মিঃ ক্রেলও অল্পদিন পরে গেলেন এবং উনি মেয়েটির সন্ধানেই গেছেন আমি জানতাম। আমার যত দুঃখ মিসেস ক্রেলের জন্যে হয়েছিলো, ঠিক ততোটাই ওঁর স্বামীর ওপর রাগ হয়েছিলো। সুন্দর, ভদ্র, বুদ্ধিমতী স্ত্রী থাকতে মিঃ ক্রেলের ঐ রকম খারাপ ব্যবহার করার কোনো অধিকার ছিলো না।
আশা করছিলাম আমি আর মিসেস ক্রেল দুজনেই তাড়াতাড়ি শেষ হোক ব্যাপারটা। আলোচনা আমাদের মধ্যে না হলেও দুজনের মনের কথা দুজনে বুঝতাম।
কয়েক সপ্তাহ পরে দুর্ভাগ্যবশতঃ ফিরে এলে দুজনেই এবং আবার শুরু হলে ছবি আঁকার কাজ।
মিঃ ক্রেল এবারে ছবিটা শেষ করার জন্যে পাগলের মতো উঠে পড়ে লাগলেন। তার আকর্ষণ যেন মেয়েটার তুলনায় ছবির প্রতিই বেশি দেখা যাচ্ছিল, তবে স্বাভাবিক ঘটনা যে এটা নয় তা বুঝতে পারছিলাম। ওঁকে মুঠোয় পুরে ফেলেছে মেয়েটা এবং উনি ছাড়বার পাত্রী নন। যেন মিঃ ক্রেল ওঁর হাতের ময়লা শুধু।
ঘটনা চরমে উঠলো উনি মারা যাবার আগে অর্থাৎ ১৭ই সেপ্টেম্বর।
মিস এলসার উদ্ধত ব্যবহার শেষের কদিন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিলো। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিজের ব্যাপারে এসে যাওয়াতে নিজেকে সব ব্যাপারেই বেশ জাহির করতে উনি শুরু করেছিলেন। খাঁটি আভিজাত্যের মতো ব্যবহার ছিলো মিসেস ক্রেলের। শান্ত নম্র বরফের মতো, তবে নিজের মনের ভাবটা এলসা সম্বন্ধে যেমন করে তোক বুঝিয়ে দিতে ছাড়তেন না স্পষ্ট ভাবে।
ঐ ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে, আমরা সবাই লাঞ্চের পর ড্রইংরুমে বসে আছি, তখন মিস গ্ৰীয়ার হঠাৎ বলে উঠলেন অ্যাল্ডারবেরিতে যখন উনি পাকাপাকি ভাবে শুরু করবেন থাকতে তখন কী ভাবে সাজাবেন ঘরটাকে।
এবং এ কথা স্বাভাবিক ভাবেই সহ্য করে নেবার মতো মহিলা নন মিসেস ক্রেল। চ্যালেঞ্জ করতেই উনি নির্লজ্জের মতো মিস এলসা আমাদের সকলের সামনে বললেন যে উনি শিগগীরই মিঃ ক্রেলকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। স্ত্রীর মুখের ওপর বলা হচ্ছে অন্য একজন তার স্বামীকে বিয়ে করবে। আমি খুব চটে ছিলাম মিঃ ক্রেলের ওপর। আর একজন মহিলাকে দিয়ে নিজেই ড্রইংরুমে বসে নিজের স্ত্রীকে অপমান কেন উনি করাচ্ছেন? পালিয়ে গিয়ে চুপচাপ বিয়ে করলেই পারতেন।
যাই ভেবে থাকুন না কেন মনে মুখে মিসেস ক্রেল ভদ্রতা বজায় রেখেছিলেন। সেই সময়ে ঠিক ওখানে ওঁর স্বামী এলেন এবং মিসেস ক্রেল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে বসলেন এলসার কথা ঠিক কিনা।
মিঃ ক্রেল স্বাভাবিক ভাবেই জোর করে এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্যে চটে গেলেন। এবং পুরুষেরা বড় অহংকারী হয়ে ওঠে অসুবিধের মধ্যে পড়লে।
সিংহের মতো মানুষটিকে তখন অসহায় লাগছিল ভেড়ার মতো। উনি বিড়বিড় করে জেরার মুখে স্বীকার করলেন কথাটি এলসার ঠিক। তবে কথাটি তাকে এখুনি জানানোর দরকার ছিলো না।
মিসেস ক্রেল নিদারুণ অবজ্ঞা দেখিয়ে ঘর থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেলেন। একে সুন্দরী মহিলা, তায় অহংকার, ওকে সব মিলিয়ে সম্রাজ্ঞীর মতো লাগছিলো।
এভাবে এই মহৎ প্রাণ মহিলাকে অসম্মানিত করার জন্যে অ্যামিয়াস ক্রেলের শাস্তি হোক আমি মনে প্রাণে এটা চাইছিলাম।
সেই প্রথম মিসেস ক্রেলকে আমার মনের কথা বলতে যাচ্ছিলাম। আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন, স্বাভাবিক ভাবেই যথাসম্ভব আমাদের থাকা কর্তব্য। মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি আমরা সকলে যাচ্ছি চায়ের নিমন্ত্রণ রাখতে।
আমি বলেছিলাম তখন, আমার কাছে মিসেস ক্রেল, আপনি এক অসাধারণ মহিলা।
উনি বলেছিলেন, জানো না তুমি…।
চলে যেতে যেতে আমাকে ফিরে এসে চুমু খেয়ে বললেন, আমার জীবনের বড় সান্ত্বনা তুমি।
তারপর নিজের ঘরে গিয়ে উনি কেঁদেছিলেন বোধ হয়। ওঁকে একেবারে দেখলাম চায়ের নিমন্ত্রণ রাখার জন্যে, সবাই যখন বেরোচ্ছি তখন। উনি বিরাট ফাঁদওলা একটা টুপি পরেছিলেন, তাই ছায়া পড়েছিলো চোখেমুখে। ওই টুপিটা তিনি সচরাচর পরতেন না।
নিজের অস্বাচ্ছন্দ্য ভাবটা মিঃ ক্রেল কাটবার জন্যে চেষ্টা করেছিলেন সব জিনিস হালকা করার। মনে হচ্ছিল মিস এলসা গ্ৰীয়ারকে বিড়াল যেন নাগালের মধ্যে পেয়ে গেছে দুধের বাটি।
সন্ধ্যা ছ’টার সময় ফিরে এলো। রাতে খাবার টেবিলে মিসেস ক্রেলকে দেখলাম। খুব শান্ত, গম্ভীর। খেয়ে তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলেন।
অ্যামিয়াস ক্রে আর অ্যাঞ্জেলা ঝগড়া করে কাটিয়ে দিলেন সন্ধ্যে বেলাটা। জটিলতা দেখা গেলো সেই স্কুলে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে। হয়ে গেছে সব কেনাকাটা, এখন বেঁকে বসেছে অ্যাঞ্জেলা, যাবে না। মনে হয় ও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলো দিদির ব্যাপারটা নিয়ে। শেষে মিঃ ক্রেলকে লক্ষ্য করে একটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে বেরিয়ে গেলো রাগে কাঁপতে কাঁপতে অ্যাঞ্জেলা।
ওকে গিয়ে ধমকাই আমি বাচ্চা মেয়ের মতো ব্যবহার করার জন্যে, অথচ বাগ মানানো যাচ্ছে না ওকে দেখে আমি কিছু না বলে ফিরে এলাম।
ঘরে যাবার ইচ্ছেটা মিসেস ক্রেলের দমন করলাম। মাঝে মাঝে মনের কথা বলার জন্যেও মানুষের তে দরকার হয়। মিঃ ক্রেলের সঙ্গে দেখা নিজের ঘরে যাবার সময়। উনি জানালেন শুভরাত্রি, আমি উত্তর দিলাম না।
ভারী সুন্দর ছিল পরদিন সকালটা, সবারই মন এমনদিনে প্রসন্নতায় ভরা থাকে। অ্যাঞ্জেলার ঘরে সকালবেলাতেই গেলাম, দেখি মেঝেতে পড়ে আছে ছেঁড়া স্কার্টটা, ও নেই। ঠিক করে রাখলাম ওকে দিয়ে সেলাই করাতে হবে।