আসামী পক্ষ থেকে মনে হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের পথটা বাছা হয়নি ঠিকমতো, বললো পোয়ারো।
ফগ রোগা রোগা কাঁধ দুটো নাচিয়ে বললেন, কীই বা আর ছিলো করার, বসে থাকা চুপচাপ আর মামলা প্রমাণ করতে সরকার পক্ষকে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করণীয় ছিলো না। গাদাগাদা প্রমাণও ছিলো বিরুদ্ধে। মহিলা নিজের হাতেই বিষটা এনেছিলেন, স্বীকারও করেছিলেন চুরি করার কথাটা। উপায়, উদ্দেশ্য, সুযোগ, ছিলো সব কিছুই।
কৃত্রিমভাবে এগুলো যে সাজানো হয়েছিলো পরপর এটা প্রমাণ করার চেষ্টাও তো কেউ করে থাকতে পারে।
কাঠখোট্টার মত ফগ বললেন পোয়ারোর কথার উত্তরে, মহিলা স্বীকার করেছিলেন বেশিরভাগই অভিযোগ। তাছাড়া খুবই কষ্ট কল্পিত আপনার বক্তব্যটি। আমার মনে হয় আপনি সবটাই অনুমান করে নিচ্ছেন। অন্য কেউ খুন করে আপনার মনে হয় সবকিছু এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ভদ্রমহিলাই খুন করেছেন মনে হয়।
আপনি কি অযৌক্তিক মনে করছেন আমার বক্তব্যটাকে? পোয়ারো প্রশ্ন করলো পাল্টা।
ধীরে ধীরে ফগ বললেন, মনে হচ্ছে করছি। আপনার মতে কাজটা করেছিলো কোনো এক রহস্যময় অজ্ঞাত ব্যক্তি। কিন্তু আমরা তাকে পাবো কোথায়?
খুব নিকট আত্মীয়গোষ্ঠীর মধ্যে অবশ্যই। পাঁচজনের কথা তো বলছিলেন, তাই না? কে এদের মধ্যে থাকতে পারে জড়িত?
পাঁচজন? দাঁড়ান, দেখি ভেবে, একজন তো হলো গাছপালার শেকড়-বাকর নিয়ে কী সব করতো ঐ বুড়ো অকর্মার ধাড়ীটা। নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক শখটা। তবে অমায়িক লোকটা। মানুষটা একটু ধোয়াটে গোছের। তা ওকে মনে হয় না ওই রহস্যময় অজ্ঞাত পুরুষ বলে। তারপর ঐ মেয়েটা, পারলে ও খুন করতো ক্যারোলিনকে। আদৌ অ্যামিয়াসকে না। তারপর ঐ দালালটা আসে শেয়ার বাজারে। আবার সে প্রাণের বন্ধু ক্রেলের। ওসব চলে গোয়েন্দা কাহিনীতে। এছাড়া তো আর কেউ নেই–ও হা… ওই সৎ বোনটা…না না সন্দেহ করা যায় না ওকে। মোটে তো চারজন হলো।
গভর্নেসের কথাটা কিন্তু আপনি বাদ দিয়ে গেলেন। মনে করিয়ে দিলো পোয়ারো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তো। গভর্নেস আজে বাজে লোক–আমাদের এতো মনে থাকে না সাধারণ মানুষের কথা। মনেও পড়ছে আবছা মহিলা মাঝ বয়েসী, মানুষ হিসেবে সিধেসাধা তবে কাজেরও ছিলো। হয়তো বলতে পারেন মনঃস্তত্ত্ববিদরা তার কোনো রকম গুপ্ত কামনা ছিলো ক্রেলের সম্বন্ধে, যার জন্যে খুন করেছে। যেমন হয় অবিবাহিতা মেয়েরা যাদের বয়স পেরিয়ে গেছে বিয়ের, এও সেরকম ছিলো। তবে ঠিক হবে না অভিযোগ আনাটা ওর বিরুদ্ধে। যতদূর মনে পড়ে আমার তার কোনো রকম মানসিক বিকারও ছিলো না।
বহুদিন আগের ঘটনা ব্যাপারটা তো?
তা তো পনেরো-ষোলো বছর হবেই। এবং সবটাই যে আমার মনে থাকবে এতদিন আগের ঘটনা এ আশাও করা উচিত নয় আপনার।
কিন্তু কি আশ্চর্য আপনি অবিশ্বাস্যভাবে সবকিছুই মনে রেখেছেন। দেখতে পান আপনি তাই না? যখন কথা বলেন আপনি মনে হয় তখন আপনার চোখের সামনে পুরো ছবিটা ভেসে ওঠে।
মাথা নাড়লেন ফগ ধীরে ধীরে, হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন, দেখতে পাই আমি…চোখের সামনে একেবারে।
পোয়ারো বললো, আমার কিন্তু ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে জানতে, এটা কেন আপনার হয়?
কেন? একবার প্রশ্নটাকেই ফগ প্রশ্নের মতো করে উচ্চারণ করলেন, তারপর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো তার মুখটা, বেড়ে উঠেছে যেন আগ্রহও–ও হা কেন প্রশ্ন করছেন ভেসে ওঠে?
আপনার চোখের সামনে কি এতো সহজেই ভেসে ওঠে? সাক্ষীরা? কৌসুলীরা? জজ? না, দাঁড়িয়ে থাকা কাঠগড়ার আসামী?
শান্তভাবে ফগ বললেন, বোধ হয় এটাই আসল কারণ, ঠিক জায়গাটায় আপনি ঘা মারতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। ঐ মহিলাকেই আমি সব সম সময়ে দেখি। ব্যাপারটা ভারী মজার, ভাবালুতা। তবে সে গুণ নিশ্চয়ই মহিলার ছিলো। তিনি সত্যি সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন কিনা তা ঠিক বলতে পারছি না–কম নয় বয়সও, ক্লান্তির ছায়া চেহারায়, চোখের কোলে কালি। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করেই যেন সব কিছু আবর্তিত হচ্ছিলো। তাকেই নিয়ে যেন নাটক। অথচ উনি ওখানে বেশির ভাগ সময় থাকতেন না, শুধু দেহটা ওঁর থাকতো ওখানে, ওঁর মন, যেন চলে যেতো ওঁর আত্মা অনেক, অন্য কোথাও অনেক দূরে অন্য কিছুর সন্ধানে। শান্ত, বিনীত মৃদু হাসি সমাহিত মুখে, আলো ছায়ার খেলা চেহারায়। অনেক বেশি প্রাণবন্ত সব মিলিয়ে, বিশেষ করে সুন্দরী, সুতনুকা ঐ কমবয়েসী মেয়েটার চেয়ে তো বটেই। আমি প্রশংসা করি এলসা গ্ৰীয়ারকে, দারুণ তেজী মেয়ে। জানে লড়তে, ও একটুও ভেঙে পড়েনি জেরার মুখে। আবার আমি শ্রদ্ধা করি ক্যারোলিন ক্রেলকে, উনি চাননি লড়তে। কারণ যেন তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন আলো আঁধারের জগতে। উনি কখনও হারেনওনি, লড়ার চেষ্টা করেননি বলে।
ফগ একটু থেমে আবার বললেন, তবে আমার একটা ব্যাপারে ভুল হয়নি। উনি খুন করেছিলেন যাকে, তাকে ভালোও বাসতেন গভীরভাবে। ভালোবাসতেন এত বেশি যে সেই সঙ্গে মরে গিয়েছিলেন নিজেও। তখন অনেক কম আমার বয়স। ভীষণ ছটফট করছি নাম করার জন্য। অথচ আমাকে ভীষণভাবে এই ঘটনাগুলো নাড়িয়ে দিয়েছিলো। ক্যারোলিন ক্রেল ছিলেন এক অসাধারণ মহিলা এ কথা বলতে বাধ্য, তাকে আমি ভুলতে পারবো না কখনই…পারবো না।
.
তৃতীয় অধ্যায়