আমি শুনে যেতে লাগলাম। মেরী বলল জন হয়ত প্রথমে তাকে ভালোবাসতেই চেয়েছিল কিন্তু পরে তারা বুঝতে পেরেছিল যে এ হবার নয়, তখনই তারা দূরে সরে যায়।
কথাটা শুনে আমি একটু আপত্তি করে কিছু বলতে যেতেই মেরী বাধা দিয়ে বললেন কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি আর সেজন্য তারা প্রায় বিচ্ছেদের মুখেই এসে দাঁড়িয়েছে। শান্ত কণ্ঠে মেরী জানালেন তিনি স্টাইলসে আর থাকবেন না।
আমি শুধু জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন? বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত মেরী বললেন তিনি মুক্তি পেতে চান।
আমার মুখে কোনো কথা ফুটল না শুধু হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হঠাৎ মেরী জোরে চিৎকার করে বলে উঠল এই জায়গাটা তার কাছে বন্দীশালার মত মনে হচ্ছে। আমি বললাম যে তার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবু আমার অনুরোধ তিনি হঠাৎ যেন কিছু করে না বসেন।
কথাটা শুনে মেরী ক্যাভেণ্ডিস অদ্ভুত মুখভঙ্গী করলেন। আমারও হঠাৎ কি খেয়াল হল, বলে ফেললাম ডাঃ বরস্টিন যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সে খবর তিনি জানেন তো? মেরীর মুখভাবটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বলে উঠলেন, সকালবেলাতেই জন দয়া করে তাকে খবরটা দিয়েছে। কথার ধরনে তার মনোভাবটা আঁচ করতে পারলাম।
আমি জানতে চাইলাম খবরটা শুনে তার কি মনে হচ্ছে? মেরী বললেন কিছুই মনে হবার নেই লোকটা জার্মান গুপ্তচর এই কথা তিনি শুনেছেন।
ওর মুখ দেখে মনের ভাব বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। মেরীকে সম্পূর্ণ পাষাণ প্রতিমা বলে মনে হল, কোনো অনুভূতির লেশমাত্রও যেন নেই। ডাঃ বরস্টিনের প্রতি ওর সত্যিই কোনো টান আছে কিনা বোঝা অসম্ভব। হঠাই মেরী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম, সত্যিই অদ্ভুত চরিত্রের মহিলা ইনি। যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি।
পরদিন সকালেও পোয়ারোর সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদেরও পাত্তা নেই। শুধু দুপুরে খাওয়ার সময় একটা ঘটনা ঘটল। ব্যাপারটা অবশ্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাওয়ার আগের দিন লেখা সেই চতুর্থ চিঠিটার একটা হদিশ পাওয়া গেল। ব্যাপারটা এক ফরাসী সঙ্গীত মুদ্রাকরের চিঠির মাধ্যমে জানা গেল। ওরা মিসেস ইঙ্গলথর্পের পাঠানো টাকার প্রাপ্তি স্বীকারের পর জানিয়েছেন রুশ লোকসঙ্গীতের সক্কলন ওরা যোগাড় করে উঠতে পারেনি।…এর ফলে চিঠির মধ্য দিয়ে রহস্য সমাধানের আশাও নির্মূল হয়ে গেল।
চা খাওয়ার আগে আরেকবার পোয়ারোর খোঁজে ওর আস্তানায় গেলাম। ওর দেখা না পেয়ে ভীষণ বিরক্তি লাগল। ওরই এক প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর খবর। তিনি জানালেন পোয়ারো ট্যাডমিনস্টারে এক মহিলার ডাক্তারখানা দেখতে গেছেন। মনে মনে ভাবলাম সিনথিয়া বুধবার ওখানে যায় না জেনেও পোয়ারো কি করতে ওখানে গেছে। যাই হোক প্রতিবেশীকে বলে এলাম পোয়ারো ফিরলে কাল সকালে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
পরদিনও পোয়ারোর কোনো দেখা নেই। খাওয়াদাওয়ার পর লরেন্স আমাকে জিজ্ঞাসা করল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করতে যাব কিনা। অগত্যা অভিমান রেখে পোয়ারোর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এবার কিন্তু হতাশ হতে হল না। ঘরে ঢুকে দেখলাম পোয়ারো দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। আমার পায়ের শব্দে চমকে উঠে দাঁড়াল ও। তার শরীর খারাপ কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। পোয়ারো মাথা নাড়ল।
কি করব বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শেষ ওকে জানালাম যে লরেন্স বলেছে সে বাড়তি কফির কাপটা খুঁজে পেয়েছে। পোয়ারোকে সেই চিঠির কথাটাও জানালাম।
পোয়ারো বলল তাহলে চিঠির থেকে কিছু তথ্য পাওয়ার আশা আর রইল না। এবার পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞাসা করল হাতের ছাপ সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা আছে কিনা। আমি বললাম সে রকম কোনো ধারণা আমার নেই, শুধু এটুকু জানি যে দুজন মানুষের হাতের ছাপ একরকম হতে পারে না।
পোয়ারো একটা ছোট দেরাজ খুলে কয়েকটা ফটো বের করে টেবিলে রেখে বলল ফটোগুলোতে এক, দুই, তিন নম্বর দেওয়া আছে। এগুলো সম্বন্ধে আমার ধারণা সে জানতে চাইল।
পোয়ারোর অনুরোধে ভালো করে ছবিগুলো লক্ষ্য করলাম। দেখলাম, এগুলো অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এক নম্বর ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে কোনো পুরুষের বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীর। দ্বিতীয় ছবিটা কোনো স্ত্রীলোকের–এটা তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট। আর তৃতীয়টা মনে হচ্ছে এক নম্বরেরই হাতের ছাপ।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে পোয়ারো ছবিগুলো আবার দেরাজে বন্ধ করে রাখল। আমার কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল এক নম্বর হাতের ছাপটা মঁসিয়ে লরেন্সের হাতের ছাপ। দুনম্বরটা হল সিনথিয়ার। শুধু তিন নম্বরটাই গোলমেলে। ছবিটার ওপর একটা কালো দাগ রয়েছে দেখতে পেলাম।
আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলাম ছবিগুলো কোথায় তুলেছে। পোয়ারো জানাল তিন নম্বর ছবিটা ট্যাডমিনস্টারের রেডক্রশ হাসপাতালের ডাক্তারখানার বিষের আলমারীর ওপরের তাকে রাখা একটা ছোটো বোতলের ছবি। ছবিটা বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেখান হয়েছে।
আমি কথাটা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে বললাম লরেন্সের হাতের ছাপ ওখানে কি করে গেল। আমরা যেদিন ওখানে গেছিলাম সেদিন তো লরেন্স আলমারীর কাছে যায়নি।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল যে আমার ভুল হচ্ছে, আমরা সবসময় একসঙ্গে থাকিনি। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল বারান্দা থেকে আমি লরেন্সকে একবার ডেকেছিলাম। আমি বললাম সে তো সামান্য সময়ের ব্যাপার। পোয়ারো বলল একজন ভেষজ ছাত্রের কাছে ঐ সময়টুকুর মধ্যে অনুসন্ধিৎসা পূরণ করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল।