মিরেলির কথাগুলো শোনার পর নিঃশব্দে ড্রেক কি চিন্তা করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
২৩.
সাবধান বাণী
লেডী টাম্পলিন ক্যাথারিনকে নিয়ে মণ্টিকালোতে এসেছিল। বাগানে দুজনে বসে যখন কথা বলছে তখন কিংটন আর পোয়ারো এসে হাজির হলেন। কিংটনকে দেখে প্রায় ছুটে গেল লেডী টাম্পলিন। কি অশ্চর্য! আপনাকে যে এখানে দেখব সে কথা ভাবতেও পারিনি।
–আমিও ভাবতে পারিনি। ভারী খুশী হলাম আপনাকে দেখে।
–তাহলে আসুন, বেড়াতে বেড়াতে দু-চারটে কথা বলি। সেই হাসপাতালের দিনগুলোর কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে?
কথা বলতে বলতে কিংটনকে অন্য দিকে নিয়ে চলল লেডী টাম্পলিন। পোয়ারো ক্যাথারিন-এর কাছে এসে হাসিমুখে বললেন, আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভালোই হলো আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার খুব দরকার ছিল। মাদমোয়াজেল, জীবনে এমন কিছু ঘটনা আছে যা ঘটবার আগেই তার আভাস পাওয়া যায়। যেমন সূর্য ওঠবার আগেই আকাশে তার আভাস পাওয়া যায়।
–হেঁয়ালিই করবেন, নাকি–আসল কথাটা বলবেন?
–ঐ আমার দোষ। মাঝে মাঝে হেঁয়ালি করতে আমার ভালো লাগে। ঠিক আছে, তাহলে সোজাসুজিই বলি। মিষ্টি করে হেসে বললেন, মিঃ কিংটনকে কেমন লাগে আপনার? যদিও প্রশ্নটা একান্তই আপনার মনের ব্যাপার।
-কথাবার্তায় আলাপে ব্যবহারে তো ভালো লোক বলেই মনে হয় ওকে। কিন্তু হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করার কারণ কি?
–কারণ আর কিছু নয় আমি আপনাকে জীবনে সুখী দেখতে চাই মাদমোয়াজেল। মাঝে মাঝে এমন কিছু লোকের সঙ্গে আলাপ হয় যাদের সুখী দেখলে আমি নিজেও সুখী হই। আপনি তাদেরই একজন।
ক্যাথারিনের মনে হল এ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক। পোয়ারোর এমন গলার স্বর আর কখনও শোনেনি সে। পোয়ারোর কথার আন্তরিকতা, তার ব্যক্তিত্ব ক্যাথারিনকে মন্ত্রমুগ্ধ করল।
পোয়ারো আবার বললেন, আচ্ছা, এবার বলুন মিঃ ক্যাথারিনকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়?
–তাঁর সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানি না।
–এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।
–আমার কিন্তু মনে হয় উত্তরটা ঠিকই হয়েছে।
–ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন আমি দুনিয়ার অনেক লোক দেখেছি অনেক কিছু দেখেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে খারাপ স্ত্রীলোকের সংসর্গে এলে ভালো লোকও অনেক সময় খারাপ হয়ে যায়, আবার একটি ভালো মেয়েকে ভালোবেসে কোনো খারাপ লোক তার সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। তা তার ভালোবাসা যতই খাঁটি হোক না কেন।
–সর্বনাশ বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন?
–আমি কারো নাম বলতে চাই না। শুধু একথা জেনে রাখুন যে, এমন কিছু লোকের চেহারা আকর্ষণীয়। আর সেই আকর্ষণে ধরা দেবার উন্মাদনা আমি আপনার মধ্যে দেখেছি। আমি এরকুল পোয়ারো, আবারও বলছি, আপনার এই উন্মাদনা যেন কোনো আকর্ষণেই ধরা না পড়ে লক্ষ্য রাখবেন মাদমোয়াজেল। মন দিতে গিয়ে যে কোনো হত্যাকারীকে বরণ করে ফেলবেন না। আশা করি আমার কথা মনে রাখবেন মাদমোয়াজেল।
হঠাৎই পোয়ারো চলে গেলেন কোনো কথা না বলে। পোয়ারোর যাওয়া দেখতে দেখতে ক্যাথারিন তার কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। তিনি কেনইবা বললেন এই কথাগুলো। তবে কি….
–কি অত তন্ময় হয়ে ভাবছেন বলুন তো?
ক্যাথারিন চমকে তাকাতেই দেখল মিঃ ক্যাথারিন পাশে দাঁড়িয়ে। সম্বিৎ ফিরে এলো তার, কই কিছু না তো! আপনি হঠাৎ কোথা থেকে?
-আর বলবেন না, আমি এতক্ষণ জুয়া খেলছিলাম। খেলতে খেলতে সব টাকা খুইয়ে তবেই ক্যাসিনো থেকে বের হলাম।
–আপনি একজন জুয়াড়ী? –প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল ক্যাথারিনের স্বর।
-আপনি ভীষণ অবাক হচ্ছেন। দেখুন, মানুষের জীবনটাই তো একটা ক্যাসিনো। জন্মালেই মানুষকে ভাগ্যের কাছে জীবনটাকে বাজী রাখতে হয়। তারপর আমৃত্যু চলে সেই বাজী হারা জেতার খেলা। আর আমি খেলি টাকা পয়সা রেখে ক্যাসিনোতে গিয়ে। জুয়া খেলি এই তো?–ঠোঁট বেঁকিয়ে স্পর্ধার হাসি হাসলো ড্রেক; আর পরের ওপর এই যে অনিশ্চয়তার একটা উত্তেজনা। ভালো শিকারী যেমন শিকার দেখলে নিজের প্রাণ বিপন্ন হলেও শিকারের পেছনে ধাওয়া করে, ভালো জুয়াড়ীও তেমনি জুয়ায় সব কিছু হারাতে পারে জেনেও জুয়ার দালাল ধরতে ছুটে যায়।
ক্যাথারিন ড্রেকের এমন বেপরোয়া স্পর্ধিত চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
ড্রেক বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। কে জানে পরে হয়তো কথার সময় হবে না। অনেকের ধারণা আমি নাকি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি। স্রেফ বাজে কথা বুঝলেন, পুলিশের কাছে অবশ্য আমাকে কিছু অল্পস্বল্প বলতে হয়েছে কিন্তু আপনার কাছে কিছু গোপন করব না। আপনাকে পাওয়া মানেই রাজত্বর সঙ্গে রাজকন্যা। সুতরাং আপনাকে নির্ভেজাল সত্যি কথাই আমাকে বলতে হবে। রুথকে বিয়ে করেছিলাম টাকার জন্যে। অবশ্য রুথও আমাকে বিয়ে করেছিল লুকোনবারী হবার জন্যে। কিন্তু ওর টাকা আছে বলে আমি নেপো হয়ে থাকবো আর তিনি কাউন্টের সঙ্গে বৌ বৌ খেলা করবেন। না না, আপনি ভাববেন না আমি অভিযোগ করছি। সে কাহিনী আমার শ্বশুরমশায়ের কাছে ভালোভাবে শুনবেন। অবশ্য একথা সত্যি রুথ-এর মৃত্যুর আগের মুহূর্তে আমার পকেট গড়ের মাঠ ছিল। দেনায় অন্ধকার দেখছিলাম চারদিক আর ঠিক সেই সময় রুথ নিজে মরে আমাকে বাঁচিয়ে গেল।–যেন বড় রকমের একটা জুয়ার বাজী জিতল এমনভাবে হেসে উঠলো ড্রেক।