নীচে নেমে শুনলাম ও রুটি আর জেলী রান্নাঘর থেকেই খেয়ে চলে গেছে। খুঁজতে বেরোলাম ওকে আমি। এসব কথা লেখার কারণ এই যে কেন সকালে সেদিন থাকতে পারিনি মিসেস ক্রেলের সঙ্গে।
স্নানের পোষাক নেই অ্যাঞ্জেলার তা দেখে সমুদ্রের তীরে আমি গেলাম। জলে বা ডাঙ্গায় পাথরের ওপর ওর চিহ্ন কোথাও দেখতে পেলাম না, ভাবলাম মিঃ মেরিডিথ ব্লেকের কাছে তাহলে গেছে। বেশ বন্ধুত্ব ছিলো ওঁদের দুজনে। ওকে পেলাম না ওখানে, ফিরে এসে দেখি মিসেস ক্রেল বসে আছেন চত্বরে, ফিলিপ আর মেরিডিথ ব্লেকও।
হাওয়া চত্বরটা ছিলো না বলে গরম লাগছিলো ভীষণ, বরফ দেওয়া বিয়ার খাওয়ার কথা মিসেস ক্রেল বললেন।
ভিক্টোরিয়ার আমলে তৈরি ঐ বাড়িতে একটা কাঁচঘরের বাগান ছিলো। ওটাকে মিসেস ক্রেল মদের বার করে তুলেছিলেন। ফ্রিজে বিয়ার আর জিঞ্জার বিয়ার থাকতো, তাকে থাকতো নানারকমের মদ।
ঐ ঘরে গেলাম মিসেস ক্রেলের সাথে। একটা বিয়ারের বোতল অ্যাঞ্জেলা ফ্রিজ থেকে বের করছিলো। মিসেস ক্রেল ছিলেন আমার আগে, বললেন, অ্যামিয়াসকে এক বোতল বিয়ার দিতে হবে।
আমার মনে তখন সন্দেহ হয়েছিলো কিনা বলা কঠিন। স্বাভাবিক ভাবেই ওঁর গলার স্বর শান্ত ছিলো। আমি পড়লাম অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। ও অপরাধী-অপরাধী মন নিয়ে ফ্রিজের পাশে দাঁড়িয়েছিলো।
আমি যথারীতি বকতে শুরু করলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য ও রইলো শান্ত হয়ে। ও যে স্নান করতে যায়নি সেকথা বলতে ও শুধু হাসলো। বোধহয় সমুদ্রতীরে সোয়েটারটা ফেলে এসেছে।
আমি এই কারণে এতো কথা বলছি যে আমি কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম বলেই কামান বাগানে মিসেস ক্রেলকে যেতে হয়েছিলো।
তারপর কি কি হয়েছিলো সেদিন সকালে আমার মনে নেই একটুও। অ্যাঞ্জেলা কথা না বাড়িয়ে সেলাই করে নিলো নিজের স্কার্টটা।
মিসেস ক্রেল লাঞ্চ খাওয়ার পর বললেন কামান বাগানে যাচ্ছেন উনি। তলায় নামলাম আমিও, অ্যাঞ্জেলার সোয়েটারটা সমুদ্রের পাড় থেকে আনতে হবে। কামান বাগানে ঢুকলেন উনি, পাশের পথ দিয়ে আমি এগোচ্ছি তীরের দিকে এমন সময় ফিরে এলাম মিসেস ক্রেলের চিৎকারে, তাড়াতাড়ি টেলিফোন করতে বললেন ডাক্তার ডাকার জন্যে। মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে মাঝপথেই দেখা হলো, টেলিফোন করতে বলে ওঁকে আবার আমি ফিরে এলাম মিসেস ক্রেলের কাছে।
এই কথাই আমি বলেছিলাম করোনারের বিচারের সময় বা আদালতে, তবে যা এবার লিখতে যাচ্ছি তা কাউকে কখনও বলিনি। কিন্তু ঠিক এটাও বিচারের সময় বা আদালতে, তবে যা এবার লিখতে হয়েছিলো তার একটাও মিথ্যে উত্তর আমি দিইনি। তবে সত্যি কথা কিছু বলা হয়নি। এবং কোনো অনুশোচনাও নেই তার জন্যে আমার। এটাও জানি আমি লোকে আমার নিন্দে করতে পারে এই কথাগুলো বলার জন্যে, কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে এতোকাল পরে খুব যে কেউ মাথা ঘামাবে তা মনে হয় না আমার-বিশেষ করে এই কারণে যে আমার সাক্ষ্য ছাড়াই ক্যারোলিন ক্রেল সাজা পেয়েছিলেন।
ঘটনাটা এবার বলি–তাড়াতাড়ি কামান বাগানে ফিরে এলাম মিঃ মেরিডিথ ব্লেককে বলে। কোনো শব্দ হয়নি কারণ বালিতে হাঁটার জুতো পায়ে ছিলো বলে। আমি দেখলাম মিসেস ক্রেল নিজের রুমাল দিয়ে বিয়ারের বোতলের গাটা মুছলেন তাড়াতাড়ি, তারপর বোতলের গায়ে স্বামীর হাতটা নিয়ে আঙুলের ছাপ লাগিয়ে দিলেন। উনি সতর্ক ভাবে এটা করার সময় কান খাড়া রেখেছিলেন আর তাকাচ্ছিলেন চারপাশে, ভয়ের ভাবটা ফুটে উঠেছিলো মুখে।
তখনই বুঝে ফেলেছিলাম আমি তার স্বামীকে মিসেস ক্রেল বিষ দিয়েছেন। তাকে আমি এর জন্য দোষ দেবো না। কেননা মিঃ ক্রেল-সহ্য শক্তির চরম সীমায় মিসেস ক্রেলকে ঠেলে দিয়েছিলেন।
ক্যারোলিন ক্রেলের মেয়ের উচিত নয় নিজের জীবন মিথ্যের ওপর গড়ে তোলা। তার যত কষ্টই হোক না কেন সত্যটা জেনে, এটা উচিত জানা।
মেয়েটিকে আমার তরফ থেকে বলবেন, ও যেন মার বিচার না করতে বসে। সহ্য শক্তির ওপর প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়েছিলো একজন স্নেহশীলা মহিলার। মেয়ে যেন সে কথা বুঝে ক্ষমা করে মাকে।
সমাপ্তি সিসিলিয়া উইলিয়ামসের বিবৃতি :
.
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের বিবৃতি
প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
সেই দুঃসহ যন্ত্রণার ষোল বছর আগেকার দিনগুলোর যতোটুকু মনে পড়ছে তাই পাঠাচ্ছি। লিখে আপনাকে, পালন করেছি প্রতিশ্রুতি। আমি লেখাটা শুরু করার পর বুঝতে পারলাম কতো সামান্য অংশ মনে আছে আমার।
আমার স্মৃতিতে সেই গ্রীষ্মকালের স্মৃতি খুবই অস্পষ্ট হয়ে আছে–সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোও, বিনা মেঘে বজ্রপাত যেন জামাইবাবুর মৃত্যু। তখন কি ঘটছে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
এবং ভাবছিলাম মনে রাখতে না পারাটা যুক্তিসঙ্গত কি না। আমারই মতো অন্ধ আর কার্লা হয় কি বছর পনেরোর কিশোরীরা, হয়তো হয়, চঞ্চলা মেয়ের মত ঐ বয়েসে আমি শুধু লক্ষ্য করতাম অন্যের মেজাজগুলোই, কিন্তু বোঝবার চেষ্টা করতাম না তার পেছনের কারণগুলো।
তাছাড়া সেই সময় ঠিক শব্দের মাদকতা আমি আবিষ্কার করতে শুরু করেছি। যা পড়তাম, কবিতা শেক্সপীয়ার…সবকিছু ঘুরপাক খেতো মাথার মধ্যে। কতদিন বাগানে মনে আছে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আবৃত্তি করেছি আপন মনে ঘন সবুজের দোলায় দোলায়…।
আর একটা নেশা এর সঙ্গে ধরেছিলো, সাঁতার কাটা, ফল খাওয়া গাছে উঠে। ঘোড়াদের ধাওয়ানো আর পেছনে লাগা আস্তাবলের বাচ্চা চাকরদের।