অবাক বিস্ময়ে পোয়ারোর চোখের দিকে তাকালাম। সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞাসা করলাম বোতলে কি ছিল, জানলার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো উত্তর দিল স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড।
পোয়ারোর উত্তর শুনে শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো বলতে থাকে আসলে স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড খুব কমই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তরল স্ট্রিকনিন সাধারণতঃ ওষুধে ব্যবহার করা হয়। এই জন্যই বোতলের ছাপটা এখনও নষ্ট হতে পারেনি।
আমি জানতে চাইলাম ঐ ছাপের ছবি কিভাবে তুলেছে সে। পোয়ারো জানাল সে তার টুপিটা বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিল। বাইরের অতিথিদের তো ঐ সময়ে নিচে যেতে দেওয়া হয় না তাই সিনথিয়ার ঐ সহকারিণী মেয়েটি ওটা আনার জন্য নিচে যেতেই পোয়ারোর কাজ হয়ে যায়।
আমরা কথা বলছিলাম, এমন সময় একজন বেলজিয়ান ভদ্রলোক এসে জানালেন নিচে একজন ভদ্রমহিলা মিঃ হেস্টিংসের খোঁজ করছেন।
আমি আর পোয়ারো দুজনেই তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম। দরজার সামনে দেখলাম মেরী ক্যাভেণ্ডিস দাঁড়িয়ে আছেন। মেরী বললেন তিনি গ্রামের এক বুড়িকে দেখতে গেছিলেন। লরেন্সের কাছে শুনেছন আমি এখানে আছি তাই তিনি এসেছেন। পোয়ারো রসিকতার সুরে বলল সে ভেবেছিল মেরী তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মেরী হেসে বললেন আরেকদিন তিনি আসবেন।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস পোয়ারোকেও তার সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। পোয়ারো রাজী হলে আমরা একসঙ্গে স্টাইলসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম।
আমরা সকলে স্টাইলসের বড়ো দরজার কাছে পৌঁছতেই আমাদের অবচেতন মন বলে উঠল একটা কিছু যেন ঘটেছে।
হঠাৎ ডরকাস ছুটে এল। কান্নাঝরা মুখে দু হাত ঢেকে সে কী যেন বলতে গেল, কিন্তু বলে উঠতে পারল না। বাড়ির অন্যান্য পরিচারকরাও একপাশে দাঁড়িয়ে কানাকানি করছে।
আমি ডরকাসকে জিজ্ঞাসা করলাম কি ঘটনা ঘটেছে। ডরকাস অতি কষ্টে বলল ঐ গোয়েন্দারা মিঃ ক্যাভেণ্ডিসকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম লরেন্সকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। ডরকাসের চোখে একটা অদ্ভুত ভাব খেলে গেল, বলল মিঃ লরেন্সকে নয়, গোয়েন্দারা মিঃ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কথাটা শুনেই আর্তনাদ করে মেরী ক্যাভেণ্ডিস আমার কাঁধে ঢলে পড়লেন। তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেলতেই পোয়ারোর মুখের ওপর নজর পড়ল–একটা শান্ত জয়োল্লাসের ঝিলিক যেন পোয়ারোর চোখে খেলে গেল।
১১. জনের বিচারের দিন
শেষ পর্যন্ত জনের বিচারের দিন এগিয়ে এল। দুমাস ইতিমধ্যে কেটে গেছে। সত্মাকে হত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে জন ক্যাভেণ্ডিস হাজির হল পুলিশ আদালতের আসামীর কাঠগড়ায়। এই সুদীর্ঘ দুটি মাস শুধু মেরী ক্যাভেণ্ডিসের বেদনা আর যন্ত্রণারই ইতিহাস। অবাক বিস্ময়ে শুধু ওর অদ্ভুত ধৈৰ্য্য আর মানসিক দৃঢ়তা দেখলাম। স্বামীর বিপদের সঙ্গে সঙ্গে মেরী ক্যাভেণ্ডিস পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্বামীকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ভেবেই জীবনপণ করে তার মুক্তির চেষ্টা করতে লাগলেন।
জন যে দোষী হতে পারে একথা বিশ্বাস করতে মন সায় দিল না। সে আমার এতদিনের পুরনো বন্ধু। পোয়ারো আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল প্রত্যেক খুনীই তো কারও আত্মীয় আবার কারও বা বন্ধু। ভাব প্রবণতার সঙ্গে যুক্তিকে মিশিয়ে ফেললে চলবে না।
পোয়ারোর দার্শনিক তত্ত্ব মানতে মন চাইল না। জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হবে কিনা জানতে চাইলাম। পোয়ারোর উত্তর শুনে খুবই অবাক হলাম। ও বলল জন ছাড়া পাবে বলেই ওর ধারণা।
আমি পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কোনোদিন জনকে সন্দেহ করেছিল কিনা। সে উল্টে আমার সন্দেহ হয়েছিল কিনা জিজ্ঞাসা করল। আমি মাথা নাড়লাম। পোয়ারো বলতে লাগল সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল–মিসেস ক্যাভেণ্ডিস আর ওঁর শাশুড়ীর কথাবার্তার টুকরো অংশগুলো শুনে বা মেরী ক্যাভেণ্ডিস তদন্তের সময়ে যে অনেক কিছু গোপন করে গেছেন এটা দেখে। পোয়ারো আমাকে বুঝিয়ে বলল, ঝগড়াটা যদি অ্যালফ্রেডের সঙ্গে মিসেস ইঙ্গলথর্পের না হয়ে থাকে, যেটা অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প জোরের সঙ্গে অস্বীকার করেছেন–তাহলে সেটা হয়েছিল লরেন্স বা জানের সঙ্গে ওদের মা মিসেস ইঙ্গলথর্পের। এখন ঐ ঝগড়া যদি লরেন্সের সঙ্গে হয়ে থাকে তাহলে কিছু বলার নেই, কিন্তু যদি ঝগড়াটা জনের সঙ্গে হয়ে থাকে তাহলে মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের ঐ রকম ব্যবহারের একটা সুন্দর অর্থ পাওয়া যায়।
আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম ঝগড়াটা তাহলে সেদিন জনের সঙ্গে হয়েছিল।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল তার ধারণা তো তাই। পুলিশের আদালতে অভিযোগের বয়ান শোনা যাবে। পোয়ারো একটা অদ্ভুত কথা আমাকে শোনাল যে সে এ ব্যাপারে আর থাকছে না।
কথাটা শুনে আমি চমকে গেলাম। পোয়ারো বলল সরকারীভাবে এতে তার আর কিছু করণীয় নেই। শেষের সূত্রটা না পাওয়া পর্যন্ত সে আড়ালেই থাকতে চায়। এছাড়াও আরো একটা কারণ আছে। সেটা হল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস যেন মনে করতে না পারেন যে তার স্বামীর বিরুদ্ধে সে কাজ করছে।
একথাটা শুনে আমার একটুও ভালো লাগল না। পোয়ারো আমাকে আশ্বস্ত করে বলল একটা প্রচণ্ড চালাক লোককে খুঁজে বের করতে হবে। জ্যাপ সব সূত্রই খুঁজে পেয়েছে। আর তাকে যদি সাক্ষ্য দিতে হয় তাহলে সেটা আসামীর পক্ষেই দেবে সে। আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। পোয়ারো বলতে লাগল যে সে এমন একটা সাক্ষ্য দিতে পারে যাতে অন্ততঃ একটা ব্যাপারে জনের নির্দোষিতা প্রমাণ হবে।