পুনঃ খবরের কাগজে তোমার দিদিভাই টাম্পলিনের সঙ্গে তোমার নাম দেখলাম। প্রার্থনা করি অহেতুক দম্ভ বা অসার আত্মশ্লাঘা তোমার চারিত্রিক মাধুর্যকে যেন বিনষ্ট করে।
ক্যাথারিন বার কয়েক চিঠিটা পড়ল। সেন্ট মেরী মিড়-এর স্মৃতি তার চোখে ভেসে আসতে লাগল। তার কেমন যেন কান্না পেয়ে গেল। হঠাৎ লেনক্স এসে ঘরে ঢুকল।
–কি হয়েছে মাসী?
–কই, কিছু না তো।–চিঠিটা ব্যাগে রাখতে রাখতে ক্যাথারিন বলল।
–কিছু না? তবে মুখ ভার কেন?
–ডিনার-এর চিঠি পেলাম, ওর ক্যান্সার হয়েছে। তাই মনটা খারাপ লাগছে। বল, কি বলবে?
-রাগ করবে না তো। জান, আমি না, তোমার সেই ডিটেকটিভ বন্ধু পোয়ারোকে তোমার নাম করে ফোন করে নিস্-এ আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছি। আমি ভাবলাম, তোমার নাম করে না বললে হয়তো উনি রাজী হবেন না। রাগ করলে মাসী?
-রাগ করতে যাব কেন? তুমি তাহলে ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও?
–সে আর বলতে! আমি বোধহয় ওর প্রেমেই পড়ে গেছি।
–বুঝতে পেরেছি। তাই কয়েকদিন ধরেই দেখছি শুধু ড্রেক ক্যাথারিন-এর গ্রেপ্তার। আর ব্লু ট্রেনের কথা বলছ বিশেষ করে ড্রেক-এর গ্রেপ্তারের পর থেকে।
–আমি গাড়ি বের করতে বলছি ড্রাইভারকে। মাকে বলিনি কারণ মা তাহলে আমাদের সঙ্গে যাবে আর মা গেলে আমি কোনো চান্সই পেতাম না কথা বলার। শুধু শ্রোতা হয়েই থাকতে হতো।
–ঠিক আছে, তুমি নিচে নাম, আমি আসছি। লেনক্স ও ক্যাথারিন নেগ্রেসকোতে পৌঁছে দেখল পোয়ারো ওদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। পোয়ারোর অভিনন্দন জানানোর সুন্দর ভঙ্গি ওদের দুজনকেই মুগ্ধ করল। আহারের সময় পোয়ারোর কথার মাধুৰ্য্য আহার্যকে আরও উপভোগ্য করে তুলল। ক্যাথারিন চুপ করেছিল। আহার শেষে কফি খেতে খেতে লেনক্স বলল, কতদূর হলো মিঃ পোয়ারো? কি বললাম বুঝতে পেরেছেন?
হাতের আঙ্গুল মটকালেন পোয়ারো। তাদের সুবিধেমত তারা কাজ করছে।
–আর আপনি বসে বসে দেখছেন।
-মাদমোয়াজেল। আপনি তরুণী, আপনার গতিবেগ চঞ্চল। কিন্তু তিনটে জিনিসের গতি ধীর হয়। যা কখনও তাড়াতাড়ি হয় না। ভালোবাসা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। ফুল ধীরে ধীরে ফোটে আর ধীরে ধীরে কাজ করে বুড়োরা।
–ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আহা, আপনি মোটেই বুড়ো নন।
–সত্যি? শুনলেও ভালো লাগে।
–কিংটন আসছেন। সঙ্গে মিঃ আলডিনও আসছেন দেখছি।
-আমি চট করে একটা কথা মিঃ কিংটনকে জিজ্ঞেস করেই এখুনি আসছি।–লেনক্স উঠে গেল।
-আপনাকে আনমনা লাগছে কেন? কত দুরের চিন্তা করছেন? পোয়ারো বললেন।
-খুব বেশি দূরের নয়।–ব্যাগ থেকে ডিনারের চিঠিটা বের করে পোয়ারোর হাতে দিলেন।
চিঠিটা পড়ে পোয়ারো বললেন, আপনি তাহলে ফিরে যাচ্ছেন ইংলণ্ডে?
–না। আপাতত যাচ্ছি না। কেনই বা যাব।
–ও। আমারই ভুল হয়েছিল। এক মিনিট একটু আসছি। পোয়ারো উঠে দেখেন মিঃ কিংটন, মিঃ আলডিন ও লেডী টাম্পলিন যেখানে ছিল সেখানে গেলেন। মিঃ আলডিনের চেহারা খুব খারাপ লাগছে এবং পোয়ারোকে দেখে তিনি বেশি একটা খুশী হলেন না।
পোয়ারো কিংটনকে পাশে ডেকে বললেন, মিঃ আলডিন কি অসুস্থ?
–আর অসুস্থ হবেন না? মেয়ে খুন হল, আর খুনী কিনা জামাই। এখন আপনার হাতে তদন্ত দিয়েছেন বলে ওর আফসোস হচ্ছে।
–ওঁর ইংলণ্ডে ফিরে যাওয়া উচিত মিঃ কিংটন। ওকে সেখানে নিয়ে যান।
–আমরা তো পরশুদিনই ইংলণ্ডে যাচ্ছি।
–তাই নাকি। খুব ভালো কথা। মিস গ্রেকে বলবেন।
–কি বলব?
–এই আপনার, মানে মিঃ আলডিনকে নিয়ে ইংলণ্ডে ফিরে যাবার কথা।
কিছুক্ষণ পরে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে নানারকম আলোচনা করতে লাগলেন। ক্রমে বিদায় নেবার পালা এলো। প্রথমেই মিঃ আলডিন ও তার সেক্রেটারী বিদায় নিলেন।
-খুব ভালো লাগল আপনাদের এমন মধুর সঙ্গ। অন্যদিনের চেয়েও আজকের খাবার যেন বেশি সুস্বাদু মনে হলো। আপনাদের সঙ্গদানের ফলে। পোয়ারো বললেন, এখন প্রাণশক্তিতে ভরপুর আমি। হাসবেন না মিস গ্রে। আপনি দেখেছেন এক নির্জীব নিরীহ এরকুল পোয়ারোকে, কিন্তু তার আরও একটা বিপরীত রূপ আছে। সে চেহারা জানে অন্য এক জগতের লোকেরা। তাদের কাছে এরকুল পোয়ারোর উপস্থিতি মৃত্যুর উপস্থিতির সমতুল্য, ক্যাথারিন-এর মনে হলো। যে পোয়ারো কথা বলছিলেন এখন যেন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক। ক্যাথারিন যেন পোয়ারোর দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করল।
-এবারও বুদ্ধির লড়াইতে এরকুল পোয়ারোর জিত হবে। হা, জিত নিশ্চয়ই হবে। চললাম মাদমোয়াজেল। কয়েক পা এগোতেই পেছনে ক্যাথারিন বললেন,
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কথাই ঠিক। আমি ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাচ্ছি।
–তাই নাকি!
–বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না?
-না, তা নয়। ভাবছি পোয়ারো কি করে আগেই জানলো। পোয়ারো গাড়িতে উঠে বললেন, কাউন্ট দ্য লা রোচির বাড়ি চল।
কাউন্টের বাড়িতে এসে দরজায় বেল টিপলেন পোয়ারো। দরজা খুলে গেল।
–আজ্ঞে, কাউন্ট তো বাড়ি নেই।
–আমি জানি তা। তুমি হিপোলাইট ফ্লাভেল না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
–মেরী ফ্ল্যাভেল তোমার বউ না?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু…
–তোমাদের দুজনকেই আমার দরকার আছে।
বলতে বলতে হিপোলাইটকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন পোয়ারো। তোমার বউ নিশ্চয়ই রান্নাঘরে? হিপোলাইট কিছু বুঝে ওঠার আগেই পোয়ারো হলঘরের উল্টোদিকের দরজা দিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে অদৃশ্য হলেন রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।