স্বামীকে খুন করার অভিযোগ যে মহিলা সম্বন্ধে আনা হচ্ছে, তিনি জানেন না বিষ দেওয়া হয়েছে কীভাবে। বিষ বোতলে ছিল ওঁর ধারণা।
প্রতিবাদ করলেন মেরিডিথ কিন্তু কেন…ওকে সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে পোয়ারো বললো, হা…কেন? আত্মহত্যা বলে ব্যাপারটা চালাবার জন্যে কেন মরীয়া হয়ে ঐ চেষ্টা করেছিলেন ক্যারোলিন? খুব সোজা তার উত্তরটা। কারণ জানতেন উনি ওঁর স্বামীকে কে বিষ দিয়েছে এবং তাকে পাছে সবাই সন্দেহ করে তাই বাঁচাবার জন্যে তাকে উনি বাধ্য হয়েছিলেন সব রকম ঝুঁকি নিতে।
এবার চিন্তা করা যাক আরও একটু এগিয়ে গিয়ে। কে হতে পারে সেই ব্যক্তিটি, তিনি কি বাঁচাতে চেয়েছিলেন ফিলিপ বা মেরিডিথকে? না, এলসা গ্ৰীয়ারকে? না সিসিলিয়া উইলিয়ামসকে? না, ক্যারোলিন যে কোনো মূল্যে শুধু একজনকে বাঁচাতে চেয়ে থাকতে পারেন।
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারনকে একটু থেমে পোয়ারো বললো, যদি দিদির চিঠিটা এনে থাকেন তবে দিন, সবাইকে আমি পড়ে শোনাই।
না স্পষ্ট জবাব অ্যাঞ্জেলার, মিঃ পোয়ারো আমি বুঝতে পারছি যে আমিই জামাইবাবুকে আপনার মনে খুন করেছি আর সে কথা দিদি জানতো। আমি এই অভিযোগ অস্বীকার করছি সম্পূর্ণ।
হাত বাড়ালো পোয়ারো, চিঠিটা…?
ওটা আমার চিঠি, আমারই ব্যক্তিগত ভাবে।
পরস্পরের দিকে দু’জন কম বয়সী মেয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন, শেষপর্যন্ত কার্লা লেমারচেন্ট বললেন, অ্যাঞ্জেলা মাসী, মিঃ পোয়ারোর অনুরোধ রাখলে ভালো হয়।
অ্যাঞ্জেলা ঝেঁঝে উঠলেন, কার্লা সত্যি, মাথা খারাপ হয়ে গেছে কি তোমার। তোমার মা ছিলেন না উনি…তুমি… কি না…।
কেটে কেটে কার্লা পরিষ্কার করে বললো, হ্যাঁ, আমার মা ছিলেন উনি, চিঠিটা পড়া হোক সেই অধিকারেই বলছি।
পোয়ারোকে চিঠিটা দিতে দিতে অ্যাঞ্জেলা বেশ রাগত ভাবেই বললেন, না দেখানোই ভালো ছিলো এটা।
পোয়ারো শেষ চিঠিটা পড়লো ক্যারোলিনের। ধীরে ধীরে ঘরের কোণে অন্ধকারে ঘনীভূত হয়ে আসতে শুরু করেছে। কার্লার হঠাৎ মনে হলো কে যেন ঘরের মধ্যে এসেছে, রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে, শুনছে, নিঃশ্বাস পড়ছে তার, যেন সে অপেক্ষা করছে, মনে হলো ওর উনি এসেছেন এখানে…এখানে এসেছেন আমার মা…এখন ক্যারোলিন এই ঘরের মধ্যে।
হঠাৎ পোয়ারোর কণ্ঠস্বর সেই অদ্ভুত নৈশব্দ ভঙ্গ করে ভেসে এলো, নিশ্চয় আপনারা সবাই একমত হবেন আমার সঙ্গে যে চিঠিটা অদ্ভুত ভারী। সন্দেহ নেই সুন্দর, তবে অদ্ভুতও বটে। এতে বাদ পড়ে গেছে একটা উল্লেখযোগ্য জিনিস–কোনো প্রতিবাদ নেই নিজের অপরাধ সম্বন্ধে।
অ্যাঞ্জেলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন ওখান থেকেই, কোনো দরকার ছিলো না তার। নির্দোষ যে ক্যারোলিন, সে কথা জানাবার কোনো প্রায়োজন তিনি অনুভব করেননি বোনকে, কারণ জানতেন তিনি কেন জানেন প্রকৃত ঘটনাটা। বোনকে সান্ত্বনা দিতে চাইছিলেন ক্যারোলিন, এবং যাতে ভয় পেয়ে অ্যাঞ্জেলা দোষ স্বীকার করে না ফেলে তাকে তার জন্যে ব্যস্ত রাখতে অন্য চিন্তায়। বারবার উনি একটা কথা লিখেছেন চিঠিতে–ঠিক আছে সব, লক্ষ্মী সোনা ঠিক আছে সব কিছু। অ্যাঞ্জেলা বললেন, কেন বুঝতে পারছেন না? আমি সুখী হই দিদি চাইছিলো।
হ্যাঁ তাই ঠিক। নিজের মেয়ের চেয়েও উনি অনেক বেশি আপনার কথা চিন্তা করেছিলেন। উনি একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন, মানুষকে তো ঋণ শোধ করতেই হবে।
সব বোঝা যায় এই একটা কথা থেকেই। ক্যারোলিন যে অপরাধ বোধ দীর্ঘকাল ধরে পুষে আসছিলেন মনের মধ্যে, ছোটো বোনের যে ক্ষতি করেছিলেন রাগের চোটে তার ঋণ শোধ করছেন। এবং সেটা করতে পেরে ভীষণ শান্তি পেয়েছিলেন মনে মনে ক্যারোলিন। যেহেতু মনে করেছিলেন তিনি অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তাই অতো বড় অভিযোগকে আদালতে শান্তভাবে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। নিন্দা, ঘৃণা কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি তাকে।
দেখুন এইবার, ক্যারোলিনের সব কাজকর্মের কতটা মিল পাই আমার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে। প্রথমতঃ এমন একটা ঘটনা ঘটে তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় যা মনে পড়িয়ে দিয়েছিলো ক্যারোলিনের কৈশোরের কথা-পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মারা অ্যাঞ্জেলার অ্যামিয়াসকে। ক্যারোলিনও ঐ ধরনের একটা কাজ করেছিলেন, তারপর চিৎকার করে অ্যাঞ্জেলা বলেছিলেন–আমি চাই মরুক অ্যামিয়াস। বিয়ারের বোতল নিয়ে পরদিন সকালে ঘাঁটতে দেখেন অ্যাঞ্জেলাকে। স্মরণ করুন মিস উইলিয়ামসের কথা, ওখানে ছিলো অ্যাঞ্জেলা। মনে হচ্ছিল ওকে অপরাধী…! বলতে চেয়েছিলেন গভর্নো পড়া ফাঁকি দেবার অপরাধে অপরাধী, আর তার অর্থ ছিলো ক্যারোলিনের কাছে অন্য। মনে রাখবেন এটাও অন্ততঃ তার আগে অ্যাঞ্জেলা একবার অ্যামিয়াসের মদের গ্লাসে একটা কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও তাই ভেবেছিলেন ক্যারোলিন।
ক্যারোলিন, অ্যাঞ্জেলার দেওয়া বোতলটা নিয়ে কামান বাগানে চলে যান। আপনারা তার পরের ঘটনা জানেন।
ক্যারোলিনের মনে তখনও সন্দেহ জাগেনি। লাঞ্চ খাবার পর তলায় গিয়ে ঐ অবস্থায় স্বামীকে দেখে সন্দেহ হয় প্রথমেই কে করতে পারে? …তবে কি অ্যাঞ্জেলা, বোনের সেই অপরাধী মুখটা নিজের কাছে ভেসে উঠলো ক্যারোলিনের মনে। প্রতিশোধ? না, জামাইবাবুর নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ। দিদির সম্বন্ধে ভীষণ খেয়ালী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় এই বয়সের মেয়েরা। অতএব বাঁচাতে হবে বোনকে। অ্যাঞ্জেলার আঙুলের ছাপ বোতলের গায়ে মুছে ফেলার জন্যে তাই তিনি অতি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।