-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার নতুন সূত্র যদি নির্ভুল হয় অর্থাৎ ড্রেককে যদি বাদ দিই, তাহলে বলতে হয় এইখানেই সেই লোকটি ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছিল।
-না। কোনো লোক ট্রেন থেকে নামেনি। গম্ভীর মুখে তাকালেন পোয়ারো।
–সেকি। আপনার নুতন সূত্র অনুযায়ী তো-।
-না মঁসিয়ে আলডিন, আমি আবার বলছি, কোনো লোক ট্রেন থেকে নামেনি। ট্রেন থেকে যে নেমেছিল সে লোক নয়। সে একজন স্ত্রীলোক।
চমকে তাকালেন কিংটন।
–একজন স্ত্রীলোক! চেঁচিয়ে উঠলেন আলডিন।
-হ্যাঁ, একজন স্ত্রীলোক। আপনার হয়তো মনে থাকতে নাও পারে মঁসিয়ে, কিন্তু মিস গ্রে তাঁর বক্তব্যে টুপি ও ওভার কোট পরা একটি যুবককে প্ল্যাটফর্মে পায়চারী করতে দেখার কথা বলেছিলেন।
সাধারণতঃ অনেকক্ষণ একভাবে ট্রেনে বসে থাকার পর কোনো স্টেশন এলে আমরা যেমন প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করে হাত পায়ের খিল ছাড়িয়ে নিই। সেই রকমই ভান করেছিল সে, যেটা মিস গ্রে ধরতে না পেরে ট্রেনের প্যাসেঞ্জার বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস সেই যুবকটি একজন স্ত্রীলোক।
-কিন্তু কে সেই স্ত্রীলোক? আলডিন বলল।
–তার নাম?–পোয়ারো গলার স্বরে অদ্ভুত একটা আস্থা নিয়ে বললেন, বহু বছর যাবৎ সবাই তাকে যে নামে চিনত তা হলো– কি টি কিড়। কিন্তু মিঃ আলডিন, আপনি তাকে চিনতেন অন্য নামে–অ্যাজ ম্যাসন।
–ম্প্রিঙের মতো লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল কিংটন। কি বললেন?
সবেগে কিংটন-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন পোয়ারো। কি বললেন? ওঃ হোঃ! ভুলেই গিয়েছিলাম। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করে এগিয়ে ধরলেন কিংটন-এর দিকে; মঁসিয়ে, দয়া করে আপনারই সিগারেট কেস থেকে আপনাকেই একটি সিগারেট অফার করার অনুমতি দিন আমাকে। প্যারীর যে বাঁকটাতে আপনি ট্রেনে উঠেছিলেন সেইখানে অসাবধানবশতঃ এটা আপনার পকেট থেকে পড়ে যায়।
কিংটন বোকার মতো তাকিয়েই এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে উঠলেন পোয়ারো।
-না, যাবার চেষ্টা করবেন না। পাশের কামরার দরজা খোেলাই আছে। এবং আপনাকে সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্যারী থেকে ট্রেন ছাড়বার সময় করিডরে যাবার দরজাটা আমি নিজে খুলে দিয়ে এসেছি? এখন সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের পুলিশ বন্ধুরা। হাঁ, ফরাসী পুলিশের আপনাকে বিশেষ জরুরী প্রয়োজন আছে। মঁসিয়ে কিংটন–কিংটন? নাঃ তার চেয়ে বরং বলি মঁসিয়ে লে মার্কুইস।
.
৩২.
পোয়ারোর বিশ্লেষণ নেগ্রেসকোতে মিঃ আলডিন-এর নিজস্ব স্যুইটে সেদিন এরকুল পোয়ারোর লাঞ্চের নেমন্তন্ন ছিল। মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে খাচ্ছিলেন আলডিন ও পোয়ারো। খাওয়া শেষ করে পোয়ারো তার নিজের ছোট একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের কড়িকাঠের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে কি ভাবলেন তারপর তাকালেন আলডিনের দিকে।
ঘটনার বিশ্লেষণ শুনতে চান? হ্যাঁ, বলব।–একটা টান দিলেন সিগারেটে। একটা জিনিসই আমাকে ধাঁধায় ফেলেছিল। জানেন কি সেটা? সেটা হলো মৃতের মুখ। বিকৃত করা মুখ। খুনের ব্যাপারে মৃতের পরিচিতের জন্যে এই রকম করে খুনীরা। বিকৃত করা মুখটা দেখেই আমার মনে হয়েছিল–সত্যিই কি উনি মিসেস ক্যাথারিন। কিন্তু একমাত্র গ্রে-র নির্ভুল সনাক্তকরণের জন্যে আমার আর চিন্তা ছিল না।
–পরিচারিকাকে কখন থেকে আপনার সন্দেহ হলো?
–প্রথম থেকে নয়। ট্রেনের কামরায় পাওয়া সিগারেট কেসটা ও বলে, ওটা নাকি মিসেস ক্যাথারিন তার স্বামীকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রথম থেকেই গরমিল। আর সেই গরমিল যখন উভয়কেই বৈষম্যের চরমে উপস্থিত করেছিল, ঠিক সেই সময় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে উপহার দেওয়াটা যথার্থই অবিশ্বাস্য। এটাই আমাকে আজ ম্যাসন-এর সততা সম্বন্ধে সন্ধিগ্ধ করে তোলে। অ্যাজ ম্যাসন মাত্র দুমাস কাজে লেগেছে, আর এই দুমাসের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক খারাপ বই ভালো হয়নি। মিঃ ড্রেক প্রায়ই মিরেলির কাছে থাকতেন। আর মিসেস ক্যাথারিনও রিভিয়ারায় কাউন্ট-এর সঙ্গে মিলতে যেতেন। এমন পরিস্থিতিতে পরিচারিকার উপহার দেওয়ার কথাটা মেনে নিই কেমন করে? তবুও এত কাণ্ডের পরেও ঠিক জুত করে অ্যাজ ম্যাসন-এর সম্বন্ধে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ সে প্যারীতে নেমে গিয়েছিল, আর তার চেয়েও বড় কথা সে প্যারীতে নামার পরেও অনেকেই মিসেস ক্যাথারিনকে জীবিত দেখেছেন, কিন্তু–পোয়ারো একটু ঝুঁকে এসে মিঃ আলডিন-এর সামনে একটা আঙুল নাড়লেন নিজেকে দেখিয়ে; মঁসিয়ে আলডিন, আমার অসীম বিশ্বাস আর আস্থা আছে এই ছোটোখাটো লোকটার ওপরে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে অ্যাজ ম্যাসন আদৌ যে প্যারীতে নেমেছিল সেটা কেমন করে জেনেছি? অবশ্য আপনার সেক্রেটারী বলেছে। সে মিস ম্যাসনকে প্যারীতে দেখেছে। কিংটন তখন সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি। তার সঙ্গে এ কেসের কোনো সম্পর্কই ছিল না। এবং কণ্ডাক্টরের কথায় আমার মনে অসম্ভব আর প্রায় আজগুবি একটা চিন্তা উঁকি দিল। মনে মনে ভাবলাম। আমার অসম্ভব চিন্তায় বলছে অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীতে দেখতে যাওয়ার কথাটা একটু ধোঁয়াটে মতন।
পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করলেন পোয়ারো। কিংটন-এর অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীর রীজ হোটেলে দেখতে পাওয়া নিয়েই কাজ শুরু করি। যদিও ওটা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু খুব সতর্কভাবে ঘটনাকে খুঁটিয়ে দেখার পর দুটো জিনিস আমার নজরে আসে। প্রথমত:-একটা আশ্চর্য রকম যোগাযোগ বেরিয়ে পড়ল–কিংটন নিজেও ঠিক দুমাস হলো আপনার কাজ করছে। দ্বিতীয়ত :- কিংটন-এরও প্রথম অক্ষর K মুখটা রুমাল দিয়ে মুছলেন। যদি ধরা যায়, মানে নেহাতই কল্পনা করি যে সিগারেট কেসটা তার এবং তারা দুজনে মিলে যদি এ কাজ করে। তাহলে অ্যাজ ম্যাসনকে সিগারেট কেসটা দেখানো মাত্রই সে এটা কিংটন-এর বলে চিনতে পেরেছিল। সেক্ষেত্রে মিস ম্যাসন-এর ঐ ধরনের মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় ছিল না। মিস ম্যাসন এমনই একটা উত্তর দেয়, যেটা মিঃ ক্যাথারিনকে আরও বেশি অপরাধের জালে জড়িয়ে ফেলে। অবশ্য আসল উদ্দেশ্য এটা ছিল না, কাউন্টকে ফসানোর জন্যেই সে বলে। কিন্তু কাউন্ট যদি খুনের সময় অন্য কোথাও ছিল বলে প্রমাণ করেন, সেইজন্যই মিস ম্যাসন নিশ্চিন্ত হজয়ে কাউন্ট-এর সম্বন্ধে কিছু বলেনি। এবার আমি একটা ঘটনা বলি যা কিছুদিন আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস আপনি লক্ষ্য করবেন। আমি ম্যাসনকে যতবার বলি, যে লোকটাকে সে ট্রেনের কামরায় দেখেছিল সে কাউন্ট নয়, সে ড্রেক ক্যাথারিন, সে সময় তাকে বেশ বিচলিত হতে দেখি। কিন্তু আমি আপনার ওখান থেকে হোটেলে ফিরে আসার একটু পরেই আপনি, আমায় ফোন করে জানান যে অ্যাজ ম্যাসন জানিয়েছে যে সে ভেবে দেখল, ঐ লোকটা ড্রেক ক্যাথারিনই, কাউন্ট নয়। আমি এটাই আশা করেছিলাম। তার মানে আপনার ওখান থেকে ফিরে অ্যাজ ম্যাসন কারো সঙ্গে পরামর্শ করে তারপর তার মতামত আপনাকে জানায়। এখন প্রশ্ন হল কে সেই পরামর্শদাতা? মেজর রিচার্ড কিংটন আর একটা তুচ্ছ ঘটনা–কথায় কথায় কিংটন একবার বলেছিল, ইয়র্কশায়ারে যে বাড়িতে সে থাকত, সে বাড়িতে নাকি একবার রত্ন চুরির ঘটনা ঘটে। দুটো চুরির ঘটনার এই মিল হয়তো আকস্মিক–আবার হয়তো উভয় ঘটনাই গ্রন্থিবদ্ধ–একটা ক্ষীণতর যোগসূত্র হয়তো বা আছে। অন্ততঃ আমার তা-ই মনে হচ্ছিল। জানেন তো ডিটেকটিভকে প্রথমে করতে হয় অনুমান। পরে সেই অনুমানকে কাজে লাগাতে হয় বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তির সাহায্যে।