ইংরেজদের ঘরোয়া হলেও কথাটা কিছুটা বুঝতে পেরেছি আমি তা আমার মনে হয়। প্রধান ফৌজদারী আদালতে, সব সময়ে ইংরেজরা তাদের প্রতিপক্ষকে হারাতে চায় একটু খেলোয়াড় সুলভ সুযোগ দিয়ে।
ধরেছেন ঠিক। ঐ অভিযুক্ত মহিলা কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো সুযোগই পাননি। মহিলাকে হাম্পি রুডলফ লাগিয়ে ছিলেন নিজের ইচ্ছে মতো, স্যার মন্টেগুকে দিয়ে শুরু হয়েছিলো, মহিলা দাঁড়িয়ে কাঠগড়ার মধ্যে। যেন একটা বাচ্চা মেয়ে বিরাট একটা পার্টিতে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে। প্রশ্ন করেছিলেন স্যার মন্টেগু আর শেখানো পড়ানো কাকাতুয়ার মতো মহিলা উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। নিরীহ অত্যন্ত, কথা মেপে মেপে বললেও আদৌ সেগুলো হতে পারছিলো না বিশ্বাসযোগ্য, জুরীর কাছে বিশেষ করে কোনো দোষ ছিলো না বুড়োর, চেষ্টা করেছিলেন যথাসাধ্য। কিন্তু কোনো সহযোগিতাই পাননি মহিলার পক্ষ থেকে। তারপর হাম্পি রুডলফ উঠেছিলেন জেরা করতে।
জেরায় জেরায় মহিলাকে উনি বানিয়ে ছেড়ে ছিলেন কিমা তা তো আগেই বলেছি। প্রত্যেকবার স্বীকার করিয়ে ছাড়ছিলেন তাঁর কথায় অসঙ্গতি মহিলার মুখ দিয়েই। তারপর শেষ বাণগুলো ছুঁড়তে শুরু করেছিলেন জেরা শেষ করার মুখে, আমার মতে আপনি, এই যে কথাগুলো মিসেস ক্রেল বলেছেন, যেমন কোনাইন চুরি করেছিলেন আত্মহত্যা করার জন্যে আপনি, সম্পূর্ণ মিথ্যে একথা। আমার মতে স্বামীকে খাওয়াবার জন্যে আপনি চুরি করেছিলেন। বিষটা, যিনি তখন অন্য এক মহিলার দিকে আপনাকে ছেড়ে বড় বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। এবং জেনে শুনেই আপনি বিষ দিয়েছিলেন স্বামীকে। …আহা, ঐ সুন্দর, শান্ত নরমশরম মহিলাটি তখন প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলেছিলেন… না না,…করিনি আমি।…আচ্ছা বলুন তো কোনো কাজ হয় এই ধরনের উত্তরে, বিশ্বাস করে কেউ, আমি দেখেছিলাম স্যার মন্টেগুর ঐ উত্তর শোনার পর চেয়ারের মধ্যে কেঁপে উঠেছিলো শরীরটা, পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন উনি–শেষ খেলা, কিছু করার আর নেই।
ফগ এক মিনিট চুপ করে থাকার পর আবার শুরু করলেন বলতে, এখনও পর্যন্ত..ঠিক বুঝতে পারিনি একটা ব্যাপার। হয়তো মহিলা দারুণ ধূর্তের মতো চাল চেলেছিলেন। যে দয়া মায়া মানুষের মধ্যে বিশেষ করে অসহায় মহিলাদের প্রতি যে সুনাম আছে সহানুভূতির জন্যে, তিনি আবেদনটা তারই কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন ঠিক মতো। জুরী কেন শুধু, যারা যারা সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলো, যেন সবাই বুঝতে পেরেছিলো কতো অসহায় মহিলা, উনি কিছুমাত্র সুযোগ পাননি আত্মপক্ষ সমর্থন করার। মহিলা বিনা প্রতিবাদে হাম্পি রুডলফের নিষ্ঠুর আক্রমণের বিরুদ্ধে অসহায় প্রাণীর মতো আত্মসমর্পণ করেছিলেন। …তবে ওঁর কিছু বলারও ছিলো না ও ছাড়া। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসেছিলেন জুরীরাও–তাঁদের রায় ঘোষণা করা হলো, অপরাধী তবে সুপারিশ করা হচ্ছে সেই সঙ্গে দয়া দেখাবার।
ব্যাপারটা কি জানেন আসলে, আর একজন যে মহিলা ছিলো মামলাতে, তবে ঐ মেয়েটা যার বয়স কম, এঁর পার্থক্যটা ছিলো তার সঙ্গে একেবারে বিপরীত ধরনের। ঐ মেয়েটাকে প্রথম থেকেই তেমন পছন্দ করেননি জুরীরা। ওর ব্যাপারে কেউ সহানুভূতিশীলও ছিলো না। দারুণ সুন্দরী, পোড়খাওয়া, আধুনিকা মেয়েটা। যে সব মহিলা আদালতে ছিলেন তাদের চোখে ঘর ভাঙানি মেয়ে ছিলো ও। আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখলে ওই ধরনের মেয়েদের সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে নিজের নিজের ঘর সংসার সামলাতে, যেন মেয়ে তো নয়, যেন এক বাণ্ডিল সেক্স। তাদের যেন নেশা মা-বৌদের অধিকারগুলোকে ভাঙচুর করাই। তবে মেয়েটিকে স্যার বলতো একটা ব্যাপারে নিজেকেও বাদ দেয়নি ও। অ্যামিয়াস ক্রেলকে সে ভালোবেসেছিলো তা স্পষ্ট স্বীকার করেছিলো, এবং তাকে ভালোবাসতো ক্রেলও। ফলে অ্যামিয়াসকে তার নিজের সংসার থেকে জোর করে মেয়েটি চেয়েছিলো উপড়ে তুলে নিয়ে যেতে।
আমি ওকে এক দিক দিয়ে প্রশংসাও করি, বলতে হবে সাহস ছিলো। স্যার মন্টেগু কিন্তু জেরার সময় কিছু নোংরা প্রশ্ন করেছিলেন, ঘাবড়ায়নি মেয়েটা। উত্তর দিয়েছিলো চোখা চোখা। অবশ্য মেয়েটাকে পছন্দ করেননি জজও, আদালতও না। জজ কিন্তু জুরীদের অভিযোগের বয়ান পড়ে শোনানোর সময় মোটামুটি আসামীর সম্বন্ধে সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। অস্বীকার না করলেও ঘটনাকে, আসামী যে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলো যথেষ্ট মাত্রায় প্ররোচিত হয়ে এ ধরনের আভাস দিয়েছিলেন।
হঠাৎ প্রশ্ন করলো এরকুল পোয়ারো, আত্মহত্যার ইঙ্গিতটা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলা মেনে নেননি, জজ, না?
মাথা নাড়লেন ফগ, কোনো ভিত্তিই ওটার ছিলো না। মনে রাখবেন একবারের জন্যেও কিন্তু একথা আমি বলছি না যে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রেখেছিলেন স্যার মন্টেগু তার তরফ থেকে। বরং বলা যায় আসামীকে বাঁচাবার জন্যে আপ্রাণ খেটেছিলেন। উনি দারুণ মামলা লড়েছিলেন। এক উদারমনা মুখ সন্ধানী, একটু অভিমানী অস্থির প্রকৃতির পুরুষ হঠাৎ জড়িয়ে পড়েছে গভীরভাবে একটা কম বয়েসী মেয়ের সঙ্গে, তারপর জর্জরিত বিবেকে কশাঘাতে, অথচ আসতে পারছে না বেরিয়েও এমন এক মানুষের ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন মর্মস্পর্শী ভাষায় আদালতের সামনে। তারপর কীভাবে সেই পুরুষটি ধাক্কা খাচ্ছে, ঘৃণা করছে নিজেকে, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধাচ্ছে স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্যে, মনের মধ্যে টানা পোড়েন সন্তানের জন্যে, শেষ পর্যন্ত বদ্ধপরিকর সব কিছুর অবসান ঘটাবার জন্যে…এবং ঐ অকালে মৃত্যু তারই পরিণতি। এ জগৎ থেকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় নেওয়া। স্যার মন্টেগু অসাধারণ আর্গুমেন্ট করেছিলেন। অনেকের চোখে জল এসে গিয়েছিলো ওঁর কথায়। হতভাগ্য মানুষটাকে গভীর আসক্তি আর কর্তব্যবোধের টানাপোড়েনে যেন চোখের সামনে সবাই দেখতে পাচ্ছিলো। ভীষণ প্রতিক্রিয়াও হয়েছিলো। তারপর ওঁর কথা যখন একসময় শেষ হলো, তখন ধীরে ধীরে কেটে গেলো যাদুর প্রভাবটাও। অ্যামিয়াস ক্রেল রূপকথার নায়ক হিসেবে বর্ণিত তার সঙ্গে সত্যিকারের অ্যামিয়াস ক্রেলের মিলটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো তখন কারণ সকলেরই জানা ছিলো ওর স্বভাব চরিত্রের কথা। ও আদৌ অতটা ভালো মানুষ ছিলো না। এমন কোনো সাক্ষ্য প্রমাণও স্যার মন্টেগু পেশ করতে পারেননি যা দিয়ে জোরালো করে তুলতে পারতেন তার বক্তব্যকে। বরং বলতে আমি বাধ্য হবো বিবেক বুদ্ধি আসে সামান্যতম এমন মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যায় না ক্রেলের। দারুণ ভালো নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, ভালো মেজাজে থাকলে, ও আত্মকেন্দ্রিক অহংকারী মানুষ ছিলো, ওর ন্যায় নীতি বলতে যা ছিলো তা শুধু ছবি আঁকার ক্ষেত্রে। হলফ করে এ কথা আমি বলতে পারি ও তা কখনো সে প্ররোচনা যতোই আসুক না কেন ছবি আঁকতো না আজে বাজে। এবং ও জীবনের অন্যক্ষেত্রেও ছিলো এক পুরো রক্ত মাংসের মানুষ, শতরূপে ভালোবাসতো জীবনকে, চাইতো বাঁচতে। আত্মহত্যা? ও তেমন মানুষই ছিলো না।