- বইয়ের নামঃ দ্য ড্রিম
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
দ্য ড্রিম
১. বনেদী ঐতিহ্যের বাহক
এরকুল পোয়ারো সপ্রশংস দৃষ্টিতে একঝলক তাকিয়ে দেখে নিল বাড়িটা এবং তার পার্শ্বস্থ পরিবেশ। চারিধারে বেশ সাজানো গোছানো নানা ধরনের বিপণী। একটা বিরাট ফ্যাক্টরি বিল্ডিং ডান দিকে। ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করা সুলভ মূল্যের ফ্ল্যাটবাড়ি বিপরীত দিকে। তার দু-চোখের কৌতূহলী দৃষ্টি সেই বিরাট নর্থওয়ে হাউসের দিকেই আকৃষ্ট হলো, তারপর ঘুরে ফিরে যেন প্রাচীনকালের কোনো বনেদী ঐতিহ্যের বাহক সেই বাড়িটি। যখন সারা পৃথিবীর বিস্তীর্ণ মাঠ খেত খামার শ্যামল সবুজের সমারোহে ভরা থাকত, এ যেন সেই সময়। সময় তখন ধীর মন্থর গতিতে গড়িয়ে চলত, তখন যেন আর সময় ফুরোতেই চাইত না। অফুরন্ত অপর্যাপ্ত অবকাশ ছিলো। তখন মানুষের হাতে করার মতো তেমন কিছু কাজও ছিল না। এখন সেই ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ দিনগুলো আর নেই। যেন মুছে গেছে ধরিত্রীর বুক থেকে সমস্ত চিত্রই। এখন সময় ছুটে চলেছে নিত্য নতুন আবিষ্কার আর যন্ত্র সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, কারণ এখন বিজ্ঞানের যুগ। ক্রমশই যেন ঊর্ধ গতির দিকে যাচ্ছে স্পীডো মিটারের কাঁটা। নিজেকে নিয়েই এখন প্রত্যেকে ব্যস্ত, স্ব স্ব চিন্তায় এখন প্রত্যকেই মগ্ন তাদের কোন অবসর নেই অপরকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার। আজকের স্থানীয় বাসিন্দারা বলতে পারবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আসলে এই বাড়িটার মালিক কে, এখন সে যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনবানদের মধ্যে একজন এই বাড়িটার মালিক একথা অনস্বীকার্য। এখন পৃথিবীতে টাকাটাই সব। অনায়াসে নাম, যশ, প্রতিপত্তির শিখরে নিয়ে যায় মানুষকে অর্থের আনুকূল্য, অনেকে আবার নিজের পরিচয় গোপন রাখতেও পারে অর্থের সুনিপুণ প্রয়োগের সাহায্যে। বেনেডিক্ট কার্লে, একজন বাতিকগ্রস্ত ক্রোড়পতি তার অবচেতন মনের অভিলাষও এই রকম। তিনি জনসমক্ষে নিজেকে হাজির করেন খুব কমই। প্রতিবেশীদের তার সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞানই নেই, যে কি ধরনের মানুষ তিনি, মেলামেশা তো দূরের কথা, তার প্রকৃত পরিচয় অজানা থেকে গেছে, আজও তিনি দূরের মানুষ।
ক্কচিৎ কখনো তার শীর্ণ দেহ এবং খড়গের মতো নাসিকা নিয়ে জনসমক্ষে তাঁর কোম্পানির বোর্ড মিটিং-এ হাজির হন এই অতি বিরল মানুষটি। কোম্পানির অন্য সব পরিচালকগণ ভয়ে চুপ করে যান, তার হম্বিতম্বি, চালচলন দেখে এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনলে। অপ্রয়োজনীয় একটা কথা বলার সাহসও কারও হয় না। অফিসে তার এরকম প্রতিচ্ছবি। সাধারণ মানুষজনের কাছে তিনি যেন এক গল্প কাহিনির নাটক, বাকী সময়ের জন্য, তাদের সঙ্গে নায়কের মতোই আচরণ করেন। তার সীমাহীন হীনমন্যতা একদিকে অন্যদিকে তার বিপুল বদান্যতা পরোপকারের গল্পও লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়। এছাড়া তাকে নিয়ে একটা মজার কথা প্রচলিত আছে। তার পোষাক পরিচ্ছদের ব্যাপার কিংবা ব্যক্তিগত আচরণ মানুষের কাছে বিশেষ মুখরোচক নয়। নানান রংয়ের বিভিন্ন কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি যে পোশাকটা তিনি (ড্রেসিং গাউন) সাধারণত ব্যবহার করেন, সেটার বয়স নাকি কম হলেও আটশ বছর, কিংবদন্তী আছে। তার অতি প্রিয় প্রাত্যহিক খাদ্য বাঁধাকপির স্যুপ আর সুটকি মাছের ডিম দিয়ে তৈরি অম্লমধুর কাসুন্দি। এর ব্যতিক্রম তার জীবনে কোনোদিন ঘটেনি।
তার বহুরূপী চরিত্রের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে, যদি আর একটা অদ্ভুত কথা তার বিষয়ে বলা যায়, এটা বিচিত্র বললেই ভালো হয় এবং সবাই এটা জানে। সেটা হলো মশলাদার কুলের প্রতি তার সহজাত ঘৃণা এবং অনীহা।
অন্য সকলের থেকে এরকুল পোয়ারো কোনো ব্যতিক্রম নয়। তিনিও ভালো করে জানতেন, তাদের মতে, এই ভদ্রলোকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা। শুধুমাত্র বিশেষভাবে জানা নয়, ওই মুহূর্ত মনে হয়, সে হয়ত আরও বেশি কিছু জানে অন্যদের থেকেও। তার এই জানাটা অবশ্য অনায়াস লভ্য এটা বলা যায়। মঁসিয়ে কার্লের চিঠিটাই, যেটা তার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল। সেটাই তাকে বেশি কিছু জানার সুযোগ করে দিয়েছে।
এরকুল পোয়ারো, যাকে সবাই ভালো করে চেনে এই মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে, সে যেন ঠিক এখন এক অদ্ভুত ভাবাবেগে আবিষ্ট হয়ে আছে। হয়তো বা কিছুক্ষণ বিষণ্ণ চিত্তে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো পোয়ারো। মনে মনে সে এই প্রাচীন ঐতিহ্যের ঢাকা পড়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতা ওল্টাচ্ছিল। যেন সবকিছুই তার কাছে অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট লাগছিল। তার দু চোখের তারা ঢেকে ফেলেছিল বেদনার ধূসর কুয়াশা। মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়েছিল। ধীরে ধীরে গেট পার হয়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল পোয়ারো, সেই ব্যথাক্রান্ত অস্পষ্টতা কাটিয়ে উঠে। সে নিজেই বুঝতে পারেনি। কখন সে যে বাড়ির প্রবেশ পথের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বদ্ধ দরজা সংলগ্ন। কলিং বেলের সাদা বোতামটা টিপবার জন্য যন্ত্রচালিত ভাবে হাতটা বাড়িয়ে দিল। আড়চোখে একবার সে দেখে নিতে ভুলল না। সেই ফকে সাবেকী আমলের বড় হাতঘড়িটাও।
নটা বেজে তিরিশ এখন। নিজেকে প্রফুল্ল করে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছু পূর্বের বিষাদ এবং বিষণ্ণভাব কাটিয়ে উঠে। এক্ষেত্রেও সে নিখুঁত ভাবে সময়ানুবর্তিতার প্রমাণ রাখতে পারল তার সহজাত অভ্যাস অনুযায়ী।
কলিং বেল টেপার পর তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দরজাটা খুলে গেল ঠিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। উর্দি পরিহিত একটি লোককে দেখা গেল দরজার অপর প্রান্তে, এবং এই সভ্য ভব্য লোকটিকে সহজেই খানসামা হিসাবে মনে করা যায়। তার চোখেমুখে সাবলীল অভিব্যক্তির ছাপ, এবং চেষ্টাকৃত বিনয় বজায় ছিলো। একটুও ঘাটতি ছিল না, লোকটি যেন এই ঠাট বজায় রাখতে দৃঢ় সংকল্প। যদিও সেটা তার নিজ স্বভাবের গুণে কষ্টকল্পিত প্রচেষ্টা, সেটা হল তার পরিপাটীর নিপুণতা এবং সবদিক থেকেই। পোয়ারোর দৃষ্টিতে সে উত্তীর্ণ হল, মনে মনে লোকটির প্রশংসা করলো পোয়ারো।
স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, বিনীত কণ্ঠে জানতে চাইল খানসামা, আগে থেকেই স্থির করা ছিলো কি আপনার এখানে আসার কথা?
পোয়ারো মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো।
আরো একটু জানতে চাই স্যার। নামটা কি আপনার?
অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল পোয়ারো, এ সামান্য ব্যক্তির নাম মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।
খানসামার পরবর্তী আচরণ দেখে মনে হল যে তার কথায় সে সন্তুষ্ট হয়েছে। খানসামা একপাশে সরে দাঁড়ালো অভিবাদন জানানো ভঙ্গিমায়। পোয়ারোকে প্রবেশ পথ মুক্ত করে দিল। সে আবার নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকেই; পোয়ারো যখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। অল্প সময়ের জন্য অভিজ্ঞ খানসামা তার দিকে তাকিয়ে যেন কি চিন্তা করল। খানসামার পরবর্তী নির্দেশের জন্য পোয়ারোও কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার বোধ হয় মনে পড়ে থাকবে যে আরো করণীয় কাজ তার বাকী আছে। যখন সে তৈরি হাতে আগন্তুকের টুপি, ছড়ি ও ওভারকোট খুলে নিচ্ছিল, তারপর সে বাকী কাজটার জন্য তৎপর হল।
কিছু মনে করবেন না স্যার, আরো একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হচ্ছি। খানসামা বলল, আপনি কি কোনো চিঠি এনেছেন আপনার সঙ্গে?
পোয়ারো এ বিষয়ে সজাগ ছিল না। যেখানে যেমন ভাবে দেখাতে হয়। পোয়ারো কোটের পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে মেলে ধরল খানসামার দিকে, বেশ গম্ভীরভাবে। চিঠিটা তার হাত থেকে নিয়ে একবার উল্টে পালটে দেখে ফিরিয়ে দিল তাকে খানসামাটি। সযত্নে পকেটে চালান করে দিল পোয়ারো চিঠিটি ভাঁজ করে নিয়ে। চিঠির প্রতিটি কথা, প্রত্যেক ছন্দ যেন মুখস্থ আছে, তার চিঠির বক্তব্যও অতি সরল এবং মনোগ্রাহী। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।
প্রিয় মহাশয়,
মিঃ বেনেডিক্ট কার্লে কোনো এক বিষয়ে পরামর্শ নিতে চান, আপনার নিকট। যদি আপনার পক্ষে সম্ভব হয়, তবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঠিক সন্ধ্যা-সাড়ে সাতটায় উপরোক্ত ঠিকানায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে বিশেষ বাধিত হবেন তিনি।
আপনার অনুগত
হুগো কর্নওয়ার্দি
(সেক্রেটারি)
পুনশ্চঃ অনুগ্রহ করে সঙ্গে এই চিঠিটাও নিয়ে আসবেন।
টুপি ও ছড়িটা পোয়ারোর কাছ থেকে নিয়ে তাকে আহ্বান জানালো খানসামা, আসুন স্যার। আপনাদের সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করা হয়েছে মিঃ কর্নওয়ার্দির ঘরেই।
আগে আগে চলল খানসামা তাকে পথ নির্দেশ করার জন্য–পোয়ারো প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল খানসামাটিকে অনুসরণ করে। পোয়ারোর দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো প্রশংসার ঘরের চারিপাশ লক্ষ্য করার পর। সে যত দেখে ততই আশ্চর্য বোধ করে। খুব কম বাড়ি আছে এমন সব মূল্যবান সামগ্রী দ্বারা সুশোভিত। এটা তার অনুমান। পোয়ারোর মনোভাব বড়ই স্পর্শকাতর প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক এইসব শিল্প সামগ্রী সম্পর্কে। নিঃশব্দে মৃদুপায়ে দোতলার করিডোর পথ দিয়ে তারা এগিয়ে চলল, খানসামার নির্দেশে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। খানসামা ঘরের দরজায় কয়েকবার টোকা দিল হালকাভাবে। একটু কাঁপলো বোধহয় পোয়ারোর ভ্ৰযুগল। আবার বোধহয় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে চলেছে তার মনে হল। হয়তো আবার কোথাও ছন্দপতন হবে। কখনো দরজায় এভাবে নক করে না অভিজ্ঞ কোনো খানসামা। মনে মনে প্রমাদ গুনলো পোয়ারো। সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হলো যে এই খানসামাটি, খানসামা সম্প্রদায়ের অভিজাত কুলের একজন। পোয়ারো চিন্তা করল হয়তো তার এই আচরণের পশ্চাতে তার মনিবের নির্দেশ রয়েছে। পোয়ারোর আর একবার খামখেয়ালীপনার নিদর্শন পেল। এ সমস্তই কোটিপতি কার্লের হরেক রকম খেয়ালীপনার আরেকটি। তাহলে মিঃ কার্লের খেয়ালীপনা শুরু হয়ে গেল এখন থেকেই? এখন পোয়ারো ভাবলো একথা। একটা গলার আওয়াজ ভেসে এল তার কানে ঠিক এইসময়ে। মৃদু ঠেলা দিলে যাতে খুলে যায় এমনভাবে ভেজানো ছিল দরজা, কিছুটা ভেতরে ঢুকে খানসামা, মৃদু গলায় তার সঙ্গীকে জানালো, স্যার আপনি অপেক্ষা করছিলেন যে ভদ্রলোকটির জন্য
পোয়ারো এবার ঘরের ভেতর প্রবেশ করল, খানসামাটির চোখের ইশারায়। ঘরটা বিশাল বড়। আসবাবের বাহুল্য নেই, ঘরটা বেশ ফঁকাই বলা যায়। ঘরের একদিকে একটা ছোট আলমারি ফাইল পত্র রাখার জন্য। মোটা মোটা রেফারেন্স বই চারিপাশে সুদৃশ্য স্টীলের র্যাকে সাজানো। ভারী কাঠের একটা টেবিল ঘরের মাঝখানে, মসৃণ কাগজে আবৃত। কয়েকটা গদি আঁটা চেয়ার টেবিলের চারপাশে। আসবাব বলতে এইসব। যেহেতু ঘরের মধ্যে আলোর প্রাচুর্য ছিল না, সেজন্য ঘরের চার কোণে আলো আধারি খেলা বেশ লক্ষ্য করবার মতো। ঘরটার বিশালত্বর দিক দিয়ে আলোর সংখ্যা বিশেষ কম। ঘরের ভেতরে একটা তেপায়া ছোট টেবিলের ওপর সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া মাত্র একটি টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল। আর দরজা পথে কেউ ঢুকলে সমস্ত আলোটাই তার উপরে প্রতিফলিত হবে, এমনভাবে রাখা ছিল টেবিল ল্যাম্পটা। পোয়ারোর চোখ ধাঁধিয়ে গেল যখন সে প্রথম প্রবেশ করলো ঘরে। উপলব্ধি করতে পারলো সে সহজের ল্যাম্পটা দেড়শো পাওয়ার-এর কম নয়। তার দৃষ্টি যখন সামঞ্জস্য ফিরে পেল, তখন পোয়ারো টেবিল ল্যাম্পের ঠিক পেছনে অর্ধশায়িত অবস্থায় আরাম কেদারায় বেনেডিক্ট কার্লেকে আবিষ্কার করল। লম্বা খাড়া নাসিকা, রোগা ছিপছিপে দীর্ঘ শরীর, পরিধানে সেই পরিচিত বিচিত্র ড্রেসিং গাউন। তাতে রঙবেরঙের খেলা। মাথাটা সামনের দিকে সামান্য ঝুলে রয়েছে বিশেষ কায়দায়। একগুচ্ছ সাদা চুল মাথায় কাকাতুয়ার ঝুঁটির মতো। একজোড়া জ্বলজ্বলে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি মেলে পুরু লেন্সের আড়াল থেকে নবাগত আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। প্রথম একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন তিনি হুম অবশ্য ধীরে ধীরে, নবাগত আগন্তুককে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর। তার গলার আওয়াজ, ধারালো এবং তীক্ষ্ণ। কানে শুনলে বিশ্রী লাগে, তাহলে আপনিই এরকুল পোয়ারো, প্রশ্ন করলেন তিনি।
উত্তর দিল পোয়ারো, হা, আমিই এরকুল পোয়ারো। নম্র ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে পোয়ারো বলল, নিজেকে আপনার প্রয়োজনে লাগাতে পারলে আমি ধন্য মনে করব। এরপর সে ধীর পায়ে চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেল।
কেমন যেন রুক্ষভাবেই ভদ্রলোক বললেন, হা হা, ওই চেয়ারেই বসুন তার নির্দেশ সুবোধ বালকের মতো মান্য করে পোয়ারো সেই চেয়ারেই বসল। এখন তার ওপরেই এসে পড়েছে টেবিল ল্যাম্পের সম্পূর্ণ আলোটাই। ক্রোড়পতি বৃদ্ধ ভদ্রলোক আলোর আড়ালে প্রায় অন্ধকার থেকেই বসে যে গভীর ভাবে তাকেই নিরীক্ষণ করছিল, এটা স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারছিল পোয়ারো। আবার সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, হুমআমি সেটা কি করে বুঝবো যে আপনিই এরকুল পোয়ারো। পোয়ারো হতবাক হয়ে গেল এমন একটি অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে। আপনাকে চেনার কি উপায় আছে বলুন?
কোর্টের পকেটে আর একবার হাত ঢুকিয়ে চিঠিটা বার করে কার্লের সামনে মেলে ধরল পোয়ারো। বেশ উত্তেজনার সঙ্গে মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ চিঠিটার দিকে একপলক তাকাবার পর, এতক্ষণে ঠিক হয়েছে, আমি এইভাবেই চিঠি লিখতে বলেছিলাম কর্নওয়ার্দিকে। আবার ভাজ করে চিঠিটা পোয়রোর হাতে ফেরৎ দেবার সময় তিনি আবার বলে উঠলেন, তাহলে আপনিই সেই গোয়েন্দা ভদ্রলোক তাই না? ভদ্রলোক বেশ তো? বিশেষ করে তাকেই কথা বলার সুযোগ দেবেন ভদ্রলোক যেহেতু তাকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এবং বাড়িতে সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেবেন, তা তো নয়ই, নিজেই যেন তিনি বক্তা।
বৃদ্ধকে আশ্বস্ত করতে চাইলো পোয়ারো হাত নেড়ে। এখানে কোনো ছলনার ব্যাপার নেই একথা বিশ্বাস করতে পারেন। পোয়ারো বলল। অদ্ভুত একটা আওয়াজ করলেন মুখে বেনেডিক্ট কার্লে এবং বললেন, এ ধরনের আশ্বাসই দিয়ে থাকে যাদুগররা টুপির মধ্যে থেকে সোনালী মাছ বার করার আগে। বুদ্ধিমানের মতো চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলো পোয়ারো কোনো উত্তর দিল না। নিজের থেকেই আবার বললেন বৃদ্ধ কার্লে, মহাশয়, আমাকে একজন সন্দিগ্ধ চিত্ত বৃদ্ধ বলে মনে হচ্ছে তাই না? আমি সত্যিই একান্তভাবে সেই রকমই। আমার চরিত্রের মূলমন্ত্র হলো, কখনো কাউকে বিশ্বাস করো না। এটাকে আপনি বৈশিষ্ট্যও বলতে পারেন। আদর্শগত ভাবে যুক্তিযুক্ত নয় হঠাৎ কোনো আগন্তুককে, কোনো বিত্তবান মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা। কারণটা কি আপনি জানেন? এর ফল অনেক সাংঘাতিক হয় শেষের পর্যায়ে তা দেখা গেছে।
শুরু থেকেই ভদ্রলোক তার সন্দেহের কথা বলে যাচ্ছেন অথবা জ্ঞান বিতরণ করছেন। পোয়ারোর পছন্দ হচ্ছিল না। সে পর্যন্ত আর অপেক্ষা না করে সে বলেই ফেলল, চিঠিতে যেভাবে লিখেছেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে কোনো বিষয়ে পরামর্শ করতে চান তাই না? এবার পোয়ারো আসল প্রশ্নের প্রস্তাব তুললো। নিশ্চয়ই। তা তো বটেই ডাইনে বায়ে দুদিকেই মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, এটা আপনাকে বলে রাখি যে আমি সর্বদা উৎকৃষ্ট জিনিসটাই পছন্দ করি। আমাকে কেউ ঠকাতে পারবে না, খারাপ কিছু দিয়ে। কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ আমি ঠিক অনুমান করতে পারবো। এটাই আমার জীবনের মূল আদর্শ। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন। টাকার জন্য কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার ফি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করিনি, তাইতো। এই ব্যাপারটা সব সময় মনে রাখবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। আর আমি সেটা করবোও না। সেটা যত অঙ্কেরই হোক–পরে আমার কাছে আপনার বিলটা দেবেন, কেন না সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। অবশ্যই সেজন্য আমাকে বোকা ভাববেন না, দু শিলিং নয় পেন্স হিসাবে ডেয়ারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ডিম-এর বিল পাঠিয়েছিল আমার কাছে, কিন্তু তখন ডিমের বাজার দর ছিল, দু শিলিং সাত পেন্স, আমি খোঁজ নিয়ে তা জানতে পারি। এরা প্রত্যেকেই এক একটি চোর। এটাই আমার ধারণা। জোচ্চোর, আমি বরদাস্ত করব না কখনওই যে কেউ আমাকে ঠকিয়ে নিয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ তাদের ব্যাপার আলাদা যারা একেবারে উচ্চপদে আসীন। অবশ্যই তারা প্রত্যেকেই উপযুক্ত ব্যক্তি। তারা বেশী অর্থ দাবি করতে পারেন যোগ্যতা বলে। আমি নিজেও একজন, ওই গোষ্ঠী ভুক্ত আপনাকে বললাম এবং আমি সব জানি…।
তর্ক এড়িয়ে গেল পোয়ারো। নীরবে শ্রোতার ভূমিকা পালন করে গেল সে, ঘাড়টা একটু বাঁ দিকে কাত করে। প্রকৃতপক্ষে তার হৃদয়ের গভীরে যেটা ক্রমশই পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল সেটা হল কিছু পাওয়ার হতাশা। এখানে এসে সে ভুল করেছে এটা তার মনে হল। তাকে সম্পূর্ণ নিরাশ করেছে আজকের এই সাক্ষাৎকার। এরকম অদ্ভুত ঘটনা কখনো আগে তার জীবনে ঘটেনি। কোনো হদিশ খুঁজে পাচ্ছিল না সে যে এর উৎসটা কোথায়? এর পরেও একটা কিন্তু থেকে যায়। ক্রোড়পতি বেনেডিক্ট কালের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় এ পর্যন্ত সে পেয়েছে তার ফলে চিনে নিতে অসুবিধা হবে না ভদ্রলোককে কিংবদন্তীর নায়ক হিসাবে। স্বগতভাবে চিন্তা করলো ভদ্রলোকটি রূপ পাণ্ডিত্যের মুখোশপরা। কেবল বাসর্বস্ব। তাকে বহু বাতিকগ্রস্ত ক্রোড়পতির সান্নিধ্যে আসতে হয়েছে। সুদীর্ঘ কর্ম জীবনে। অবশ্য তাদের মধ্যে এক একটা তীব্র শক্তি পোয়ারো অনুভব করেছিলো। আর পোয়ারো নিজের অনুভব শক্তির দ্বারা সহজেই তাদের শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আদায় করে নেয়। তাদের মধ্যে কেউ যদি শতছিদ্র পোকায় কাটা ড্রেসিং গাউন পরে থাকেন, তবে বোঝা যায়, সে বিশেষ করে তারা ভালোবাসেন ওই ড্রেসিং গাউনটা পরে থাকতে। এটাই হল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। যেন কোনো যাত্রাদলের সম্পত্তি বেনেডিক্ট কার্লের এই ড্রেসিং গাউনটা পোয়ারোর অন্ততঃ সেই কথাই মনে হল। ভদ্রলোক যেন যাত্রাদলের সাজ পরে মঞ্চের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নাটকীয় অভিব্যক্তির ছোঁয়া আছে তার চালচলন কথাবার্তাতেও খুব স্বল্পভাষী তিনি, প্রতিটি কথাই সংক্ষেপে বলেন। তার কথা বলাটা যেন নির্দিষ্টভাবে কোনো কিছুকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য।
পোয়ারো সম্পূর্ণ থেমে গেলো না। আবার সে তার নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে প্রশ্ন করল, মিঃ কার্লে, চিঠিতে আপনি সেরকমই লিখেছিলেন যে, আপনি কোনো বিষয়ে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চান। যেন আচম্বিতে পরিবর্তন দেখা গেল ক্রোড়পতি কার্লের হাবভাবের মধ্যে। তিনি খুব ধীরে ধীরে, চাপা স্বরে কথা বলছিলেন। সামান্য উত্তেজিত হয়ে এক সময় ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে, তিনি বললেন এবার, হ্যাঁ সেটাই ঠিক। আমি এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই। আপনি কি বলেন। পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রেই। আমার নীতি কি এটাই? সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বা ধুরন্ধর গোয়েন্দা এই দুইজন-এর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে আমাকে। এদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে আমি প্রয়োজনে লাগাতে পারব এটাই বেছে নিতে হবে আমাকে।–তাকে কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো পোয়ারো, কিন্তু মঁসিয়ে, ব্যাপারটা তবুও আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। অবশ্যই আপনি ঠিক বলেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো, সেটাই তো স্বাভাবিক। হঠাৎ রাগান্বিত হলেন ক্রোড়পতি কার্লে, তিনি বললেন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে, আপনি কি করে জানবেন। এখনও তো ব্যাপারটা আপনাকে যথাযথ বলা হয়নি। আগের মতোই হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন তিনি, গদী আঁটা চেয়ারে বসে। আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো স্বপ্ন সম্বন্ধে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা আছে? ধুরন্ধর গোয়েন্দা প্রবরকে একি সব অদ্ভুত কথা শুনতে হচ্ছে? স্বপ্ন? বৃদ্ধ কার্লে কি তাকে স্বপ্নের কাহিনি শোনাবার জন্যই ডেকে এনেছেন? একী পাগলামো তার। কোনো মানে হয় না। এইভাবে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করার। যাই হোক পোয়ারো নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করল। নিজের থেকেই কুঞ্চিত হল তার ভ্র যুগল। স্বপ্নেও সে কল্পনা করতে পারেনি এমন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সে। শুনুন মঁসিয়ে কার্লে এ বিষয়ে আপনাকে আমি নেপোলিয়নের বুক অফ ড্রীমস্ বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। অথবা আপনি সাহায্য নিতে পারেন ফ্যাশন দুরস্ত হার্লে স্ট্রিটের কোনো আধুনিক মনোবিশেষজ্ঞদের।
কার্লে তার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলেন। তারপর উত্তর দিলেন ধীর কণ্ঠে, আমার দুর্ভাগ্য আমি কোনো ফল পাইনি, আপনার বলার আগেই আমি দু জায়গাতেই দেখা করেছি। মঁসিয়ে পোয়ারো। এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, খুবই অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর প্রথম দিকে, আবার একটু একটু করে তার স্বর চড়া পর্দায় যেতে লাগল। আমাকে কাটাতে হয় বারবার সেই একই স্বপ্নের ঘোরে প্রতি রাতে সেই একই স্বপ্নের জের টেনে যেতে হয় আমাকে। আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। এজন্য আমাকে কি মানসিক যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে। আমি বাস্তবিকই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। এ অসহ্য আমি আর পারছি না। বিচিত্র সেই স্বপ্ন। আর, জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ঠিক অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে স্বপ্নের সেই দৃশ্যগুলি। আমি আমার চেয়ারে যেন বসে আছি, ঠিক এর পাশের ঘরেই। সাবেকী আমলের এক টেবিল আমার সামনে। টেবিলের ওপর সুন্দর একটা টাইমপিস ঘড়ি। কাটায় কাটায় তিনটে বেজে তেইশ, ঘড়িটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একবার দেখে নিই। কোনো দিনও এর নড়চড় হয় না এই সময়ের এটাই আশ্চর্য! আমি কি বলতে চাইছি, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। একটা ভয়ার্ত বিহ্বল ছায়া বেনেডিক্ট এর চোখে কাঁপতে থাকে। যখন ঘড়িটার দিকে তাকাই, বুঝতে পারি এবার সময় হয়ে গেছে সেই স্বপ্ন দেখার। আমার বুকটা তখনই ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে। আমার করণীয় কাজটা এবার শেষ করে নিতে হবে, ঠিক তখনই চিন্তা করি। আমি অত্যন্ত ঘৃণা বোধ করি এমন কি এ ধরনের কাজ করাটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। অথচ আমি অসহায়, কাজটা আমাকে শেষ করতেই হবে যে ভাবেই হোক…তার কণ্ঠস্বর ক্রমশ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। পোয়ারো অবিচলিত ভাবে বলল, কি এমন কাজটা যেটা আপনাকে শেষ করতেই হবে বলে আপনি মনে করছেন?
বেনেডিক্ট কার্লে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, ঠিক তিনটে বেজে আঠাশ মিনিটের সময়, আমার ডানদিকের ডেস্কের দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুললাম আমার রিভলবারটা সেখানে রাখা ছিল। ড্রয়ার থেকে বার করে সেটা টেবিলের ওপর রাখলাম। জানালার ধারে চলে এলাম রিভলবারে গুলি ভর্তি করে। তারপর বলুন, তারপর সেখানে কি ঘটলো, জানতে চাইলো পোয়ারো। হ্যাঁ তারপর, তারপর আমি নিজেই নিজেকে গুলি করি…।
এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা নেমে এল ঘরের মধ্যে। পোয়ারো সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলো। অতএব এটাই আপনার সেই স্বপ্ন?
হ্যাঁ, বললেন কার্লে।
প্রতি রাত্রেই কি আপনি শুধু এই স্বপ্নটা দেখেন?
ঠিক তাই তিনি উত্তর দিলেন।
বলতে পারেন আপনি নিজেই নিজেকে গুলিবিদ্ধ করার পর কি ঘটেছিলো? জানতে চাইলেন পোয়ারো।
কার্লে উত্তর দিলেন তখন আমার আবার ঘুম ভেঙে যায়। পোয়ারো আস্তে আস্তে মাথা দোলাচ্ছিল। আমার তখন মনের অবস্থা এমন যে কিছুই বলতে পারলাম না অথচ অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু বলা হল না ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো পোয়ারো কি যেন ভাবছিলো তখন। আপনি কি সবসময় ওই নির্দিষ্ট ড্রয়ারে রিভলবার রাখতেন অর্থাৎ আপনার নিজের স্বার্থে?
হা রাখতাম, বললেন কার্লে।
কিন্তু কেন? পোয়ারো প্রশ্ন করলেন।
এটা আমার অভাস বলেও ধরে নিতে পারেন। আমি সবসময় এটাই করে আসছি। একথা ঠিক যে সবসময় নিজেকে প্রস্তুত রাখাই শ্রেয়। জানতে পারি কি, এই প্রস্তুতি কিসের জন্য? কার্লে বিরক্ত হলেন এ ধরনের অবান্তর প্রশ্ন শুনে, প্রত্যেকেরই সতর্ক হওয়া উচিত-দেহরক্ষী রাখা উচিত আমার মত অবস্থায় পড়লে। এটা জানেন নিশ্চয়ই প্রতিটি বিত্তবান মানুষের অনেক শত্রু থাকতে পারে।
প্রসঙ্গটা আর দীর্ঘতর না করে, কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন পোয়ারো। ঠিক কি কারণে আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন বলুন তো?
নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সব কথাই বলব, তার আগে আমি শুধুমাত্র তিনজন চিকিৎসকের পরামর্শ করেছি।
আচ্ছা তারপর? পোয়ারো জানতে চাইলেন। এসবই প্রাত্যহিক খাদ্যের ব্যাপারে প্রথম চিকিৎসক বলেন। খাবারের অনিয়মে এরকম হতে পারে। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক তিনি। দ্বিতীয় জন একজন আধুনিক স্কুলের যুবক। তিনি বিশ্বাসী, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে। তার মতে এই দুঃস্বপ্নের উৎস অল্পবয়সের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা। ঠিক তিনটে বেজে আঠাশ মিনিটেই সেই বিশেষ ঘটনাটাই ঘটে ছিল। আমি সেই অপ্রীতিকর ঘটনাকে ভুলে যেতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলাম। এমনকি প্রয়োজন হলে নিজেকে আমি ধ্বংস করতেও প্রস্তুত, ব্যাখ্যাটা ঠিক হলো তো?
প্রশ্ন করলো পোয়ারো, আর সেই তৃতীয় ডাক্তারের কি বক্তব্য ছিল? বেনেডিক্ট কার্লের কণ্ঠস্বরে এবার রীতিমতো ক্রোধের আভাস পাওয়া গেল–এই ডাক্তারটিও যুবক। অদ্ভুত ছিল তার থিওরীটা–তার বক্তব্য অনুসারে বলা যায়–আমি নাকি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার জীবন সম্বন্ধে এবং অসহনীয় হয়ে উঠছে আমার কাছে আমার জীবন, সেজন্যই আমি নিজে ইতি টানতে চাইছি আমার জীবনের। যদি সেটা মেনে নিতে হয়, তবে নিজেকে ব্যর্থ স্বীকার করতে হবে। কখনই আমি সেটা মানতে পারলাম না জ্ঞানতঃ। মেনে নিলে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু যখন আমি ঘুমোই তখন আমার কোনো জ্ঞান থাকে না, অবচেতন, বা চেতনাই হোক তখন আমি যেন আমার মনের সব শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলি, প্রবলভাবে কাজ করে তখন আমার মনের সব কামনা বাসনা। সেটাই আমি তখন কাজে পরিণত করতে যাই যেটা আমি ইচ্ছা করি, অর্থাৎ নিজেই নিজের হত্যাকারী হতে চাই।
আপনি অবচেতন মনে নিজের মৃত্যু কামনা করে থাকেন। অথচ সজ্ঞানে কিছুই টের পান না। এটাই কি তার ধারণা। পোয়ারো মন্তব্য করল।
তীক্ষ্ণস্বরে চীৎকার করে উঠলেন মিঃ কার্লে, অসম্ভব, সেটা একেবারেই অসম্ভব। আমি সম্পূর্ণভাবে সুখী। এতো সুখী আর কেউ নেই এ জগতে আমার চেয়ে। অনেক কিছুই আমি, পেয়েছি জীবনে যা চেয়েছি। সব কিছুই আমার হস্তগত অর্থের বিনিময় যা যা পাওয়া যায়। কতখানি অবাস্তব এবং অসম্ভব আমার সম্বন্ধে এইরূপ ধারণা করা। পোয়ারো আগ্রহ সহকারে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ভদ্রলোকের দিকে। সেটা মনের মধ্যে সহজেই সন্দেহের ভাব উদ্রেক করবে, কার্লের হাতনাড়ার ধরন বা বাচনভঙ্গীর মধ্যে এমন একটা সুদৃঢ় প্রতিবাদের ভাব ছিল। এবার সে সতর্ক হল তার প্রতিবাদের ঝড় তোলা এবং স্বীকার না করার প্রবণতা সম্পর্কে। আর সেটার প্রয়োজনই বা কি? সে তাই নস্বরে বলল, (পোয়ারো), মঁসিয়ে আমার আর এখানে আসার কি প্রয়োজন? কার্লে এবার হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলেন। টেবিলের ওপর কয়েকবার টোকা দিলেন পরক্ষণেই অধৈর্য ভঙ্গীতে।
সম্ভাবনা আছে আরও একটা, আর একমাত্র আপনিই সেটা জানতে পারবেন, যদি ব্যাপারটা সত্য হয়। বিশ্ববিখ্যাত একজন গোয়েন্দা আপনি অবিশ্বাস্য এবং অভূতপূর্ব ভাবে আপনি সব জটিল কেস সমাধান করে দিয়েছেন। কিসে কি হয় আপনিই দেখে থাকবেন, অন্য কেউ না জানতেও পারে।
পোয়ারো জানতে চাইলেন, বলুন তো আপনি কি জানার কথা বলছেন!
নীচু পর্দায় হঠাৎ কালের কণ্ঠস্বর নেমে এল, তিনি ফিসফিস করে বললেন, ধরুন কেউ আমাকে খুন করতে চায়–সে এই কাজটা কিভাবে করবে? সেকি আমাকে বাধ্য করাতে পারবে রাতের পর রাত এই স্বপ্ন দেখতে, সে হয়ত ভাবছে রাতের পর রাত এই স্বপ্ন দেখে জীবনের প্রতি ঘৃণায় হয়তো আমি নিজেকে শেষ করব। আমাকে তার হত্যার অভিপ্রায়টা কাজে পরিণত হবে, সেই অর্থে দেখলে। নিজের হাতে সে আমাকে হত্যা করল না। আমিই সেটা করলাম। রাতের পর রাত ধরে সে আমাকে হত্যা করার জন্য প্ররোচিত করল। সেটা কেউ জানতে পারল না। এমনকি পুলিশও নয়। সেই প্রবাদ বাক্যটার মতো, সাপও মরল না। আবার লাঠিও ভাঙ্গল না।
আপনি কি হিপনোটিজমের কথা বলতে চাইছেন? জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো।
কার্লে বলল। হা কতকটা সেই রকমের বলতে পারেন। পোয়ারো বিষয়টা নিয়ে মনে মনে চিন্তা করল বেশ কিছু সময়। তার মনে কি উত্তর তৈরি হল কে জানে, তবে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সে জানাল। হ্যাঁ সেটা সম্ভব আমার মনে হয়। আমি মনে করি এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া সর্বাপেক্ষা উচিত। আচ্ছা আপনার জীবনের অভিজ্ঞতায় কি আপনি এ ধরনের কেস দেখেছেন?
না। আমি কখনও এরকম ঘটনার মুখোমুখি হইনি, জানালো পোয়ারো। নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন আমার বক্তব্যটা। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমায় রাতের পর রাত জাগতে বাধ্য করা হচ্ছে। হয়তো একদিন আমি নিজেকে অবশেষে খতম করে ফেলবো এরকম মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে। বাধ্য হবো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে।
মাথা নাড়ল পোয়ারো ধীরে ধীরে, তারপর সে মগ্ন হলো গভীর চিন্তায়।
অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলেন বেনেডিক্ট কার্লে পোয়ারোর দিকে। একটাই চিন্তা কেবল তখন তার মনে, বাস্তবে কি পরিণত হবে সেই সম্ভাবনাটা সেটাই হয়ত তখন অনুমান করছে সে। তাকে তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান বলে মনে করে থাকেন। তার অনুমান অভ্রান্ত বলে যদি এই ধুরন্ধর গোয়েন্দাটি রায় দেয়। তাহলে তিনি বাঁচবেন কি আশা নিয়ে? হয়ত আর রাত্রের সেই দুঃস্বপ্ন দেখার জন্য তাকে আর বসে থাকতে হবে না। হয়তো তিনি হার্টের ধুক ধুকুনির জন্য ভয়ে হার্ট ফেল করবেন তার পূর্বেই। তিনি কখনই এত তাড়াতাড়ি মরতে চান না। বাঁচতে চান তিনি আরও কিছুদিন। উপভোগ করতে চান জীবনটাকে। এরকুল পোয়ারোর সাহায্য তার একান্ত প্রয়োজন জীবনটাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য। কার্লের একান্ত বিশ্বাস পোয়ারোই একমাত্র তাকে বেঁচে থাকার পরামর্শ দিতে পারে। আর তিনি যদি একান্তই সক্ষম হন। তবে তাকে পৃথিবীর এমন শক্তি নেই যে বাঁধিয়ে রাখতে পারবে। এখন সবকিছুই নির্ভর করছে এরকুল পোয়ারোর মর্জির উপর, যদি সে ইচ্ছা করে তাকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার।
বেনেডিক্ট কার্লে সেজন্য ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা নিশ্চয়ই আপনি সম্ভব বলে মনে করেন না।
অথচ, একেবারে অসম্ভবও বলা যায় না, পোয়ারো বলল।
এটার সম্ভাবনা খুব কম তাই মনে করেন তো আপনি?
হ্যাঁ সেটাই আমি মনে করি বলল পোয়ারো।
কার্লে অস্পষ্টস্বরে বললেন ডাক্তারদের অভিমত ও সেই রকম। আবার তার কণ্ঠস্বর উঁচু পর্দায় উঠল, আমাকে কেন রাতের পর রাত একই স্বপ্ন দেখাতে বাধ্য করা হচ্ছে। কেন, এর কারণটা কি?
পোয়ারো কেবল মাথা নাড়ল।
বেনেডিক্ট কার্লে আবার নিজে থেকেই বলে উঠলেন তাকে চুপ করে থাকতে দেখে। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার অভিজ্ঞতায় এর ব্যাখ্যা কি? এই ধরনের কেসের কোনো উদাহরণ নেই আপনার কাছে এ সম্বন্ধে কি আপনি নিশ্চিত? অর্থাৎ আমার কেসটাই আপনার কাছে নতুন?
না, একেবারেই না? পোয়ারো বললেন।
শুধু এই কথাটাই আপনার কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম, কার্লে জানালেন।
পোয়ারো মৃদু কেসে গলাটা পরিষ্কার করে নিলো। বলল, যদি অনুমতি দেন একটা প্রশ্ন করব?
তিনি দুবার বললেন কি সেই প্রশ্ন, ভালো কথা তো, জিজ্ঞাসা করুন।
মঁসিয়ে কার্লে কে আপনাকে খুন করতে পারে বলে আপনি সন্দেহ করছেন?
বেশ জোর দিয়ে কালে বললেন, কাউকেই নয়, আমার সন্দেহের তালিকায় কোনো নাম নেই।
বেশ জোর দিয়ে পোয়ারো বললেন, মিঃ কার্লে এমন একটা ধারণা তো আপনার মনে বেশ আগে থেকেই গেঁথে বসে আছে।
আমি শুধু যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলাম সত্যিই এমন সম্ভাবনা আছে কিনা?
আমার নিজের এমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলল পোয়ারো, আবার প্রশ্ন করল মঁসিয়ে কার্লে। কোনোদিন কেউ কি আপনাকে হিপনোটাইজ করেছে?
না, কখনোই না উল্টে প্রশ্ন করলেন পোয়ারোকে কার্লে, এরকম ভিত্তিহীন ধারণাকে তাহলে আমি প্রশ্রয় দিতে যাব কেন, আপনি কি বলেন।
একেবারেই ভিত্তিহীন অবাস্তব এই ধারণাকে অহেতুক শুধু আমি কেন যে কেউ এটা বলতে পারে পোয়ারো বললেন।
তাহলে স্বপ্নটা, আপনি নিরর্থক বলছেন। আপনার মতামত কি স্বপ্নটার পরিপ্রেক্ষিতে, কোনো মানে নেই কি এর?
নিশ্চয়ই এর অর্থ আছে স্বপ্নটা খুবই চমৎকার, এবং অভিনবও বলা যেতে পারে বললেন পোয়ারো। কপালে কুঞ্চন দেখা যায় পোয়ারোর, চিন্তার ছাপ দেখা যায় মুখমণ্ডলে। একটু পরে আবার সে বলে উঠল। আমি বিশেষভাবে নিজের চোখে যাচাই করে নিতে চাই। এই অদ্ভুত নাটকের পার্থিব বস্তুগুলো। মনে করুন সেই রিভলবারটা, টেবিল আর টেবিলের ওপর রাখা টাইমপিসটা। অবশ্যই, চলুন। আমি আপনাকে এখনই সেই ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। গোছগাছ করে নিলেন লম্বা ঢিলেঢালা ড্রেসিং গাউনটা তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠবার হুকুম জানালেন কার্লে। আবার তিনি কি ভেবে মত পরিবর্তন করেন, তার ক্রোড়পতি মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। অন্য একটা চিন্তা বুঝি তার মগজে খেলা করছে, মুখের ভাব দেখে মনে হল। আবার তিনি নিজের চেয়ারে অলসভাবে বসে পড়লেন যদিও চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন।
তিনি বললেন না, কিছু দেখার নেই সেখানে, যা কিছু বক্তব্য সবই তো আপনাকে খুলে বলেছি। পোয়ারো বললেন, আমি তো স্বচক্ষে একবার সেগুলি দেখতে চাই।
না সেটার দরকার হবে না, তার চেয়ে আপনি নিজের অভিমত ব্যক্ত করুন। সম্পূর্ণ ইতি টানতে চাই আমি এই অধ্যায়ের। বললেন কার্লে।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আপনার মতামত আপনিই ঠিক করুন, উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো এবার। মঁসিয়ে কার্লে আমি দুঃখিত আপনাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারলাম না বলে।
বেনেডিক্ট কার্লে সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, চারিদিকে যেন এ নিয়ে গুজব ছড়াবেন না। আবার তিনি অনেকটা ধমকের সুরে বললেন। সব কিছুই খুলে বললাম আপনাকে, আপনি এর মধ্যে থেকে কোনো রহস্যই বার করতে সক্ষম হলেন না। অবশ্য এজন্যে আমার মনে সামান্য ক্ষোভও নেই। তবে মনে রাখবেন এখানেই এর শেষ। এবার বলুন আপনাকে কত পারিশ্রমিক দিতে হবে, কারণ এখানে এসে আপনি আপনার মূল্যবান সময়ের অনেকটাই ব্যয় করলেন। আপনি একটা বিল পাঠিয়ে দিতে পারেন পরামর্শ দক্ষিণা হিসাবে। হ্যাঁ আমার সেটা পাঠাতে ভুল হবে না শুকনো গলায় পোয়ারো জানালো। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে ফিরে যাওয়ার জন্য।
পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠলেন ক্রোড়পতি কার্লে, দাঁড়ান একটু, সেই চিঠিটা আমি ফেরৎ পেতে চাই। আপনার সেক্রেটারীর লেখা সেই চিঠিটাতো! হ্যাঁ, সেটাই আমি ফেরৎ চাই।
পোয়ারো বিস্মিত হলেন। আর বাক্যব্যয় না করে পকেট থেকে ভাঁজ করা চিঠিটা বার করে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলেন।
চিঠিটা হাতে নিয়ে কার্লে উল্টে পাল্টে দেখলেন সেটা, তারপর বেশ যত্ন সহকারে রেখে দিলেন টেবিলের উপর।
পোয়ারো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, ধীর, মন্থর গতিতে। সত্যিই তিনি বেশ বিভ্রান্ত হয়েছেন। এখন তার সমগ্র চিন্তা জুড়ে রয়েছে, যে কাহিনিটা তিনি কিছুক্ষণ পূর্বে শুনলেন। চোখ বুজে তিনি যেন এখন সমস্ত দৃশ্যপট কল্পনা করে নিতে পারছেন। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি এসব কিছুকে সরিয়ে রাখলেও। অবশ্য তিনি নিজেই এই অস্বস্তির কারণ, বেনেডিক্ট কার্লে নন। এরকুল পোয়ারোর মনে হল কোথাও যেন একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যেই প্রোথিত আছে ভুলটা এরকম মনে হল তার। দরজার হাতলে, হাত দেবার পরেও আবার দ্বিতীয়বার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এবার তার সবকিছু স্পষ্ট মনে পড়েছে। একটা সাংঘাতিক ভুলের জন্য দায়ী সে, এরকুল পোয়ারো। আবার সে ফিরে গেল ঘরের দিকে। বিনীতভাবে বলল পোয়ারো। একটা মারাত্মক ভুলের জন্য আমি আপনার কাছে সহস্রবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি মিঃ কার্লে। আমি একটা বাজে কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছি আপনার সমস্যার কথা ভাবতে গিয়ে। যখন আপনি চিঠিটা ফেরৎ চাইলেন। অন্যমনস্কভাবে আমি ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছিলাম। বাঁ পকেটে ছিল আপনার চিঠিটা।
কি এসব বলছেন, মানেটা কি?
আপনার হাতে আমি অন্য একটা চিঠি তুলে দিয়েছি। লন্ড্রী কর্তৃপক্ষ আমার টাই-এর রঙটা জ্বলিয়ে দেবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে একটা চিঠি দিয়েছিল, সেটাই আপনাকে দিয়েছি। পোয়ারো বিব্রত ভাবে ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে আসল চিঠিটা বার করল। প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিলেন চিঠিটা, বৃদ্ধ কার্লে।
মুখে বিশেষ বিরক্তি ফুটে উঠতে দেখা গেল। তার চোখে : কি যে আপনারা করেন ভেবে পাই না। সব অপদার্থের দল। আর একবার মার্জনা চেয়ে নিল পোয়ারো লন্ড্রীর মালিকের চিঠিটা পকেটস্থ করার সময়। এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়াল সে সিঁড়ির মুখে এসে। নীচের হলঘরের দিকে সরাসরি নেমে গেছে মার্বেল পাথরের সিঁড়িটা। ওর কাঠের ভারী টেবিল হলঘরের মাঝখানে। একরাশ মাসিক পত্র-পত্রিকা টেবিলের ওপর পড়েছিল। কুশান আঁটা দুটি শৌখীন চেয়ার ছিল টেবিলের পাশেই। আর একটা অপেক্ষাকৃত ছোট টেবিল ছিল পাশেই। গোটাকয়েক ফুলদানী সাজানো রয়েছে তার ওপর। মনে হচ্ছে এটা কোনো বিলাস বাহুল ডেন্টিস্টের চেম্বার, ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে। সেই খানসামাটিকে অপেক্ষা করে থাকতে দেখলো হলঘরে নেমে এসে। মনে হয় তাকে বিদায় দেবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল সে। স্যার আপনার জন্যে কি ট্যাক্সি ডেকে দেবো? বলল লোকটি। লাগবে না ধন্যবাদ এমন সুন্দর মনোরম রাতে হেঁটে যেতেই ভালো লাগবে। রাস্তায় পা দিয়ে, গেট পেরিয়ে আসার পর বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হল পোয়ারোকে। গাড়ির ভিড় রাস্তায়, এধার ওধার ছোটাছুটি করছে গাড়িগুলো। তার চিরদিনের অভ্যাস, ধীরে সুস্থে রাস্তা পার হওয়াটা। পথ চলতে লাগলো পোয়ারো ধীরে পদব্রজে। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। স্বগতোক্তি করল সে না! আদৌ আমি এর এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না। সবকিছুই যেন অবাস্তব স্বার্থহীন আমার কাছে মনে হয়। খুবই অনুশোচনার ব্যাপার, তবুও আমি এরকুল পোয়ারো স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে–আমি কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়েছি।
এই নাটকের প্রথম অঙ্কের এখানেই যবনিকাপাত। সপ্তাহ খানেক পরে শুরু হবে দ্বিতীয় অঙ্ক। ফোনটা বেজে উঠল ঠিক সেই সময় যখন পোয়ারো তার সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে বসেছিল। সরকারী ডাক্তার স্টীলিং ক্লীট ফোন করেছিল। আমি ডাক্তার স্টীলিং ক্লীট কথা বলছি, কি হে, পোয়ারো নাকি, সেই পুরানো ঘোড়া! ঠিক তাই বন্ধু! এবার বলুন তো কি ব্যাপার। শুনুন, আমি কথা বলছি, নর্থ ওয়ে হাউস এ বেনেডিক্ট কালের বাড়ির থেকে বললেন ডাক্তার।
খুব সচেতন কণ্ঠে পোয়ারো বলল, তাই নাকি? ব্যাপার কি মিঃ কার্লের?
মারা গেছেন কার্লে, আজ বিকালে তিনি নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেছেন। খানিক নীরবতার পর আবার কথা বললো পোয়ারো।
হু, অর্থাৎ বুঝতে পারলাম।
খুব একটা সবাক হননি আপনি আপনার ছোট্ট উত্তর শুনে মনে হচ্ছে, কিছু জানেন নাকি আপনি এ ব্যাপারে?
পোয়ারো জানতে চাইলেন, কেন আপনার একথা মনে হল বলুন তো?
আমি কোনো সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ, অথবা টেলিপ্যাথি বা অন্য কিছুর সাহায্যে এই সিদ্ধান্তে আসিনি মিঃ পোয়ারো। সপ্তাহখানেক আগের একটা চিঠি এখানে পাওয়া গেছে এটাই হল আসল খবর। মিঃ কার্লে আপনাকে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য সেই চিঠিতে অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন।
আচ্ছা তাই নাকি পোয়ারো বললেন। একজন শান্ত ভদ্র পুলিশ অফিসার এখানে উপস্থিত রয়েছেন। সুতরাং ক্রোড়পতি মারা গেলে আমাদের কি রকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় সেটা বুঝতেই পারছেন। সেজন্য ভাবলাম, আপনার দ্বারা যদি সম্ভব হয় নতুন কোনোভাবে আলোকপাত করতে। আসুন না এখানে একবার যদি সম্ভব হয়, ডঃ বললেন।
আচ্ছা আমি যাচ্ছি এক্ষুনি। বললেন পোয়ারো ভালো কথা, আপনি মনে হয় শিকারের গন্ধ পেয়েছেন।
না, সেরকম কিছু নয় বললেন পোয়ারো। আচ্ছা ঠিক আছে আমি নর্থওয়ে হাউস-এ যাচ্ছি। অর্থাৎ আপনি টেলিফোনে সব কথা বলতে রাজি নন তাই না? চলে আসুন তাহলে, ডঃ বললেন। পোয়ারোকে বসে থাকতে দেখা গেল মিনিট পনেরো পরেই নর্থওয়ে হাউসের পিছনদিকে লম্বা ধাঁচের লাইব্রেরী ঘরে। আর পাঁচজন উপস্থিত ছিল ঘরের মধ্যে। ইনসপেক্টর বানেট, ডঃ স্টীলিং ক্লীট, মিসেস কার্লে (ক্রোড়পতির স্ত্রী) তার একমাত্র কন্যা জোয়ানো কালে, এবং হুগো কর্ণওয়ার্দি, তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারী।
ইনসপেক্টর বার্নেটকে বিচক্ষণ ও চতুর মনে হল, তাদের সকলের মধ্যে। এই পরিবারের পেশাদার সরকারি ডাক্তার স্টীলিং ক্লীট এটাই মনে হয়। সামনা সামনি চেহারার কোনো মিল নেই তার দূরভাষের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে দীর্ঘ চেহারা, লম্বাটে মুখ তিরিশ বছরের যুবক সে। তার স্বামীর থেকে অনেক কম বয়সী মনে হল মিসেস কার্লেকে। মাথা ভর্তি কালো চুল, দারুণ সুন্দরী তিনি। মুখটায় তার কাঠিন্য, সেখানে তার চোখের ভাষায় খুঁজে পাওয়া গেল না ভাবাবেগের কোনো অভিব্যক্তি। তার উপস্থিতি সংযত। একমাথা সোনালী চুল জোয়ানো কার্লের। মুখে কিছুটা অভিজ্ঞতার ছাপ থাকলেও চেহারাটা আকর্ষণীয়। তার পিতার সঙ্গে বিশেষ মিল আছে মেয়েটির নাক এবং চিবুক-এ। বুদ্ধিদীপ্ত তার চোখ দুটি। বেশ ভালোই দেখতে হুগো কর্নওয়ার্দিকে, পরনে নিখুঁত পরিপাটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোষাক। দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ চোখে মুখে।
প্রাথমিক ভাবে যখন আলাপ পরিচয় পর্ব শেষ হল, পোয়ারো তখন ধীরে ধীরে, গত সপ্তাহের কার্লের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের বিবরণ ব্যক্ত করল। সমস্তই বিস্তারিতভাবে তাদের বললো। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্নটার বিবরণ দিয়ে গেলো সে। যারা ঘরের মধ্যে উপস্থিত ছিল দেখা গেল, প্রত্যেকেই বেশ আগ্রহ সহকারে কথাগুলো শুনছে।
মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করল ইনসপেক্টর বার্নেট, স্বপ্নটা দারুণ চমকপ্রদ তো! তারপর সে মিসেস কালের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, মিসেস কার্লে আপনি কি এ বিষয়ে কিছু জানেন? : মাথা কাত করলেন ভদ্রমহিলা।
হ্যাঁ, স্বপ্নটার কথা আমার স্বামী আমাকে বলেছিলেন, ওকে বেশ চিন্তায় ফেলেছিল, উনি ভীষণ উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, ওর কথা শুনে মনে হয়েছিল। আমি ভাবলাম, এটা তো স্বপ্ন, বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম আমি ওকে। এত অল্পে হতাশ হলে চলবে কেন? হয়তো হজমের কোনো ব্যাঘাত ঘটার ফলে এমন সব অদ্ভুত চিন্তা তার মাথায় পাক খাচ্ছে, এটা আমি তাকে বলেছিলাম। উল্লেখযোগ্য ছিল, ওর প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকাটা একটু অদ্ভুত। আমি এজন্য ওকে কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে অনুরোধ করেছিলাম। চরিত্রের মধ্যে বেশ অনন্যতা আছে। মাথা নাড়ল ডঃ স্টীলিং ক্লীট আমার সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে কোনো পরামর্শ করেননি, স্বপ্ন বাতিল। মিঃ কার্লে হয়ত হার্লে ফ্লাটের ফ্যাশন দুরস্ত বিশেষজ্ঞদের কাছেই গিয়েছিলেন মঁসিয়ে পোয়ারোর কথা শুনে মনে হচ্ছে। আচ্ছা তাহলে কি মনে হয় আপনার মিঃ কার্লের বোধশক্তি লোপ পেয়েছিল? আপনার মতামত আমি জানতে চাই, যেহেতু আপনি একজন ডাক্তার মিঃ স্টীলিং ক্লীট। পোয়ারো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো, বিশেষজ্ঞরা যে এই অদ্ভুত স্বপ্নের ব্যাপারে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। সে বিষয়ে আমি আপনার ধারণা জানতে চাই। একটু বিব্রত মনে হল স্টীলিং ক্লীটকে।
বলাটা ঠিক অতটা সহজ নয়। মিঃ কার্লে আপনাকে যা যা বলেছিলেন হয়ত বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের সঙ্গে তা মিলতেও না পারে, এই সম্ভাবনার কথাটা আপনাকে ভেবে দেখতে হবে। মঁসিয়ে পোয়ারো। কোনো অনভিজ্ঞ ব্যক্তি অনেক সময় কোনো কোনো কথার ভুল ব্যাখ্যা করে নিতে পারে এমনটিও দেখা যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে মিঃ কার্লে তাদের আসল বক্তব্যটাই বুঝতে পারেননি, আর আপনি কি এটাই বলতে চাইছেন। না সেরকম ভাবে নয় বললেন, মিঃ স্টীলিং ক্লীট, সাধারণ লোকের পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব, বিশেষজ্ঞরা তাদের সুনির্দিষ্ট পেশাদারী ভাষায় যা মন্তব্য করে থাকেন। হয়তো এ ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু ঘটে থাকবে আমার মনে হয়। যতটুকু বুঝেছিলেন মিঃ কার্লে সেটাকে নিজের ধারণা মতো সাজিয়ে নিয়ে বলেছেন আপনাকে। আসলে চিকিৎসকরা তা বলেননি, উনি যেটা আমাকে বলেছিলেন। এটাই তার অর্থ হয় পোয়ারো বললেন।
একনজরে তাই মনে হয়, হয়তো কোথাও একটু ভুল বুঝে থাকবেন তিনি। আমার কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। বললেন ডঃ স্টীলিং ক্লীট। মাথা নাড়লো পোয়ারো চিন্তিতভাবে।
মিঃ কার্লে কোন কোন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন, আপনারা কেউ সে বিষয়ে জানেন কি? পোয়ারো প্রশ্ন করলেন।
মাথা নেড়ে মিসেস কালে জানালেন। না আর এইভাবে মন্তব্য রাখলেন জোয়ানো কার্লে। সম্পূর্ণ অজানা ব্যাপার এটা আমাদের কাছে। তিনি কোন কোন চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন সেটাও আমরা কেউ জানি না। পোয়ারো, জোয়ানোকে জিজ্ঞাসা করল। তিনি কি আপনাকেও বলছিলেন এই অদ্ভুত স্বপ্নের ব্যাপারে? মেয়েটি মাথা নেড়ে না জানাল।
আর মিঃ কর্নওয়ার্দি আপনি কিছু জানেন কি?
না, আমাকে তিনি কিছুই বলেননি, বলল কর্নওয়াদি। আমি চিঠিটা আপনাকে পাঠিয়ে ছিলাম তার নির্দেশ মতো। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই, তিনি কি বিষয়ে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করবেন। তার ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো গণ্ডগোলের ব্যাপারে হয়ত আপনাকে ডেকেছেন। এটাই আমি ভেবেছিলাম তাহলে এবার মিঃ কালের মৃত্যুর প্রসঙ্গেই আলোচনা করা যাক, বললেন পোয়ারো।
উপস্থিত সকলে সম্মতি জানালো মাথা হেলিয়ে। পোয়ারো বলল, এবার শুরু করা যাক, আপনাদের মধ্যে যে কেউ প্রথমে বক্তব্য রাখতে পারেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে ইনসপেক্টর বার্নেট একবার মিসেস কার্লে পরে ডঃ স্টীলিং ক্লীট এর দিকে ফিরে তাকাল। তাদের দুজনকে নীরব দেখে সে নিজেই বক্তার ভূমিকা নিল।
দোতলার নিজের ঘরে বসেই প্রত্যেক দিন বিকালে মিঃ কার্লে কাজকর্ম সারতেন। তার প্রাত্যহিক রুটিন মাফিক কাজ ছিল এটাই। খুব শীঘ্রই তিনি নাকি পারস্পরিক বোঝা পড়ার ভিত্তিতে অন্য একটা বড় কোম্পানির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সমাধা করতে যাচ্ছিলেন। বার্নেট আবার একটু থেমে হুগো কর্নওয়ার্দির দিকে ফিরে তাকাল।
তার প্রশ্নটা অনুমান করে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হুগো বলল, কনসোলিডেটেড কোচলাইন্স (অফিস) সেই সূত্রে মিঃ কার্লে রাজি হয়ে যান খবরের কাগজের দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য, ইনসপেক্টর তার কথার জের টেনে বললেন। তিনি অবশ্য কদাচিত এ ধরনের সাক্ষাৎকারে রাজি হতেন। একবারও মুখ খুলতেন না পাঁচ বছরের মধ্যেও সম্ভবতঃ। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই সেই প্রতিনিধি দুজন সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেয়ে। নর্থওয়ে হাউসে এসে হাজির হয়েছিলেন। তখন মিঃ কার্লে নিজের কাজে ঘরে ব্যস্ত ছিলেন। অথচ তারা দুজন রীতি অনুযায়ী তার দোতলার ঘরের সামনে অপেক্ষা করছিল। কনসোলিডেটেড কোচলাইনস এর অফিস একজন দ্রুত কিছু কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয় তিনটে বেজে কুড়ি মিনিট তখন মনে হয় মিঃ কার্লেকে দিয়ে সেগুলো সই করাতো। মিঃ কার্লের ঘর দেখিয়ে দেওয়া হয় তাকে সে ঘরে গিয়ে তার হাতে কাগজগুলো তুলে দেয়। তাকে সঙ্গে নিয়ে মিঃ কালে তার ঘরের দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে প্রেসের প্রতিনিধিদের দেখা হয়ে যায়। তখন তিনি তাদের বলেন : ভদ্রমহোদয়গণ আমি দুঃখিত যে আপনারা অপেক্ষা করে আছেন। আমার শেষ করতে হবে কিছু জরুরী কাজ, আপনাদের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করব।
মিঃ অ্যাডাম আর মিঃ স্টার্ডাট, দুজনেই মিঃ কার্লেকে আশ্বস্ত করে বলল, আমরা অপেক্ষা করছি, আপনার সুবিধা মতো সময়ে দেখা করবেন। ঘরের ভিতর প্রবেশ করে মিঃ কার্লে ভেতর থেকে দরজা ভেজিয়ে দেন–তাকে আর তারপর জীবিত অবস্থায় দেখা যায়নি।
পোয়ারো বলল, বলে যান
ইনসপেক্টর আবার তার কথার জের টেনে শুরু করল। চারটের কিছু পরে মিঃ কর্নওয়ার্দি তাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং মিঃ কার্লের ঘরের সামনে প্রেসের দুজন প্রতিনিধিকে তখনো সেখানে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যান। মিঃ কার্লেকে দিয়ে কতকগুলো চিঠি সই করবার জন্য তিনি তার ঘরেই যাচ্ছিলেন। কর্নওয়ার্দি ভাবলেন, চিঠি সই করবার সময় প্রেসের দুজন প্রতিনিধির বসে থাকার কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন। তিনি ঠিক সেই মতো মিঃ কার্লের ঘরে গিয়ে ঢোকেন। মিঃ কার্লেকে ঘরে ঢুকে প্রথমে তিনি দেখতে পেলেন না। তখন তার ঘরটা ফাঁকা মনে হয়েছিল। মিঃ কার্লের নির্দিষ্ট চেয়ারটাও ফাঁকা ছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার! কারণ সহসা এসময় তিনি ঘর ছেড়ে কোথাও যান না। চওড়া টেবিলটার পিছনে হঠাৎ একটা বুটের ডগার দিকটা তার নজরে আসে। ঠিক জানালার পাশেই ছিল টেবিলটা। দ্রুতপায়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য। তখনই দেখলেন সেইখান থেকেই মিঃ কার্লের রক্তাপ্লুত দেহটা লম্বা ভাবে মেঝের উপর পড়ে রয়েছে। রিভলবারটাও রয়েছে তার দেহের পাশেই।
দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তখন মিঃ কর্নওয়ার্দি এবং খানসামাকে ডাকেন, নির্দেশ। দেন ও স্টীলি ক্লীটকে ফোন করার জন্য। পরে পুলিশকে খবর দেবার ব্যবস্থা করা হয় স্টীলিং ক্লীট-এর নির্দেশানুযায়ী।
পোয়ারো জানতে চাইল গুলির শব্দ কেউ শুনতে পায়নি? যেহেতু এদিকে যান চলাচল খুব বেশী। বাইরের দিকের জানালাও তখন বন্ধ ছিল। গুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া খুব অসম্ভব ব্যাপার মোটর আর লরির হর্নের অবিশ্রান্ত শব্দ ভেদ করে। মাথা দোলালো পোয়ারো চিন্তিতভাবে, তার মৃত্যু ঘটেছে ঠিক কটার সময় বলে মনে হয়?
আমি এখানে আসা মাত্র ওকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখি, স্টীলিং ক্লীট বলল–তখন চারটে বেজে বত্রিশ। হয়তো তার একঘণ্টা আগে মিঃ কার্লে মারা গিয়েছেন। অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠল পোয়ারোর মুখ। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে স্বপ্নে তিনি যে সময় এই ঘটনাটা দেখতেন বাস্তবের সঙ্গেও সেটার মিল থাকা বিচিত্র নয়। আমাকে তিনি সময় বলেছিলেন তিনটে বেজে আঠাশ মিনিট। ডঃ সীলিং ক্লীট বলল ঠিক তাই।
কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে, রিভলবার থেকে? পোয়ারো প্রশ্ন করলো।
সেটাতে ওর নিজের হাতের ছাপ ছিল।
রিভলবারটা নিশ্চয় তারই ছিল?
পোয়ারোর প্রশ্নের জবাব দিল এবার ইনসপেক্টর বার্নেট।
ডেস্কের নীচের ড্রয়ারে থাকত সবসময় তার রিভলবারটা। দৃশ্যটা হুবহু সেইরকম। স্বপ্নে তিনি যে রকম দেখতেন বলে আপনাকে বর্ণনা দিয়েছেন। বেশ জোরের সঙ্গেই মিসেস কার্লে স্বীকার করেছেন যে জিনিসটা তারই। এছাড়া একটাই মাত্র দরজা, তার ঘরে প্রবেশ করার। প্রেসের দুজন প্রতিনিধি অপেক্ষা করছিলেন।
ভেতর থেকে বন্ধ দরজা সংলগ্ন প্রশস্ত বারান্দায়। তাদের সামনে দিয়েই যেতে হবে যদি কাউকে ঘরের ভেতর প্রকোপ করতে হয়। মিঃ কর্নওয়ার্দি চিঠির তাড়া নিয়ে ঘরে ঢোকার আগে অন্য কেউ যে ঘরে ঢোকেনি সে বিষয়ে তারা নিঃসন্দেহ। অতএব তিনি আত্মহত্যা করেছেন, এটাই ধরে নিতে হবে। ইনসপেক্টর বানেট সামান্য একটু হাসল মনে হল চেষ্টাকৃত হাসি। এই মুহূর্তে যদি কেউ না আসে, অথবা অন্য কাউকে হাসাতে না পারে তবে জোর করে হাসতে হয়। তার বুকটা ফেটে যায় একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায়। কিন্তু এখন সে কিইবা করতে পারে।
এতগুলো সাক্ষী যেখানে, দেখুন তাহলে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। থাকার কথাও নয়। বার্নেট বলল। পোয়ারো তার কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, এতগুলো সাক্ষী মানে?
মিঃ অ্যাডাম ও মিঃ ষ্টার্ডাট, সর্বোপরি তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারী মিঃ কর্নওয়ার্দি অর্থাৎ প্রেসের দুজন প্রতিনিধি এবং কর্নওয়ার্দি এদের সাক্ষ্যই কি প্রমাণ করে না যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
পোয়ারো বলল, সত্যি মিথ্যে যাচাই না করে আপনি কেউ কিছু বললেই তা মেনে নেবেন?
মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি এর প্রতিবাদ করছি, সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কর্ন ওয়ার্দি। যখন আমার কথায় আপনার আস্থা নেই, তখন আপনাদের আলোচনায় মাঝে আমার না থাকাই ভালো বলে আমার মনে হয়। তদন্তের কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে আমি থাকলে সেজন্য
মিঃ কর্নওয়ার্দি সেটা আপনার দেখার কথা নয় আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটল কিনা। আপনার এখানে উপস্থিতি যতক্ষণ আমাদের কাম্য বলে মনে হবে ততক্ষণই আপনাকে থাকতে বলব, তার এক সেকেন্ড বেশি বা কম সময় আপনাকে আমরা ধরে রাখতে যাবো না। সুতরাং আপনি বসতে পারেন পোয়ারো জানালেন।
হুগো কর্নওয়ার্দি ফিরে আবার তার চেয়ারে বসে পড়ল। তবে মুখটা তার এখন বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছিল আগের থেকে। কিছুটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাল মিস জোয়ানো কার্লে তার দিকে। তাদের যেন একপলকে চোখে কি কথা হয়ে গেল।
তরুণ বয়স্ক, সুপুরুষ দেখতে, হুগো কর্নওয়ার্দি। সেই কারণে একটু দুর্বলতা থাকতেই পারে জোয়ানোর মতো সুন্দরী যুবতীর। হয়তো এটা কোনো ব্যাপার নয়। আপাতত ওদের দুজনার প্রসঙ্গ থাক। পরে ভাবব পরের কথা, ভাবল এরকুল পোয়ারো। এবার ফিরে তাকাল পোয়ারো ইনসপেক্টর বার্নের্ট এর দিকে, এবং বলল, আচ্ছা আপনি যেন কি বলছিলেন মিষ্টার বার্নেট? এতগুলো সাক্ষী যেখানে…বলতে গিয়ে থেমে গেলেন আপনার হয়তো শেষ করা হয়নি কথাটা। এবার তাহলে বলুন।
যা বলছিলাম আমি–তবে একটা মাত্র কারণেই
বললেন মিঃ বার্নেট।
সেই কারণটা কি জানতে পারি? বললেন পোয়ারো ইনসপেক্টর বার্নেট এই কথা বলে হাসল–আপনাকে লেখা সেই চিঠিটা। মঁসিয়ে পোয়ারো, কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে ফেলছে সেই চিঠিটা আমার হিসাব ভুল করে দিচ্ছে।
হাসল পোয়ারোও। সে বলল, তাই নাকি?
এরকুল পোয়ারো যেখানেই থাকে, সেখানেই একটা খুনের সন্দেহ দেখা দেয় তাই না মিঃ বার্নেট?
এটাই প্রমাণিত হচ্ছে।
ইনসপেক্টর শুকনো গলায় বলল, কথাটা খুবই সত্যি, শুরু করল আবার–যাই হোক তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দেবার পর
পোয়ারো বলে উঠল তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে এক মিনিট দাঁড়ান। তারপর ফিরে তাকাল মিসেস কার্লের দিকে, এবং প্রশ্ন করল, আচ্ছা মিসেস কার্লে আপনার স্বামীকে কি কেউ কখনো হিপনোটাইজ করেছিল বলে মনে হয়? মিসেস কার্লে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন না, কখনওই না। আমার স্বামী সেরকম বোকা মানুষ ছিলেন না। বেশ ভালো কথা, পোয়ারো বলল, এবার আমার আর একটি প্রশ্ন হল, হিপনোটিজম সম্বন্ধে কি মিঃ কার্লের কোনো পড়াশুনার অভ্যাস ছিলো? অথবা কোনো আগ্রহ ছিল তার এই বিষয়ে?
মাথা নেড়ে না জানালেন মিসেস্ কালে এবং বললেন, তা হলেও আমার এটা জানা নেই। ভদ্রমহিলার সযত্ন রক্ষিত আত্ম সংযমের সুদৃঢ় বাঁধটা প্রবল ভাবাবেগের বন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় গুঁড়িয়ে পড়ল অকস্মাৎ। অশ্রুর বন্যা নামল তার দুচোখে, তিনি বলতে শুরু করলেন কান্নাভেজা, ভাঙ্গা ভাঙ্গা করুণ গলায়, এই শোচনীয় পরিণতির জন্য দায়ী ওই অভিশপ্ত স্বপ্নটাই। যার ওপর অশুভ শক্তির প্রভাব চেপে বসে একমাত্র সেই বোঝে কি দুনিৰ্বার এই শক্তি। কি কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল ওঁকে আপনারাই ভেবে দেখুন। প্রতিটি রাত ক্ষুধিত নেকড়ের মতো সেই ভয়াল বিধুর দুঃস্বপ্নটা ওর ঘুমের গুহায় হানা দিয়ে গেছে। ওর মানসিক অবস্থা কি হতে পারে এই পরিস্থিতিতে। একজন মানুষ, হয়তো তার অসুস্থতার জন্য রাতের পর রাত তাকে জেগে থাকতে হয়, তাহলে তার কি পরিণতি হতে পারে?
আমরা প্রায়ই এরকম ঘটনা শুনতে পাই। ক্রমশঃ রাত্রি জাগরণের ফলে পাগল হয়ে গেছে। বেচারা। মিঃ পোয়ারো সেজন্য আমার এক্ষেত্রে কি মনে হয় জানেন?
কি বলুন, মিসেস কার্লে? পোয়ারো জানতে চাইলেন।
মিসেস কার্লে বললেন, তিনি অবশেষে আত্মহননের পথটাই বেছে নিলেন তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে।
মনে পড়ে গেল পোয়ারোর বেনেডিক্ট কার্লের কথা। আমি সত্যি যেটা করতে চাই। আমি এবার সেই কাজটা সমাধা করতে যাচ্ছি। এবার আমার জীবনের ইতি টানব আমি। পোয়ারোর চিন্তা থেমে গেল কথাটা মনে হতেই।
সময়ে সময়ে মানুষ পাগল হয়ে যায় রাত্রি জাগরণে, আবার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। তবে একথা সে মেনে নিতে পারছে না এজন্য কেউ আত্মহত্যা করবে। আর এই স্থানেই সে অন্যদের সঙ্গে একমত হতে পারছে না। কারো যুক্তিই তার যুক্তি সঙ্গত মনে হচ্ছে না এক্ষেত্রে মিঃ কার্লে নিজেই তাকে বলেছিলেন অথবা এও বলা যেতে পারে তিনি তার শেষ ইচ্ছাই প্রকাশ করেছিলেন, এভাবে বেঁচে থাকা যায় না, একথাটাই কেবল তার মনে হচ্ছিল কোনো এক অশুভ শক্তি এসে রাতের পর রাত আমার ঘুমের গুহায় হানা দেবে, আমার দেহ মন অবশ করে দেবে। আর আমি ঘুমাতে না পেরে পাগলের মতো ছটফট করব, কতদিন তা সহ্য করা যায়? এর ইতি টানা প্রয়োজন। আর তা এখনই এগুলিও তিনি বলেছিলেন, আত্মহনন হল সেই চূড়ান্ত সম্পত্তির অর্থ। যখন পোয়ারো শুনেছিল কার্লের কথাগুলো মনে হচ্ছিল এগুলা তার মনের কথা নয়, কেউ তার মুখ দিয়ে যেন এ কথাগুলো বলাচ্ছিল।
কেউ যেন তাকে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে যেতে প্ররোচিত করছিল। তখন যেমন পোয়ারোর মনে হয়েছিল তেমন আজও মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি যদি তিনি আত্মহত্যা করে থাকেন, তবে স্ব ইচ্ছায় করেননি। আড়াল থেকে হয়তো তাকে কেউ মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে, তার এই কাজের পিছনে হয়তো কারো কৌশল নিযুক্ত আছে। তাহলে দেখতে হবে কে হতে পারে সেই অদৃশ্য মানুষটি? খতিয়ান করে দেখতে হবে মিঃ কার্লের মৃত্যুতে তার কি লাভ হতে পারে। চিন্তা করছিল পোয়ারো।
আপাতত তার চিন্তাটাকে সুপ্ত রেখে পোয়ারো সরাসরি ফিরে তাকাল মিসেস কার্লের দিকে। সে বলল, কখনো কি আপনার মনে এমন সন্দেহ জেগেছিল যে আপনার স্বামী আত্মহত্যা করতে পারেন?
মিসেস কার্লে উত্তর দিলেন, সে রকম নয় তবে
মিসেস কার্লে এই তবে টা কি? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল পোয়ারো, থামলেন কেন বলুন?
তার কথার জের টেনে মিসেস কার্লে আবার বললেন, তবে, মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত বলে মনে হত তার চালচলন, অর্থাৎ ঠিক স্বাভাবিক আচরণ তখন তিনি করতেন না।
ফোঁস করে উঠল জোয়ানো কার্লে, খুব স্পষ্ট ভাবেই সে বলল, না, কখনই আত্মহত্যা করতে পারেন না আমার বাবা। তিনি সেরকম মানুষই নন। যথেষ্ট সচেতন থাকতেন তিনি নিজের সম্পর্কে সব সময়। কখনো কি এরকম মানুষ নিজেকে শেষ করতে পারেন একেবারেই সম্ভব নয়, তার সম্বন্ধে এরকম ধারণা করাটা শুধু অবাস্তবই নয় এটা একটা মিথ্যার অবতারণা করা।
এবার মুখ খুলল স্টীলিং ক্লীট, তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে কিনা একথা কারুর বাহ্যিক আচার আচরণ দেখে সবসময় বিচার করা যায় না এবং সেটা অন্য কারো মতের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। আরো ব্যাখ্যা দিল ডঃ স্টীলিং ক্লীট তার এই মতের সমর্থনে, সেজন্য আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে কোনো কোনো আত্মহত্যার ঘটনা। সামান্য আভাস ও কেউ কল্পনা করতে পারে না আগে থেকে এটা আরো আশ্চর্যের ব্যাপার। অবশ্য ঢাক ঢোল পিটিয়ে কেউই আত্মহত্যা করে না।
কারণ সেক্ষেত্রে তার আত্মহত্যার কাজ সফল হবে না, তাকে সেই কাজ থেকে বিরত হবার জন্য সকলেই চেষ্টা করবে। আর সেজন্যই তার আত্মহত্যা করা হয়ে ওঠে না। হয়তো কেউ কেউ আত্মহত্যা করবার পূর্বে পাগল হয়ে যায় এমন একটা প্রবাদ আছে। কথাটা নির্ভেজাল ভাবে সত্যি। কেউ কি তার সুন্দর জীবন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় নষ্ট করতে চায়। অর্থাৎ সাধারণতঃ কেউ নিজেকে হত্যা করে না জ্ঞানত। দেখা যাচ্ছে মানুষ নিজেকে খতম করে ফেলে অজ্ঞান অবস্থায় অতএব–পোয়ারো তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, মিঃ স্টীলিং ক্লীট মিঃ কালের মধ্যে কেউ কোনো পাগলামির লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একথাটা ভুলে গেলে চলবে না। সম্ভবত আপনিও নন, লক্ষ্য করেছিলেন কি আপনি?
ওঃ, থতিয়ে গিয়ে বললেন, না, হ্যাঁ আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি। এতে আর বোঝ না বোঝার কি আছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না কারোর পাগলামির লক্ষণ। অথবা বুঝিয়ে দিতে হয় না পাখি পড়ানোর মতো। এ ব্যাপারটা হল অনুভূতি দিয়ে বোঝার ব্যাপার। একটা বাড়তি মনোযোগ চাই এজন্য। যেটা স্নায়ুকোষগুলি সচল রাখে। একটু থামল এবার পোয়ারো এবং ফিরে এলো কাজের কথায়।
উঠে দাঁড়ালো পোয়ারোর চেয়ার ছেড়ে, যদি অনুমতি দেন, তবে সেই বিয়োগান্ত ঘটনাস্থল, মানে অকুস্থল আমি নিজের চোখে দেখে আসতে ইচ্ছা করি। অবশ্যই দেখতে পারেন বলে স্টীলিং ক্লীট তাকে দোতালায় সঙ্গে করে নিয়ে এলো।
তার সেক্রেটারীর ঘরের থেকে অনেক বড় মিঃ কার্লের বসার ঘরটা। পুরু কার্পেট দিয়ে মোড়া ঘরের সম্পূর্ণ মেঝেটা। হাতলওয়ালা চেয়ার চামড়ায় মোড়া, ঘরের বাড়তি শোভা বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট সৌখিন ও বিলাসবহুল আসবাবপত্র। বিরাট একটা লেখার টেবিল একধারে রাখা আছে। পোয়ারো তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায় ঘরের ভেতরটা সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলো। তারপর সন্তর্পণে টেবিলটা পেরিয়ে এসে দাঁড়ালো সে জানালার সামনে, সে দেখল দামি কার্পেটের উপর চাপ চাপ কালচে দাগ জানালার ঠিক নীচে। তার বুঝতে কোন অসুবিধা হলো না যে দাগটা টাটকা রক্তের, যেন সেই ক্রোড়পতি কালে তাকে বলছেন তার মনে পড়ল : ঠিক তিনটে বেজে আঠাশ মিনিটের সময় আমি ওই টেবিলের ডানদিকের নিচের ড্রয়ারটা থেকে আমার গুলি ভরা রিভলবারটা বার করে জানালার ধারে চলে আসি। রিভলবারে আগে থেকেই গুলি ভরে রেখেছিলাম। তাই কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না। তাই ঠান্ডা মাথায় ধীর স্থির ভাবে রিভলবারটা হাতে তুলে নিলাম। আর তারপর হ্যাঁ তারপর নিজেকে গুলিবিদ্ধ করলাম।
২. কার্লের আর্তনাদ
পোয়ারোর চোখের সামনে যেন ঠিক একটা এই রকম চিত্র ভেসে উঠল। সে অবশ্য কার্লের আর্তনাদ নিজের কানে শোনেনি। সেই প্রতিধ্বনি তার কানে এখনো বাজছে তার মনে হল। মনে হলো ঘড়িতে যেন নির্দেশ দিচ্ছে এখনই তিনটে আঠাশ। নিজের মনে মাথা নাড়ছিল পোয়ারো অবশ্য কার্লের মৃত্যুর সময় সে যদি উপস্থিত থাকত তাহলে সে দেখতে পেত দৃশ্যটা ঠিক এই রকমই এবং ভয়ার্ত আর্তনাদ শুনতে পেত সে। একথাও চিন্তা করলো পোয়ারো, সে যদি সেই সময় উপস্থিত থাকতো তাহলে কি, মৃত্যুর হাত থেকে তাকে বাঁচাতে পারতো? নিয়তি তবে আর কাকে বলে? সেদিন তাকে সব আশঙ্কার কথা পরিষ্কার ভাবে বললেন ভদ্রলোক, কিন্তু একবার তিনি জানতে চাইলেন না যে এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কিনা? অদ্ভুত মানুষ তিনি। তাকে তিনি ডেকে আনলেন তার সমস্যার কথা বলার জন্য। কিন্তু যখনই পোয়ারো সমাধানের পথ বলতে গেল তখনই তিনি নির্বিবাদে বললেন, এখানেই আমার বক্তব্যের ইতি টানছি, আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই, আমি নিজেই মোকাবিলা করতে পারবো আমার আসন্ন বিপদের। আপনি এখন যেতে পারেন। আর দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো কথাটা যেন পাঁচ কান না হয়ে যায়। আমি কেবল আপনাকেই আমার আশঙ্কার কথা বললাম। যদি সেই আশঙ্কার কথা অন্য কারো মুখে শুনি তাহলে বুঝবো সেজন্য আপনিই দায়ী হ্যাঁ, আপনিই। আমি তার আশঙ্কার কথা কারো কাছে প্রকাশ করব না, কার্লে একরকম জোর করেই আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন। নিজের মনে মাথা নাড়ল পোয়ারো, আমি কত মক্কেলকেই এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এর আগে। সেটা যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, কথাটা প্রকাশ করা কর্তব্য মনে করল সে কারণ তার যে অবস্থা গেল। কার্লের ব্যক্তিগত জীবনের একটা অধ্যায় সম্পর্কে নীরব থাকতে পারে না সে, বিশেষ করে এ অবস্থায়, এই মুহূর্তে। এই আকস্মিক মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত কিছু প্রকাশ না করলে ব্যাহত হবে পুলিসী তদন্তের কাজ। সে নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না একজন গোয়েন্দা হিসাবে।
এরকুল পোয়ারো এবার ফিরে এলো বাস্তব পরিস্থিতিতে কথাটা মনে আসতেই।
সে বলল ডঃ স্টীলিং ক্লীটের দিকে তাকিয়ে, এইভাবেই কি জানালাটা ভোলা ছিল? ডঃ মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। ওই পথে তো কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। বলল ডঃ স্টীলিং ক্লীট। আচ্ছা তাই নাকি? নিজেই যাচাই করে নিতে চায় পোয়ারো তার কথাটা। পরের কথা শুনে তার বিশ্বাস হয় না, এটাই তার স্বভাব। সব কিছুই সে নিজে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেবে, তার জন্য যদি তাকে অপ্রিয় হতেও হয় সে গ্রাহ্য করে না।
সেজন্য সে মাথা ঝোকালো জানালা দিয়ে, কার্ণিশ বা ওই জাতীয় কোনো কিছুর বালাই নেই জানালার, নীচে। সরাসরি নীচের দিকে নেমে গেছে সিমেন্ট বাঁধানো মসৃণ দেওয়াল। এমন পাইপ যার সাহায্যে ওপরে উঠে আসা যায়, জানালার সংলগ্ন বা কাছাকাছি তেমন পাইপ তার নজরে পড়ল না। পোয়ারো দেখল মানুষ তো দূরের কথা একটা বেড়ালও ওই মসৃণ দেওয়াল বেয়ে উঠতে পারবে না। কারখানার নিরেট দেওয়াল জানালার ঠিক বিপরীত দিকে, সমগ্র দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করে খাড়া ওপরের দিকে উঠে গেছে। কোনো ফাঁক ফোকর নেই তার মধ্যে।
তৎক্ষণাৎ শোয়ারো তার পর্যবেক্ষণ শেষ করে ফিরে তাকাল, তখনই বিস্ময়ের সুর ধ্বনিত হল ডঃ স্টীলিং ক্লীট এর কণ্ঠ থেকে এটাই বিশেষ আশ্চর্যের ব্যাপার যে মিঃ কার্লের মত একজন ক্রোড়পতি নিজের ব্যবহারের জন্য এরকম একটা অফিস ঘর পছন্দ করতে পারেন, তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো। জেলের কম্পাউন্ড থেকে যেন দূরের আকাশ দেখছি, দেখুন আপনি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে তাই মনে হয় না?
সারাদিন পোয়ারো তার কথা, হ্যাঁ বাস্তবিক সেটাই। তারপর সে তাকাল হাত কয়েক দূরে জানালার বাইরে নীরেট ইটের দেওয়ালটার দিকে।
এই দেওয়ালটার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমার মনে হচ্ছে, ডঃ সীলিং ক্লীট।
দুচোখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে নিমেষে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল ডঃ স্টীলিং ক্লীট। আপনি কি বলতে চাইছেন, এটা মনের উপরে প্রভাব পড়ার কথা, বললেন ডঃ স্টীলিং ক্লীট। পোয়ারো তৎক্ষণাৎ উত্তরটা দিল না। ধীরে ধীরে অলস ভঙ্গীতে এগিয়ে গেলো সে টেবিলটার দিকে। একটা লম্বা লোহার চিমটে তুলে নিল সে টেবিলের উপর থেকে। সেই চিমটের সাহায্যে কার্পেটের উপর থেকে একটি পোড়া দেশলাই এর কাঠি অতি সতর্কতার সঙ্গে তুলে নিলো সে, তারপর সেটা বাজে কাগজের বাক্সের মধ্যে ফেলে দিল। ডঃ স্টীলিং ক্লীট এর পছন্দ হলো না পোয়ারোর কাজের পদ্ধতি। ঈষৎ বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল তার কথায়-কখন সে আপনার এই খুঁটিনাটি কাজ শেষ হবে। কোনো গুরুত্ব দিল না পোয়ারো তার এই অসহিষ্ণুতায়। পোয়ারো এমন ভাব দেখালো যেন তার কথাটা শুনতে পায়নি যে এবং আপন মনে অস্ফুটভাবে বলে উঠল সে, খুবই অভূত পূর্ব পরিকল্পনাটি এটা মেনে নিতেই হবে, হাতে ধরা চিমটেটা রেখে দিল টেবিলের উপর তারপর সে তাকাল স্টীলিং ক্লীটের দিকে। হাজার হাজার প্রশ্ন জমা আছে এখন পোয়ারোর চোখে।
ডঃ স্টীলিং ক্লীট পোয়ারোর মনোভাব বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জেগেছে এটা আমার মনে হচ্ছে। পোয়ারো উত্তর দিল, একটা নয় হাজারটা প্রশ্ন। তবে আমার এই মুহূর্তে একান্ত জানা দরকার যে প্রশ্নটা সেটা হল
বলুন পোয়ারো সেটা কি? ডঃ বললেন।
মিঃ এবং মিসেস কার্লে কোথায় ছিলেন, মিঃ কার্লের মৃত্যুর সময় বলতে পারেন?
স্টীলিং ক্লীট সামান্য সময় মনে করার চেষ্টা করল তারপর বলল নিশ্চয়ই, যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গী করে সে বলল : নিজের ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মিসেস কার্লে, তার ঘরটা এই ঘরের ঠিক উপরে। ছাদের পাশে মিস কার্লের ঘর। সে আর্ট স্কুলের ছাত্রী। একটা স্টুডিও আছে তার ঘরের পাশেই। জোয়ানো তখন ব্যস্ত ছিলেন ছবি আঁকায় তার স্টুডিও ঘরে।
তবে, তাই নাকি? নীরব থাকল পোয়ারো দু-এক মিনিট, অলস ভঙ্গিমায় টেবিলের ওপর আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটলো, আবার সে মুখ খুলল, তারপর একসময়, মিস কার্লের সঙ্গে আমি একবার নিজে কথা বলতে চাই, তাকে কি দু এক মিনিটের জন্য এ ঘরে ডেকে আনা সম্ভব হবে আপনার কি মনে হয়?
আপনি যেটা ভালো বুঝবেন, উত্তর দিলেন ডঃ কৌতূহলের চিহ্ন ফুটে উঠল স্টীলিং ক্লীটের চোখে, তবে আর কথা না বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। ভেজানো দরজা ঠেলে মিনিট কয়েক বাদেই ঘরে এসে ঢুকল জোয়ানো কার্লে আমি আপনাকে অসময়ে ডেকে এনে কোনো অসুবিধায় ফেললাম নাতো ম্যাডাম?
না, না, মোটেই না, বলল জোয়ানো কার্লে।
ধন্যবাদ পোয়ারো বলল, মেয়েটির দিকে অল্প সময় তাকিয়ে রইল পোয়ারো। মনে হল অস্বস্তিবোধ করছে জোয়ানো। আর থাকতে না পেরে সে বলে উঠল। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
হ্যাঁ তাই তো, যেন সম্বিত ফিরে পেলো পোয়ারো বলল, মাদমোয়াজেল, আপনাকে আমি দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনি কি তাতে বিরক্ত হবেন? সবিনয়ে সে বলল।
শান্ত শীতল ছায়া কাঁপতে লাগল জোয়ানোর চোখের তারায়। অবশ্যই না, বিরক্ত হবো কেন? ঠান্ডা গলায় বিনীত বাচন ভঙ্গীতে সে জানাল, আপনি আমাকে যে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন প্রয়োজন মনে করলে। আর আমি সেজন্য একটুও বিরক্ত হবে না। আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেব আমি বরং খুশী মনেই। অবশ্য যদি উত্তরগুলো আমার জানা থাকে তবেই
তবেই মানে জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো।
মৃদু হাসলো জোয়ানো এই কথা বলে, আমি অপরূপা বুঝতেই পারছেন।
কিন্তু আমার ধারণা, আমার প্রশ্নগুলো খুব কঠিন এবং আপনার অজানা নয়। আর তাছাড়া অজানা প্রশ্ন আপনাকে করবই বা কেন? জোয়ানোর চোখে চোখ রেখে বলল পোয়ারো। আমার কাজ নয় কাউকে ঠকানো বা বেকায়দায় ফেলা। সত্যকে সামনে আনা আমার কাজ।
জোয়ানো চোখে গভীর সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করল। আপনি কি সত্যই এই কেসের সত্যকে উদ্ঘাটন করতে পারবেন?
পারব না কেন, তবে সব কিছু আপনার উপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ আপনি কি বলেন তার ওপর।
জোয়ানো বলল, তাই নাকি?
এবার কোনো ভূমিকা না করেই পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি সে খবর জানতেন, যে আপনার বাবা তার টেবিলের ড্রয়ারে সবসময় একটা গুলি ভরা পিস্তল রেখে দেন?
ঘাড় নাড়লো জোয়ানো, না আমার জানা ছিল না বলল সে, এবার আপনার পরবর্তী প্রশ্ন বলুন।
হ্যাঁ অবশ্যই বলব, বলল পোয়ারো। এবার খুব মন দিয়ে আমার প্রশ্নটা শুনবেন তারপর বেশ চিন্তাভাবনা করে উত্তর দেবেন।
বেশ বলুন কি জানতে চান? জোয়ানো বলল।
আপনি এবং আপনার মা কোথায় ছিলেন, যখন আপনার বাবার মৃত্যু হয় পোয়ারো বলল, শুনেছি উনি আপনার বিমাতা, ঠিক বলছি তো?
উনি আমার সৎ মাই হন, লুইসি কার্লে ওর নাম। আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী বলল জোয়ানো। আপনারা দুজনে কোথায় ছিলেন, গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার রাত্রে?
কি যেন চিন্তা করল জোয়ানো কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে। বলল বৃহস্পতিবার…একটু চিন্তা করতে দিন, অপেক্ষা করুন, মনে করতে চেষ্টা করল সে গত বৃহস্পতিবার আমরা যেন কোথায় ছিলাম? চিন্তা করার পর জোয়ানো বলল, হ্যাঁ এবার মনে করতে পেরেছি। আমরা থিয়েটারে গিয়েছিলাম প্রত্যেকে। দ্য লিটল ডগ লাফড নাটকটা দেখতে।
আপনার বাবা কি আপনাদের সঙ্গে যাবার প্রস্তাব করেছিলেন?
না, না কখনই তিনি নাটক, থিয়েটার দেখতে যেতেন না।
তাহলে সন্ধ্যে বেলাটা তিনি কিভাবে কাটাতেন প্রশ্ন করল পোয়ারো?
তিনি তার কাজ নিয়ে থাকতেন বলল জোয়ানো, পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি তার ঘরে।
কোথাও তিনি যেতেন না কখনও?
না…উত্তর দিল জোয়ানো।
তিনি সামাজিক মেলামেশা করতেন না? পোয়ারো প্রশ্ন করল, জোয়ানো এবার সোজাসুজি তাকান পোয়ারোর দিকে। বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করল সে। মনে মনে তখন সে ভাবছিল পারিবারিক কথা এই ভদ্রলোককে বলা সম্ভব কি না, বা বলা উচিত কিনা। সে পূর্বেই শুনেছে এরকুল পোয়ারোর নাম। মনের কথা ওকে বলা যায়? ওঁকে বিশ্বাস করা যায়। অন্যের কাছে নিশ্চয়ই তিনি তাদের ঘরোয়া কথা প্রকাশ করবেন না। তাছাড়া জোয়ানোর মনে আর একটা কথাও জাগল। চিকিৎসক এর কাছে তেমন রোগীর রোগ সম্পর্কে কিছু গোপন করা উচিত নয়। কারণ রোগ নির্ণয় করা তাহলে সহজ হবে। যেমনি খুনের কেসে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করে দিতে হবে। মিস কার্লে এইসব ভাবার পর আবার বলল :
মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি আপানকে সমস্ত সত্য কথাই বলব। আমার বাবার ব্যক্তিত্ব ছিল কাঠিন্যতা পূর্ণ। আর কেউ তাকে হয়তো এজন্য সহ্য করতে পারতো না। তার অতি কাছের লোকেরাও তাকে কিছুতেই পছন্দ করত না।
পোয়ারো মন্তব্য করল, সত্যি ম্যাডাম, খুব গুছিয়ে আপনি বলতে পারেন মার কথাটা। আমি আপনার মূল্যবান সময় সংক্ষেপে করে দিচ্ছি মিঃ পোয়ারো। এছাড়া আমার অন্য উদ্দেশ্য নেই। আবার সে বলল, আপনার প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থটা যে কী, তা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। আমার সত্যার কথা যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে প্রথমেই বলি, তিনি আমার বাবাকে বিত্তবান জেনে সেই লোভেই বিয়ে করেছিলেন। এখানে আমিও কেন মুখ বুজে পড়ে আছি জানেন, আমি স্পষ্ট করেও বলছি, সেটাও আমার বাবার অর্থ ও সম্পত্তির লোভে। কারণ কোথায় চলে গিয়ে যে একা একা শান্তিতে থাকব তার উপায় নেই, কারণ আমার হাত একেবারে খালি। তার ওপর আমি ভালোবাসি একটি ছেলেকে, খুবই গরীব সে। আমার বাবা জানতেন আমাদের প্রেমের ব্যাপারটা, তিনি হয়তো মনে মনে চাইতেন যে আমি তাকে বিয়ে করি। আর যাহোক আমি তো বাবার সব বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবো-কাজেই ব্যাপারটা খুব সহজ।
হা সাথে সাথে আপনার বাবার সৌভাগ্য আপনাতে বর্তাচ্ছে। ঠিক কথাই বলেছেন মিঃ পোয়ারো। তবে সিকি মিলিয়ন রেখে গেছেন সৎ মায়ের জন্য। এছাড়া আরও কিছু শর্ত ছিল তার উইল-এ। তবে বাদ বাকী সব আমার। মেয়েটি হঠাৎ হেসে উঠল তাহলে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বাবার মৃত্যু কামনা করা আমার পক্ষে খুবই যুক্তি যুক্ত তাই না?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল। হ্যাঁ ম্যাডাম? আপনি দেখছি আপনার বাবার বিষয় সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে তার বুদ্ধিরও উত্তরাধিকারিণী হয়েছেন।
মেয়েটি চিন্তিত মুখে বলল, আমার বাবা যে চতুর ছিলেন একথা স্বীকার করি এবং চিনি প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। লোকের কাছে তার পরিচয় এরকমই ছিলো। তার অন্যকে নিয়ন্ত্রিত করবার একটা ক্ষমতা ছিল অথচ কিই বা লাভ হলো? শুধুই তিক্ততা সবই ব্যর্থ হলো–বড়ই প্রকট ছিল তার মধ্যে সাধারণ মানবিক গুণাবলীর স্বভাব।
স্রিয়মাণ মুখে বলে উঠলো পোয়ারো, হায়। ভগবান। কি অসম্ভব বোকা আমি?
চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জোয়ানো কার্লে ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে। তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু জানতে চান আপনি?
আছে আরো ছোট দুটি প্রশ্ন, এই লোহার চিমটেটা, টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল এবং জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো এটা কি টেবিলের ওপর সব সময়ই পড়ে থাকে?
জোয়ানো বলল, বাবা ওটা ব্যবহার করতেন কোনো জিনিসপত্র তোলার জন্য। ঘর নোংরা থাকা কোনোমতেই তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। পোয়ারো বলল, আর একটা প্রশ্ন? স্বাভাবিক ছিল কি আপনার বাবার দৃষ্টিশক্তি?
পোয়ারোর দিকে নিশ্চল ভাবে তাকালো জোয়ানো। বলল সে, ঠিক কথা, না, তিনি চশমা ছাড়া একেবারেই কিছু দেখতে পেতেন না। সব কিছুই তার অস্পষ্ট মনে হত। তার দৃষ্টিশক্তি ছেলেবেলা থেকেই খারাপ ছিলো।
চশমা পরে তার কি দেখার অসুবিধা হতো পোয়ারো জানতে চাইল।
না, চশমা পরে দেখতে তার কোনো অসুবিধা হতো না, জানাল জোয়ানো।
খবরের কাগজের ছোট লেখা তিনি কি পড়তে পারতেন।
হ্যাঁ তা পারতেন অবশ্যই জোয়ানো উত্তর দিল। আচ্ছা ম্যাডাম এ পর্যন্ত থাক আমার আর কিছু জানার নেই। আপনি এখন যেতে পারেন। তবে আশাকরি প্রয়োজন হলে সহযোগীতা করবেন। পোয়ারো বলল তা অবশ্যই করবো। এই কথা বলে জোয়ানো আর দাঁড়াল না, মন্থর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো পোয়ারো অনেকক্ষণ বসে রইল জোয়ানো যে পথ দিয়ে চলে গেল সে দিকে তাকিয়ে। নানা চিন্তা খেলা করছে তখন তার মাথায়। একটা চিন্তার সমাধান হতে না হতেই আরেকটা চিন্তা হাজির হয় আবার সেই চিন্তার জট খুলতেই, নতুন আর একটা চিন্তা। এমন সেই চিন্তা, যেটার সঙ্গে কোনো মিল নেই আগের চিন্তাগুলোের। এই লোকের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তবে পোয়ারো মনোযোগ দিলে বুঝতে পারত। একত্রিত করা যায় সব চিন্তাগুলিকে, সেগুলো দেখা যাবে একই সূত্রে বাঁধা। প্রতিটি চিন্তাই যেন এ ওর পরিপূরক। সবগুলোই অসমাপ্ত বলে মনে হবে একটি পদ বাদ দিলে। সেজন্য সে কোনো চিন্তাই নস্যাৎ করতে পারলো না। প্রতিটি চিন্তা এবং তার সমাধানের উপায়। অর্থাৎ লুকিয়ে রাখল সে তার স্নায়ুর নাগপাশে। তখনই সে তার স্মৃতির ভাণ্ডারে হানা দেবে যখনই তার ইচ্ছা হবে। বা প্রয়োজন মনে করবে। এবং সমাধানের সূত্র খুঁজে বার করবে। একটা সম্ভাবনার কথা মনে এল তার, সমাধানের সূত্রের কথা মনে করতেই। সে তার মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করল নিজের ওপর সে দোষারোপ করতে লাগল। সে বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলতে লাগল, ওঃ কি নির্বোধ আমি। প্রকৃতপক্ষে আমি যেন জম্মের বোকা। একবারের জন্যও আমার সেদিকে দৃষ্টি পড়েনি অথচ সারাক্ষণ জিনিসটা আমার চোখের সামনে পড়ে রয়েছে। আমার তো বোঝা উচিত এত সামনেই পড়ে রয়েছে। তাদের কাছেই হয়তো নজরে আসেনি এত কাছে পড়ে আছে বলেই। আর একবার জানলা দিয়ে মাথা গলিয়ে পোয়ারো নীচের দিকে তাকালেন। কাছারি বিল্ডিং আর নর্থওয়ে হাউস এর মাঝ বরাবর একটি সরু প্যাসেজ এতক্ষণে তার নজরে পড়ল কালো একটা বস্তু প্যাসেজের মাঝখানে।
তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ালো পোয়ারো, একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তির হাসি তার চোখে মুখে। সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে সে এবার নীচে নেমে এলো।
লাইব্রেরী ঘরে অন্য সকলে অপেক্ষা করছিল। পোয়ারো বেনেডিক্ট কার্লের সহকারী হুগো কর্নওয়ার্দিকে বলল : মিঃ কর্নওয়ার্দি, বিস্তারিতভাবে একটু বলুন আমাকে স্মরণ করে, যে। কখন, কি অবস্থায় মিঃ কার্লে আমার কাছে চিঠি পাঠাবার নির্দেশ দেন। কোনো ঘটনাই যেন দয়া করে বাদ দেবেন না। আচ্ছা চিঠির বয়ানটাও কি তিনি যথাযথভাবে আপনাকে বলে দিয়েছিলেন?
বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তিনি আমায় এই চিঠিটা টাইপ করার নির্দেশ দেন, আমার যতদূর মনে পড়ছে, বললেন মিঃ কর্নওয়ার্দি।
চিঠিটা তাকে দেওয়ার ব্যাপারে কি বিশেষ কোনো নির্দেশ ছিল? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে তিনি নিজে হাতে চিঠিটা তাকে দিতে বলেছিলেন।
তার নির্দেশ আপনিও ঠিক ভাবে পালন করেন?
হু বললেন কর্নওয়ার্দি।
খানসামাকে কি কোনোরকম ব্যক্তিগত নির্দেশ দেওয়া ছিল আমাকে তার কাছে নিয়ে আসার ব্যাপারে? কর্ণওয়ার্দি বললেন, হ্যাঁ, আমায় তিনি বলেছিলেন যেন খানসামা হোমসকে ডেকে দিই। এক ভদ্রলোক তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন আগামীকাল সন্ধ্যা সাড়ে নটায়, তিনি হোমসূকে তার নাম জিজ্ঞাসা করতে নির্দেশ দেন, আর যেন সে দেখতে চায় সেই চিঠিটা যেটা ওই ভদ্রলোককে পাঠানো হয়েছে।
খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, এ ধরনের নির্দেশে সাবধানতার মন্ত্রটা অশোভন ভাবে বেশি আপনার কি মনে হয়। মিঃ কর্নওয়ার্দি?
কর্নওয়ার্দি গুরুত্ব না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন সতর্কতার সঙ্গে বলল সে, মিঃ কার্লে একটু অস্বাভাবিক ধরনের মানুষ।
মিঃ কালের আর কোনো নির্দেশ ছিলো, জানতে চাইলো পোয়ারো।
কর্নওয়ার্দি বললেন, তিনি আমাকে ছুটি নিতে বলেছিলেন ওই সন্ধে বেলাটার জন্য।
আপনিও সেই নির্দেশটা নিশ্চয়ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন?
কর্নওয়ার্দি বলল, সেদিন সন্ধ্যায় আমি সিনেমা দেখতে চলে যাই, নৈশভোজের পরই। কখন আপনি ফিরে এলেন, জানতে চাইলো পোয়ারো।
তখন প্রায় সওয়া এগারোটা হবে, হুগো বললেন।
মিঃ কার্লের সঙ্গে সেদিন কি আপনার আর দেখা হয়েছিল?
না। বললেন কনওয়ার্দি।
তিনি কি পরের দিন সকালে আপনাকে এ বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
না তিনি কিছু বলেন নি, জানালো মিঃ কর্নওয়ার্দি আবার একটু থামলো পোয়ারো। শুরু করল আবার সে, যখন আমি এখানে এসে পৌঁছাই তখন আমাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। না, আমাকে তিনি বলেছিলেন আমি যেন হোমসকে নির্দেশ দিই। আপনাকে যেন সোজাসুজি তার ঘরেই নিয়ে যাওয়া হয়। মিঃ কার্লে সেখানেই আপনার জন্য তিনি অপেক্ষা করবেন। কিছু জানেন কি আপনি এই ব্যবস্থা কি জন্য? পোয়ারো প্রশ্ন করলো।
মাথা নাড়লেন কর্নওয়ার্দি। কখনো আমি তার নির্দেশ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করতাম না, সেদিনও করিনি। তিনি খুব বিরক্ত হতেন তার মুখের ওপর কোনো কথা বললে। এই কারণে সব ব্যাপারেই আমি নীরব থাকতাম।
তিনি কি সবসময় তার নিজের ঘরেই আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলঃ হ্যাঁ, বেশির ভাগ সময়, তবে সবসময় নয়, আমার ঘরেও হয়তো কখনো আপনাদের বসানোর ব্যবস্থা হতো। বলল কর্নওয়ার্দি।
আচ্ছা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি এর পেছনে? কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলো কর্নওয়ার্দি তারপর বলল, আমার তো সেটা মনে হয় না। অবশ্য এটা নিয়ে কোনোদিন বিশেষভাবে ভেবে দেখিনি।
এবার মিসেস কালের দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো, ম্যাডাম, আপনাদের খানসামা হোমসকে একবার ডেকে দেবেন, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
অবশ্যই, মঁসিয়ে পোয়ারো তাকে আমি এক্ষুনি ডেকে পাঠাচ্ছি। তারপর বেল টিপলেন মিসেস কার্লে। হোমস সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল অভিজ্ঞ খানসামার মতই।
আমাকে আপনি ডেকেছেন ম্যাডাম, সে জিজ্ঞাসা করল। পোয়ারোর দিকে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দিলেন মিসেস কার্লে। হোমস বিনীতভাবে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল। এবং বলল, বলুন স্যার কি জানতে চান? হোমস, বলতো তোমার প্রতি কি নির্দেশ দেওয়া ছিল, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন আমি এখানে আসি? বলল হোমস তার গলা পরিষ্কার করে মিঃ কর্নওয়ার্দি নৈশভোজের পর আমাকে বলেন। রাত সাড়ে নটা নাগাদ মিঃ এরকুল পোয়ারো নামে এক ভদ্রলোক মিঃ কার্লের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। ভদ্রলোককে একটা চিঠি দেওয়া হয়েছে, একথাও তিনি বলেন। তিনিই যে মিঃ এরকুল পোয়ারো তা জানার জন্য আমাকে চিঠিটা দেখতে বলা হয়েছিল। তারপর আমাকে নির্দেশ দেওয়া ছিল ভদ্রলোককে মিঃ কর্নওয়ার্দির ঘরে নিয়ে যাওয়ার। এমন কোনো নির্দেশ তোমাকে কি তোমার মনিব দিয়েছিলেন, যে আমাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করার আগে তোমাকে দরজায় নক করতে হবে? খানসামা একটু হতভম্ব হয়ে গেল পোয়ারোর প্রশ্নটা শুনে। একটু করুণ বিপন্নভাব ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। বলল সে, অবশ্যই সেটা ছিল মিঃ কার্লের স্থায়ী নির্দেশ। সব সময়েই নক করা আমাদের কাছে একটা প্রথা হয়ে গিয়েছিল। কোনো অপরিচিত লোককে সেখানে নিয়ে যাবার আগে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকই বেশি আসত, দেখা করতে। আসতেন তারা ব্যবসার বিষয়ে।
আমাকে অবাক করেছিল সেটাই, পোয়ারো বলল, আর কিছু নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন আমার সম্পর্কে? সে বলল, না স্যার। আমাকে কেবল এই কটি নির্দেশ দিয়ে যান কর্নওয়ার্দি বেরিয়ে যাবার সময়। তখন কটা বেজেছিল পোয়ারো জানতে চাইলেন, স্যার, নটা বাজতে দশ মিনিট বাকী ছিলো। উত্তর দিল খানসামা।
তুমি কোথায় ছিলে আমি আসার আগে? কিচেনে ছিলাম স্যার খানসামা বলল।
অবাক হয়ে পোয়ারো বলল কিচেনে? আর একটু আগে তুমি বলেছিলে, তোমার বাড়ির সবার নৈশভোজ সারা হয়ে গিয়েছিল আগেই। তুমি তাহলে কিচেনে কি কাজ করছিলে?
তখনো আমার নৈশভোজ সারা হয়নি খানসামাটি বলল। দোতলায়, না একতলায় তোমাদের কিচেনটা? পোয়ারো জানতে চাইল। দোতলায় স্যার, খানসামা বলল। কত দূরে সেটা মিঃ কালের ঘর থেকে? জানতে চাইল পোয়ারো। সে উত্তর দিল, দুখানা ঘরের পাশেই।
তাহলে ব্যাপারটা হচ্ছে, কর্নওয়ার্দি চলে যাবার পর দোতলায় তোমার মনিব কালের ঘরের সব থেকে কাছে ছিলে একমাত্র তুমিই। পোয়ারো মন্তব্য করল।
খানসামাটি বলল, হ্যাঁ স্যার।
তাহলে তুমি আজও কি কিচেনে ছিলে, তোমার মনিবের মৃত্যুর সময়?
হা স্যার, কিচেনেই ছিলাম আমি, সে জবাব দিল।
কোথায় ছিলেন তখন মিঃ কর্নওয়ার্দি?
পোয়ারো জানতে চাইলো।
খানসামা হোমস জোরে মাথা দুলিয়ে বলল তা, তো জানি না স্যার। আসলে আমি তখন ঠিক করে নজর দিইনি।
তুমি কি জানো তোমার ওপর নজর রাখা হয়েছিল? কি করে আমি জানব স্যার, আমার তো সেটা জানার কথা নয়।
তুমি কি করতে জানতে পারলে?
অবশ্যই একটু সতর্ক থাকতাম খানসামা বলল।
পোয়ারো জানতে চাইল কি ভাবে সতর্ক হতে?
তাহলে আমিও পাল্টে নজর রাখাতম।
হোমস চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিচুগলায় বলল, সব সময় সব কথা সবার সামনে বলা যায় না স্যার, কেউ শুনে ফেলতে পারে। এখানে দেওয়ালেরও কান আছে।
তোমার আশঙ্কার কথা নিরাপদ কোনো জায়গায় পরে না হয় শুনব, সেটাই ভালো হবে, পোয়ারো বলল। তোমার সঙ্গে কোথায় দেখা হতে পার?
বলল হোমস, আমার কিচেনে কিচেন খালি হয়ে যাবে একটু পরেই। আমার অনেক কথা বলার আছে স্যার। আপনার কাছে বলে হালকা হতে চাই। আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই
হোমস আমিও যে তোমার কাছে কিছু শুনতে চাই বলল পোয়ারো। ঠিক আছে তাই হবে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো পোয়ারো। সত্যি কথা বলছে কি খানসামা হোমস? কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে তাকে। তার দৃষ্টি মনে হয় অন্যপথে সরিয়ে দিতে চাইছে সে কথার মারপ্যাঁচে। কি হতে পারে এর অর্থ? সময় নিতে চাইছে কেন সে? প্রমাণ সরাতে চায় কি সে মিঃ কার্লের খুন সংক্রান্ত বিষয়ে? কি তার মোটিভ হতে পারে? এটা যদি আত্মহত্যার কেস না হয়ে খুনের কেস হয়, তবে কিসে এতে অংশ নিয়েছিল? আর কেই বা কলকাঠি নেড়েছিল এই হত্যার পেছনে?
পোয়ারোর মনে হল অসম্ভব এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে পাওয়া। এর খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি বিষয় ধীরে ধীরে আলোচনা করতে হবে। আর উত্তর বের করতে হবে প্রতিটি প্রশ্নের এক একটা করে। তারপর নির্দিষ্ট সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে উত্তরগুলিকে একত্র করে সাজিয়ে নিয়ে।
নতুন প্রশ্নমালার জের টেনে আবার সে শুরু করল খানসামা হোমস্ এর দিকে ফিরে কিয়ে মিঃ কার্লের সঙ্গে আর কি তোমার দেখা হয়ে ছিল হোমস?
প্রতিদিনের অভ্যাস মতো আমি ঠিক নটার সময় তার জন্য এক গ্লাস গরম জল নিয়ে গিয়েছিলাম, স্যার। বললো হোমস। গরম জলের গ্লাসটা তার টেবিলের ওপর রেখেও এসেছিলাম।
মিঃ কার্লে কি নিজের ঘরেই ছিলেন, না মিঃ কর্নওয়ার্দির ঘরে ছিলেন?
তারই ঘরে ছিলেন তিনি, স্যার।
কিরকম অবস্থায় তুমি তাকে দেখেছিলে? প্রশ্ন করল পোয়ারো।
চেয়ারে বসেছিলেন মিঃ কার্লে, বলল হোমস।
তুমি ঠিক দেখেছিলে তো, চেয়ারের পাশে তিনি কি পরেছিলেন?
না স্যার, আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম তিনি বসেছিলেন চেয়ারের উপর।
তোমার অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য পড়েনি ঘরের ভেতর জানতে চাইলো পোয়ারো।
অস্বাভাবিক অর্থে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন স্যার জানতে চাইল হোমস।
ধরো, চেয়ারে বসেছিলেন তিনি–হয়তো কোনো সে রকম উত্তেজনা বা অস্বাভাবিক আচরণ, এইরকম কোনো লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলে কি?
না তো, সে রকম কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ তার মধ্যে আমি দেখিনি স্যার, উত্তর দিল হোমস।
আচ্ছা বলতে পারো সেই সময় মিসেস কার্লে এবং মিস কার্লে কোথায় ছিলেন? পোয়ারো জানতে চাইল। তারা দুজনেই তখন থিয়েটারে গিয়েছিলেন স্যার।
ওদের কি থিয়েটার থেকে ফেরার পর মিঃ কার্লের ঘরে ঢুকতে দেখেছিলে প্রশ্ন ছুঁড়ল পোয়ারো। তখন আমি কিচেনে ছিলাম, সঠিক বলতে পারব না জবাব দিল হোমস।
বর্তমানে আমার এতেই কাজ চলে যাবে। হোমসকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে চলে যেতে বলল পোয়ারো।
অভিবাদন জানিয়ে হোমস ঘর থেকে চলে যাবার পর, পোয়ারো তাকালো ক্রোড়পতি বিধবা মিসেস কালের দিকে।
মিসেস কার্লে নড়াচড়া করছিলেন। পোয়রোর হাত থেকে কখন তিনি নিস্তার পাবেন কে জানে? তিনি কখনোই পুলিসী ঝামেলা বরদাস্ত করতে পারেন না। দরজার দিকে সেজন্য তিনি বার বার দৃষ্টিপাত করছিলেন। ভাবখানা এমন ছিল যে কখন পোয়ারো তাকে রেহাই দেবে। এই জিজ্ঞাসাবাদের সমাপ্তি হবে কখন?
মিসেস কার্লে এবার কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে, পোয়ারো জানাল। আপনার স্বামীর দৃষ্টিশক্তি কি স্বাভাবিক ছিল? একথা প্রথম জিজ্ঞাসা করছি।
না, তিনি কিছুই দেখতে পেতেন না চশমা ছাড়া বললেন মিসেস কার্লে।
তা হলে আপনি বলছেন যে তার দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ ছিলো? এটাই ধরে নেবো পোয়ারো বলল।
চশমা না পড়লে তিনি অসহায় হয়ে পড়তেন, এটা সত্যি কথাই মিসেস কার্লে জানালেন। একেবারেই যেন তিনি অন্ধ হয়ে যেতেন।
কয়েক জোড়া চশমাও ছিল তার নিশ্চয় জানতে চাইল পোয়ারো।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মিসেস কালে জানালো–হ্যাঁ সেটাই ঠিক।
পোয়ারো আহ্ শব্দটা উচ্চারণ করল। তারপর সে আবার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমার আর একটা প্রশ্ন আছে।
মিস কার্লে আর আপনি তো থিয়েটারে গিয়েছিলেন। স্বামীর সঙ্গে কি আপনি দেখা করেছিলেন থিয়েটার থেকে ফেরার পর?
না, করিনি–বললেন মিসেস কার্লে, আমরা আমাদের ঘরে সোজা চলে গিয়েছিলাম। অবশ্যই আমরা সেটাই করেছিলাম জোর দিয়ে বললেন মহিলাটি তার শেষ জবানবন্দীতে মিসেস কার্লে বলেছেন তিনি ও তার কন্যা জোয়ানো মিঃ কার্লের সঙ্গে দেখা না করেই যে যার ঘরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটা থিয়েটারের টিকিট পাওয়া গেছে বেনেডিক্ট কার্লের ঘর থেকে। একটাই পাওয়া গেছে, দুটো টিকিটের মধ্যে…হয়তো ওদের দুজনের মধ্যে কেউ একজন তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কে হতে পারে সেই একজন, মিস অথবা মিসেস কার্লে। থিয়েটারে গিয়েছিল ওরা দুজন। আর ফিরেও এসেছিল একই সঙ্গে। অতএব মিঃ কার্লের ঘরে কে প্রবেশ করেছিল? যদি কেউই গিয়েই থাকে, কেউ তা প্রকাশ করেনি জবানবন্দীর সময়। অর্থাৎ মিথ্যে বলছে কেউ না কেউ একজন। হয়ত বা তারা পরস্পরের অন্যায় কাজ ঢাকা দেবার চেষ্টা করছে। আবার অন্যভাবে মনে করা যায় তারা একজন আর একজনের কাছে, নিজেকে আড়াল রাখতে চাইছে। এই কথা বলে যে মিঃ কালের ঘরে তারা কেউই প্রবেশ করেনি। তাহলে-চিন্তা করছিল পোয়ারো এইসব তথ্য সম্বন্ধে।
এদের থেকে একটু অন্যরকম মিস জোয়ালো, এটাই মনে হয়। কারণটা হল এই যে, তার বাবাকে খুন করে বাড়তি কিছু তার লাভ হবে না, উইল করে তার নামেই লিখে গেছেন সমস্ত সম্পত্তি এবং অধিকাংশ অর্থই তার পিতা মিঃ কার্লে। তা হলে সে কেন তার পিতাকে হত্যা করবে? থিয়েটারের একটা মাত্র টিকিট পাওয়া গেছে কালের ঘরে। তার অনুমান যদি সত্যি হয়, পোয়ারো ভাবল, মিস জোয়ানো কালে যদি এই খুনের সঙ্গে জড়িত না হয়, তবে ধরে নিতে হয় টিকিটটা মিসেস কার্লেরই। হয়তো তিনি তার স্বামীর ঘরে গিয়েছিলেন। থিয়েটার থেকে ফেরার পর। হয়তো কোনো বোঝাঁপড়া করার জন্য, তা হলে কিসের বোঝাঁপড়া? মিসেস কার্লেকে তার উইলে অর্থ কিংবা সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত করেছেন। সেটা কি মনঃপূত হয়নি মিসেস কার্লের? তিনি কি বদলাতে চেয়েছিলেন মিঃ কালের উইল? সেজন্যই কি তিনি ঢুকেছিলেন মিঃ কার্লের ঘরে একটা বোঝাঁপড়া করার জন্য। আর তারপর-না, সেটাই বা কি করে সম্ভব? মিঃ কার্লে যদি আত্মহত্যা না করে থাকেন। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন যে অবস্থায়, কোনো নারীর লক্ষ্য ভেদ করা সম্ভব নয়। হয়তো বা এটাই কোনো পুরুষের কাজ অথবা নিজেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। অথবা কে হতে পারে সেই পুরুষটি যে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে?
মাথা নাড়লো পোয়ারো নিজের মনে। মনে হল তার মুখের ভাব দেখে যেন একটা প্রলম্বিত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ফুসফুস থেকে এটাই মনে হল। পোয়ারো তার সহজাত ভঙ্গীতে সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে পড়ে বলে উঠল, মনে হয় এখানেই মামলার নিষ্পত্তি ঘটলো, এটাই আমার বিশ্বাস। তাহলে সমাধানের একটি সূত্র খুঁজে পেয়েছেন আপনি?
হ্যাঁ পেয়েছি হয়তো কিন্তু
তবে কিন্তু কেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
আমার এই সমাধানের সূত্র এখানে অনেকেরই যেমন, মিসেস কার্লে এবং হুগোর পছন্দ নাও হতে পারে। বলল পোয়ারো ওরাই বা কেন মেনে নেবেন না ওঁরা। আমরা অর্থাৎ পুলিশ কর্তৃপক্ষ যদি আপনার সমাধান সূত্রকে যথেষ্ট বলে মনে করি। বললেন মিঃ বানেট বিশেষত মিসেস কার্লে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবেন মেনে নিলে, সে কারণেই মানতেন না। স্বামী আত্মহত্যা করে কেন? হয়তো তার স্ত্রীর সহযোগীতা ও ভালোবাসার অভাবে, তাই নয় কি? আর স্ত্রীই বা নিজেকে শেষ করে কখন? স্বামীর অত্যাচারে।
ইনসপেক্টর বার্নেট বললেন, মিঃ পোয়ারো এটাই ঠিক কথা। আপনি কি তবে নিশ্চিত যে আত্মহত্যা করেছেন মিঃ কার্লে?
আত্মহত্যা করবেন কেন তিনি, আত্মহত্যা করার মতো কি তার কোনো কারণ ঘটেছিল? পোয়ারো বলল।
সেই দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে হয়তো তিনি একসময় পাগলামীর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন, আর পাগলামীর একটা লক্ষণ আত্মহত্যা করা। এটা জানেন তো?
অবশ্যই জানি, স্বপ্নটা যদি সত্যি হয় সেই ক্ষেত্রে বলল পোয়ারো।
তাহলে কি স্বপ্নটা সত্যি নয়? জানতে চাইলেন বার্নেট। স্বপ্ন কি আর সত্যি হয়? উত্তর দিল পোয়ারো। পোয়ারোর কথার সারমর্মে যা বোঝাতে চাইছেন, ইনসপেক্টর বার্নেট বুঝতে পারল, সে যা জেনেছে দুঃস্বপ্নের কোনো সম্পর্ক নেই কার্লের আত্মহত্যার সঙ্গে। তাহলে কিসের সঙ্গে জড়িত মিঃ কার্লের আত্মহত্যা।
সারা ঘরে এখন বিরাজ করছে একটা, অস্বস্তিকর নীরবতা। সেই ছোটখাট মানুষটির মুখের ওপর এখন সকলের উদগ্রীব দৃষ্টি। কিন্তু সে দিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না এরকুল পোয়ারোর। সে তখন ব্যস্ত তার পশমের মতো নরম গোঁফের প্রান্ত ভাগে হাত বুলাতে। এটাও একটা সহজাত অভ্যাসের অন্যতম। একটা বিব্রত হত বিহ্বল ভাব ইনসপেক্টর বার্নেটের মুখে। ডঃ স্টীলিং ক্লীট তাকিয়ে আছে, দুই ভুরুর মাঝখানে কুঞ্চন রেখে কুটীল চোখে, অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তি মুখে চোখে মাখিয়ে চেয়ে আছে মিঃ হুগো কর্নওয়ার্দি। অব্যক্ত বিস্ময় মিসেস কার্লের দু চোখের কোণে আর অদ্ভুত চঞ্চলতা মিস জোয়ানোর চোখের তারায়।
মিসেস কার্লে শেষ পর্যন্ত ভঙ্গ করলেন সেই নীরবতা। ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বরে তিনি বলে উঠলেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি এসবের, মানে কিছুই বুঝতে পারছি না, সেটা কি স্বপ্ন ছিল না দুঃস্বপ্ন? এ নিয়ে অবশ্যই ভাবনা চিন্তা করা উচিত।
মহাশয়া আপনি ঠিকই বলেছেন, পোয়ারো তাকে সমর্থন জানিয়ে বলল, সত্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্বপ্নটা।
কেঁপে উঠলেন মিসেস কার্লে, তিনি বললেন, এর আগে আমি কখনো অলৌকিক বা অতি অলৌকিক ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। কাউকে যদি রাতের পর রাত এই দুঃস্বপ্নর শিকার হতে হয় সেরকম পরিস্থিতিতে
উঃ স্টীলিং ক্লীট বলল, সত্যিই ঘটনাটা আশ্চর্যজনক। অভূতপূর্ব, আপনার যদি না আপত্তি থাকে তাহলে মঁসিয়ে পোয়ারোকে আমাদের সরাসরি ব্যাপারটা বলতেন, যেহেতু আপনি সবিস্তারে খোদ মালিকের কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনেছেন, আবার পেশাদারী ভঙ্গিমায় হালকা ভাবে একটু কেশে নিয়ে বলতে শুরু করল, মিসেস কার্লে, মাপ করবেন, মিঃ কার্লে যদি নিজের মুখে কথাটা না বলতেন। আমার বক্তব্য হচ্ছে যে
পোয়ারো বলল সত্যি তাইই, তারপরই তার আধবোজা চোখ দুটি খুলে গেল, সে যেন হঠাৎ জেগে উঠল পিঙ্গলস বুজ আলোর আভাস তার ধূসর চোখের মনিতে, যদি না শোনাতেন আমাকে এই কাহিনি বেনেডিক্ট কার্লে–নিঃশ্বাস নেবার জন্য একটু থামল সে। সবার মুখের উপর দিয়ে সে তার তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি অর্ধবৃত্তাকারে একবার বুলিয়ে নিল।
তারপর সে এইভাবে বলতে শুরু করল
সেদিন সন্ধ্যায় এমন একটা কিছু ঘটেছিল, যার ব্যাখ্যা করতে আমি পারিনি, হয়তো আপনারা সকলেই সেটা বুঝতে পেরেছেন। প্রথম কথা হল, মিঃ কার্লে কেন আমার সঙ্গে তার সেই চিঠি আনতে বলেছিলেন?
কর্নওয়ার্দি অভিমত প্রকাশ করল হয়তো সনাক্তকরণের জন্য।
অত সোজা নয় বাছা আমার, অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপারটা। নিশ্চয়ই কোনো জোরালো কারণ আছে এর পশ্চাতে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেটা শুধু আমাকে নিয়ে আসতেই বলা হয়নি, চিঠিটা আমাকে দিয়ে দিতেও বলেন। সেই চিঠিটা এমন কি তিনি নষ্ট করেও ফেলেননি, আমার চলে আমার পরও। তার সেই চিঠিটা আজ বিকেল পর্যন্ত তার অন্য কাগজের মধ্যে ছিলো। কেউ তিনি রেখে দিয়েছিলেন সেই চিঠিটা, স্বভাবতই এই প্রশ্ন আসে-কেন, কেন, কেন–এবার মুখ খুলল জোয়ানো কার্লে। এবার জোয়ানো কার্লে বলতে লাগল, সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা সবাইকে জানাবার জন্য চিঠিটা তিনি রেখে দিয়েছিলেন, কারণ যদি তার জীবনে কোনো অঘটন ঘটে এটা আমার ধারণা। তার কথায় সম্মতি জানালো পোয়ারো মাথা নেড়ে। তারপর শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে সে ভাবল, মেয়েটা অসাধারণ। কেবলমাত্র তাই নয় সেজন্য মিসেস কার্লের থেকে অন্যরকম। তার মানসিকতা পৃথক, পরিচয়ও তার অন্যরকম। আর বিচার বুদ্ধি অনন্য। কিন্তু আবার ভাবল পোয়ারো, অভিনয় করছে না তো মেয়েটি? অনেক সময় চতুর মেয়েদের, ভেতরের রূপ বোঝা যায় না বাইরে থেকে দেখে। আবার জোয়ান কার্লের সম্বন্ধে বিরূপ কিছু ভাবাই যায় না। তাই সে ফিরে গেল মেয়েটির সম্বন্ধে পূর্ব ধারণায় এবং সে বলল :
ম্যাডাম আপনি খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা। হ্যাঁ, এটাই একটা কারণ হতে পারে চিঠিটা রেখে যাওয়ার এবং ব্যাখ্যা করলে এটাই দেখা যায়। যেমন মনে করুন, সেই অদ্ভুত স্বপ্নের প্রসঙ্গ উঠবে মিঃ কার্লের মৃত্যুর পর পুলিসী তদন্তের সময়। হয়তো আমিও সে সময় জানাবো এই স্বপ্নের কথা, হয়তো আমার মতো মিসেস কালেও জানাবেন একই কথা। যেহেতু আমরা দুজন মৃত মিঃ বেনেডিক্ট কার্লের মুখ থেকে শুনেছি সেই স্বপ্নের কথা। ঘোড়ার মুখের কথার মতো যেন ব্যাপারটা। তবে অত্যন্ত জরুরী, সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা। যতই ভয়াবহ স্বপ্ন হোক না কেন ম্যাডাম, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেটা। এবার আমি দ্বিতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। পোয়ারো বলল–আমি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম মিঃ কার্লের কাছে তার স্বপ্ন কাহিনি শোনার পর, সে আমি তার ঘরে গিয়ে সেই টেবিল, টেবিল সংলগ্ন ড্রয়ার এবং রিভলবারটা স্বচক্ষে দেখব। প্রথমে তিনি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে চেয়ার ছেড়ে যেন উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গী করলেন, কিন্তু না, আমার অনুমান ভুল, সেটা তার ইচ্ছা ছিল না। তার মনের কথা হল তিনি তার ঘরে নিয়ে যেতে চান না। স্পষ্টভাবে বোঝা গেল কিছু একটা ভেবে নিয়ে তিনি মত পরিবর্তন করলেন। আমার প্রস্তাবটা তিনি সরাসরি বাতিল করে দিলেন। মানুষটা কি অদ্ভুত। রাজি হয়েও মত পরিবর্তন করলেন। তার এইরকম মানসিক পরিবর্তন কেন? কেন প্রত্যাখ্যান করলেন আমার সেই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবটা? অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা ভেবেছি, তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আপনাদের মতামতের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চাই সেই গবেষণা লব্ধ উত্তরটা। আপনারা কি জানেন, এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন। চেষ্টা করে দেখুন না বলতে পারবেন। সবটা না পারলেও একটু কিছু বলুন। তারপর না হয় আমি বলব। হয়তো এসব ক্ষেত্রে আমরা নিজের চেয়ে অন্যদের মতামত বেশি কাজে লাগে। আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণ কি ছিল তার ক্ষেত্রে, সেজন্য আপনাদের বলছি, আপনারা কি কেউ জানেন? প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখের দিকে দেখতে লাগলো, তাদের অভিব্যক্তি এমন ছিল। যেন, তুমিই বলো। আমি শুনব, আমার ধারণাটা তোমার সঙ্গে মিলিয়ে নেব। আর চিৎকার করে বলে উঠব যদি মিলে যায়–ঠিক এই কথাটাই ভেবেছিলাম আমি। যদি না মেলে, সেজন্য চট করে বলার সাহস হচ্ছিল না। যদি রহস্য উদঘাটন না করতে পারি। কিছু মন্তব্য না করাই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে চিন্তে এটাই ঠিক করলাম। ভুল বর্ণনা থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে মুখ বন্ধ করে থাকলে। পোয়ারো তাদের সম্বন্ধে এইসব চিন্তা করছিল। কেউই অগ্রসর হল না তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে। যেন সবাই পালন করছে এক অদ্ভুত নীরবতা।
যখন আপনাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেলাম না। অতএব আমি প্রশ্নটা অন্যরকম ভাবে আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি। এমন কিছু ছিল কি পাশের ঘরে যার জন্য মিঃ কার্লে রাজি হলেন না আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে? যদি তাই হয় তবে সেটা কী? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল। পূর্ববৎ নীরবতা বিরাজ করছিল ঘরের মধ্যে। কে যেন সবার মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছিল আর চাবি যেন হারিয়ে গেছে। পোয়ারো বলল, নিঃসন্দেহে প্রশ্নটা কঠিনই নয় শুধু, জটিলও বটে। সর্বোপরি এটাই সত্যি যে এমন কোনো কারণ ছিল যার জন্য মিঃ কালে তার সেক্রেটারীর ঘরেই বন্দোবস্ত করেছিলেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। আর নিজের ঘরে নিয়ে যেতে তিনি অস্বীকার করেন যে কোনো কারণেই হোক। তার ঘরে এমন কিছু ছিল, যা আমাকে তিনি দেখাতে চাননি এর থেকেই প্রমাণিত হয়। হয়তো তার কোনো উপায় ছিল না আমাকে দেখাবার এমনটাও হতে পারে।
এরপর একটু নীরবতা পালন করলো পোয়ারো, তারপর সবার মুখের উপর দিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠল, আমি এবার তৃতীয় ঘটনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করবো এই নাটকের। সেটা ঘটনা হিসাবে বেশ চাঞ্চল্যকর এবং ওই সন্ধ্যায়ই ঘটেছিল। মনে আছে কি সেদিনের কথা, আমি যখন বেরিয়ে আসছিলাম ঘর থেকে মিঃ কার্লের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, হঠাৎ তখন তিনি একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। একটা প্রথা বর্হিভূত কাজ করলেন তিনি অর্থাৎ আমার কাছে ফেরৎ চাইলেন চিঠিটা। আমার অবশ্য আপত্তি ছিল না চিঠিটা ফেরৎ দিতে, তবে এই ভেবে অবাক হয়েছি যে কেউ কাউকে চিঠি দিলে সেটা ফেরৎ দিতে পারা যায়। আর আমি ভুল করে তাকে অন্য একটা চিঠি দিয়ে ফেলি, চিঠিটা ছিল আমার লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের লেখা। আমার ফেরৎ দেওয়ার পর চিঠিটা তিনি চোখ বুলিয়ে দেখলেন, তারপর যত্ন করে পাশের টেবিলে রেখে দিলেন। ফিরে যাচ্ছিলাম আমি, তারপর হঠাৎ আমার মনে পড়ল দরজার কাছে এসে, তবে তার কাছে গিয়ে চিঠিটা আবার পালটে নিয়েছিলাম। তবে সেদিন-এর সাক্ষাৎকারের পর আমি মনে মনে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একথা অস্বীকার করতে পারব না।
মনে মনে কোন সদুত্তর পাচ্ছিলাম না কতগুলো প্রশ্নের। শেষের ঘটনা তো বিশেষভাবে বিস্ময়কর।
বক্তব্য থামালো পোয়ারো। এবার সকলের মুখের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কিছুই কি আন্দাজ করতে পারছেন না আপনারা?
উত্তর দিলো এবার প্রথমে ড. স্ট্রীলিং ক্লীট–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের চিঠির কি ভূমিকা থাকতে পারে এর মধ্যে সেটা আমার বুদ্ধির অগম্য।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, বুঝতে পারছেন না আপনি? উত্তর দিল হুগো কর্নওয়ার্দি, সত্যি তাই আমাদের ব্যাপারটা যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। এবার মিসেস কার্লে মুখ খুললেন, ওদের দুজনের বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত হচ্ছি।
মিস জোয়ানো কার্লে শুধু ব্যতিক্রম। এবার সে বলল, অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের ঐ চিঠিটার, মঁসিয়ে পোয়ারো আমিও সেটাই মনে করি। এরকুল পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে সে অনুরোধ জানালো যাতে তিনি সেটা ব্যাখ্যা করে বলেন।
আপনার অনুমান নির্ভুল, ম্যাডাম, তার কথায় সম্মতি জানিয়ে পোয়ারো বলল, এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের চিঠিটার। এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল পোয়ারোর ওষ্ঠা ধারে। লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষ আমার টাই এর রঙ জ্বালিয়ে দিয়ে জীবনে এই একটি বার উপকার করেছিলো। এটাই খুব আশ্চর্যের ঘটনা যে আপনারা এমন একটা সহজ ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। তিনি একপলকেই বুঝতে পারতেন যে আমি তাকে ভুল চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ভ্রূক্ষেপও করেননি। তবে কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না তখন? সত্যিই কি তিনি অন্ধ?
হঠাৎ প্রশ্ন করলেন ইনসপেক্টর বার্নেট, কেন, তখন কি চশমা ছিল না তার চোখে?
মাথা নেড়ে হেসে পোয়ারো বলল, তিনি অবশ্য চশমা পরেই ছিলেন। আর ব্যাপারটা আমার কাছে সেজন্যই আশ্চর্য মনে হয়েছিলো। অন্যমনস্ক ভাবে ঝুঁকে পড়লেন তিনি আমাদের দিকে এবং বললেন, মিঃ কালের স্বপ্নের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী। লক্ষ্য করে দেখুন এই স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবে কত মিল। তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন আত্মহত্যা করছেন বাস্তবেও তাই হলো। তাকে মৃত অবস্থায় একলা ঘরের মধ্যে পাওয়া গেল। একটা রিভলবার পড়েছিল তার মৃতদেহের পাশে ঠিক সেই সময় তার ঘর থেকে কাউকে বেরিয়ে আসতে বা ঢুকতেও দেখা যায়নি, অর্থাৎ যে সময় তিনি মারা গেছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে অতএব এখানে অতি সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে অবশ্যই ঘটনাট আত্মহত্যা।
ড. স্ট্রীলিং ক্লীট পূর্ণ সমর্থন জানালেন, হ্যাঁ নিশ্চয়ই এটা ধরে নেওয়া যায়।
ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো চারিদিক দেখে নেওয়ার পোয়ারো ভালো করে নিল, তার কণ্ঠে মেঘ মেদুর রহস্যময় ভাব ফুটে উঠল। ঘটনাটা প্রকৃতপক্ষে কি জানেন। এটা একটা খুনের মামলা, আর অপরাধ জগতে এটা একটা অভুতপূর্ব নজির যে এর পশ্চাতে যে অভিনব পরিকল্পনা রয়েছে। পেয়ারো বলল, আসলে সেটাই মনে হয়।
অস্থিরভাবে পোয়ারো টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে টোকা মারছিল। একটা সবুজ আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তাকালে আমাকে হাস, যে তখন সেই
জানেন সেদিন মিঃ কার্লে আমাকে তার ঘরে নিয়ে যেতে চাননি কেন? কে ছিল তখন সেই ঘরে? বলল পোয়ারো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে তখন সেই ঘরে স্বয়ং বেনেডিক্ট কালেই ছিলেন। রুদ্ধশ্বাসে যেন সবাই তার কথাগুলো শুনছিলো। সামান্য হাসলো পোয়ারো তাদের বিস্মিত চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে। বলল, অবশ্যই আমার সঠিক উত্তর মিলছে ওই চিঠিটার জন্যেই। আমি হয়ত পাগলের মত প্রলাপ বকছি, এর পরেও আপনারা হয়ত সেটাই ভাবছেন। না, আমি সুস্থ মস্তিষ্কেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি। আচ্ছা এবার তাহলে পরিষ্কার করেই বলি। আমি কথা বলেছিলাম মিঃ কার্লের সঙ্গে। কেন তিনি এই চিঠি দুটোর পার্থক্য করতে পারেন নি। জানেন কি আপনারা তার কারণ? কারণ তিনি ছিলেন একজন স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ।
চমকে উঠলেন ড. স্ট্রীলিং ক্লীট, স্বাভাবিক দৃষ্টি মানে, তিনি বললেন, ছেলেবেলা থেকেই ওর দৃষ্টি মানে, তিনি বললেন, ছেলেবেলা থেকেই ওর দৃষ্টি শক্তি খারাপ ছিলো, এটাই আমি জানি–তা সত্ত্বেও আপনি বলছেন যে
পরে সে প্রসঙ্গে আসছি পোয়ারো বলল, তখন উনি সত্যিই চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। কারণ তার চোখে সে সময় শক্তিশালী লেন্সের চশমা ছিলো। ডা. স্ট্রীলিং ক্লীট, আমি কি ঠিক বলছি যে, ওই লেন্সের চশমা পরলে স্বভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন লোকও কার্যতঃ অন্ধ হয়ে যায়?
অস্ফুট স্বরে বলতে লাগল স্ট্রীলিং ক্লীট, হাঁ এটা খুব সত্যি কথা। অবশ্যই তা হতে পারে–পোয়ারো তার কথায় যোগ টেনে বলতে থাকে। মিঃ বেনেডিক্ট কার্লের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই আমার জানি না কেন মনে হয়েছিল। আমি একজন অন্তসারশূন্য ব্যক্তির সামনে উপস্থিতি হয়েছি। আর কোনো অভিনেতা যেন তার নির্দিষ্ট ভূমিকাটুকু অভিনয় করে চলেছে। ভেবে দেখুন একবার পারিপার্শ্বিক পরিবেশটার কথা। ঘরটা সামান্য আলো যুক্ত ছায়াময়। সবুজ ঘেরাটোপা দেওয়া একটা জোরালো আলো জ্বলছে ঘরের মাঝখানে। আর একজন দীর্ঘকায় মানুষ বসে আছেন আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে আলোর ঠিক পেছনেই। তার নাসিকা খড়গ এর মতো উন্নত, পরনে ঢিলেঢালা ড্রেসিং গাউন–অবশ্য এখন বোঝ যাচ্ছে নামটা তার নকল ছিলো। ধবধবে সাদা মাথা ভর্তি চুল। আর এক জোড়া চোখ লুকিয়ে চশমার পুরু লেন্সের আড়ালে।
অবশ্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ আছে কি। ডঃ বেনেডিক্ট কার্লে তার যে দুঃস্বপ্নের কথা নিজের মুখে আমার কাছে বলেছিলেন। মিসেস কার্লের উক্তি আর মিঃ কার্লের ব্যক্ত করা সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা। এই দুটিই মাত্র প্রমাণ।
ইনসপেক্টর বার্নেট তার কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, মঁসিয়ে পোয়ারো, এর অন্তর্নিহিত কি মানে আপনি বলতে চাইছেন?
পোয়ারো কাধ ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করল, ষড়যন্ত্রটা এঁটেছিল দুজন মাত্র ব্যক্তি। তাদের দুজনের মধ্যে একজন হলেন মিসেস কার্লে আর অপরজন মিঃ হুগো কর্নওয়ার্দি। বেনেডিক্ট কার্লের জবানীতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এই কর্নওয়াদি, আর আমার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করতে হবে তিনিই সেটা নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সিনেমা দেখতে চলে যান আমি এখানে এসে হাজির হবার আগেই। তবে প্রকৃত পক্ষে তিনি সিনেমা দেখতে যাননি। তিনি বাড়ী থেকে বের হবার পর আবার পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে এসেছিলেন। তার কাছে কাছে সবসময়ই থাকত সেই দরজার একটা চাবি। নিজের ঘরেই তিনি বসে রইলেন সবার অলক্ষ্যে ফিরে এসে আর তিনি তখন বেনেডিক্ট কার্ডের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন; আর আমরা সকলে আজ বিকেলে এখানে মিলিত হতে পেরেছি। কারণ হল এটাই।
দীর্ঘদিন ধরে যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। মিঃ কর্নওয়ার্দি, তিনি অবশেষে সেটা পেলেন।
আপনি কি বোঝাতে চাইছেন সুবর্ণ সুযোগের মানেটা কি? ইনসপেক্টর বার্নেট পোয়ারোকে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল। ব্যাপারটা হলো, দরজার বাইরে দুজন খবরের কাগজের প্রতিনিধি বসে থাকলে তারা যদি সাক্ষ্য দেয় নির্দ্বিধায় যে তারা কাউকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখনি। তার ওপর অবিরাম যানবাহন চলাচলের রাস্তাঘাট বিকেলের দিকে সবসময় কোলাহল মুখরিত থাকে। কর্নওয়ার্দি এই সুযোগে একটা লম্বা লোহার চিমটের ডগায় একটা বস্তু নিয়ে এসে তার ঘরের জানালার সামনে নাড়াতে থাকেন আড়াল থেকে। মিঃ কালে তখন ব্যাপারটা কি দেখবার জন্য জানালার সামনে এসে মুখ বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করেন ঠিক সেই মুহূর্তে কর্নওয়াদি তার কপাল লক্ষ্য করে গুলি চালান।
এবার আবার প্রশ্ন করল ইনসপেক্টর, কিন্তু কেন কেউ দেখতে পেল না মিঃ কর্নওয়াদি যখন গুলি চালাচ্ছেন? হয়তো তার সৌভাগ্যের ব্যাপার এটা যখন তিনি গুলি চালালেন তখন কেউ দেখতে পায়নি বলল পোয়ারো।
সেটা কি করে সম্ভব হলো? বানেট জানতে চাইলেন। একটা উঁচু নিরেট দেওয়াল ছিল মিঃ কার্লের ঘরের জানালার সামনে তার ফলেই তার এই অপকর্মের কোনো সাক্ষী রইলো না। স্টীলিং ক্লীট দুচোখে কৌতূহল মাখিয়ে প্রশ্ন করল, তারপর? মিঃ কর্নওয়াদি তারপর তার নিজের ঘরে বসে কুড়ি পঁচিশ মিনিট অপেক্ষা করেন। এরপর সেই লোহার চিমটেটা আর রিভলবারটা একতাড়া চিঠি আর ফাইলপত্রের আড়ালে লুকিয়ে বেশ সতর্কভাবে মিঃ কার্লের ঘরে প্রবেশ করেন তিনি খবরের কাগজের দুই প্রতিনিধির সামনে দিয়ে। পোয়ারো এইভাবে ব্যাপারটার ব্যাখা দিল। প্রথমেই তিনি একটা কাজ করলেন ঘরে ঢুকে। রিভলবারের উপরে মিঃ কার্লের আঙুলের ছাপ লাগিয়ে সেটা তার মৃতদেহের পাশে ফেলে রাখলো সে। যথাস্থানে লোহার চিমটেটাও রেখে দিলেন। তারপর ঘর ছেড়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন এবং চোখে মুখে নকল উদ্বেগ ফুটিয়ে তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন মিঃ কার্লের আত্মহত্যার খবরটা।
এমন ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন যাতে করে পুলিশ মিঃ কার্লের ঘরে ঢোকা মাত্রই আমার চিঠিটা, যেটা আমার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল, যাতে পুলিশের সেটা নজরে আসে। ফলে আমার এখানে ডাক পড়বে অনিবার্যভাবে। আর আমি যখন এখানে আসার পর আমার অনুরোধ মিঃ কালে তার স্বপ্নের অদ্ভুত যে বিবরণ শুনিয়েছিলেন সেটা সকলের কাছে খুলে বললো, তখন তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার কথাও খুব সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে।
তবে–বলে থামলো পোয়ারো।
ইনসপেক্টর বার্নেট জানতে চাইল মিঃ পোয়ারো এই তবে–টার মানে?
চকিতের মধ্যে মিসেস কার্লের মুখের ওপর পোয়রোর দৃষ্টি নিবন্ধ হলো। ধূসর পার ছায়া এখন মহিলার মুখাবয়বে। গভীর একরাশ ভয় ও হতাশা তার সেই দুচোখে।
এরকুল পোয়ারো তার বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে একটু থেমে বলল, এবং পরিবেশে এরপর এক অন্তবিহীন সুখের পরিণতি লাভ করা যাবে। কারণ মিঃ কার্লে তার যাবতীয় অর্থ সম্পত্তি আর অর্থ তার একমাত্র মেয়ের নামে উইল করে গেলেও, কর মুক্ত আড়াই লক্ষ পাউন্ড দিয়ে গিয়েছিলেন তার স্ত্রীর নামে। দুজনেই বেশ সুখেই দিন কেটে যেত সেই টাকায়? এরকুল পোয়ারো ড. জন স্টীলিং ক্লীটকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলেন নর্থওয়ে হাউস ছেড়ে। আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাদের ডানদিকে কারখানার বিরাট উঁচু পাঁচিল। লম্বা সরু একটা প্যাসেজ পাঁচিলের পাশ দিয়ে সোজা চলে গেছে। তারা এগিয়ে চলল দুজনে সেই রাস্তা ধরে। এরকুল পোয়ারো থেমে পড়ল মিঃ বেনেডিক্ট কালের ঘরের জানালার ঠিক নীচেই। সেখানে তার নজরে পড়ল কালো রঙ এর একটা বস্তু। পোয়ারো নীচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিল। সেটা ছিল, একটা খেলনা বিড়াল, কালো কাপড় দিয়ে মোড়া।
পোয়ারো বলল, হায় ঈশ্বর, কর্নওয়ার্দি লম্বা চিমটে দিয়ে ধরে এই জিনিসটা মিঃ কার্লের জানালার সামনে নিয়ে এসে নাড়াচাড়া করছিল। অবশ্যই কর্নওয়ার্দি সে কথা জানত যে মিঃ কার্লে একেবারে বিড়ালদের সহ্য করতে পারেন না। আর জানালার ধারে ছুটে এসেছিলেন তিনি খেলনা বিড়ালটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে?
কর্নওয়ার্দি ওদিকে ফাঁদ পেতে বসেছিল। সেটা দেখার জন্য জানালার বাইরে দিয়ে মুখ বাড়ানো মাত্র সে রিভলবারের ট্রিগার টিপে দেয় তার কপাল লক্ষ্য করে। আর তারপরের ঘটনা তো আপনি জানেন অবশ্যই।
আচ্ছা তার কাজ শেষ করে তো মিঃ কর্নওয়ার্দি এই খেলনা বেড়ালটা এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে পারত? তারপক্ষে সে কাজ করা সম্ভব ছিল না। কারণ এই ব্যাপারটা যদি দুর্ভাগ্য ক্রমে কারো চোখে পড়ে যেত তাহলে সন্দেহটা গিয়ে তার উপরেই পড়ত। আর লোকে ভাববে কোনো বাচ্চা ছেলেই হয়ত এটা এখানে ফেলে গেছে, যদি কারও নজরে আসত এখানে এই বিড়াল পড়ে আছে। কেউ মাথা ঘামাত না এটার বিষয়ে যে কোনো গুরুত্ব আছে। তা অবশ্য ঠিক স্টীলিং ক্লীট বলল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেরকম সন্দেহ করাই স্বাভাবিক সাধারণ লোকের পক্ষে। তবে এরকুল পোয়ারোর চোখে ধূলো দেওয়া অত সহজ নয় এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি কি ভেবেছিলাম জানেন আপনার বক্তৃতার শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত? আপনি হয়তো মনস্তাত্ত্বিক একটা ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছেন কোনো গালভরা শব্দের মালা সাজিয়ে, আড়াল থেকে কিভাবে অপরের মনে আত্মহত্যার প্ররোচনা কাজে লাগানো যায়? আপনি হয়তো তারই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ হাজির করবেন। ওই দুজন ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিক এই রকমই একটা চিন্তা করে থাকবে, আমি বাজি রেখে এটাও বলতে পারি। এটাই মনে হচ্ছে যে তিনি অতি সহজেই ভেঙে পড়েছেন, মিসেস কার্লের আচার আচরণ দেখে। প্লাস পয়েন্ট এটা। না হলে স্বীকারোক্তি আদায় করা সম্ভব হতো না, কর্নওয়ার্দির মতো অসৎ লোকের কাছ থেকে। ভদ্রমহিলা যে ভাবে হাত উঁচু করে আপনার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আমি তো নিজের চোখে দেখলাম। আপনার চোখ দুটো চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যেত, যদি পেছন থেকে না আপনাকে জাপটে ধরতাম।
সে আবার এক মিনিটের জন্য থেমে বলল। মিস কার্লে ওদের মধ্যে ব্যতিক্রম আমার মনে হয়। আমি পছন্দ করি মেয়েটিকে। মঁসিয়ে পোয়ারো বুঝলেন, মেয়েটি দারুণ বুদ্ধিমতী। লোকে হয়ত মনে করবে আমি ভাগ্য ফেরানোর মতলব করছি আমি যদি ওর সঙ্গে মাখামাখি করার চেষ্টা করি।
বন্ধু আপনার বেশ দেরী হয়ে গেছে। কারণ ইতিমধ্যেই ওর হৃদয়ের শূন্য সিংহাসনটা দখল করে বসে আছে এক যুবক। এ খবর আমি জেনেছি। তাদের মিলনে আর কোনো বাধা নেই মিঃ কার্লের মৃত্যুর পর। আরও একটা অনুপ্রেরণা থাকতে পারত এটা ঠিক কথা। বলল স্টীলিং ক্লীট। পোয়ারো বলল, প্রেরণা আর সুযোগই শেষ কথা নয়। তার পশ্চাতে সক্রিয় থাকা চাই অপরাধী সুলভ মনোভাব।
মঁসিয়ে পোয়ারো আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন। বলল স্ট্রীলিং ক্লীট, আমি বাজী ধরে বলতে পারি, আপনি যদি নিজে হাতে এখনও কাউকে খুন করেন সেইক্ষেত্রে তার প্রমাণ খুঁজে বার করা কখনও কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য আপনার পক্ষে এটা খুব সহজ ব্যাপার সেটা নিশ্চয়ই খেলোয়াড়ী মনোভাবের বিরুদ্ধ হবে।
এটা ইংরেজদের একটা বিচিত্র ধারণা উত্তরে জানানো পোয়ারো।