মিস হাওয়ার্ড এরকম কেন করলেন জিজ্ঞাসা করলাম। পোয়ারো বলল সে প্রথমে এটা বুঝতে পারছিল না। পরে এটারও সমাধান সে করতে পেরেছে। পোয়ারো বলল যেহেতু মিস হাওয়ার্ড ও মিঃ ইঙ্গলথর্প মামাতো পিসতুতো ভাই-বোন সেহেতু মিস হাওয়ার্ড খুন না করলেও ইঙ্গলথর্পের সহচরী হতে কোনো বাধা নেই। আসলে ওদের মতলব ছিল ঐ সরল বৃদ্ধাকে বিয়ে করে এই উইল লিখিয়ে নেওয়া তারপর সুযোগ সুবিধা মতো ওঁকে খুন করে ফেলা। এরপর বাকি জীবন ওঁরই টাকাতে বাইরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে আরামে জীবন কাটানো।
ইঙ্গলথর্পের ওপর যতক্ষণে সকলের সন্দেহ পড়ার ততক্ষণে মিস হাওয়ার্ড সম্পূর্ণ ব্যবস্থা পাকা করে ফেলবেন–এই ছিল তাদের পরিকল্পনা।
মিস হাওয়ার্ড যখন মিডলিংহ্যাম থেকে এলেন তখন কেউ কোনো সন্দেহ করল না। সুযোগমত জনের ঘরে ঐ স্ট্রিকনিন লুকিয়ে রাখলেন। সিন্দুকের মধ্যে দাড়ির গোছাও রেখে দিলেন। ওগুলো যে সময়মত কারও চোখে পড়বে একথা তার জানা ছিল।
আমি বললাম ওরা জনের ওপর দোষ চাপাতে গেল কেন, লরেন্সের ওপরও চাপাতে পারত। আর লরেন্সের হাবভাবও বিশেষ সুবিধের লাগছিল না।
পোয়ারো বলল আমি সেই কারণটা জানি না বলেই একথা বলছি। আসলে লরেন্স ভেবেছিল সিনথিয়াই অপরাধী। আমি বললাম এটা কখনই সম্ভব নয়। পোয়ারো বলল যে অসম্ভব না হওয়ার কিছু নেই। সিনথিয়া ব্রোমাইড পাউডার তৈরি করেছিলেন। ডরকাস বলেছিল যে সিনথিয়া পুরুষের ছদ্মবেশ নিতে পারদর্শী। সুতরাং ওর বিরুদ্ধেই সকলের চেয়ে বেশি সন্দেহ পড়েছে।
পোয়ারো বলতে লাগল, সেই দুর্ঘটনার রাতে লরেন্স তার মার ঘরে ঢুকে খুব ভয় পেয়েছিল। আমি বললাম একথাটা তো আমিই তাকে বলেছিলাম। পোয়ারো মাথা নেড়ে বলে যেতে লাগলেন লরেন্সের সেইসময় নজরে পড়েছিল সিনথিয়ার ঘরে ঢোকার দরজাটার দিকে, এটা ভোলা ছিল।
আমি বললাম লরেন্সই তো বলেছিল দরজাটা বন্ধ ছিল।
পোয়ারো বলল সেজন্যই তো বুঝতে পারা গেল যে লরেন্স সিনথিয়াকে বাঁচাতে চাইছেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাঁচাতে চাইছে কেন। পোয়ারো বলল লরেন্স সিনথিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন।
কথাটা শুনে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, বললাম আমি ভালো ভাবেই জানি লরেন্স সিনথিয়াকে এতটুকু পছন্দ করে না।
পোয়ারো মৃদু হেসে জানতে চাইল আমি একথা কি করে জানলাম। আমি বললাম সিনথিয়া নিজেই বলেছে লরেন্সের পছন্দে-অপছন্দে ওর কিছু যায়-আসে না। পোয়ারো বলল স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম্ বোঝা দুষ্কর।
আমি যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। পোয়ারো বলল এতে অবাক হবার কিছু নেই। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যেত যে সিনথিয়া যখনই জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে হেসে কথা বলেছে তখন লরেন্স ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এর কারণ লরেন্স ভেবেছিলেন সিনথিয়া জনের সঙ্গে প্রেম করছে। সেজন্য যখন লরেন্স দেখলেন ওর মা বিষের দ্বারা মারা গেছেন, তখনও ওর ধারণা হল সিনথিয়া অনেক কিছু জানে। কথাটা ভেবে লরেন্স প্রচণ্ড রেগে গেলেন তাই প্রথমেই কফির কাপটা গুঁড়িয়ে ফেললেন যাতে ওর তলানি আর পরীক্ষা করা না যায়। এরপর থেকেই উনি বলতে লাগলেন মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুটা স্বাভাবিক।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম তাহলে বাড়তি কফির কাপের ব্যাপারটা কি।
পোয়ারো বলল সে নিশ্চিতভাবে জানত যে মিসেস ক্যাভেণ্ডিসই কফির কাপটা লুকিয়েছেন। তাসত্ত্বেও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে লরেন্সকে ঐ কাপটা খুঁজতে বলেছিল। লরেন্সও দেখল এরকম একটা কাপ খুঁজে বের করতে পারলে ওর প্রেমিকার ওপর থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে। এবং বাস্তবে তাই ঘটেছে।
এবার আমার মনের আরেকটা প্রশ্ন পোয়ারোকে করলাম সেটা হল মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাবার সময় যা বলেছিলেন সেগুলোর কি অর্থ? পোয়ারো বলল সেগুলো তার স্বামীর প্রতি দোষারোপ ছাড়া কিছু নয়।
আমি বললাম শেষ পর্যন্ত তাহলে সব ভালোভাবেই মিটল। জনের সঙ্গে মেরীর মিলন ঘটল।
পোয়ারো বলল এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে। আমি জানতে চাইলাম কেন তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে।
পোয়ারো বলল এরকম একটা ঘটনা ঘটল বলেই ওরা পরস্পরের কাছাকাছি আসার সুযোগ পেল এবং মিলন সম্ভব হল। জন ক্যাভেণ্ডিস যে তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন তা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। মেরীরও ভালোবাসার অভাব ছিল না কিন্তু সামান্য ভুল বোঝাবুঝিই ওদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল। মেরী ভালো না বেসেই জনকে বিয়ে করেছিলেন–জন একথা জানত। তবুও সে কখনই মেরীর ওপর জোর করে ভালোবাসা চাপাতে দেয়নি। শুধু ওরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মেরীর মনে প্রেম জেগে ওঠে। কিন্তু ওদের অহমিকাই পরস্পরের কাছে আসার পথে দুস্তর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই ফলস্বরূপ জন মিসেস রেইকসের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হলেন আর মেরী ডঃ বরস্টিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করলেন।
পোয়ারো একটা অদ্ভুত কথা শোনাল। ইচ্ছে করলেই সে জন ক্যাভেণ্ডিসকে তাড়াতাড়ি মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু মেরীর কথা ভেবেই সে তা করেনি। যে চরম বিপদের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে সেটা না হলে ওদের মত দাম্ভিক স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন কখনও সম্ভব হত না।
আমি অবাক বিস্ময়ে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঐ ছোটখাটো মানুষটাকে কত বড়, কত মহৎ মনে হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম সত্যি পোয়ারো ছাড়া আর কারও পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। খুনের কিনারা করতে গিয়ে সে প্রেমের পুনরুজ্জীবন ঘটাল।