সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মিসেস ইঙ্গলথর্পের ওষুধের মধ্য দিয়ে তার শরীরে স্ট্রিকনিন প্রবেশ করেছিল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ ওর ওষুধে স্ট্রিকনিন মিশিয়ে দিয়েছে তাহলে?
পোয়ারো জানাল মেশানোর দরকার হয়নি। সে ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করল। ট্যাডমিনস্টারের রেডক্রশ হাসপাতালের ডাক্তারখানার একটা ওষুধ তৈরির বই থেকে কিছুটা অংশ পড়ে শোনাল-১ গ্রেন স্ট্রিকনিন সালফেট, ১.৫ গ্রেন পটাশিয়াম ব্রোমাইড এবং পরিমাণমত জল নিয়ে মেশান হলে এই দ্রাবকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্ত্রিকনিন ব্রোমাইডের স্ফটিক জমা হয়ে যায়। স্ট্রিকনিন ব্রোমাইডের দানাগুলো জলে দ্রবণীয় নয়। ইংল্যাণ্ডের জনৈকা মহিলা ঠিক এরূপ দ্রাবকের শেষ দাগটি গ্রহণ করে মারা গেছিলেন কারণ ওষুধের শেষ দাগটিতেই একসঙ্গে সব স্ট্রিকনিন জমা হয়েছিল।
পোয়ারো মনে করল সে একটা খালি, ব্রোমাইডের গুঁডোের বাক্সের কথা উল্লেখ করেছিল। ঐরকম একটা বা দুটো ব্রোমাইডের গুঁড়োর পুরিয়া ওষুধে ঢেলে দিলে স্বাভাবিকভাবেই ওর তলায় স্ট্রিকনিন ব্রোমাইডের স্বচ্ছ দানা জমা হবে এবং রোগী ঐ মারাত্মক ওষুধ খেতে বাধ্য হবে একমাত্র শেষ দাগটিতে। মিসেস ইঙ্গলথর্পের ওষুধ দেওয়ার ভার যার ওপর ছিল সে কখনও শিশিটা ঝাঁকাতো না। যার ফলস্বরূপ স্ট্রিকনিনের দানা শিশির নিচেই জমা হয়ে যেত।
সুতরাং দুর্ঘটনাটা ঘটার কথা সোমবার সন্ধ্যায়। কারণ ঐ দিনই মিসেস ইঙ্গলথর্পের বাজানোর ঘন্টাটা সুন্দরভাবে কেটে রাখা হয়েছিল আর সিনথিয়া তো বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে রাত কাটাচ্ছিলেন। সুতরাং প্রয়োজন হলে মিসেস ইঙ্গলথর্প যাতে কারও সাহায্য না পান সেই ব্যবস্থাই হয়েছিল। সুতরাং ডাক্তার ডাকার আগেই তিনি মারা যেতেন।
কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। মিসেস ইঙ্গলথর্প গ্রামের উৎসবে পৌঁছবার তাড়ায় ওষুধ খেতে ভুলে গেছিলেন। পরের দিনও তিনি দুপুরবেলা বাইরে নিমন্ত্রণে গেলেন। সুতরাং শেষের সেই ওষুধের দাগটা তিনি গ্রহণ করেন সেদিন রাতে অর্থাৎ হত্যাকারী যে সময় ভেবে রেখেছিল তার ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরে। পোয়ারো বলল, এই দেরিটা হয়েছে বলেই সেই মারাত্মক সূত্রটা তার হাতে এসে গেছে।
সকলের তীব্র উত্তেজনার মধ্যে পোয়ারো তিন টুকরো পাতলা কাগজের ফালি তুলে দেখালো। পোয়ারো আমাদের দিকে ওগুলো দেখিয়ে বলল, হত্যাকারীর নিজের হাতের লেখা আছে ঐ কাগজে। পোয়ারো কাগজের টুকরোগুলোকে পাশাপাশি রেখে গলা পরিষ্কার করতে করতে পড়তে শুরু করল।
প্রিয়তমা ইভিলিন,
কোনো সংবাদ না পেয়ে বোধ হয় আশ্চর্য হয়ে গেছে। সব কিছুই ঠিক আছে, শুধু গত রাত্রের পরিবর্তে আজ রাত্রেই ঘটনাটা ঘটবে। বুড়ী মারা গেলে সত্যিই আমাদের সুদিন ফিরে আসবে। খুনের দায় কেউ আমার উপর চাপাতে পারবে না। তোমার ঐ ব্রোমাইডের ব্যাপারটা বেশ চমৎকার। তবে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। একটু ভুল হওয়া মানেই–।
চিঠিটা এখানেই শেষ হয়ে গেছে। সম্ভবতঃ চিঠির লেখক কোনো কারণে বাধা পেয়েছিল। তবে লেখকের পরিচয় আর গোপন নেই, হাতের লেখাটা খুবই পরিচিত।
একটা ভয়ানক চিৎকারে ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
একটা চেয়ার কারও ধাক্কায় উল্টে গেল। পোয়ারো তাড়াতাড়ি একপাশে সরে দাঁড়াল। আক্রমণকারী লোকটা পোয়ারোকে শয়তান বলে গালাগাল করতে লাগল, তারপর ভারসাম্য রাখতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
পোয়ারো এবার অদ্ভুত কায়দা করে বলল সে আমাদের সাথে হত্যাকারীর পরিচয় করিয়ে দিতে চায়–ইনি আর কেউ নন–মিঃ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প।
১৩. পোয়ারোর কৃতিত্ব
পোয়ারোকে নিয়ে সত্যি আর পারা যায় না। ও আমাকে খুব বোকা বানিয়েছে। মনে মনে খুব রাগ হল, তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন ও এভাবে আমাকে ঠকিয়েছে।
পড়ার ঘরে বসে আমরা কথা বলছিলাম। কয়েকটা দিন যেভাবে কাটল। জন ছাড়া পেয়েছে। মেরীর সঙ্গে তার পুনর্মিলন ঘটেছে। অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প আর মিস হাওয়ার্ড পুলিশের হেফাজতে–এসবই পোয়ারোর কৃতিত্ব।
আমার অভিযোগ শুনে পোয়ারো বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর একসময় বলল সে আমাকে ঠকায়নি, আমি নাকি নিজেই ঠকে গেছি। তার কারণ আমার মনটা খুব সরল। মনের ভার আমি গোপন রাখতে পারি না। পোয়ারো যদি তার ধারণার কথা আমাকে আগে বলত তাহলে মিঃ ইঙ্গলথর্প আমার মুখ দেখে কিছু আঁচ করে ফেলত আর তাকে কোনোদিনই ধরা সম্ভব হত না। সেজন্য পোয়ারো আমাকে কিছু বলেনি।
পোয়ারোর কথা শুনে আমার রাগটা একটু কম। আমি বললাম তবু সে তো আমাকে একটু আকারে ইঙ্গিত আভাস দিতে পারত।
পোয়ারো কলল সে আমাকে অনেকবারই আভাস দিয়েছে। যেমন সে জনকে অপরাধী বলে ভাবেনি বলেই বার বার বলেছিল জন ছাড়া পাবে বলেই তার ধারণা। আবার এও বলেছিল হত্যাকারীকে ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া বলেছিল মিঃ ইঙ্গলথর্পকে এখনই গ্রেপ্তার করা উচিৎ হবে না।
আমি বললাম তাহলে কি পোয়ারো প্রথম থেকেই মিঃ ইঙ্গলথর্প কে সন্দেহ করেছিল।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বলল প্রথমেই তার মনে হয়েছিল মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে তার স্বামী। কিন্তু মিঃ ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো এত প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছিল যে একসময় পোয়ারোর মনে হয়েছিল মিঃ ইঙ্গলথর্প বোধ হয় হত্যাটা করেননি। সেজন্য পোয়ারোর ধারণা চিন্তাভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।