–আশ্চর্য তো আলডিন ফিসফিস করে বললেন।
–হ্যাঁ, সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। এ কাউকে বলায় নয় মিস গ্রেও তাই কাউকে কিছু বলেননি। আরও একটা জায়গায় আমি ধাঁধাঁয় পড়েছিলাম। আপনার সেক্রেটারী একটু খুঁড়িয়ে চলত। কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলে যুদ্ধে তাঁর পায়ে বুলেট লাগে তাই। অথচ মার্কুইস খুঁড়িয়ে চলে না। এই দুটো অমিল আমাকে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু লেনক্স একবার আমাকে বলেন, তার মায়ের সৈনিকদের হাসপাতালে যে ডাক্তার কিংটনকে চিকিৎসা করেছেন তিনি দীর্ঘদিন পরেও কিংটনকে খুঁড়িয়ে চলতে দেখে অবাক হন। তখনই আমার সন্দেহ হয়। এই খুঁড়িয়ে চলাটাই তার ছদ্মবেশ। কিংটন ও মার্কুইস-এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যেই এই ছলনা। আমি লণ্ডনে গিয়ে সেই ডাক্তারের সঙ্গে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে এটা ওর ছলনা ছাড়া কিছুই নয়। পরশুদিন কিংটন-এর শুনানীর সময় আমি সেই ডাক্তারের নাম বলেছি। যার নাম কিংটন কখনও কাউকে বলেনি। কারণ কিংটন জানত যে তার খুঁড়িয়ে চলার কোনো যুক্তিই ডাক্তারের কাছে ছিল না। আর এখানেই আমি আমার শেষ মোক্ষম সিদ্ধান্তে পৌঁছই। মিস গ্রেও আমাকে একটা পুরনো খবরের কাগজের কাটিং দেখান যা থেকে আমি জানতে পারি, কিংটন যখন লেডি টাম্পলিন-এর সৈনিক হাসপাতালে ছিল, সেই সময় সেখানে একটা ডাকাতির ঘটনা ঘটে। প্যারী থেকে আমার চিঠি পেয়েই মিস গ্রে বুঝতে পারে যে ওঁর আর আমার সন্দেহ একই লক্ষ্যে। প্যারীতে আমার জানবার ছিল যে অ্যাজ ম্যাসন রীজ হোটেলে কখন এসে পৌঁছয়? হ্যাঁ, আমার ধারণা ঠিক। আগের রাতেই রীজ হোটেলে একটা ঘর অ্যাজ ম্যাসন-এর নামে রিজার্ভ হলেও অ্যাজ ম্যাসন সেখানে পরের দিন ভোরে পৌঁছায়।
পোয়ারো চুপ করলেন। কিছুক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে আলডিন একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার প্রশংসা করার মতো কোনো ভাষা নেই। আপনি সত্যিই অনন্য। আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। আমি আপনাকে একটা চেক দিতে চাই, যদিও এর দ্বারা আমি আমার কৃতজ্ঞতার পরিমাণ আপানকে বোঝাতে পারব না।
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। মৃদু হাসি ও বিনম্র স্বরে বললেন, আমি তো সামান্য এরকুল পোয়ারো। আমাকে দিয়ে আপনার কার্যোদ্ধার হয়েছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ও বড় পুরস্কার।
আলডিন-এর কাছে বিদায় নিয়ে হোটেলের লাউঞ্জে দেখা হলো মঁসিয়ে পপোপুলাস ও তাঁর মেয়ে জিয়ার সঙ্গে।
–আরে। মঁসিয়ে পোয়ারো যে, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি নিস থেকে চলেই গেছেন। পোয়ারোর একটা হাত নিজের হাতে নিলেন পপোপুলাস।
–আমার কাজই আমাকে আবার টেনে নিয়ে এলো।
–কাজ?
–সত্যিই তাই। আপনি আছেন কেমন?
–ভালোই আছি। কালই আমরা প্যারীতে ফিরে যাচ্ছি।
-খুব সুখবর। শুনলাম আপনি না কি প্রাক্তন গ্রীক মন্ত্রীকে বেশ ভালোভাবেই বধ করেছেন?
-আমি?
-হ্যাঁ। আপনি ওঁর কাছে একটা অপূর্ব সুন্দর রুবী বিক্রি করেছেন না? যেটা নৃত্যশিল্পী মিরেলি পরেন। অবশ্য ব্যাপারটা একান্তভাবে আপনার আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলেই বললাম।
-ও হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
-আচ্ছা, রুবাটা সেই বিখ্যাত হার্ট অব ফায়ারর মত নয় তো?
–অনেকটা তার সঙ্গে মিল আছে বটে।
–সত্যিই মিঃ পপোপুলাস, রত্নের ব্যাপারে আপনার হাতযশ অসামান্য। কিন্তু মাদমোয়াজেল জিয়া যে আমাকে নিঃসঙ্গ করে এত তাড়াতাড়ি প্যারী ফিরে যাচ্ছেন, কোথায় ভাবলাম কাজকর্ম শেষ হলো, এবার মিস জিয়ার সঙ্গে প্রাণ খুলে আলাপ করা যাবে। না; তা আর হলো না দেখছি।
-আচ্ছা, জিজ্ঞেস করতে পারি কি মঁসিয়ে কাজটা কি ছিল এখানে?–বললেন পপোপুলাস।
–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এতদিন যে শুধু বুদ্ধির জোরেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে অবাধে অপরাধ লীলা চালিয়ে এসেছে, সেই মাকুইসকে ধরার ব্যাপারেই একটা সাহায্য করলাম মাত্র। মাকুইস-এর এবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এরকুল পোয়ারো।
-মাকুইস।–বিড়বিড় করলেন পপোপুলাস। কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে নামটা?; মনে করতে পারছি না।
–ও আপনি মনে করতে পারবেন না। ও কথা বাদ দিন। আমি একজন বিখ্যাত অপরাধীর কথা বলেছিলাম। রত্ন চুরি করাই তার অন্যতম প্রধান নেশা। সম্প্রতি সে মাদাম ক্যাথারিন নামে এক ইংরেজ মহিলাকে খুন করার জন্যে গ্রেপ্তার হয়েছে।
-তাই নাকি। শুনতে হবে তো একদিন ঘটনাটা। আজ আমার আবার একটু কাজ….
-হা মঁসিয়ে পপোপুলাস, আমারও একটু তাড়া আছে। মাদমোয়াজেল জিয়া, আবার কোনো এক সুন্দর দিনে আপনার সুন্দর মুখ দেখার আশায় রইলাম, তখন ভালো করে আলাপ করা যাবে। চলি।
পোয়ারোর সুন্দর রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বাবা ও মেয়ে তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর পপোপুলাস বললেন, লোকটা একটা ধূর্তের শিরোমণি।
–কিন্তু যাই বলো বাবা, আমার কিন্তু ওকে ভালোলাগে। আমি ওঁকে পছন্দ করি। ওর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ওপর যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে আমার।
-কিন্তু আমাদের কাছে ও একটা সাক্ষাৎ শয়তান, সাক্ষাৎ….
.
৩৩.
সমুদ্রের স্বাদ
আরও দুদিন কেটে গেছে। সেই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি মানুষের মন থেকে অতীতের দিকে এগিয়ে গেছে। শুধু একটা প্রায় মিলিয়ে যাওয়া স্মৃতির করুণ সুর কয়েকটি বিশেষ মনকে থেকে থেকে আক্ষেপে ভরিয়ে তুলেছে। মার্গারেট ভিলার বারান্দায় মুখোমুখি বসে এরকুল পোয়ারো ও লেনক্স। সামনের সমুদ্রকে আজ যেন বড় বেশি নীল দেখাচ্ছে। পোয়ারো এই মাত্র লেনক্সকে সমস্ত ঘটনাটা শোনালেন। চুপ করে একটু ভেবে তারপর আস্তে আস্তে বলল লেনক্স, ড্রেকের কি হলো?