–তাকে গতকাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
–কোথায় গেছে সে?–করুণ দেখাল লেনক্সকে
–গত রাত্রেই তিনি নিস্ ছেড়ে চলে গেছেন।
–কোথায়? সেন্ট মেরি মিড়-এ?
–হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর লেনক্স প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল, আমারই চিনতে ভুল হয়েছে মাসীকে। আমি ভেবেছিলাম ও বোধহয় ড্রেককে গ্রাহ্যই করে না।
মিস গ্রে অত্যন্ত চাপা স্বভাবের মহিলা। উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে কখনও অধীর হন না। নিজের মনের কথা আজ অবধি কাউকেই বলেননি।
–অবশ্য আমাকে বললে নিশ্চয়ই ওর কোনো ক্ষতি হতো না।– অভিমান ফুটে উঠল। লেনক্স-এর স্বরে।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আপনাকে বিশ্বাস করলে তার নিশ্চয়ই কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন সেই জাতের মেয়ে, যারা নিজের কথা বলার চেয়েও অন্যের কথা শুনতে ভালোবাসে। এদের জীবনের সুখ-দুঃখের কোনো ব্যাপারেই এঁরা অন্যকে ভাগীদার করেন না। নিজেরাই সব সইয়ে নেন।
-সত্যি আমি কি বোকা! জানেন, আমি ভাবতাম, মাসী বোধ হয় কিংটনকে ভালোবাসে। আমার আরও একটু বোঝা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আমি অহেতুক নিজেকে ড্রেক-এর প্রতি….।
-গলার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতাগুলোও ভিজে আসছিল লেনক্স-এর। পোয়ারো তাড়াতাড়ি তার একটা হাত তুলে নিজের হাতে নিয়ে একটু চাপ দিলেন। মাদমোয়াজেল দুঃখ করবেন না। আমি জানি আপনি ক্যাথারিনকে ভালোবাসেন। তিনি কিন্তু। আপনাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখেন।
–ঠিকই বলেছেন আপনি।–বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে গালের ওপর গড়িয়ে পড়া কয়েক ফোঁটা চোখের জল মুছে নিল লেনক্স। তাছাড়া ড্রেকের কাছে এখনও আমি ছোটটিই হয়ে গেছি। ও এখন পরিণত স্পর্শের আস্বাদ চায়। অনেকক্ষণ চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। কিন্তু যাই বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমিও কিছু সাহায্য করেছি। যে ভাবেই হোক আমার সাহায্যও কাজে লেগেছে।
নিশ্চয়ই আপনি সাহায্য করেছেন মাদমোয়াজেল। আপনি যে মুহূর্তে বলেন খুনীর পক্ষে ট্রেনের যাত্রী না হয়েও বাইরে থেকে খুন করা সম্ভব, সেই মুহূর্ত থেকেই আমি সত্যের আলো দেখতে পাই। আমার কাছে খুনের ব্যাপারটা তখন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। তার আগে খুন হওয়ার ঘটনাটা আমার কাছে বেশ জটিল মনে হয়েছিল। সে কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আপনার। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল লেনক্স :- ওই আমার সান্ত্বনা–তাতেই আমি খুশী।
অনেকদূর থেকে ইঞ্জিনের তীব্র বাঁশির আওয়াজ ভেসে এলো। লেনক্স বলল, এই সেই ব্ল ট্রেন যাচ্ছে। আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো ট্রেন জিনিসটা অদ্ভুত সৃষ্টি না। এ কোনোদিন থামবে না। এর চলার কোনো বিরাম নেই। বিশ্রাম নেই। মানুষ খুন হচ্ছে। কত নানা রকমের ঘটনা ঘটছে। এই ট্রেনের বুকে অথচ বিরামহীন তার চলা। যাকগে, কি সব যা তা বকে চলেছি আমি।
-হা হা, ঠিকই বলেছেন মাদমোয়াজেল। মানুষের জীবনটা তত ট্রেনেরই মতন! ট্রেনেরই মত তার অবিশ্রাম গতিবেগ। তবে দুয়ের মিল মঙ্গলসূচক।
-কেন?
–কারণ যাত্রাপথ যত দীর্ঘই হোক না কেন ট্রেনকে অবশেষে একটা জায়গায় থামতেই হয়। যাত্রাপথেরও একসময় শেষ হয়। আর সেই যে একটা প্রবাদ আছে-যাত্রাপথের শেষ হলেই মানুষ তার ভালোবাসার জনকে পায়।
হেসে উঠল লেনক্স। আমার বেলায় ও কথা প্রযোজ্য নয়। একেবারেই মিলল না।
-এখনও আপনার যাত্রাপথ শেষ হয়নি মাদমোয়াজেল। শেষ হোক–তখন নিশ্চয়ই মিলবে। আপনি এখনও ছেলেমানুষ।
নিজেকে যতটা ছেলেমানুষ ভাবেন তার চেয়েও অনেক বেশি ছেলেমানুষ আপনি। মানুষের ট্রেনরূপী জীবনে বিশ্বাস রাখবেন মাদমোয়াজেল, কারণ এই ট্রেনের চালক স্বয়ং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।
আবার ইঞ্জিনের বাঁশি শোনা গেল।
-ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবেন মাদমোয়াজেল। অন্তরঙ্গ চোখে তাকালেন পোয়ারো, আর বিশ্বাস রাখবেন এই এরকুল পোয়ারোর দিকে। আপনাদের পোয়ারো ঈশ্বরে বিশ্বাস করে যে মূল্য লাভ করেছে, তা স্বর্গীয় তা অমৃত সমান।
৬. গৃহের আকর্ষণে
২৬. গৃহের আকর্ষণে
কল্যাণীয়া ক্যাথারিন,
এত আমোদ-প্রমোদের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই এই বুড়ীর বা এখানকার নিরানন্দ জীবনের কথা তোমার এখন মনে পড়ে না। কত বন্ধু হয়েছে তোমার। অবশ্য স্থল আনন্দে ডুবে থাকার মেয়ে যে তুমি নও, সে কথা আমি জানি। এখানকার খবর গতানুগতিক। এখানকার বেয়াড়া মেয়েদের নিয়ে বড়ই ঝামেলায় পড়তে হয় মাঝে মাঝে। অবাধ্য সব, বললেও গ্রাহ্য করে না। তোমার সঙ্গে যে এদের কত তফাৎ এখানে তাই ভাবি। এত করে বলি মেয়েদের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্কার্ট আর বড় মোজা পরতে তা কেউ শোনে না আমার কথা। আমার বাতের ব্যথা খুব বেড়েছিল। ডক্টর হ্যারিসন আমাকে লণ্ডনে নিয়ে গিয়ে বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দেখিয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন রোগটা ক্যান্সার। সাবধানে থেকো। অল্পবয়স আর প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী তুমি। অসৎ পুরুষ মানুষের বন্ধুত্ব করো না। কিন্তু মন্দ পুরুষ মানুষের ছলনায় কত মেয়ের জীবন যে নষ্ট হয়েছে তার একাধিক উদাহরণ আমি জানি। যদিও তুমি ভিন্ন প্রকৃতির মেয়ে তবুও তোমার মঙ্গলকামী বলেই একথা লিখলাম। সবসময় মনে রাখবে তোমার জন্যে এখানকার দরজা চিরদিনই ভোলা থাকবে। আশীর্বাদ জেনো।
—আমেনিয়া ডিনার।