কামান বাগানে তখন ছিলাম আমরা। বেশ গরম ছিলো দিনটা, চারদিক সূর্যের আলোয় ভরা, গুন গুন করে বেড়াচ্ছিলো পাখি আর মৌমাছি। সুখের আর শান্তির হওয়ার উচিত ছিলো পরিবেশটা। কিন্তু তার উল্টো বাস্তব ক্ষেত্রে দুঃখে ভরা বড়। বেশি…যেন…যেন…প্রতিফলন ভবিষ্যতের ছবিটার সেদিনই গিয়েছিলো দেখা।
জানতাম আমি লন্ডনে ফিরে কোনো লাভ আমার হবে না। তবুও বললাম, ঠিক আছে, আমি ফিরে যাবো তুমি বলছো বলেই।
গিয়েছিলাম ফিরেও, কিন্তু চিঠি দিইনি ওকে। ও নিজেই দশদিন পরে চলে এলো, এ্যাতো রোগা ক্লান্ত আর বিপর্যস্ত ওকে লাগছিলো যে কষ্ট হলো আমার।
ও বললো, এলসা তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। তুমি ওকথা বলতে পারবে না যে, সাবধান করে দিইনি।
আমি বলেছিলাম, আমি তোমারই অপেক্ষায় আছি। তুমি আসবেই জানতাম।
এক ধরনের চাপা গোঙানির শব্দ ওর মুখ দিয়ে ভেসে এলো, কয়েকটা এমন জিনিস আছে যা শক্তিশালী মানুষের চেয়েও খেতে পারছি না আমি, পারছি না ঘুমোতে, তোমার অভাবে পারছি না কিছু করতে।
জানিয়েছিলাম আমি এরকম যে হবে আমি সেটা জানতাম। একই দশা আমারও। এবং আমি ডুবেছি প্রথম দিন থেকেই। নিয়তি ওটাই, কোনো মানে হয় না এর বিরুদ্ধে লড়াই করার।
অ্যামিয়াস বলেছিলো, তেমন কোনো লড়াই তোমাকে করতে হয়নি, এলসা তাই না।
ওসব করার কিছু চেষ্টা আমি করিনি।
ও বলেছিলো আমার বয়স কেন এতো কম, আমি বলেছিলাম তাতে আসে যায় না কিছু। বলতে পারি আমরা খুব সুখে ছিলাম তার পরের কয়েকটা সপ্তাহ। তবে সব বলা যাচ্ছে না সুখ কথাটায়, আরও গভীর তার চেয়েও, আর ভয়ানক কিছু।
পরস্পরের জন্যেই যেন আমরা জন্মেছিলাম, এবং এতোদিন পরে খুঁজে পেয়েছি দুজনে দুজনকে, আর চিরকাল দুজনকে, জানতাম একসঙ্গেই থাকতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে ঘটলো অন্য ঘটনা। মন থেকে দূর করতে পারছিলো না অসমাপ্ত ছবিটার কথা অ্যামিয়াস। ও একদিন আমাকে বললো, মজার ব্যাপার কি কখনই তোমার ছবি আগে হলে আঁকতাম না, জোর করে তুমিই জড়িয়েছিলে এ ব্যাপারে আমাকে। এখন কিন্তু এলসা তোমার ছবি আঁকতে চাই। এমনভাবে আমি তোমাকে আঁকবো যাতে আমার শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি হবে ওটাই। ভেতরটা আমার ভীষণ ছটফট করছে, এখুনি সেই কামান বাগানে ইচ্ছে করছে চলে যাই। তুমি বুড়ো চেস্টনাস্ট গাছের তলায় কামানের ওপর বসবে, সেই চির পরিচিত সুনীল সমুদ্র থাকবে পেছনে আর বিচিত্র রঙের দেশী গাছ…আর তুমি…সুতীব্র আনন্দের একটা বেসুরো উচ্ছ্বাসের মতো বসে থাকবে।
ও বলেছিলো, তোমার ছবি ঐ ভাবেই আঁকবো। তবে আমাকে নিয়ে গণ্ডগোল বা বিরক্তি করা চলবে না আঁকার সময়। ছবিটা শেষ হলে সব কথা ক্যারোলিনকে আমিই বলবো, তখন চুকে যাবে সব ঝাট। আমি বলেছিলাম, ক্যারোলিন তোমাকে ডিভোর্স করার ব্যাপারে গণ্ডগোল করবে না তো? মনে তো হয় না। তবে মুস্কিল মেয়ে মানুষদের চেনা, বলেছিলো অ্যামিয়াস।
আমি বলেছিলাম এই ভাবে ক্যারোলিনের মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্যে দুঃখিত আমি, কিন্তু ঘটে তো এই রকমই।
ও বলেছিলো, তুমি কতো সুন্দর আর সমঝদার এলসা। কিন্তু একটুও বুঝতে চায় না ক্যারোলিন, কখনও চেষ্টাও করবে না বোঝবার। আমাকে ও ভালোবাসে।
আমি বলেছিলাম বুঝেছি, তবে অ্যামিয়াসকে ও যদি ভালোবাসে তাহলে স্বামীকে সবদিক দিয়ে সুখী করার চেষ্টা করা ওর উচিত, অন্ততঃ মুক্তি চাইলে স্বামী ওর উচিৎ হবে না তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করা।
ও বলেছিলো, অসাধারণ সুন্দর সুন্দর বাণী দিয়ে ও বলেছিলো আধুনিক সাহিত্যের তো জীবনের সমস্যার সত্যিই সমাধান করা যায় না। প্রতিহিংসা পরায়ণা বড়ই প্রকৃতি, এটা মনে রেখো।
আমি বলেছিলাম, আমরা তো এখন সবাই সভ্য মানুষ। আমিয়াস হেসে উঠেছিলো উত্তরে, সভ্য মানুষ? হায় রে। মনে হয় ক্যারোলিন তো ছুটবে কাটারি নিয়ে তোমাকে মারতে। তুমি কি এটা বোঝো না যে এলসা এতে ও কষ্ট পাবে…কষ্ট পাবে। এলসা তুমি জানো না কাকে কষ্ট পাওয়া বলে?
তখন আমি বলেছিলাম, ওকে তাহলে বোলো না।
ও বলেছিলো, না, ছিন্ন তো করতেই হবে সম্পর্ক, এলসা তোমাকে চাই সম্পূর্ণভাবে। জগতের সকলের সামনে, একান্ত আপন করে।
ধরো যদি বিবাহ বিচ্ছেদে ও রাজী না হয়?
সে ভয় আমি করি না।
তখন আমি বললাম, তাহলে ভয় কি তোমার?
অ্যামিয়াস অস্ফুট স্বরে বলেছিলো, জানি না আমি…অতএব বুঝতে পারছেন মিঃ পোয়ারো, ঠিক চিনেছিলো ও ক্যারোলিনকে, পারিনি আমি।
মজার ব্যাপার হলো সবচেয়ে এই যে একেবারেই কোনো কিছুকে অ্যামিয়াস পরোয়া করছিলো না। ও পছন্দ করতো ক্যারোলিনকে, তাই সততা বা অসৎ হওয়ার প্রশ্নটা নিয়ে ঘামালেন না মাথা। পাগলের মতো সব ভুলে গিয়ে ছবি আঁকতে লাগলো। ওঁর এই তন্ময়তা দেখে পারলাম বুঝতে ও কত বড় শিল্পী। ও চিন্তাই করতো না ছোটখাটো ভালো মন্দর কথা। অথচ অবস্থা আমার সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। ওর মতো তো আর আমি নই। আমার ওপর ক্যারোলিন অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলো।
ওকে সব কথা বলা উচিত ছিলো, কিন্তু ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যামিয়াস ও নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না।
আমি বলেছিলাম, এ ব্যাপারে আমি সৎ থাকতে চাই। ক্ষেপে গিয়ে অ্যামিয়াস বলেছিলো, তোমার সততা গোল্লায় যাক। শেষ করতে দাও আমাকে ছবি। ওর কথা আমি বুঝতে পারলাম, কিন্তু ও বোঝার চেষ্টাই করতো না আমার কথাটা।