আমিই শেষ কালে ভেঙে পড়লাম। ক্যারোলিনরা পরের শরৎকালে বেড়াতে যাবে কোথায় দুজনে আমাকে এসব কথা শোনাচ্ছিলো কায়দা করে, রাগ আমি আর সামলাতে পারিনি। মুখের ওপর আসল কথাটা বলে দিয়েছিলাম। না ভুল করিনি, মনে হয় আজও ঠিক করেছিলাম। তবে নিশ্চয়ই বলতাম না ভবিষ্যতের কথা জানলে।
সংঘর্ষ বাঁধলো এর ফলে, আমার ওপর অ্যামিয়াস চটে লাল হলেও আমার কথাটা স্বীকার করলো ঠিক।
ক্যারোলিনকে ঠিক আমি বুঝতে পারিনি। সবাই মিলে আমরা মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি গিয়েছিলাম, হেসে, কথা বলে ক্যারোলিন দারুণ অভিনয় চালিয়ে গেলো। আমি বোকার মতো ভেবেছিলাম ব্যাপারটাকে বোধ হয় মেনে নিচ্ছে ও ভালো মনে। ছাড়তেও পারছিলাম না বাড়িটা, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে অ্যামিয়াসের ভেবেছিলাম নিজের থেকেই চলে যাবে ক্যারোলিন।
আমি ওকে কোনাইন নিতে দেখিনি। সত্যি কথাটা আমি স্বীকার করতে চাই, ওর কথাটাই ঠিক আমার ধারণা, বিষ চুরি করে থাকতে পারে ও আত্মহত্যা করার জন্যেই। তবে ও বড় ঈর্ষা পরায়ণ মেয়ে মানুষ, গ্রাস করে নিতে চায় সব কিছু। ওর নিজস্ব সম্পত্তি ছিলো আমিয়াস। মনে হয় আমার অন্য কোনো মেয়ের হাতে স্বামীকে ছেড়ে দেবার বদলে ও মেরে ফেলতে তৈরি ছিলো তাকে। আর যখন খোলাখুলি ভাবে কোনাইনের কথা মেরিডিথ বলছিলেন ও তখনই মনে মনে প্ল্যান এঁটে নেয় খুন করার। ভীষণ নিষ্ঠুর ক্যারোলিন, প্রতিহিংসাপরায়ণ মেয়ে মানুষ। ওকে ঠিকই চিনেছিলো অ্যামিয়াস। আমি পারিনি চিনতে।
পরদিন ক্যারোলিনের সঙ্গে লেগে গেলো অ্যামিয়াসের। বাইরে চত্বরে বসে আমি শুনেছিলাম ওদের কথা। মেজাজ দারুণ ঠান্ডা রেখে অ্যামিয়াস বোঝাচ্ছিলো, যা করার করবে বৌ আর মেয়ের কথা খেয়াল রেখেই। ক্ষেপে গিয়ে শেষের দিকে বলেছিলো–জেনে রাখো তবে আমি বিয়ে করবোই এলসাকে। পরস্পরকে ছেড়ে স্বাধীনতা তো বরাবরই আমাদের দুজনের ছিলো। মানুষের জীবনে এরকম তো ঘটেই থাকে।
খুব শান্তভাবে ক্যারোলিন বলেছিলো, যা খুশি করো তোমার, তবে তোমায় সাবধান করে দিলাম আমি।
ক্যারোলিন এর মানে কি? প্রশ্ন করেছিলো অ্যামিয়াস।…
উত্তর হয়েছিলো, আমার তুমি এবং তোমাকে খুন করবো আমি…।
ঠিক সেই সময়ে চত্বরে ফিলিপ ব্লেক আসতে আমি ওঁর কাছে উঠে চলে গেলাম, ওদের ঝগড়া ব্লেক শুনুক তা চাইছিলাম না।
অ্যামিয়াস একটু পরে বেরিয়ে এল। শেষ করতে চায় ছবিটা, তাই কামান বাগানে গেলো আমাকে নিয়ে। পথে বললো ভীষণ বাড়াবাড়ি করছে ক্যারোলিন, তবে যেন কোনো কথাবার্তা না হয় এ নিয়ে। আর একটা দিন লাগবে ছবিটি শেষ করতে।
ও বলেছিলো, আমার সবার সেরা কাজ হবে এটাই। এর জন্যে যদিও প্রচুর মূল্য দিতে হচ্ছে।
আমি একটু পরে বাড়ির মধ্যে গিয়েছিলাম সোয়েটার আনতে, ঠান্ডা লাগছিলো একটু। ফিরে দেখি ক্যারোলিন, হয়তো জানাতে এসেছিলো শেষ কাকুতি-মিনতি। ওখানে ফিলিপ আর মেরিডিথ ব্লেকও ছিলেন।
অ্যামিয়াস ঠিক তখনই খুব ঠান্ডা বিয়ার চেয়েছিলো। খুব স্বাভাবিক সুরে ক্যারোলিন বলে ছিলো পাঠিয়ে দিচ্ছে বরফ দেওয়া বিয়ার। কী অসাধারণ ও অভিনেত্রী ছিলো। কারণ ও নিশ্চয়ই ততক্ষণে কী করবে ঠিক করে ফেলেছিলো।
ক্যারোলিন দশ মিনিট পরে অ্যামিয়াসের সামনে বিয়ার এনে গ্লাসে ঢেলে রাখলো। দুজনেই আমরা তখন কাজে ব্যস্ত নিজের। নজর দিইনি ওর দিকে।
বিয়ার গলায় ঢাললো এক ঢোকে, অ্যামিয়াস বিয়ার খেতো ঐ ভাবেই। মুখ বিকৃত করে বললো, বিশ্রী লাগলো ভীষণ, তবে খুব ঠান্ডা।
আমার সন্দেহ তখনও হয়নি, শুধু হেসে আমি বলেছিলাম, লিভার।
ক্যারোলিন, অ্যামিয়াসকে বিয়ার খেতে দেখে চলে গেলো।
অ্যামিয়াস ব্যথা আর শরীর শক্ত হয়ে ওঠার কথা প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে বললো। বোধহয় ওর বাত হয়েছে পেশীতে, ওর মনে হয়েছিলো এটাই। একেবারে সহ্য করতে পারতো না অসুখ বিসুখ। তারপর বললো হালকা সুরে, বয়স হয়ে যাচ্ছে তো। এলসা শেষ পর্যন্ত একটা প্যানপেনে বুড়োকে পছন্দ করলে। ওর সুরে আমি সুর মেলালাম। কিন্তু লক্ষ্য করলাম পা-টা ওর শক্ত হয়ে উঠেছে, মুখও বিকৃত করলো দু-একবার। তবে ভাবিনি স্বপ্নেও অন্য কিছু বাত ছাড়া হতে পারে। ও বেঞ্চটা টেনে শুয়ে পড়লো হাত-পা ছড়িয়ে, ও প্রায়ই এরকম করতো ছবি আঁকতে আঁকতে। তাই ওটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগেনি।
দুজনেই লাঞ্চের ঘণ্টার শব্দ শুনেছিলাম, কিছু খাবে না ও বললো। আশ্চর্য হইনি তাতেও, বোধ হয় ও চাইছিলো না ক্যারোলিনের মুখোমুখি হতে।
কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে যেন কেমন করে বের হচ্ছিলো, ও রকম ভাবে ও কথা বলতে মেজাজ বিগড়ে থাকলে।
আমরা খেতে চলে গেলাম ওকে একলা ওখানে রেখে। আমার তেমন অসুখ বিসুখের সঙ্গে পরিচয় নেই। অ্যামিয়াস ভেবেছিলাম শিল্পীর খেয়ালে আছে। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতাম, অসুস্থ ও…বুঝতে পারতাম যদি…তাহলে ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম ডাক্তার এনে…হায় ভগবান…কেন যে করিনি…এখন অবশ্য চিন্তা করাও বৃথা। বোকা হাঁদা একেবারে আমি অন্ধ।
আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই।
খাওয়ার পরে ক্যারোলিন আর গভর্নেসটা নীচে নেমে গিয়েছিলো। মেরিডিথ যান তারপর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন উনি দৌড়ে। জানালেন যে মারা গেছে অ্যামিয়াস।
বুঝতে পেরেছিলাম তখনই। বুঝতে পেরেছিলাম মানে ক্যারোলিনেরই যে কাজ ওটা তা বুঝে ফেলেছিলাম। অবশ্য বিষের কথা তখনও মনে হয়নি আমার। ভেবেছিলাম আমি ক্যারোলিন হয় নীচে গিয়ে গুলি করেছে অথবা খুন করেছে ছুরি মেরে অ্যামিয়াসকে।