হুঙ্কার দিয়ে উঠলো অ্যামিয়াস। এলসার নিশ্চয়ই ওর মতো মাথা ব্যথা নেই, সারা শরীরে ওর বাত হয়েছে। এলসা ব্যঙ্গ করে বললো, আহা! বুড়ো মানুষ বেচারা, অ্যামিয়াস উত্তরে বলেছিলো এই অকর্মণ্য নড়বড়ে লোকটাকেই তো ও ঘাড়ে নিচ্ছে যেচে।
আমার খুব খারাপ লেগেছিলো কথাটা শুনে, তারা হালকাভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎকে মেনে নিচ্ছিলো বটে কিন্তু বেশ কষ্ট যে পাচ্ছে সেটাতে দুজন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অথচ মেয়েটার ওপর বিরূপ হতে পারলাম না আমি। এতো অল্পবয়সী, আত্মবিশ্বাস এতো আর গভীরভাবে প্রেমে এলসা জড়িয়ে পড়েছে। আর কিযে সে করছে ঠিক তাও বুঝতে পারছে না। কাকে কষ্ট বলে তাও ঠিক জানা নেই। বসে আছে সরল বিশ্বাস নিয়ে এই ভেবে যে ক্যারোলিনের ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে আর শিগগীরই কাটিয়ে উঠতে পারবে সে সব বাধা। নিজেকে আর অ্যামিয়াসকে ছাড়া মেয়েটা অন্য কারুর কথা খেয়ালই করেনি। সুখে থাকবে দুজনে মিলে। আমাকে আগেই এলসা বলেছিলো আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা সেকেলে। মনে ওর ছিলো না কোনো সন্দেহ, না ছিলো বিবেকের দংশন-কারুর জন্যে করুণাও ছিলো না। কেউ কি দৃপ্ত যৌবনের কাছ থেকে আশা করতে পারে? বয়োবৃদ্ধদের ধর্ম ওটা। অবশ্য ওরা বেশি কথা বলেনি। কোনো শিল্পীই বকবক করতে চায় না কাজ করার সময়। এলসা দশ মিনিট অন্তর অন্তর একটা না একটা মন্তব্য করেছিলো আর ফুঁসতে ফুঁসতে অ্যামিয়াসও তার উত্তর দিচ্ছিলো। এলসা একবার বললো, যা বললে তুমি স্পেনের ব্যাপারটা সেটাই ঠিক ভেবে দেখলাম। আমরা প্রথমে ওখানেই যাবো। আমাকে তুমি ষাঁড়ের লড়াই দেখাতে নিয়ে যাবে। দারুণ হবে, তাই না। তবে ইচ্ছে আমার মানুষটাকে মারুক ষাঁড়টাই। যখন রোমের মহিলারা মরতে দেখতেন মানুষকে তখন তাদের যে মনোভাব হতো আমি সেটা অনুভব করতে পারি। জানোয়াররা অনেক বেশি সুন্দর মানুষের তুলনায়।
মনে হয় আমার মেয়েটি নিজেই ছিলো পশুর মতো যুবতী এবং আদিম মনোভাবাপন্না। মানুষের দুঃখের অভিজ্ঞতা বা দ্বিধা জড়িত জ্ঞান তার মধ্যে কোনোটিই ছিলো না। এলসা চিন্তা করতে পারে আমার মনে হয় না, শুধু অনুভূতি ছিলো ওর। বড় বেশি প্রাণবন্ত ছিলো তবে, অত প্রাণপ্রাচুর্য আমি আর দেখিনি কারুর মধ্যে।
আমার শেষ দেখা সেই ওকে, প্রাণোচ্ছল এবং আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর–যেন সে বিচরণ করছিলো স্বর্গে।
লাঞ্চ খাবার ঘণ্টা পড়তেই উঠে আমি পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে। আমার সঙ্গে যোগ দিলো কামান বাগানের দরজার কাছে এলসা। গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার পথে চোখ ধাঁধাচ্ছিলো আমার ওখানকার আলোকে। দেখতে পারছিলাম না ভালো। অ্যামিয়াস শুয়ে ছিলো হাত পা ছড়িয়ে। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো ছাদটার দিকে। ওইভাবে আমি অনেকবার ওকে শুয়ে থাকতে দেখেছি। আমি কি করে জানবো যে তখন সেদিন শুরু হয়ে গেছে বিষের ক্রিয়া, হাত-পা ওর শক্ত হয়ে উঠেছে।
আমিয়াস ঘেন্না করতে অসুস্থতাকে। দুর্বলতা দেখাতো না কখনও এবং নিজের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কখনও অভিযোগও করত না।
এলসা বললো, ও আসবে না লাঞ্চ খেতে। আমি মনে মনে অ্যামিয়াসের বুদ্ধির তারিফ করলাম, মুখে বললাম, আসছি তাহলে।
ছবির দিক থেকে চোখ সরিয়েও তাকালো আমার দিকে। সে এক বিচিত্র–বোঝাবো কি ভাবে ফুটে উঠেছিলো পরশ্রীকাতরতার চিহ্ন তার মুখে।
আমি তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। মনের মতো ছবি অনেক সময় না হলে তার মুখের ভাব ঐরকম হিংস্র হয়ে উঠতো। সেরকমই মনে হয়েছিলো এবারও।
তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করিনি আমি বা এলসা–মনে হয়েছিলো শিল্পীর মেজাজ।
অ্যামিয়াসকে ফলে ওখানে একলা ফেলে রেখে হাসতে হাসতে আমি আর এলসা চলে গেলাম বাড়ির দিকে। তখন যদি বেচারী জানতে ও জীবনে আর কোনো দিনও দেখতে পাবে না অ্যামিয়াসকে…ভালোই হয়েছিলো অবশ্য যে জানতো না, আরও কিছুক্ষণ তো ও পেয়েছিলো সুখে থাকতে।
ক্যারোলিন খুব স্বাভাবিক ছিলো খাবার টেবিলে নিজেকে নিয়ে একটু যেন ব্যস্ত ছিলো, আর কিছু না। আর প্রমাণ কি এটাই নয় যে ও ব্যাপারে কোনো হাত ছিলো না ওর? সে তো অতো বড় অভিনেত্রী নয়।
আরও পরে গভর্নেস নীচে নেমে গিয়ে ঐভাবে আবিষ্কার করেছিলো অ্যামিয়াসকে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো মিস উইলিয়ামসের, ডাক্তারকে ফোন করতে উনিই বলেছিলেন।
আর ঐ বেচারী…ঐ এলসার কথা বলছি…বাচ্চার মতো বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলো সে শোকে। বিশ্বাসই করতে পারে না ওদের মতো মেয়েরা যে এই ধরনের ঘটনা জীবনে ঘটতে পারে। খুব শান্ত ছিলো ক্যারোলিন। হ্যাঁ বলতে হবে বেশ শান্তই ছিলো। অন্ততঃ ও নিজেকে এলসার তুলনায় বেশ সংযত রাখতে পেরেছিলো। কোনো অনুশোচনা ছিলো না ওর মধ্যে। শুধু বলেছিলো এটা অ্যামিয়াস নিজেই করেছে। অবশ্য তা আমরা বিশ্বাস করিনি। রাগে এলসা ফেটে পড়ে ক্যারোলিনের মুখের ওপরেই বলেছিলো যে তার দোষটা।
তবে ক্যারোলিনও বুঝতে পারছিলো ততক্ষণে যে তাকে সবাই সন্দেহ করবে।
নিঃসন্দেহ ছিলো তো ফিলিপ কাজটা করেছে ক্যারোলিনই।
তখন বেশ মিস উইলিয়ামস তৎপর হয়ে উঠে সাহায্য করেছিলেন নানাভাবে। জোর করে এলসাকে ঘুমোবার ওষুধ খাওয়ালেন শুইয়ে দিয়ে। অ্যাঞ্জেলাকে সরিয়ে দিলেন পুলিশ আসার আগেই। আর নিজে আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্ব নিয়ে মোকাবিলা করলেন পুরো ব্যাপারটার।