–কিন্তু একটা ব্যাপার যে আমি বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো? প্যারীতে ট্রেনের ভেতরে ঐ লোকটা তাহলে কে ছিল? ড্রেক ক্যাথারিন না কাউন্ট?
–আঃ হা। সমস্ত ব্যাপারটা ওইখানেই একটা বিরাট ধোঁকা দেওয়া হয়েছে আসলে কোনো লোকই ছিল না। বুঝতে পারছেন না চালাকিটা কোথায়? আচ্ছা, ট্রেনের সেই লোকটার কথা আমরা কার বক্তব্য থেকে জানতে পারছি? শুধুমাত্র অ্যাজ ম্যাসনই একথা বলেছে। সেটা আমরা বিশ্বাস করছি কেন? কিংটন বলেছে তার সঙ্গে অ্যাজ ম্যাসন-এর প্যারীতে দেখা হয়েছে। তাহলে দেখুন আমরা কিংটন-এর কথায় বিশ্বাস করেছি যে অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তো?
–কেন? পরিচারিকাকে নামিয়ে দেবার কথা রুথ নিজেই কণ্ডাক্টরকে বলেছে।
–ব্যস্ত হবেন না। আসছি। ও ব্যাপারেই আসছি। হ্যাঁ, মিসেস ক্যাথারিন-এর নিজের উক্তি বলেই আমরা ধরে নিয়েছি, কিন্তু এটা মিসেস ক্যাথারিন-এর উক্তি নয়।
তার মানে?
তার মানে মঁসিয়ে, মৃত কখনও কথা বলে না। কণ্ডাক্টরকে যখন একথা বলা হয়, তার আগেই মিসেস ক্যাথারিন-এর মৃত্যু হয়েছে। এটা মিসেস ক্যাথারিন বলেনি, বলেছে পরিচারিকা। এবং দুটো বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে।
–আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আঁসিয়ে। তাহলে কি কণ্ডাক্টর মিথ্যে বলেছে?
-না না, কখনও না। মিথ্যে সে কখনও বলেনি। যা সত্যি তাই সে বলেছে। কিন্তু যে রুথ তার পরিচারিকা নামিয়ে দেবার কথা বলেছে, সে আপনার মেয়ে রুথ নয়। সে সেজেছিল মাত্র।
হতভম্ব আলডিন-এর মুখে কোনো কথা নেই।
–মঁসিয়ে আলডিন, মনে রাখবেন গেয়ার দ্য নয়েনস পৌঁছবার আগেই আপনার মেয়েকে হত্যা করা হয়। এটা হলো অ্যাজ ম্যাসন-এর কাজ, সে তার কী নিহত হবার পর তার গা থেকে ফারের কোট এবং মাথার টুপিটা খোলে। নিজে সেগুলো পরে নিয়ে তারই ছদ্মবেশে কামরা থেকে হাত বাড়িয়ে ডিনারের বাক্স কেনে এবং সেই কণ্ডাক্টরকে একথা বলে।
–অসম্ভব। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন রুথ-এর ছদ্মবেশে অ্যাজ ম্যাসনই একাজগুলো করেছে? আর কণ্ডাক্টর তাকে চিনতে পারল না।
-না মঁসিয়ে আলডিন, না। কিছুই অসম্ভব নয়। ক্ষণিকের দেখায় একজন আরেকজনের মুখ যত না মনে রাখে, তার চেয়েও বেশি মনে রাখে তার সাজপোশাককে। আপনার মেয়ে এবং অ্যাজ ম্যাসন দুজনেই মাথায় মাথায়। তার ওপর সেই একই ফারের কোট তার গায়ে, মাথায় সেই একই টুপি এবং সর্বোপরি রুথ ক্যাথারিন-এর মাথা থেকে কেটে নেওয়া কয়েক গোছা সোনালী চুল। নিজের মাথার দু-পাশের চুলের সঙ্গে বিনুনি করে কান পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে মাথার টুপিটাকে চোখ পর্যন্ত টেনে দেয়। ও সহজেই কণ্ডাক্টরের চোখকে ফাঁকি দেয়। কণ্ডাক্টরের কাজ যাত্রীরা যখন ট্রেনে ওঠে তখন টিকিটগুলো সংগ্রহ করে রিজার্ভেশন চার্ট দেখে যাত্রীদের স্ব স্ব কামরা বলে দেওয়া। কাজেই কণ্ডাক্টরের পক্ষে সম্ভব নয় প্রতিটি যাত্রীর মুখ চিনে রাখা। শুধু মাত্র রাত্রে যাত্রীদের কামরায় গিয়ে তাদের বিছানাগুলো ঠিক করে বিছিয়ে দেওয়া। এখানেও সে তাই করেছে। একথা ঠিক অ্যাজ ম্যাসনই টিকিটগুলো তার হাতে জমা দেয়। কিন্তু টিকিট সংগ্রহ করার সময় সে রিজার্ভেশন চার্ট দেখে কামরা বলে দিতে ব্যস্ত ছিল। একটি স্ত্রী লোকের হাত থেকে টিকিট নিচ্ছে এটাই লক্ষ্য করেছে শুধু। কত্রী বা পরিচারিকাকে চিনে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। আর এও মনে রাখবেন, অ্যাজ ম্যাসন বা কিটি কিন্তু একজন নামকরা তুখোড় অভিনেত্রী। মুহূর্তের মধ্যে নিজের চেহারা বা কণ্ঠস্বর বদলে দিতে সে অদ্বিতীয়। তার পক্ষে ছদ্মবেশ ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু একটা বিপদের আশঙ্কা ছিল, যেটা হলো পরদিন সকালে রুথ ক্যাথারিনকে ঘুম ভাঙাতে এসে কণ্ডাক্টর হয়তো চিনে ফেলবে যে গতরাতে বিছানা পাতবার সময় সে যার সঙ্গে কথা বলেছে সে এই নিহত মহিলাটি নয়। এই কারণেই রুথ-এর মুখ বিকৃত করেছিল। অত্যন্ত মূল্যবান একটা সূত্র কণ্ডাক্টরের চোখের সামনেই ছিল। কিন্তু শুধু অসাধারণ দূরদর্শিতার জন্যে অ্যাজ ম্যাসন তার চোখে ধুলো দিয়েছে। এছাড়া আরও একটা বিপদের আশঙ্কা করেছিল মিস ম্যাসন, সেটা প্যারী থেকে ট্রেন ছাড়বার পর হয়তো ক্যাথারিন গ্রে এই কামরায় মিস ক্যাথারিন কাছে আসতে পারে। তাই সে মিস গ্রে কে দেখিয়ে ডিনার বাক্সটা কেনে এবং নিজের কামরা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ মিস গ্রেকে হাবভাবে বোঝাল সে যেন তার কামরায় না আসেন।
–কিন্তু রুথকে কে হত্যা করল আর কখন?
–প্রথমেই মনে রাখতে হবে এই অপরাধ দুজনে মিলে করেছে কিংটন ও অ্যাজ ম্যাসন। কিংটন সেদিন আপনারই কাজে প্যারী যায় এবং প্যারীর কাছে যে লুপ অর্থাৎ বড় বাঁকটা আছে, যেখানে ট্রেনের গতি মন্থর হয় সেখানে কোনো একটা জায়গায় কিংটন ট্রেনে ওঠে। মিসেস ক্যাথারিন তাকে দেখে খুবই অবাক হয়। তারপর কিংটন হয়তো বেশ কিছু দেখিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে বাইরে মিসেস ক্যাথারিন-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় এবং যেই সে সেদিকে দৃষ্টি ফেরায়, অমনি মুহূর্তের মধ্যে পেছন থেকে সরু মজবুত সিল্ক কর্ডটা তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়। বাকি কাজটা মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার। কামরার দরজা বন্ধই ছিল। এরপর কিংটন ও অ্যাজ ম্যাসন কাজে লেগে যায়। প্রথমে মিস ক্যাথারিন-এর ওপরের জামাগুলো খুলে নেয়। তারপর মৃত দেহটাকে একটা কম্বলের মধ্যে জড়িয়ে পাশের সংযোগকারী কামরায় সুটকেস ও ব্যাগের সঙ্গে সিটের ওপর রেখে দেয়। এবার কিংটন জুয়েলস কেসটা নিয়ে নেমে যায়। বলা বাহুল্য ট্রেনটা তখনও বাঁকের মধ্যে থাকায় গতি আস্তেই ছিল। কিংটন দেখল বারো ঘন্টার আগে খুনের ব্যাপার জানাজানি হবার কোনো ভয় নেই, তারপর আজ ম্যাসন-এর মিসেস ক্যাথারিন সেজে কণ্ডাক্টরকে এক গল্প ফাদার ব্যাপার তো আছেই। সুতরাং অপরাধের সময় নিজের উপস্থিতিকে অন্য কোথাও প্রমাণ করতে বেগ পেতে হবে না। রুথ এর ড্রেস পরে নিয়ে গেয়ার দ্য নয়েন–এ এবার ডিনার বাক্সে কেনে অ্যাজ ম্যাসন। তারপর কণ্ডাক্টরকে তাঁদের ফাঁদের গল্প করল। কণ্ডাক্টরকে বলার সময় সে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। যাতে করিডর দিয়ে যাবার সময় কেউ তার মুখ দেখতে না পায়। সেখান দিয়ে তখন অনেকেই যাতায়াত করছিলেন। এমন কি মিস গ্রে ও সেই সময় সেখান দিয়ে যায় এবং যার ফলেই অনেকের মতো সে, সে সময় মিসেস ক্যাথারিন-এর জীবিত থাকার কথা বলেছিল।