-সতেরো বছর আগে, মানে ষোল বছর বয়সে কেমন বোকা আর সরল ছিলাম না?
–সত্যি আপনি খুব সরল ও বোকা ছিলেন। যে যা বলত, তাই বিশ্বাস করতেন। যার জন্যে অতবড় ব্যাপারটাই ঘটে গেল সেবার। অবশ্য আপনার বাবা আসল ভেতরের খবর কিছুই জানেন না।
-সে কি! বাবা জনেন না আপনি ঠিক জানেন?
–আমাকে আপনার বাবা যখন ব্যাপারটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, হারানো জিনিস ফেরত পেয়েছেন আর কিছু জানতে চাইবেন না–আপনার পক্ষে অপ্রীতিকর হবে। জানেন কেন বলেছিলাম এ কথা?
-না, কেন?–আড়ষ্ট হল জিয়া।
-সতেরো বছর আগের সেই কিশোরীটির মুখ চেয়ে আমার নিজের মুখ বন্ধ করতে হয়েছিল।
–আপনি কি সব বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
–বুঝতে পারছেন না? অ্যান্টনিও পিরেজিও-আপনার বাবার দোকানের সেই যুবক কর্মচারীটিকে কি আপনার মনে পড়ছে না? যে আগে থেকেই চুরির মতলব নিয়ে ঢুকেছিল আর যার জন্য তাকে আপনার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে হয়েছিল? যাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে সেই কিশোরীটি তার বাবার মহামূল্যবান রত্ন রাখার গুপ্তস্থান পর্যন্ত বলে দিয়েছিল? তাকে ভুলে গেলেন মাদমোয়াজেল? ওঃ সেদিনের সেই কিশোরীটির চেহারা আজও আমার চোখের ওপর ভাসছে। বেচারা সব বুঝতে পারছে অথচ কিছু বলতে পারছে না। কি বলবে! আর কে বিশ্বাস করবে। যাক, এরকুল পোয়ারোর তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধিকে অনেক ধন্যবাদ যে কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই চোরাই মাল উদ্ধার করে আসল মালিককে দিতে পেরেছিলেন।
–কে আপনাকে অ্যান্টনিওর কথা বলেছিল?–রেগে লাল হলো জিয়া।
-কেউ না। আমার নির্ভুল অনুমান আর আপনার মুখের নির্বাক ভাষা। দেখুন মাদমোয়াজেল, যদি আপনাদের মুখের না বলা ভাষা আমি না পড়তে পারলাম তাহলে কিসের এরকুল পোয়ারো?
-তা এতদিন পরে একথা বলছেন কেন? বাবাকে বলবেন নাকি?
ছি ছি, এ কি বলা যায়?
তার বদলে আমার কাছে কিছু আশা করেন নিশ্চয়ই।
–আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী মাদমোয়াজেল।
–আপনাকে সাহায্য করব একথা ভাবলেন কি করে?
–ভাবিনি। শুধু আশা করেছিলাম মাত্র।
–যদি না করি তাহলে বাবাকে বলে দেবেন তো?
–মাদমোয়াজেল, আমি অনুরোধ করছি আপনার ঐ ধারণাটা বদলান। আমি ব্ল্যাকমেলার নই।–একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন পোয়ারো। যদি না চান তো না-ই করলেন। আমার করার কিছুই নেই।
–কিন্তু বাবা তো আপনাকে একটা আভাস দিয়েছেন।
–তার জন্যে পোয়ারো তার কাছে কৃতজ্ঞ।
-কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু আপনাকে…. আচ্ছা-না, আপনাকে বলব, নিশ্চয়ই বলব। সেদিন আপনি ঠিকই ধরেছেন কেন আমরা নিস-এ এসেছি। রুবীগুলো এখানেই হস্তান্তর করা হয়েছে। ওগুলো এখন বাবার কাছেই আছে। আর কে এই মক্কেল সে তো বাবা ঘোড়ার নামে টিপস্ দিয়ে আভাস দিয়েছে।
-মার্কুইস।
–হ্যাঁ, মার্কুইস।
–আচ্ছা মাদমোয়াজেল, মাকুইসকে আপনি কি কখনও দেখেছেন?
–একবার মাত্র। তাও চাবি লাগবার গর্ত দিয়ে। মুখে প্ল্যাস্টিক-এর হুবহু মানুষের অনুকরণে একটা মুখোশ ছিল। মাথার চুল ধবধবে সাদা।
–যুবক না বয়োজ্যেষ্ঠ?
–গলার স্বর এবং চলা দেখে বয়স্ক বলে মনে হয় না।
–আবার তার গলার স্বর শুনলে চিনতে পারবেন?
–হয়তো পারব। কিন্তু এর চেয়েও প্রয়োজনীয় কথা আপনাকে বলছি।
–বলুন। সজাগ হলেন পোয়ারো।
–আমি আপনাকে আগেই বলেছি রুবীগুলো এই নিস শহরেই হাত বদল হয়েছে। এবং যে এটা করেছে সে….
-সে একজন….
–সে একজন নারী।
৬. আবার ব্লু ট্রেনে
৩১. আবার ব্লু ট্রেনে
ভয়াবহ গতিতে ছুটে চলেছে ব্লু ট্রেন। যার আর একম নাম– কোটিপতি ট্রেন। শুধু কোটিপতিরাই এই ট্রেনে ভ্রমণ করার খরচ পোষাতে পারেন। অনেকক্ষণ ধরে অনেক বড় একটা বাঁক শেষ করে আবার ভূমধ্যসাগরের কোণ ঘেঁসে হাওয়ার বেগে ছুটে চলল। কোটিপতিদের ট্রেন-ব্লু ট্রেন। ভ্যান আলডিন, কিংটন আর পোয়ারো কোনো কথা না বলে যে যার জানালা দিয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখছিলেন।
ভ্যান আলডিন ও কিংটন-এর কামরা দুটোর মাঝখানে পরস্পর সংযোগকারী দরজা আছে। ঠিক যেমন আসল ঘটনার দিন রুথের কামরা আর তার পরিচারিকার কামরা দুটোর মাঝখানে ছিল। পোয়ারোর নিজের কামরাটা ছিল একটু পেছন দিকে।
এবারের ব্লু ট্রেনে ভ্রমণ ভ্যান আলডিন-এর মনে এক অতি বেদনাদায়ক স্মৃতি বয়ে যাচ্ছিল। তাঁর বারবার মনে পড়ছিল যে তার প্রাণাধিক রুথ-এর এই ট্রেনের কামরায় শেষ দেখা করুণ মুখখানা। পোয়ারো আর কিংটন কখনও নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছিলেন। দুজনেই মিঃ আলডিন-এর মনোভাব বুঝে তাকে বিরক্ত করেননি।
তারপর ট্রেন যথাসময়ে গেয়ার দ্য নয়েন-এ পৌঁছানো মাত্রই বিদ্যুৎবেগে কাজে লেগে গেলেন পোয়ারো। ভ্যান আলডিন বুঝলেন পোয়ারোর ট্রেনে করে এই ভ্রমণের উদ্দেশ্যই হলো সেদিনের সেই ঘটনার ছবিটা তুলে ধরা। অবশ্য পোয়ারো নিজেই প্রত্যেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে লাগলেন। প্রথমেই রুথ ক্যাথারিন–এর পরিচারিকার ভূমিকায়। ঠিক যেন রুথ ক্যাথারিন–এর পরিচারিকা নিজের কামরায় তাড়াতাড়ি ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর রুথ ক্যাথারিন-এর ভূমিকায়। স্বামীকে অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রেনে নিজের কামরায় দেখে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠল। তারপর স্বামী ড্রেক ক্যাথারিন–এর ভূমিকায় ড্রেক ক্যাথারিন যেন হঠাৎই আবিষ্কার করলেন যে তার স্ত্রী রুথও ঐ ট্রেনে যাচ্ছে। তারপর পোয়ারো দ্বিতীয় কামরাটায় কোনো ব্যক্তির পক্ষে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখার যতরকমের সম্ভাব্য জায়গা থাকতে পারে সেগুলোও যাচিয়ে দেখলেন।