বুঝলাম কোনো অঘটন ঘটেছে। ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম।
কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় লরেন্স বলল তার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি আবার ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছেন।
ড্রেসিং গাউনটা টেনে নিয়ে লরেন্সের সঙ্গে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের দিকে ছুটলাম। জন ও কয়েকজন পরিচারক সেখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লরেন্স উদগ্রীব হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। জন মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের দরজার হাতলটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু দরজা খুলল না।
ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে একটা গোঙানির শব্দ আসছে।
ডরকাস বলল, মিঃ ইঙ্গলথর্পের ঘরের দরজা দিয়ে ঢোকা যায় কিনা দেখতে। কথাটা শুনেই চারদিকে তাকালাম, দেখলাম মিঃ ইঙ্গলথর্প আমাদের মধ্যে নেই। জন তাড়াতাড়ি ওর ঘরটা খুলে ঢুকলো, বাতি হাতে নিয়ে লরেন্সও ঢুকলো। হালকা বাতির আলোয় দেখতে পেলাম নির্ভাজ শয্যা, বিছানাটা যে কেউ ব্যবহার করেনি তা পরিষ্কার বোঝা গেল।
দুই ঘরের মাঝের দরজাটাও বন্ধ। মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে ঢোকার কোনো উপায় নেই।
ডরকাস কেঁদে বলল তাহলে কি করা যাবে?
জন বলল দরজা ভেঙে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই, যদিও কাজটা খুব শক্ত। জন বলল কেউ যেন নিচে গিয়ে বেইলীকে ডেকে তাড়াতাড়ি ডাঃ উইলকিন্সকে খবর দিতে বলে।
হঠাৎ সে বলে উঠল, সিনথিয়ায় ঘর দিয়েও তো ঢোকা যেতে পারে, জন দৌড়ে সিনথিয়ার ঘরে গেল। মেরী ক্যাভেণ্ডিস সিনথিয়াকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছিলেন, সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
একটু পরে জন বেরিয়ে এসে জানাল ঐ দরজাটাও বন্ধ। সুতরাং দরজা ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আমরা সবাই মিলেই প্রচণ্ড ধাক্কা দিলাম। মনে হল বৃথা চেষ্টা করছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় দরজাটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। সকলে একসাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
লরেন্স আলোটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখলাম–মিসেস ইঙ্গলথর্প বিছানায় পড়ে আছেন– সারা শরীর কাঁপছে। বিছানার পাশে একটা টেবিল উল্টে পড়ে আছে। দুএক মুহূর্তের মধ্যেই মিসেস ইঙ্গলথর্প শিথিল ভঙ্গীতে বালিশের ওপর পড়ে গেলেন।
জন তাড়াতাড়ি গিয়ে গ্যাসটা জ্বালাল। পরিচারিকা অ্যানিকে ডেকে একটু ব্র্যাণ্ডি আনতে বলেই মার কাছে এগিয়ে গেল। আমি বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিলাম।
হঠাৎ লরেন্সের মুখ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কী ভয়ার্ত মুখ! বাতি ধরে থাকা হাতটা কাঁপছে আর ও উল্টো দিকের দেওয়ালে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা দেখে যেন ও পাথর হয়ে গেছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে কিছুই বুঝতে পারলাম না।