ট্রেন প্যারীতে আসতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। শক্ত করে ভ্যান আলডিনের হাতটা চেপে ধরলেন। একটা জিনিস ভেবে দেখিনি আগে, আমাদের প্যারীতে নেমে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি নামুন। নামুন! কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে স্যুটকেসগুলো নিয়ে ট্রেন থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন। হতভম্ব আলডিন ও কিংটন নেমে পড়লেন। পোয়ারোর এই অদ্ভুত কাজকর্ম তার ক্ষমতা সম্বন্ধে আলডিনকে আরও বেশি। নিরাশ করতে লাগল। রেলিঙের ধারে এসে ওদের থামতে হলো টিকিট কালেক্টরের কাছে। টিকিট খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, ট্রেনের কণ্ডাক্টরের কাছেই রয়ে গেছে ওদের তিনজনের টিকিট। নামার সময় কেউই খেয়াল করেননি। পোয়ারো অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু রাশভারী টিকিট কালেক্টরের মন তাতে বিগলিত হলো না। পোয়ারো কিন্তু নিরাশ না হয়ে তখনও বুঝিয়ে চললেন….
কথা না বাড়িয়ে চলুন এখান থেকে চলে যাই। আলডিন খুবই বিরক্ত হলেন। বুঝতে পারছি আপনারও তাড়া আছে। ক্যালে থেকে হিসেব করে যা ভাড়া হয় চুকিয়ে দিন, তারপর চলুন আপনার যা করণীয় আছে করবেন।
পোয়ারো খুব সরল ভাবে বললেন, সত্যি আমি বোকা। আমার দেখছি দিন দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চলুন, আমরা ট্রেনেই ফিরে যাই। আবার আমাদের যাত্রা শুরু করি। মনে হয় ভাগ্য ভালো, ট্রেনটা পেয়ে যাব আমরা। চলুন, চলুন।
আলডিন ও পোয়ারো ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দিল। সবশেষে কিংটন কোনোমতে চলন্ত ট্রেনে লাফ মেরে উঠলো।
কণ্ডাক্টর খুব যত্ন করে আবার লাগেজগুলো বয়ে নিয়ে ওদের কামরায় রেখে দিল। আলডিন মুখে কিছু না বললে বিরক্তস্বরে কিংটনকে বললেন, লোকটা বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। ঘটনার জটিলতায় লোকটা নিজের আস্থা তো হারিয়েছেই। সেই সঙ্গে নিজের ধৈৰ্য্যও হারিয়ে ফেলেছে। লোকটার বুদ্ধি ছিল। চিন্তাশক্তি ছিল কিন্তু হলে হবে কি? যে নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারে না। এই মুহূর্তে বলছে এক পরমুহূর্তে করছে আরেক। এমন লোকের দ্বারা কোনো সিদ্ধান্তে আসা কি করে সম্ভব?
কয়েক মুহূর্তের পরে হতাশ মনে পোয়ারো এসে আলডিন ও কিংটনের কাছে খুবই দুর্দশাগ্রস্তের মত অনুনয় বিনয় করে ক্ষমা চাইলেন। মিঃ আলডিন মনের রাগ আর মুখে প্রকাশ করলেন না। ট্রেনেই তারা ডিনার খেলেন। ডিনার খাওয়ার পর পোয়ারো বললেন, এবার আমরা তিনজনেই মিঃ আলডিন-এর কামরায় গিয়ে বসব, পোয়রোর কথায় দুজনেই অবাক হলেন।
–আপনি আমাদের কাছে কিছু গোপন করছেন মঁসিয়ে।
–চোখ কুঁচকে মিঃ আলডিন বললেন।
–আমি? কি লাভ বলুন।
আলডিন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। কণ্ডাক্টর রাতে তার শোবার বিছানা করতে এলে তাকে ফিরিয়ে দিলেন। নিঃশব্দে তিনজনে বসে ব্লু ট্রেনের দোলানি খেতে লাগলেন।
হঠাৎ পোয়ারো কেমন যেন অস্থির আর চঞ্চল হলেন।
-মেজর কিংটন, আপনার কামরার দরজাটা বন্ধ আছে তো? মানে আমি বলছি কামরা থেকে করিডরে যাবার দরজাটা।
–হ্যাঁ, আমি এখনি বন্ধ করে এসেছি।
–ঠিক বন্ধ করেছেন তো?
–যদি বলেন তো আবার একবার নিশ্চিত হয়ে আসি।
–না না, আপনাকে যেতে হবে না। আমি দেখে আসছি।….
–পোয়ারো গিয়ে আবার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ফিরে এসে বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি, বন্ধই আছে দরজাটা।–বয়স হয়েছে তো। তাই অকারণে ব্যস্ত হই। এবার দু-কামরার মাঝের দরজাটা বন্ধ করে পোয়ারো ডান দিকের কোণে গিয়ে বসলেন।
সময় কেটে যাচ্ছে। তিনজনেই ক্ৰমে ঢুলতে শুরু করলেন। মিঃ আলডিন ও কিংটন ভেবে বেশি বিরক্ত হচ্ছিলেন যে প্রত্যেকের আলাদা কামরা রিজার্ভ থাকলেও পোয়ারো কি করছেন। পোয়ারো থেকে থেকে ঘড়ি দেখতে লাগলেন। মাঝে একবার গিয়ে সংযোগকারী দরজাটা খুলে পাসের ঘরটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন। আবার এসে নিজের জায়গায় বসলেন।
–কি ব্যাপার বলুন তো? ফিসফিস করল কিংটন। আপনাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কিছু ঘটবে আসা করছেন নাকি?
-হ্যাঁ, ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছি আমি… যেন টালির ছাদে ওত পেতে শিকারের আসায় বসে থাকা ধূর্ত বেড়াল। সামান্যতম শব্দও আমাকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
-ওঃ জীবনে এতবার ট্রেনে চাপলাম কিন্তু এবারের মতো জঘন্য ট্রেন যাত্রা-হাই তুলে বিড়বিড় করতে লাগলেন কিংটন। আমার মনে হয় মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি জানেন কি হবে।
তারপর কিংটন একটু আরাম করে বসে ঘুমোতে লাগল। আলডিনও এভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। পোয়ারো আবার ঘড়ি দেখলেন। ঝুঁকে পড়ে আলডিন-এর কাধ ধরে মৃদু আঁকানি দিয়ে বললেন, আপনি তো দেখছি ঘুমে বিভোর কিন্তু এদিকে যে পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই
ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলেন আলডিন। নয়েনস্? হে ভগবান।তার চোখ মুখ কেমন যেন উদভ্রান্ত আর ফ্যাকাশে মনে হলো। তাহলে তো সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত, যখন আমার রুথকে মেরে ফেলা হয়। তার করুণ উদভ্রান্ত দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। ঠোঁট দুটো সামান্য ফঁক, মন খুঁজে বেড়াতে লাগলো এক ভয়াবহ ঘটনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া হৃদয়ের ধনকে। যে তার জীবনের সবটুকু আনন্দ নিয়ে চলে গেছে।
মাঝে মাঝে ব্রেকের একটানা লম্বা আওয়াজ করে ট্রেনের গতি কমতে লাগল। তারপর ট্রেন নয়েন স্টেশনে ঢুকল। আলডিন জানলাগুলো খুলে ঝুঁকে বাইরের দিকটা দেখলেন।