জুরীদের দিকে তাকিয়ে স্যার আর্নেস্ট বললেন জন ক্যাভেণ্ডিস ছাড়াও অন্য আরও অনেকের বিরুদ্ধেই প্রমাণ আছে বিশেষতঃ লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের বিরুদ্ধে কোনো অংশে তার ভাইয়ের চেয়ে কম প্রমাণ নেই।
এবার স্যার আর্নেস্ট জনের সাক্ষ্য নিতে চাইলেন। জন সাক্ষীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াল। জেরার মুখে জন চমৎকারভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করল। নিজের আর্থিক অনটনও সত্মার সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা যেভাবে স্বীকার করল তাতে ফলটা ভালোই হল।
সাক্ষ্যের শেষে জন বলল একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সে স্যার আর্নেস্টের অভিযোগের বিরুদ্ধে বলতে চায় যে তার ভাই লরেন্স তার মতই নিরপরাধ।
কথাটা শুনে স্যার আর্নেস্ট শুধুমাত্র হাসলেন। জুরীদের মনে কথাটা ভালো ধারণারই সৃষ্টি করেছে বলে মনে হল।
এবার সরকার পক্ষের জেরা শুরু হল।
মিঃ ফিলিপস আক্রমণ হানলেন অন্য দিকে থেকে, জিজ্ঞাসা করলেন। জন বেশ সুযোগ বুঝেই তাহলে চিরকুটটা দাখিল করেছেন। উকিল বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ঐ হাতের লেখাটা জনের। তার ধারণা একটা অজুহাত তৈরি করার জন্য। জন নিজেই সেই চিরকুট লিখেছিলেন। জন বললো এ কাজ সে করেনি।
ফিলিপস বললেন তিনি চিরকুট, খাতা ও জনের হাতের লেখা কিছু নমুনা জুরীদের বিবেচনার জন্য দাখিল করছেন। মিঃ ফিলিপস একথা বলে বিজয়ীর ভঙ্গীতে আসন গ্রহণ করলেন।
সেদিনের মত আদালতে স্থগিত ঘোষিত হল।
পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখে একরাশ বিরক্তি আর চিন্তা। আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পেলাম না।
বাড়িতে পৌঁছতেই মেরী চা দিতে এলেন। পোয়ারো চা খেলো না। সে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। পোয়ারোর দুশ্চিন্তা তখনও কাটেনি দেখলাম। ও দেরাজ খুলে এক প্যাকেট তাস বের করল। তারপর টেবিলে বসে তাসের ঘর তৈরি করতে লাগল।
আমি অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই বলল সে তার স্নায়ুগুলোকে স্থির করার জন্য তাসের বাড়ি বানাচ্ছে। আঙ্গুলগুলো স্থির হলেই মস্তিষ্কের অস্থিরতাও দূর হবে, তখন ঠিকমত চিন্তাভাবনা করা যাবে।
অবাক হয়ে পোয়ারোর তাসের ঘর তৈরি দেখতে লাগলাম। একের পর এক ঘরগুলো উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। মনে হল যেন কোনো যাদুর খেলা দেখছি। আমি হঠাৎ বলে উঠলাম পোয়ারোর হাত দুটো তো বেশ স্থির হয়ে গেছে। অনেকদিন আগে একবার শুধু তার হাত কাঁপতে দেখেছিলাম।
পোয়ারো বলল, প্রচণ্ড রাগ হলেই তার হাত কাঁপে।
আমি বললাম, ঠিক তাই।মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে যখন নথীব্যাগটার তালাটা কেউ জোর করে খুলেছে বলে পোয়ারো বলেছিল, তখন তাপচুল্লীর তাকের উপর জিনিষগুলো গুছিয়ে রাখার সময় তার হাত ভীষণভাবে কঁপতে দেখেছিলাম।
আমার কথা মাঝপথেই থেমে গেল। পোয়ারো হঠাৎ খুব জোরে আর্তনাদ করে তাসের ঘরগুলো ভেঙে ফেলল। তারপর দুচোখে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। আমি তার কি হয়েছে জানতে চাইলে পোয়ারো বলল তার একটা কথা মনে পড়েছে। আর সেটা নাকি আমি তাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছি।
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পোয়ারো লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে এসে আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আমি ছুটে জানলায় গিয়ে দেখলাম রাস্তা দিয়ে পোয়ারো আপন মনে বকবক করতে করতে ছুটছে। বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। রাত গড়িয়ে যেতে লাগল কিন্তু পোয়ারোর দেখা মিলল না।
১২. অস্বস্তিতে পড়লাম
হঠাৎ পোয়ারোর ওভাবে চলে যাওয়াতে খুবই অস্বস্তিতে পড়লাম। রবিবার এসে গেল, কিন্তু পোয়ারো তবু বেপাত্তা। বেলা তিনটে নাগাদ একটা শব্দ শুনে শুনলাম এসে দাঁড়াতেই দেখলাম একটা গাড়ি থেকে পোয়ারো এবং স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সেই দুজন গোয়েন্দা জ্যাপ আর সামারহে নামছেন।
পোয়ারোর চোখে মুখে উচ্ছ্বাস দেখলাম। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে দেখে ও যেন খুশীতে ফেটে পড়ল। সে মেরীর ঘরে একটা সভার আয়োজন করার অনুমতি চাইল। তাতে সকলের উপস্থিতি একান্ত কাম্য বলে জানাল।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন তিনি তো পোয়ারোকে সব ক্ষমতাই দিয়েছেন।
পোয়ারো খুশী মনে আমাদের সকলকে বসার ঘরে নিয়ে চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখতে লাগলো। এক একটা চেয়ার দেখিয়ে পোয়ারো বলতে লাগল এখানে মিস হাওয়ার্ড বসবেন, এখানে সিনথিয়া, তার পাশে মাসিয়ে লরেন্স বসবেন। আর দুটো চেয়ার দেখিয়ে বলল সেখানে ডরকাস আর অ্যানী বসবে। পোয়ারো বলল শুধু মিঃ ইঙ্গলথর্প আসবেন কিনা সেটাই ব্যাপার।
মিস হাওয়ার্ড কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠে বললেন মিঃ ইঙ্গলথর্প এখানে এলে তিনি চলে যাবেন। পোয়ারো তাড়াতাড়ি মিস ওয়ার্ডের কানে কানে কিছু বলতেই উনি চুপ করে গেলেন।
একটু পরেই মিঃ ইঙ্গলথর্প এসে গেলেন।
সবাই আসন গ্রহণ করতেই একজন কৌশলী বক্তার মত পোয়ারো তার বক্তৃতা শুরু করল, বলতে লাগল–এই রহস্যের তদন্তের ভার জন ক্যাভেণ্ডিস তার ওপর দিয়েছিলেন। তদন্তের শুরুতে পোয়ারো মৃতা মিসেস ইঙ্গলথর্পের শোবার ঘর পরীক্ষা করে। ঘরটা ডাক্তার দুজনের পরামর্শমত বন্ধ রাখা ছিল, ফলে দুর্ঘটনার পর থেকে ঐ ঘরটা সেইভাবেই ছিল। পোয়ারো জানাল অনুসন্ধান চালিয়ে সে ঘর থেকে তিনটে জিনিস পেয়েছে, প্রথমতঃ এক টুকরো সবুজ সুতো দ্বিতীয়তঃ জানলার কাছে কার্পেটের ওপর কিছু ভিজে দাগ আর তৃতীয়তঃ একটা ব্রোমাইডের গুঁড়োর খালি বাক্স।