স্টাইলসের সেন্ট মেরী গ্রামটা স্টেশন থেকে অন্ততঃপক্ষে মাইল দুই দূরে। আরও মাইল খানেক ভেতরে গেলে তবে স্টাইলস কোর্ট।
জুলাই মাস, গরমও পড়েছে প্রচণ্ড। এসেক্সের সবুজ প্রান্তর দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখলে কে বলবে, কিছু দূরে কি ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। আমার মনে হল অন্য কোনো জগতে যেন এসে পড়েছি।
জন বলে উঠল এ জায়গাটা আমার বেশি শান্ত বলে মনে হতে পারে। আমি তাকে বললাম ঠিক এরকম পরিবেশই আমার চাই। কাজকর্ম না থাকলে এরকম জায়গাই সময় কাটানোর পক্ষে উপযুক্ত।
জন জানাল সে সপ্তাহে দুদিন স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কাটায়, খামার টামার দেখে। তার স্ত্রীও সকাল পাঁচটা থেকে দুধ দোয়ানোর কাজে লেগে যায়। তাদের সব কিছুই বেশ ভালোভাবে কাটছিল। কিন্তু ঐ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প সব গোলমাল করে দিল। কথা বলতে বলতে জন ঘড়ি দেখে বলল সে সিনথিয়াকে তুলে নেবে কিনা ভাবছে নাকি এতক্ষণে সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম সিনথিয়া কি তার স্ত্রী। জন বলল সিনথিয়া হল তার মার আশ্রিতা–এক স্কুলের বান্ধবীর মেয়ে। সিনথিয়ার মা এক হতভাগ্য সলিসিটরকে বিয়ে করেছিলেন। লোকটা মেয়েটাকে অনাথ করে রেখে যায়। জনের মা দুবছর আগে ওকে। এখানে আশ্রয় দিয়েছে। সিনথিয়া সাত মাইল দূরে ট্যাডমিন্স্টার রেডক্রশ হাসপাতালে কাজ করে।
কথা বলতে বলতে আমরা একটা সুন্দর পুরনো বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, সেখানে একজন মহিলা ফুলগাছের ওপর ঝুঁকে কি যেন করছিলেন। তার পরনে আঁটোসাঁটো টুইডের পোশাক। আমাদের দেখতে পেয়েই তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
জন সেই মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। মহিলার নাম বলল মিস ইভি হাওয়ার্ড। আর আমার পরিচয় দিল বীরপুঙ্গব হেস্টিংস বলে। নামের আগে জন বেশ বড়সড় একটা বিশেষণ যোগ করল।
মিস হাওয়ার্ড বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি মিস ইভিকে বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করলাম। বেশ রোদে ঝলসানো মুখ, নীল চোখের মণিবয়স প্রায় চল্লিশ, মুখের গড়নটা যেন একটু পুরুষালী। চেহারাটাও বেশ ভারিক্কী। তবে মহিলার কথাবার্তা কেমন যেন খাপছাড়া লাগল। আমাকে দেখে প্রথমেই বললেন এখানে অনেক আগাছার উৎপাত। আমি যেন সাবধানে থাকি, নাহলে জড়িয়ে পড়ব।
আমি বললাম সকলের সঙ্গেই না হয় মানিয়ে নেবার চেষ্টা করব। সঙ্গে সঙ্গে ইভি বললেন আমার প্রথমেই এ কথা বলা উচিৎ নয় কারণ পরে হয়ত আমার এজন্য পস্তাতে হতে পারে।
আমাদের কথা শুনে জন হাসতে হাসতে বলল ইভির কথার কোনো ছিরি ছাঁদ নেই। সে জানতে চাইল সেদিন চায়ের ব্যবস্থা ভেতরে হয়েছে না বাইরে হয়েছে। চা খাওয়ার জন্য জন তাগাদা দিতে লাগল।
হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে মিস হাওয়ার্ড আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। একটা ডুমুর গাছের নিচে চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এখানেই প্রথম জনের স্ত্রী মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে দেখলাম। জন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম–লম্বা ঋজু চেহারা, স্বপ্নালু বাদামী রঙের চোখ–যা আমি আগে কখনও দেখিনি। আকর্ষণ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওর, চেহারাটার মধ্যে একটা শিথিল বন্য উদ্দামতা আর শান্ত দৃঢ়তা অথচ দেখলে মনে হয় যেন কেমন কোমল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে এই প্রথম দেখার ক্ষণটুকু আমার স্মৃতিপটে চিরদিনের মত গাথা হয়ে গেল।
শান্ত স্বরে মেরী আমাকে স্বাগত জানালেন। একটা বেতের চেয়ার টেনে আমি বসে পড়লাম আর মনে মনে জনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলাম।
চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মেরী ক্যাভেণ্ডিস দুএকটা কথা বললেন। আমিও প্রত্যুত্তর দিতে লাগলাম। আমার আরোগ্যকালীন স্বাস্থ্যবাসের দুএকটা মজার কাহিনীও বললাম। ভদ্রমহিলার মনে হয় শুনতে ভালোই লাগছিল। জন চুপচাপ বসে রইল, ও অবশ্য কোনোদিনই কথাবার্তায় পটু নয়।
কথাবার্তায় সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। বুঝতে অসুবিধা হল না ওই কণ্ঠস্বর জনের মা মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের। তিনি কারও উদ্দেশ্য কিছু বলছিলেন। আলফ্রেড বলে কাকে সম্বোধন করছেন, বুঝতে পারলাম উনিই তার স্বামী, মিঃ ইঙ্গলথর্পৰ্প।
একটু পরে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন শুভ্রকেশা এক মহিলা আর তার পেছনে এক আজ্ঞাবহ পুরুষ। আমাকে দেখেই জনের মা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন আমাকে দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছেন। তিনি তার নতুন স্বামীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আলফ্রেড ইঙ্গলথর্পকে আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখলাম। লোকটাকে দেখলেই মনে বিতৃষ্ণা জাগে। মুখে কালো একগোছা দাড়ি। চোখে সোনার ফ্রেমে বাঁধানো পাঁশনে, গলার স্বরটা কর্কশ এবং অদ্ভুত ধরনের। ভদ্রলোক যেন নিষ্প্রাণ হাত দিয়ে করমর্দন করলেন আর বললেন আমার সঙ্গে আলাপ করে নাকি তিনি আনন্দিত হয়েছেন। এরপর স্ত্রীর চেয়ারের কুশনটা গদগদ হয়ে বদলে দিলেন।
মিসেস ইঙ্গলথর্প অর্থাৎ জনের মারও দেখলাম বেশ গা ভাব, বুড়ো বয়সের প্রেম তে। এসব দেখে আমার বেশ মজাই লাগল।
মিঃ ইঙ্গলথর্প আসার পর থেকেই যে একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে পারলাম। লোকটাকে আমিও ঠিক সহ্য করতে পারছিলাম না। ..